।। ষোলো।। মিস থাম্পির জীবনকথা
পুপুর জ্বর ছেড়ে গেছে—খবরটা ডাক্তার রুদ্র আগেই ফোনে পেয়েছেন। তবু এদিন সন্ধ্যায় এলেন। এসে রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?
রীণা ম্লান হেসে বলল, ভালো। কী খাবেন বলুন, চা না কফি?
—কফিই করো।
রীণা রান্নাঘরে ঢুকল।
ঘরে ছিলেন বন্দনার মা। রীণা অসুস্থ হবার পর থেকে উনি প্রায়ই আসেন। তিনিও উঠে রীণার সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। রীণা এখন বেশ সুস্থ। তবু তার চোখের চাউনিতে একটা উদভ্রান্ত ভাব। ডাঃ রুদ্রের তা লক্ষ এড়ায়নি।
বন্দনার মা রীণাকে বললেন, আপনি গল্প করুন, আমি কফি করছি।
কলকাতায় মান্তু ছাড়া রীণা এই একজন মানুষকে কাছে পেয়েছে। বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের স্ত্রীরা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির। কারো পরের সংসারের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল, কেউ—বা ঈর্ষাকাতর। বন্দনার মা—ই ব্যতিক্রম। অল্প কথা বলেন, রীণার ওপর তাঁর যেন সত্যিকারের স্নেহ, রীণাও যেন একজন দিদি পেয়েছে।
কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমরা তো মিস থাম্পিকে দেখলে। আমার দুর্ভাগ্য তাঁকে দেখতে পেলাম না। খবর পেলে নিশ্চয়ই আসতাম। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।
সঞ্জয় অপরাধীর মতো বলল, আপনি যে ওঁর সম্বন্ধে এত ইন্টারেসটেড কী করে জানব বলুন। জানলে নিশ্চয়ই খবর দিতাম।
—আবার যদি কখনো আসেন তাহলে খবর দিতে ভুলো না। ইংরিজি একটা ম্যাগাজিনে ওঁর লাইফহিস্ট্রি পড়ে অবাক হয়েছিলাম। ওঁর মতো স্পিরিচুয়ালিস্ট এখন সারা ভারতে নেই। অথচ মজার কথা প্রথম জীবনে উনি ছিলেন নামকরা সম্মোহনবিদ। ওঁর জীবনটাই ইন্টারেস্টিং। সম্মোহনবিদ থাকার সময়ে তরুণী বয়েসে তিনি একবার তাঁর সেই শক্তির অপব্যবহার করেছিলেন। অবশ্যই তার একটা কারণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওঁর অনুশোচনা হয়। অনুশোচনা থেকেই আসে পরিবর্তন। তিনি হিপনোটিজম ছেড়ে দেন। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায় স্পিরিচুয়ালিজমের সাধনা।
ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন । তারপর বললেন, সঞ্জয় তুমি তো জানো মেসমেরিজম নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করছি। কাজেই ও সম্বন্ধে আমি যদি কিছু বলি তাহলে নিশ্চয়ই অনধিকারচর্চা হবে না।
বলে তিনি একটু হাসলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, হিপনোটিজম আর মেসমেরিজম কি এক?
বন্দনার মা চলে যাচ্ছিলেন, রীণা তাঁর হাত ধরে বলল, বসুন না।
বন্দনার মা বসলেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, হ্যাঁ, একই। বাংলায় এর নাম সম্মোহন।
সঞ্জয় বলল, তা হলে ম্যাজিশিয়ানরা যে হিপনোটিজমের খেলা দেখায় সেও কি এই সম্মোহন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, কতকটা। তবে প্রকৃত সম্মোহনবিদরা কিন্তু একটু তাকিয়েই অপরকে সম্মোহিত করতে পারেন। এমন কি গল্প করতে করতেও এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। এমনও দেখা গেছে, একজন পাকা সম্মোহনবিদ অনেক দূরের কোনো মানুষকে সম্মোহিত করেছেন। আমাদের দেশের কাপালিক বা ডাইনিরা কতকটা এই জাতীয় একটি বিদ্যায় পটু ছিলেন। তাকে বলে বশীকরণ। মানুষ বশ করতে ওস্তাদ ছিলেন তাঁরা। তবে তার জন্যে যে সাধনার প্রয়োজন তা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হত না। অল্পস্বল্প যেটুকু শক্তি তাঁরা অর্জন করতেন তার বেশির ভাগটাই প্রয়োগ করতেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখন তাঁদের কথা থাক। আমার বক্তব্য মেসমেরিজম।
ফ্রেডারিক অ্যান্টনি মেসমার এই সম্মোহিনী শক্তির আবিষ্কারক। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের লোক। এক বার জাহাজডুবি হয়ে এই জার্মান ভদ্রলোক ভাঙা মাস্তুল আঁকড়ে ভাসতে ভাসতে অজানা জঙ্গলভরা এক তীরে এসে ঠেকলেন। রাতে আশ্রয় নিলেন একটা গাছে। সকাল হলে দেখেন গাছের নীচে এক বিরাট অজগর মড়ার মতো পড়ে আছে। বুদ্ধিমান মেসমার তখনি গাছ থেকে নামলেন না। তিনি লক্ষ করতে লাগলেন। একসময়ে দেখলেন সাপটা পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর আকাশ থেকে উড়ন্ত পাখি এসে পড়ছে তার মুখে। মেসমার অবাক হলেন—এ কী করে সম্ভব? সাপের চোখের চাউনিতে এমন কোন শক্তি আছে যাতে আকাশের পাখি ছুটে এসে পড়ছে তার মুখে?
এই ভাবনা থেকে শুরু হল সাধনা। সেই সাধনার ফলশ্রুতি সম্মোহন—বিদ্যা। তাই এই সম্মোহন—বিদ্যার একটা নাম মেসমেরিজম। কিন্তু এ তো অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যাপার। তার ঢের আগে তিব্বত, চিন, ভারতে এই মহাবিদ্যার চর্চা শুরু হয়েছিল। পশ্চিমী দেশগুলি এই বিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসার কাজে লাগিয়েছিল। প্রাচ্যের দেশগুলি তা পারেনি।
এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন, মিস থাম্পি প্রথম জীবনে এই সম্মোহনবিদ্যার চর্চা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন তাঁকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল এক জাদুকরী। জাদুকরীটি ঝাড়ফুঁক করত, সম্মোহনশক্তিও ছিল অসাধারণ। তার বোধহয় ইচ্ছা ছিল থাম্পিকে সে উত্তরাধিকারিণী করে যাবে। তাই সেই বালিকা বয়স থেকেই তাকে সম্মোহনবিদ্যায় তালিম দিতে থাকে। বেশ কিছুকাল পরে পুলিশ যখন জাদুকরীর হাত থেকে থাম্পিকে উদ্ধার করে তখন সে একজন পাকা সম্মোহনবিদ।
বাড়ি ফিরে আসার পর মিস থাম্পি পড়াশোনা শুরু করেন পুরোদমে। তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি পরিচিতি ছিল ধনীকন্যা বলে। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো মিস থাম্পির মনটাও ছিল সংসারী। তিনিও চাইতেন একজন দায়িত্বশীল মমতাময় স্বামী। মিস থাম্পি ভালো করেই জানতেন যে তিনি সুশ্রী নন। তবু তিনি মনে মনে অপেক্ষা করতেন এমন কারও জন্যে যিনি শুধু তাঁর বাইরের চেহারাটাই দেখবেন না, যাঁর উদার হৃদয়ে তাঁর জন্যে ভালোবাসার আসন পাতা থাকবে। কিন্তু বহুদিন অপেক্ষা করেও এমন কাউকেই পেলেন না যিনি স্বেচ্ছায় ভালোবেসে তাঁকে ঘরে নিয়ে যাবেন। ধনী পিতার কন্যা হিসেবে বিবাহের সম্বন্ধ তাঁর অনেক এসেছিল। কিন্তু সে সবই তিনি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পাত্রপক্ষের লক্ষ্য যে তাঁর বাপের টাকা তা তিনি বুঝতেন।
এমনি সময়ে মিস থাম্পি এক অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসেন। দর্শনের অধ্যাপক। সুদর্শন, ধীর, স্থির, জ্ঞানদীপ্ত মানুষটি। এই প্রথম মিস থাম্পি দুর্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু অপর পক্ষে তেমন চাঞ্চল্য নেই, অথচ তিনি যে একটু বিশেষ চোখে তাঁকে দেখেন, তাঁকে একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়াতে চান থাম্পি তা বেশ বুঝতে পারেন।
থাম্পি যখন বুঝলেন—এই সুপুরুষটির সব গুণই আছে—নেই শুধু এগিয়ে আসার সাহস, তখন তিনি নিজেই অধ্যাপকের কাছে বিয়ের ইচ্ছা জানালেন।
অধ্যাপক সস্নেহে তাঁর মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি আমার ছাত্রী। আমাদের সম্পর্ক সেইরকম হওয়াই উচিত। তা ছাড়া আমার বিয়ে অন্যত্র স্থির হয়ে আছে।
এ কথায় থাম্পির দু—চোখ জ্বলে উঠল। তিনি অধ্যাপকের কথা বিশ্বাস করলেন না। যদি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিকই হয়ে থাকত, তা হলে তাঁর হাবভাব অন্যরকম হত। সেরকম তো কিছু লক্ষে পড়েনি।
মিস থাম্পি ক্ষুব্ধ অভিমানে বললেন, মিথ্যে কথা বলে আমায় ভোলাচ্ছেন কেন? বললেই তো পারেন আমাকে আপনার পছন্দ নয়।
অধ্যাপক লজ্জিত হয়ে বললেন, বিশ্বাস কর অন্য একজনের সঙ্গে আমি engaged.
মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একথা আগে আমাকে বলেননি কেন? একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা?
অধ্যাপক বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, শান্ত হয়ে ভাবার চেষ্টা করো। আমার দিক থেকে তোমার সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি বা এমন কোনো কথা বলিনি যাতে তোমাকে ঠকানো হয়।
কিন্তু মিস থাম্পির ধৈর্য ধরে ভাবার অবস্থা ছিল না। তাঁর শুধু একটা কথাই মনে হল অধ্যাপক তাঁকে পছন্দ করেননি। যদি পছন্দ করতেন তা হলে অন্য মেয়েকে ছেড়ে তাঁর কাছেই আসতেন। এনগেজড তো কি হয়েছে? তাকে তো আর তিনি বিয়ে করেননি। পুরুষের জীবনে অমন কত মেয়ে রঙিন স্বপ্নচোখ নিয়ে আসে তার পর একদিন সে স্বপ্ন ছুটে যায়।
এরপর মিস থাম্পি আর অধ্যাপকের সামনে আসেননি। দূরে দূরে রইলেন। কিন্তু চুপ করে বসে রইলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন অধ্যাপককে জব্দ করবার।
একদিন অধ্যাপক ক্লাস নিতে ঢুকছেন। হঠাৎ তাঁর মাথাটা কীরকম টলে উঠল। চোখে যেন ধোঁয়া ধোঁয়া দেখলেন। তবু ক্লাস করতে গেলেন। কিন্তু লেকচার দিতে গিয়ে সব ঘুলিয়ে ফেললেন। ছাত্ররা তো অবাক। তারা বলল, স্যার, আপনার বোধহয় শরীর খারাপ। চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
বাড়ি এসেই অধ্যাপক শুয়ে পড়লেন। ঘুমে দু—চোখ জড়িয়ে এল।
এরপর থেকে রোজই তাঁর লেকচার এলোমেলো হতে লাগল। ছাত্ররা বিরক্ত হয়ে প্রিন্সিপ্যালকে জানাল। প্রিন্সিপ্যাল শেষ পর্যন্ত একদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁর লেকচার শুনলেন। বুঝলেন অধ্যাপক ঠিক সুস্থ মস্তিষ্কে নেই। তিনি তখন তাঁকে ছুটি নিতে বাধ্য করালেন।
এরই মধ্যে একদিন রাত্তিরে হঠাৎ অধ্যাপক মিস থাম্পির বাড়ি গিয়ে হাজির।
মিস থাম্পি কিছুমাত্র অবাক না হয়ে শ্লেষের সুরে বললেন, হঠাৎ কী মনে করে আমার কাছে?
অধ্যাপক ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলেন, তুমি যে আমায় ডাকলে।
—আমি ডাকলাম? মিস থাম্পি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, যদি ডেকেই থাকি তাহলেও কি আমার মতো নগণ্য একটা মেয়ের বাড়িতে এই রাত্তিরে আপনার মতো একজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের আসা উচিত?
অধ্যাপক এর উত্তর দিতে পারেননি। তাঁর দু—চোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল।
এমনিভাবেই মিস থাম্পি এক নিরীহ অধ্যাপককে সম্মোহিত করে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠলেন। প্রায় প্রতিদিন গভীর রাত্রে অধ্যাপককে ডেকে নিয়ে আসেন। এক বিকৃত ভোগের খেলায় মেতে থাকেন তিনি। তাঁকে খুশি করেই অধ্যাপক ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙলে তাঁর আর কিছুই মনে থাকে না। তিনি শুধু অবাক হয়ে যান। মিস থাম্পির বিছানায় শুয়ে আছেন দেখে তিনি ভীষণ লজ্জা পান। ‘ছিঃ ছিঃ এ কী করে সম্ভব’ বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে যান।
মিস থাম্পি এতে এক ধরনের আনন্দ পান বটে কিন্তু ঠিক সুখ পান না। এ যেন জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পুরুষসঙ্গ আদায় করা। তা তো তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ভালোবাসা।
তবু তিনি অধ্যাপককে ছাড়তে পারেননি। বেঘোর অবস্থাতেও যদি মানুষটা দুটো ভালোবাসার কথা বলেন, যদি কাছে টানেন তাহলে সেইটুকুই লাভ। রক্তমাংসের ওই দেহটা যে কিছুক্ষণের জন্যেও তাঁরই—অন্য কারও নয়—এইটুকু মনে করেই তাঁর আনন্দ।
একদিন মিস থাম্পি একটা ফন্দি আঁটলেন। অন্য দিনের মতোই অলক্ষে থেকে হিপনোটাইজ করে অধ্যাপককে ডেকে আনলেন। সম্মোহিত অধ্যাপক যখন মিস থাম্পির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে প্রেমের কথা বলে যাচ্ছিলেন তখন থাম্পি অধ্যাপকের হাতে একটা কাগজ আর কলম গুঁজে দিয়ে বললেন, আপনি যেসব কথা বলছেন, তা এই কাগজে লিখুন।
সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক লিখলেন—‘I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage.’
লেখাটুকু পড়ে মিস থাম্পির বৃথাই রোমাঞ্চ হল। তবু বললেন, নীচে সই করুন।
অধ্যাপক সই করলেন।
—তারিখ দিন।
অধ্যাপক তারিখ বসালেন।
মিস থাম্পি কাগজটি যত্ন করে রেখে দিলেন।
মাস ছয় পর।
মিস থাম্পি লক্ষ করলেন দিন দিন অধ্যাপকের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে।
তা তো পড়বেই। অমন সম্মানের চাকরিটা গেল। বেকার জীবন। লোকে তাঁকে দেখলে হাসাহাসি করে। বলে—পাগলা প্রফেসার।
এ যন্ত্রণা কে আর কতদিন সহ্য করতে পারে?
এদিকে যে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা—মিস থাম্পি খবর নিয়ে জানলেন সেই মেয়েটির বাড়ির লোকরাও পাগলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নন। মেয়েটি কান্নাকাটি করছে।
অধ্যাপকের শরীর আর মনের অবস্থা দেখে মিস থাম্পি চিন্তায় পড়লেন। সম্মোহনের সাহায্যে তাঁকে আবার চাঙ্গা করা যায়। কিন্তু সে তো সাময়িক। তা ছাড়া একজনের ওপর বার বার সম্মোহন প্রয়োগ করলে বিশেষ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।
তখন একদিন তিনি প্রফেসারকে ডেকে বললেন, আপনি কীরকম লোক যে একটা কলেজ থেকে চাকরি গেছে বলে অন্য কোথাও চেষ্টা করছেন না?
অধ্যাপক ম্লান হেসে বললেন, সবাই যে বলে আমি অসুস্থ। অসুস্থ লোককে কেউ চাকরি দেয়?
মিস থাম্পি বললেন, না, আপনি অসুস্থ নন। আমি বলছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। লোকে শত্রুতা করে আপনার বিরুদ্ধে লেগেছিল।
অধ্যাপক বললেন, চাকরি করেই—বা কি হবে? আমার জীবনে আর কোনো আনন্দ নেই। আমার সব আশা শেষ হয়ে গেছে।
মিস থাম্পি বললেন, না, কিছুই শেষ হয়নি। আমি বলছি সব ঠিক আছে।
এই বলে শহরের বাইরে একটা কলেজের ঠিকানা দিলেন।—এখানে একজন ফিলজফির প্রফেসার দরকার। আপনি অ্যাপ্লাই করুন।
মিস থাম্পির প্রেরণায় অধ্যাপক দরখাস্ত করলেন। তারপর দু—মাসের মধ্যে সেই কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পাণ্ডিত্যে আর অধ্যাপনার গুণে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপক তাঁর সুনাম আর সম্মান ফিরে পেলেন। অধ্যাপক সুস্থ হয়ে উঠলেন।
মিস থাম্পি সব খবরই রাখেন। যেদিন শুনলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় অধ্যাপককে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে সেদিন তিনি গোপনে একটু হাসলেন। কিন্তু তিনি আর কোনো দিন প্রফেসারকে সম্মোহন করে ডাকেননি।
না ডাকলেও একদিন অধ্যাপক নিজেই হাসিমুখে মিস থাম্পির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এলেন প্রায় এক বছর পর। তবে একা এলেন না। সঙ্গে সুন্দরী একটি মেয়ে। অধ্যাপক আলাপ করিয়ে দিলেন—এরই নাম এলিশ। এর সঙ্গেই আমি engaged ছিলাম। সামনের মাসে আমার বিয়ে।
মিস থাম্পি এলিশকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। ওরা চলে যাবার সময়ে মিস থাম্পি প্রফেসারকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার বোধহয় আর দেখা হবে না।
প্রফেসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
—আমি সব ছেড়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
—কোথায়?
—তা এখনো ঠিক করিনি।
—তুমি যেখানেই থাকো আমায় চিঠি দিও।
মিস থাম্পি তার কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু একটু হেসেছিলেন।
তারপর সুযোগমতো প্রফেসারকে আলাদা করে ডেকে তাঁর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, এটা পড়ে দয়া করে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। দেখবেন যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে।
চিঠিতে মিস থাম্পি সব কথাই খুলে লিখেছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছিলেন তাঁর অপরাধের কথা। শেষ দুটি ছত্র এইরকম—কোনো প্রত্যাখ্যাতা মেয়ের মর্মযন্ত্রণা উপলব্ধি করার ক্ষমতা যদি আপনার থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনি ক্ষমা করবেন।
এই চিঠির সঙ্গেই ছিল আলাদা আর একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা ছিল—.‘I love you dearly and want to have you as my life-partner by mariage.’…
ডাক্তার রুদ্র থামলেন। ঘড়িতে তখন নটা বেজে পনেরো মিনিট। ডাঃ রুদ্র উঠে পড়লেন।
—তারপর থেকে মিস থাম্পি আর সম্মোহন করার চেষ্টা করেননি। ওই লাইনটা ছেড়েই দিলেন। তিনি ঘুরতে লাগলেন দেশ—বিদেশ—পাহাড়—জঙ্গল—মঠ—মন্দির—গির্জা। যেখানেই প্রাচীন পুথি পান সেখানেই ছোটেন। বিশেষ কোনো মানুষকে চেয়েছিলেন বড্ড আপন করে। তা তিনি পাননি। তাই শেষ পর্যন্ত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন অলৌকিক রহস্য—জীবন—মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কোনো কিছু অদৃশ্য অস্তিত্বের সন্ধান।
.
ডাক্তার রুদ্রকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল সঞ্জয়। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে গিয়েছে তখন হঠাৎই রীণা ব্যস্ত হয়ে সঞ্জয়কে ডাকল, শুনে যাও।
ডাঃ রুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় ঘরে এসে ঢুকল।
—পুপুর চোখ দুটো দ্যাখো কিরকম বসে গেছে না?
সঞ্জয় টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখল। হ্যাঁ, চোখের নীচে কালি। চোখ দুটো হঠাৎ যেন বসে গেছে।
—কী হল? বলে ডাঃ রুদ্রও এসে দাঁড়ালেন। তিনিও দেখলেন। অনেকক্ষণ ধরেই দেখলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হল কেন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, ও কিছু নয়।
গাড়িতে ওঠার সময় ডাঃ রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি পেটের অসুখ কিংবা বমি হয়েছিল?
সঞ্জয় বলল, বিকেলেও এরকম দেখিনি।
আচ্ছা, লক্ষ রেখো। আমায় জানিও। ডাক্তার রুদ্রের গাড়ি কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সঞ্জয় ওপরে উঠতে লাগল। তাকে কেমন চিন্তাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ চোখ বসে যাওয়াটা কেমন যেন অস্বাভাবিক।