ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.১ অন্ধকার সিঁড়ি

প্রথম পর্ব

।। এক ।। অন্ধকার সিঁড়ি

এলাকাটা কলকাতার কালিন্দী—বাঙ্গুর—বরাটের কাছাকাছি। যশোর রোড থেকে একফালি রাস্তা হঠাৎ যেন ছুরির বাঁকা ফলার মতো ভেতরে ঢুকে গেছে।

বড়ো রাস্তার দু—পাশে যথেষ্ট পরিবর্তন হলেও ফালি রাস্তার ভেতরে এই যে বিস্তীর্ণ জায়গাটা পড়ে আছে সেখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখনো সেখানে ঝোপ—ঝাপ, জলা, ডোবা দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখলে কে বলবে—জায়গাটা কলকাতার মধ্যেই।

এখানে কয়েকটা টালির ঘর ছাড়া একটা বিশেষ বাড়ি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

চুন—বালি খসা জীর্ণ তেতলা বাড়ি। পাঁচিল—ঘেরা কম্পাউন্ড। জায়গায় জায়গায় পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। তা পড়ুক। তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

কম্পাউন্ডে ঢোকার মুখে লোহার গেট। নামেই গেট। সে—গেট বন্ধ করা যায় না। একদিকের পাল্লাই নেই।

সেই ভাঙা গেট দিয়ে একদিন একটা ট্রাক এসে ঢুকল। ট্রাকভর্তি মাল। সঙ্গে এল একজন ভদ্রলোক, একজন মহিলা, একজন প্রৌঢ়া আর কোলে একটি শিশু।

বাড়ির সামনে পাথরের ভাঙা নারীর নগ্নমূর্তি। তার চারিদিকে খানকয়েক লোহার বেঞ্চি।

তখন বিকেল। এ—বাড়ির বৃদ্ধেরা বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল। ট্রাক ঢুকতে তারা অবাক হয়ে তাকাল।

—নতুন ভাড়াটে বোধহয়।

—হুঁ। তিনতলাটা তো খালি ছিল।

—ভালোই হল। আমরা দলে ভারী হলাম।

—তা হয়তো হলাম। কিন্তু কেমন ফ্যামিলি সেটাই বড়ো কথা।

—দেখে তো মনে হচ্ছে ছোটোখাটো ভদ্র পরিবার। ওরা বোধহয় স্বামী—স্ত্রী।

—বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই। আর ওটা ওদের বাচ্চা।

—কিন্তু বুড়িটা?

—হয় মেয়ের শাশুড়ি, নয় ছেলের শাশুড়ি।

—বুড়িটাকে ছন্দপতন বলে মনে হচ্ছে। নইলে ‘ছোটো পরিবার সুখী পরিবার’—এর আদর্শ দৃষ্টান্ত।

প্রৌঢ়ের সরস মন্তব্যে সকলেই হেসে উঠল।

তরুণ ভদ্রলোকটির বোধহয় ভয় ছিল বাড়িটা স্ত্রীর পছন্দ হবে কিনা। তাই সসংকোচে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু মহিলাটি কম্পাউন্ডে ঢুকেই বলে উঠল—বাঃ! কতখানি জায়গা! বিকেলে এখানেই বেশ বেড়ানো যাবে। ওমা! কী চমৎকার বুনো ফুল! বলেই ছুটে গেল পাঁচিলের দিকে।

—এই! এসো এদিকে।

প্রৌঢ়া মাল—পত্তর আগলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক বাচ্চা কোলে করে স্ত্রীর কাছে গেল।

—এগুলো কী ফুল বলো তো? চোখের ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল মহিলা।

—জানি না।

—ঢোলকলমী। আমাদের দেশের বাড়ির পুকুরের ধারে গাদা ফুটত। ওমা! কেমন একটা পুকুর।

ভদ্রলোক হেসে বলল—পুকুর তো তোমার কী? চান করবে নাকি?

—দেশের বাড়ি হলে করতাম। ওটা দেখেছ?

বলে ছাদের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। কীরকম অদ্ভুত, না?

—হ্যাঁ, গম্বুজের মতো। সেকালের বাড়ি তো।

মহিলাটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ গম্বুজটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ গম্বুজটার মাথায় তখন কেমন যেন বিষাদের আলপনা এঁকে যাচ্ছে।

—চলো, ওপরে যাই। জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিতে হবে। ভদ্রলোকটি তাড়া দিল।

মহিলাটি যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল—হ্যাঁ, চলো। আসুন পিসিমা।

ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। উচিত ছিল ভদ্রলোকেরই আগে আগে যাওয়া। কেননা ভদ্রলোক এর আগে এসেছে। কিন্তু ভদ্রমহিলারই উৎসাহ বেশি। সে এগিয়ে এগিয়ে চলেছে—যেন তার চেনা বাড়িতে ঢুকছে।

সিঁড়িটা অন্ধকার। দেওয়ালে হাজার ফাঁক—ফোকর। সিঁড়িগুলোও যেন দাঁত খিঁচিয়ে আছে।

সিঁড়িটা যেন গোটা বাড়ির বুক চিরে উপরে উঠে গেছে। দু—পাশে ঘর। দরজায় দরজায় পর্দ ফেলা। বুঝতে পারা যায় সব ঘরেই ভাড়াটে আছে। কোনো ঘরে রেডিয়ো বাজছে, কোনো ঘরে কিশোরীকন্যার গানের রেওয়াজ চলেছে, কোথাও বা দুরন্ত ছেলেকে মা তারস্বরে ধমকাচ্ছে। ঘরে ঘরে জীবনের লক্ষণ।

—অন্ধকার। আস্তে আস্তে ওঠো। ভদ্রলোক স্ত্রীকে সাবধান করে দিল।

চার ধাপ ওপরে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা ঘাড় ফিরিয়ে হেসে বলল, ভয় নেই। পড়ব না।

বলেই দু—ধাপ উঠে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল—পড়ে গেলাম!