১.২ খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে

খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে প্রথম যে কথাটি ইরনের মাথার মাঝে খেলা করে গেল সেটি হচ্ছে প্রজেক্ট আপসিলন। কাল রাতে একটি নিম্নস্তরের কম্পিউটার প্রোগ্রাম তাকে এই বিপজ্জনক প্রজেক্টে জুড়ে দেবার চেষ্টা করছিল। ইরন বিছানায় উঠে বসে এবং খানিকটা চেষ্টা করেও মাথা থেকে প্রজেক্টের নামটি সরাতে পারে না। কুৎসিত বিকৃত কিছু দেখলে মানুষ যেরকম বিতৃষ্ণা নিয়েও তার থেকে চোখ সরাতে পারে না এটাও অনেকটা সেরকম। ইরন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কমিউনিকেশান্স মডিউলটি নিজের কাছে টেনে এনে সেটি চালু করল। নীলাভ স্ক্রিনে মডিউলের পরিচিত চিহ্নটি ফুটে উঠতেই ইরন নিচু গলায় বলল, তথ্য অনুসন্ধান।

কমিউনিকেশান্স মডিউল তার যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত হয়ে নেয়। ইরন আবার নিচু গলায় বলল, প্রজেক্ট আপসিলন।

কমিউনিকেশান্স মডিউলের যত দ্রুত তথ্য নিয়ে আসার কথা তার থেকে কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় লেগে যায়। নীলাভ স্ক্রিনে প্রজেক্ট আপসিলনের সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ ত্রিমাত্রিক ভিডিও ক্লিপে ফুটে ওঠে। ইরন ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো তথ্যই নেই। ইরন নিচু গলায় বলল, পরবর্তী পর্যায়ের তথ্য।

সাথে সাথে প্রথমে স্ক্রিনটি বর্ণহীন হয়ে যায়, পর মুহূর্তে উজ্জ্বল কমলা রঙে নিষিদ্ধ তথ্য প্রতীকচিহ্নটি ফুটে ওঠে এবং সাথে সাথে যান্ত্রিক গলায় উচ্চারিত হয়, প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য সংরক্ষিত। এটি সর্বসাধারণের মাঝে প্রচারের জন্য নয়।

ইরন ভুরু কুঁচকে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখন বিজ্ঞান গবেষণাগারে বড় একটি দল নিয়ে ওয়ার্মহোলের ওপর গবেষণা করছিল তখন পৃথিবীর যে কোনো তথ্য তার জন্য উনাক্ত ছিল, এক বছরের মাঝে সে নিচুস্তরের একটি প্রজেক্ট সম্পর্কে তুচ্ছ খানিকটা তথ্যও জানতে পারবে না ইরন কমিউনিকেশান্স মডিউলে গিয়ে চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে নিয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই হঠাৎ করে প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য আসতে শুরু করে। মূল তথ্য কেন্দ্র এখন তাকে পুরোপুরি আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি।

প্রজেক্ট আপসিলন একটি মহাকাশ অভিযান। নতুন একটি জ্বালানি এবং মহাকাশযানের। একটি নতুন নকশা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে। মহাকাশযানটি সৌরজগৎ থেকে। বের হয়ে আবার ফিরে আসবে, এর গতিবেগ হবে আলোর গতিবেগের এক–দশমাংশ, ত্বরণ হবে অস্বাভাবিক। এই প্রচণ্ড তুরণে মানুষের দেহকে রক্ষা করার একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা চালানো হবে, পরীক্ষাটির বিপদসূচক সংখ্যা খুব বেশি। সে কারণে যারা জেনেশুনে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় সেরকম অভিযাত্রী খোঁজা হচ্ছে। প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ। দিতে চাইলে কোথায় এবং কবে যোগাযোগ করতে হবে সেটিও জানিয়ে দেওয়া আছে।

ইরন খানিকক্ষণ ঠিকানাটির দিকে তাকিয়ে থেকে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। আকাশের কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্টের উপর থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে একটি বিপজ্জনক মহাকাশযানে সৌরজগৎ পাড়ি দেওয়া তার কাছে মোটেও বেশি আকর্ষণীয় মনে হল না।

কাজেই সেদিন অপরাহ্নে ইরন যখন প্রজেক্ট আপসিলনের নিয়োগ কেন্দ্রে একজন সুন্দরী তরুণীর সামনে নিজেকে আবিষ্কার করল সে নিজের ওপর নিজেই একটু অবাক না হয়ে পারল না। সুন্দরী তরুণটি অত্যন্ত সপ্রতিভ, ইরনকে তার নরম চেয়ারে বসিয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ইরন, তুমি কেন এই প্রজেক্টে যোগ দিতে চাও?

ইরন দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি আসলে চাই না।

মেয়েটি হেসে ফেলল, তা হলে তুমি কেন এখানে এসেছ?

আমি এখনো জানি না। আমার ওপর দিয়ে ভাগ্য এমন সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছে যে কিছুতেই কিছু আসে–যায় না।

তুমি তো জান এই প্রজেক্টের বিপদসূচক সংখ্যাটি অনেক উপরে।

জানি।

আমাদের রেকর্ড বলছে তুমি হতাশাগ্রস্ত একজন বিজ্ঞানী–তুমি কি আত্মহত্যার বিকল্প হিসেবে এটা বেছে নিয়েছ?

যদি বলি হ্যাঁ।

তা হলে তোমাকে আমরা নেব না।

কেন নয়?

আমরা চাই প্রজেক্টটি সফল হোক। হতাশাগ্রস্ত মানুষদের দিয়ে কোনো প্রজেক্ট সফল হয় না।

তা হলে তোমরা আমাকে নেবে না? 

সুন্দরী মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, না।

ইরন সোজা হয়ে বসে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি এই প্রজেক্টে যেতে চাই।

কেন?

কারণ–কারণ– ইরন একটু ছটফট করে বলল, এই প্রজেক্টে যারা আসবে সবাই। নিশ্চয়ই আমার মতো। পৃথিবীর কোনো মানুষ আমাকে বুঝতে পারে না, কিন্তু এই প্রজেক্টের অভিযাত্রীরা আমাকে বুঝবে। আমিও তাদের বুঝব। আমরা একজন অন্যজনকে হতাশার। গহ্বর থেকে টেনে তুলব।

সুন্দরী মেয়েটি নরম চোখে খানিকক্ষণ ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ। আমি তোমাকে মনোনয়ন দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো আমি একজন সাধারণ মনোবিজ্ঞানী। আমি শুধুমাত্র প্রাথমিক মনোনয়ন দিই। তোমাকে এরপর সত্যিকারের পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাঝে দিয়ে যেতে হবে, শুধু তারপর ঠিক করা হবে তোমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া যায় কি না।

ইরন হঠাৎ হেসে ফেলল, বলল, আত্মহত্যা করার জন্য এত ঝামেলা করতে হয় কে জানত!

মেয়েটি ইরনের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। ইরন বলল, তুমি একটি জিনিস জান?

কী?

আমি আজ অনেকদিন পর হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলে গিয়েছিলাম।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ইরনের কাধ স্পর্শ করে বলল, তুমি আবার হাসবে ইরন। আমি নিশ্চিত আবার তোমার জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।

.

পরের কয়েকদিন ইরন খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটাল। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে তার শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষকে পরীক্ষা করে দেখা হল, বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেওয়া হল, মানসিক ভারসাম্যের সূচক বের করা হল, জরুরি অবস্থায় তার ধীশক্তির পরিমাপ করা হল। রক্তচাপ, মেটাবলিজম, নিউরন বিক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে রেটিনার সংবেদনশীলতা পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখা হল।

চতুর্থ দিনে গম্ভীর ধরনের মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ ইরনের হাতে ছোট এক টুকরো ক্রিস্টাল ডিস্ক তুলে দিয়ে বলল, তোমাকে প্রজেক্ট আপসিলনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

ইরন ক্রিস্টাল ডিস্কটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান আমি অনেকদিন পর একটি কাজে সফল হলাম!

গম্ভীর মানুষটি কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন চোখ মটকে বলল, তবে আত্মহত্যা করতে যাবার প্রতিযোগিতায় সফল হওয়াটাকে কি সাফল্য বলা যায়?

গম্ভীর মানুষটি এবারেও কোনো কথা বলল না, ইরন আবার বলল, তোমার কি মনে হয় না আমি মানুষটা আসলেই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবান? গত এক বছর প্রত্যেকটা কাজে ব্যর্থ হয়েছি–একমাত্র কাজে সাফল্য পেয়েছি আর সেটি হচ্ছে একটি ডাহা মারা যাবার টিকিট!

ইরন হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে, গম্ভীর ধরনের মানুষটি ইরনের কথায় কোনো কৌতুক খুঁজে পায় না, একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ করে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখ পরীক্ষা করতে শুরু করে।

ইরন হাসি থামিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

হ্যাঁ, পার। তবে আমি যেটুকু জানি তার সবই ক্রিস্টাল ডিস্কে আছে।

তবু তোমাকেই জিজ্ঞেস করি।

বেশ।

এই প্রজেক্টে কি কোনো রোবট থাকবে?

গম্ভীর ধরনের মানুষটি ভুরু কুঁচকে ইরনের দিকে তাকাল, তাতে কী আসে–যায়?

কিছু আসে–যায় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে রোবট পছন্দ করি না।

তুমি যদি এই কথাটি আগে বলতে সম্ভবত তোমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া হত না।

ইরন চোখ মটকে বলল, সেই জন্য আগে বলি নি।

তুমি কেন রোবটদের পছন্দ কর না? নবম প্রজন্মের রোবটের বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত তোমার কিংবা আমার থেকে বেশি।

সেটাও একটা কারণ।

একটা শক্তিশালী ঘোড়ার জোর তোমার থেকে অনেক বেশি। সেজন্যে তুমি কি ঘোড়াকে অপছন্দ কর?

ইরন বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তুমি খুব খারাপ একটা উদাহরণ বেছে নিয়েছ। আমার বয়স যখন এগার তখন আমি একবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আমি ঘোড়াকে দুই চোখে দেখতে পারি না।

গম্ভীর ধরনের মানুষটি এই প্রথমবার একটু হাসল। হাসলে যে কোনো মানুষকে সুন্দর দেখায় এবং ইরন প্রথমবার আবিষ্কার করল, মানুষটি সুদর্শন। সে হাসিমুখেই বলল, ঘোড়াকে অপছন্দ করার কারণ থাকতে পারে কিন্তু রোবটকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। তাদের তৈরি করা হয় মানুষকে সাহায্য করার জন্য।

ইরন মাথা নাড়ল, কিন্তু মানুষ থেকে বুদ্ধিমান একটা বস্তু মানুষের পাশে পাশে বোকার ভান করে থাকছে

রোবট কখনো বোকার ভান করে না।

করে। মানুষকে সরিয়ে নিজেরা যে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে না সেটা হচ্ছে। ভান। তারা ইচ্ছা করলেই পারে।

কিন্তু তারা তৈরি হয়ে আছে সেভাবে, তাদেরকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে তারা কখনোই মানুষের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবে না। কিন্তু মহাকাশযানে–যেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, প্রয়োজন হলেই রোবট মানুষের নেতৃত্বকে অপসারণ করে ফেলবে।

গম্ভীর ধরনের সুদর্শন মানুষটি হেসে বলল, এটি তোমার একটা অমূলক সন্দেহ। তুমি নিশ্চয়ই নবম প্রজাতির সর্বশেষ রোবটগুলো দেখ নি। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে মানুষ থেকে ভালো। বুদ্ধিমান, কৌতূহলী এবং সহানুভূতিসম্পন্ন। যে কোনো মানুষ থেকে তাদের রসবোধ অনেকে বেশি তীক্ষ্ণ।

ইরন আবার মাথা নাড়ল, বলল, তাতে কিছু আসে–যায় না। একটি রোবট সবসময়েই রোবট।

মানুষটি কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন বলল, তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। প্রজেক্ট আপসিলনে কি কোনো রোবট থাকবে?

আমার জানা নেই। তবে

তবে?

তবে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। এই প্রজেক্টে মানুষের ওপর পরীক্ষা করার কথা।

চমৎকার। আশা করছি তোমার কথা যেন সত্যি হয়। না হয়—

না হয় কী?

না, কিছু না। ইরন আপন মনে বলল, আমি রোবটকে খুব অপছন্দ করি। ব্যাপারটা প্রায় ঘৃণার কাছাকাছি।

সুদর্শন মানুষটি এবারে একটু অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল।