লুসাই পাহাড়ের শয়তান – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
০১. রাঙ্গামাটির পাহাড়ে আমন্ত্রণ
বিকেল বেলা আসরের নামাজে বসেছিলেন দিদু। সালাম ফিরিয়ে লম্বা একটা মোনাজাত করার কথা ভেবেছিলেন। ঠিক তখনই নিচের তলায় কলিং বেল বাজলো। শব্দ শুনে তিনি অতি সংক্ষেপে মোনাজাত সারলেন। জানেন বাড়িতে এখন একটা তুলকালাম কাণ্ড হবে। কারণ তার ক্লাস এইটে পড়া ছোট নাতনি রিমি স্কুল থেকে ফিরছে। চার মাসও হয়নি তারা এ পাড়ায় এসেছেন। এরই ভেতর গোটা পাড়ায় খবর হয়ে গেছে–পুলিসের নতুন এস পি সাহেবের ছোট মেয়ের দস্যিপনায় ছেলেরা পর্যন্ত তটস্থ থাকে।
রিমির দেড় বছরের বড় বোন সিমি, ক্লাস নাইনে পড়ে, এমনই শান্ত যে বাড়িতে থাকলে কাক-পক্ষিটিও টের পায় না। ফরসা, হালকা পাতলা গড়ন, চোখে চশমা, নরম গলায় কথা বলে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখে, লেখাপড়াতেও ক্লাসে সবার ওপরে থাকে-সিমিকে নিয়ে বাবা মার গর্বের শেষ নেই। আর রিমি কোনো রকমে পরীক্ষায় পাস করে, সারাদিন খেলাধুলো নিয়ে মেতে থাকে, রোদে পুড়ে গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরে ঘোরে–কখন কী অঘটন ঘটায় এ নিয়ে বাবা মা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকেন।
ওদের বাবা আফজাল হোসেন গত তিন বছর যশোরের এস পি ছিলেন, সম্প্রতি ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছেন। মা যশোরে সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাঁর বদলি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে হয়নি। গত তিন মাস ছুটোছুটি করে এ মাস থেকে ঢাকা কলেজে জয়েন করেছেন।
ঢাকায় সিমি রিমিকে একস্কুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসে কোনো স্কুলই নতুন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে চায় না। আর্মিতে বন্ধু বান্ধব ছিলো বলে রিমিকে শাহীন স্কুলে আর সিমিকে শহীদ আনোয়ারা স্কুলে ভর্তি করানো গেছে। দুজনেই চারটা থেকে সাড়ে চারটার ভেতর বাড়ি ফেরে। দিদু তখন নামাজে থাকেন। সিমি এলে দুবার বেল বাজায়, অপেক্ষা করে, চুপচাপ ঘরে এসে কাপড় ছেড়ে নাশতা খেয়ে ছাদে ঘুরতে যায়। দিদু প্রাণভরে মোনাজাত করার যথেষ্ট সময় পান। কিন্তু রিমি আগে এলে তার রেহাই নেই। দরজা না খোলা পর্যন্ত ক্রিং-ক্রিং করে কলিং বেল অনবরত বাজতে থাকবে। একবারে তিন সিঁড়ি লাফিয়ে ওপরে উঠবে। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বুয়া আমার নীল প্যান্ট কই, শামসু ভাই আমায় র্যাকেট কেন আনোনি,–এমনি সব চিৎকারে বাড়ি মাথায় করবে। তারপর বিকেলের নাশতা কোনো রকমে নাকে মুখে গুঁজে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।
সেদিন কলিং বেল শুনে তড়িঘড়ি নামাজ শেষ করে উঠতে না উঠতেই রিমি এসে দিদুকে জড়িয়ে ধরলো-এই দেখ দিদু, স্পোর্টস-এ আমি ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। রিমির হাতে মস্ত বড় সোনালি রঙের কাপ, চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছে। দিদু ওর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ভারি খুশি হয়েছি। এখন যাও, মুখ হাত ধুয়ে নাশতা খেয়ে নাও।
আপু আসেনি এখনও? বলে জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই রিমি গলা তুলে ডাকলো–আপু, ও আপু, দেখে যা।
দিদু বলতে যাবেন–সিমি এখনও আসেনি, ঠিক তখনই দরজায় দুবার কলিং বেল বাজলো। দিদু হেসে বললেন, সিমু অনেকদিন বাঁচবে। যা, দরজা খুলে দে।
দিদুকে ছেড়ে এক ছুটে রিমি নিচে গেলো। দরজা খুলেই সিমিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে সুখবরটি জানালো। রিমির উচ্ছ্বাসের চাপে সিমির তখন দম আটকে যাওয়ার দশা–আরে ছাড় ছাড়, আমাকে নিঃশ্বাস ফেলতে দে। তুই আমাকে মেরে ফেলবি দেখছি।
আমার লক্ষ্মী আপু! বলে সিমির গালে চুমু দিয়ে রিমি আবার তিন সিঁড়ি টপকে ওপরে ওর নিজের ঘরে গেলো।
ওদের দজুনের বেডরুম পাশাপাশি। মাঝখানে দরজা আছে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার জন্য। দরজাটা সব সময় খোলাই থাকে। সিমি ঘরে এসে ওয়ার্ডরোব খুলতে খুলতে পাশের ঘরে দেখলো রিমি যথারীতি জুতো, মুজো, জামা খুলে সারা ঘরে ছুঁড়ে দিচ্ছে। একপাটি জুতো চেয়ারের ওপর, আরেক পাটি দরজার আড়ালে, জামা টেবিলের ওপর আর বইগুলো সব বিছানায় ছড়ানো। নিজে জামা পাল্টে রিমির ঘরে এসে ওর ছড়ানো ছিটানো বই, জামা, জুতো সব গুছিয়ে রাখলো সিমি। তারপর বিছানায় নতুন কেনা টিনটিনের কমিকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া রিমিকে বললো, চল, নাশতা খাবি।
রিমি মুখ না তুলে বললো, লক্ষ্মী আপু, বুয়াকে বল না আমারটা এ ঘরে দিয়ে যেতে!
টিনটিনের কমিকই হোক আর এনিড ব্লাইটনের অ্যাডভেঞ্চারই হোক-পড়ার সময় রিমির হুঁশ থাকে না। পড়ে আর ভাবে–আহা কখনও যদি ওরকম কোনো তাডভেঞ্চারে নিজেকে জড়াতে পারতাম!
সিমি ওর বোনকে ভালো মতোই চেনে। ডাইনিং রুমে গিয়ে বুয়ার হাতে রিমির নাশতা পাঠিয়ে দিলো। দিদু ডাইনিং টেবিলে সিমির পাশে বসে উল বুনছিলেন । বললেন, আদর দিয়ে তোর বাপ মেয়েটার মাথা খেয়েছে। এ মেয়ের যে কী হবে তাই ভাবি। ফ্রেঞ্চ টোস্ট-এ ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে সিমি মৃদু হেসে বললো, সব ঠিক হয়ে যাবে দিদু।
হ্যাঁরে, পরীক্ষা না শেষ হয়ে গেছে। এখন তোদের আবার কিসের ক্লাস?
কোচিং ক্লাস। ক্লাস টেন-এর পড়া এখন কিছুটা করিয়ে রাখছে। রেজাল্ট আউট হওয়া পর্যন্ত চলবে।
রেজাল্ট দেবে কবে?
পরশু।
রিমিদের রেজাল্ট কবে দেবে?
দুএক দিনের ভেতরই দেয়ার কথা।
ও কি কোচিং ক্লাস করছে?
না দিদু। ওদের স্কুলে তো কদিন ধরে ইন্টার স্কুল স্পোর্ট হচ্ছে।
স্পোর্টস-এ প্রাইজ এনে মেয়েটা তো ঘর ভরিয়ে ফেলেছে। শুধু লেখাপড়ায় কিছু হলো না।
চেষ্টা করলেই ও পারবে দিদু। ওর মাথা খুব পরিষ্কার।
তোমাদের মা দুনিয়ার মেয়ে ঠেঙিয়ে পড়াচ্ছেন, নিজের মেয়েটার দিকে নজরই দেন না।
মাকে যেন ও কত পাত্তা দেয়! বাঘা বাঘা টিউটররাই ওর কাছে ফেল মেরে যাচ্ছেন!
না বাছা, ওর ব্যাপারে তোমার বাপকে একটু শক্ত হতে হবে। ওই তো গায়ের রং লেখাপড়ায় ভালো না হলে এ মেয়েকে বিয়ে দেবে কি করে?
রিমিকে নিয়ে দিদুর দুশ্চিন্তার কারণ জেনে সিমি হেসে ফেললো–তুমি যে কী বলো, মাত্র ক্লাস এইটে পড়ছে, এখনই বিয়ের চিন্তা!
হেসো না বাছা তোমাকে নিয়ে ভাবি না। তোমার যা চেহারা-ছেলেদের লাইন লাগবে বাড়িতে। আমার যত চিন্তা রিমিকে নিয়ে।
চেহারা কিছু না দিদু! আসল কথা হচ্ছে গুণ। খেলাধুলায় ও আজ স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। যত্ন নিলে একদিন দেখবে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হবে। তখন ওর জন্যেই ছেলেদের লাইন লাগবে।
খেলাধুলো নিয়ে ওকে আর নাচিও না। যতই বলো ছেলেরা কখনও অমন হাত পা শক্ত গেছো মেয়ে পছন্দ করে না।
দিদু সেকেলে মানুষ। তাঁর কথা সিমির ভালো লাগলো না। বললো, দিদু, পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। দেশ চালানো থেকে শুরু করে এমন কোনো কঠিন কাজ নেই মেয়েরা এখন যা করছে না। রিমিকে নিয়ে ভেবো না । দেখো তুমি, একদিন ও অনেক নাম করবে।
সিমির কথার কী জবাব দেবেন ভেবে না পেয়ে দিদু আপন মনেই উল বুনতে বুনতে গজ গজ করতে লাগলেন।
মা কলেজ থেকে ফিরলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে। ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অন্যদিন অবশ্য পাঁচটার ভেতর ফেরেন। দিদু বললেন, আজ এত দেরি হলো যে বৌমা?
মা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার এক প্রফেসরের ফেয়ারওয়েল ছিলো।
তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওভালটিন দিয়ে দুধ দিতে বলবো?
দুধ না মা, চা খাবো।
ড্রইং রুমে মার গলা শুনে রিমি ওর কাপ হাতে ছুটে এলো দেখেছো মা, বলতো এটা কী?
দৌড়ের প্রাইজ বুঝি?
শুধু দৌড় না মা হাই জাম্প, লঙ জাম্প আর সুইমিং চারটা ইভেন্টে ফার্স্ট হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।
মা হেসে ওর থুতনি নেড়ে আদর করে বললেন, ক্লাসের পরীক্ষায় একবার ফাস্ট হয়ে আমাদের সবাইকে দেখিয়ে দাও তো মামনি!
একদিন ঠিকই দেখাবো মা! ভেবো না পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়াটা আপুর একচেটিয়া ব্যাপার।
সিমি বললো, একটু আগে দিদুকেও আমি তাই বলছিলাম। তোর মাথা যা পরিষ্কার, সামান্য পরিশ্রম করলেই পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হতে পারিস।
পারিই তো! রিমি মুখ টিপে হাসলো–আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে তোর আদর কমে যাবে সেজন্যেই তো হই না। এই বলে সিমিকে চোখ টিপে নিজের ঘরে চলে গেলো। টিনটিনকে ও গুণ্ডাদের খপ্পরে খুব বিপদজনক জায়গায় রেখে এসেছে। তাড়াতাড়ি বেচারার উদ্ধার পাওয়া দরকার।
আধঘণ্টা পর যখন বাবা অফিস থেকে ফিরলেন––রিমির টিনটিন পড়া শেষ, সিমি তখন হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস পড়ছিলো। বাবা ড্রইংরুম থেকেই গলা তুলে ডাকলেন–আমার মা মনিরা কোথায়, শিগগির এসো।
গায়ের কোটটা খুলে টাইয়ের নট আলগা করে বাবা সোফায় বসেছিলেন : রিমি এলো ওর সাফল্যের কাপ হাতে নিয়ে বাবার পাশে বসে সাড়ম্বরে ওর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিবরণ দিলো। বাবা চোখ বড় বড় করে সব শুনলেন। তারপর রিমির পিঠ চাপড়ে বললেন, দারুণ কাণ্ড তো দৌড়ে ছেলেবাও তোমার সঙ্গে পারেনি?
আমাদের গেম টিচার তো তাই বললেন। যে ছেলেটা দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছিলো ওকে আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। কী শয়তান ছেলে বলে মেয়েদের সঙ্গে আমি কম্পিটিশন করি না।
ভারি অন্যায় মা মনি। আমি জুরি বোর্ডে থাকলে এর জন্য তোমাকে আলাদা একটা প্রাইজ দিতাম।
দিদু ওঁর ঘরে থেকে বেরিয়ে এলেন–এ মেয়েকে লাই দিয়ে আর মাথায় তুলিল না বাপ।
সিমি ও বাবার পাশের সোফায় বসেছিলো। বললো, তুমি কী যেন আমাদের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে বাবা?
ও হ্যাঁ। সিমির দিতে তাকিয়ে বাবা হাসলেন–রিমির এত বড় কাপ দেখে ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাদের আতিক কাকু চিটাগং থেকে চিঠি লিখেছেন। এইটুকু বলে তিনি থামলেন। মুখে মিটিমিটি হাসি, যেন দারুণ কোনো খবর চেপে রেখেছেন।
রিমি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, কী লিখেছে জলদি করে বলো।
মা নিজে চা বানিয়ে এনেছেন বাবার জন্য। তার মতো চা নাকি আর কেউ বানাতে পারে না। মা বললেন, তোমরা বাবাকে একটু রেহাই দাও। অফিস থেকে মাত্র এসেছেন, চা টুকু তো খেতে দেবে!
রাখো তো মা! রিমি আদুরে গলায় বললো, চা কি পালিয়ে যাচ্ছে? বলো না বাবা আতিক কাকু কী লিখেছে চিঠিতে!
কাকু লিখেছে বলবে না রিমি। বলবে লিখেছেন। মেয়ের কথা শুধরে দিলেন মা।
কী লিখেছেন বলো না বাবা?
লিখেছেন বড়দিনের ছুটিতে সবাই যেন রাঙ্গামাটিতে ওর নতুন খামার বাড়িতে বেড়াতে যাই।
কথাটা শুনেই কী মজা বলে দুহাতে বাবার গলা জড়িয়ে চুমু খেলো রিমি।
বাবার নিজের কোনো ভাই বোন নেই। আতিকুর রহমান তার ছোটবেলার বন্ধু, আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি! চট্টগ্রামে থাকেন, চিংড়ি রফতানি করে অনেক টাকা জমিয়েছেন। বছর চারেক আগে রাঙ্গামাটির হিরণছড়িতে ওদের কোম্পানি দেড়শ একর জমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছে রবার চাষের জন্য। শহর থেকে আঠারো মাইল দূরে চমৎকার এক পাহাড়ি ঝরণা আছে সেই জমিতে। ছোট্ট একটা হ্রদ আছে। সেহ্রদের ধারে তিনি বাড়ি বানিয়েছেন। বাবাকে চিঠিতে লিখেছেন–কতদিন তোদের দেখি না। আমারও সময় হয় না যাওয়ার। মেয়েদের তো পরীক্ষা শেষ, ভাবীও নিশ্চয় বদলির জন্য ছুটোছুটি করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। সবাই মিলে চলে আয়, কদিন চুটিয়ে আড্ডা দেবো। তোর তো আবার চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। আমার চিঠি পাওয়া মাত্র টেলিফোন করবি।
মা আতিক কাকুর চিঠি শুনে মৃদু হেসে বাবাকে বললেন, আমি যে জয়েন করেছি তুমি বুঝি জানাওনি!
সময় পেলাম কোথায়! রোজই ভাবি টেলিফোন করবো আর হয়ে ওঠে না। ওকে ফোনে পাওয়াও আরেক ঝামেলা।
রাঙ্গামাটি যাওয়ার আমন্ত্রন পেয়ে রিমি, সিমি দুজনই ভারি খুশি! সিমি মুখে কিছু না বললেও ওর চোখ দুটো চকচক করছিলো। আর রিমি তো বাবার গলা ধরে ঝুলে পড়লো–কবে যাবো বাবা, বলো না!
বাবা ওর কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে বললেন, যেতে বললেই কি যাওয়া যায় রে পাগলি মেয়ে নতুন চার্জ নিয়েছি, এ সময় স্টেশন ছাড়া একেবারেই সম্ভব নয়।
মা শুকনো হেসে বললেন, আমিই বা যাব কিভাবে। মাত্র জয়েন করেছি, এক বছরের আগে ছুটির কথা মুখেও আনা যাবে না।
তাহলে? কাঁদো কাঁদো গলায় রিমি বললো, স্কুল ছুটির এক মাস বুঝি আমাদের বাড়িতে বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
বন্দী কেন থাকবে মামনি। বাবা ওর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, শুক্রবারগুলোতে আমরা চিড়িয়াখানায় যাবো, বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবো, ন্যাশনাল পার্কে পিকনিক করবো। অনেক মজা হবে!
ছাই মজা হবে! রিমি ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, চিড়িয়াখানা আর বোটানিক্যাল দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আতিক কাকুর নতুন বাড়িতে যাবোই।
বাবা সিমিকে বললেন, তুমি কিছু বলছে না মামনি?
তোমাদের অসুবিধে হলে থাক না হয়। সিমি নিচু গলায় বললো, আমরা নাহয় সামনের বছর রাঙ্গামাটি যাবো।
আপু তুই থামবি? সুযোগ পেলেই বড় বোনকে ও ধমক লাগায় কাল রাতেই তো তুই বলছিলি গত বছরের মতো যদি বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারতাম! নিজের কথা নিজে ভুলে গিয়ে খুব ভালোমানুষ সাজা হচ্ছে, না?
রিমির ধমকে সিমি কিছু মনে করে না। সবাই জানে ও এরকমই। যখন তখন ধমক দিয়ে কথা বললেও ওর মনটা খুব নরম। সেবার ওদের কাজের বুয়ার যখন টাইফয়েড হলো রিমি কেঁদে কেটে একাকার করেছে।
মা রিমিকে বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছে রিমি। সংসারের সুবিধা অসুবিধা তোমাকে বুঝতে হবে। বাবা তো বলেছেন বন্ধের দিনগুলোতে সবাইকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন।
ঠিক আছে তোমরা বেড়াও গে! বলেই রিমি ভ্যা করে কেঁদে ফেললো আমি কোথাও যাবো না। সারাদিন সাইকেলে করে রাস্তায় ঘুরবো বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশবো। কেউ কিছু বলতে পারবে না।
বাবা ব্যস্ত হয় বললেন, আহা, কাঁদছো কেন মামনি! আমরা দুজন নাইবা গেলাম। তুমি আর সিমি গিয়ে বেড়িয়ে আসো না! তোমাদের পেলে আতিক কাকু, চাচী, জয় সবাই খুশি হবে।
সত্যি! আমাদের একা যেতে দেবে? কান্না ভুলে রিমি খুশিতে ঝলমল করে উঠলো।
দিদু এতক্ষণ চুপচাপ বসে উল বুনছিলেন। নাতনির একটুখানি কান্নায় তাঁর ছেলে যেভাবে গলে গেলো, দেখে মোটেই ভালো লাগলো না–মাথা কি তোর খারাপ হয়ে গেছে বাছা! একরত্তি দুটো মেয়েকে একা চাটগাঁ পাঠাবি? বুদ্ধি-সুদ্ধি তোর কোনো কালেই হলো না!
দিদুর কথা শুনে রিমির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। বাবা ওকে আশ্বস্ত করলেন–চাটগাঁ আর এমন কী দূর মা! এখান থেকে প্লেনে তুলে দেবো। আধঘণ্টা পর চাটগাঁতে আতিক ওদের রিসিভ করবে। আমার এক পরিচিত লোকের ছ বছরের ছেলে গত মাসে একা লন্ডন গেছে।
ছ বছর হলেও ছেলে তো! দিনকাল মোটেই ভালো না। মেয়েদের একা চাটগাঁ পাঠিয়ে কাজ নেই।
তুমি ভেবো না মা। প্লেনের ভেতর ওদের কোনো অসুবিধে হবে না। দরকার হলে আমি পাইলটকে বলে দেবো।
পাইলট প্লেন চালাবে, না তোমার মেয়েদের পাহারা দেবে?
সারাক্ষণ মেয়ে মেয়ে করো না তো দিদু! রিমি ঝাঁঝালো গলায় বললো, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কম কিসে শুনি! মেয়েরা প্লেন চালাচ্ছে না? দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে না?
তবে আর কী! চাটগা কেন, চাদে চলে যাও না একা! সিমি একটু হেসে বললো, তুমি বুঝি জানো না দিদু, রাশিয়ার মেয়ে ভেলেন্তিনা তেরেশকোভা একা চাদেও গিয়েছিলো।
ঘাট মানছি বাপু! দিদু হার মেনে বললেন, তোমরা যে তেরেশকোভার বাবা আমার মনেই ছিলো না!
বাবা হেসে বললেন, ঠিক আছে মামনিরা। আমি কাল বিমান অফিসে যাবো। টিকেট পেতে অবশ্য দু চার দিন লেগে যেতে পারে।
তা লাগুক। মা বললেন, ওদের এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। যাওয়ার গোছগাছও তো করতে হবে।
রিমি ব্যস্ত গলায় বললো, কাল আমাদের রেজাল্ট দেবে। পরশু আপুদেরটা। আমি জানি আপু এবারও ফার্স্ট হবে।
বাবা বললেন, তোমাদের জন্য গরম পুলোভার আর উলের মুজো কিনতে হবে। পাহাড়ী এলাকায় শীত বেশি থাকে। দুটো উলের টুপিও লাগবে।
তাই বলে তুমি শামসু ভাইর মতো বাঁদুরে টুপি কিনে এনো না। আপত্তি জানালো রিমি।
মা বললেন, ওদের পুলোভার কেনার সময় জয়ের জন্যে কিনতে ভুলে যেও না। গত শীতে আতিক ভাই সবার জন্য কাপড় পাঠিয়েছিলেন।
দিদু বললেন, শুধু জয় কেন, আতিকের জন্য কিছু কিনবে না?
বাবা বললেন, চাটগাঁয়ে ভালো ছবির ভিডিও ক্যাসেট পাওয়া যায় না। ওর জন্য কটা ক্যাসেট কিনে দেবো।
ওর বৌ-এর জন্য একটা শাল কিনে দিও। গত বছর ও কী দামী শাল পাঠিয়েছিলো আমার জন্য!
রিমি জানতে চাইলো–আমরা স্যুটকেস কোনটা নেবো মা?
মা হেসে বললেন, ওসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি সব শুছিয়ে দেবো।
রাঙ্গামাটি যাওয়ার আনন্দে রিমি রাতে ভালো মতো ঘুমোতেই পারলো না। উত্তেজনায় সারাক্ষণ ওর বুক ঢিব ঢিব করছিলো।
.
০২. যাওয়ার পথে ঝামেলা
পরদিন রিমি আর সিমির জন্য এক দুঃসংবাদ বয়ে আনলেন বাবা। সেদিন রিমির পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। এই প্রথম ও সব বিষয়ে ক পেয়ে অনেক ওপরে উঠে এসেছে। বাবাকে খুশির খবর জানাবার জন্য ও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। সন্ধ্যেবেলা বাবা এসে কাষ্ঠ হেসে বললেন, বিমানে আগামী পনেরো দিন চিটাগাং যাওয়ার কোনো টিকেট পাওয়া যাবে না।
বাবার কথা শুনে রিমির মুখ শুকিয়ে গেলো। সিমিও যথেষ্ট দমে গেলো। বাইরে প্রকাশ না করলেও রাঙ্গামাটি যাওয়ার জন্য সেও কম উত্তেজিত ছিলো না। মা বললেন, চিটাগাং রোজ দুটো ফ্লাইট না! এত ভিড় কিসের জন্য?
আমেরিকান এক সার্ভে টিম এসেছে। তাছাড়া চিটাগাং-এ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য বহু বিদেশী সাংবাদিক রোজ যাওয়া আসা করছে।
দিদু বিরক্ত হয়ে বললেন, টাকা কি ওদের কামড়ায়? রোজ কেন চাটগাঁ যেতে হবে! ওখানে থাকার জায়গা নেই?
রিমি একটু ভয়ে ভয়ে বললো, আমরা তো ট্রেনেও যেতে পারি বাবা!
পাগল নাকি! দিদু ধমক দিয়ে বললেন, কত স্টেশন ঘুরে দশ বারো ঘণ্টায় ট্রেন চাটগাঁ যায়। পথে ডাকাতের ভয় আছে, কামরায় বাতি থাকে না, বাথরুমে পানি থাকে না, অ্যাকসিডেন্টের ভয়–কোনো দরকার নেই ট্রেনে যাওযার।
বাবা বললেন, আজকাল ট্রেনের অবস্থা ভালো হয়েছে মা। সকালের ট্রেনে উঠলে দুপুরের আগে চিটাগাং চলে যাবে, পথে কোথাও থামবে না।
সিমি বললো, তাই ভালো বাবা। খরচও কম পড়বে আর সব দেখতে দেখতে যাবো।
রিমি বললো, হ্যাঁ বাবা, প্লেনের চেয়ে ট্রেন অনেক ভালো।
মা হেসে বাবাকে বললেন, ঠিক আছে, ওদের তাহলে ট্রেনের টিকেটই করে দাও। আতিক ভাইকে ফোনে বলে দিও।
রাঙ্গামাটি যাওয়ার আরেকটা বাধা এভাবে কাটলো। সিমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জামা কাপড় আর জিনিসপত্র কী কী নেবে সব গোছানো আরম্ভ করলো।
পরদিন সিমির পরীক্ষার ফল বেরোলো। নাইন থেকে টেন-এ উঠেছে ফার্স্ট হয়ে । জানা কথা যদিও-দিদু পোলাও, মুরগির রোস্ট আর রেজালা রান্না করে সেলিব্রেট করলেন। বড় নাতনিটির জন্য তার পক্ষপাত বাড়ির কারও অজানা নয়।
রাতে খাবার টেবিলে বাবা বললেন, তাহলে মামনিরা তোমরা কাল চিটাগাং যাচ্ছো!
রিমি বললো, হ্যাঁ বাবা, আমাদের ব্যাগ স্যুটকেস গোছানো সব শেষ।
ওরা দুটো হাত ব্যাগ আর একটা সুটকেস নিচ্ছে। স্যুটকেসের অর্ধেক অবশ্য আতিক কাকুদের জিনিসে ভর্তি। দিদু আবার শেষ মুহূর্তে তার হাতে বানানো দুই বয়েম আমড়া আর রসুনের আচার ওতে ভরে দিয়েছেন। সিমির চেয়ে রিমির ছোটখাট জিনিসপত্র অনেক বেশি। বড় মামা জার্মানী থেকে এনেছিলেন ছোট বাইনোকুলার আর ম্যাকগাইভার ছুরি, ও দুটো সঙ্গে নিয়েছে। ফার্স্ট এইড কিড, নোট বই, বলপেন, টর্চ নিয়েছে। নিজের স্কিপিং রোপ ছাড়াও নাইলনের কড নিয়েছে অনেকখানি। সিমি যতবার জিজ্ঞেস করেছে-এত সব জিনিস দিয়ে বোঝা ভারি করছিস কেন, রিমি হাতব্যাগ গোছাতে গোছাতে জবাব দিয়েছে–কখন কোন জিনিসটার দরকার হয় কে বলতে পারে! সিমির মনে হচ্ছিলো পারলে বুঝি রিমি ওর গোটা কামরাটাই তুলে নিয়ে যায়।
রাতে খাবার পর বাবা সিমির ঘরে এলেন। বিছানায় বসে রিমিকেও ডাকলেন। বললেন, কথাটা তোমাদের আগেও বলেছি। বড়দের ছাড়া দূরের রাস্তায় যাচ্ছে বলে আবার বলছি, অচেনা কোনো লোক যদি কিছু খেতে দেয় কখনও খাবে না। কোনো বিপদ যদি দেখ মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। সাহায্যের দরকার হলে পুলিসকে বলবে। ধরো এমন হতে পারে আতিক কাকুকে স্টেশনে পেলে না। সোজা স্টেশন মাস্টারের অফিসে চলে যাবে। সেখান থেকে কাকুর বাসায় ফোন করবে। নম্বর মনে আছে তো?
রিমি বললো, হ্যাঁ বাবা আছে। আমি নোট বইতে লিখেও রেখেছি।
মনে থাকলে আর লেখার কি দরকার?
বারে! এমন যদি হয় আমরা গুণ্ডাদের খপ্পরে পড়লাম। এমন কোনো ওষুধ দিয়ে ওরা আমাদের স্মৃতি নষ্ট করে দিলো। তখন কেউ যদি আমাদের উদ্ধার করে পরিচয় জানবে কেমন করে?
রিমির কথা শুনে বাবা গলা খুলে হাসলেন–নিশ্চয় তোমার পড়া কোনো বইতে এরকম ঘটেছিলো?
হ্যাঁ বাবা, এনিড ব্লাইটনের একটা বইতে ছিলো। আমাদের ঠিকানাও নোট বইতে লিখে রেখেছি। ভালো করিনি বাবা?
খুব ভালো করেছে। রিমিকে আদর করে বাবা বললেন, আতিক কাকুর বাসায় তুমি লক্ষী হয়ে থাকবে। আপুর কথা শুনবে। তোমার নোট বইতে আরও দুটো ফোন নম্বর লিখে রাখো। একটা চিটাগং-এর এসপির নম্বর, আরেকটা রাঙ্গামাটির এসপির নম্বর। রাঙ্গামাটির এসপির সঙ্গে আমি কাল কথা বলবো।
বাবার কথা মতো রিমি ওর নোট বইতে দুই জেলার দুই এসপির নম্বর লিখে রাখলো। বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সিমিকে বললো, দেখলি তো আপু, নোট বই কেন নিয়েছি।
সিমি হেসে ওর চুলের ঝুঁটি নেড়ে দিলো–তুই টিনটিন না ম্যাকগাইভার?
নাক উঁচু করে রিমি বললো, আমি কেন ম্যাকগাইভার হতে যাবো! আমি অ্যাভেঞ্চার-এর মিস এমা পিল হবো!
আমাকে তোর এ্যাসিসটেন্ট রাখবি তো? হেসে জানতে চাইলে সিমি।
ভুরু কুঁচকে সিমিকে ভালো করে দেখে রিমি বললো, তুই যদি ছেলেদের কথা শুনে গলে না যাস, তোকে এ্যাসিসটেন্ট বানাতে পারি।
দেবো এক চড়! বলে সিমি হাসতে হাসতে ওর ঘরে গেলো।
ঢাকা স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের ট্রেন ছাড়ে সকাল সাড়ে সাতটায়। সিমি রিমিরা স্টেশনে এসে পৌঁছলো সাতটা দশে। ওদের ট্রেনে তুলে দেয়ার জন্য বাবার সঙ্গে মা আর দিদু এসেছেন। বুয়াও আসার জন্য বায়না ধরেছিলো। গাড়িতে জায়গা হবে না বলে ওকে আনা হয়নি। বাড়ি থেকেই ও কেঁদে কেটে সিমি রিমিকে বিদায় দিয়েছে। স্টেশনে আসার পর দিদুও ফোঁঁত ফেঁত করে রুমালে নাক মুছতে লাগলেন।
ওদের জন্য ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কাটা হয়েছিলো কামরা খুঁজে বের করে বাবা ওদের জিনিসপত্র ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। কামরায় চার জনের বসার জায়গা। ওরা ছাড়া সেখানে আর কোনো যাত্রী ছিলো না। মা বললেন, আমরা নেমে গেলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিস। শুধু গার্ড এলে খুলবি।
পথে খাবার জন্য দিদু ওদের স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিয়েছেন। দুটো করে আপেলও দিয়েছেন। বাবা স্টেশন থেকে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে দিলেন। ঘর থেকে বেরোবার আগে সিমিকে আড়ালে ডেকে দিদু ওর হাতে একশ টাকার একটা নোট খুঁজে দিয়েছেন। বলেছেন কাউকে বলার দরকার নেই। এটা রাখ, আপদে বিপদে কাজে দেবে। সিমি এত বড় হয়েছে তবু বাবা ওর হাতে পারতপক্ষে নগদ টাকা দিতে চান না। বলেন, যখন যা দরকার মাকে বলবে। স্কুলে মাঝে মধ্যে বন্ধুদের খাওয়াতে হয়, কারণ ওরাও খাওয়ায়। তখন দিদুই হচ্ছে ওদের ভরসা।
শেষবারের মতো হুইসেল বাজলো ঠিক সাড়ে সাতটায়। বাবা মা আর দিদু ট্রেন থেকে নেমে গেলেন । করিডোরে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে সিমি রিমি ওদের বিদায় জানালো। ট্রেন যখন চলা আরম্ভ করলো বাবা চেঁচিয়ে বললেন, রিমি মাথা ভেতরে নাও। ওভাবে কখনও জানালা দিয়ে মাথা বের করবে না।
দিদু ঘন ঘন চোখ মুছছিলেন আর হাত নাড়ছিলেন। মার চোখে কান্না থাকলেও ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাসি অতি কষ্টে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। মার অবস্থা দেখে সিমির কান্না পাচ্ছিলো। রিমি হাসাহাসি করবে এই ভয়ে অতি কষ্টে কান্না চেপে বললো, রিমি ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দাও।
ওদের বাড়ি বনানী, নিউ এয়ারপোর্ট রোডের ঠিক ওপরে। ট্রেন তেজগাঁ স্টেশন পেরোবার পর রিমি বললো, আপু দেখিস, আমি বললাম ট্রেন দেখার জন্য বুয়া ঠিক ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়িতে দোতালার জানালা পর্যন্ত ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। ছাদে না উঠলে ট্রেন দেখা যায় না। মহাখালী রেল ক্রসিং পার হওয়ার একটু পরই ওরা দেখলো ছাদে শুধু বুয়া নয়, শামসু ভাইও দাঁড়িয়ে আছে। রিমি চেঁচিয়ে ডাকলো, বুয়া, আমরা এখানে। ট্রেনের প্রচণ্ড শব্দের নিচে ওর কথা চাপা পড়ে গেলো। গতিও তখন কম ছিলো না। চোখের পলকে ওদের বাড়িটা হারিয়ে গেলো অন্য সব বাড়ির আড়ালে।
রিমি বললো, আমরা দুজন ছাড়া কামরায় আর কেউ নেই। কী মজা না আপু?
সিমি ততক্ষণে ব্যাগ থেকে হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস বের করে পড়া আরম্ভ করেছে। রিমির কথায় শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলো। রিমি আবার বললো, রাতে আমার কী মনে হয়েছিলো জানিস আপু?
বই থেকে চোখ তুলে সিমি জানতে চাইলো, কী মনে হয়েছিলো?
যদি আমাদের কামরায় কোনো ছেলেধরা ওঠে! ধর আমরা একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, ওরা ক্লোরোফর্মওয়ালা রুমাল নাকে চেপে ধরে আমাদের অজ্ঞান করে দিলো–
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে রিমি? ফার্স্ট ক্লাসে ছেলেধরা আসবে কোত্থেকে? ওরা জানবে কিভাবে আমাদের সঙ্গে বড় কেউ নেই? তাছাড়া অজ্ঞান করে আমাদের ট্রেন থেকে বের করে নিয়ে যাবে কীভাবে?
ছেলেধরারা সব খোঁজ খবর নিয়েই কাজটা করে। আপাতত চট্টগ্রাম যাচ্ছি, সঙ্গে বড় কেউ নেই–এসব জানার জন্য ওদের স্পাইরা কাজ করে।
হাতে ধরা খোলা বইটা বন্ধ করে সিমি হেসে বললো, ফালতু সব ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে তোর মাথায় বুঝি সারাক্ষণ এসব ঘোরে।
তুই তো পড়িস ন্যাকা ন্যাকা সব উপন্যাস। তোর মাথায় …… রিমির কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় কে যেন ধাক্কা দিলো। বার তিনেক ধাক্কা দিয়ে খসখসে গলায় বললো, ভেতরে কে আছেন দরজা খুলুন!
সিমি উঠতে যাবে–রিমি চাপা গলায় ধমক দিলো, বসে থাক আপু! গলা শুনেই মনে হচ্ছে কোনো গুণ্ডা বদমাশ হবে!
তা কেন হবে! গার্ডও তো হতে পারে! রিমিকে আশ্বস্ত করতে চাইলো সিমি।
দাঁড়া, আগে দেখি! দরজার পাশে টেনে নামানো এলুমিনিয়ামের হালকা জানালাটা নিচ থেকে সামান্য ফাঁক করে দেখে রিমি ফিশ ফিশ করে বললো, না আপু, গার্ড নয়, কোট প্যান্ট পরা দাড়িওয়ালা বুড়ো মতো লোক।
নিশ্চয় এ কামরার প্যাসেঞ্জার হবে। এটা চারজনের কামরা। এই বলে সিমি দরজা। খুলে দিলো।
থ্রি পিস কমপ্লিট স্যুট পরা ষাট পয়ষট্টি বছরের এক বুড়ো চোখে পুরু কাঁচের চশমা, এয়ার ব্যাগ হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজা খোলার পর ভেতরে চোখ পিট পিট করে দেখে তিনি বললেন, এ কামরার তিন নম্বর সিটটা বোধ হয় আমার। ভুলে অন্য কামরায় ঢুকে পড়েছিলাম। আশা করি সহযাত্রী হিসেবে আপনাদের বিরক্তির কারণ হবো না?
রিমি ভেবেছিলো ওদের কামরায় বুঝি আর কেউ উঠবে না। পুরো রাস্তা হাত পা ছড়িয়ে আরামে যাওয়া যাবে। অচেনা একজন সঙ্গী হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই ওদের ভালো লাগছিলো না। তবে ষাট সত্তর বছরের একজন বুড়ো ওদের আপনি বলছেন এতে ওরা খুব মজা পেলো। সিমি বললো, ভেতরে আসুন।
সিমি রিমি দুজনে মুখোমুখি জানালার ধারে বসেছিলো। বুড়োর জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে সিমি যাচ্ছিলো রিমির পাশে বসতে–বুড়ো ব্যস্ত গলায় বললেন, জানালার ধারে
আপনি আরাম করে বসুন। আমি এ পাশটায় বসছি।
সিমিকে আপনি বলার ঘটা দেখে রিমি হাসি চাপতে গিয়েও পারলো না। হাত ব্যাগটা গদিমোড়া সিটের তলায় রেখে আরাম করে বসে বুড়ো বললেন, আমি হচ্ছি প্রফেসর জাকারিয়া খান। চিটাগং ইউনিভার্সিটির বোটানি ডিপার্টমেন্টে আছি।
কেউ নিজের পরিচয় দিয়ে পরিচিত হতে চাইলে তার জবাব দিতে হয় এ শিক্ষা সিমি রিমির আছে। সিমি ওদের পরিচয় জানিয়ে বললো, আমরা বয়সে আপনার অনেক ছোট। আমাদের তুমি বলবেন।
একগাল হেসে প্রফেসর জাকারিয়া বললেন, কী ভুলো মন আমার! তোমাদের বুঝি আপনি বলছিলাম? দেখ তো কাণ্ড! আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি হিস্ট্রির হামিদা খানম!
না, না, আমি সিমি! অতি কষ্টে হাসি চেপে ও বললো, আমি শহীদ আনোয়ারা স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ি। আমার বোন রিমি, শাহীন স্কুলে এবার এইটে উঠেছে।
দেখ দেখি কাণ্ড! প্রফেসর অমায়িক হেসে বললেন, কী ভুলো মন আমার! ক্লাস টেন-এর আনোয়ারাকে ভাবছি আমাদের সুলতানা আপা। বোনের কি নাম বললি, শাহীন! বাহ, খুব ভালো নাম। চাটগাঁ যাচ্ছিস–সঙ্গে বড় কেউ নেই?
রিমি মুখে রুমাল চেপে হাসি সামলাতে ব্যস্ত। সিমি দেখলো প্রফেসরের ভুল শুধরে দিয়ে কোনো লাভ নেই, আবার ভুল করবেন। বললো, আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি। এইটুকুই তো পথ, সঙ্গে লোক লাগবে কেন?
প্রফেসর গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভারি খুশি হলাম। আমার নাম জাকারিয়া খান।
রিমি তার কথার মাঝখানে বললো, আপনি চিটাগাং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।
বাহ মেয়ে, দারুণ বুদ্ধি তো তোমার! নিম্ব্যাগের গায়ে আমার পরিচয় দেখেছো। রিমির কথায় চমৎকৃত হয়ে প্রফেসর বললেন, আমার ছোট ভাইয়ের দুটো মেয়ে আছে তোমাদের মতো। ওদেরও খুব বুদ্ধি। একটু থেমে মুখ কাচু মাচু করে প্রফেসর বললেন, কিছু যদি মনে করেন আমি একটু টয়লেটে যাবো। প্লীজ, দরজা বন্ধ করবেন না। শেষে খুঁজে পাবো না।
সিমি হাসি গোপন করে বললো, আপনি ভাববেন না স্যার। আমরা দরজা খোেলা রাখবো।
ধন্যবাদ। বলে প্রফেসর কামরা থেকে বেরিয়ে যেতেই সিমি রিমি হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। রিমি বললো, আপু, তোর নাম আনোয়ারা। কী মজা!
সিমি বললো, তাও ভালো, নিজের নামটা ভুলে যাননি!
বুঝবো কিভাবে ওটা যে আসল নাম?
দুবারই এক নাম বলেছেন।
প্রফেসর টয়লেটে যাওয়ার কথা বলে কামরা থেকে সেই যে বেরোলেন আধঘণ্টা হয়ে গেলো ফেরার নাম নেই। সিমি আর রিমি হেসে হেসে ক্লান্ত হয়ে ওদের পছন্দের দুটো বই খুলে বসেছিলো। সিমির হাতে উপন্যাস, রিমির হাতে ব্যাটম্যান-এর কমিক। সিমি প্রথম বললো, প্রফেসরের হলো কী? এখনও আসছেন না!
রিমি ফিক করে হেসে বললো নিশ্চয় বড় বাথরুম পেয়েছে।
ধ্যাৎ। এতক্ষণ লাগবে কেন?
বাথরুম খুঁজতে কোথায় গেছেন কে জানে!
এমনও তো হতে পারে যেতে যেতেই ভুলে গেছেন কোথায় যাবেন! হয়তো অন্য কোনো কামরায় বসে আছেন।
যেখানে যাক ব্যাগ যখন এ ঘরে ঠিকই আসবেন।
আরও পনেরো মিনিট পরে এলেন প্রফেসর। হেসে বললেন, এবারও ভুলে গিয়েছিলাম আমার কামরা কোনটা। এক লোক এসে চিনিয়ে দিয়ে গেলো।
সিমি বললো, লোক না গার্ড?
না না, গার্ড তো চিনি। অচেনা লোক। আমাকে চেনে। বললো, স্যার বুঝি কামরা খুঁজে পাচ্ছেন না। চলুন দেখিয়ে দিই। এই বলে এ পর্যন্ত এলো।
সিমি উঠে দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দুজন পুলিস অফিসার এসে সামনে দাঁড়ালেন। বেশি রাশভারি চেহারার যিনি গম্ভীর গলায় বললেন, এ কামরাটা সার্চ করতে চাই।
কেন? জানতে চাইলো সিমি।
এটা রুটিন চেক আপ। আপনাদের ব্যাগ দেখান।
সিমি অবাক হয়ে ওদের ব্যাগ স্যুটকেস দেখিয়ে দিলো। অফিসার দুজন ওগুলো খুলে বেশি ঘাটাঘাটি করলেন না। প্রফেসরের ব্যাগ দেখিয়ে ওঁকে বললেন, এ ব্যাগ আপনার?
প্রফেসর মাথা নেড়ে সায় জানালেন। অফিসার বললেন, চাবিটা দিন! প্রফেসর অবাক হয়ে বললেন, ব্যাগ তো খোলা! চাবি চাইছেন কেন?
এয়ার ব্যাগের চেইন-এর মাথায় ঝোলানো ছোট্ট তালাটা দেখিয়ে অফিসার বললেন, এটাতে তালা দেয়া।
প্রফেসর আপন মনে বললেন, ব্যাগে আবার তালা দিলাম কখন?
রিমি মুখ টিপে হেসে বললো, দিতে পারেন স্যার। আপনার তো আবার ভুলো মন!
তাহলে চাবি কোথায় রাখলাম! এই বলে প্রফেসর তার কোট আর প্যান্টের পকেটগুলি হাতড়ে দেখলেন। কোথাও চাবি খুঁজে না পেয়ে বোকার মতো পুলিস
অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
অফিসার যেন জানেন, চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সামান্য হেসে বললেন, তাহলে তো স্যার তালাটা ভাঙতে হয়।
ভাঙুন। প্রফেসর বললেন, ওটা আমার তালা নয়।
ছোট তালা ভাঙতে বেশি বেগ পেতে হলো না, অফিসারের পকেটে তালা খোলা যন্ত্র ছিলো। সামান্য চাপ দিতেই তালা খুলে গেলো ব্যাগের চেইন ধরে টান দিলেন তিনি। ওপরে সাদা তোয়ালে। ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকালেন। তার কপালে ভাঁজ পড়লো। ভেতর থেকে যা বের করে আনলেন দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। অফিসারের হাতে কয়েকখানা সোনার বিস্কুট। প্রফেসরের চোয়াল ঝুলে গেলো। সিমি রিমি ঢোক গিললো। অফিসার দুজন চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। প্রফেসর বিড়বিড় করে বললেন, এসব কী!
কোনো কথা না বলে কামরার মেঝের ওপর ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন অফিসার। জানালা দিয়ে আসা রোদের আলোয় ঝলমল করে উঠলো অনেকগুলো সোনার বিস্কুট। ঠাণ্ডা গলায় রাশভারি অফিসারটি বললেন, সত্যিই কি এ ব্যাগ আপনার প্রফেসর?
হ্যাঁ, আমারই তো। নাম লেখা আছে না?
যিনি ব্যাগ হাতাচ্ছিলেন তিনি ওটা উল্টে পাল্টে দেখলেন কোথাও প্রফেসরের নাম। নেই। বললেন, কোথায় নাম?
প্রফেসর এবার শক্ত গলায় বললেন, নাম না থাকলে ওটা আমার ব্যাগ নয়। ট্রেনে ওঠার আগে আপনার ব্যাগ কোথাও রেখেছিলেন?
একটু ভেবে প্রফেসর বললন, ট্রেনে ওঠার পর আমি ভুলে অন্য কামরায় উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ বসেওছিলাম। পরে গার্ড এসে বললো ওটা আমার কামরা না। হতে পারে তখন কারও সঙ্গে ব্যাগটা বদল হয়ে গেছে।
কোন কামরায় উঠেছিলেন?
তা তো মনে নেই! গার্ড বলতে পারে।
ঠিক আছে আপনি কামরায় থাকুন। এ বলে পুলিস অফিসাররা সোনার বিস্কুটগুলো ব্যাগে ভরে ওটা নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
প্রফেসর কাষ্ঠ হেসে সিমিকে বললেন, কী সর্বনেশে কাণ্ড বলুন তো! আমার ব্যাগ খুঁজে না পেলে ওরা ভাববে এটা বুঝি আমার ব্যাগ!
প্রফেসরের ব্যাগে রাশি রাশি সোনা দেখেই সিমি রিমি তাঁকে সাংঘাতিক কোনো ক্রিমিনাল ভেবে বসে আছে। প্রফেসরের সাফাইয়ে ওদের ধারণা পাল্টালো না। কোনো কথা না বলে সিমি বই খুলে বসলো।
উত্তেজনায় রিমির বুক ঢিবঢিব করছিলো। মুখের সামনে ব্যাটম্যানের কমিক খুলে ও আকাশ পাতাল ভাবছিলো। প্রফেসর যদি সেরকম কোনো ক্রিমিনাল হন পুলিস যখন অ্যারেস্ট করতে আসবে তখন তিনি ওদের জিম্মি বানিয়ে ফেলতে পারেন। অবশ্য সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে রিমির তা জানা আছে। কমিকের আড়াল থেকে ও লক্ষ্য রাখলো প্রফেসর যেন পালিয়ে যেতে না পারেন। সিমিকে দেখলো–উপন্যাসের ভেতর ডুবে গেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে প্রফেসর জাকারিয়া ঘুমিয়ে পড়লেন। ট্রেনের তালে তালে তাঁর মাথাটা দুলতে লাগলো। অনবরত রাঙ্গামাটি শব্দ করতে করতে দুপাশে ন্যাড়া ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে পৌষের রোদ গায়ে মেখে প্রচণ্ড বেগে ছুটছিলো ট্রেনটা।