১-২. রাত্রির অন্তিম প্রহর

দ্য ওয়ে ক্রুকি ক্র্যাম্বলস – জেমস হেডলি চেজ
ভাষান্তর : পৃথ্বীরাজ সেন

০১.

রাত্রির অন্তিম প্রহর এখন শুরুর পথে।

প্যারাডাইস সিটি পুলিশ হেড কোয়ার্টার। নাইট ডিউটিতে তখন ছিলেন জো বেইগলার।

 বয়স প্রায় তিরিশের ওপর, তবে বলিষ্ঠ চেহারা, পুলিশী গাম্ভীর্যের ছাপ মুখে সুস্পষ্ট।

একটা ফাইল সামনে নিয়ে তার ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন বেইগলার, এই সময়ে তার টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা সরব হয়ে উঠল।

ভুরু কুঁচকে দেওয়াল ঘড়িতে একবার চেয়ে দেখলেন। রাত তিনটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট। এই অসময়েও কোথা থেকে কার ডাক এল আবার?

রোমশ হাতে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকিয়ে অপ্রসন্ন কণ্ঠে সাড়া দিলেন : বেইগলার বলছি।

লাইনের ওপাশ থেকে ডেক্স সার্জেন্ট চার্লি ট্যানারের কণ্ঠস্বর ভেসে এল :’মিঃ হ্যারী ব্রাউনিং তোমার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করার প্রয়াসী জো।

নাম শোনামাত্রই বেইগলারের সব বিরক্তি, সব অপ্রসন্নতা কোথায় যেন নিমেষের মধ্যে উবে গেল। যে সে মানুষ নয়, এই শহরের মেয়র আর তাদের বড়কর্তা, মিঃ টেরলের বিশেষ বন্ধু তোক। তাছাড়া প্যারাডইস সিটির সবচেয়ে মূল্যবান আর খানদানী তিন তিনটে রেস্তোরাঁর একজন মালিক রূপে জনমানসে তিনি পরিচিত। তাই হ্যারী ব্রাউনিং এর নাম কানে যেতেই বেইগলারকে যথেষ্ট মাত্রায় সতর্ক এবং ঐ সঙ্গে সচেতনও হতে হলো সতর্কতার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে।

লাইন দাও। চার্লিকে বললেন তিনি আর শোন, কাউকে দিয়ে একপট কফি পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দাও, গলাটা কেমন শুকনো শুকনো ঠেকছে।

-ওকে।

একটু পরেই লাইনে এলেন হ্যারী ব্রাউনিং।

কে? বেইগলার তো? ভারী ভরাট গলায় গাম্ভীর্য কণ্ঠস্বর।–

আজ্ঞে হ্যাঁ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে নাকি।

-না, না, শোন, একটা বিশ্রী ব্যাপারে আমি এমন ভাবে জড়িয়ে গেছি যে বলার নয় হে ভায়া। আমার রেস্তোরাঁয় একজন মহিলার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমি চাই তুমি যতো তাড়াতাড়ি পার এখানে এসে এই গোলমেলে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখে যা কিছু করার তাই কর। তুমি এলে আমিও নিজেকে এই ঝামেলার হাত থেকে মুক্ত করতে পারব। তবে হ্যাঁ, আর একটা কথা কিন্তু স্মরণে রেখো বেইগলার এই ব্যাপার নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ হোক, কাগজে কাগজে ঢি ঢি পড়ে যাক–এ আমি কখনোই চাই না। কারণ এই ব্যাপারটা এতই সাংঘাতিক যে কাগজে এই ঝামেলার সম্বন্ধে প্রকাশ হওয়ামাত্র আমার রেস্তোরাঁর নামটাও ঐ সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। তুমি ব্যাপারটার গভীরতা কিছুটা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছ? এ আমার বাসনা নয়। তুমি এসে তোমার করনীয় কাজগুলো করে নেবে, আমার বলার কিছু থাকতে পারে না। তুমি আসবে, রিপোর্ট নিয়ে নেবে…লাশ তুলে নিয়ে যাবে। ব্যস! এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু এই মুখরোচক খবর যদি কোনভাবে তোমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে বাইরে চলে যায়, তবে কিন্তু কাউকে আমি ছেড়ে কথা বলব না। আই অ্যাম ক্লিয়ার?

বেইগলার বিরস আর শুকনো কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, বুঝেছি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এ খবর আমি থাকতে বাইরে যেতে দেব না।

–লাশ নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আর আমার নির্দেশমতো কাজ না হওয়া পর্যন্ত আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব এ খেয়াল তোমার মাথায় কী করে এল হে?

লাইন কেটে গেল টেলিফোনের।

বেইগলার কয়েক সেকেন্ড বিতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে রইলেন টেলিফোন রিসিভারটার দিকে, তারপর কী ভেবে ক্ৰশবার ঠোকাঠুকি করে ডাকলেন চার্লি ট্যানারকে।

–চার্লি! একবার দেখে নাও তো, তোমার আশেপাশে কোন খবরের কাগজের সাংবাদিক ঘর আলো করে বসে আছে কিনা।

–জাস্ট এ মিনিট, বলে চার্লি থামলেন। একটু পরেই তার কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল : একমাত্র প্যারাডাইস সান-এর বার্ট হ্যাঁমিল্টনই যা উপস্থিত রয়েছে স্বশরীরে। ব্যাটাছেলে এক বোতল বীয়ারে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে বেঁহুশ হয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

— কেন? কী ব্যাপার?

–তা আছে বটে, কোন ব্যাপার। এক্ষুনি একবার আমাকে বেরোতে হবে। নীচে আজ কারা ডিউটিতে আছে বলতে পার?

-হ্যাঁ, মানড্রেক আর জ্যাকসন। মানড্রেক অবশ্য কফির সন্ধানে বাইরে গেছে।

ঠিক আছে, তাহলে জ্যাকসনকেই না হয় পাঠিয়ে দাও আমার কাছে। ও নিজে এসে আমায় রিলিভ করবে। ভালো কথা, হেস্ আছে, না চলে গেছে?

আছে তবে সেই কখন থেকে মার মার করে যাচ্ছে।

–ওকে উঁড়াতে বলল। আমি যাচ্ছি, ও আমার সঙ্গেই বেরোবে।

ফেড হেস–হোমি সাইড ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ। ছোটখাটো ভারিক্কী চেহারার মানুষটি হলে হবে কি যেমনি বুদ্ধি তেমনি চাতুর্যে ভরপুর তার মস্তক।

বেইগলারকে গম্ভীরমুখে চুপচাপ ড্রাইভ করতে দেখে তিনি মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেলেন ব্যাপারটা খুব সুবিধেরও নয় আবার সামান্যও নয়। অনেকটা পথ পেছনে ফেলে আসার পর তিনি মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় কোন উদ্দেশ্যে চলেছি আমরা?

আমাদের গন্তব্যস্থল হল হ্যারী ব্রাউনিং-এর রেস্তোরাঁ—

লা-কোকাইল-এ।

-খুনের ব্যাপার নাকি?

–সঠিক ভাবে এমুহূর্তে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলতেও চাননি, আমিও জানার জন্য আমার কৌতূহল প্রকাশ করিনি। তবে ফোনে কথা বলে মনে হল হ্যারী ব্রাউনিং এর এ ব্যাপারে কথা বলার কোন ইচ্ছা নেই। জানো নিশ্চয়ই, উনি এ শহরের একজন গণ্যমান্য প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী ধনী ব্যক্তি। আমাদের ওপর মহলের বড়কর্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি নিজ মুখে যখন কিছু বললেননা,তখন ভাবলাম ঘটনাস্থলে পৌঁছেই দেখতে পাব–আসলেকীব্যাপার। তাইতো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এলাম।

হেস আর কথা বাড়ালেন না।

পুলিশের কার এসে থামল লা-কোকাইল’ রেস্তোরাঁর দোরগোড়ায়। নানা রঙ-বেরঙের বাহারীফুল আর পামগাছের সেরা টব দিয়ে মোড়া সুসজ্জিত সাজানো চমকপ্রদ ইন্দ্রপুরীর মতো জায়গা। রাত আড়াইটে নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়, লোকজন, গাড়ী আর আলোর অভাবে অনেকটাই সুনসান আর নিষ্প্রভ।

এঁদের অভ্যর্থনার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য লবিতেই অপেক্ষা করে বসেছিল ফ্লোর ম্যানেজার স্বয়ং লুই। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ আর অভিজাত চেহারা। মুখ ভাবলেশহীন, নিরুত্তাপ কিন্তু তার চক্ষু জোড়া সর্বদাই সজাগ।

লুই এঁদের সঙ্গে করে নিয়ে এল মনিবের কাছে। রেস্তোরাঁর দোতলায় বার কাউন্টারের ধারে একটা টুলের ওপর চুপচাপ বসেছিলেন তিনি। হাতে ধরা ব্রান্ডির গ্লাস, মুখে জ্বলন্ত ধূমায়িত সিগার। ভারিক্কী চেহারা, বয়সে প্রবীন বছর পঞ্চান্ন হবে প্রায়, মাথা ভরা টাক। পরনে মহার্ঘ পরিচ্ছদ, বাটনহোলে একটা সাদা ধবধবে কার্নেশান ফুল গোঁজা। ভদ্রলোককে দেখলেই মনে হয় ঐশ্বর্য, শক্তি, দম্ভ আর নিষ্ঠুরতার সাক্ষাৎ জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি।

সৌজন্য বিনিময়ের পর বেইগলার তৎপর হয়ে উঠলেন তাঁর কাজের ব্যাপারে। মহিলার লাশ কোথায়–বেইগলার জানার আগ্রহ প্রকাশ করলে মিঃ ব্রাউনিং প্রতুত্তরে কোন জবাব না দিয়ে শুধু চোখ তুলে তাকানে লুই-এর দিকে। লুই কোন কথা না বলে মাথা নেড়ে বলল, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।

লুইকে অনুসরণ করতে করতে তারা এসে পৌঁছে গেলেন সেই হলঘরের শেষের একটা ঘরের সামনে। দরজা বন্ধ কিনা বাইরে থেকে তা ঠিক বোঝা গেল না সামনে লাল ভেলভেটের একটা ঝুলন্ত পর্দা থাকায়।

বেইগলার আর হেকে দাঁড় করিয়ে লুই সেই পর্দাটা এক হাতে তুলে ধরল একপাশে।

অন্ধকার ঘর, বাইরের আলো ঘরে যেটুকু আলো ছড়াল তা পর্দা তোলার দরুণ। এরপর যে দৃশ্য তাদের সামনে ধরা দিল তা এক মহিলার, স্বর্ণকেশিনী এক সুন্দরী মহিলার দেহ সামনের টেবিলে অর্ধশায়িত অবস্থায় পড়ে আছে। পরনে সাদা ব্যাকলেস সান্ধ্য পোশাক। পাশেই একটা লেডিজ হ্যান্ড ব্যাগ।

বেইগলার লুইকে বলে উঠলেন, এখানে আরো একটু জোরাল আলোর ব্যবস্থা করা যায় না?

মিঃ ব্রাউনিংও এসেছিলেন ওদের অনুসরণ করেই। তিনি নির্দেশ দেওয়ামাত্রই লুই সেই ঘরে প্রবেশ করে সুইচ টিপে সবগুলো আলো জ্বেলে দিল এক এক করে। সারা ঘর এখন আলোয় ঝম করছে।

মহিলার অচৈতন্য দেহ দেখে খুব ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল যে দেহে আর প্রাণের স্পন্দন নেই, তবু পুলিশী কেতা অনুযায়ী বেইগলার এগিয়ে গিয়ে প্রাণহীন দেহটা একবার পরীক্ষা করে দেখলেন।

হেসে বলে উঠলেন, লাশটার কোন ব্যবস্থা করার আগে এর কতগুলো ছবি নেওয়া দরকার।

হেসের কথায় বোমার মত ফেটে পড়লেন মিঃ ব্রাউনিং–যা কিছু করণীয় তা মর্গে নিয়ে গিয়ে কর, এখানে ওসব ছেলেখেলা আমি কখনই বরদাস্ত করব না। কারণ আমার সময়ের যথেষ্ট দাম আছে।

বেইগলার! তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে লাশ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। তোমাদের এই ছেলেমানুষি কর্মকাণ্ডের ফলে আমার এই ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসায় যদি বদনামের কোন আঁচড় লাগে তবে তোমাদের কাউকে ছেড়ে কথা বলার পাত্র আমি নই, তা স্মরণে রেখ। নাউ গেট আর আউট অফ হিয়ার, বয়েজ!

একেবারেই অসম্ভব! লাশের ছবি না তোলা পর্যন্ত লাশকে নড়ানো এক কথায় বে-আইনী।

হে দৃঢ় কণ্ঠে আরো বললেন, কে বলতে পারে এটা কোন খুনজনিত ব্যাপার নয়?

জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে মিঃ ব্রাউনিং তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে হে বাপু তুমি? আমার সামনে এই অযৌক্তিক আইনের বুলি আওড়াচ্ছ?

বন্ধুর এই সমূহ বিপদের আশঙ্কা করে বেইগলার আর চুপ থেকে এই তামাসা দেখতে চাইল না। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পরিস্থিতি কিছুটা হালকা করার জন্য বলল, ওঁর নাম ফ্রেড হেস…উনি হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ। হেস যা বলেছে তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার। ধারণা ঠিকও হতে পারে স্যার, এটা একটা খুনের মামলাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে…

ব্রাউনিং তার গ্রানাইট পাথুরে গড়ামুখের ওপর একটা দৃঢ়তার আবরণ টেনেততোধিক দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলেন, এই ব্যাপারটা দেখে কখনই মনে হচ্ছে না এটা কোন খুনের মামলা। খুবই সাদাসিধে সাধারণ আত্মহত্যার রহস্য। পূর্ণবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, দিস ইজ সুসাইড! ঐ দেখ টেবিলের তলায় এখনও পড়ে আছে একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ সঁচসমেত, আর মেয়েটার মুখের আকৃতি একবার ভালো করে লক্ষ্য করে দেখ–পূর্বের মুখশ্রীর প্রকৃত রঙ এখন বিবর্ণ হয়ে নীল রঙে রূপান্তরিত হয়েছে। ওভারডোজ হেরোইনই ওর মৃত্যু ডেকে এনেছে।

মেয়েটি নেশা করত একথা এই দৃশ্য দেখার পর সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবে। এই সাধারণ ব্যাপারটাকে কেন যে তোমরা এতো গুরুত্ব দিচ্ছ কে জানে। সহজ সাধারণ একটা আত্মহত্যার রহস্য তোমাদের মগজে ঢুকছেনা কেন?মাথামোটা কেমন ধরণের পুলিশ হে তোমরা? এই মগজ নিয়ে তোমাদের আবার এতো মাথা ব্যথা। নাউ গেট আর আউট অফ হিয়ার।

ব্রাউনিং-এর কথামতো বেইগলার আবিষ্কার করলেন হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ নিডিল সমেত টেবিলের তলা থেকে। মৃতার মুখের অস্বাভাবিক নীলচে ভাব তার দৃষ্টিকেও আকর্ষণ করল। তিনি নিখুঁত ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল ব্রাউনিং এর অনুমান মিথ্যে নয়।

তবু

ঘুরে দাঁড়িয়ে বেইগলার শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনি যা বললেন তা পুরোপুরি সত্যিও যেমন নয় তেমনি মিথ্যা বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। মৃতদেহ দেখে আত্মহত্যাও মনে হতে পারে আবার খুনও হতে পারে। কারণ এমনও হতে পারে কেউ ওঁকে জোর করে হয়তো ওভার ডোজ হেরোইন ইনজেক্ট করে তাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছে।

–কে আবার মেরে ফেলবে? মেয়েটি একাই এখানে এসেছিল আর সারাক্ষণ ধরে সে এই ঘরে একাকীই ছিল। অধীর কণ্ঠে এই কথা বলে ফেললো মিঃ ব্রাউনিং। অনেক হয়েছে, এবার তোমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ এখান থেকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা কর। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। দিনের আলো ফোঁটার অপেক্ষায়। আমি আর অযথা সময় ব্যয় করতে চাই না। তোমাদের সঙ্গে অযথা তর্কে জড়িয়ে পড়ার কোন হীনতম প্রবৃত্তি আমার নেই।

–না স্যার, তা হয় না। যতক্ষণনা আত্মহত্যার ঠিক ঠিক প্রমাণ আমাদের হাতে এসে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ এখান থেকে লাশ সরাবার কোন ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। আইনের চোখে এটা গুরুতর অপরাধ। ওপর ওয়ালার কাছে যখন ডাক পড়বে তখন আমরা কী জবাবদিহি করব তা আপনি বলতে পারেন? আপনি একবার বোঝার চেষ্টা করুন ব্যাপারটা। বেইগলার শান্তকণ্ঠে বোঝাবার শেষ চেষ্টা করলেন।

ব্রাউনিং-এর দুই চোখ রাগে ধিকিধিকি করে জ্বলছে। উত্তপ্ত কণ্ঠে তিনি যে কড়াকড়া বুলি আওড়ালেন তা হল, তোমাদের মতো এমন অবাধ্য আর নির্বোধ পুলিশ অফিসারের আমার কোন প্রয়োজন নেই। তোমরা এখান থেকে বিদায় নিতে পার।লুই!পুলিশ-চীফ ক্যাপ্টেন টেরলকে ফোন করে একবার ডেকে পাঠাও। এ বিষয়ে তার সঙ্গেই সরাসরি যা বলার আমি তাকেই বলতে চাই।

লুই তাড়াতাড়ি চলে গেলে বেইগলার ব্রাউনিং-এর উদ্দেশ্যে বললেন, আপনি অনর্থক আমাদের ওপর চটে যাচ্ছেন স্যার। পুলিশী তদন্তের এটা অন্যতম রীতি। অবশ্য স্বয়ং চীফ যদি বন্ধুত্বের খাতিরে অন্য কিছু নির্দেশ প্রদান করেন, সেকথা আলাদা। আচ্ছা, এখানে আর কোন ফোন আছে নাকি? একবার ব্যবহার করতাম তাহলে।

তোমাদের চীফের সঙ্গে আমার কথোপকথন না হওয়া পর্যন্ত তুমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারবে না, বুঝেছ? এটা আমার হুকুম বা নির্দেশ যা তুমি মনে কর তা করতে পার। কথা, শেষ হলে রাগে গর্জন করতে করতে তিনি এগিয়ে চললেন বার কাউন্টারের দিকে। বেচারি বেইগলার,কী আর করেন?বন্ধু, সহকর্মী হেস্ত্রে দিকে তাকালেন নিরুপায়ের দৃষ্টি নিয়ে, তারপর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মনঃসংযোগ করলেন মৃত মহিলার নিঃসাড় অসাড় দেহে। সামান্য পরীক্ষার পর সহজে যে ব্যাপারটা মনকে বেশী উতলা করল তাহল মিঃ ব্রাউনিং-এর অনুমান অমূলক নাও হতে পারে। কারণ, মহিলার দু-হাতেই সঁচে বিধ্বস্ত করা অজস্র দাগ। অর্থাৎ মহিলা ড্রাগ-অ্যাডিক্ট।

মহিলার পাশেই পড়েছিল তার সাদা ও সোনালী ব্রাকেডের সান্ধ্যকালীন ব্যাগ। সেটা তুলে নিয়ে খুলে একবার চোখ বোলালেন হে। প্রসাধন সামগ্রীর সঙ্গে একটা খাম নজরে এল তার। মুখ খোলা। হে খামের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে একটা চিরকূট এনে বার করে সন্তর্পণে। পড়েও ফেললেন এক নিমেষে। তারপর বেইগলারের দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, চিঠিটা আমাদের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছে। একবার পড়ে দেখলেই বুঝতে কষ্ট হবে না।

বেইগলার হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন—

পুলিশ ডিপার্টমেন্ট,
আপনারা ২৪৭, সীভিউ বুলেভার্ডে চলে যান। সেখানে আর একজনের দেখা পাবেন আপনারা। তার প্রাপ্য সাজা সে আমার কাছ থেকেই পেয়ে গেছে। গ্যাস চেম্বারের কষ্ট লাঘব করার জন্য শর্টকাটই বেছে নিলাম ঐ মুহূর্তে মাথায় যা এল।
মুরিয়েল মার্শ ডেভন

পুনঃ–ও বাড়ির চাবি আপনি দরজার সামনে বিছানো মাদুরের তলায় পেয়ে যাবেন।

বেইগলার কোন মন্তব্য করার পূর্বেই বার কাউন্টার থেকে ব্রাউনিং-এর গলা শোনা গেল, ওহে বেইগলার, তোমাদের চীফ তোমায় একবার ডাকছেন।

চিঠিটা হাতে নিয়েই বেইগলার ছুটলেন ফোন ধরতে। রিসিভারটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়েই ব্রাউনিং কয়েক পা তফাতে সরে দাঁড়ালেন।

–আমায় ডাকছেন, চীফ?

আজ্ঞে, মিঃ ব্রাউনিং-এর ফোন পেয়ে আমি এখানে এসেছি। মহিলার লাশ ওপর ওপর দেখে মনে হয় আত্মহত্যা। ওভারডোজ হেরোয়িনের রি-অ্যাকশন। হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জও একটা পেয়ে গেছি তার বড়ির কাছ থেকে। শরীরের বেশকিছু জায়গা জুড়ে ইনজেকশান নেওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। আর সেই সঙ্গে হাতে এসেছে একটা সুইসাইড নোট।

তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা।

মিঃ ব্রাউনিং-এর কানে যেন কোন কথা না পৌঁছয় বুদ্ধি করে বেইগলার নিম্নকণ্ঠে চিঠির বয়ান পড়ে শোনালেন চীফকে। আবার স্বাভাবিক কণ্ঠে নিজের মতো করে বলতে লাগলেন:মিঃ ব্রাউনিং এর মনোগত ইচ্ছা আমরা বিনা তদন্তেই এখান থেকে লাশ সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি। আপনি। কী বলেন? তাকি উচিত হবে? আমার মতে এখানে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট স্কোয়াড পাঠানো প্রয়োজন।

মাঝে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। তারপর আবার বেজে উঠল মিঃ টেরলের গলা:তোমার সঙ্গে আর কে আছে?

হেস।

বেশ, লাশের ভার না হয় ওর ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি আর সময় নষ্ট না করে সোজা চলে যাও সীভিউ বুলেভার্ডে। টম লেপস্কিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাকে হাতে হাতে সাহায্য করার অভিপ্রায়ে। আমি ব্রাউনিং এর রেস্তোরাঁয় বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি, ও-কে?

ও-কে চীফ। হাসিমুখে জবাব দিলেন বেইগলার। কিন্তু মিঃ ব্রাউনিং

ওকে বোঝাবার ভার আমার ওপর বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়ে তুমি আর দেরী না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় রওনা দাও।

–এক্ষুনি রওনা হয়ে যাচ্ছি, চীফ। ঘুরে দাঁড়িয়ে রিসিভারটা মিঃ ব্রাউনিং-এর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন বেইগলার, নিন কথা যা বলার আছে বলে ফেলুন, মিঃ ব্রাউনিং।

রিসিভারটা তার হাতে জোর করে ধরিয়ে দিয়ে ছুটলেন তিনি হেরে উদ্দেশ্যে।

হেসকে সব জানিয়ে বেইগলার যখন বাইরে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা ফেলছেন, তার কানে এল, মিঃ ব্রাউনিং ক্রোধে মত্ত হয়ে তর্কের ঝড় তুলেছেন স্বয়ং চীফের সঙ্গে।

টিকি এডরিস, লা কোকাইল রেস্তোরাঁর ওয়েটার। মাঝারি গড়ন, বকেশ্বর। মাত্র সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা। দীর্ঘ আট বছর ধরে এই রেস্তোরাঁর কাজ করে আসছে সে। এতদিন ধরে তার কাজে কোন ত্রুটি দেখা যায়নি। তাই জনপ্রিয়তার শিখরে সে আজ সহজেই পৌঁছতে পেরেছে। শুধু তার দৈহিক খবতার জন্যই নয় রেস্তোরাঁর খরিদ্দারদের কাছেও সে ভাড় হিসেবে বিখ্যাত।

রাত আড়াইটে নাগাদ রেস্তোরাঁর দরজা বন্ধ হলে সব কাজ সেরে, গুছিয়ে হিসেব জমা দিয়ে, নিজের কম্পার্টমেন্টে তার ফিরতে আরো দেড়-দুঘণ্টা দেরী হয়ে যায়। আজ সে যাবার জন্য জামা কাপড় পরিবর্তনে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় ফ্লোর ম্যানেজার লুই এসে খবর দিল পুলিশ তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়, টিকি।

পুলিশ আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী? কেন? ওই মৃতা মেয়েটার ব্যাপারে বুঝি? ঠিক আছে, আমার যতটুকু জানা আছে, যা দেখেছি তাই খুলে বলব, এর বেশী আর কিছু আমার বলারও নেই কারণ এই পর্যন্তই আমার জানা।

বার-হল-এর একধারে ফ্রেড হেস আর স্বয়ং ডিটেকটিভ ম্যাক্স জ্যাকবি বসেছিলেন একান্ত পৃথক হয়েই। জ্যাকবির হাতে ধরা নোটবই আর পেন্সিল। এডরিস হেলতে দুলতে এখানে এসে উপস্থিত হল।

দুই ডিটেকটিভ এডরিসের চেহারা দেখে প্রথমে সত্যি সত্যিই হতবাক হয়ে গেলেন। একটা প্রচণ্ড হাসির রোল দুজনেরই বুক ঠেলে গলায় এসে ঠেকল। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সামলে নিলেন নিজেদের।

তুমিই মৃত মহিলাকে অ্যাটেন্ড করেছিলে? জিজ্ঞাসা করে উঠলেন হেস্।

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–কী নাম তোমার?

–আজ্ঞে, টিকি এডোয়ার্ড এডরিস।

 –ঠিকানা?

—২৪ নং ইস্ট স্ট্রীট সীকোষ।

সীকোম্ব হল প্যারাডাইস সিটির উত্তর শহরতলী। শ্রমিক শ্রেণীর বেশীর ভাগ লোকেরই সেখানে নিবাস।

–ভদ্রমহিলা রাত ঠিক কটা নাগাদ এখনে এসেছিলেন বলতে পারবে?

–ঘড়িতে তখন ঠিক কটা বেজেছিল বলতে পারব না তবে এগারোটার কিছু পরেই হবে।

মহিলা কী এখানে একাই এসেছিলেন না সঙ্গে কেউ ছিলেন?

না, একাই এসেছিলেন।

–যে ঘরে এই মুহূর্তে তার মৃতদেহ পড়ে আছে, সে ঘরটা কী তার আগে থেকেই রিজার্ভ করা ছিল?

–আজ্ঞে না, অত রাতে বিশেষ লোকজন বার হল থেকে তখন প্রায় বিদায় নিয়েছিল। সকলেই রেস্তোরাঁয় ভোজন সারার ব্যাপারে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাই বহু কামরাই খালি পড়েছিল?

–মহিলাকে কেমন দেখেছিলে? আই মিন সুস্থ না অসুস্থ?

–আজ্ঞে, যতদূর মনে আছে তাকে সুস্থই দেখেছিলাম।

–তারপর তিনি ঠিক কী কী করেছিলেন?

–সোজা তার কামরায় প্রবেশ করে একটা চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে এটাই জানতে চাইলাম : তিনি কী কারো জন্য প্রতীক্ষা করতে চান? জবাবে শুধুমাত্র মাথা নেড়ে না  বলে নির্জলা হুইস্কির অর্ডার দিলেন আমাকে। তার হাব-ভাব দেখে মনে হল তিনি প্রাইভেসি চান। তার অর্ডার মতো হুইস্কি সার্ভ করে, পর্দা টেনে আমি অন্যত্র চলে যাই নিজের কাজ সারতে।

তারপর।

–আড়াইটে নাগাদ আমাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেলে খদ্দেররা একে একে বিদায় নিতে শুরু করে দিল। আমি কামরায় কামরায় উঁকি দিয়ে আসতে আসতে যখন তার কামরার দোর গোড়ার সামনে এসে দাঁড়ালাম, দেখলাম তখন পর্দা টানা রয়েছে। বাইরে থেকে বেশ কয়েকবার সাড়া নেবার চেষ্টাও করলাম, কিন্তু পরিবর্তে জবাব না পেয়ে পর্দা তুলে দেখি ঐ অবস্থার সম্মুখীন।

–তাহলে তোমার বয়ান হলো : রাত ঠিক এগারটা থেকে আড়াইটে, এই সাড়ে তিনঘন্টা তুমি আর ওর ধারে কাছে যাওনি। তাইতো, কেমন?

-আজ্ঞে হ্যাঁ।

এইসময় মিঃ ব্রাউনিং বললেন বন্ধুকে, আমি বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম, ফ্র্যাঙ্ক। লু রইল ঐসব এখানকার কাজকর্ম সামলে নেবে। আজ যা কেলেঙ্কারী কাণ্ড হলো, এতে না আমার ব্যবসায় লোকসানের কোন প্রতিফলন পড়ে। যত তাড়াতাড়ি পার এই সাফল্ড পুলিশী-তদন্ত শেষ করে ফেল বন্ধু। লুই বেচারিও মানুষ, ওরও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।

-না, না, বেশীক্ষণ সময় নেবে না আমার লোকেরা। তুমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে যেতে পার।

অতঃপর বন্ধুকে গুডনাইট জানিয়ে মিঃ ব্রাউনিং ধীর পদব্রজে সে স্থান পরিত্যাগ করলেন।

মিঃ ব্রাউনিং চোখের আড়ালে যেতেই এডরিস বলে উঠল–হেস্ কে? মিঃ অফিসার!

আপনি যখন আমাকে প্রশ্ন করে বললেন–মহিলাকে আমি ঠিক কেমন দেখেছিলাম, তখন কিন্তু জবাবে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিল আমাকে। কেন জানেন? মনিব আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলেই বাধ্য হয়ে আপনাকে মিথ্যে বলতে হয়েছিল। কেন না আমি সত্যি প্রকাশ করলে উনি অকারণে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন আর আমার এই সাধের চাকরিটিকেও খোয়াতে হোত। এবারে না হয় সত্যি জবাবটাই দিয়ে ফেলি।

রাগে হেসের চোয়াল নিজের অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠল। এডরিস আবার বলতে লাগল–ওঁকে যখন দেখলাম, আমার ধারণা হলো উনি নিশ্চয়ই কোন না কোন ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছেন। কেন না, মুখের ভাব বিবর্ণ…দু চোখের চাউনিতে চাঞ্চল্যের ভাব…থর থর করে শরীর কেঁপে উঠছে…হাতের মুঠো মাঝে মাঝে খুলছেন আর বন্ধ করছে..নিজের মনেই বিড়বিড় করে চলেছেন…সঙ্গীন অবস্থার এই ভয়াবহ রূপ দেখে বুঝলাম যে কোন মুহূর্তে একটা কিছু কেলেঙ্কারী বাঁধিয়ে বসবেন উনি। এর আগেও এমন ঘটনার সম্মুক্ষীণ হয়েছি আমি, তাই পরিস্থিতির এই চেহারা কিছুটা নিজের দখলে থাকায় তাকে এই কামরার মধ্যে ঢুকিয়ে হাতের কাছে হুইস্কির পাত্র রেখে ও দরজা ভেজিয়ে, পর্দা টেনে দিয়ে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেললাম। মনিব আমার চিরদিনই শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোনরকম ঝুটঝামেলা কেলেঙ্কারী পছন্দ করেন না। একমাত্র তার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে মহিলাকে ঐভাবে কামরায় আটক করে রাখলাম তখনকার মতো অবস্থার সামাল দেবার জন্য।

হেস আর জ্যাকোবি পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময় করলেন সবিস্ময়ে। হে জিজ্ঞাসা করলেন, মহিলাটিকে তুমি তবে আগে থাকতে চিনতে?

জবাব দেবার আগে এডরিস একবার দেখে নিল ফ্লোর ম্যানেজার লুই কোথায়? তার চোখে পড়ল, সে কিছুটা দূরে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কীসের যেন আলোচনা করছে। অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে হেস-এর কথার জবাব দিল স্বরের তীক্ষ্ণতা কিছুটা নরম করে : আজ্ঞে হ্যাঁ, চিনতাম। আমার উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্টে উনি থাকতেন।

–একথা আগে আমার কাছে প্রকাশ করোনি কেন বাপদ?রাগে বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করে উঠলেন হেস।

–সে প্রশ্নতো আপনি আমায় করেননি অফিসার, এডরিস বোকার মতো মুখ করে নিরীহ সুরে জবাব দিয়ে বসল।

–হয়েছে, অনেক হয়েছে। এবার বলো কী জান তুমি ওঁর সম্বন্ধে। ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন হেস্?

-সত্যিকথা বলতে কী, মেয়েটি ভদ্রঘরের সন্তান হলেও ইদানিং তার চালচলন ঠিক ছিল না।

নেশা করা আর বেশ্যাবৃত্তি তার ছিল জীবিকা। গত আট বছর ধরে ওর সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় ছিল। শুধুই আলাপ। ওর আর আমার মধ্যে যা ছিল তা হল এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এর চেয়ে বেশীকিছুনয়।কারণ বলতে বলতে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল এডরিস, আবেগশূন্য কণ্ঠে জানাল : আমার এই চেহারার মূর্তি দেখে কোন চক্ষুষ্মতী কন্যা আমার সঙ্গে কোন সাহসে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াসী হবে বলুন?মুরিয়েলও আমায় আর পাঁচজনের মতন কৃপাবর্ষণ করে কথালাপ সারত।

–কী কথোপকথন হতো তোমাদের?

-বলার মতো কিছু নয়, মুরিয়েল যখন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত তখন ওর ঘর সংসারের জন্য শোক অকারণে উথলে উঠত। মেয়ের কথা, স্বামীর কথা,সংসারের টুকিটাকি বিষয়ে কথা, কখনো কখনো তার বর্তমান প্রেমিকের কথাও শোনাত সাতকাহন করে।

হেস আর কি যেন প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন এডরিসকে, এমন সময় লুই কাছে এসে বলল, মিঃ হে! আপনার টেলিফোন এসেছে। উঠে দাঁড়ালেন হেস্ যাবার আগে এডরিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, সে যেন এখানেই থাকে, আরো কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে তাকে।

বার কাউন্টারে এসে ফোন ধরলেন হেস –হ্যালো?

হেস্? আমি বেইগলার বলছি। চী আছেন?

–হ্যাঁ, কেন?

–তাকে গিয়ে শুধু বলো যে, মুরিয়েল মার্শের হ্যান্ডব্যাগে পাওয়া চিরকূটের লেখা অনুযায়ী ২৪৭ নং সীভিউ বুলেভার্ডে এসে একজন পুরুষের লাশ পেয়েছি আমি। খুব কাছ থেকে অন্ততঃ পক্ষে পাঁচবার গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে। আর শোন, তোমাকে আমার একটু প্রয়োজনে লাগবে। চীকে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় চলে এসো এখানে।

ও কে। বলছি তাকে। আজ সারা রাতটাই তাহলে আর দু চোখের পাতা এক করার কোন সম্ভবনাই নেই। চমৎকার!

হে রিসিভারটা ক্ৰডেলে সবে মাত্র রেখেছেন ঠিক সেই সময়ে দুজন সাদা কোট পরনে ইন্টার্ন একটা ভাজকরা স্ট্রেচার বয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

–ডেডবডি নিয়ে যেতে এসেছে অফিসার। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল।

–দাঁড়াও, দেখছি ডাক্তারের কাজ সমাপ্ত হয়েছে কিনা। এই বলে হে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে সেই কামরার দিকে পা বাড়ালেন। এডরিসের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় শুধু বলে গেলেন, ঠিক আছে, টিকি। আজকের মতন তোমার ছুটি। আগামীকাল সকাল এগারোটা নাগাদ হেডকোয়ার্টারে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। ডেক্স সার্জেন্টকে শুধু এটুকু বলবে, তুমি মিঃ হেন্দ্রে সঙ্গে দেখা করতে চাও, কেমন?

টিকি মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিল।

মুরিয়েল মার্শের মৃতদেহ যে কামরায় ছিল সেই কামরায় এসে হেস দেখলেন, ডাক্তার লোইসের কাজ প্রায় সমাপ্ত। তিনি পুলিশ চীফ টেরলকে সম্বোধন করে বলছেন, আমার যা যা, করণীয় ছিল তা সবই হয়ে গেছে। লাশ এবার সরাতে পারেন। আগামীকাল সকাল দশটা নাগাদ আমার ফাইনাল রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।

ডাক্তারের কথা শেষ হলে হে মুচকি হাসি হেসে বললেন, কাজ এখনই শেষ কী বলছেন, ডাক্তার? আরো একটা মৃতদেহ ২৪৭ নং সীভিউ বুলেভার্ডের এক অ্যাপার্টমেন্টে পড়ে আছে আপনারই পথ চেয়ে। এই মাত্র ফোনে এই কথা জানাল স্বয়ং জো। সেখানে যাবেন না?

টেরল প্রকৃত ব্যাপারটা জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জো এর কাছ থেকে শোনা বুলিগুলো হে পুনরাবৃত্তি করে গেলেন।

টেরল একবার মৃতা মহিলাটির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখলেন। তার অসাড় দেহটা তখন মেঝেতেই পড়েছিল। সুন্দরী,সুঠাম দেহের অধিকারিনী,বয়স প্রায় চল্লিশ। যৌবন পূর্ণমাত্রায় ভরপুর, ভাটার টান তখনও এসে পৌঁছয়নি।

চীফকে কৌতূহলী ভরা চোখ নিয়ে মৃতার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হে তখন বলে উঠলেন এডরিসের আওড়ানো বুলিগুলো। টেরল নীরবে শুনে গেলেন সব ব্যাপার। তারপর এও বললেন, ম্যালকে এখানে দায়িত্বে ন্যস্ত করে জো-এর কাছে চলে যাই।

চলুন।

মুরিয়েল মার্শ-এর চিরকুটের বয়ান মতোই ২৪৭নংসীভিউ বুলেভার্ডের গৃহে উপস্থিত হলেন জো-বেইগলার। এই এলাকায় ধনিক শ্রেণীর লোকের বাস। তাই গৃহগুলোর মূল্যও যথেষ্ট, সুদৃশ্য এবং বিলাসবহুল। ২৪৭নং গৃহ একটা বাংলো আকৃতির ভিলা। সামনে কয়েক ফালি বাগান, গৃহকে আজ অন্ধকারে ঢেকে রেখেছে। হয় বাসিন্দা নেই, না হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

বেইগলার গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। তারপর গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট থেকে নিজের ফ্ল্যাশ লাইটটা টেনে হাতে নিয়ে ফটক খুলে ধীর পদব্রজে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে।

দরজার সম্মুখে দড়ির বোনা মাদুর পাতা। চিরকুটের বয়ান অনুসারে এরই তলায় এই গৃহে প্রবেশের চাবি থাকার কথা।

আর ছিলও তাই। চাবি হাতে নিয়ে বেইগলার সর্বপ্রথমে কলিংবেল টিপলেন বার কয়েক সন্তর্পণে। কারো কাছ থেকে কোন সাড়া মিলল না। তিনি যখন এই সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হলেন যে, গৃহে কেউ উপস্থিত নেই ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি চাবিটা লাগালেন। নিঃশব্দে নীরবে খুলে গেল সদর দরজা। বেইগলার এক হাতে ফ্ল্যাশ লাইট আর এক হাতে নিজের সার্ভিস-রিভলবারটাকে মুঠোয় চেপে ধীর পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন ভেতরে।

— ভেতরে পা রেখেই ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে তিনি এ গৃহের আলোর সুইচের সঠিক অবস্থান দেখে নিয়ে একটা সুইচে চাপ দিতেই প্যাসেজটা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। এই প্যাসেজের দুই প্রান্তে দুই পাশে দরজা দুটি তার নজরে এল।

আপন মনেই কিছু ভেবে নিয়ে বেইগলার প্রথমে বাঁদিকের বন্ধ দরজাটা খোলার ব্যাপারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিলেন। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সুইচের সন্ধান করে আলো জ্বালাতেই অনুধাবন করতে পারলেন নিঃসঙ্গ এক শয়নকক্ষ। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিরাট শয্যা, তাতে সুন্দর করে চাদর বিছানো, বালিশ পাতা। কিন্তু নিজ অবস্থা ঘোষণা করছিল সেগুলো কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি প্রায় কিছু দিন যাবৎ। খাটের মাথার দিকে, পায়ের দিক বরাবর আর সিলিঙে প্রকাণ্ড ধরণের তিন তিনটে দর্পণ ফিট করা। দেয়াল ঘন সবুজ রঙের ওয়াল পেপারে মোড়া। চার দেয়ালের জায়গায় জায়গায় হাস্যমুখী নিরাবরণা, সুন্দরী লাস্যময়ী রমনীদের দেয়াল চিত্র টাঙ্গানো। আঁকা ছবি নয়–প্রকৃত ফটোগ্রাফ। ঘরের এক কোণে প্রমাণ সাইজের আলমারী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাল্লা একটু টেনে খুলতেই বেইগলার মুহূর্তের জন্য একটু থমকে গেলেন।

যুবতীদের বিবিধ অন্তর্বাস, যৌনচিত্র, বিভিন্ন ধরণের সঙ্গম-ভঙ্গীমার চিত্র, যৌনাচারের সময়ে ব্যবহৃত নানা প্রকারের সাজ-সরঞ্জাম–অর্থাৎ একজন বিকৃতকাম যৌন উন্মাদ পুরুষের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন সব রকমারি অদ্ভুত জিনিসে আলমারি বোঝাই।

বেইগলার বেরিয়ে এলেন সে ঘর থেকে। এবারে তিনি প্রবেশ করলেন পাশের ডানদিকের ঘরে। এ ঘরেও আলো ঢোকেনি। অগত্যা সুইচের সাহায্যেই আলো জ্বালাতে হল। আলো জ্বলে উঠতেই যে দৃশ্য তাঁর চোখের ওপর ভেসে উঠল তাতে তিনি শুধু থমকেই যাননি, রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

ঘরের ঠিক মাঝখানে পাতা একটা সিঙ্গল বেড খাট।খাটে বিছানোখবরের কাগজের ওপরহুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে নিষ্প্রাণ দেহের এক মানুষ। পরণেনীল সাদা ডোরাকাটা পাজামা আর জ্যাকেট।

রক্ত শুধু অজ্ঞাত ব্যক্তির সর্বাঙ্গেই নয়, বিছানা, মেঝে এমনকি দেয়াল পর্যন্ত রক্তের বিন্দুতে ভরপুর।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন বেইগলার সেই দরজার কাছেই। তারপর ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে ধীর পদব্রজে এগিয়ে এলেন খাটের অভিমুখেই।

আগন্তুক বলশালী চেহারার অধিকারী। মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো পেশীবহুল কাধ,কালো চুল সেই সঙ্গে সরু গোঁফ। মুখশ্রী মন্দ নয়।

মিনিটখানেকের মতো মৃত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকার পর অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালেন বেইগলার। খাটের পাশেই একটা টিপয়ের ওপর টেলিফোন। সন্তর্পণে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন লা-কোকাইলের উদ্দেশ্যে।

হেসের সঙ্গে কথা সমাপ্ত হওয়া মাত্রই এ বাড়ির দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। বেইগলার বেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই রহস্যসন্ধানী ডিটেকটিভ লেপস্কিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।

-শুনলাম এখানে নাকি কী একটা গোলমেলে ব্যাপার হয়েছে। চীফ তমাকে সাহায্য করার । জন্যই আমাকে পাঠিয়েছেন। তা ব্যাপার কী?

বেইগলার দরজা বন্ধ করতে করতে জবাব দিলেন, খুন। একজনের লাশ পাওয়া গেছে এ গৃহে, এসো একবার দেখে যাও।

যে ঘরে মৃতদেহ পড়েছিল সেই ঘরে দুজনে এসে ঢুকলেন। লেপস্কি মৃত ব্যক্তির টুপিটা মাথার দিকে ঠেলে দিয়ে সামান্য বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আরে, এযে আমার পূর্ব পরিচিত জনি উইলিয়ামস্ দেখছি।

–তুমি তাহলে চেন এই আগন্তুক কে?

–হ্যাঁ, চিনি বৈকি, প্যালেস হোটেলের মাইনে করা নাচিয়ে। ও এখানে মরতে এসেছিল কেন?

হয়তো এটাই ওর ডেরা বা আস্তানা।

–কে খুনী হতে পারে, কিছু আন্দাজ করতে পারছ?

একটি মেয়ে নাম মুরিয়েল মার্শ। এই বলে সংক্ষেপে সব ঘটনার বিবৃতি লেপস্কির সামনে তুলে ধরল। তারপর দুজনে মিলে তল্লাশির কাজে নেমে পড়ল সমগ্র ঘরটার। খুঁজতে খুঁজতে হাতে মিলল একটা আটত্রিশ ক্যালিবারের কোল্ট অটোমেটিক। এটা পড়েছিল খাটের তলায়। মনে হয় খুনের হাতিয়ার। বেইগলার সেটা রুমালে মুড়ে নিয়ে নিজের পকেটে চালান করে দিলেন।

তাদের যৌথ তল্লাশীর সময়েই উপস্থিত হলেন পুলিশের ডাক্তার। বেইগলার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল এবং লাশের সামনে হাজির করে সকৌতুকে বলে উঠলেন, এই ধরুন আপনার আমানত, এবার সামলান।

ডাক্তার গজ গজ করে নিজের মনেই বলে উঠলেন, রাত্রের শেষ প্রহরেই যত ঝামেলা জুটে গেল ভাগ্যে। একটু যে নিদ্রা নেব তার উপায় পর্যন্ত নেই।

বেইগলার বা লেপস্কি কেউই কোন মন্তব্য করলনা শুধু নিজেদের মধ্যে সকৌতুক দৃষ্টি বিনিময় করে, ঘর থেকে বেরিয়ে এই গৃহের কম্পাউন্ডে এসে দাঁড়ালেন।

লেপস্কি চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এই খুনের পেছনে কোন উদ্দেশ্য তো থাকবে? ঝগড়া ঈর্ষা? কিন্তু অত সামান্য কারণেও তো কেউ কাউকে এভাবে নৃশংসরূপে গুলি করতে পারে না। এ যেন মনে হচ্ছে কোন কিছু ব্যাপার নিয়ে মেয়েটা তার মনের আক্রোশ বর্ষণ করেছে লোকটার ওপরে। তোমার কী মনে হয়?

বেইগলার জবাব দেবার পূর্বেই মিঃ টেরল তার দলবল সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলেন সেখানে। আধঘণ্টা পরের কথা

যা দেখার ছিল তা একে একে দেখে নিয়ে মিঃ টেরল তার গাড়িতে বসে পাইপ টানতে টানতে প্রতীক্ষা করছিলেন তার সঙ্গীদের কাছ থেকে রিপোর্টের জন্য। ডাক্তার উপস্থিত হলেন। তিনি জানলেন : রাত দশটার কিছু আগে পরে গুলি করা হয়েছে।

পাঁচটা বুলেটই হৃদযন্ত্রকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আর গুলিও করা হয়েছে খাটের পায়ার খুব কাছ থেকেই। অর্থাৎ গুলির প্রবেশ পথের গতি নীচ থেকে ওপরে। বিস্তারিত রিপোর্ট আগামীকাল সকাল এগারোটা নাগাদ পেয়ে যাবেন চীফ। এখনকার মতো তাহলে বিদায় নিই।

ডাক্তার চলে গেলেন নিজের গাড়িতে চেপে। টেরল অতঃপর নেমে এলেন গাড়ি থেকে। গৃহের ভেতরে পা রাখলেন। হলঘরে বেইগলার আর হেস কথালাপ সারছিলেন নিজেদের মধ্যে। চীফকে আসতে দেখে হেস্ বলে উঠলেন, এখনকার কাজ আপাততঃ শেষ, স্যার। একেবারে ওপেন অ্যান্ড শর্ট মার্ডার কেস।

টেরল বললেন, তাতেইতো আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে খুব বেশী করে। শোন, তোমরা দুজনে মিলে ইস্ট স্ট্রীটে ঐ মেয়েটার অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাও। সুইসাইড নোটের সঙ্গে ওর হস্তাক্ষরও মিলিয়ে নিও একবার। বেঁটে গড়নের বকেশ্বরের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখ। আমার মন বলছে, ও অনেক কিছুই জানে, তাই ও যা বলেছে ওর বয়ান তার চেয়ে আরো অনেককিছুই মনে চেপে রেখেছে। হয়তো ওর পক্ষেই বলা সম্ভব, কি কারণে মেয়েটা তার মনে এতো আক্রোশ পুঞ্জীভূত রেখেছিল। যা যা বললাম তা ছাড়াও তোমরা নিজেরা যা পাবে জানবে বুঝবে সেসবের পরিপূর্ণ রিপোর্ট আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যেই আমি যেন পেয়ে যাই। বুঝেছ? নাও এবার চটপটু এখান থেকে যাবার ব্যবস্থা করে ফেল।

–ওকে চীফ।

টেরল এগিয়ে গেলেন সেই দিকেই, যেখানে লেপস্কি আর স্কোয়াডের নানান পারদর্শী ব্যক্তির দল নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।

–টম! লেপস্কিকে ডেকে টেরল শুধু বললেন, এ গৃহে গুলি চালানোর আওয়াজ কারো কানে পৌঁছেচে কিনা আর জনি উইলিয়ামরে পূর্বের কিছু কথা, এ দুটি খবরের দায়িত্ব আমি তোমাকে দিচ্ছি। অবিলম্বে খোঁজ-খবর নাও।

ও-কে, চীফ।

.

০২.

 মিঃ টেরল আর তার লোকজন লো-কোকাইল রেস্তোরাঁ ত্যাগ করে চলে যাবার পর এডরিসকে আর কোন প্রয়োজনে লাগবে না দেখে জ্যাকবি তাকে চলে যাবার অনুমতি দিলেন।

রেস্তোরাঁর পেছনের দিককার স্টাফ কার পার্কিং জোনে মাত্র দুখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই সময়ে। একটা কুপারমিনি, আরেকটা বুইক রোডমাস্টার ককভর্টিবল।

বুইকের ড্রাইভিং সীটে বসেছিল জনৈক বৃষস্কন্ধ পুরুষ। তার পরণে ছিল ফন কালারের স্যুট আর মাথায় ব্রাউন স্ট্রহ্যাট। এক মাথা সোনালী কেশ। বয়স প্রায় আন্দাজ আটত্রিশ। সুদর্শন বলিষ্ঠ চেহারা। চিবুকের নীচে গভীর খাঁজ।

প্রথম দর্শনেই এটাই মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে লোকটি হয়তো কোন আইনজ্ঞ, ব্যাঙ্ক অফিসার, রাজনীতির কাণ্ডারী অথবা একজন অভিনেতা।

কিন্তু সে তার একজনও নয়।

লোকটির নাম ফিল অ্যালগির, একজন জেল খালাশি কয়েদী। নিজের চেহারা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অসাধারণ বাকপটুতার গুণে বহু লোককে প্রতারণা করে আত্মসাৎ করার অপরাধে ধরা পড়ে, চৌদ্দ বছরের জেল খাটার পর সম্প্রতি সে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। জেল থেকে বেরোবার পর যখন অর্থের অভাবে কষ্টভোগ করছে, সেই সময়ে এডরিসের সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয়। এডরিস তাকে ভরসা দেয় : ফিল যদি তার নির্দেশমতো কাজ করতে প্রস্তুত থাকে তবে সে তাকে ছোট-খাটো রাজা বানিয়ে দিতে পারবে। কাজটা যদিও কঠিন কিছু নয় শুধু বুদ্ধি আর স্নায়ুর জোর থাকলেই কাজ হবে।

কাজটাতে ঝুঁকি ছিল নিশ্চয়ই তবে সামান্য চালের ভুল হলে গ্যাস-চেম্বার পর্যন্ত ঢুকতে হতে পারে, কিন্তু নিজের সাহস আর বুদ্ধিমত্তার ওপর ফিলের ছিল অগাধ আস্থা। তাই অনেক ভেবেচিন্তে রাজী হয়ে গেল সে এডরিসের দেওয়া প্রস্তাবে। অতঃপর তারা দুজনে মিলে মতলব এঁটে যে খেলা খেলতে ময়দানে নামল, আজই ছিল তার প্রথম রাউন্ড।

এডরিসের অপেক্ষায় গাড়িতে বসে সিগারেট টানতে টানতে সময় অতিবাহিত করছিল ফিল, এমন সময়ে এডরিস এসে তার গাড়িতে উঠে বসল। তাকে দেখে ফিল তাড়াতাড়ি সিগারেটটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সমগ্র জানতে চাইল : এদিককার অবস্থার হালচাল?

–জলের মতন তরতর করে বয়ে চলেছে। জবাব দিল এডরিস।

-কোন ঝামেলা হয়নি, কেউ কোন এ বিষয়ে সন্দেহ করেনি। তারপর তোমার দিককার খবর কি? সব ঠিকঠাক তো?

–আপাততঃ সবকিছু প্ল্যান মতোই চলছে।

–গুড। পুলিশ বাংলোর দিকেই গেছে। তারপর আসবে ইস্ট স্ট্রীটে। তোমার পরের চাল কী হতে পারে, তা স্মরণে আছে তো?

হ্যাঁ, ফিল গাড়িতে চড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

-বেশ। তবে চলি এখন। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল এডরিস। তারপর বলল, টেরল একজন তুখড় পুলিশ অফিসার।

তাই সকাল সাড়ে সাতটার আগে কখনই স্কুলের ধারে কাছে যাবে না। সাবধান!

জানি হে বাপু, জানি। অত করে সাবধান না করলেও চলবে। তুমি আর আমি তোবদারই সেখানে গেছি। যাইনি? তাহলে ঘাবড়াবার আছেটাই বা কি? তুমি তোমার দিকটা দেখ? আমি দেখি আমারটা।

বলতে বলতে ফিল গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িটা বাঁক ঘুরে তার চোখের আড়াল হতেই, এডরিস গিয়ে তার নিজের মিনি কুপার খানিতে চেপে বসল। বিস্তর খরচ-খরচা করে নিজের এই খাটো আকৃতির চেহারা অনুযায়ী মিনি সীট, ব্রেক অ্যাকসিলেটার, গীয়ার ইত্যাদি নতুন করে অ্যাডজাস্ট করিয়ে নিয়েছে সে নিজে উপস্থিত থেকে। পরিশ্রম করে ড্রাইভিংটা আয়ত্ত করেছে ভালোভাবে। এখন সে একজন দক্ষ ড্রাইভার।

গাড়ি চালিয়ে, কতকটা ইচ্ছে করেই ২৪৭ নং সীভিউ বুলেভার্ডের বাংলোর সামনে দিয়ে নিজের ডেরা ইস্ট স্ট্রীটে ফিরল এডরিস। আড়চোখের দৃষ্টি দিয়ে একবার দেখে নিল পুলিশ কারগুলোর দিকে–সেগুলো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলবাংলোর সামনে। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে পোশাক-আশাক ছেড়ে প্রথমে জলে গা ভিজিয়ে নিল। তারপর এক গ্লাস হুইস্কি হাতে নিয়ে ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে আরাম করে সোফায় গিয়ে বসল।

ঘরটা খুব সাজানো-গোছানো। ফার্নিচার যা ছিল সবই প্রমাণ মাপের। শুধু সেগুলো যথাযথ ভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রতেকটির সামনে একটি করে ছোট টুল পাতা।

হুইস্কি আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজের হাত ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে দেখল এডরিস, ভোর সাড়ে ছটা। গ্রেটার মিয়ামিতে পৌঁছতে পৌঁছতে ফিলের ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে। সব কিছু নির্বিবাদে চলতে থাকে, তবে প্যারাডাইস সিটিতে ফিরে আসতে সাড়ে আটটা বাজবে ফিলের। তারপর প্ল্যান অনুযায়ী কাজ সমাপ্ত করে ফিলের খবর দিতে দিতে সাড়ে নটা দশটা তো বাজবেই।–মনে এগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল।

আরও একগ্লাস হুইস্কি ঢালল গ্লাসে। কয়েক চুমুক দিতে না দিতেই সে শুনতে পেল সাইরেনের শব্দ তুলে পুলিশের একটা গাড়ি সশব্দে থামল তাদের বিল্ডিংয়ের নীচে। এডরিস তাড়াতাড়ি গ্লাস ফাঁকা করে ধুয়ে আবার যথাস্থানে রেখে এল। নিঃশব্দে পায়ে পায়ে বন্ধ দরজার কাছে এসে কপাটের গায়ে কান ঠেকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

এই গৃহের কেয়ারটেকারের কাছে মুরিয়েলের কামরার চাবি নিয়ে বেইগলার আর হেস সশব্দে ওপরে উঠে এলেন।

ওপরে এসে লক্ খুলে মুরিয়েলের টুরুম অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করলেন গোয়েন্দা দুজন। সুন্দর ভাবে সুসজ্জিত ঘর। প্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্রই মজুত আছে কামরাদুটিতে। ড্রেসিংটেবিল প্রসাধনী দ্রব্যসামগ্রীতে সজ্জিত ছাড়াও রূপোর তৈরী ডবল ফ্রেম-এ দুটো ফটোগ্রাফ : সেখানে রাখা ছিল। কালো চুলওয়ালা এক সুদর্শন যুবার, বয়স প্রায় ত্রিশের দোরগোড়ায়। দ্বিতীয়টি ষোলো সতেরো বছরের এক রমনীর। রমনীর মুখশ্রী যেমন অপরূপা তেমনি চোখদুটোও দুষ্টুমিতে ভরা।

যথারীতি তদন্ত তল্লাসীর পথে পা বাড়ালেন দুজনে। উল্লেখযোগ্য জিনিস কিছুই মিলল না। তবে কিছু টাকাপয়সা মুরিয়েলের কয়েকটি না দেওয়া বিল আর তার নামের কিছু চিঠিপত্র–যার শুরু ডিয়ার মমি দিয়ে, আর শেষ-ভালোবাসা নিও, নোরেনা বলে। পত্র প্রেরিকার ঠিকানা : গ্রাহাম কো-এড কলেজ, গ্রেটার মিয়ামি।

মুরিয়েলের ব্যক্তিগত নোটগুলোর সঙ্গে সুসাইড নোটে হস্তাক্ষর মিলিয়ে এটুকু স্থির সিদ্ধান্তে আসা গেল যে–একজনেরই হস্তাক্ষর।

বেইগলার বললেন, ড্রেসিং টেবিলের ওপর যে যুবতীর ছবি রয়েছে ঐ বোধহয় নোরেনা মুরিয়েল মার্শের কন্যা। কিন্তু পিতা কে? ছবির ভদ্রলোকটি নিশ্চয়ই নন।

হেস জাবাব দিলেন একটু ভেবে :বেঁটেটা জানলেও জানতে পারে। ওর সঙ্গে মুরিয়েলের একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চল, ওকে গিয়ে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক।

এ্যাপার্টমেন্টের দরজা পুনরায় লক করে ওঁরা এবার বিপরীতমুখী এ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ঘা দিলেন। একটু পরেই দরজা খুলে সামনে এল এডরিস।

–ও, আপনারা আসুন, ভেতরে আসুন। কফি তৈরী করছিলাম, তাই দরজা খুলতে একটু সময় লেগে গেল।

ভেতরে প্রবেশ করলেন দুজনে।

বসুন আরাম করে। কফি খাবেন তো?

–তা পেলে মন্দ হতো না। জবাব দিলেন বেইগলার। চারিদিকে ঘরের সাজসজ্জা চেয়েচেয়ে দেখতে লাগলেন। একটি ট্রেতে কফি নিয়ে উপস্থিত হল এডরিস।

কয়েক চুমুক কফি খাবার পর হেই সর্ব প্রথম থমথমে নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন, তোমার সঙ্গে মুরিয়েল মার্শের একটা ভালো সম্পর্ক ছিল, ওর শয়নকক্ষে ড্রেসিং টেবিলের ওপর যে যুবার ফটোগ্রাফ দেখলাম, সেটা কী ওর স্বামীর ছবি?

এডরিস বোকা নয়। বুদ্ধি তার মগজেও কিছু আছে। অতসহজে এই পুলিশের ফাঁদে পা দেবার পাত্র সে নয়।

সে উত্তরে শুধু বলল : কেমন করে জানব বলুন? আমি তো কখনও ওর ঘরে পা দিইনি।

হেস কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে বামনটাকে দেখলেন, তারপর নিজেই উঠে গিয়ে ফ্রেম সমেত ছবি দুটো নিয়ে এসে এডরিসের হাতে দিয়ে বললেন, দেখে বল।

ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে এডরিস জানাল: না, এ মুরিয়েলের পতিদেবতার ছবি নয়। এরই সঙ্গে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে বেরিয়ে গেছিল। এর নাম হেনরি লিউইস। বছর পনেরো আগের কথা, এক মোটর দুর্ঘটনায় ছোকরা প্রাণ হারায়। তা দেখতে দেখতে এতোগুলো বছর কেটে গেছে।

এই মেয়েটি বোধহয় মুরিয়েলের মেয়ে?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, নাম নোরেনা।

বর্তমানে থাকে কোথায়?

 –গ্রাহাম কো-এড কলেজ, গ্রেটার মিয়ামিতে। সেখান থেকে ও পড়াশুনা করছে।

–মুরিয়েলের স্বামী জীবিত?

–হ্যাঁ, বেঁচে আছেন।

 –নাম জান?

–জানি। মেলভিন ডেভন।

–কোথায় বাস করেন ভদ্রলোক?

–সঠিক জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, এই শহরেরই কোথাও তিনি থাকেন।

–মুরিয়েলের গৃহত্যাগের কারণ কিছু জানা আছে?

–ভাসা ভাসা কিছু জানি–মানে যা শুনেছিলাম মুরিয়েলের মুখ থেকে তাই আর কি। মিঃ ডেভন খুবই সিরিয়াস প্রকৃতির, কাজ পাগল মানুষ। স্ত্রীর প্রতি বিশেষ নজর দিতেন না। এই নিয়ে মুরিয়েলের মনে দুঃখ কষ্টের অন্ত ছিল না। বিয়ের বছর দুই বাদে এক পার্টিতে হেনরির সঙ্গে তার প্রথম আলাপ। প্রাণচঞ্চল আর রোমান্টিক প্রকৃতির যুবক। ফলে প্রেমে পড়তে বেশী সময় লাগল না মুরিয়েলের। এরপর একদিন স্বামীর ঘর ছেড়ে সকন্যা মুরিয়েল হেনরীর সঙ্গে আবার নতুন করে ঘর বাঁধল।

হেনরীর সঙ্গে সুখশান্তিতে বেশ কয়েকবছর অতিবাহিত করেছিল মুরিয়েল। তারপর হঠাৎ একদিন কার অ্যাক্সিডেন্টে হেনরী মারা যায়। এ ঘটনা আগেই বলেছি, পনেরো বছর আগের।

হেস জিজ্ঞাসা করল, মুরিয়েল এতো কথা নিজমুখে তোমাকে বলেছে?

–হ্যাঁ, তবে একসঙ্গে নয়, বারে বারে, কিছু কিছু করে। কিছু আপনা থেকেই বলেছে আর কথায় কথায় নিজের অজান্তে বেরিয়ে পড়েছে। এই আর কি।

-তারপর?

-তারপর আর কি, হেনরীর যখন মৃত্যু হয় মুরিয়েল একেবারে নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য। তার মনোগত বাসনা ছিল, মিঃ ডেভনের নিকট থেকে ডিভোর্স পেলেই বিয়ে করে ফেলবে দুজনে। কিন্তু সে স্বাদ আর পূর্ণ হল না। অগত্যা শিশু কন্যাটিকে নিজের আপন পিতার কাছে রেখে মুরিয়েল একটা হোটেলে রিশেপসনিস্ট-এর কাজ নিল। মুরিয়েল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কুসংসর্গে পড়ে অধঃপতনের পথে পা ফেলল সে। নেশা করা ধরল–শুধু মদ নয়, মর্ফিন, হেরোইন ইত্যাদি নেশাও ছিল। যা ঘটার তাই ঘটল। চাকরিটা গেল। নিজেই বা কী খাবে আর মেয়ের মুখেই বা কী তুলে দেবে? পরিশেষে তাকে গনিকাবৃত্তির খাতায় নাম লেখাতে হল। চেহারা ভালো, রূপ যৌবন অটল ও অনড়, তাই পেশা জমে উঠতেও দেরী লাগল না। মেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে পড়াতে লাগল। সেই সঙ্গে নিজেও চলে এল নিউইয়র্ক ছেড়ে এই শহরে। এখানেই পরিচয় হল জনি উইলিয়ামরে সঙ্গে।

এই পর্যন্ত বলে থামল এডরিস। বেইগলার আর হেরে কাপে আরো খানিকটা কফি ঢেলে দিয়ে বলল, আমার মনে হয়, এর পরের ঘটনা আমার চেয়ে জনিই ভালো বলতে পারবে। আপনারা বরং তার সঙ্গে একবার দেখা করুন।কারণ, সে আমার চেয়ে মুরিয়েলকে আরো অনেক কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছে।

হেস্ এবার নিজেই এক কাপ কফি ঢেলে নিয়ে তাতে দুএক চুমুক দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, জনি এ জগতের মায়া ত্যাগ করেছে। মুরিয়েল তাকে ভবনদী পার করে দিয়েছে।

আচ্ছা এডরিস! তোমার বান্ধবী তোমাকে এতকিছু বলেছে, আর এই খুনের ব্যাপারেই মুখ খোলেনি?

এডরিস চুপচাপ বসে রইল খানিকক্ষণ বড় বড় চোখ করে। তারপর বলল, না, বলেনি। অবশ্য ওর হাবভাব থেকে শুধু এটুকু বুঝেছিলাম কিছু একটা কাণ্ড নিশ্চয়ই বাঁধিয়ে এসেছে মুরিয়েল। তবে কারো প্রাণ নিয়ে এসেছে তা বুঝতে পারিনি। কারণ ও মদ্যপানে আসক্ত ছিল তাই নিজের মধ্যে সে ছিল না। তবে জনির ভাগ্যে এরকম যে কিছু একটা ঘটবে তা জানাই ছিল। ব্যাটা নীচ, চুগলি খোর, কুত্তির বাচ্চা!

-এরকম একটা কিছু পাওনা জনির ভাগ্যেই বা ছিল কেন? কী করেছিল সে? জানতে চাইলেন বেইগলার।

–ও ব্যাটার জন্য মুরিয়েলকীনা করেছিল। ওর খাওয়া, থাকা, জামাকাপড়, বাবুয়ানার সমস্ত খরচ কিনা জুটিয়েছে মুরিয়েল। জনি ওকে প্রথম থেকেই জোঁকের মতন রক্ত চুষে চুষে খেয়েছে। মুরিয়েল কোন প্রতিবাদ জানায়নি, নিঃশব্দে সব সয়ে গেছে। শেষে ব্যাটা ওরই রোজগারের পয়সা নিয়ে প্যালেস হোটেলের এক আধবুড়ি নাচিয়ে মাগীর সঙ্গে ফুর্তিতে মেতে উঠেছিল। এ নিয়ে মুরিয়েল কিছু বলার জন্য উদ্যত হলেই মহা হম্বিতম্বির পাহাড় জুড়ে দিত ব্যাটাচ্ছেলে।

শেষে ছয়মাস ভীষণ কষ্টে দিন কাটিয়েছে মেয়েটা। ড্রাগের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে গিয়েছিল শরীর মোটেই ভালো যাচ্ছিল না, খদ্দেরও কমে আসছিল…নোরেনার স্কুলের ফিসবাকি পড়ে যাচ্ছিল, এমন আরও বহু সংকটের সম্মুক্ষীণ হয়েছিল সে।

ধার চেয়েছিল কিছু জনির কাছ থেকে। কিন্তু পরিবর্তে এক পয়সাও দিল না জনি, উল্টে নানা খোঁটা দিত মুরিয়েলকে।

নোরেনা জানে এসব?

না, মুরিয়েল তাকে কিছু জানায়নি। তার মা একজন গণিকা, এটাই তাদের জীবিকার একমাত্র পথ। এ সবকিছুই তার কাছে অজ্ঞাত।

-তা তুমিতো ওর প্রাণের বন্ধু ছিলে, তুমি আজ ওর এই দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে না কেন?

–আমি দিতে চাইলেও সে কখনই গ্রহণ করত না।

কেন?

এডরিসের মুখটা মলিন হয়ে গেল।

সে উদাস কণ্ঠে বলে উঠল, কারণ, সে আমায় মানুষ বলে গণ্যই করে না। আমায় কৃপা করত, করুণাও বর্ষণ করত কিন্তু কখনো সমকক্ষ বলে মনে করত না।

হেস্ আর বেইগলার আবার নিজেদের মধ্যে একবার চোখাচোখি করলেন। বেইগলার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল হে, এবার না হয় ওটা যাক টিকি। কফি খাওয়ানোর জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

হেসও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। দুজনে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। দরজার কাছে পৌঁছে হেস্ মৃদু হেসে বলে উঠলেন, ওহে বেঁটে বকেশ্বর! নিজের নাসিকাকে অপরিষ্কার রেখো না যেন, কিছু বুঝলে?

দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন তারা।

কয়েক মিনিট চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল এডরিস। তার মুখ রক্তিম, চোখ জোড়া উজ্জ্বল আর হাত মুষ্টিবদ্ধ।

ধীরে ধীরে সে ফিরে এল নিজের বসবার জায়গায়। ঘড়ি দেখল : সকাল সাতটা পনেরো। এক মুহূর্তের জন্য ভাবল তারপর টেলিফোন স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে একটা বিশেষ জনের উদ্দেশ্যে ডায়াল ঘোরাল।

রিসিভারে ধ্বনিত হল একটি মহিলা কণ্ঠ : দিস ইজ গ্রাহাম কো-এড কলেজ।

-ডাঃ গ্রাহামের সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। খুব দরকারী।

–আপনি কে কথা বলছেন?

আমাকে, আপনি চিনবেননা। আমি এডোয়ার্ড এডরিস। আপনাদের স্কুলের একজন ছাত্রী। মিস নোরেনা ডেভনের ব্যাপারে কথা বলতে চাই ওর সঙ্গে। বিশেষ দরকার।

-একটু ধরুন তাহলে।

কয়েক সেকেন্ড পরে শোনা গেল ভরাট গলার পুরুষ কণ্ঠস্বর : দিস ইজ ডঃ গ্রাহাম।

ডাঃ গ্রাহাম? আমি এডোয়ার্ড এডরিস বলছি। ডেভন পরিবারের একজন পুরনো বন্ধু আমি। নোরেনা আমার পরিচিত। নোরেনার মা এক সাংঘাতিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। সিরিয়াস কেস। অবশ্য নোরেনাকে এতো কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই, অকারণে সে অস্থির হয়ে পড়বে। শুধু দুর্ঘটনার কথাটুকুই বলবেন। নোরেনার মা তার কন্যাকে দেখার জন্য খুব ছটফট করছেন। ওঁর অ্যাটর্নী মিঃ স্ট্যানলী টেরল এখন গ্রেটার মিয়ামিতেই আছেন। তাঁকেও এ সংবাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনি এসে পড়বেন। এটাই স্থির হয়েছে আমার সঙ্গে তিনি বোর্ডিং থেকে নোরেনাকে নিয়ে আসবেন, বুঝেছেন?

ডঃ গ্রাহামকে নিরুত্তর দেখে এডরিস আবার বলে উঠল, কী ভাবছেন, ডক্টর?

-নোরেনা কী মিঃ টেরলকে চেনে?

খুব সম্ভব নয়, তবে নামটুকু জানে বোধহয়। আমাকে খুব ভালো করে জানে ও পূর্ব পরিচিতি আছে আমার সঙ্গে নোরেনার। বুঝতেই পারছেন সমগ্র পরিস্থিতি। ভদ্রমহিলা মৃত্যুশয্যায়। মেয়েকে একবার শেষ দেখা দেখতে চান। আপনার যদি কোন আপত্তি থেকে থাকে তবে না হয় আমি যাই। কিন্তু এর ফলস্বরূপ যে সময়ের অপচয় হবে তার মধ্যে যদি কিছু অঘটন ঘটে যায় তবে দুপক্ষেরই আফশোষের আর সীমা থাকবে না, ডক্টর।

কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপরেই গলা ঝেড়ে নিয়ে ডঃ গ্রাহাম জানালেন :ঠিক আছে, মিঃ এডরিস। আমি নোরেনাকে তার মার দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে তাকে পাঠাবার জন্য তৈরী করে দিচ্ছি। আর কিছু?

নো, থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর।

সিরিভারটা যখন ক্রেডেলে রাখল এডরিস, তখন তার চোখে মুখে চাপা উল্লাসের ছাপ স্পষ্ট।

ডঃ গ্রাহামের অফিসে টেবিলের দুধারে মুখোমুখি বসেছিলেন ডঃ গ্রাহাম আরফিল অ্যালগির। ফিলের পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ দামী এবং রুচিসম্পন্ন। সুশ্রী মুখে সময়নোচিত দুঃখের ছায়া।

ফিল বলছিল-মিঃ এডরিসের কাছে যে সংবাদ পেলাম, তাতে আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে নোরেনা শেষপর্যন্ত তার মাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবেন কিনা। আপনি যদি একটু তাড়াতাড়ি নোরেনার যাবার ব্যবস্থা করে দেন ডঃ গ্রাহাম, তবে খুব উপকৃত হই।

-ও-তো তৈরীই ছিল। তবে এখনো আসছেনা কেন কে জানে? আচ্ছা, আমি একটু এগিয়ে দেখছি–

চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন ডঃ গ্রাহাম, ঠিক সেই মুহূর্তে নোরেনা এসে প্রবেশ করল তার অফিস ঘরে।

পরনে কুচি দেওয়া ধূসর রঙের স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ, কালো টুপি, কালো মোজা আর কালো জুতো। হাতে ধরা ধূসর রঙের শার্ট কোট, চোখে চশমা।

নোরেনার দিকে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেল ফিল মৃদু করমর্দন করে কোমল কণ্ঠে বলে উঠল, তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারছ না, নোরেনা। আমি তোমার মায়ের অ্যাটনী। কিছুদিন হল তিনি আমার ক্লায়েন্ট। এই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে তোমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় এভাবে হবে আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। যাইহোক, এবার যাওয়া যাক, মিথ্যে সময় নষ্ট করে কী লাভ? পথও তো নেহাৎ কম নয়।

ফিল অ্যালগিরের বুইক যথাসম্ভব দ্রুতবেগে চলেছে গ্রেটার মিয়ামির হেভীট্রাফিক ভেদ করে। পাশাপাশি বসে নোরেনা আর ফিল। দুজনেই নীরব। নীরবতা ভঙ্গ করে নোরেনা খানিকটা ইতস্ততঃ হয়েই জিজ্ঞাসা করল : মাকি তখন নেশায় বেঁহুশ ছিলেন।

ফিল একটু অবাক হল নোরেনার এই রকম প্রশ্নের ধরন ধারণে। শুধু জানাল, মাতাল? তার মানে? ছিঃ নোরেনা, নিজের মার সম্বন্ধে এ ধরনের মন্তব্য করা শোভনীয় নয়।

নোরেনা কিন্তু ফিলের এই কথায় বিন্দুমাত্র লজ্জিত হল না দুঃখও পেল না। বরং–আবেগের বশে বলতে লাগল : এ পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চেয়ে আমার মা আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়। আমি জানি আমার মা মদ খান, নেশাতেও আসক্ত। যদিও এই কথা কোনদিন তিনি নিজ মুখে আমার কাছে স্বীকার করেননি। কিন্তু এ সংবাদ আমার কানে এসেছে। শুধু তাই নয়, আমি জানি কেন আজ তিনি এই চরম দুর্দশার শিকার? আমাকে মানুষ করার জন্যে মা যে নিজেকে কতখানি উজাড় করে ফেলেছেন তা আর কেউ না জানুক আমি জানি। নিজের এই রিক্ততা গোপন করতেই মদের গ্লাস আমার মা স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছেন। তাইতো জানতে চাইছিলাম,দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন কি তিনি নেশার ঘোরে বেঁহুশ ছিলেন?

-না, অন্ততঃ এডরিস আমায় অ বলেনি। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাটা গেছে। যাই হোক তুমি এবার চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো নিজের জায়গায় বসে থাক। বেশী কথালাপ হলে আমার গাড়ি চালানোর আর কিছু ব্যবসাগত ভাবনাচিন্তার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল, কেমন?

মিষ্টি মধুর সুরে হুকুম জারি করল স্বয়ং ফিল। কারণ, কথায় কথায় যদি বোস তার নিজের অজান্তেই নির্গত হয়ে আসে মুখ থেকে। সত্যি কথা বলতে কী সেও তো বিশেষ কিছুই জানে না মুরিয়েল সম্পর্কে।

.

নিউইয়র্ক থেকে রাতের ফ্লাইটের প্লেন ঠিক ঠিক সময়ে এসেই মিয়ামি এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করল। সকাল তখন সাড়ে সাতটা। যাত্রীদের মধ্যে ছিল একজন সপ্তদশী তরুনী। রূপ আর যৌবন যেন উপচে পড়ছে তার সারা শরীর থেকে। মাথায় সাদা স্কার্ফ, পরনে সবুজ সোয়েড জ্যাকেট, কালো আঁটসাট প্যান্ট, গলায় গিট বাঁধা সাদা রুমাল। জ্যাকেটের সামনের দিকটা উন্মুক্ত। তার তলায় যে সাদা শার্ট ছিল তার দুপাশ দিয়ে উত্তেজক ভঙ্গিতে মাথা তুলে উঠেছিল সুগোল, সুগঠিত দুই সুঠাম স্তন। হাই হিল জুতো পরে হাঁটার তালে তালে সে জোড়াও এবং নিতম্বও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছন্দে ওঠানামা করছিল।

তার এই ছন্দোময় চলন, চোখ ধাঁধানো রূপের ছটা,বুকে দোলা জাগানো যৌবন মাধুর্য দেখে আত্মহারা হয়নিঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেনি, এমন নর-নারীর সংখ্যা খুবই কম ছিল এয়ারপোর্টে।

তরুণীর নামইরা মার্শ, মুরিয়েলের সবচেয়ে ছোট বোন। মানুষ হয়েছেব্রুকলীনের বস্তিতে। ইরার চেয়ে মুরিয়েল বাইশ বছরের বড়। মুরিয়েল যখন গৃহ ছেড়ে আসে, মার্শ পরিবারের জীবন থেকে মুছে যায় চিরদিনের মত,ইরা তখন পৃথিবীর আলো দেখেনি। এগারোজন ভাইবোনদের মধ্যে ইরা সর্বকনিষ্ঠা। চার ভাই মারা যায়, হয় দুর্ঘটনা না হয় মদ পান করে, মারামারি করতে গিয়ে ছুরি বা গুলিবিদ্ধ হয়ে।

দুজন ডাকাতির দায়ে সারা জীবনের সাজা মাথায় নিয়ে জেল খাটছে। মুরিয়েল আর তার তিন বোন বক্তির ঐ নরক জীবন পেছনে ফেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বৃহত্তর জীবনের বিভিন্ন পথে। একমাত্র মুরিয়েলই ক্ষণিকের জন্য দর্শন পেয়েছিল জীবনের উজ্জ্বল দিকটা। তারপর সেও তার আত্মীয় পরিজনদের মতো তলিয়ে যায় অতল অন্ধকার গহ্বরে। ইরার ভাগ্যে যে কী লেখা আছে তা এখনো অজানা। বর্তমানে এডরিসের কল্যাণে ইরা আজ জেনেছে তার বড় দিদির কথাকে সে জন্মের পর চোখে দেখেনি, শুধু মা বাপের মুখে এক আধবার তার নামটুকুই শুনে এসেছে।

মাস চারেক আগে পাবলিক বাথ থেকে যখন স্নান সেরে সদ্য ফিরে আসছিল ইরা, তার নজরে পড়ল তাদের গলির মোড়ে একটা লাল রঙের মিনি কুপার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইরা দেখেও না দেখার ভান করল। সে গাড়ির পাশ কাটিয়ে গলিতেই ঢুকতে যাবে সেই মুহূর্তে খুলে গেল বন্ধ থাকা গাড়ির লাল দরজা। ব্রাউন স্পোর্টস জ্যাকেট ও গ্রে ফ্ল্যানেল পরা এক অদ্ভুত রকমের বেঁটে লোক তিড়িং করে লাফিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর আকৰ্ণ বিস্তৃত হাসিতে মুখ তুলে বলল, তুমি যদি ইরা মার্শ হয়ে থাক তবে তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে এই ইরা। মাথা ঝাঁকিয়ে সামনে দাঁড়ালো, সেই বেঁটে গড়নের বামনকে ভুরু কুঁচকে লক্ষ্য করে উপেক্ষার সুরে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি ইরা মার্শ। কিন্তু তুমি, তুমি কে? আমি পথে-ঘাটে দাঁড়িয়ে কোন অচেনা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করি না।

এডরিস হাসিমাখা মুখেই জবাব দিল, আমি তোমার দিদি মুরিয়েল মার্শের বন্ধু। তোমার দিদির ব্যাপারেই কথা ছিল। তাও কি শুনতে প্রস্তুত নও?

অচেনা ব্যক্তির মুখে দিদির নাম শুনে কেমন থতমত খেয়ে গেল ইরা। শুধু নাম ছাড়া দিদির, বাকি সবকিছুই ছিল তার কাছে অজানা। তাই এতো বছর বাদে সেই অদেখা অচেনা অজানা দিদির নাম শুনেও তার বিষয়ে কিছু কথা জানার সুযোগ পেয়ে, কৌতূহলী মন তা জানার জন্য উসখুস করছিল।

আশে-পাশে ততক্ষণে মানুষের ভিড় জমে উঠেছে ইরার মতন একজন অপরূপা সুন্দরী তরুণীকে আধবয়সী বেঁটে বামনের সঙ্গে পথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে। বেগতিক দেখে ইরা চটপট মিনির দরজা খুলে উঠে বসল ড্রাইভারের পাশের সীটে। ইঙ্গিত বুঝে এডরিসও সময় নষ্ট করল না গাড়িতে উঠে বসতে। তারপরেই ছুটে চলল লাল মিনি।

গলির মুখ ছাড়িয়ে বেশ ক্ষানিকটা পথ চলে আসার পর এডরিস বলল, আমার নাম টিকি এডরিস তোমায় সঙ্গে নিয়ে আমি একটা কাজের ধান্দায় আছি, যা করতে পারলে আমরা দুজনেই লাভবান হতে পারব, হাতে কিছু মালকড়িও আসবে।

আমায় নিয়ে? আমায় চেন না জান না অথচ আমায় নিয়ে কাজের ধান্দায় আছ! আশ্চর্য!

এডরিস হেসে জবাব দিল: চিনতামনা একথা সত্যি এবার তো পরিচয়পর্ব শেষ। আর জানার কথা বলছ? আমি তোমার সম্পর্কে যা জানি, তুমি নিজেও তোমার সম্বন্ধে ততোখানি জান কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।

কথা বলতে বলতে একটা নির্জন জায়গায় দেখে গাড়ি থামাল এডরিস।কথাটার মধ্যে কোথায় কোন মিথ্যা নেই, খুবই সত্যি। মাস খানেক আগে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় একদিন মুরিয়েল তার এই বোনের কথা বলেছিল এডরিসকে। সে বলেছিল : বোনটাকে আজ অবধি চোখের দেখাও দেখিনি আমি। সে যে এ পৃথিবীর আলো দেখেছে তাই জানতাম না। একদিন হোটেলে আমাদের পাড়ার বেশ কিছু লোক এসেছিল খানা-পিনার উদ্দেশ্যে। আমায় দেখে তারা বলাবলি করছিল ওর কথা। বলছিল আমাদের পাড়ার মার্শদের ছোট মেয়েটাকে অবিকল ঐ রিসেপশনিস্ট মেয়েটির মতন দেখতে, তাই না? শুনে তো আমি হতবাক! আমার মেয়ের বয়সী যে আমার বোন থাকতে পারে এ ব্যাপারে আমি কোনদিন সত্য জানার জন্য আগ্রহী ছিলাম না।

কথাটা এডরিসের মনকে বেশ নাড়া দিল, তাই গেঁথেও গেল একেবারে। কারণ সে যে কাজের উদ্দেশ্যে ছিল তাতে একজন মেয়ের খুবই প্রয়োজন ছিল। যে সে মেয়ে এই স্থানে বসার উপযুক্ত নয়। সে হবে চটপটে, সাহসী, চাতুর্যে ভরা আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করবে। বহু সন্ধান করেও এমন মেয়ে তার কপালে জুটছিল না। মুরিয়েলের কথা শুনে তার বোনটাকে একটু বাজিয়ে নিতে চাইল এডরিস। তাই সে বিলম্ব না করে, নিউইয়র্কের এক বে-সরকারী পেশাদার এনকোয়ারী এজেন্সীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের জানাল :ষোল-সতেরো বছরের সুন্দরী এক নারীর বর্ণনা কতকটা এই রকম : এখানে যে মুরিয়েলের একটি সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরল নাম ইরা মার্শ, নিবাস বর্তী অঞ্চল। তার সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ভাল মন্দ সমস্ত সংবাদ চাই। ।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে এজেন্সীর দেওয়া একটা পাঁচ পাতার রিপোর্ট ছবি সমেত এডরিসের হাতে এসে পৌঁছল, রিপোর্ট পড়ে এডরিসের মন খুশিতে ভরে গেল। তার কাজের পক্ষেই এই মেয়ে উপযুক্ত।

তার প্ল্যানের বিরাট কঠিন বেড়ার প্রথম ধাপ যে স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করে গেল। এই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তার দুশো ডলার নিজের পকেট থেকেই ব্যয় করতে হয়েছে, তবে এই নিয়ে আফশোস করার মতন নয় সে। সে জানে এমন একটা সময় তার দ্বারে উপস্থিত হতে চলেছে। যে সময় দুশো গুণ টাকা পুনরায় তার পকেটে ফিরে আসবে স্ব-মহিমায়।

ইরা খুব জবরদস্ত মেয়ে (রিপোর্টে তাই বলছে) ছোট-খাটো চুরি চামারিতে পাকাঁপোক্ত সে। মোকামিন গ্যাঙের (পাড়ার উঠতি মস্তান তরুণদের দল) সঙ্গেও সে যুক্ত। এই দলের সর্দার জে ফার নামের এক আঠারো বছর বয়সের তরুণ। ফারের বান্ধবীর নাম লিয়া ফ্লেচার। মনের সংগোপন আসনে ইরার কামনার পুরুষ ছিল এই ফার। লিয়ার তদারকীর জন্য কাছে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পেত না। ফারের কাছে যাওয়ার জন্য পথের কাঁটা লিয়াকে আগে সরাতে হবে। বারংবার হতাশা আর ব্যর্থতার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ইরা তার মনকে আরো দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পেরেছে, মনে মনে এক মতলব আঁটল ইরা।

গোপনে সে জেমকে এড়িয়ে একমাস ধরে কিছু ক্যারাটের প্যাঁচ শিখে নিল। নিজেকে সে লিয়ার একজন প্রতিপক্ষরূপে গড়ে তুলতে পারল। চ্যালেঞ্জ জানাল তার পথের প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী স্বয়ং লিয়াকে। এরপর আর কি?

একদিন একটা পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে দলের প্রধান প্রধান সদস্যবৃন্দের উপস্থিতিতে ফারকে পাওয়ার দাবী নিয়ে সম্মুখীন হল এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বিনী। একমাত্র পরনের ভূষণ বলতে প্যান্টি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। থাকাটা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না। শুরু হল লিয়া ও ইরার দ্বৈরথ সংগ্রাম–অবশ্যই উন্মুক্ত হস্তে।

সেই প্রচণ্ড সংগ্রামে ওদের হিংস্রতা আর তাণ্ডবতা দেখে দলের প্রায় সকলেই এমনকি যাকে নিয়ে এই তাণ্ডব নৃত্য স্বয়ং ফারও মাঝে মধ্যে এই ভেবে অস্থিত হয়ে পড়ছিল যে : এবার বুঝি মেয়েটা এই অল্প বয়সে বেঘোরে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়বে। কিন্তু বাধা দেবার নিয়ম ছিল না বলেই কেউ যুদ্ধ থামাতে এগিয়েও এলনা। শেষ পর্যন্ত ইরার গলায়ই জয়মাল্য উঠল। অবশ্য তার পুরস্কারস্বরূপ ফারকে নিজের প্রণয়ীরূপে পেলেও তাকে দিন পনেরো ডাক্তারের সেবা-শুশ্রূষায় থাকতে হয়েছিল।

রিপোর্টের অন্ত এই ভাবে :এই তরুণীটি কামুকী,কুটিলা,বদমেজাজী, স্বার্থপর এবং অনৈতিক রূপেও তার যথেষ্ট সুনাম। কোন কিছু নিজের করে পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে এমন কোন দুঃসহ কাজ ছিল না যা সে করতে পারে না। ইরার মূল অস্ত্র ছিল ইরার সাহসিকতা, বুদ্ধিদীপ্তা, চতুরা, বিচক্ষণা, দৃঢ়সংকল্পশালিনী, সর্বোপরি সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারিণী। শুধু তাই নয় লেখাপড়া, বিভিন্ন ধরনের অ্যাডিং মেশিন ও কম্পিউটারে সে তার পারদর্শীতা বজায় রেখেছিল।

এডরিস যা আশা করেছিল এই মেয়েটি তার চেয়ে অনেক বেশী প্রতিভাশালী। তাই সে সময় নষ্ট না করে জাল বিছানোর কাজে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। ইরাকে দেখে তার সুপ্ত বাসনা আরো দৃঢ় হল–একে দিয়েই তার কাজ হবে। তবে নিজের মতো করে ঘষে মেজে নিতে হবে এই যা।

এডরিস বলল, বুঝলে তো? আমি তোমার সম্পর্কে না জেনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। এবার বলো, তুমি কি কিছু টাকা উপার্জন করতে চাও?

ইরা একটু ভেবে নিয়ে বলল:এতো সকলেরই কল্পিত ইচ্ছা, তবে আমার চাওয়া দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে : কত পাব আর তার জন্য আমায় কী বলিদান দিতে হবে?

এডরিস আড়চোখে ইরাকে একবার দেখে নিয়ে সহাস্যে জিজ্ঞাসা করল :বেবী তুমি কখনো স্বপ্ন দেখেছ?

–বহুবার।

—কত টাকা পাবার আশা তুমি কর?

–পাবার আশা অনেক।

–তবু? তোমার কল্পনার পরিমাণ কত?

ইরা থতমত খেয়ে গেল। তারপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, যদি বলি এক লক্ষ ডলার।

-ব্যস! হো হো করে বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠল এডরিস। হাসতে হাসতেই বলল, তোমার কল্পনার দৌড় এই পর্যন্ত? এত অল্পে সন্তুষ্ট তুমি। দশ-বিশ পর্যন্ত ওঠার ক্ষমতায় কুলোল না? নিছক স্বপ্ন তো!

ইরা বিরক্তিসূচক মুখ নিয়ে রিস্ট ওয়াচের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, বাজে কথা এবার থামাও, অনেক হয়েছে। গাড়ি ঘোরাও। বাড়ি যেতে হবে আমায়, হাতে কাজও কিছু আছে।

বাড়ি ফেরার এতো তাড়া কিসের, বাড়ি ফিরবে তো নিশ্চয়ই। আগে আমার কথা শেষ করতে দাও তারপর না হয় তোমার মতামত দিওবাজে না কাজের তা শুনলেই বুঝতে পারবে, কোমল কণ্ঠে জবাব দিল এডরিস।

একটু থেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল : আমি যদি বলি তোমার প্রাপ্য পঞ্চাশ হাজার ডলার, তবে কী কোন বিষয়ে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস তোমার আছে?

ইরাও পাল্টা দৃষ্টিতে তার প্রতিপক্ষকে একবার নিরীক্ষণ করল। বোঝবার চেষ্টা করল সে ঠাট্টা বিদ্রূপ করছে নাকি।

কিন্তু এডরিসের মুখভাব, তার চাউনিতে তামাসার কোন ইঙ্গিত ছিল না বরং তার পরিবর্তে সিরিয়াস হবার ভাব-ভঙ্গিমাই ছিল প্রকট। সহসা সে রক্তের মধ্যে এক অনাস্বাদিত পূর্ব চাঞ্চল্য অনুভব করল। নিজেকে অতিকষ্টে সংযত করে ধীরেসুস্থে প্রশ্ন করল : কোন বিষয়ে আমার ঝুঁকি নিতে হবে। যেমন আমি আমার স্বাধীনতার ঝুঁকি নিজের কবলে নিয়ে নিয়েছি। (

বল কি। তোমার স্বাধীনতার ঝুঁকির মূল্য পঞ্চাশ হাজার ডলার? তুমি সত্যি হাসালে। শুধু স্বাধীনতা কেন? তুমি তোমার যথাসর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে সব কিছুরই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছ ঐ টাকার জন্য আর কিছু?

শোন,টাকাটা কিন্তু আমি নিজে হাতে তোমার হাতে তুলে দেব না। তোমার বুদ্ধি ও ক্ষমতার জোরে সেই টাকা উপার্জন করতে হবে।

–কেমন করে?

পরে আসছি এই কথায়। তার আগে আমার এই প্ল্যানের প্রকৃত ইতিহাস কি তা জেনে নাও।

এই বলে এডরিস তার বয়ান শুরু করল।মুরিয়েলের ব্যাপারে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে বিবাহ করা, আবার স্বামীর ঘর ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করা পর্যন্ত যাবতীয় যা কিছু আছে তা একটু একটু করে ইরার সামনে তুলে ধরল। গভীর মনযোগে ইরা এডরিসের কথাগুলো শুনে যেতে লাগল।

অতঃপর এডরিস ইরাকে তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তুলল:তার প্ল্যানেইরার অবস্থান কোথায়, কী তার অংশ ইত্যাদি সব বিস্তৃত ভাবে বলল, মুরিয়েলের স্বামী আর কখনো তার মেয়েকে দেখেননি, ষোল বছর ধরে মেয়ের কোন সংবাদ রাখেননি। তোমার চেহারা অবিকল মুরিয়েলের মতন। মিঃ ডেভন যদি তোমায় একবার দেখেন তবে ভাববেন–মুরিয়েলই বোধহয় কোন যাদুমন্ত্র বলে আবার তার কিশোরী বয়সে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাই এদিক থেকে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তোমায় তিনি তার নিজের কন্যা রূপে গ্রহণ করবেন নির্দ্বিধায়।

কথাটাতে যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়নি ইরা তা জানত। কেন না কথায় কথা উঠলে তার মা-ই কতবার বলেছে : তুই আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে মুরিয়েল। তার জায়গা দখল করেছিস তুই, ইরা। অবিকল মুরিয়েল হয়েছিস তুই।

এডরিস তার বক্তব্য শেষ করলে ইরা বলল, তানা হয় হল, কিন্তু আমি যার পরিবর্তে ডেভনের মেয়ে সেজে যাব তার ব্যবস্থা কী হবে? সে যদি কোনভাবে এই সত্য জানতে পেরে যায়।

না, সে জানতে পারবে না। জানবেই কী করে? গত সপ্তাহ তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই তো আমি ছুটে এসেছি তোমার কাছে। সে জীবিত থাকলে কি আর আমার এই প্ল্যান বাস্তবে পরিপূর্ণ রূপ দেবার সাহস করতাম আমি? সে মারা যেতেই তো এই মতলবটা আমার মাথায় খেলে গেল। অবশ্য তোমার দিদি গত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে, মনে হয় বড় জোর তিন থেকে চার মাস। তার যা অবস্থা, ঐ সময় পর্যন্ত জীবিত থাকে কিনা সন্দেহ। হেরোয়িনের বিষ তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেছে।

ইরা আবার প্রশ্ন করল : দিদির মেয়েটা মরল কী সে?

জলে ডুবে। অম্লান বদনে মিথ্যে বলে গেল এডরিস। সাঁতার কাটতে নেমেছিল সমুদ্রবক্ষে, হাতে পায়ে খিল ধরে হঠাৎ, সাহায্যের জন্য কেউ ছুটে আসার আগেই সে অতল গহুরে তলিয়ে গেল।

আর কিছু বলল না ইরা। তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এডরিস জিজ্ঞাসা করল :শেষ পর্যন্ত কী ঠিক করলে? কাজটা করবে কি করবে না? ঝুঁকি আছে নিঃসন্দেহে আর টাকার অঙ্ক পঞ্চাশ হাজার ডলারও তো কিছু কম নয়।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ইরা বলল, আমায় কয়েকটা দিন ভাবার অবকাশ দাও টিকি। তুমি বরং আগামী রবিবার এখানে একবার পদধূলি দিও। সেই দিনই আমি আমার মতামত জানিয়ে দেব তোমায়।

–অসম্ভব! পরের চাকরি করে আমায় বেঁচে থাকতে হয়। ঘন ঘন এত দূরে আসা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আজ এসেছিছুটি ভাগ্যে জুটেছে বলে। এক কাজ কর, এই বলে পকেট থেকে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা কার্ড বের করে ইরার হাতে তুলে দিয়ে বলল, তোমার মন আর মতি স্থির হলেই এখানে আমায় টেলিগ্রাম করে দিও–হ্যাঁ বা না এই দুই শব্দের মধ্যে তোমার মর্জি মতো যে কোন একটা বেছে নিয়ে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তোমার দিদি মৃত্যুর কোলে মাথা না রাখা পর্যন্ত একাজে আমরা হাত দিতে পারব না, তাই ব্যস্ততার কোন কারণ নেই। ঠিকঠিক ভাবে কাজ হাসিল করতে হলে হাতে সময়ের প্রয়োজন। আমি আমার কাজ সঠিক পথেই করতে চাই। বুঝলে?

এয়ারপোর্টের রিসেপশান লবীর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই সব কথাই চিন্তা করছিল ইরা। এরপর বার দুয়েক মুখোমুখিও হয়েছে টিকির সঙ্গে। প্ল্যান আর প্রোগ্রাম এই দুটি বহুবার ঘষে মেজে পরিষ্কার করেছে সে। সব শোনার পর ইরার মনে হয়েছে–প্ল্যান নিখুঁত ও নির্ভুল। সাফল্য এই পথে আসতে বাধ্য। মা বাবাকে ছেড়ে আসতে মনে যতব্যথা অনুভব করেছিল তার থেকে অনেক বেশী কষ্ট পেয়েছিল শুধু ফারকে ছেড়ে আসতে। তাকে কোন কথা ইরা জানায়নি। শুধু বলেছে : ব্রুকলিনের বাইরে ভালো একটা চাকরী তার ভাগ্যে জুটেছে, আপাততঃ এখন সে সেখানেই থাকবে।