মামলার আরও কথা
কিরীটী ঘরের মধ্যে ইতস্তত পায়চারি করছিল।
আর সুব্রত ভাবছিল, ব্যাপার এখন যা বোঝা যাচ্ছে তাতে করে মনে হচ্ছে তার কাজের সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল। এখন সে কোন্ পথে যাবে? কোন্ পথে অগ্রসর হবে? কিরীটীর মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায়, বর্তমানে সে কোনো গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। এ সময় কোনো প্রশ্ন করলে তার কাছ থেকেও কোনো জবাব পাওয়া যাবে না।
রাত্রি প্রায় দুটো হল, সুব্রতর দুচোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসছে, সে শয্যার উপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। শিয়রের ধারে খোলা জানালাপথে রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া শিরশির করে এসে চোখে মুখে যেন একটা স্নিগ্ধ প্রলেপ দিয়ে যায়।
সুব্রতর চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে।
কিরীটীর চোখে কিন্তু ঘুম নেই, ক্যাম্পখাটের ওপরে কাত হয়ে শুয়ে সে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে টানতে লাগল।
বাইরে চৈত্রের রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। রাতের অন্ধকারে ক্রমশ অস্পষ্ট ভোরের আলো যেন ফুটে উঠছে। রাত্রিশেষের আবছা আলোয় পৃথিবী অস্পষ্ট, কেমন যেন অচেনা।
ঘুম আর হবে না এটা ঠিকই। একসময় কিরীটী ক্যাম্পখাটের উপর উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বারান্দার একপাশে আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়ে থাকোহরি ঘুমোচ্ছে।
চায়ের পিপাসা পেয়েছে, এক কাপ চা হলে এখন মন্দ হত না। কিরীটী আপাদমস্তক চাদরাবৃত থাকোহরির গায়ে একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে ডাকলে, থাকোহরি!
সামান্য ঠেলাতেই থাকোহরির ঘুম ভেঙে যায়, কিরীটীর ডাক না শুনেই।
ধড়ফড় করে থাকোহরি উঠে বসে, হ্যাঁ!
এক কাপ চা খাওয়াতে পার থাকোহরি?
থাকোহরি উঠে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
একটু পরেই সুব্রতর ঘুমটা ভেঙে গেল। চারদিকের অন্ধকার কেটে গিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তখন চেয়ে দেখলে কিরীটী নেই।
বারান্দায় কিরীটী আপনমনে পায়চারি করছিল।
সুব্রত বাইরে এসে দাঁড়াল। সুব্রতর পায়ের শব্দে পায়চারি থামিয়ে কিরীটী ফিরে দাঁড়াল, ঘুম হল কল্যাণবাবু?
হ্যাঁ, কিন্তু এ কি! তুই কি সারাটা রাত্রি জেগেই কাটালি নাকি?
তা—মানে ঘুম এল না, কি করি?
থাকোহরি এককাপধূমায়িত গরম চা নিয়ে এসে দাঁড়াল। কিরীটী পরম আগ্রহ ভরে থাকোহরির হাত থেকে গরম চায়ের কাপটা নিতে নিতে স্মিতভাবে বললে, বাঁচালে বাবা!
ও কি করে বুঝল যে তুই এত ভোরে চা পান করিস!
বুঝিয়ে দিয়েছি। চায়ের কাপে একটু চুমুক দিয়ে কিরীটী বললে, আঃ, বেশ চা-টি বানিয়েছ হে থাকো! বেঁচেবর্তে থাকো।
আমি হাতমুখটা ধুয়ে আসি। সুব্রত কুয়োতলার দিকে চলে গেল।
.
বেলা তখন প্রায় সাতটা। ভোরের সোনালী রোদে চারিদিক যেন খুশীতে ঝলমল করছে। অকারণেই মনটা যেন আনন্দে ভরে ওঠে।
সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা চলছিল।
আমাকে এখানে আচমকা আসতে দেখে নিশ্চয়ই তুই খুব অবাক হয়েছি, সুব্রত! কিন্তু না এসে আর আমার উপায় ছিল না। চারদিকেই ক্রমে জট পাকিয়ে উঠছে। তবে আমি আত্মগোপন করেই আপাতত থাকব, যাতে করে তোর কাজের কোনো অসুবিধা না হয়। যদিচ তার একটা খুব কোনো প্রয়োজন ছিল না বর্তমানে, তবু থাকব। একটু থেমে সুব্রতর মুখের দিকে চেয়ে কিরীটী বলতে থাকে, তুই যখন প্রথমে এখানে আসিস, আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে তখনও রূপ নেয়নি। পরে একটু একটু করে ঘটনাচক্র বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আর আমাদেরও এখন ঠিক সেইভাবেই এগুতে হবে।
তুই এখানে আসার পর কি কোনো নতুন সূত্র পেয়েছিস? সুব্রত প্রশ্ন করে।
এখানে আসবার পর তো পেয়েছিই, তবে তোর চিঠিতেই আমি পেয়েছিলাম আগে।
আচ্ছা সতীনাথের হত্যাকারী কে বুঝতে পেরেছিস কি?
ঠিক কে তা এখনও বুঝতে না পারলেও, কার দ্বারা যে সেটা সম্ভব হতে পারে সেটা বোধ হয় বুঝতে পেরেছি। এবং সেদিক দিয়ে যদি বিচার করিস,তবে খুনী কে তা হয়ত কিছুটা বুঝতে পারবি।
কিরীটীর কথায় মনে হয় সুব্রত যেন একটু উদগ্রীবই হয়ে ওঠে, কিন্তু কোনো কিছু বলে না। চুপ করেই থাকে।
কিন্তু সে কথা থাক, কিরীটী বলতে থাকে, আমাদের এখন প্রথম কাজ হচ্ছে তোক তোর প্ল্যানমাফিক কালই নৃসিংহগ্রামে যেতে হবে। এবং সেখানে গিয়ে যথাসম্ভব চটপট চারিদিক দেখেশুনে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোকে আবার ফিরে আসতে হবে। তুই ফিরে এলেই এখানকার তল্পিতল্পা আমরা গুটাবো। কলকাতায় এখনও আমাদের কিছু কাজ বাকি। তারপর যেতে হবে সেই সুদূর বোম্বাই। হ্যাঁ দেখ,নসিংহগ্রামের কাছাড়িবাড়ী ও তার আশপাশ খুব ভাল করে পরীক্ষা করবি, কেননা দু-দুটো খুন ঐ কাছারিবাড়িতেই হয়েছিল এবং সেখানকার পুরানো কর্মচারীরা কেউ বদলায়নি। সবাই আছে এখনও। যতদূর জেনেছি, নৃসিংহগ্রামের কাছারিবাড়িতে শিবনারায়ণ বলে যে বৃদ্ধ নায়েবটি আছেন তিনি অনেক দিনের লোক, লোকটি শুনেছি অত্যন্ত সদাশয়ও, বয়স তাঁর বর্তমানে পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর মধ্যে। লোকটা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও তৎপর। বিবাহাদি করেননি। একটি চক্ষু (বাম) নাকি তাঁর কানা, পাথরের অক্ষিগোলক বসানো। স্থানীয় যে কয়েকঘর সাঁওতাল ও বাউরী আছে রাজাবাহাদুরের, তারা শিবনারায়ণকে দেবতার মতই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। এক কথায় শিবনারায়ণের তাদের প্রতি অখণ্ড প্রতাপ। রায়পুরের বর্তমান রাজাবাহাদুরের পিতা, রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক তাঁর পিতার মৃত্যুর কয়েক বৎসর আগে রাজস্টেটের কয়েকজন পুরনো কর্মচারীকে পিতার সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ করে, কতকটা জেদাজেদি করেই কর্মচ্যুত করে নতুন কয়েকজন কর্মচারী বহাল করেন। তাদের মধ্যে শিবনারায়ণ চৌধুরী নৃসিংহগ্রামের অন্যতম। তারপর থেকেই শিবনারায়ণ এঁদের স্টেটে চাকরি করছেন।
আর সতীনাথ লাহিড়ী? সুব্রত প্রশ্ন করে।
না, সতীনাথ সুবিনয় মল্লিকের নিযুক্তলোক। তার পরেই কিরীটী বলে, আমিই নৃসিংহগ্রামে যেতাম ছদ্মবেশে, কিন্তু শিবনারায়ণ আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সেখানে তোকেই যেতে হবে।
বলিস কি! শিবনারায়ণকে তুই চিনিস নাকি? সুব্রতর কণ্ঠে বিস্ময়।
চিনি। সে এক অতীত কাহিনী। সময়মত সে আর একদিন বলব। ঠিক পরিচয় না থাকলেও সে আমার নাম শুনেছে এবং আমিও তাকে ভাল করেই চিনি তার কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। মহাত্মাদের পরিচয় কি কখনও গোপন থাকে রে? তার যে স্বরূপেই প্রকাশ। শিবনারায়ণের এক ছোট ভাই ছিল। নাম তার নরনারায়ণ। শিনারায়ণের চাইতে সে প্রায় দশ-এগারো বৎসরের ছোট। পরিচয়টা আমার তার সঙ্গেই,মানে নরনারায়ণের সঙ্গেই বেশী ছিল। তিনিও একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন কিনা।
তার মানে?
তার মানে অতীতে একবার তাঁর সঙ্গে আমায় মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল।
তাই নাকি! তা সে মহাত্মাটি এখন কোথায়? সুব্রত হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে। বর্তমানে তিনি বছর ছয়-সাত হল গত হয়েছেন। কোনো একটি খুনের দায়ে নরনারায়ণ ধরা পড়েছিল। কোর্টে যখন বিচার চলছে, এমন সময় জেল ভেঙে প্রাচীর টপকিয়ে পালাতে গিয়ে প্রহরারত সেন্ট্রির বন্দুকের গুলি খেয়ে প্রাণ হারায়। সাধারণত প্রহরীদের হাতের নিশানা অব্যর্থ হয় না, কিন্তু কি জানি নরনারায়ণের বেলায় it was a susccess,বোধ হয় ঐ ভাবে তার মৃত্যু ছিল বলেই।
এসব কথা তো কই এতদিন তুই আমায় জানাসনি?
মনে ছিল না তাই। পুরাতন ডাইরীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কয়েক দিন আগে সব জানতে পারলাম। তবে হ্যাঁ, কথাটা তাহলে তোকে খুলেই বলি স্পষ্ট করে। সেখানে গিয়ে একটা কথা কিন্তু সর্বদা মনে রাখিস, গোখরো সাপের চাইতেও সাংঘাতিক ঐ শিবনারায়ণ চৌধুরী লোকটা। খুব হিসাব করে পা ফেলবি। সামান্য এতটুকু ভুল হয়েছে কি, আর রক্ষা নেই—সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু-ছোবল দেবে সে।