।। দুই।। সূত্রপাত
রীণা মফসসলের মেয়ে।
ওখানকার কলেজ থেকেই বি. এ পাশ করে বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে এম এ পড়ছিল। পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী ডাক্তার। শ্বশুরবাড়ি বহরমপুরে। কিন্তু ডাক্তারিসূত্রে সঞ্জয়কে প্রথমেই আসতে হল কলকাতায়। রীণা খুব খুশি। কলকাতায় সংসার পাতবে এতখানি সৌভাগ্য কল্পনাও করেনি কখনো। তা ছাড়া এখানে তার একটি বান্ধবীও আছে—মান্তু। তার সঙ্গেও দেখা হবে।
কলকাতায় চাকরি পাওয়া যদিও—বা সম্ভব, বাড়ি পাওয়া সহজ নয়। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এই বাড়িটা পাওয়া গেল। পুরোনো বাড়ি। জায়গাটাও গলির মধ্যে। তবুও কলকাতায় সংসার পাতার আনন্দে রীণা খুঁতখুঁত করল না।
তিনতলায় সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একফালি বারান্দা। তিনতলাটা একেবারেই ফাঁকা।
সামনের ঘরটাকে রীণা করে নিল ড্রয়িংরুম। একটা টেবিল, খান—দুই স্টিলের চেয়ার, একটা মোড়া আর একটা ডিভান—এই নিয়েই ড্রয়িংরুম সাজাল। এরই পিছনে আর একখানা ঘর। সেটা হল ওদের বেডরুম। বিছানায় শুয়ে দু—ঘরের মধ্যের খোলা দরজা দিয়ে তাকালে সিঁড়ি পর্যন্ত দেখা যায়।
দরজা—জানলাতে রীণা রঙিন পর্দা লাগাল। টেবিলে পাতল ওরই হাতে তৈরি সুন্দর টেবিল—ক্লথ। ওপরে রাখল পেতলের ফ্লাওয়ার ভাস।
দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথের একখানি ছবি, আর সুদৃশ্য একখানি ক্যালেন্ডার।
রীণা খুব খুশি। সকালে সঞ্জয় বেরিয়ে যায় হাসপাতালে। দুপুরটা কাটে ঘুমিয়ে। বিকেলে সঞ্জয় ফিরলে ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ে।
পিসিমা এসেছিলেন ওদের নতুন সংসার গুছিয়ে দিতে। গোছানো হয়েছে। এবার তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। রীণা ওঁকে আটকে দিল।
—এখুনি যাবেন কী? কালীঘাট দেখলেন না, দক্ষিণেশ্বর দেখলেন না—
ওর আন্তরিকতা অকৃত্রিম। তবু কিছু স্বার্থও আছে। পিসিমা থাকলে পুপুকে রেখে একটু বেরোনো যায়।
প্রথম ক—দিন রীণার কাটল সিনেমা দেখে। একদিন থিয়েটারও দেখল।
তারপরই একদিন ছোটোখাটো একটা অঘটন ঘটল।
সঞ্জয় একদিন বলল, মহাজাতি সদনে দারুণ ম্যাজিক শো হচ্ছে।
রীণা বলল, তুমি যাও। ম্যজিক আমার ভালো লাগে না।
সঞ্জয় অবাক। সে কী! ম্যাজিক ভালো লাগে না!
রীণা বলল, ছোটোবেলায় একবার ম্যাজিকে নররাক্ষসের খেলা দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আর ম্যাজিক দেখি না।
সঞ্জয় হেসে উঠল, ওসব নৃশংস খেলা এখন আর হয় না।
রীণা তবু মাথা নাড়ল, না বাপু, ম্যাজিক দেখে কাজ নেই।
সেদিন আর কথা হল না। তারপর একদিন সঞ্জয় কিছু না বলে দুখানা টিকিট কেটে বাড়ি ঢুকল। রীণা খুশি হল না। তবু যেতে হল।
রবিবার। বেলাবেলি খাওয়া—দাওয়া সেরে পুপুকে পিসিমার কাছে রেখে দুজনে বেরিয়ে পড়ল।
রীণার উৎসাহ একেবারেই ছিল না। তাকে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেমন অন্যমনস্ক। তার তখন ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছিল। সেই অন্ধকার টিনের ছাউনি দেওয়া হলঘর। কালো পর্দা। পর্দা উঠল। স্টেজে মিটমিটে আলো। কালো পোশাক পরা কী ভয়ংকর মানুষটা! চুলগুলো ফাঁপানো, দু—চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো স্টেজের মধ্যে দাপাদাপি করছিল। আর কোমরে দড়ি বেঁধে তিনজন লোক টেনে ধরেছিল।
তারপর রাক্ষসটা যখন জ্যান্ত মুরগিটাকে ধরল—মুরগিটা পাখা ঝাপটাতে লাগল…..মুরগিটা মরণডাক ডেকে উঠল। উঃ! তারপর আর মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।….
সেই ম্যাজিক দেখা, তারপর এই যাচ্ছে। এখন অবশ্য ওইসব ভয়ানক খেলা আর হয় না। তবু ভয় করছে। কীসের যে ভয় রীণা তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
শো আরম্ভ হল। হলভর্তি দর্শক। ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে পায়ে ছন্দ তুলে স্টেজে ঢুকলেন। খেলা শুরু হল।
কী একটা খেলা দেখাবার পর ম্যাজিশিয়ান তাঁর কালো টুপিটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে আবার নিজের হাতে ধরতে গেলেন, ঠিক তখনই রীণা একটা অস্ফুট শব্দ করে সঞ্জয়ের বুকের ওপর ঢলে পড়ল।
অবশ্য বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকেনি। জ্ঞান ফিরতেই সঞ্জয় তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে রীণা চোখে—মুখে জল দিল। একটা কোল্ড ড্রিংক খেল।
—এখন কেমন? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
—ভালো। এবার বাড়ি চলো।
সঞ্জয় একটা ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিতে গা এলিয়ে বসেছিল রীণা। দু—চোখ বন্ধ। সঞ্জয় ওর হাতটা তুলে নিল। হাতটা ঠান্ডা।
—তুমি আচ্ছা ভীতু তো! সঞ্জয় হেসে রীণার দিকে তাকাল।
রীণা উত্তর দিল না।
—কিন্তু কীসে এত ভয় পেলে? কোনো ভয়ের খেলা তো দেখায়নি।
রীণা এবার মাথাটা একটু নাড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল, জানি না।
ট্যাক্সি যখন কম্পাউন্ডে ঢুকল তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। গলিপথটা নির্জন হয়ে গেছে। কম্পাউন্ডেও বুড়োরা কেউ বসে নেই।
আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ। রীণা হঠাৎ চমকে ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়াল।
—কী হল?
—দ্যাখো দ্যাখো গম্বুজটা!
গম্বুজটার ওপর হালকা চাঁদের আলো পড়ে কেমন রহস্যময় লাগছিল। তার চেয়েও রহস্যময়ী লাগছিল রীণাকে। তার মুখটা মনে হচ্ছিল যেন কাগজের তৈরি অন্য একটা মুখ। সে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল গম্বুজটার দিকে।
—কী হল? নামো। সঞ্জয় বলল।
রীণা চমকে উঠল। তারপর সঞ্জয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে নামল।