প্ৰথম খণ্ড/ প্রথম পরিচ্ছেদ – বিষম বিপদ
বোম্বে শহরে পথের উপরে একটা ছোট বাড়ীর সম্মুখে একখানা ভাঙা চেয়ারে বসিয়া যুবক পাণ্ডুরাং অতি নিবিষ্টমনে “মুম্বই সমাচার” পাঠ করিতেছিল।
দ্বারের পার্শ্বেই একটি ছোট ঘর ঘরের মধ্যে একপার্শ্বে একটা আলমারী, মধ্যস্থলে একখানি টেবিল ও টেবিলের চতুষ্পার্শ্বে তিন-চারিখানি বেন্টউড্ চেয়ার, আর একখানা অপেক্ষাকৃত কিছু দামী চেয়ারের উপরে একটি লোক রহিয়াছে। এই ক্ষুদ্র আফিসের একমাত্র কেরাণী-পুঙ্গব হইতেছেন—সংবাদপত্রপাঠরত পাণ্ডুরাং।
সহসা সম্মুখে একজন গুজরাটী ভদ্রলোককে দেখিয়া পাণ্ডুরাং ক্ষিপ্রহস্তে কাগজখানি সরাইয়া রাখিল। গুজরাটী ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তার আছেন?”
“আছেন — আসুন।”
“আমার একটা দাঁত তুলিবার প্রয়োজন।”
.
“আসুন-বসুন, আমি তাঁহাকে সংবাদ দিতেছি, বলিয়া পাণ্ডুরাং নিজের চেয়ারখানি ছাড়িয়া, সেই ভদ্রলোকটিকে বসিতে দিল। তৎপরে সত্বরপদে কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, তথায় যিনি বসিয়াছিলেন, তিনিই হইতেছেন এই পাণ্ডুরাং এর মনিব। পাণ্ডুরাং তাঁহাকে বলিল, “একজন ভদ্রলোক দাঁত তুলিতে চায়।”
দন্ত-চিকিৎসক পার্শী জামসেদজী সৈয়দজী পাটেল আফিসে আসিয়া জানালার দিকে মুখ করিয়া প্রত্যহ জনবহুল পথের দিকে চাহিয়া থাকেন। তাঁহার খরিদ্দারের বড়ই অভাব, সুতরাং পয়সারও সেইরূপ অপ্রতুল। মাসের মধ্যে বড় জোর দুই-একজন তাঁহার নিকটে দাঁত তুলিতে আসে।
তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দোরাবজী সৈয়দজী পাটেল ডাক্তারী পাশ করিয়াছেন। ‘এল এম এস’ লাভ করা সত্ত্বেও, দুঃখের বিষয় তাঁহার নিকটেও রোগীর বড়ই অপ্রতুল, দুই ভ্রাতারই অবস্থা শোচনীয়। পয়সার অভাবে এ পর্য্যন্ত উভয়েই বিবাহ করিয়া সংসারী হইতে পারেন নাই।
একজন খরিদ্দার মিলিয়াছে শুনিয়া জামসেদজী সোৎসাহে বলিলেন, “শীঘ্র এইখানে তাঁহাকে ডাকিয়া আন।”
পাণ্ডুরাং বাহিরের ঘর হইতে সেই গুজরাটী ভদ্রলোকটিকে ডাকিয়া আনিল। জামসেদজী উঠিয়া সসম্ভ্রমে তাঁহাকে বসিতে বলিলেন।
না বসিয়া সেই গুজরাটী ভদ্রলোকটি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনিই কি সৈয়দজী পাটেল—আপনিই দন্ত-চিকিৎসক?”
“হাঁ, আমার ঐ নামই বটে।”
“সাইনবোর্ডে আপনার নাম দেখিলাম।”
“আপনি দাঁত তুলিতে ইচ্ছা করেন?”
“হাঁ, একটা দাঁত তুলিতে ইচ্ছা করি।”
“তবে এই চেয়ারখানায় বসুন।”
“দাঁড়ান, একটা কথা আগে জিজ্ঞাসা করি, আপনার সাইনবোর্ডে লেখা রহিয়াছে—যন্ত্রণাহীন দাঁত তোলা।”
“হাঁ।”
পাঁচকড়ি রচনাবলী (৬ষ্ঠ)
“আমি সেই রকমই চাই।”
“আপনি তাহা হইলে গ্যাস ব্যবহার করিতে ইচ্ছা করেন?”
“আমি গ্যাস-ট্যাস জানি না, মহাশয়। যাহাতে দাঁত তুলিবার সময়ে কোন কষ্ট না হয়, তাহাই আমি চাই। তাহা যদি হয়, তবে আপনাদের এ একটা অদ্ভুত আবিষ্কার বটে।”
“হাঁ, অনেকেই তাহা বলেন।”
“তাহা হইলে লেগে যাও, ডাক্তার।”
“দু-চার মিনিট বিলম্ব করিতে হইবে।”
“আবার বিলম্ব কিসের জন্য ― কি মুস্কিল!”
“আপনাকে গ্যাস লাগাইবার জন্য আর একজন ডাক্তার ডাকিতে হইবে।”
“নিজে তুমি পার না, ডাক্তার?”
“না, তাহা নিয়ম নয়।”
“কতক্ষণ লাগিবে?”
“এই এখনই তিনি আসিবেন, ডাক্তার নিকটেই থাকেন।”
“ভাল, তাহাই হউক।”
“তবে আপনাকে আমার আগে বলা উচিত যে, ইহার জন্য আপনাকে কিছু বেশি দিতে হইবে।”
“কত বেশি দিতে হইবে?”
“দাঁত তোলার খরচার উপরে চারি টাকা বেশী দিতে হইবে।”
“তাহা হইলে মোট?”
“আট টাকা মাত্র।”
“ভাল — তাহাই। যদি আমার কোন কষ্ট না হয়, তাহা হইলে টাকা দিতে আমি নারাজ নই। টাকা আমার এখন পকেট পোরা।”
দত্ত-চিকিৎসক বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। তৎপরে পাণ্ডুরাংকে ডাকিয়া বলিলেন, “যাও, এখনই ডাক্তার সাহবেকে ডাকিয়া আন, বলিও একজন ভদ্রলোক গ্যাসের সাহায্যে দাঁত তুলাইবেন, রোগী এখানে অপেক্ষা করিতেছেন। শীঘ্র আসা চাই।”
পাণ্ডুরাং চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরেই ডাক্তার দোরাবজী পাটেল শশব্যস্তে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আগন্তুক গুজরাটী ভদ্রলোক বলিলেন, “ডাক্তার সাহেব, আপনিই কি কষ্টনিবারক?”
দোরাবজী হাসিয়া বলিলেন, “উপস্থিত তাহাই।”
এই বলিয়া তিনি যন্ত্রাদি বাহির করিয়া ঠিকঠাক সাজাইয়া লইলেন।
আগন্তুক বলিলেন, “আমার ভিতরে এ গ্যাস প্রবেশ করাইয়া দিলে পরে কি হইবে? এ যে দেখিতেছি বেলুনের ব্যাপার! কতক্ষণ গ্যাসপোরা থাকিব?”
ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “এক মিনিট মাত্র, সেই সময়ের মধ্যে আপনার দাঁত তোলা হইয়া যাইবে।”
“কষ্ট হবে না?”
“কিছুমাত্র নয়। সম্ভবতঃ কি হইতেছে, তাহা আপনি জানিতেও পারিবেন না।”
“বেশ ভাল, আজ বড় গরম বোধ হইতেছে — জামাটা খুলিয়া ফেলিলে আপনার আপত্তি নাই – কিছু অসুবিধা হইবে না ত?”
“কিছুমাত্র নয়।”
“আমি সমস্ত দিনই ঘুরিয়া বেড়াইতেছি অনেক কাজ ছিল, এখন বড় ক্লান্ত হইয়াছি—আচ্ছা, জামা খোলা থাক।”
“আপনার যেরূপ ইচ্ছা।”
“হাঁ, কাল আমি জাহাজে পোর-বন্দরে যাইব, সেইখানেই আমার বাড়ী; আমার দাঁতে বড় বেদনা বোধ হইতেছিল, জাহাজের টিকিট পর্যন্ত কেনা হইয়া গিয়াছে। এই পথে যাইতে যাইতে আপনার সাইনবোর্ড দেখিলাম।”
“এইখানে বসুন– এইখানে — হাঁ — এইরকম — এইবার ঠিক হইয়াছে—”
“আঃ ও কি—কি আপদ!”
“ভয় পাইবেন না — কেবল এ গ্যাস — কোন ভয় নাই — মনে করুন, যেন আপনি ঘুমাইয়া পড়িতেছেন। হাঁ, বেশ হইয়াছে। ভায়াজি, ঠিক হইয়াছে, এইবার, বলিয়া ডাক্তার সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সত্বর সাঁড়াসী দিয়া দাঁতটা তুলিয়া লইয়া এক গেলাস জল হাতে তুলিয়া লইলেন, তৎপরে সহসা বলিয়া উঠিলেন, “ভায়াজি, ভায়াজি—দেখ, দেখ—একি—শীঘ্র —”
ডাক্তার জানালার নিকটে বক্ষে বাহুবিন্যাস করিয়া পথের দিকে চাহিয়া দণ্ডায়মান ছিলেন; ভ্রাতার কথা শুনিয়া চকিত হইয়া সত্বর ফিরিলেন; তৎপরে বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
কিন্তু তাঁহাকে উত্তরের প্রতীক্ষা করিতে হইল না, তিনি আগন্তুকের মুখের দিকে চাহিয়া সত্বর ভ্রাতার হাত হইতে জলের গেলাস লইয়া তাঁহার মুখে জলের ঝাপটা দিলেন, তৎপরে বলিলেন, “ব্রাণ্ডি?”
তিনি মুখের ভিতরে গেলাস দিয়া খানিকটা ব্রাণ্ডি রোগীর মুখে ঢালিয়া দিলেন। তৎপরে বলিলেন, “ভায়াজি, আমার অস্ত্রের ব্যাগ?”
ব্যাগ হইতে অস্ত্র বাহির করিয়া দোরাবজী তদ্বারা একটা কি ঔষধ তৎক্ষণাৎ সেই গুজরাটী ভদ্রলোকের দেহে বিদ্ধ করিয়া শিরার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। তখন তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “ভায়াজি, শীঘ্র দরজা বন্ধ করিয়া দাও।”
জামসেদজী তখন ভীতিবিস্ফারিতনেত্রে ভ্রাতার মুখের দিকে চাহিলেন। দোরাবজী রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “হাঁ, মৃত্যুই হইয়াছে। বোধহয়, হাজারের মধ্যে একজনেরও এরূপ হয় না। অদৃষ্ট—অদৃষ্ট—আমাদের অদৃষ্ট—”
দন্ত চিকিৎসক ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “এখন উপায়?”
“অপরে নীরব। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “পুলিসকে সংবাদ দেওয়া যায়?”
“তাহাতে কি ফল হইবে?”
“এরূপ হইলে পুলিসে সংবাদ দেওয়া নিয়ম।”
“নিয়ম! কোন্টা নিয়মমত এখানে হইতেছে? এখন পুলিস মানে আমাদের সর্ব্বনাশ।”
“আমরা কিরূপে এ বিপদ কাটাইব?”
“কাটাইতেই হইবে—ভাবিতে দাও –”
(ক্ষণপরে) “কিছু ভাবিয়াছ?”
“হাঁ, কিছু।”
“কি স্থির করিলে?”
“এসপ্ল্যানেডের বাগানে রাত্রে কেহ থাকে না?”
“না।”
“সেই পর্য্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করিতে হইবে। তাহার পর সেইখানে এই মৃতদেহটা রাখিয়া আসা।”
“ভয়ানক!”
“কেন? এ মরিয়া গিয়াছে! ইহার দেহ পুলিসকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে; সুতরাং এইঘরে ইহার দেহ না পাইয়া না হয় এসপ্ল্যানেডের বাগানেই পাইল। ইহাতে ইহার কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না; অথচ এখানে ইহাকে পাইলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হইবে।”
“নিশ্চয়ই—একেবারে সর্ব্বনাশ।”
তাঁহাদের অবস্থা একেই ভাল নহে, ইহার উপরে পুলিস-হাঙ্গামা হইলেই হইয়াছে আর কি! উভয়ে বহুক্ষণ নীরবে রহিলেন। উপায় কি?
কিয়ৎক্ষণ পরে দন্ত-চিকিৎসক বলিলেন, “ইহাকে গাড়ী করিয়া ইহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া যায় না কি?”
“হাঁ, তাহা যাইতে পারে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও কি সৰ্ব্বনাশ হইবে না?”
“তাহা হইলে ইহাকে –”
“এখন এই আলমারীর মধ্যে ইহাকে পুরিয়া রাখিয়া দেওয়া যাক; ধর — হাঁ, এইরকম হইলেই চলিবে।”
তখনই তাঁহারা উভয়ে মিলিয়া আগন্তুকের দেহ একটা আলমারীর মধ্যে বন্ধ করিয়া রাখিলেন। ডাক্তার বলিলেন, “এখন এই পর্য্যন্ত, পাণ্ডুরাং যেন কিছু না জানিতে পারে। সে কখন বাড়ী যায়?”
“পাঁচটার সময়ে।”
“পাঁচটা ত প্ৰায় বাজে। সে আমার ওখানে আছে, এখনই এখানে আসিবে; সে যেন মনে করে যে, গুজরাটী ভদ্রলোকটা চলিয়া গিয়াছে। সে পাঁচটার সময়ে চলিয়া যাক, তাহার পর আমি আসিব।”
তাহাই হইল। পাণ্ডুরাং আসিয়াই ছুটি পাইয়া চলিয়া গেল। তখন তাহার নিজের আফিস বন্ধ করিয়া ভ্রাতার আফিসে আসিলেন। তিনি বাহিরের দরজা বন্ধ করিয়া ভিতরের ঘরে আসিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বিপদে সম্পদ
ডাক্তার বলিলেন, “ভায়াজি, আমি এ বিষয়ে অনেক ভাবিয়াছি। এখন মনে হইতেছে, ইহাকে এসপ্ল্যানেডের বাগানে ফেলিয়া দেওয়া ভয়ানক কাজই হইবে বটে; যাহা হউক, প্রথমে দেখা যাক, এই লোকটা কোথায় থাকিত, তাহা হইলে ইহাকে ইহার বাড়ীতেই রাখিয়া আসা যাইবে।”
“ইহা বিপজ্জনক হইবে না?”
“হাঁ, তবুও ইহাই আমাদের করিতে হইবে। অনেক রাত্রে ইহাকে ইহার বাড়ীর দরজায় বসাইয়া রাখিয়া আসিব।”
“ইহা কি সম্ভব?”
“প্রথম কথা — এই লোকটা কোথায় থাকিত? যদি সহরের বাহির হয় তাহা হইলে অতি সহজেই এ কাজ করা যাইবে, কেহ দেখিতে যাইবে না। একখানা গাড়ী ডাকিয়া আনিয়া দরজায় দাঁড় করাইয়া কোচম্যানকে কিছু আনিতে পাঠাইয়া দিলেই হইবে। তুমি ঘোড়াটা ধরিবে, আমি মৃতদেহটা অন্ধকারে গাড়ীতে তুলিয়া দিব।”
“লোকটার মুখে শুনিয়াছি, পোর বন্দেরে যাইতেছিল।”
“তাই ত — ঠিক কথাই ত মনে পড়িয়াছে। আমার এতক্ষণ মনেই ছিল না — দেখা যাক, ইহার পকেটে কোন কাগজ-পত্র আছে কি না। তাহা হইলে হয় ত ইহার ঠিকানাটা জানা যাইতে পারে।”
তখন তাঁহারা আলমারী খুলিয়া সেই মৃতদেহের জামার পকেট হইতে কতকগুলি কাগজ টানিয়া বাহির করিলেন। তন্মধ্যে অনেকগুলির শিরোনামায় লিখিত আছে, “হরকিষণ দাস-গিরগাম—বম্বে।”
তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন, এই লোকটা গিরগামে বাস করিত। পত্রগুলি কলবাদেবী রোডের পার্শী উকিল মেটার নিকট হইতে আসিয়াছে। এই পত্রগুলি পাঠ করিলেই জানা যাইতে পারা যায়, কেন হরকিষণ দাস পোর-বন্দর হইতে বোম্বাই আসিয়াছিল, সুতরাং দুই ভাবে মিলিয়া পত্রগুলি পাঠ করিতে লাগিলেন। পত্র পড়িয়া এইরূপ বুঝিলেন যে, বোম্বাইয়ে হরকিষণ দাসের এক মাতুলানী ছিলেন, সম্পতি তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে—তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী, হরকিষণ দাস। মাতুলানীর মৃত্যু-সংবাদ মেটার নিকট হইতে পাইলে হরকিষণ দাস পত্রোত্তরে তাঁহাকে সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করিতে বলে। পরে সমস্ত বিক্রয়ের সংবাদ পাইলে হরকিক্ষণ দাস লিখিয়াছিল, “আমি স্বয়ং যাইতেছি, গিয়া টাকা লইব।”
শেষ তারিখের একখানি পত্রে মেটা লিখিয়াছেন, “সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া এক লক্ষ টাকা আদায় হইয়াছে। সত্বর আসিয়া টাকা লইয়া যাইবেন।” এই পত্র পাঠ করিয়া উভয়ে উভয়ের দিকে চাহিলেন। এক লক্ষ টাকা! তাঁহারা মৃতদেহের পকেটে আর কিছু দেখিতে পাইলেন না। উভয়ে বহুক্ষণ ধীরে ধীরে বলিলেন, এক-লাখ টাকা! তাঁহারা মৃতদেহের পকেটে আর কিছু দেখিতে পাইবেন না। উভয়ে বহুক্ষণ নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন।
অবশেষে কনিষ্ঠ পাটেল ধীরে ধীরে বলিলেন, “এক-লাখ টাকা!” বলিয়াই তিনি ব্যস্তভাবে দুই হাতে মৃতদেহের বস্ত্রাদির ভিতরে সেই টাকার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। পকেটে জাহাজের টিকিট তিন খানা পাইলেন, তন্মধ্যে দুইখানা বাক্সের টিকিট, সেই বাক্স দুইটা জাহাজের ষ্টেষনে জমা আছে। অপরখানি যাত্রীর টিকিট।
তখন জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “নিশ্চয় লক্ষটাকা এই বাক্সে আছে?”
তাঁহার ভ্রাতা বলিলেন, “এখন মূর্খ কে আছে যে, এক লাখ টাকা এইরকম করিয়া রাখিবে?”
“তাহা হইলে গিরগামের বাসায় আছে?”
“না, সে সম্ভাবনা কম।”
ডাক্তার মৃতদেহের কোমরে হাত দিয়া একটা লম্বা থলী দেখিতে পাইলেন। তিনি সেটা খুলিয়া টানিয়া বাহির করিলেন। তাহার ভিতরে তাড়া বাঁধা অনেকগুলি নোট। তিনি সেই থলীর ভিতর হইতে সর্ব্বাগ্রে নোটগুলি টানিয়া বাহির করিলেন, একশতখানা হাজার টাকা নোট। ঠিক এক লাখ টাকা
কিয়ৎক্ষণ উভয়ে নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন। কথাবার্তায় কোন প্রয়োজন ছিল না। উভয়ে উভয়ের মনের ভাব বুঝিতে পারিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে দন্ত-চিকিৎসক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “লাখ টাকা!”
ডাক্তার বলিলেন, “হাঁ, এখন আমাদেরই হইবে।”
“নম্বরি নোট—ভাঙান দায়।”
“উপায় করিতে হইবে।”
“কি উপায়?”
“তাহাই ভাবিতেছি।।”
“কি ভাবিতেছ?”
“জাহাজের লোক ইহাকে চিনিবে না, টিকিট সহরের আফিসে কিনিয়াছে।”
“না, তাহারা চিনিবে না।”
“কাল ইহার জাহাজে উঠিবার কথা ছিল।”
“তাহা ত বুঝিলাম।”
“ভায়াজি, আমরা চিরকাল গরীবই থাকিতে পারি — অথবা সহজে বড়লোক হইতে পারি।”
এই বলিয়া তিনি নোটগুলি নাড়িতে লাগিলেন; উভয়েরই চক্ষু ক্রমে যেন জ্বলিয়া উঠিতে লাগিল। অর্থলোভে অতি নিরীহ লোকও অতি শীঘ্রই ভয়াবহ মূর্তিধারণ করিয়া থাকে।
সহসা ডাক্তার বলিল, “আমাদের একজনকে যাইতে হইবে।”
“কোথায়?”
“ইহার নাম লইয়া পোর-বন্দরে।”
“প্রয়োজন?”
“বিশেষ প্রয়োজন বইকি। আগে এইটাকে সরাইতেই হইবে।”
এই বলিয়া ডাক্তার অঙ্গুলী দিয়া মৃতদেহটা দেখাইয়া দিল। দিয়া বলিল, “তাহার পর ইহার নাম ধরিয়া পোর-বন্দরে নামিয়া নিরুদ্দেশ হইতে হইবে। অবশেষে যখন এ বিষয় লইয়া গোল উঠিবে, তখন এখানে কাহাকে কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না।”
“বুঝিতেছি।”
“যখন আমাদের একজন জাহাজে রওনা হইবে—অপরে ক্রমে ক্রমে নোটগুলি ভাঙাইতে থাকিবে। যতদিন তাহার কথা না প্রকাশ হইতেছে, ততদিন এই সকল নোট ব্যাঙ্কে কেহ বন্ধ করিবে না, সুতরাং নোট ভাঙাইবার যথেষ্ট সময় আছে।”
“হাঁ, কিন্তু এই লাসটা এখন কোথায় সরান যায়?”
“জাহাজে লইয়া যাইতে হইবে।”
“সে কি?”
“আর অন্য উপায় নাই। আমিই জাহাজে যাইব। আর তুমি এদিকে নোটগুলি ভাঙাইবার চেষ্টায় থাক। আমি দুইটা বাক্সে এই মৃতদেহটা লইব, পরে সুবিধামত জাহাজ হইতে সমুদ্রে ফেলিয়া দিতে চেষ্টা পাইব।”
“দুইটি বাক্সে এত বড় একটা মানুষের মৃদদেহ?”
“হাঁ, আমি শরীর-ব্যবচ্ছেদ করিতে জানি—আমি ডাক্তার—
“কি ভয়ানক! তুমি তাহা হইলে –”
মধ্যপথে বাধা দিয়া ডাক্তার কহিল, “হাঁ, অত ভয় পাইলে কাজ হয় না। ঐ ঘরে যাও, আমি যন্ত্রাদি আনিয়াছি।”
অপরে সত্বর তথা হইতে পলাইল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল — তাহার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছিল, তাহার ছোট ভায়ের ন্যায় তাহার মনের বল নাই।
ক্ষণপরে ডাক্তার বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, “যাও, একখানা গাড়ী করে গিয়া এখনই দুইটা বাক্স কিনিয়া আন, দেরি করিও না।”
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তৎক্ষণাৎ বাক্স আনিতে ছুটিল।
এদিকে ডাক্তারের কাজ চলিল। বিশেষতঃ ছুরি চালাইতে ডাক্তার খুব সুদক্ষ ছিল।
বাক্স আসিলে ডাক্তার, হরকিষণ দাসের খণ্ড খণ্ড দেহের প্রত্যেক খণ্ড স্বতন্ত্রভাবে খবরের কাগজে মুড়িয়া দুই বাক্সে বোঝাই করিল। তৎপরে বলিল, “আমি সুবিধামত জাহাজ হইতে এই দুইটা বাক্স জলে ফেলিয়া দিতে পারিব, কোন ভয় নাই, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।”
“তবে—”
“তবে আবার কি ভয় করিলে কোন কাজই হয় না। সময়ে খুনের কথা প্রকাশ পাইবে; কিন্তু আমাদের কেহ কোনক্রমেই সন্দেহ করিতে পারিবে না। বিচলিত হইও না, এদিকে সুবিধামত তুমি নোটগুলি ভাঙাইবার চেষ্টা করিতে থাক।”
“কিন্তু —”
“আর” কিন্তু “নাই—পরে টাকা হাতে আসিলে সব কিন্তুই মিটিয়া যাইবে। বোধ হয়, এক মাসের মধ্যেই আমি ফিরিয়া আসিতে পারিব। পথে জাহাজ কেবল মারঙি-বন্দরে একবার থামিতে, ইহার মধ্যে আমি চাই যে, তুমি নোটগুলি ভাঙাইয়া ফেলিবে।”
“কিরূপ ভাঙাইব—ব্যাঙ্কে যাইব?”
“না—না–একটা অন্য স্থানে গিয়া একখানা ভাল রকম বাড়ী ভাড়া নাও, সেইখানে কিছুদিন থাকিয়া দালালদের মারফৎ খুব ভাল ভাল সেয়ার কিনিতে থাক, সেয়ারের দামে এই সকল নোট দিয়ো, পরে সেয়ারগুলো বেচিবার সময় যদি দাম কিছু কম হয়, তাহাতেও বেশী কিছু আসে যায় না।”
“তাহাই করিব।”
“এখন তুমি বাড়ী যাও।”
“আর তুমি?”
“আজ রাত্রে আমি এইখানেই থাকিব।”
“এই ঘরে — এই মৃতদেহের সঙ্গে?”
“ইহাতে আমার কিছুমাত্র ভয় নাই, আমি এখন কিছুতেই এই মৃতদেহ দৃষ্টির বাইরে রাখিতে পারি না। সমুদ্রের জলে ফেলিয়া দিলে তবে নিশ্চিন্ত হইতে পারিব।”
“তুমি—তুমি—এখানে ঘুমাইতে পারিবে?”
“খুব।”
“তাহা হইলে আমি?”
“তুমি খুব সকালে আসিবে, তুমি আসিলে আমি হরকিষণ দাস হইয়া জাহাজে গিয়া উঠিব।”
এই বলিয়া সে একরূপ জোর করিয়া তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে গৃহ হইতে বাহির করিয়া দিল।
পরদিন অতিপ্রাতে দন্ত-চিকিৎসক নিজের আফিসে আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহার চেহারা দেখিলে স্পষ্টই বোধ হয় যে, সে সমস্ত রাত্রের মধ্যে একবারও নিদ্রিত হইতে পারে নাই।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে আসিতে দেখিয়া ডাক্তার, মৃত হরকিষণ দাসরে পরিত্যক্ত পোষাক পরিধান করিয়া গুজরাটী হইল। তাহার পর বাক্স দুইটা গাড়ীর উপরে উঠাইয়া পোর-বন্দর রওনা হইল। তথা হইতে পোর-বন্দরের জাহাজ ছাড়িবে।
ডাক্তার জাহাজে উঠিল। কিয়ৎক্ষণ পরেই জাহাজ ছাড়িয়া দিল। হরকিষণ দাসের পকেটে পূর্ব্বেই জাহাজের টিকিট পাওয়া গিয়াছিল, সুতরাং ইহার জন্য তাহাকে এখন আর স্বতন্ত্র এক পয়সাও ব্যয় করিতে হইল না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সম্পদে লোভ
উকীল বাইরামজী মেটা একসঙ্গে কখনও লক্ষ টাকা দেখেন নাই—অনেকেই দেখেন নাই। তবে লক্ষ টাকা হাতে পাইলে অনেকেই তারা নিজস্ব করিবার জন্য প্রলুব্ধ হন। টাকা জিনিষটার এই আকর্ষণ অত্যন্ত খারাপ, সন্দেহ নাই।
উকীল মেটাও প্রলুব্ধ হইলেন; হইবার কারণও অনেক। তিনি মদ্যপ—জুয়াড়ী—তাঁহার আপাদমস্তক দেনায় ডুবিয়া গিয়াছে।
দেনা হইলে লোকের কোন জ্ঞান থাকে না; উচ্চ শিক্ষিত হইলেও ক্রমে তাঁহাদের হিতাহিত জ্ঞান লোপ হইয়া আসে। মেটা সাহেবেরও তাহাই হইয়াছে। ক্রমে তাঁহার পশার নষ্ট হইতেছে—উকীল সমাজে তিনি হেয় ও হতশ্রদ্ধেয় হইয়া পড়িয়াছেন।
এই সময়ে হঠাৎ হরকিষণ দাসের বৃদ্ধা মাতুলানীর মৃত্যুতে এই একটা সুযোগ তাঁহার হাতে আসিয়া পড়িল। বহুকাল হইতে তিনি এই বৃদ্ধার কাজ-কৰ্ম্ম দেখিতেন; বৃদ্ধাই তাঁহার একমাত্র মক্কেল ছিল।
বৃদ্ধার সম্পত্তি হইতে তাঁহার বেশ দু পয়সা হইবে, ইহাই তিনি মনে মনে করিয়াছিলেন; মনে করিয়াছিলেন, হরকিষণ দাস কখনই দূর পোর-বন্দর হইতে এখানে আসিবে না। তিনি শুনিয়াছিলেন, সে চাষ-বাস করিয়া খায়, একরূপ মাতব্বর চাষামাত্র, কখনও সহর দেখে নাই—সহরে আসে নাই, তাহাকে ঠকান বড় কঠিন হইবে না।
পরে যখন মেটা পত্র পাইযা জানিলেন যে, হরকিষণ দাস সশরীরে আসিতেছেন, তখন তাঁহার ক্রোধে সৰ্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। হরকিষণ দাস উপস্থিত হইলে উকীল মেটা আরও নিরুৎসাহ হইলেন। তিনি যাহা ভাবিয়াছিলেন, তাহা নহে হরকিষণ দাস নিতান্ত সাদাসিদে লোক নহে, তাহাকে ঠকানও সহজ কাজ নয়। নিদারুণ নৈরাশ্যে তিনি একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন।
হরকিষণ বোম্বাই না আসিলে বেশ দু পয়সা হইত; কিন্তু সে আসিয়া পড়ায় মেটা টাকা লইতে সাহস করিলেন না। একেই তাঁহার বদনাম যথেষ্ট, তাহার উপরে হরকিষণ যদি কোনক্রমে জানিতে পারে যে, তিনি তাহার কিছু অর্থ আত্মসাৎ করিয়াছেন, তাহা হইলে সে তাঁহার রক্ষা রাখিবে না, বিন্দুমাত্র দয়ামায়া করিবে না, তাঁহার নামে তৎক্ষণাৎ পুলিসে নালিশ করিবে।
এই সকল ভাবিয়া-চিন্তিয়া তিনি তাঁহাকে তাঁহার লক্ষ টাকা হিসাব ঠিক করিয়া বুঝাইয়া দিলেন; কিন্তু তিনি মনে মনে অন্য একটা মলব আঁটিতে লাগিলেন। স্থির করিলেন, এ টাকা হাতে পাইয়া হাত হইতে কিছুতেই যাইতে দেওয়া হইবে না। মেটা মনে মনে যাহা প্রতিজ্ঞা করেন, তাহাতে কৃতকার্য্য হইবার জন্য তিনি অন্য কোন দিকেই আর দৃপাত করেন না।
তিনি হরিক্ষণের সহিত তাঁহার জাহাজের টিকিট কিনিয়া দিতে যাইতেছিলেন। হরকিষণ আগামী কল্য পোর-বন্দর অভিমুখে রওনা হইবেন। উভয়ে একত্রে যাইতেছিলেন, সহসা হরকিষণ দাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “উকীল এত কি ভাবিতেছ?
মেটা চমকিত হইলেন। তৎপরে বলিলেন, “কই, কিছুই নয়।”
“জাহাজের টিকিটের আফিস কত দূর?”
“এই যে—ঐ দেখা যাইতেছে।”
তাহারা উভয়ে জাহাজের আফিসে আসিয়া শুনিলেন যে, সেকেণ্ড ক্লাসের একটা কেবিন খালি আছে, ইহাতে দুইজন যাইতে পারেন। হরকিক্ষণ দাস একখানা টিকিট কিনিলেন
আফিই হইতে বাহির হইয়া মেটা হরকিষণ দাসের নিকট হইতে বিদায় লইয়া নিজের আফিসের দিকে চলিয়া গেলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে হরকিক্ষণ দাস দত্ত-চিকিৎসক খুঁজিতে লাগিলেন।
কিন্তু এদিকে মেটা ঠিক নিজের আফিসে ফিরিলেন না। হরকিষণ দাস দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে তিনি আবার সেই জাহাজের আফিসে ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, “আমার বন্ধু আমাকে আবার পাঠাইলেন। তাঁহার ইচ্ছা নহে যে, তাঁহার কেবিনে আর কেহ যায়; তিনি অন্য টিকিটখানাও কিনিতে ইচ্ছা করেন।”
“এ উত্তম কথা, বলিয়া জাহাজের কর্ম্মচারী নির্দ্দিষ্ট দাম লইয়া অপর টিকিটখানিও দিলেন। মেটা টিকিট লইয়া আফিস হইতে সহাস্য মুখে বাহির হইলেন।
যে কেবিনে হরকিষণ দাস যাইবেন, মেটা সেই কেবিনের অন্য টিকিট সংগ্রহ করিলেন। তিনিও হরকিষণ দাসের সঙ্গে সঙ্গে যাইবেন, তবে তাঁহার পোর-বন্দর পর্য্যন্ত যাইবার ইচ্ছা ছিল না। পথে জাহাজ মারভি-বন্দরে থামিবে; তিনি তাঁহার কার্য্য শেষ করিয়া সেই মারভি-বন্দরেই নামিয়া পড়িবেন, মনে মনে এইরূপই স্থির করিয়াছিলেন। তিনি যেরূপ বন্দোবস্ত করিলেন, তাহাতে তাঁহার বিশ্বাস, সেই লক্ষ টাকা ঘুরিয়া ঠিক আবার তাঁহার হাতেই আসিয়া পড়িবে; কিন্তু লোকে যাহা ভাবে, নিয়তি তাহার বিপরীত ঘটাইয়া দেয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ছদ্মবেশের প্রয়োজন
মেটা নিজ চেহারা ও বেশের পরিবর্তন আবশ্যক মনে করিলেন। তাঁহার দাড়ী-গোঁফ ছিল না। তিনি এক ভাল পরচুলওয়ালার দোকানে গিয়া গোঁফ ও দাড়ী সংগ্রহ করিলেন। তৎপরে দাড়ীতে লাল রং লাগাইলেন। তিনি মুসলমানের পোষাক পরিয়া যখন এই দাড়ী-গোঁফে সজ্জিত হইলেন, তখন তাঁহাকে পার্শী উকীল মেটা বলিয়া চিনিবার যো রহিল না। যে দেখিত, সেই মনে করিত, তিনি কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান সওদাগর।
জাহাজ প্রাতেই ছাড়িবার কথা ছিল, কিন্তু কোন কারণে সন্ধ্যার পূর্বে ছাড়িতে পারে নাই। এতক্ষণ জাহাজে থাকিলে পাছে কেহ তাঁহাকে চিনিতে পারে, সেই ভয়ে মেটা তৎক্ষণাৎ জাহাজ হইতে তখনই নামিয়া আসিলেন। জাহাজ ছাড়িবার একটু আগে তিনি পুনরায় আসিয়া জাহাজে উঠিলেন। এমন কি একটু দেরী হইলে আর জাহাজ পাইতেন না।
তিনি তাঁহার নির্দ্দিষ্ট কেবিনে আসিয়া শুইয়া পড়িলেন। লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা কথাবাৰ্ত্তা কহিতে তাঁহার সাহস হইল না—আর সে ইচ্ছাও ছিল না। জাহাজের খানাসামা আসিয়া তাঁহাকে আহারের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন, “অসুখ হইয়াছে—কিছু খাইব না।”
জাহাজ চলিল। পথে সন্ধ্যা হইল। সন্ধ্যার সময়ে সমুদ্র বড় গম্ভীর ও উদারভাব ধারণ করিল। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার তাহাতে সমুদ্রের নীলবক্ষে শুভ্রফেণ কি সুন্দররূপে শোভা পাইতেছে! সুনীল সমুদ্রের ফেণকেই তাহার অপূর্ব্ব হাস্যের মত দেখাইতেছে। অন্ধকার নিবিড় হওয়ায় ক্রমে জগৎ ম্লানমূর্তি ধারণ করিল। তাহার পর মনোহর চন্দ্রোদয় সমুদ্র রৌপ্যবর্ণ রঞ্জিত হইল—তখন চক্ষু যত দূর ইচ্ছা প্রসারিত করিয়া দাও, কেবল সমুদ্র আকাশ জ্যোৎস্না, আর জ্যোৎস্না আকাশ সমুদ্র—এই তিন ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কিছুরই সৃষ্টি হয় নাই। এদিকে জাহাজের ভিতরে প্রত্যেক কেবিনে ইলেকট্রিক আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। মেটা সেই আলোকে কেবিনটি ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া, প্রাচীরের দিকে মুখ করিয়া শয়ন করিয়া রহিলেন — কি জানি, হরক্ষিণ দাস আসিলে পাছে তাঁহাকে চিনিতে পারেন। ‘
অনেক রাত্রে হরকিষণ দাস কেবিনে শয়ন করিতে আসিলেন এতক্ষণ তিনি উপরে ডেকে ছিলেন। মেটা তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়া শুইয়া আছেন।
তাঁহার সহযাত্রী ঘুমাইয়াছেন দেখিয়া হরকিষণ আলো নিভাইয়া দিয়া শয়ন করিলেন।
মেটা স্পন্দিতহৃদয়ে নিঃশব্দে পড়িয়া রহিল। ক্রমে অপরের নাসিকাধ্বনি শ্রুতিগোচর হইল, তখন মেটা ধীরে ধীরে উঠিল, আগে হইতেই এক সুশানিত ছোরা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল—ইহা নিজ বস্ত্রমধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। মেটা একখানি তোয়ালেও সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন।
মেটা তোয়ালে ও ছোরা লইয়া নিঃশব্দে উঠিল। সে পূৰ্ব্ব হইতেই কেবিন বিশেষরূপে লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন, সুতরাং অন্ধকারে তাহাকে স্বকার্য্য উদ্ধারের জন্য বিশেষ কিছু অসুবিধা ভোগ করিতে হইল না। মেটা সহসা সুপ্ত হরকিষণের মুখে বামহস্তে রুমালখানা চাপিয়া ধরিয়া শানিত ছোরা তাঁহার কন্ঠের উপরে চালাইয়া দিলেন।
হরকিষণ কেবল সামানমাত্র গোঁ গোঁ করিলেন, একবার তাঁহার দেহ কম্পিত হইল, তাহার পর সকলই নিস্তব্ধ! মেটার কার্য্য সফল হইয়াছে।
মেটা খানিকক্ষণ নীরবে দণ্ডায়মান রহিল, সে দম বন্ধ করিয়া এই ভয়াবহ কাজ করিতেছিল, এতক্ষণে দম ঠিক করিয়া লইল।
সে মৃতের মুখের উপরে তোয়ালেখানা ঢাকিয়া দিল, কে স্বহস্তে ছেদন করা, দ্বিখণ্ড মৃতদেহ এরূপভাবে নিৰ্জ্জনে দেখিতে সাহস বা ইচ্ছা করে? মেটা মৃতদেহের মুখ তোয়ালে ঢাকিয়া বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিল। জ্বালিয়া দেখিল, সৌভাগ্যক্রমে নিম্নে রক্ত পড়ে নাই, তবে বিছানাটা রক্তে একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে, মেটা তখনই তাহা চাপাচুপি দিয়া ঠিক করিয়া ফেলিল। ইহাতে তাহার করতল রক্তরঞ্জিত হইয়া গেল তাহা হউক, পার্শ্বস্থ জলপাত্রে সে রক্ত অনায়াসেই ধুইয়া ফেলা যাইতে পারিবে। এবং মশারিটা একটু টানিয়া দিলে সকলেই মনে করিবে যে, লোকটা ঘুমাইতেছে। তাহার পর সে মারভি-বন্দরে নামিয়া গেলে, অন্ততঃ জাহাজ বহুদূর না গেলে এ যে কেন এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত ঘুমাইতেছে—তাহার সন্ধান কেহ করিবে না, সুতরাং তাহার কোন বিপদ হইবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নাই। এখন নিশীথ রাত্রি, সকলেই নিদ্রিত।
সে জানিত যে, হরকিষণ দাস নোটগুলি একটা লম্বা থলীতে পুরিয়া কোমরে বাঁধিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহার কোমের হাত দিয়া মেটা দেখিল যে, কোমরে সে নোটের থলী নাই।
মেটা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল, তবে সে নোট কোথায়? তবে কি হরকিষণ দাস কোন ব্যাঙ্কে জমা দিয়াছে। না, নিশ্চয়ই তাহা হইলে এই বাক্সে আছে। সৌভাগ্যের বিষয় বাক্স খুলিয়া দেখিবার যথেষ্ট সময় আছে।
মেটা তাড়াতাড়ি তাহার পকেট খুঁজিতে লাগিল অবশেষে চাবি পাইয়া তৎক্ষণাৎ একটা বাক্স খুলিয়া ফেলিল; দেখিল তাহাতে কাগজে মোড়া কি একটা বড় দ্রব্য রহিয়াছে, তাহার গন্ধটাও কেমন একরকম। এসব দেখিবার তাহার কিছুমাত্র সময় ছিল না, সে তাড়াতাড়ি আর একটা বাক্স খুলিয়া ফেলিল। দেখিল, তাহাতেও কাগজে মোড়া কয়েকটা কি রহিয়াছে, তন্মধ্যে একটা গোল, অন্য চারিটা লম্বা।
সে লম্বা একটা তুলিয়া লইয়া ক্রোড়ের উপরে রাখিয়া তাহার উপরের কাগজগুলি সন্তর্পণে খুলিতে আরম্ভ করিল।
কাগজ খুলিলে বাহির হইল, এক মানুষের হাত। তাড়াতাড়ি এবার গোলাকার মোড়কটা খুলিল, তাহার ভিতরে একটা মানুষের ছিন্ন মস্তক–কি ভয়ানক। মেটা নিজের মুখের শব্দ বন্ধ করিবার জন্য নিজেই নিজের মুখ চাপিয়া ধরিল। অন্যান্য কাগজের মোড়কে কি আছে, তাহা দেখিতে তাহার আর সাহস হইল না। সে বুঝিল, হরকিষণ দাস বোম্বাই সহরে কাহাকে হত্যা করিয়া তাহারই মৃতদেহ এইরূপে বাক্স-বন্দী করিয়া লইয়া যাইতেছে। দেখিতেছি ভগবান তাহার দণ্ড আমার হস্তেই দিলেন; কিন্তু লাখ টাকা কোথায়–তাহার সকল পরিশ্রম বৃথা হইল? অনর্থক হরকিষণকে খুন করিলাম, নিশ্চয়ই সে টাকা অন্যত্রে কোথায় রাখিয়াছে, এটা স্থির তাহার সঙ্গে টাকা নাই। সে তখনই সেই ছিন্নমস্তকটা উল্টাইয়া দেখিল, “কি ভয়ানক এ যে ঠিক হরকিষণের মুখ দেখিতেছি—একি স্বপ্ন না কি! মেটা ক্ষিপ্রবেগে এবার হরকিষণ দাসকে দেখিতে গেল, মশারি তুলিয়া সেই মৃতদেহের মুখ হইতে রুমাল টানিয়া তুলিয়া লইল—একি! এ আবার কে?”
এই সময়ে জাহাজের বাঁশী বাজিয়া উঠিল। মেটা বুঝিল, জাহাজ মারভি বন্দরের নিকটস্থ হইয়াছে, আর সময় নাই। যেমন করিয়া হউক, পলাইতেই হইবে। মেটা তাড়াতাড়ি সেই মৃতদেহের বাক্স দুইটা বন্ধ করিয়া ফেলিল। পরে আলো নিভাইয়া মৃত ব্যক্তির মুখের দিককার মশারি টানিয়া দিয়া বেশ-বিন্যাস করিল। তৎপরে যেন কিছুই হয় নাই, এইরূপভাবে উপরে ডেকে আসিল, সেখানে জাহাজের একজন কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কোথায় আসিলাম?”
“মারভি।”
‘এখানে কতক্ষণ জাহাজ থাকিবে?”
“একঘন্টা ডাক দিতে হইবে, ডাক লইতে হইবে। ঐ ছোট ষ্টীমার আসিতেছে। ঐ ডাক লইয়া যাইবে, তাহার পর আবার ডাক লইয়া আসিবে।”
“তীরে গিয়া সহরটা দেখিতে যাইতে পারা যায়?”
“হাঁ, যাইতে চান?”
“ক্ষতি কি, জায়াগটা দেখিয়া আসি।”
“কেবল একঘন্টা জাহাজ থামিবে।”
“ও-যথেষ্ট সময়।”
ক্রমে একখানি ক্ষুদ্র স্টীমার আসিয়া বড় জাহাজের গায়ে লাগিল। তখন জাহাজে একটা ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। মারভির যাত্রিগণ মাল-পত্র লইয়া ষ্টীমারে উঠিতে লাগিল। সেই গোলমালে মেটাও উঠিয়া পড়িল। কেহ তাহাকে দেখিল না, সে ষ্টীমার হইতে নামিয়া মেটা মারভি সহরে নিরুদ্দেশ হইল।