বাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
০১. বাভারিয়ায় একটি বাঙালি পরিবার
আকাশের দিকে তাকিয়ে বুড়ো ওক গাছের তলায় শুয়েছিলো স্বপন। গাছের পাতার ফাঁকে চকচকে নীল টুকরো টুকরো আকাশ দেখা যাচ্ছিলো। দুপুরের মৃদু বাতাসে শীতের নরম আমেজ। মধ্য ইউরোপে এখন পাতা ঝরার সময়। বাভারিয়ার বনে কালচে ঘনসবুজ পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে ওক, লিন্ডেন, বার্চ, পপলার আর চেস্টনাট গাছে নানা রঙের মেলা। সেপ্টেম্বর শেষ হতে চলেছে। বাভারিয়া আর বোহেমিয়ার বনে আরও কিছু দিন থাকবে রঙের এই সমারোহ।
টুপ করে একটা গাঢ় লাল ওক পাতা খসে পড়লো স্বপনের বুকের ওপর। পাশে বাবা বসে বিচিত্রা পত্রিকা পড়ছেন। দেশের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ এরই মাধ্যমে রয়েছে। চিঠি লেখার কথা মনে হলে রাজ্যের আলসেমি পেয়ে বসে তাঁকে। সময় মতো চিঠির উত্তর দেন না বলে ঢাকার বন্ধুরা তাকে কদাচিৎ লেখেন। বড় এক ভাই আছেন বটে, গত দু বছরে কোনো চিঠি লেখেননি।
স্বপন লক্ষ্য করলো পত্রিকায় কী একটা লেখা পড়ে বাবা উদাস হয়ে গেলেন। অল্প দূরে মা আর ওর ছোট বোন শীলা চা বানাবার আয়োজন করছে। আজ শনিবার, ওদের ছুটির দিন। প্রায় প্রত্যেক শনিবারে ওদের ডেগেনডর্ফের বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে ডানিউব নদীর তীরে বনের ভেতর এই বিশেষ জায়গায় পিকনিক করতে আসে ওরা। এ ছাড়া ওদের ছোট্ট শহরটায় যাবার তেমন কোনো জায়গা নেই।
স্বপনের মা জার্মান। এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে রেগেনবার্গে ওর নানার বাড়ি। নানা-নানি যখন বেঁচেছিলেন তখন ওরা ওখানে যেতে বেড়াতে। দুবছর হলো নানা-নানি দুজনই মারা গেছেন। বাড়িতে এখন এক কেয়ারটেকার থাকে। স্বপনরা গত দু বছরে মাত্র তিনবার গেছে নানা বাড়ির অবস্থা দেখতে।
বাবাকে উদাস হয়ে বসে থাকতে দেখে স্বপন জানতে চাইলো, তুমি কী ভাবছো বাবা?
কী আর ভাববো! বলতে গিয়ে হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাবা।
তুমি দেশের কথা ভাবছো। কথাটা স্বপন এমনভাবে বললো যেন ও বাবার মনের সব খবর রাখে।
বাবা স্বপনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। কোনো কথা বললেন না। ছেলের মুখের আদল ওঁর মতোই, তবে গায়ের রঙ পেয়েছে মায়ের। মাত্র তের বছরে পা রেখেছে, অথচ দেখলে মনে হয় ওর বয়স পনেরো বোলর কম নয়। স্কুলে পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলোর দিকে ওর ঝোঁক বেশি। এ বয়সেই স্কুলের ফুটবল টিমে চান্স পেয়ে গেছে। শীলা হয়েছে স্বপনের ঠিক উল্টো। গায়ের রঙ বাবার মতো শ্যামলা, চেহারা মার সঙ্গেই বেশি মিল, মায়ের মতো শান্ত স্বভাবের, ক্লাসে পড়াশোনায় সব সময়ে ওপরের দিকে থাকে।
স্বপন বললো, বাবা, তুমি কি আজ আমাদের দেশের কথা বলবে?
স্বপনের জন্ম হয়েছে জার্মানিতে। কোনদিন বাংলাদেশে আসেনি। বাবার কাছে অবশ্য বাংলা বলা শিখেছে, কিছু পড়তেও পারে, তবে লেখার ব্যাপারে ওর কোনো আগ্রহ নেই। অথচ স্কুলে জার্মান ছাড়াও ফ্রেঞ্চ আর ইংলিশ দুটোই শিখছে। শীলা বয়সে ওর এক বছরের ছোট হলেও বাংলা খানিকটা লিখতে পারে, শেখারও আগ্রহ আছে। ওদের মা জার্মান, জন্মেছে জার্মানিতে, তবু ওরা দুজনই নিজের দেশ ভাবে বাংলাদেশকে। মাঝে মাঝে ওরা বাবার কাছে বাংলাদেশের কথা জানতে চায়।
ওদের বাবা শফিক খান দেশ ছেড়েছেন চৌদ্দ বছর আগে। ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বলতে গেলে পালিয়ে এসেছেন দেশ থেকে। না পালালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো, নয়তো যাবজ্জীবন জেল খাটতে হতো।
স্বপনের মা ওদের জন্য চা বানিয়ে আনলেন। বড় একটা চাদর পাতা ছিলো গাছের নিচে। স্বপন শুয়েছিলো এক কিনারে। মা এসে বাবার পাশে বসলেন। মার সঙ্গে শীলাও উঠে এসেছে।
চা খেতে খেতে স্বপন আবার বললো, বলো না বাবা আমাদের দেশের কথা!
বাবা মুখ ফিরিয়ে মার দিকে তাকালেন। তারপর আবার স্বপনকে দেখলেন। একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি তো বলেছি, এটাই তোমাদের দেশ। তোমরা এদেশের নাগরিক।
এদেশের নাগরিক হতে পারি, কিন্তু এটা আমাদের দেশ নয় বাবা। আমাদের ফাদারল্যান্ড হচ্ছে বাংলাদেশ।
স্বপন জার্মানদের মতো নিজের দেশকে মাতৃভূমি বলে না, বলে পিতৃভূমি। বাবা বললেন, তুমি কথাও বলো জার্মানদের মতো। বাঙালিরা কখনও ফাদারল্যান্ড বলে না।
শীলা একটু হেসে বললো, আমাদের মাদারল্যান্ড জার্মানি, ফাদারল্যান্ড বাংলাদেশ।
মা মৃদু হেসে বাবার দিকে তাকালেন–শীলা ঠিক বলেছে। ওরা যদি ওদের ফাদারল্যান্ড সম্পর্কে জানতে চায় তুমি আপত্তি করতে পারো না শফিক।
বাবা নিচু গলায় বললেন, তুমি তো জানো ইভা, সে সব কথা আমি মনে করতে চাই না। কষ্ট হয় ভাবলে।
একা কতকাল এই কষ্ট বয়ে বেড়াবে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। তোমার কষ্টের ভাগ ওদেরও নিতে দাও। মার গলাটা নরম জেরানিয়াম ফুলের মতো।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন নদীর দিকে মুখ করে। বিকেলের সোনাগলা রোদে ঝলমল করছে নীল ডানিউব নদী আর গাঢ় সবুজ বাভারিয়ার বন। একটা সীগাল একা উড়ে বেড়াচ্ছে ডানিউবের ওপর। মাঝে মাঝে আর্ত গলায় সঙ্গীকে ডাকছে। কে জানে কোন নিষ্ঠুর শিকারী ওকে সঙ্গীহারা করেছে। নদীর তীরে চকচকে সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে তারার মতো ছোট ছোট হলুদ ডেইজি ফুল ফুটেছে। নানা রঙের প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে।
বাবা আপন মনে বললেন, তোমাদের আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা বলেছি।
বলেছো বাবা। শীলা বললো, তুমিও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলে।
যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে দেখি পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের পুরো গ্রামটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। আমার বাবাকে ওরা গুলি করে মেরেছে।
তোমার মা কোথায় ছিলেন? জানতে চাইলো শীলা।
মা আমাদের ছোটবেলায় মারা গেছেন। আমরা দুভাইই যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বড় ভাই আমার ছবছরের বড়। যুদ্ধের আগে তিনি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। আমি তখন কলেজে। যুদ্ধের পর ভাই হলেন আমার অভিভাবক। এক বছর পর আমি ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম। আর তখনই রাজনীতির সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে গেলাম।
স্বপন বললো, ইউনিভার্সিটি শেষ না করে তুমি রাজনীতিতে জড়ালে কেন?
দেশের খারাপ অবস্থা দেখে। যে আশা নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, ভেবেছিলাম দেশ স্বাধীন হলে সে আশা পূরণ হবে। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ আর বঞ্চনার কবল থেকে বাঁচার জন্য। ভেবেছিলাম দেশ স্বাধীন হলে কোনোরকম শোষণ পীড়ন থাকবে না। কিন্তু কিছুই হলো না। সব কিছু আগের মতোই চলছিলো। বরং যারা গরিব ছিলো তারা আরও গরিব হতে লাগলো। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে লাগলো। দেখে মনে হলো এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। তাই রাজনীতিতে জড়ালাম।
মা বললেন, বড় রকমের যুদ্ধের পর সব দেশের অবস্থাই খারাপ থাকে। বাবা মার কাছে শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে বহু লোক খেতে না পেয়ে মারা গেছে। ছবিতে নিশ্চয় দেখেছো আমাদের গোটা দেশটাই ছিলো একটা ধ্বংসস্তূপ।
বাবা বললেন, আমাদের অবস্থা অবশ্য জার্মানির মতো খারাপ ছিলো না। তবু চুয়াত্তর সালে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মরে গেছে।
তোমার দলের নাম কী ছিলো বাবা? জানতে চাইলে স্বপন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। আমরা সংক্ষেপে বলি জাসদ। সেই দলের ছাত্র সংগঠনে কাজ করতাম আমি। সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার ছিলাম।
হিটলারের পার্টির নামও তো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল! তোমরা কি নাৎসিদের সমর্থন করো?
কক্ষণো নয়। বাবা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, আমরা মার্কসবাদে বিশ্বাস করতাম। বাংলাদেশে আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম।
খুব বড় দল ছিলো তোমাদেরটা।
মোটামুটি বড়ই বলতে পারো। সরকার বিরোধী দলগুলোর ভেতর তখন অন্যদের তুলনায় আমাদের শক্তিই বেশি ছিলো। সরকারের দুর্নীতি আর নানা রকম অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্যে আমাদের বহু কর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছিলো। সরকারী বাহিনীর গুলি খেয়ে মারাও গেছে অনেকে।
কী সাংঘাতিক। আঁতকে উঠলো শীলা–তার মানে তুমিও মারা যেতে পারতে?
আমিও মারা যেতে পারতাম। একটু থেমে বাবা আবার বললেন, আমাদের মতো দেশে রাজনীতি করতে হলে সব সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। সরকারী দলেরও অনেক কর্মী তখন বিরোধী দলের কর্মীদের হাতে মারা পড়েছে।
বলো কী বাবা! অবাক হয়ে স্বপন উঠে বসলো–এখনও কি বাংলাদেশের অবস্থা ভালো হয়নি?
এখনকার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। মানুষের জীবনের কোনো দামই এখন নেই। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে বাবা মা ভয়ে ভয়ে থাকেন–ওরা জীবিত ফিরে আসবে না লাশ হয়ে ফিরবে।
তোমাকে দেশ ছাড়তে হলো কেন সে কথা বলল।
পঁচাত্তর সালের অগাস্টে আমাদের দেশে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হলো। কয়েকজন আর্মি অফিসার প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে গুলি করে মেরে ফেললো। তাঁর তিন ছেলে আর স্ত্রীকেও তারা হত্যা করেছিলো।
মা বললেন, তুমি না বলেছিলে শেখ মুজিবের ডাকে তোমরা স্বাধীনতার যুদ্ধে গিয়েছো?
তা তো গিয়েছিলাম। তার মতো নেতা বাংলাদেশে আর কখনও আসেনি। কিন্তু দেশ চালাতে গিয়ে তিনিও অনেক ভুল করেছিলেন।
তাই বলে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে? তোমরা কি তাই চেয়েছিলে?
না, আমরা তা চাইনি। আমরা রাজনৈতিকভাবে তার বিরোধিতা করেছি। রাজনৈতিকভাবেই আমরা সরকারের পরিবর্তন চেয়েছিলাম। তাকে মেরে যারা ক্ষমতায় বসলো তারা অনেক বেশি খারাপ ছিলো। নবেম্বরে আমরা তাদের বিরুদ্ধে একটা অভ্যুত্থান করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়। আমাদের নেতারা সবাই ধরা পড়ে গেলেন। বহু কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। অত্যাচারের পাহাড় নেমে এলো আমাদের ওপর। বলতে গিয়ে বাবার মুখে বিষাদের নীল ছায়া ঘনিয়ে এলো। এ অভ্যুত্থানের প্রধান নায়ক ছিলেন কর্নেল তাহের। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অসম্ভব সাহসী একজন অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধে তিনি একটা পা হারিয়েছিলেন। আমি তার সেক্রেটারির কাজ করতাম। তিনি জেলে যাওয়ার আগেই আমাকে বলেছিলেন যেভাবে পারি আমি যেন দেশ ছেড়ে চলে যাই। তোমাদের মা ইভা ছিলো আমার পেনফ্রেন্ড। কলেজে থাকতেই চিঠিতে ওর সঙ্গে পরিচয় আর বন্ধুত্ব হয়েছিলো। একদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশ এলো আমার খোঁজে। তার দুদিন পরই আমি দেশ ছাড়ি। জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিই। তখন আমাদের দলের অনেকেই জার্মানি এসেছিলো। এখানে আসার সাতদিন পরই তোমাদের মাকে বিয়ে করি।
তোমাদের নেতা কর্নেল তাহেরের কী হলো? প্রশ্ন করলো স্বপন।
তাকে জেলের ভেতর বিচারের একটা প্রহসন করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো। বলতে গিয়ে রাগে বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো–পরে তাহেরের হত্যাকারী প্রেসিডেন্ট জিয়াকে তাঁর নিজের সৈন্যরাই গুলি করে মেরেছিলো।
তোমার বড় ভাইর কথা বলেছিলে। তিনিও কি রাজনীতি করতেন? প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য প্রশ্ন করলো শীলা।
না, কখনও রাজনীতির ধারে কাছেও তিনি আসেন নি। বরং আমার রাজনীতি করার ব্যাপারে তাঁর খুবই আপত্তি ছিলো। শেষের দিকে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবু তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি না থাকলে আমার লেখাপড়া হতো না। জার্মানিতে আসার টিকেট আর অন্য সব ব্যবস্থা তিনিই করে দিয়েছিলেন। তবে এখানে। আমার বিয়ে করাটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। গত দু বছর তাঁর কোনো চিঠিও পাইনি।
মা বললেন, তুমি কিন্তু কয়েক বার তাঁকে টাকা পাঠিয়েছে।
তা পাঠিয়েছি। বিয়ে করেছেন বাহাত্তরে। ছেলেমেয়ে চারটা। তাঁর অবস্থা বেশি ভালো হওয়ার কথা নয়। অবশ্য টাকার জন্য তিনি কখনও আমাকে লেখেননি।
তুমি ইচ্ছে করলে তোমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের এখানে আসতে বলতে পারো, যদি ওদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন হয়।
বলতে পারি। মনে হয় না ভাই ওদের কাউকে আমার কাছে পাঠাবেন।
এর কারণ কি তুমি বিদেশী বিয়ে করেছো বলে?
একটু বিব্রত হয়ে বাবা বললেন, অনেকটা তাই।
তোমরা বিদেশীদের এত ঘৃণা করো কেন?
ঘৃণা নয় ইভা, বলতে পারো রক্ষণশীলতা। আমাদের সমাজটা খুবই পিছিয়ে পড়া–মধ্যযুগে এখানে যেমন ছিলো।
স্বপন বললো, মাম, জার্মানরাও কিন্তু বিদেশীদের পছন্দ করে না।
সব জার্মানরা নয়, নাৎসিরা পছন্দ করে না। তোমরা খুব ভালো করেই জানো নাৎসিদের আমি কী রকম ঘৃণা করি।
নাৎসিদের আমরাও ঘৃণা করি। কিন্তু মাম ওদের শক্তি দিন দিন বাড়ছে।
সে জন্য আমার আরও বেশি রাগ হয়।
বাবা ম্লান হেসে বললেন, তোমাদের দেশে নাৎসিদের শক্তি বাড়ছে, আমাদের দেশে ওদের দোসর জামাতীদের শক্তি বাড়ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই এসব অশুভ শক্তির প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। অথচ সবাই চুপ করে আছে। খুবই ভয়ের কথা ইভা!
মা বললেন, নাৎসিরা আর কত বাড়বে? জার্মানির মানুষ এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভুলে যায়নি।
শীলা বললো, বাবা, তুমি দেশের কথা বলতে গিয়ে নোংরা রাজনীতির ভেতর চলে এসেছে।
রাজনীতিতে ভালো মন্দ দুইই আছে শীলা। বাবা বললেন, নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে আমাকে সুন্দর একটি দেশ ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয়েছে।
স্বপন বললো, জার্মানিও খুব সুন্দর দেশ বাবা।
বাবা কোনো কথা বললেন না। আধাশোয়া হয়ে আনমনে বিচিত্রার পাতা ওল্টাতে লাগলেন। কোথাও দেশের কোনো খবর পড়লে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা উপত্যকায় পাহাড়ের ছায়া পড়েছে। রোদ উঠে গেছে পাহাড়ের ওপরের গাছের মাথায়। মা শীলাকে বললেন, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আমাদের যাবার সময় হয়েছে। তুমি কি আরেক কাপ চা খাবে শফিক?
বাবা হাই তুলে বললেন, দিতে পারো।
চায়ের প্রতি বাবার বিশেষ দুর্বলতার কথা স্বপন আর শীলাও জানে। ওরা বুঝলো একটু পরেই বাবার মন ভালো হয়ে যাবে। বাবা বিষণ্ণ হলে ওদেরও মন খারাপ করে।
সন্ধ্যার দিকে সবাই জিনিসপত্র গুছিয়ে ওদের মস্ত বড় বিএমডব্লু গাড়ির পেছনে তুললো। বাবা ড্রাইভিং সিটে বসলেন। মা বসলেন তার পাশে। পেছনের সিটে স্বপন আর শীলা। গাড়ি চালাতে চালাতে বাবা মাকে বললেন, এ জায়গাটা দারুণ দেখতে। একটা মোটেল খুলবে নাকি? জানাজানি হলে প্রচুর টুরিস্ট আসবে।
মা হেসে বললেন, আমাদের যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট। টুরিস্টদের এ জায়গাটা চেনাতে চাই না। এটা একান্তভাবেই আমাদের থাকবে।
স্বপন বললো, আমাদের বন্ধুরা নিশ্চয় আসতে পারে?
পারে, যদি তারা এ জায়গার কথা আর কাউকে না বলে!
শীলা হেসে বললো, এ্যানি যদি একবার এখানে আসে, স্কুল সুদ্ধো সবাইকে গল্প করবে।
এ্যানি স্বপনের বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে। শীলার কথা শুনে স্বপনের রাগ হলো। বললো, কার্ল বুঝি এর কথা ওকে বলে বেড়ায় না?
কার্ল শীলার বন্ধু, ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। শীলা বললো, কার্লকে এখানে আনতে আমার বয়েই গেছে।
ছেলেমেয়েদের খুনসুটি শুনে বাবা মা মৃদু হাসছিলেন। বন্ধুরা সবাই বলে ছেলে মেয়েদের চমৎকার লালন করছেন খান দম্পতি।
দূর থেকে ওদের বাড়ির সামনে, পাঁচটা গাড়ি দাঁড়ানো দেখে সবার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। নামেই শুধু ওদের বাড়ি। আসলে ডেগেনডর্ফের সবচেয়ে বনেদি হোটেল এটা। বাভারিয়ার জাতীয় ফুল জেরানিয়ামের নামে এই হোটেলটা চল্লিশ বছর আগে বানিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার এক ভদ্রলোক। পরে তার কাছ থেকে কিনেছিলেন স্বপনের নানা। একমাত্র মেয়ের বিয়ের পর জামাইকে এটা উপহার দিয়েছেন। মস্ত বড় তিনতলা কাঠের বাড়ি। ওপরে রান্নাঘর ছাড়া কামরা হচ্ছে পাঁচটা। দোতালায় আটটা আর নিচের তলায় চারটা কামরা আর বড় হলঘর। একতলা আর দোতালায় হোটেলের অতিথিরা থাকে, স্বপনরা থাকে তিন তলায়। দোতালায় ওঠার সিঁড়ি হলঘরের ভেতর দিয়ে, তেতালায় উঠতে হয় বাইরে দিয়ে।
ট্যুরিস্ট সিজনে এক মাস আগে জেরানিয়ামের কামরা বুক করতে হয়। সেপ্টেম্বরের শেষে ট্যুরিস্ট সিজন শেষ হয়ে যায়। অক্টোবরের বৃষ্টি, ঝড়ো ঠাণ্ডা বাতাস নবেম্বর পর্যন্ত গড়ায়। তারপর নামে বাভারিয়ার হাড় কাঁপানো শীত। এক রাতের বরফে সব কিছু সাদা হয়ে যায়। মার্চের শেষ থেকে বরফ গলতে আরম্ভ করে। পাহাড়ে পাহাড়ে বুনো টিউলিপ, জেরানিয়াম আর ডেইজির নানা রঙের মেলা বসে। জার্মানির সবচেয়ে সুন্দর আকাশ আর প্রকৃতি দেখার জন্য তখন ঝাঁকে ঝাঁকে আসে ট্যুরিস্টরা।
গাড়ি সোজা গ্যারেজে তুলে দিয়ে বাবা বললেন, বেচারা টমাসের নিশ্চয় খুব ঝামেলা যাচ্ছে। আজ তো মার্থাও আসেনি।
টমাস হচ্ছে জেরানিয়ামের ম্যানেজার। মার্থা বার-এ বসে। সব মিলিয়ে জেরানিয়ামের কর্মচারী আটজন। টমাস আর মার্থা ছাড়া ওয়েটার ওয়েট্রেস আছে চারজন, একজন বাবুর্চি, আরেকজন পাহারাদার। রান্নার কাজে স্বপনের মা প্রায়ই বাবুর্চি গুস্তাভকে সাহায্য করেন। অতিথি বেশি হলে স্বপন আর শীলাও ওয়েটারের পোশাক পরে কাজে লেগে যায়। বাবা ক্যাশ সামলান।
স্বপনরা যা ভেবেছিলো হল রুমে ঢুকে তাই দেখলো। এক কোণায় বার-এর সামনে জমজমাট আসর বসেছে। টমাস আর নোরা মগ ভর্তি বিয়ার দিতে দিতে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। অন্য ওয়েটাররাও ব্যস্ত পায়ে টেবিল থেকে টেবিলে ছুটোছুটি করছে। জাপানি ট্যুরিস্টদের একটা দল বসেছে বড় টেবিলে। ছেলে মেয়ে বুড়ো সব সুদ্ধো দশজন। কোনো টেবিলই খালি নেই। দরজার পাশের টেবিলে মাঝ বয়সী এক জোড়া দম্পত্তি লাল মদ আর মাংসের স্টেক নিয়ে বসেছে। যেভাবে জোরে জোরে কথা বলছিলো দেখেই মনে হয় ইটালিয়ান। জার্মানদের মতো ওরা যখন তখন বিয়ার খায় না। ওদের পছন্দ লাল মদ।
স্বপন আর শীলা পিকনিকের জিনিসপত্র রাখতে ওপরে গেলো। বাবা গেলেন ম্যানেজারের চেম্বারে আর ওদের মা গিয়ে ঢুকলেন রান্নাঘরে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শীলা বললো, গত কদিন ট্যুরিস্ট না আসায় বাবার বেশ মন খারাপ ছিলো।
স্বপন হেসে বললো, আজ একদিনেই সব পুষিয়ে যাবে।
ঠিক তখনই টেলিফোন বাজার শব্দ হলো। স্বপন এক বারে তিন সিঁড়ি টপকে দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো।
.
০২. মিউনিখের বিচিত্র উৎসবে
কাঁধে একটা, হাতে আরেকটা ব্যাগ নিয়ে শীলা ধীরে সুস্থে ওপরে উঠে দেখলো বারান্দার এক কোণে রাখা টেলিফোনে কথা বলতে বলতে স্বপনের মুখ চকচক করছে। গলা তুলে জিজ্ঞেস করলো, কার টেলিফোন?
রিসিভারে হাত চেপে স্বপন চেঁচিয়ে বললো, বন থেকে রনি টেলিফোন করেছে। তারপর আবার ও কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো।
মৃদু হেসে নিজের ঘরে ঢুকে শীলা ব্যাগ দুটো নামিয়ে রেখে হাত পা ঝেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। রনি যখন ফোন করেছে এক ঘন্টার আগে স্বপনের কথা শেষ হবে না।
বছর চারেক আগে বড়দিনের ছুটিতে রাজধানী শহর বন-এ বেড়াতে গিয়ে রনিদের সঙ্গে ওদের পরিচয় হয়েছে। রনির বাবা বাংলাদেশ এম্বাসির কাউন্সিলর। বিজয় দিবসে এম্বাসিতে অনুষ্ঠান হবে শুনে ওরা দেখতে গিয়েছিলো। সেখানে পরিচয়ের সূত্রে জানা গেলো কাউন্সিলর কুতুবউদ্দিন আহমেদ স্বপনের চাচার সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছেন। ছোটবেলায় স্বপনের দাদার বাড়িতেও গেছেন। রনি স্বপনের চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে। বন-এ আমেরিকান স্কুলে পড়ে ও। সেবার স্বপনরা উঠেছিলো হোটেলে। পরদিন কাউন্সিলার কুতুবউদ্দিন বড় মার্সেডি এনে ওদের সবাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। রনির সঙ্গে স্বপনের বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি। এরপর প্রতি শীতেই অন্য সব জায়গায় ঘুরতে গেলে স্বপনরা এক ফাঁকে বন হয়ে আসে। স্বপনের বাবা অবশ্য প্রত্যেকবারই রনির বাবাকে বলেছেন ওদের ডেগেনডর্ফের বাড়িতে বেড়াতে আসতে। এম্বাসির কাজে তিনি এত ব্যস্ত থাকেন যেদুবার প্রোগ্রাম করেও আসতে পারেননি।
স্বপনের বন্ধু হলেও রনিকে শীলার ভালোই লাগে। স্বপনের মতো অতো লম্বা চওড়া নয় ও। হালকা পাতলা গড়ন, চোখে চশমা, চুলগুলো কোকড়া, দুচোখে দুষ্টুমি ভরা, কথাও বলে খুব মজার। গত বার ওকে যখন শীলা নতুন বছরের কার্ড পাঠালো, তার জবাবে রনি লিখেছিলো, প্রতিবারই স্বপনের কার্ডের সঙ্গে তোমার কাছ থেকে একটা কার্ড পাবো আশা করি। এতদিনে সে আশা পূরণ হলো। আরও ভালো লাগতো খামটা যদি নীল হতো আর ভেতরে যদি দু লাইনের একটা চিঠি থাকতো। তাহলে এটুকু অন্তত বলতে পারতাম আমাকে চিঠি লেখার মতো একটা মেয়ে আছে। স্বপনের চিঠিতে ফুটবলের কচকচি পড়তে পড়তে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।
জবাবে শীলা লিখেছিলো, নতুন বছরে বন্ধুদের এত কার্ড পাঠাতে হয়–সবাইকে তার সঙ্গে চিঠি দিতে গেলে প্যাডের অর্ধেকটা শেষ হয়ে যাবে। খামের রঙের ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিলো না। দোকান থেকে কার্ডের সাথে রঙ মিলিয়ে খাম দিয়েছে । তাছাড়া বিশেষ কোনো রঙের প্রতি আমার তেমন পক্ষপাতিত্বও নেই।
এরপর রনি আর চিঠি লেখেনি। টেলিফোনে শীলাকে বলেছে, তুমি ক্রিস্টা উলফের উপন্যাস পড়ে পড়ে যে বখে যাচ্ছো এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
শীলা কোনো জুৎসই জবাব দিতে পারেনি। কারণ রনি মিথ্যে বলেনি। জার্মান লেখিকা ক্রিস্টা উলফের উপন্যাস পেলে ও গোগ্রাসে গেলে। না গেলার কোনো কারণও নেই। ওর বয়সী জার্মানির যে কোনো মেয়েই ক্রিস্টা উলফের নামে পাগল।
মিনিট পনেরো পরেই স্বপন গলা তুলে ডাকলো, শীলা, টেলিফোন ধরো। রনি তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
শীলা উঠে গিয়ে টেলিফোনে হ্যালো বলতেই রনি ওপাশ থেকে খুশিভরা গলায় বললো, আমি তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছি শীলা!
সত্যি বলছো তো? কবে আসবে? আনন্দে ঝলমল করে উঠলো শীলার চেহারা।
স্বপন তো বললো অক্টোবরে যেতে। তোমাদের বাভারিয়াতে নাকি অক্টোবর ফেস্টিভ্যাল হয় তখন? আর নাকি সব হাজার বছরের পুরোনো দুর্গ ছড়িয়ে আছে ওখানে?
শুধু কি পুরোনো! হরর ছবির শুটিং করার মতো রহস্যময় সব দুর্গ আছে বাভারিয়ায়। চলে এসো রনি। দারুণ মজা হবে।
হ্যাঁ, স্বপন বলেছে।
আসবে তো ঠিক! নাকি গতবারের মতো শেষ মুহূর্তে বাতিল করবে?
এবার আসবো। স্বপনকে বলেছি এবার না এলে আর কখনও আসা হবে না।
এ কথা কেন বলছো?
বাবার বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। নবেম্বরে আমরা অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি।
তোমাদের কী মজা রনি! কয়েক বছর পর পর এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ঘুরছে।
মা যদি তোমার কথা শোনে এক্ষুণি চেঁচিয়ে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধাবে!
কেন?
মা বলেন, কোথাও শেকড় না গাড়তেই চলে যেতে হয়, এ কেমন জীবন! মা বরং তোমাদের মত থাকতে পছন্দ করেন।
আমাদের তো শেকড়ই নেই। ম্লান হেসে শীলা বললো, বাবা বলেন আমরা শেকড় ওপড়ানো মানুষ!
বলো কী শীলা! চোদ্দ বছর বাভারিয়ায় আছো, এখনও শেকড় গজালো না? ভয়ানক পাথুরে মাটি নাকি ওখানকার? গাছপালা কিছুই গজায় না?
শীলা হেসে বললো, বাভারিয়ার মতো সবুজ জার্মানির আর কোথাও দেখতে পাবে না।
তোমার মার মতো শেকড় পেয়েও তোমার বাবা কী করে ভাবতে পারেন–তোমরা শেকড় ওপড়ানো মানুষ?
বাবা এখনও ভয়ানক মিস করেন নিজের দেশকে।
মাঝে মাঝে গেলেই পারো।
দেশে বাবার নামে হুলিয়া বেরিয়েছিলো। গেলেই তাকে পুলিশে ধরবে।
কেন ধরবে? তোমার বাবা কী করেছেন?
তিনি রাজনীতি করতেন। বিকেলে বাবার কাছ থেকে শোনা কথাটা চেপে রাখতে পারলো না শীলা। বললো, বাবা একটা ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
কোন অভ্যুত্থানের কথা বলছো? বাইরে বাইরে থাকলেও দেশের সব খবরই রাখে রনি।
যে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল তাহের। তুমি কি তাঁর নাম শুনেছো?
কেন শুনবো না? তাঁর মতো বীর বাংলাদেশে খুব কমই জন্মেছেন।
শীলা ভেবেছিলো ওর বাবা রাজনীতি করতেন, ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন, এসব শুনলে রনি একটু দমে যাবে। বাবার দলের নেতা সম্পর্কে রনির উঁচু ধারণার কথা জানতে পেরে ও খুশি হলো। বললো, তুমি আসছো কিভাবে রনি?
মিউনিখ পর্যন্ত প্লেনে। তারপর বাসে যাবো ভেবেছিলাম। স্বপন বললো, গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে নিতে আসবে। কী পাগলামি দেখ তো! এতদূর আসার কোনো দরকার ছিলো না।
সেটা আমরা বুঝবো। তুমি টিকেট কেটেই ফোন করে ফ্লাইটের সময় জানিয়ে দিও।
ঠিক আছে শীলা। এখন রাখছি। রাতে আশা করি সুন্দর একটা স্বপ্না দেখবে।
গত দু রাত আমি স্বপ্নে দেখেছি একটা বাঁদর আমার পায়ের তলায় পাখির পালক দিয়ে কাতুকুতু দিচ্ছে।
ছেলে বাদর না মেয়ে বাদর?
তা কী করে বলবো?
নিশ্চয় ওটা মেয়ে বাঁদর। আজ তুমি অন্যরকম স্বপ্না দেখবে। বলে টেলিফোন রাখলো রনি।
স্বপন ততক্ষণে নিচে গিয়ে রনির আসার কথা বাবা মাকে জানিয়েছে। শীলা নিচে নেমে দেখলো এ্যাপ্রন পরে স্বপন মহা উৎসাহে অতিথিদের খাবার পরিবেশন করার কাজে লেগে গেছে। ও রান্নাঘরে ঢুকে মাকে বললো, আমি কি তোমাকে কোনো কাজে সাহায্য করতে পারি মাম?
মা মৃদু হেসে বললেন, হোয়াইট সসটা শেষ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে খানিকটা বানাতে পারো।
রান্নাঘরে মার সঙ্গে কাজ করতে শীলা খুবই পছন্দ করে। বললো, কতটুকু বানাবো মাম?
ছোট কাঁচের জারের মাপে করলেই হবে। একটু থেমে মা মুখ টিপে হাসলেন–রনি আসবে শুনে নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছো?
শীলা না বোঝার ভান করে বললো, হ্যাঁ মা, স্বপন খুব ফুর্তিতে আছে।
রাতে খেতে বসে বাবা বললেন, কুতুব ভাইরা চলে যাবেন শুনে খারাপ লাগছে।
মা বললেন, ওঁরা যখন আসতে পারবেন না, আমরাই না হয় এক উইকএ গিয়ে দেখা করে আসবো।
স্বপন বললো, রনি বলেছে ও সাত দিন থাকবে। আমরা ওকে পৌঁছে দেয়ার উপলক্ষে যেতে পারি।
শীলাও ওকে সমর্থন করলো–হ্যাঁ বাবা, খুব মজা হবে।
দুদিন পর রনি টেলিফোন করে জানিয়েছিলো অক্টোবরের এক তারিখ সকাল নটায় ও কেএলএম-এর ফ্লাইটে মিউনিখ আসছে। মা শুনে বললেন, ভালোই হলো। অনেকদিন মিউনিখের অক্টোবর ফেস্ট-এ যাই না। রনিকে আনার সুযোগে ফেস্টিভ্যাল দেখা হয়ে যাবে।
প্রত্যেক বছর মিউনিখের অক্টোবর ফেস্ট দেখার জন্য সারা ইউরোপ থেকে হাজার হাজার ট্যুরিস্ট আসে। পৌনে দুশ বছর আগে রাজা ম্যাক্স জোসেফ অক্টোবরের পয়লা তারিখে গোটা মিউনিখ শহরের বাসিন্দাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন বাভারিয়ার যুবরাজ লুডভিগের সঙ্গে সাশেনের রাজকুমারী থেরেসার বিয়েতে। শহরতলীতে এই উৎসব এমনই জমেছিলো যে কেউ সেটা ভুলতে পারলো না। রাজার রক্ষী বাহিনী ঘোষণা করলো, প্রতিবছর তারা অক্টোবরের পয়লা তারিখে এই উৎসব করবে। সেই থেকে শুরু। বাভারিয়ার মানুষ সারা বছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে।
এক তারিখে অতি ভোরে স্বপনরা সবাই তৈরি হয়ে গেলো মিউনিখ যাবার জন্য। বাভারিয়ার রাজধানী ওদের ছোট জনপদ ডেগেনডর্ফ থেকে গাড়িতে আড়াই ঘন্টার পথ। বাবা শুধু ফর্মাল স্যুট পরেছেন। মা পরেছেন বাভারিয়ার মেয়েদের সনাতন পোষাক লম্বা ঝুলওয়ালা প্রচুর লেসের কাজ করা দামী ভেলভেটের গাউন। স্বপন আর শীলাও বাভারিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছে। স্বপনের সাজ দেখে মা মন্তব্য করলেন, কোমরে একটা তলোয়ার ঝোলালে ওকে নাকি রাজকুমার লুডভিগের মতো লাগবে।
শীলা মুখ টিপে হেসে বললো, আফসোস হচ্ছে আমাদের এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রিন্সেস এ্যানি আমাদের প্রিন্সকে দেখতে পেলো না।
মা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, প্রিন্সেস এ্যানি কে?
স্বপনদের স্কুলে পড়ে।
কোথাকার প্রিন্সেস?
স্বপন যদি প্রিন্স হতে পারে এ্যানিও প্রিন্সেস হতে পারে।
আমি কক্ষণো প্রিন্স হতে চাই না। প্রতিবাদ করলো স্বপন
বাবা তাড়া দিলেন, রাজ-রাজড়ার গল্প গাড়িতে উঠেও করতে পারবে। সবাই ঝটপট উঠে পড়ো।
ডেগেনডর্ফ থেকে মিউনিখ দেড়শ কিলোমিটারের কিছু বেশি। হাইওয়েতে ওঠার খানিক পরই স্বপনরা দেখলো শুধু ওরা নয়, আশে পাশের এলাকা থেকে আরও অনেক পরিবার মিউনিখের অক্টোবর ফেস্ট-এ যাচ্ছে। গাড়ির আরোহীদের জমকালো সনাতনী পোষাকই বলে দিচ্ছিলো ওদের গন্তব্য কোথায়। সেদিন আবহাওয়াতেও ছিলো উৎসবের আমেজ। ভোরের নরম আলোয় নীল আকাশ চকচক করছে। কোথাও মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। রাতের কুয়াশা তখনও ফিনফিনে মলমল কাপড়ের মতো হাইওয়ের ডান পাশে ঢেউ খেলানো রাইয়ের ক্ষেতে আর বাঁদিকে ইশার নদীর ওপর বিছানো ছিলো। ফসলের ক্ষেতের পরই মাঝে মাঝে বন আর ছোট ছোট জনপদ। রঙিন কাঠের বাড়ির পাথরের চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে, জানালাগুলোর নিচে টবের ভেতর লাল, গোলাপি আর সাদা জেরানিয়াম থোকা থোকা ফুটে আছে। বাভারিয়া ছাড়া জার্মানির আর কোথাও এত জেরানিয়াম দেখা যাবে না।
ঘুম থেকে ওঠার পর পরই স্বপন নাশতা খেতে পারে না। এমনিতে ও ঘুম থেকে ওঠে ছটায়। নাশতা খেতে খেতে সাড়ে সাতটা আটটা বাজে। ঘরে হালকা কিছু ব্যায়ামের ফাঁকে টেলিভশনে মিউজিক্যাল শো দেখে। তারপর মাইল খানেক জগিং করে ফিরে এসে এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস খায়। বাবা মা ওঠেন সাতটার দিকে। ওদের সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসতে আরও আধঘন্টা। সেদিন শীলা ভোরে উঠেই বাবা মার সঙ্গে নাশতা সেরে নিয়েছিলো। স্বপন দুটো স্যান্ডউইচ আর অরেঞ্জ জুস খেলো চলন্ত গাড়িতে বসে।
ওরা মিউনিখের যত কাছে আসছিলো রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ততই বাড়ছিলো। বেশির ভাগই যাচ্ছিলো উৎসবে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্বপনদের গাড়ির স্পীড কমাতে হলো। ওরা মিউনিখ এয়ারপোর্ট পৌঁছলো নটা বাজার দশ মিনিট আগে। ওপরে ঝোলানো টেলিভিশনের পর্দায় লেখা দেখলো, কেএলএম সময় মতোই আসবে।
বাবা মা গাড়ি থেকে নামেননি। ভীষণ ব্যস্ত এয়ারপোর্ট মিউনিখ। গাড়ি পার্কিং-এ খুব অসুবিধে হয়। কাছাকাছি পার্কিং না পেয়ে বাবা বললেন, স্বপন আর শীলা গিয়ে রনিকে নিয়ে এসো। আমরা গাড়ি নিয়ে এদিকে ঘোরাঘুরি করবো। তোমরা এসে এই টেলিফোন বুথটার পাশে দাঁড়াবে।
মিউনিখ এয়ারপোর্টের নাড়িনক্ষত্র সব কিছু স্বপনদের জানা। প্রতি বছর বাইরে যাওয়ার জন্য বার দুয়েক আসতে হয়। শীলা এক মুঠো চুইং গাম কিনলো। তারপর রনির জন্য এ্যারাইভাল লাউঞ্জে দাঁড়ালো। অক্টোবর ফেস্ট দেখার জন্য বিদেশী টুরিস্টও কম আসেনি। বেশিক্ষণ অবশ্য দাঁড়াতে হয়নি ওদের। মিনিট পাঁচেক পরই ওরা আগত যাত্রীদের ভিড়ে কাঁধে এয়ারব্যাগ, হালকা খয়েরি রঙের জ্যাকেট পরা রনির হাসিমাখা মুখ দেখতে পেলো। চশমার ভেতর রনির দুষ্টুমিভরা চোখ দুটো ওদেরই খুঁজছিলো। স্বপন গলা তুলে বললো, হাই রনি।
রনি ওদের দেখতে পেয়ে হাত তুললো। ভিড় ঠেলে আসতে গিয়ে এক বুড়ির ধমক আর এক বুড়োর কটমটে চাউনি ওকে হজম করতে হলো। কাছে আসতেই শীলা বললো, বুড়িটা নির্ঘাত তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছে রনি, নইলে একতরফা এত কথা বলতো না।
রনি হেসে বললো, পছন্দ করেছে বলেই আমাকে কয়েকবার যমের বাড়িতে পাঠিয়েছে। আর আমার বাবা মা, স্কুলের টিচার সবাইকে ধোলাই দিয়েছে।
স্বপন জিজ্ঞেস করলো, তোমার আর লাগেজ নেই?
কাঁধের ব্যাগ দেখিয়ে রনি বললো, তিন চার দিনের জামা কাপড় এর ভেতরই আছে।
বললেই হলো, তিন চার দিন? সাত দিনের আগে আমরা তোমাকে যেতে দিচ্ছি না। শীলা রায় ঘোষণা করলো।
তার মানে আমাকে তোমার জামাকাপড় পরতে হবে।
স্বপন বললো, তুমি আমার কাপড় পরবে। মেয়েদের কাপড় কেন পরতে যাবে?
তোমার প্যান্ট শার্ট পরলে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রনির যা স্বাস্থ্য–কথাটা বাড়িয়ে বলেনি।
শীলা বললো, এখানে দাঁড়িয়ে বক বক না করে চলো গাড়িতে গিয়ে উঠি। বেচারা বাবা মা নিশ্চয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
ওঁরা এলেন না কেন?
যেতে যেতে রনিকে পার্কিং-এর সমস্যার কথাটা বললো স্বপন। শেষ করলো এই বলে, কুতুব চাচা আর চাচী এলে বাবা খুব খুশি হতেন।
বাবা মার দম ফেলার সময় নেই। আজ থেকে প্যাকার্স কোম্পানির লোক আসবে। আগামী দশদিন যে কী ভয়ানক অবস্থা হবে ভাবতেও ভয় হয়। বাবার বদলির আগের কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা রনির জন্য মোটেই সুখকর নয়।
ওকে নিয়ে টেলিফোন বুথের পাশে মিনিট দশেক দাঁড়াতে হলো স্বপন আর শীলাকে। সাঁই করে এসে ওদের পাশে গাড়ি থামিয়ে বাবা হেসে বললেন, ভালো আছো তো রনি? উত্তরের অপেক্ষা না করে তাড়া দিলেন, ঝটপট উঠে পড়ো। পুলিশ টের পেলে জরিমানার টিকেট লাগিয়ে দেবে।
ওরা তিনজন পেছনে বসলো। চারজন আরামে বসা যায় বিএমডব্লুর এই মডেলটায়। শীলা জানতে চাইলো, আমরা এখন কোথায় যাবো বাবা?
আগে ওল্ড মার্কেট স্কয়ারের কফি শপে গিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিই। তারপর প্যারেডে যাবো।
স্বপন মুখ টিপে হেসে বললো, এমন একটা দিনে বিয়ারের বদলে তুমি কফি দিয়ে গলা ভেজাবে বাবা?
ওর কথা শুনে বাবাও হাসলেন–আমি আর তোমার মা না হয় বিয়ার খেলাম। তোমাদের তো কফি খেতে হবে।
অক্টোবর ফেস্ট-এ এসে এক পাত্র বিয়ার খাবো না–একথা শুনলে আমাদের বন্ধুরা হাসাহাসি করবে। প্লীজ বাবা!
প্লীজ বললেও লাভ নেই। মোল বছর হওয়ার আগে এ্যালকহল ছুঁতে পারবে না-এ কথা আগেও তোমাদের বলেছি।
শীলা ভালো মানুষ সেজে বললো, তোমরা বলছো কেন বাবা? আমি কি বিয়ার খেতে চেয়েছি?
মা বললেন, আমি যদুর জানি অক্টোবর ফেস্ট-এ ছোটদের জন্য নন এ্যালহলিক বিয়ার পাওয়া যায়।
শীলা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, বলো কি মা! সোনালি রঙ হয়, মগভর্তি ফেনা হয়!
সব হয়। খাওয়ার সময় গন্ধও পাবে। শুধু এ্যালকহলের ঝাঁঝটা সেখানে থাকবে না।
তাই সই বাবা। স্বপন মন্তব্য করলো, বিয়ার হলেই চলবে। লোকে বুঝুক আমরা বড় হয়েছি।
রনি মৃদু হেসে বললো, আর কত বড় হবে স্বপন। এমনিতেই ছ ফুট ছুঁই ছুঁই করছো।
শীলা মুখ টিপে হাসলো–কার্ল ছয় এক। সেজন্য স্বপনকে ছয় দুই হতে হবে।
কার্ল কে? জানতে চাইলো রনি।
শীলার প্রাণের বন্ধু। খোঁচানোর ভঙ্গিতে বললো স্বপন।
আমার কোনো প্রাণের বন্ধু নেই। হেসে বললো শীলা–তবে এ্যানির জন্য স্বপন প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকলেও সে কিন্তু পছন্দ করে উলফকে।
স্বপন রেগে উঠলো, দ্যাখ শীলা, সব সময় ভাঙা রেকর্ডের মতো এক কথা বার বার বলবি তো …।
শীলা বাবার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে বললো, জানি কান ছিঁড়ে ফেলবে।
কথাটা মনে রাখলে খুশি হবো।
মা রনিকে বললেন, সারাক্ষণ দুটো দুরন্ত চড়ুই পাখির মতো একজন আরেক জনকে খোঁচাচ্ছে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু দন্ড কথা বলার উপায় নেই। চারদিক থেকে লোকজনের ধাক্কা-ধাক্কি দেখে মনে হচ্ছে যেন সবাই শেষ বাস মিস করতে যাচ্ছে। ভিড়ের ভেতর মোটা সোটা এক হাইল্যান্ডার জার্মান বাবাকে ধাক্কা দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন–আরে শফিক তুমি এখানে! ভদ্রলোকের চোখ দুটো দুর্লভ জিনিস আবিষ্কারের উচ্ছ্বাসে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
বাবাও উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, উলরিখ তুমি? কতদিন পর দেখা হলো বলতো?
এরপর দুজনের কোলাকুলি আর হাত মেলানো শেষই হতে চায় না। হঠাৎ বাবার মনে পড়লো তার সঙ্গীদের কথা। মাকে বললেন, ইভা, আগে না দেখলেও উলরিখের কথা তোমাকে বলেছি। এদেশে এসে ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ যার বাড়িতে প্রথম ছিলাম । তুখোড় সাংবাদিক! ডার স্পিগেলে আছে।
মা হেসে উলরিখের সঙ্গে হাত মেলালেন–আপনার কথা অনেক শুনেছি পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, উলরিখ আমার সবচেয়ে বিপদের দিনের বন্ধু।
স্বপন, শীলা, রনি সবাই তাকে খাঁটি জার্মান কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে বললো, গুটেনটাখ।
অভিবাদনের জবাব দিয়ে উলরিখ বন্ধুকে নিয়ে পড়লেন–অনেক কথা জমে আছে শফিক। চলো এক পাত্র কড়া হুইস্কি পান করি। ফুলাইন ইভা, আপনিও চলুন। ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াতে বেশি পছন্দ করবে। এই বলে বন্ধুকে চোখ টিপলেন ।
বাবা হাসলেন–তুমি আগের মতোই আছো। ঠিক আছে স্বপন; দুপুরের লাঞ্চ পর্যন্ত তোমরা মুক্ত । একটায় আমরা গাড়ির সামনে মিলিত হবো। কোনো উল্টোপাল্টা কাজ করবে না।
ভিড়ের জন্য ওদের গাড়ি বেশ খানিকটা দূরে পার্ক করতে হয়েছে। অযাচিত স্বাধীনতা পেয়ে স্বপনরা বেজায় খুশি আমাদের জন্য ভেবো না আমরা ঠিক থাকবো। বলে দুই হাতে শীলা আর রনিকে ধরে চোখের পলকে স্বপন ভিড়ে মিশে গেলো।