১.১ সমুদ্রের পানিতে সূর্যটা

উৎসর্গ

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রথমবার যখন কয়েক ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেয়া হয় তখন একজন মা তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সন্তানকে নিয়ে শহরে বের হলেন। যেদিকেই তাকান সেদিকেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষর।

মা তার সন্তানকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এখন কী করতে হবে?

সন্তান বলল, মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে।

মা বললেন, আমার দুই পুত্রের মাঝে তুমিই এখন উপযুক্ত। আমি তোমাকেই আমাদের দেশের জন্যে দিতে চাই। তুমি যুদ্ধে যাও। এই দেশকে স্বাধীন করে ফিরে এসো। মনে রেখো তোমাকে কিন্তু বীরের মতো ফিরে আসতে হবে।

যুদ্ধে পাঠানোর জন্যে মা সন্তানের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। যখন সে বিদায় নিচ্ছিল মা তখন হাসিমুখে তাকে বিদায় দিলেন। ছেলে চোখের আড়াল হবার পর মা প্রথমবার আকুল হয়ে কাঁদলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পর সেই তরুণ বীর-যাদ্ধা হয়ে তার দেশ এবং তার গর্ভধারিণী মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল।

সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ওয়াকার হাসান এবং তার বীর প্রসবিনী মাতা শামসুন নাহার ইসলামের জন্যে আমার ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৪ জানুয়ারি, ২০০৮

———-

ডেডালস ও তাহার পুত্র ইকারাস সমুদ্রবেষ্টিত ক্রীট দ্বীপ হইতে পলায়ন করিরার জন্যে তাহাদের শরীরে পাখির পালকে তৈরি ডানা সন্নিবিষ্ট করিল। উড্ডয়নের পূর্বে ডেড়ালাস তাহার পুত্র ইকারাসকে বলিল, বৎস, আকাশে উড়িবার সময় সূর্যের নিকটবর্তী হইও না। আমাদের শরীরে এই পালকগুলি মোম দ্বারা সংযুক্ত হইয়াছে। সূর্যের উত্তাপে মোম গলিয়া পালকগুলি দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে তুমি সমুদ্রে পতিত হইবে।

উড্ডয়নকালে চপলমতি ইকারাস তাহার সাবধানবাণী বিস্মৃত হইয়া সূর্যের নিকটবর্তী হইল। সূর্যের উত্তাপে তাহার শরীরে সন্নিবিষ্ট মোম গলিয়া পালকগুলি খুলিয়া গেল।

হতভাগ্য ইকারাস তখন অনেক উচ্চ হইতে সমুদ্রে পতিত হইল।

একটি গ্রিক উপাখ্যান

———–

১.১

প্রথম পর্ব

সমুদ্রের পানিতে সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত জহুর বালুবেলায় চুপচাপ বসে রইল। সে প্রতিদিন এই সময়টায় সমুদ্রের তীরে আসে এবং চুপচাপ বসে সূর্যটাকে ড়ুবে যেতে দেখে। ঠিক কী কারণে দেখে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই। সে খুবই সাধারণ মানুষ। প্রকৃতি বা প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এসব ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। যারা তাকে চেনে তাদের ধারণা সে বাউণ্ডুলে এবং ভবঘুরে ধরনের মানুষ। সেটি পুরোপুরি সত নয়—অল্প সময়ের ব্যবধানে তার একমাত্র মেয়ে এবং স্ত্রী মারা যাবার পর। হঠাৎ করে সে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর জন্যেই আকর্ষণ অনুভব করে না।

সূর্যটা পুরোপুরি ড়ুবে যাবার পর জহুর উঠে দাঁড়াল এবং নরম বালুতে পা ফেলে হেঁটে হেঁটে ঝাউগাছের নিচে ছোট টংঘরটাতে হাজির হলো। সেখানে কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চটাতে বসে জহুর এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। তার যে চা খেতে খুব ইচ্ছে করে তা নয়, তারপরেও সে রুটিনমাফিক এখানে বসে এক কাপ চা খায়। যে ছেলেটা দুমড়ানো কেতলি থেকে কাপে গরম পানি ঢালে, দুধ চিনি দিয়ে প্রচণ্ড বেগে একটা চামচ দিয়ে সেটাকে ঘুটে তার সামনে নিয়ে আসে জহুর বসে বসে তার কাজকর্ম লক্ষ করে। কেন লক্ষ করে জহুর নিজেও সেটা জানে না। এখন তার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, একদিন থেকে পরের দিনের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।

জহুর অন্যমনস্কভাবে চায়ের কাপে চুমুক দেয়, চা-টা ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে জহুর সেটাও বুঝতে পারল না। অনেকটা যন্ত্রের মতো কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সে সামনের দিকে তাকালো এবং দেখল মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। জহুরের ভাসা ভাসাভাবে মনে হলো এই মানুষটা সে আগে কখনো দেখেছে কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না। মানুষটার সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং গায়ে একটা ভুসভুসে নীল রঙের শার্ট।

জহুর মানুষটাকে এক নজর দেখে আবার তার চায়ের কাপে চুমুক দেয়, এবারে তার মনে হলো চায়ে চিনি একটু বেশি দেয়া হয়েছে—তকে তাতে তার কিছু আসে-যায় না। কোনো কিছুতেই তার কখনো কিছু আসেযায় না। জহুর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে আবার সামনের দিকে তাকালো, দেখাল মাথার সামনে চুল পাতলা হয়ে যাওয়া মধ্যবয়স্ক মানুষটা এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।

জহুর একটু অস্বস্তি অনুভব করে, সে নিজে সুযোগ পেলেই তার চারপাশের মানুষকে লক্ষ করে, কিন্তু সেটা সে করে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। এই মানুষটি তাকে লক্ষ করছে সরাসরি, এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। জহুর একটু ঘুরে বসবে কি না চিন্তা করছিল তখন মধ্যবয়স্ক মানুষটা সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে তার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করল, ভাই। আপনি কী করেন?।

জহুর কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, একজন মানুষ—যার সাথে চেনা পরিচয় নেই তাকে সরাসরি এভাবে এ রকম একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারে কি না সেটা সে একটু চিন্তা করল। যে আসলে কিছুই করে না, সে কী বলে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে? জহুর অবশ্য বেশ সহজভাবেই উত্তর দিল, বলল, কিছু করি না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, কিছু করতে চান?

জহুর এবারে একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, আমি?

জি। আপনি কি কোনো কাজ করতে চান?

কাজ? আমি?

হ্যাঁ। মানুষটা মাথা নেড়ে মুখের মাঝে হাসি হাসি একটা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।

জহুর কয়েক সেকেন্ড মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কী কাজ?

মানুষটা একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি যদি কাজ করতে চান তাহলে বলি কী কাজ। যদি না করতে চান তাহলে—

জহুর খুব বেশি হাসে না, কিন্তু এবারে সে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, কাজটা কী সেটা যদি না জানি তাহলে করতে চাইব কি না কেমন করে বলি? যদি বলেন অস্ত্র চোরাচালানের কাজ।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা সবেগে মাথা নাড়ল, বলল, না না না। কোনো বেআইনি কাজ না। খাঁটি কাজ। তবে–

তবে কী?

নয়টা পাঁচটা কাজ না। চব্বিশ ঘণ্টার কাজ।

চব্বিশ ঘণ্টার?

জি।

কোথায়?

মধ্যবয়স্ক মানুষটা আবার তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, এটাই হচ্ছে সমস্যা।

জহুর ভুরু কুঁচকে বলল, সমস্যা?

জি। মানুষটা মাথা নাড়ে। এইটাই একটু সমস্যা।

কেন? সমস্যা কেন?

কাজটা অনেক দূরে। সমুদ্রের মাঝখানে।

সমুদ্রের মাঝখানে?

মানুষটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল, সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপের উপরে একটা হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। খুব হাইফাই হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের কাজ।

সমুদ্রের মাঝখানে হাইফাই হাসপাতাল?

মানুষটি মাথা নাড়ল। জহুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, সমুদ্রের মাঝখানে হাসপাতালের দরকার কী? সমুদ্রে কে থাকে?

সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস।

মানুষটি চুপ করে গেল, জহুর একটু অপেক্ষা করে কিন্তু মানুষটার মাঝে সেই লম্বা ইতিহাস বলার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। জহুর জিজ্ঞেস করল, শুনি সেই লম্বা ইতিহাস।

মানুষটি একটু ইতস্তত করে বলল, আসলে সেটা নিয়ে আমরা বেশি কথা বলাবলি করি না। আমাদের কাদের স্যার হাসপাতালটা নিয়ে বেশি হইচই করতে না করেছেন।

কাদের স্যারটা কে?

কাদের স্যার এই হাসপাতাল তৈরি করেছেন। অনেক বড় ডাক্তার!

জহুর মাথা নেড়ে বলল, আমি পুরো ব্যাপারটা এখনো ভালো করে বুঝতে পারি নাই। কিন্তু আপনার যদি বলা নিষেধ থাকে, ব্যাপারটা গোপন হয় তাহলে থাক—।

মানুষটা ব্যস্ত হয়ে বলল, না-না-না। এটা গোপন না, গোপন কেন হবে? কিন্তু আমাদের কাদের স্যার নিজের প্রচার চান না। সেই জন্যে এটা নিয়ে আমাদের বেশি কথাবার্তা বলতে না করেছেন। কিন্তু আপনাকে বলতে সমস্যা নাই—আপনি তো আর পত্রিকার লোক না। কথা শেষ করে মানুষটা একটু হাসার চেষ্টা করল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো পত্রিকার লোকেরা খুব বিপজ্জনক মানুষ।

জহুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি আসলে এখনো ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝতে পারি নাই। একটা হাসপাতাল যদি সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপের মাঝে হয় তাহলে রোগীরা সেখানে যাবে কেমন করে? সাঁতার দিয়ে?

জহুরের কথা শুনে মানুষটা হা হা করে হেসে উঠল, যেন এটা খুব মজার একটা কথা, হাসতে হাসতে বলল, না না রোগীরা সাঁতরে সঁতরে হাসপাতালে যায় না। রোগী আনার জন্যে হেলিকপ্টার আছে।

হেলিকপ্টার? জহুর চোখ কপালে তুলে বলল, হেলিকপ্টার?

জি। মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে বলেছি এটা অনেক হাইফাই হাসপাতাল। এখানে হেলিকপ্টার আছে, স্পিডবোট আছে, বড় জাহাজ আছে, আলাদা পাওয়ার স্টেশন আছে আর হাসপাতাল তো আছেই।

জহুর এবারে পুরো ব্যাপারটা খানিকটা অনুমান করতে পারে। হাসপাতাল বললেই চোখের সামনে যে রকম একটা বিবর্ণ দালানের ছবি ভেসে ওঠে, যার কোনায় কোনায় পানের পিকের দাগ থাকে, যার বারান্দায় রোগীরা শুয়ে থাকে এবং মাথার কাছে আত্মীয়স্বজন উদ্বিগ্ন মুখে পাখা দিয়ে বাতাস করে—এটা সে রকম হাসপাতাল না। এটা বড়লোকদের হাসপাতাল, তারা হেলিকপ্টারে করে এখানে আসে। এটা আসলে নিশ্চয়ই হাসপাতালের মতো না, এটা ফাইভস্টার হোটেলের মতো। এখানে যেটুকু না চিকিৎসা হয় তার থেকে অনেক বেশি আরাম আয়েস করা হয়। সমুদ্রের মাঝে ছোট একটা দ্বীপে বড়লোকেরা বিশ্রাম নিতে আসে, সময় কাটাতে আসে। সে জন্যে এই হাসপাতালের কথা পত্রপত্রিকায় আসে না, সাধারণ মানুষ এর কথা জানে না। যাদের জানার কথা তারা ঠিকই জানে। পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে কেন জানি জহুরের একটু মন খারাপ হলো, সে ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা জহুরের মন খারাপের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না, সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকল, বুঝলেন ভাই, নিজের চোখে না দেখলে আপনি বিশ্বাস করবেন না। হাসপাতালের মেঝে তৈরি হয়েছে ইতালির মার্বেল দিয়ে দেখলে চোখ উল্টে যাবে।

জহুর বলল, অ।

থাকার জন্যে আলাদা কোয়ার্টার। ইলেকট্রিসিটি, গ্যাস। ট্যাপ খুললেই গরম পানি। নিজেদের ডিশ। ইন্টারনেট, কম্পিউটার সব মিলিয়ে একেবারে যাকে বলে ফাটাফাটি অবস্থা।।

জহুর এবারে একটু ক্লান্তি অনুভব করে, ছোট একটা হাই তুলে বলল, আমার চাকরিটা কী রকম হবে?

অনেক রকম চাকরি আছে। আপনার কীরকম লেখাপড়া, কীরকম অভিজ্ঞতা তার ওপর চাকরি। তার ওপর বেতন।

আমার লেখাপড়া নাই। জহুর দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই।

মাঝবয়সী মানুষটার এবার খানিকটা আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। সরু চোখে জিজ্ঞেস করল, লেখাপড়া নাই?

নাহ্। গ্রামে মানুষ হয়েছি, চাষ বাস করেছি। লেখাপড়ার দরকার হয় নাই, করিও নাই। পত্রিকাটা কোনোমতে পড়তে পারি। পত্রিকায় যে সব খবর থাকে এখন মনে হয় ওইটা না পড়তে পারলেই ভালো ছিল।

অ। মানুষটা এবারে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেশি লেখাপড়া জানা মানুষেরও চাকরি আছে।

জহুর একটু উৎসাহ দেখানোর ভান করে বলল, আছে নাকি?

জি। আছে।

সেটা কী চাকরি?

এই মনে করেন কেয়ারটেকারের চাকরি।

জহুর একটু হাসার ভঙ্গি করল, বলল, তার মানে দারোয়ানের চাকরি?

মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা আপনার ইচ্ছে হলে বলতে পারেন। চাকরি হচ্ছে চাকরি। দারোয়ানের চাকরিও চাকরি কেয়ারটেকারের চাকরিও চাকরি।

জহুর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নাহ্ ভাই। এই বয়সে আর দারোয়ানের চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নাই।

তাহলে অন্য চাকরিও আছে—

জহুর এবারে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, নাহ্।

কেন না?

জহুর মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে ভাই আপনি যে রকম হাইফাই হাসপাতালের বর্ণনা দিলেন, আমার সেই রকম হাসপাতালে চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নাই। আমি মনে করেন চাষা মানুষ, বড়লোক সে রকম দেখি নাই। দেখার ইচ্ছাও নাই। এই রকম বড়লোকদের চাকর-বাকরের কাজ করার ইচ্ছা করে না।

মাঝবয়সী মানুষটা কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুঝেছি। আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বুঝেছি। আপনি যে রকম করে ভাবেন আমিও সেই রকম করে ভাবি। তবে–

তবে কী?

আপনি চাকরি করতে না চাইলে নাই। তবে আমি বলি কী—আপনি হাসপাতালটা একটু দেখে আসেন।

জহুর একটু অবাক হয়ে বলল, দেখে আসব?

জি। এটা একটা দেখার মতো জায়গা। কাদের স্যার যদি পাবলিকদের এটা দেখার জন্যে টিকেট সিস্টেম করতেন তাহলে মানুষ টিকেট কিনে দেখে আসত।

আচ্ছা!

জি। মানুষটা মাথা নাড়ে, বলে, আপনার চাকরি করার কোনো দরকার নাই। শুধু একটা ইন্টারভিউ দিয়ে আসেন। এই হাসপাতালটা দেখার মাত্র দুইটা উপায়। এক হচ্ছে রোগী হয়ে যাওয়া। আর দুই হচ্ছে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া।

জহুর কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চাকরি না চাইলেও ইন্টারভিউ দিব?

কেন দিবেন না?

কীরকম করে দিব? কেমন করে যাব?

আমি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। জেটি থেকে সপ্তাহে দুই দিন একটা ট্রলার হাসপাতালে যায়।

জহুর মাথা নেড়ে বলল, না ভাই! আমার ইচ্ছা নাই।

কেন ইচ্ছা নাই? যে জায়গাটা মানুষ পয়সা দিয়েও দেখতে পারে না, আপনি সেটা ফ্রি দেখে আসবেন। যাতায়াত থাকা খাওয়া ফ্রি—

জহুর একটু হেসে ফেলল, বলল, ভাই আমি গরিব মানুষ কথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে একটা কিছু ফ্রি হলেই আমি হামলে পড়ি না!

মানুষটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি সেটা বলি নাই! আমি বলেছি জায়গাটা দেখে আসার জন্যে। এটা একটা দেখার মতো জায়গা।

জহুর কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি সত্যি কথাটা বলেন দেখি। কেন আপনি আমাকে এত পাঠাতে চাইছেন। এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে।

মানুষটা প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গিয়ে অপ্রস্তুতের মতো একটু হেসে ফেলল, হাসি থামিয়ে বলল, আমি আসলে এই হাসপাতালের একজন রিক্রুটিং এজেন্ট। যদি হাসপাতাল আমার সাপ্লাই দেয়া কোনো মানুষকে চাকরি দেয় তাহলে আমি একটা কমিশন পাই।

জহুর এবার বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, এইবার বুঝতে পারলাম।

মানুষটা বলল, আপনাকে আমি কয়েকদিন থেকে লক্ষ করছি। চুপচাপ মানুষ, কোনোরকম হাঙ্গামা হুঁজ্জোতের মাঝে নাই। সেইদিন দেখলাম ওই পকেটমারকে পাবলিকের হাত থেকে বাঁচালেন। আপনি না থাকলে বেকুবটাকে পাবলিক পিটিয়ে মেরে ফেলত। কী ঠান্ডা মাথায় কাজটা করলেন, অসাধারণ! যখন পুলিশের সাথে কথা বললেন আপনার কোনো তাপ উত্তাপ নাই। আপনি রাগেন না—আপনি ভয়ও পান না। ঠান্ডা মানুষ।

জহুরের সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ল, সমুদ্রের তীরে পকেট মারতে গিয়ে কমবয়সী একটা ছেলে ধরা পড়ল। ভদ্রঘরের মানুষজন তখন তাকে কী মারটাই না মারল, সে গিয়ে না থামালে মেরেই ফেলত। লাশটা ফেলে রেখে সবাই সরে পড়ত। যেন মানুষের লাশ না, কুকুর বেড়ালের লাশ।

মানুষটা বলল, হাসপাতালটা আসলে আপনাদের মতো ঠান্ডা মানুষ। খোঁজে। আমার মনে হচ্ছিল আপনি ইন্টারভিউ দিলেই চাকরি পেয়ে যাবেন।

আর আমি চাকরি পেলেই আপনি কমিশন পাবেন?

অনেকটা সেই রকম।

জহুর এবার উঠে দাঁড়াল, বলল, ভাই আপনার এইবারের কমিশনটা গেল। চোখ কান খোলা রাখেন আর কাউকে পেয়ে যাবেন। দেশে আজকাল চাকরির খুব অভাব—

জহুরের সাথে সাথে মাঝবয়সী মানুষটাও উঠে দাঁড়াল, পকেট থেকে নীল রঙের একটা কার্ড বের করে জহুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন ভাই। এইটা রাখেন।।

এইটা কী?

ইন্টারভিউ কার্ড। আপনি যদি মত পাল্টান তাহলে পরশু দিন জেটিতে আসেন। বড় ট্রলার, নাম হচ্ছে এম.ভি, শামস। কার্ড দেখালেই আপনাকে তুলে নেবে।

জহুর কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল, আর যদি না আসি?

তাহলে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দিবেন—অন্য কাউকে দিবেন না।

ঠিক আছে। জহুর লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে, তখন পেছন থেকে মাঝবয়সী মানুষটা বলল, আরেকটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।

কী জিনিস?

আপনি যদি ইন্টারভিউ দিতে আসেন তাহলে কাদের স্যারের সাথে দেখা হবে। পৃথিবীতে এই রকম দুইটা মানুষ নাই।

কেন?

সেইটা বলে বোঝানো যাবে না—আপনার নিজের চোখে দেখতে হবে। স্যার নিজে সবার ইন্টারভিউ নেন। মালী থেকে শুরু করে সার্জন—সবার।

অ।

কাদের স্যার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরের সবকিছু বুঝে ফেলেন।

তাই নাকি?

জি। মানুষটা মাথা নাড়ল, চোখ দুইটা ধারালো ছোরার মতে। কেটে ভেতরে ঢুকে যায়।

জহুর কোনো কথা না বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যের বাতাসে সমুদ্রের তীরের ঝাউগাছগুলো হাহাকারের মতো এক ধরনের শব্দ করছে, সেই শব্দ শুনলেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।

 

দুই দিন পর জহুর আবিষ্কার করল সে জেটিতে এসে এম.ভি, শামস খুঁজে বের করে তার নীল রঙের ইন্টারভিউ কার্ড দেখিয়ে সেখানে চেপে বসেছে। কেন বসেছে নিজেও জানে না।