১.১ ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে

ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে নির্জন বিস্তৃত বালুবেলায় একাকী বসে আছে। তার মন বিষণ্ণ, বিষণ্ণতার ঠিক কারণটি জানা নেই বলে এক ধরনের অস্থিরতা তার মনকে অশান্ত করে রেখেছে। ইরন অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়–একটা ভাঙা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বের হওয়ার মিথ্যে চেষ্টা করে আবার মেঘের আড়াল হয়ে গেল। মেঘে ঢাকা চাঁদের কোমল আলোতে চোখের রেটিনায় বর্ণ অসংবেদী রড–গুলো কাজ করছে–তাই চারদিক আবছা এবং ধূসর। মধ্যরাত্রিতে নির্জন বালুবেলায় সামনের বিস্তৃত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রটিকে একটি অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য বলে মনে হয়। ইরনের পিছনে দীর্ঘ ঝাউগাছ, সমুদ্রের নোনা ভেজা হাওয়ায় সেগুলো দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করছে। হাহাকারের মতো সেই শব্দ শুনলেই বুকের মাঝে বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে।

ইরন তার বুকের মাঝে দুর্বোধ্য সেই শূন্যতা নিয়ে নিজের হাঁটুর উপর মাথা রেখে নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে সে বড় নিঃসঙ্গ এবং একাকী। তার বুকের ভিতরে যে বিষণ্ণতা তার সাথে সে পরিচিত নয়, যে হতাশা তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।

অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। ইরন সুদর্শন, সুস্থ, সবল, নীরোগ একজন পুরুষ, তার বয়স মাত্র সাতাশ, এরকম বয়সে একজন মানুষ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর প্রথমবার সত্যিকার জীবনে প্রবেশ করে। নিজে দায়িত্ব বুঝে নেয়, নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করে, আশপাশে অন্য মানুষেরা তার চিন্তা–ভাবনা–সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। ইরন মেধাবী এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিল। তার ভিতরে তীক্ষ্ণ এক ধরনের সৃজনশীলতা ছিল, জীবনকে ভালবাসার ক্ষমতা ছিল, উপভোগ করার আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা তার ভিতরে সহজাত নেতৃত্বের একটা ক্ষমতা ছিল। তার সাতাশ বছর বয়সে সে সত্যিকারের সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে কেমন জানি সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। এক বছরের মাথায় তার যা–কিছু অর্জন সবকিছু যেন ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা হয়ে তার কাছে ফিরে এল। সে কিছুতেই হিসাবটি মিলাতে পারে না, কেন তার ভাগ্য হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পণ করে ফেলেছে, প্রতিটি পদক্ষেপ হঠাৎ করে ভুল হতে শুরু করেছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছেলেমানুষি হাস্যকর ব্যর্থতা হয়ে তাকে উপহাস করতে শুরু করেছে। ইরন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে তার ভিতরে সেই একাগ্র জীবনীশক্তি নেই, সেখানে কেমন যেন খাপছাড়া শূন্যতা। আনন্দ নেই, ভালবাসা নেই, স্বপ্ন নেই, সাহস নেই। শুধু এক ধরনের অসহায় বিষণ্ণতা।

রাতের আকাশে হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাখি কর্কশ স্বরে শব্দ করে উড়ে গেল–এমন কিছু ভয়াবহ শব্দ নয় কিন্তু ইরন হঠাৎ করে চমকে ওঠে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, সমুদ্রের নোনা শীতল বাতাস ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে, বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার। নিজের বাসার কথা মনে করে ইরন আবার একটি লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক কী কারণ সে জানে না, তার আজকাল বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে করে না। দীর্ঘ রাত সে শহরতলির পথে–ঘাটে হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে তবু বাসায় ফিরে যায় না। আজ অবশ্য সে বাসায় ফিরে যাবে। আজ তার সাতাশতম জন্মবার্ষিকী–হয়তো কেউ সেটা স্মরণ করে তার কাছে একটা শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। হয়তো কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তার জন্য ভালবাসার কথা বলে গেছে, হয়তো সেটা দেখে আজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার মন ভালো হয়ে যাবে।

কিন্তু বাসায় ফিরে ইরনের মন ভালো হয়ে গেল না–বরং নতুন করে আবার বিচিত্র এক ধরনের বিষণ্ণতা এসে তাকে গ্রাস করল। তার কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তাকে স্মরণ করে কোনো শুভেচ্ছা রেখে যায় নি। আকাশের কাছাকাছি ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টের স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিচে বহু দূরে শহরে জীবনের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ইরন বুঝতে পারল তাকে কী করতে হবে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলল, কী আশ্চর্য আমি এটা বুঝতে এত দেরি করলাম!

ইরন স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালাটির দিকে তাকাল–চারপাশে কয়েকটি সাধারণ ক্রোমিয়াম স্ন্যাপার দিয়ে আটকানো– মাঝারি আকারের একটা স্কু ড্রাইভার হলেই সে জানালাটি খুলে নিতে পারবে। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে সে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক কিলোমিটার উঁচু এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিচে পড়তে তার প্রায় পনের সেকেন্ড সময় নেবে, পনের সেকেন্ডে তার বেগ হওয়ার কথা ঘণ্টায় প্রায় চার শ কিলোমিটার–কিন্তু বাতাসের বাধার জন্য সেটা তার অর্ধেকে গিয়ে থেমে যাবে। ঘণ্টায় দু শ কিলোমিটার বেগে সে যখন নিচের শক্ত কংক্রিটে আঘাত করবে তখন তার মৃত্য হবে। তাৎক্ষণিক। তার সকল হতাশা, বিষণ্ণতা এবং যন্ত্রণার অবসানও হবে তাৎক্ষণিক। ব্যাপারটি চিন্তা করে অনেকদিন পর হঠাৎ ইরন নিজের ভিতরে এক ধরনের উল্লাস অনুভব করে।

ইরন ঘরের ভিতর ফিরে এল, খাবারের কাবার্ড থেকে সে একটা পানীয়ের বোতল বের। করে তার বিছানায় বসে। নিজেকে শেষ করে দেবে সিদ্ধান্তটি নেবার পর সবকিছুকেই হঠাৎ করে খুব সহজ মনে হচ্ছে–কাজটি এই মুহূর্তে করা আর কয়েক ঘণ্টা পরে করার মাঝে সত্যিকার অর্থে কোনো পার্থক্য নেই।

ইরন তার অগোছালো বিছানায় পা তুলে বসে হাতের পানীয়ের বোতলটি থেকে এক ঢোক তরল গলায় ঢেলে নেয়। উত্তেজক বিতানীন মিশ্রিত পানীয়, হঠাৎ করে তার সারা শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।

ইরন হাত বাড়িয়ে যোগাযোগ মডিউলের টিউবটি স্পর্শ করতেই ঘরের ঠিক মাঝখানে পৃথিবীর সাদামাঠা মানুষের জন্য তৈরি হালকা আনন্দের একটি নাচ–গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। অনুষ্ঠানটি স্বরুচির মানুষদের জন্য তৈরি, ইরন কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখতে পারল না। বিতানীন মিশ্রিত পানীয়টি পুরো বোতল শেষ করার আগে সে এই অনুষ্ঠানটি দেখতে পারবে বলে মনে হয় না। টিউব স্পর্শ করে সে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে, প্রকৃতির ওপর একটি অনুষ্ঠান, ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি থেকে ঘুরে আসা মহাকাশযানের কৃত্রিম ভ্রমণবৃত্তান্ত, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে মানুষের খাবারের জন্য তৈরি কৃত্রিম এক ধরনের প্রাণীর বিজ্ঞাপন, কিরি কম্পিউটারের কম্পোজ করা সঙ্গীত, দশ হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎদণ্ড দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করার এক ধরনের নির্বোধ খেলা–এই ধরনের কিছু অনুষ্ঠানে চোখ বুলিয়ে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরের মাঝে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিতে মধ্যবয়সী একজন মহিলাকে দেখতে পেল। মহিলাটি সোজা ইরনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বিষণ্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত? তুমি কি নৈরাশ্যবাদী এবং যন্ত্রণাকাতর? তুমি কি তোমার নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছ? যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে তা হলে সব শেষ করে দেবার আগে আমাদের সাথে যোগাযোগ কর। মাত্র অল্প কিছু ইউনিটের বিনিময়ে আমরা হয়তো তোমার জীবন রক্ষা করতে পারব।

হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মহিলাটি তার চোখে–মুখে এক ধরনের ব্যাকুলতার ভাব ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নতুন কিরি কম্পিউটারে তৈরি এ ধরনের অনেক প্রোগ্রাম মানুষের বিনোদনের জন্য তৈরি হয়েছে। টুরিন টেস্টে উত্তীর্ণ এই ধরনের কৌশলী প্রোগ্রাম দীর্ঘ সময় মানুষের সাথে কথা বলে যেতে পারে, বুদ্ধিবৃত্তির একেবারে নিচের দিকের মানুষেরা এদের। সাথে কথা বলে এক ধরনের তৃপ্তি পায় বলে জানা গেছে। ইরন কখনোই এ ধরনের প্রোগ্রামের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে নি, আজ হঠাৎ করে কৌতূহলী হয়ে সে প্রোগ্রামটি চালু করল। তার ব্যাংক থেকে ইউনিট স্থানান্তর করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল এবং তারপর হঠাৎ করে মনে হল তার ঘরের ঠিক মাঝখানে মধ্যবয়সী একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তৈরি একজন কৃত্রিম মানুষের প্রতিচ্ছবি জানার পরও একজন সত্যিকার মানুষ বলে ইরনের ভুল হতে থাকে। মহিলাটি তার। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তোমার ঘরটি দেখে মনে হচ্ছে একটা ছোটখাটো বিপর্যয় ঘটে গেছে।

ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ

মহিলাটির পিছনে একটা চেয়ার, সেটাও কৃত্রিম। মহিলাটি চেয়ারটির কাছে গিয়ে বলল, বসতে পারি?

হ্যাঁ, বস।

কাজের কথায় চলে আসা যাক, কী বল?

ইরন এক ধরনের কৌতুক অনুভব করে, সে আরো এক ঢোক পানীয় খেয়ে বলল, তুমি তো আসলে সত্যিকারের মানুষ নও–কাজেই তোমার সাথে যদি ভদ্রতাসূচক কথাবার্তা না বলি তুমি কিছু মনে করবে না তো?

ইরনের স্পষ্ট মনে হল তার এই রূঢ় কথাটিতে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মহিলাটি একটু আহত হয়েছে। মহিলাটি অবশ্য সহজেই নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলল, না, আমি কিছু মনে করব না। তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি–তুমি যদি খোলামেলাভাবে আমার সাথে কথা বল হয়তো সত্যিই তোমাকে সাহায্য করতে পারব।

মনে হয় না। ইরন সোজা হয়ে বসে বলল, তোমাদের তৈরি করা হয়েছে হালকা আমোদর জন্য

না, ইরন। মহিলার মুখে নিজের নাম শুনে ইরন একটু চমকে ওঠে কিন্তু মহিলাটি সেটা ঠিক লক্ষ করল না, মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, আমি এখানে আসার আগে তোমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। তথ্যকেন্দ্রে যেসব তথ্য আছে সেটা থেকে মনে হচ্ছে তুমি সত্যি সত্যি এক–দুই দিনের মাঝে আত্মহত্যা করবে। আমি সত্যিই তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমি সত্যিকারের মানুষ না হতে পারি, কিন্তু আমি সত্যিকারের সাহায্য করতে পারি।

আমার সম্পর্কে তোমার কী কী তথ্য আছে?

আমরা জানি কিছুদিন আগেও তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলে। ওয়ার্মহোল রিসার্চে তোমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আছে। ওয়ার্মহোল তৈরির ব্যাপারে তোমার কিছু নিজস্ব ধারণা আছে–

এবং সেই ধারণা কাজে লাগাতে গিয়ে আমি পৃথিবীর সামনে নিজেকে গর্দভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি।

মহিলাটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের পরীক্ষাতে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।

দুর্ঘটনা? তুমি এটাকে দুর্ঘটনা বলছ? একটা শহরের আধখানা উড়ে যাওয়া দুর্ঘটনা?

নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা।

পর পর তিনবার একই দুর্ঘটনা!

মহিলাটি একটু নড়েচড়ে বলল, হ্যাঁ, পর পর একই ধরনের তিনটি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু

কিন্তু কী?

মানুষের জীবনে খুব কম সম্ভাবনার ঘটনা তো ঘটে। তুমি নিশ্চয়ই জান যে একজন মানুষের মাথায় দুবার বজ্রপাত হয়েছিল।

ইরন মাথা নাড়ল, না, জানি না। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। সেই হতভাগা মানুষের জীবনে কী হয়েছিল কে জানে! কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি তার আমার মতো অবস্থা হয় নি। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, কথা বলার লোক নেই, একাকী উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি

মহিলাটি বাধা দিয়ে বলল, এটাই জীবন। এটাই মানুষের জীবন। কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা, কখনো সুখ, কখনো।

ইরন হঠাৎ তার বিছানায় সোজা হয়ে বসে তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, চুপ কর। চুপ কর তুমি।

মহিলাটি বিভ্রান্তের মতো বলল, চুপ করব?

হ্যাঁ। তুমি মানুষের জীবনের কী জান? কিছুই জান না। তার কষ্টের কথা যন্ত্রণার কথা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই! তুমি একটা তৃতীয় শ্রেণীর প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে জীবন সম্পর্কে বক্তৃতা শোনাতে এসো না।

মহিলাটি আহত মুখে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার জীবনের কষ্ট, হতাশা আর যন্ত্রণার কথা নিয়ে আমার সাথে কথা বলবে। আমি তো নিজে থেকে আসি নি। তুমি আমাকে ডেকে এনেছ।

ইরন উত্তেজিত গলায় বলল, হ্যাঁ। তোমাকে আমি ডেকে এনেছিলাম, এখন আমিই তোমাকে বিদায় করে দিচ্ছি। তুমি দূর হও এখান থেকে।

মহিলাটি তুমি ধরনের বিস্ময় নিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউবে স্পর্শ করলেই আমি চলে যাব ইরন। আমি নিজে থেকে যেতে পারি না।

বেশ, তা হলে আমি তোমাকে সেভাবেই বিদায় করছি। ইরন টিউবটি স্পর্শ করতে হাতটি এগিয়ে দিতেই মহিলাটি স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, দাঁড়াও, ইরন।

কী?

তুমি কি সত্যিই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

হ্যাঁ।

তুমি কোনোভাবে তোমার মত পাল্টাবে না?

না।

তা হলে

তা হলে কী?

তা হলে তুমি তোমার আত্মহত্যাকে আরো একটু অর্থবহ কর না কেন? সম্পূর্ণ অকারণে নিজেকে মেরে ফেলে কী লাভ? তুমি যদি–

আমি যদি–

তুমি যদি একটা খুব বিপজ্জনক প্রজেক্টে অংশ নাও, যেখানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী–সেটি কি একটা মহৎ কাজ হয় না?

ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

মনে কর প্রজেক্ট আপসিলনের কথা। এই প্রজেক্ট মানবসভ্যতার একটা নতুন দ্বার খুলে দেবে। অথচ এর মতো বিপজ্জনক প্রজেক্ট কখনো প্রস্তুত হয় নি। কারো বেঁচে আসার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য তিন। আত্মহত্যা না করে তুমি যদি এই প্রজেক্টে যোগ দাও।

ইরন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পানীয়ের বোতলটি মহিলার উদ্দেশে ছুঁড়ে মারল। হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবির ভিতর দিয়ে বোতলটি ছুটে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ল। ইরন চিৎকার করে বলল, বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। মানুষের প্রাণ নিয়ে তুমি ব্যবসা করতে এসেছ?

মহিলাটি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার চেহারায় এক ধরনের ভয়ের ছাপ পড়ল, সে আতঙ্কিত হয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমি যদি তোমাকে ধরতে পারতাম, গলা টিপে খুন করে ফেলতাম।

কিন্তু তুমি তো ধরতে পারবে না। আমি–আমি তো সত্যি নই। আমাকে তো ধরা ছোঁয়া যায় না।

জানি। তোমাকে ধরা–ছোঁয়া যায় না। কিন্তু তুমি মানুষ মারা প্রজেক্টের জন্য লোক ধরে নিতে এসেছ? বেছে বেছে খোঁজ করছ আমার মতো মানুষদের!

মহিলাটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন তার আগেই কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউব স্পর্শ করে মহিলাটিকে অদৃশ্য করে দিল। ঘরের ভিতর হঠাৎ করে তার অবিন্যস্ত মন খারাপ–করা শোয়ার ঘরটি ফিরে আসে। দেয়ালে পানীয়ের লাল ছোপ, মেঝেতে ভাঙা বোতলের কাঁচ ছড়ানো। ইরন সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে উঠল, কী আশ্চর্য, সে একটা কৌশলী প্রোগ্রামের সাথে রাগারাগি করছে। কেমন করে সে এরকম হাস্যকর ব্যবহার করতে পারল?

ইরন কোয়ার্টজের জানালার দিকে তাকাল, একটা বড় ভ্রু ড্রাইভার এনে ক্রোমিয়ামের স্ন্যাপারগুলো খুলে সে এখনই জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়তে পারে কিন্তু হঠাৎ করে তার কেমন জানি ক্লান্তি লাগতে থাকে। কিছু না করার ক্লান্তি। অবসাদের ক্লান্তি। সে শ্রান্ত পায়ে নিজেকে টেনে এনে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

বিছানায় মাথা স্পর্শ করার সাথে সাথেই কিছু বোঝার আগেই ইরন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।