ট্রলারে বসে থাকা মানুষগুলো কেউই খুব বেশি কথা বলে না—তাতে অবশ্যি জহুরের খুব সমস্যা হলো না, বরং একটু সুবিধেই হলো, কারণ সে নিজেও খুব বেশি কথা বলে না। ট্রলারের ইঞ্জিনের বিকট শব্দ—কথা বলতে হলেও সেটা বলতে হয় চেঁচিয়ে, কানের কাছে মুখ লাগিয়ে। যে হাসপাতালের মেঝে ইতালি থেকে মার্বেল এনে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে রোগী আনা হয় হেলিকপ্টারে সেই হাসপাতালে ইন্টারভিউ নেয়ার মানুষগুলোর জন্যে কেন আরেকটু ভালো ট্রলারের ব্যবস্থা করা যায় না, সেটা জহুর বুঝতে পারল না।
ট্রলারের ছাদে বসে জহুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। জহুরের মনে হয় সমুদ্রের একটা নিজস্ব মেজাজ আছে আর সেই মেজাজের ওপর নির্ভর করে তার একটা নিজস্ব রূপ তৈরি হয়। যখন মেজাজ খারাপ থাকে তখন পানির রং হয় কালো, ঢেউগুলো ফুসে ওঠে। এই মুহূর্তে সমুদ্রের মনে হয়। ফুরফুরে হালকা মেজাজ তাই সমুদ্রের পানির মাঝে স্বচ্ছ হালকা একটা নীল রং, ছোট ছোট ঢেউ, তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। জহুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক দূরে হালকা ধূসর বর্ণের। একটা দ্বীপ দেখতে পেল। তারা এখন এই দ্বীপটাতেই যাচ্ছে।
খুব ধীরে ধীরে দ্বীপটা স্পষ্ট হতে থাকে, জহুরের ধারণা ছিল সে মাথা উঁচু করে থাকা বড় বড় দালান দেখতে পাবে কিন্তু সে রকম কিছু দেখল না। যতই কাছাকাছি আসতে থাকে দ্বীপটাকে ততই গাছগাছালি টাকা অত্যন্ত সাধারণ একটা দ্বীপ বলে মনে হতে থাকে। খুব কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ একটা ছোট হেলিকপ্টারকে উঠে যেতে দেখা গেল—এটি না দেখলে এখানে যে কোনো বৈশিষ্ট্য আছে সেটা বোঝার কোনো উপায়ই থাকত না।
ট্রলারটা জেটিতে থেমে যাওয়ার পর জহুর অন্য মানুষগুলোর সাথে ট্রলার থেকে নেমে আসে। জেটিতে খাকি পোশাক পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, সে সবাইকে কাছাকাছি একটা ছোট ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সবাইকে একজন একজন করে একটা নীল পর্দার সামনে দাঁড়া করিয়ে একটা ছবি তুলে তাদের নাম পরিচয় লিখে আইডি কার্ড তৈরি করে দিল। একজন মহিলা জহুরের হাতে কার্ডটি তুলে দিয়ে বলল, যতক্ষণ এখানে থাকবেন এটা গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
মনে রাখবেন এটা খুব জরুরি। এক সেকেন্ডের জন্যেও খুলবেন না। খুললে কিন্তু ঝামেলা হতে পারে।
ঝামেলা?
হ্যাঁ। এখানে সিকিউরিটি খুব টাইট।
একটা হাসপাতালে সিকিউরিটি কেন টাইট হতে হবে জুহুর সেটা খুব ভালো বুঝতে পারল না, কিন্তু সে এটা নিয়ে কোনো প্রশ্নও করল না। সে কম কথার মানুষ।
আপনি চলে যাওয়ার সময় আই.ডি, কার্ডটা এখানে জমা দিয়ে যাবেন?
জহুর মাথা নাড়ল, যাব।
এই দ্বীপে খাবার জায়গা আছে—আই ডি কার্ডটা দেখিয়ে যখন যা খেতে চান খেতে পারবেন।
ঠিক আছে।
পিছন দিকে একটা ডর্মিটরি আছে, যদি রাতে থাকতে হয় সেখানে থাকতে পারবেন।
ঠিক আছে।
আপনার যখন ইন্টারভিউ নেয়ার সময় হবে আপনাকে ডেকে আনা হবে।
জহুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে ডেকে আনা হবে?
আপনি যেখানেই থাকেন সেখান ডেকে আনবে। সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
সে যেখানেই থাকবে তাকে সেখান থেকেই কীভাবে ডেকে আনবে সেটা জহুর ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সে সেটা নিয়ে কোনো কথা বলল না, আইডি কার্ডটা গলায় ঝুলিয়ে বের হয়ে এলো।
দ্বীপের কিনারা দিয়ে একটা খোয়া বিছানো রাস্তা চলে গেছে—জহুর সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। একটু পরপর বসার জন্যে পাথরের বেঞ্চ বসানো আছে, এই পাথরগুলো না জানি কোথা থেকে এনেছে। দ্বীপটা শুরুতে কেমন ছিল অনুমান করা কঠিন, এখন গাছগাছালিতে ঢাকা। খোয়া বিছানো রাস্তার দুই পাশে বড় বড় নারকেল গাছে, সমুদ্রের বাতাসে তার। পাতাগুলো শিরশির শব্দ করে কাঁপছে।
জহুর সরু রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরো এলাকাটা সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা করে। দ্বীপের মাঝামাঝি যে বড় দালানটি রয়েছে সেটা সম্ভবত মূল হাসপাতাল, দালানটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে শুধু সামনের একটা বড় গেট দিয়ে সেখানে ঢোকা যায়। তাই এটাকে দেখে ঠিক হাসপাতাল মনে হয় না, মনে হয় একটা জেলখানা।
দ্বীপের খোয়া বাঁধানো রাস্তাটি ধরে হেঁটে হেঁটে জহুর দ্বীপের শেষ প্রান্তে চলে আসে। অনমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে জহুর লক্ষ করল, হঠাৎ করে খোয়া বাধানো রাস্তা শেষ হয়ে সেখানে খানিকটা পথ কংক্রিটের, সেটা শেষ হয়ে আবার খোয়া বাঁধানো পথ শুরু হয়েছে। জহুর দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে-হঠাৎ করে খানিকটা জায়গা কংক্রিটের কেন? সে ডানে-বামে তাকালো, তার মনে হলো কংক্রিটে বাঁধানো অংশটুকু আসলে একটা সুরঙ্গের উপরের অংশটুকু। সুরঙ্গের অন্যপাশে মাটি ফেলে ঘাস লাগানো হয়েছে, এখানে লাগাতে পারেনি। দ্বীপের মাঝখানে যে হাসপাতালটি আছে সেখান থেকে সুরঙ্গটা এসেছে—সমুদ্রের তীরে গিয়ে শেষ হয়েছে। জহুর ভালো করে তাকিয়ে দেখে সুরঙ্গটা যেখানে শেষ হবার কথা সমুদ্রের তীরে সেখানে গাছগাছালি ঢাকা জায়গায় দুটো স্পিডবোট, ভালো করে না তাকালে সেটা দেখা যায় না। ব্যাপারটা হঠাৎ করে জহুরের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়—হাসপাতালের ভেতর থেকে হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ার এটা একটা গোপন রাস্তা। জহুরের কাছে ব্যাপারটা খানিকটা দুর্বোধ্য ঠেকে—হাসপাতাল থেকে কেউ কেন কখনো গোপন পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে?
জহুরের একবার ইচ্ছে করল নিচে নেমে গিয়ে গোপন পথের দরজাটি দেখে আসে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা করল না। এটা আসলেই যদি গোপন সুরঙ্গ হয়ে থাকে তাহলে সে যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এটা দেখার চেষ্টা করে তাহলে অনেকেই তার ওপর সন্দিহান হয়ে উঠবে। একদিনের জন্যে বেড়াতে এসে মানুষজনকে বিরক্ত করার তার কোনো ইচ্ছে নেই। হয়তো এই মুহূর্তেই তাকে কেউ কেউ তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে। কাজেই জহুর ভান করল সে কিছুই দেখেনি। অন্যমনস্কভাবে এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে ইতস্তত ভাব করে আবার হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়।
দ্বীপটা নিশ্চয়ই বেশ ছোট। কারণ বেশ অল্প সময়ের মাঝেই সে পুরোটা ঘুরে এলো। দ্বীপটা সাজানো-গোছানো এবং সুন্দর, মানুষজন বলতে গেলে নেই, পুরো দ্বীপটাই বেশ নির্জন। মূল দালানের বাইরে কয়েকটা ছোট ছোট দালান রয়েছে, এর মাঝে কোনো একটা সম্ভবত ডর্মিটরি। জহুর যদি সত্যি সত্যি এখানে চাকরি নেয় তাহলে তার এ রকম কোনো একটা ডর্মিটরিতে তার দিন কাটাতে হবে।
জহুর যখন হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে তার মার্বেল পাথরের মেঝে, হেলিকপ্টারের হেলিপ্যাড এসব দেখবে কি না চিন্তা করছিল তখন খাকি পোশাক পরা একজন মানুষ লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে এলো। মানুষটা কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?
জহুর মাথা নাড়ল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা বলল, আপনার নাম জহুর হোসেন?
হ্যাঁ।
আমার সাথে আসেন— বলে মানুষটা ঘুরে জহুরের জন্যে অপেক্ষা করেই হাঁটতে শুরু করে।
জহুর কোনো কথা না বলে মানুষটার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। খাকি পোশাক পরা মানুষটা হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যায়, সামনে একটা বড় গেট, গেটটা বন্ধ। খাকি পোশাক পরা মানুষটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার গলায় ঝোলানো কার্ডটা গেটের নির্দিষ্ট একটা ফোকরে ঢুকিয়ে দিতেই গেটটা ঘরঘর শব্দ করে খুলে গেল।
খাকি পোশাকপরা মানুষটার সাথে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই গেটটা আবার ঘরঘর শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের তিনতলায় যেতে হবে।
তিনতলায়?
হ্যাঁ। স্যার তিনতলায় বসেন।
কোন স্যার? কীদের স্যার।
জহুল বলল, অ
খাকি পোশাক পরা মানুষটা ভেবেছিল কাদের স্যার কে সেটা নিয়ে জহুর কোনো একটা প্রশ্ন করবে, জহুর কোনো প্রশ্ন করল না তাই সে নিজে থেকেই বলল, কাদের স্যার আমাদের এম.ডি.।
জহুর বলল, অ।
কাদের স্যার নিজে সবার ইন্টারভিউ নেন।
জহুর আবার বলল, অ।
কাদের স্যারের মতোন দ্বিতীয় মানুষ কেউ কখনো দেখে নাই।
জহুর ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে কেন কাদের স্যারের মতো দ্বিতীয় মানুষ কেউ কখনো দেখে নাই, কিন্তু কী ভেবে শেষ পর্যন্ত কিছু জিজ্ঞেস করল না, বলল, অ।
জহুরের জবাব দেবার ধরন দেখে খাকি পোশাক পরা মানুষটা এর মাঝে তার সাথে কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখ শক্ত করে এগিয়ে যায়, জহুরও কোনো কথা না বলে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে।
একটা লিফটে করে তিনতলায় উঠে যাওয়ার পর জহুর প্রথমবার হাসপাতালের ভেতরটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। একটা বিশাল করিডোরের দুই পাশে ছোট ছোট অনেকগুলো কেবিন। হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে একটা কেবিনের জানালায় তার দৃষ্টি আটকে যায়, আঠারো উনিশ বছরের একটা মেয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, মেয়েটির মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন, দেখে কেন জানি বুকের ভেতরটুকু কেঁপে ওঠে। জহুর সেখানে দাঁড়িয়ে গেল, মেয়েটি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়েছে। দেখে মনে হয় বুঝি কিছু একটা বলবে। জহুর জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কিছু বলবে।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। জহুর বলল, বল।
মেয়েটি কোনো কথা না বলে জহুরের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল। খাকি পোশাক পরা মানুষটা তখন জহুরের পিঠে হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে বলল, দাঁড়াবেন না। চলেন।
জহুর এই প্রথমবার নিজে থেকে কথা বলল। খাকি পোশাক পরা। মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটার কী হয়েছে?
মানুষটা কাঁধ বাঁকিয়ে বলল, মানসিক রোগ।
জহুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, মানসিক রোগ?
হ্যাঁ।
এইটা কি মানসিক রোগের হাসপাতাল?
এইটা সব রোগের হাসপাতাল।
সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপের মাঝখানে কেমন করে সব রোগের হাসপাতাল তৈরি করে রাখা হয়েছে জহুরের সেটা জানার ইচ্ছে করছিল কিন্তু খাকি পোশাক পরা এই মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে সেটা জানা যাবে বলে তার মনে হলো না, তাই সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। হেঁটে ঘুরে যেতে যেতে সে আবার ঘুরে তাকালো, জানালার কাছে তখনো ভাবলেশহীন চোখে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হেঁটে যেতে যেতে কেবিনের নম্বরটি জহুরের চোখে পড়ল তিনশ তেত্রিশ। তিন তিন তিন।
খাকি পোশাক পরা মানুষটি করিডোরের শেষ মাথায় একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইন্টারকম সুইচে চাপ দিয়ে বলল, স্যার।
জহুর ইন্টারকমে একটা ভারী গলা শুনতে পেল, বল।
জহুর হোসেন ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।
ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
খাকি পোশাক পরা মানুষটি জহুরকে ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত করল। জহুর দর্জী খুলে ভেতরে ঢুকে একটু হকচকিয়ে যায়। সে মনে মনে খুব হাল ফ্যাশনের একটা অফিস দেখবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু এটা মোটেও সে রকম নয়। ঘরের ভেতর চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, তার মাঝখানে কাঁচাপাকা চুলের একজন মানুষ একটা মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে কী। একটা দেখছিল, মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়ান।
কাঁচাপাকা চুলের মানুষটি নিশ্চয়ই ডক্টর কাদের, সে এক সেকেন্ড দাঁড়ানোর কথা বললেও বেশ কিছুক্ষণ মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলল না। জহুর অবাক হলো না। ক্ষমতাশালী মানুষেরা সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের ক্ষমতা বোঝানোর জন্যে এটা করে, তাদেরকে অকারণে দাঁড় করিয়ে রাখে। জহুর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে থাকে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই সে চেনে না, শুধু ঘরের দেয়ালে লাগানো টেলিভিশন স্ক্রিনগুলো সে চিনতে পারল। এক একটা স্ক্রিনে দ্বীপের এক একটা সমুদ্রতীর দেখা যাচ্ছে। সে যখন দ্বীপটাকে ঘিরে ঘুরছিল তখন তাকে নিশ্চয়ই এই স্ক্রিনগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ভালোই হয়েছে সুরঙ্গটা নিয়ে সে বেশি কৌতূহল দেখায়নি।
ডক্টর কাদের এক সময় মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলে জহুরের দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলল, বসেন।
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, বসতে হবে না।
জহুরের কথা শুনে ড. কাদেরের মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না, সে শান্তু মুখে বলল, আমার এখানে ইন্টারভিউ দিতে হলে সামনে বসতে হবে। বসে হাত দুটো টেবিলে রাখতে হবে।
জহুরের ইচ্ছে হলো সে জিজ্ঞেস করে কেন তার চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রাখতে হবে কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস না করে চেয়ারে বসে টেবিলে হাত রাখল। জুর কাদের এসে টেবিলের অপর পাশে রাখা তার নরম আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখল। কি-বোর্ডে কিছু একটা লিখে ডক্টর কাদের জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যতক্ষণ আপনার সাথে কথা বলব আপনি ততক্ষণ হাতটা টেবিলে চাপ দিয়ে রাখবেন।
কী কারণে হাত চাপ দিয়ে রাখতে হবে জহুরের সেটা জানার কৌতূহল হচ্ছিল কি সে সেটাও জানতে চাইল না, টেবিলে হাতটা একটু জোরে চেপে ধরল। ডক্টর কাদের বলল, চমৎকার। এবার আমি প্রশ্ন করব আপনি সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
জহুর বলল, ঠিক আছে।
ডক্টর কাদের মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বলল, শুধু একটা ব্যাপার।
কী ব্যাপার?
আমি আপনাকে যে প্রশ্ন করব আপনি তার ভুল উত্তর দেবেন।
জহুর ভুরু কুঁচকে বলল, ভুল উত্তর?
হ্যাঁ। আপনি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না।
সঠিক উত্তর দিতে পারব না?
না। প্রত্যেকটা উত্তর হতে হবে মিথ্যা—
মিথ্যা?
ড. কাদের মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। মিথ্যা।
কেন প্রশ্নের উত্তর মিথ্যা দিতে হবে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে জহুর থেমে গেল। তার কেন জানি মনে হলো এই প্রশ্নটার সঠিক উত্তরটা সে ডক্টর কাদেরের কাছ থেকে পাবে না।
ডক্টর কাদের জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে শুরু করি?
করেন।
আপনার নাম কী?
জহুর বলল, আমার নাম ডক্টর কাদের।
জহুরের উত্তর শুনে ডক্টর কাদেরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসিমুখে কম্পিউটারের দিকে তাকালো এবং হঠাৎ করে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে ভুরু কুঁচকে জহুরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন আপনার নাম?
আমি বলেছি আমার নাম ডক্টর কাদের।
ডক্টর কাদের আবার কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকালো এবং তার মুখ কেমন জানি গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে জিব দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কখনো মানুষ খুন করেছেন?
করেছি।
ডক্টর কাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার জহুরের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, কয়টা?
একটা।
কীভাবে?
একটা গামছা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরেছিলাম।
কেন খুন করেছেন?
পূর্ণিমার রাতে যখন অনেক বড় চাঁদ ওঠে তখন আমার মানুষ খুন করার ইচ্ছে করে।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ তার কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে, জহুর বুঝতে পারে কোনো একটা বিষয় ডক্টর কাদেরকে খুব বিভ্রান্তু করে দিয়েছে কিন্তু সেটা কী জহুর ঠিক বুঝতে পারল না।
ডক্টর কাদের এবারে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি কি আকাশে উড়তে পারেন?
জহুর মাথা নাড়ল, বলল, পারি।
কীভাবে ওড়েন?
পাখা দিয়ে।
আপনার কী পাখা আছে?
আছে। আমার দুটি বিশাল পাখা আছে। ভঁজ করে পিঠে লুকিয়ে রাখি—কেউ দেখতে পায় না।
আপনি কখন আকাশে ওড়েন?
সন্ধ্যেবেলা সূর্য ড়ুবে গেলে আমি আকাশে উড়ি। প্রতিদিন।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে থেকে জহুরের দিকে তাকালো, বলল, আমার ইন্টারভিউ শেষ।
জহুর টেবিল থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি কি এখন যেতে পারি?
একটু দাঁড়ান।
জহুর চেয়ার থেকে উঠে একটু সরে দাঁড়াল। ডক্টর কাদের বলল, আমি আপনাকে আমার এখানে চাকরি দিতে চাই।
জহুর কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ডক্টর কাদের বলল, আপনি কি এখানে চাকরি করবেন?
জহুর একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি কেন আমাকে চাকরি দিতে চাইছেন?
কারণ আপনার নার্ভ ইস্পাতের মতো শক্ত।
আপনি কেমন করে জানেন?
আমি জানি। আপনি শান্ত গলায় শরীরের একটি লোমকূপেও একটু আলোড়ন না করে ভয়ঙ্কর বিচিত্র কথা বলে ফেলতে পারেন। আমি আগে এ রকম কখনো কাউকে দেখিনি।
তার মানে কী?
তার মানে আপনি কখনো উত্তেজিত হন না—আপনি অত্যন্ত ঠান্ডা মানুষ। ঠান্ডা মাথায় শান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমার আপনার মতো একজন মানুষের দরকার।
জহুর বলল, অ।
আপনি কি আমার এখানে চাকরি করবেন?
জহুর মাথা তুলে ডক্টর কাদেরের চোখের দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, তার আগে আমার জানা দরকার আপনি কী করেন?
ডক্টর কাদের থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কী করি?
হ্যাঁ।
আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
জহুর শান্ত গলায় বলল, এই দ্বীপের মাঝে আপনি যে হাসপাতালটা বানিয়েছেন, এটা আসলে হাসপাতাল না। এটা অন্য কিছু। আমি জানতে চাইছি এটা কী?
ডক্টর কাদের কয়েক মুহূর্ত জহুরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এটা হাসপাতাল।
জহুর খুব বেশি হাসে না, তার মুখের মাংসপেশি হাসতে অভ্যস্ত নয় তাই সে যখন হাসে তাকে কেমন যেন বিচিত্র দেখায়। জহুর তার সেই বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার কাছে কোনো যন্ত্র নাই, কিন্তু যখন কেউ মিথ্যা কথা বলে আমি সেটা বুঝতে পারি।
ডক্টর কাদের কোনো কথা বলল না, জহুর নিচু গলায় বলল, কোথাও কাজ করার আগে আমার জানা দরকার সেখানে কী হয়। আমি জানি এটা আসলে হাসপাতাল না। এটা অন্য কিছু। এখানে কাজ করার আগে আমাকে জানতে হবে এটা কী।
ডক্টর কাদের কিছুক্ষণ জহুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেমন করে জানেন এটা অন্য কিছু?
আমি জানি। তা ছাড়া—
তা ছা কী?
তা ছাড়া তিনশ তেত্রিশ নম্বর কেবিনে যে মেয়েটি আছে—
ডক্টর কাদের হাত তুলে জহুরকে থামাল। ঠিক আছে। আপনি এখানে আরো একদিন থাকেন। কাল ভোরে আমি আপনার সাথে কথা বলব। আমি আপনাকে বলব এটা কী।
এই জায়গাটা কী জানার জন্যে জহুরকে অবশ্যি পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না—সেদিন রাতেই সে সেটা জানতে পারল।