দুঃখের হোমানল
এই ঘরটি অন্য দুটি ঘরের চাইতে আকারে একটু বড়ই বলে মনে হয়। এবং অন্য দুটি ঘরের চাইতে এই ঘরের যেন একটু বিশেষ রকম সাজানোগোছানো ও ফিটফাট।
মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো আগাগোড়া, চারটি দেওয়ালই ঢাকা পড়ে গেছে আলমারীতে। প্রত্যেকটি আলমারীতে একেবারে ঠাসা বই।
মধ্যখানে ছোট একটি গোলটেবিল, তার চতুস্পর্শে সোফা, কাউচ ও চেয়ার পাতা।
ওরা দুজনেই ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখছিল, হঠাৎ কার গলা শোনা গেল, অত্যন্ত স্পষ্ট,
যেন কে ঠিক ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছে—অথচ তাকে ওরা দেখতে পাচ্ছে না। আশ্চর্য!
তুমি ভাব আমি কিছু বুঝি না বৌদি! তোমাদের ধারণা আমি একেবারে পাগল হয়ে গেছি! পাগল আমি হইনি, হয়েছ তোমার। হয়েছিল দাদা।
ওরা দুজনেই চমকে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
ব্যাপারটা দুজনের কেউই যেন ভাল করে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। পরিষ্কার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, অথচ কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা ওরা, এ আবার কিহেঁয়ালি! রহস্যের খাসমহলই বটে এই রায়পুরের রাজপ্রাসাদ।
একটু শুনেই তারা বুঝতে পারে সস্পষ্ট এ নিশনাথেরই গলা। মনে হচ্ছে বুঝি দেওয়াল ফুটো হয়ে কথাগুলো ওদের কানে আসছে।
তার তো যাওয়ার সময় হয়নি, নিশানাথের গলা আবার শোনা গেল, কিন্তু তবু তাকে যেতে হল। প্রয়োজনের তাগিদে। তবু তোমাদের কারও খেয়াল হয়নি। কিন্তু আমি জানতাম এ আগুন এত সহজে নিভবে না। আগুন খাণ্ডবদাহনের মত একে একে সব গ্রাস করবে।
ঠাকুরপো! একটু শান্ত হও। একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর। মেয়েলী মৃদু শোনা গেল।
ঘুমোব! ঘুম আমার আসে না বৌদি। ঘুমোলেই যত দুঃস্বপ্ন আমার দুচোখের পাতার ওপরে এসে যেন তাণ্ডব নৃত্য জুড়ে দেয়। সংসারে অর্থই যত অনর্থের মূল। এর চাইতে বড় শত্রু বুঝি মানুষের আর নেই। তাই তো এই অর্থের বিষাক্ত হাওয়া থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। ভাবছ হয়ত পাগল মানুষ, পাগলামির ঝোঁকেই এসব কথা বলছে, কিন্তু তাই যদি হয় তো পাগল সবাই, কে পাগল নয়! তুমি পাগল, আমি পাগল, বিনু পাগল, সবাই পাগল। আর পাগল না হলে কেউ অন্য একজনকে পাগল সাজিয়ে এমনি করে বন্দী করে রাখতে পারে?
সুব্রত পাথরের মতই যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে। আশ্চর্য! কোথা থেকে আসছে এই কথাবাতার আওয়াজ? পাশের ঘর নয়, সামনে বা পিছনে ঘর নেই, উপরে ও নিচে ঘর আছে কেবল।
তবে কি এই ঘরের উপরে বা নীচে এমন কোন ঘর আছে যেখান থেকে ঐ কথাবাতার আওয়াজ আসছে! কিন্তু তাই যদি হয়, এত স্পষ্ট শোনা যায় কি করে? এ কি রহস্য! এ কি বিস্ময়! চকিতে সুব্রতর মনের মধ্যে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।
রহস্যে-ঘেরা এ রাজবাড়ির এও হয়ত একটি রহস্য।
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের চতুর্দিকে চোখ বোলাতে থাকে।
কি দেখছেন চারিদিকে অমন করে চেয়ে মিঃ রায়? বিকাশ মৃদু কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
সুব্রত মৃদু হেসে জবাব দেয়, দেখছি রায়পুরের রাজবাড়ির ঐ রহস্যময় দেওয়ালগুলো, ওরাও কথা বলে কিনা। তাছাড়া ছদ্মবেশের অনেক লেঠা, এবং হাতে সময়ও অল্প। তদন্তের। ব্যাপারে এমনি তাড়াহুড়ো চলে না।
এবারে চলুন, ও ঘরে যাওয়া যাক। রাজাবাহাদুর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
হ্যাঁ চলুন।
ও ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ওরা রাজাবাহাদুরের বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করতেই রাজাবাহাদুর প্রশ্ন করলেন, দেখা হল দারোগাবাবু?
হ্যাঁ।
কিছু বুঝতে পারলেন?
না। রাত্রি প্রায় এগারোটা বাজে। আজকের মত আমি বিদায় নেব রাজাবাহাদুর। কাল পারি তো সকালের দিকে একবার আসব।
বেশ তো। একবার কেন, যতবার খুশি আসুন না। সব সময়ই আমার ঘরের দরজা আপনার জন্য খোলা থাকবে। কোন সংকোচই করবেন না। তারপর সহসা সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, কল্যাণবাবু, আপনি যাবেন না। একটু অপেক্ষা করুন, আপনার সঙ্গে আমার গোটাকতক জরুরী কথা আছে।
কল্যাণবাবু, তাহলে আপনি পরেই আসবেন, আমি আসি। নমস্কার।
বিকাশ নমস্কার জানিয়ে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ডাঃ সোম আগেই বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
বসুন কল্যাণবাবু। রাজাবাহাদুর অদূরে একটা চেয়ার নির্দেশ করলেন সুব্রতকে। একটু চুপ করে থেকে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক বললেন, সংসারে আপনার কে কে আছেন মিঃ রায়?
সুব্রত মৃদু হেসে বললে, সেদিক দিয়ে আমি একেবারে ঝাড়া-হাত-পা। একমেবাদ্বিতীয়। আপনার কয়েকদিনের কাজে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি কল্যাণবাবু। আপনি শুধু কর্মঠ ও পরিশ্রমীই নন-বুদ্ধিমানও, পরীক্ষায় আপনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। আপনাকে আমি এখন পরিপূর্ণ বিশ্বাস করি। তাই বলছি, আপনারা হয়ত জানেন না, এ সব কিছুর মূলে আছে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র এবং আমার বিরুদ্ধেই সে ষড়যন্ত্র চলেছে। দেখলেন তো আজ আমার জীবনের ওপরে attempt পর্যন্ত হয়ে গেল! একটু থেমে আবার বললেন, অবিশ্যি এতটা আমি ভাবি নি। কিন্তু এবারে আমায় সাবধান হতে হবে। আততায়ীর জিঘাংসা কখন যে এর পর কোন্ পথ ধরে নেমে আসবে তাও বুঝতে পারছি না। তবে যদি বলেন প্রস্তুত থাকবার কথা, তা আমি থাকব। আমার হয়েছে কি জানেন, শাঁখের করাত, আগে পিছে দুদিকেই কাটে। অর্থের মত এত বড় অভিশাপ বুঝি আর নেই। রাজাবাহাদুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।
সুব্রত বিস্মিত খুব কম হয়নি। ঠিক এতখানি সে মুহূর্ত-আগেও চিন্তা করতে পারত কিনা সন্দেহ। উচ্ছ্বাসের মুখে কাউকে বাধা দেওয়া উচিত নয় সুব্রত তা জানে, তাই কোন কথা না বলে চুপ করেই রইল।
রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক আবার বলতে লাগলেন, জানি না আপনি আমাদের রাজবাড়ির সেই ভয়াবহ হত্যা-মামলার সম্পর্কে জানেন কিনা। আমার ছোট ভাই সুহাসের হত্যার ব্যাপার খবরের কাগজে হয়ত পড়ে থাকবেন, তবু সব আসল ব্যাপার জানেন না। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বর অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে।
এত বড় লজ্জা! এত বড় অপমান! এ কলঙ্ক এ জীবনেও বুঝি যাবে না। বুঝতে পারেন কি, ভাইয়ের হত্যাব্যাপারের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ভাই! উকিলের সওয়ালের জবাব দিচ্ছি। অনুমান করতে পারেন কি, দিনের পর দিন সে কি দুঃসহ মর্মপীড়া! পৃথিবীর সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার বিমাতা পর্যন্ত ঘৃণায় আমার কাছ হতে দূরে সরে গেছেন। উত্তেজনায় রাজাবাহাদুর উঠে দাঁড়ালেন, আমি ভুলতে পারি না—আমি ভুলতে পারি না সেসব কথা। এই বুকের মাঝে দাগ কেটে বসে আছে।
কিন্তু সে যে মিথ্যা—সেও তো প্রমাণিত হয়ে গেছে রাজাবাহাদুর। শান্ত কণ্ঠে সুব্রত বলে।
রাজাবাহাদুর জবাবে মৃদু হাসলেন, প্রমাণ! হ্যাঁ, তা হয়েছে বইকি। কিন্তু বাইরের অপরিচিত আর দশজন লোকের কাছে তার মূল্য কতটুকু! আমার নিদোষিতাটা আইনের চোখে প্রমাণিত হয়নি আজও। আদালত বলেছে প্লেগের বীজ প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আমিও একজন নাকি ছিলাম। ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জা, কি ঘৃণা! সব চাইতে মজার ব্যাপার কি জানেন কল্যাণবাবু? এ সম্পত্তির ওপরে আমার এতটুকুও লোভ নেই, এর সর্বপ্রকার দাবিদাওয়া আমি হাসিমুখে ত্যাগ করতে রাজি আছি—এখনই, এই মুহূর্তে।
যে জিনিস চুকেবুকে গেছে, তাকে মনে করে কেন আবার দুঃখ পান! সুব্রতর কণ্ঠে অপূর্ব একটা সহানুভূতির সুর জেগে ওঠে।
কল্যাণবাবু, আপনাকে আমি একটা কথা বলব—
বলুন?
আমি কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম চাই। আমার অবর্তমানে একমাত্র লাহিড়ীর প্রতি আমি বিশ্বাস রাখতে পারতাম। তার আকস্মিক মৃত্যু আমার পক্ষে যে কতবড় চরম আঘাত, তা কেউ জানে না, বুঝবেও না। তার হত্যার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার যাবতীয় মনের বল একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। আজ তার অবর্তমানে আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়েই বুঝেছি আপনাকে সত্যিই বিশ্বাস করা যায়। আর একটা কথা, আজ আমি বেশ বুঝতে পারছি, ঘরে বাইরে সর্বত্রই আমার শত্রু। ফলে আর কাউকেই যেন এখানে আজ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
বেশ তো, আপনি না হয় কিছুদিন গিয়ে কলকাতা থেকে ঘুরে আসুন। এদিককার যা দেখাশোনার প্রয়োজন আমিই করব। কিছু ভাববেন না। তা কবে আপনি যেতে চান?
ভাবছি পাঁচ-সাতদিনের মধ্যেই যাব।
বেশ। তাহলে আমি নৃসিংহগ্রামটা একবার ঘুরে আসি, আমি এলেই আপনি যাবেন। রাত্রি অনেক হল, অসুস্থ শরীর আপনার—এবারে বিশ্রাম নিন।
রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুব্রত সেরাত্রের মত উঠে দাঁড়াল।
***
রাত্রি বোধ করি সাড়ে এগারোটা কি পৌনে বারোটা হবে।
সুব্রত অন্যমনস্ক ভাবে রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিল। একান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক সহসা যেন নিজেকে উদঘাটিত করে দিয়েছেন।
আজকে যা ঘটল তাতে করে সুব্রতর অন্তত একটা কথা মনে হচ্ছিল, আততায়ী যেই হোক না কেন, রাজবাড়ির মধ্যে গতিবিধি তার আছে এবং রাজবাড়ির সমস্ত গলিখুঁজি তার চেনা। যার ফলে সে খুব সহজেই রাজাবাহাদুরকে আহত করে পালিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু পালাল সে কোন্ পথে? ছাদ দিয়ে তো পালাবার কোন পথ নেই, আর তাতেই মনে হয়। গেছে সে রাজাবাহাদুরের শয়নকক্ষের ভিতর দিয়েই। প্রবেশও হয়ত ঐ পথ দিয়েই করেছিল সবার অলক্ষ্যে অতি গোপনে কোনো এক সময়ে। তারপর নিশানাথ! তাকে কি সত্যিই বন্দী করে রাখা হয়েছে?না নিশানাথের বিকৃত-মস্তিষ্কের উন্মাদ কল্পনা মাত্র? কিন্তু নিশানাথের স্বগত উক্তিগুলি! সামঞ্জস্যহীন বিকৃত উক্তি বলে তো একেবারে মনে হয় না। কথাগুলো যতই এলোমেলো হোক না কেন, মনে হয় না একেবারে অর্থহীন!
বাড়ির বারান্দার সামনে এসে সুব্রত চমকে ওঠে, অন্ধকার বারান্দার ওপরে ইজিচেয়ারে কে যেন অস্পষ্ট ছায়ার মত শুয়ে, তার মুখে প্রজ্বলিত সিগারের লাল অগ্রভাগটি যেন কোনো জন্তুর চোখের মত জ্বলছে অন্ধকারের বুকে।
সুব্রত আশ্চর্য হয়ে যায়। কে? তার বারান্দায় ইজিচেয়ারটার ওপর শুয়ে? এগিয়ে এসে সুব্রত বলতে যাচ্ছিল, কে!
কিন্তু তার আগেই প্রশ্ন, কেকল্যাণ নাকি?
কে, কিরীটী! সুব্রত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কখন এলি?
দিনতিনেক আগে, কিরীটী জবাব দেয়।
তিনদিন হল এসেছিস, তবে এ কদিন কোথায় ছিলি?
হারাধনের ওখানে আত্মগোপন করে।
সুব্রত পাশের একটা মোড়ার ওপরে উপবেশন করল, হঠাৎ যে!
হ্যাঁ, চলে এলাম। কারণ বুঝতে পারছি, আর খুব বেশী দেরি নেই, একটা কিছু আবার ঘটতে চলেছে।
আমরও তাই মনে হয়, তাছাড়া আজ ব্যাপার অনেক দূর এগিয়েছে। সুব্রত সংক্ষেপে আজ সন্ধ্যায় রাজাবাহাদুর-ঘটিত সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলে গেল।
কিরীটীকে সব শোনার পরও এতটুকুও বিচলিত মনে হল না। ওর ভাব দেখে সুব্রতর মনে হল,সব কিছু শুনে যেন ও এতটুকুও আশ্চর্য হয়নি। আলস্যে একটা আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে কিরীটী বলে, থাক ওসব কথা এখন সুব্রত, রাত অনেক হল—তোর শ্রীমান থাকোহরিকে দুজনের মত রান্নার জন্যে বলে দিয়েছিলাম, খোঁজ নে তো রান্না হল কিনা! বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে।
সুব্রত উঠে গেল খোঁজ নেওয়ার জন্য। থাকোহরি জানালে, রান্না তৈরী বাবু।
তবে আর দেরি করিস নে, আমাদের খেতে দে, সুব্রত বললে।
আহারাদির পর ক্যাম্পখাটটার ওপর শয্যা বিছিয়ে কিরীটী টান টান হয়ে শুয়ে একটা টী
তোর ব্যাপারটা কি মনে হয় কিরীটী? এতক্ষণে সুব্রত প্রশ্ন করল।
কোন ব্যাপারটা?
কেন, আজকের রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা!
জিওমেট্রির অ্যাকসগুলোও তুই ভুলে গেছিস—things which are equal to the same thing, are equal to one another!
মানে?
মানে সেই শুরু হতে আজকের ঘটনাটি পর্যন্ত, যদি মনে মনে বিচার করবার চেষ্টা করিস তো মানে দেখবি সব একসূত্রে গাঁথা। রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস,যাদের বা যার পরিকল্পনা মাফিক নিহত হয়েছে, সতীনাথ লাহিড়ীও তাদের প্ল্যান অনুযায়ী মৃত্যুবাণ খেয়েছে, কিন্তু তোদের রাজাবাহাদুরের ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম। কিন্তু একটা জিনিস আমার মনে খটকা লাগছে, হ্যাঁ রে, হঠাৎ কিরীটী কথার মোড় ফিরিয়ে অন্য বিষয়ে চলে এল, বললে, রাজাবাহাদুরের শোবার ঘর ও নিশানাথ যে ঘরে থাকে, সে দুটো ঘরই কি একই তলায়? বাড়িটা তো সবসমেত তিনতলা লিখেছিলি! দোতলায় রাজাবাহাদুর থাকেন—নিশানাথও কি ঐ দোতলারই কোনো ঘরে থাকেন, না তিনতলায় থাকেন?
তা তো ঠিক জানি না, তবে যতদূর অনুমানে মনে হয় নিশানাথের ঘর দোতলায় বা তিনতলায় নয়, দোতলা ও তিনতলার মাঝামাঝি কোথাও।
কিরীটী সুব্রতের কথায় হেসে ফেললে, মাঝামাঝি মানে? শূন্যে ঝুলছে নাকি?
তাই বলেই তো মনে হয়। বলে সুব্রত নিশানাথের কথাগুলো সুবিনয় মল্লিকের লাইব্রেরী ঘরে দাঁড়িয়েও কেমন স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছিল তা বললে। সুব্রতর শেষের কথাগুলো শুনে কিরীটী যেন হঠাৎ উঠে বসে চেয়ারটার ওপরে, বলে, তাই নাকি? কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল? তাহলে তো আর মনে কোনো খটকাই নেই, রাজাবাহাদুরের আহত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এ দেখছি এখন তাহলে বোধহয় খুনীর আসল প্ল্যানটা ঠিক অন্যরকম ছিল। তা হ্যাঁ রে,নৃসিংহগ্রামে যাওয়া ঠিক তো? কিরীটী আবার অন্য কথায় ফিরে এল।
হ্যাঁ, পরশুই যাচ্ছি। আজও সে সম্পর্কে কথা হয়েছে।
হ্যাঁ, এবারে আর দেরি না করে নৃসিংহগ্রামটা চটপট সাতে করে আয়। দুএকটা সূত্র হয়তো সেখানে কুড়িয়ে পেতে পারিস!
তোর কি মনে হয়, নৃসিংহগ্রামের মধ্যে সত্যিই কোনো সূত্র জট পাকিয়ে আছে?
ভুলে যাচ্ছিস কেন, এই বিরাট হত্যাকাণ্ডের বীজ তো ওইখানেই ছিল সর্বপ্রথমে। ভেবে দেখ, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ওইখানেই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হন। তারপর সুধীনের পিতা, তিনিও সেইখানেই নিহত হয়েছেন। দুটি ঘটনা সামান্য কয়েক মাসের ব্যবধানে মাত্র ঘটেছে। আমি এখানে তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছি, তার কারণ আমি ভেবেছিলাম তোর বুঝি চাকরি ফুরলো, কেননা তোর আসল পরিচয় আর গোপন নেই। তুই ধরা পড়ে গেছিস।
সে কি!
কেন, এখনও তোর সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ আছে নাকি? বৎস,তুমি তো ধরা পড়েছই এবং তোমার ওপরে আসল হত্যাকারীর সদাসতর্ক দৃষ্টিও আছে জেনো।
কি করে বুঝলি?
তোমার মতে সকলের অজ্ঞাতে (?) যখন তুমি সতীনাথ-ভবনে সৎকার্যে ব্যস্ত ছিলে, ছাতের ওপরেযে ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল, তিনিই আমাদের এই রহস্যের আসলমেঘনাদ। এবং তার দৃষ্টি সর্বক্ষণই তোর ওপরে আছে। তাছাড়া তুই বোধ হয় জানিস না—তুই যে কারণে সতীনাথ-ভবনে আবির্ভূত হয়েছিলি, ঠিক সেই একই কারণে সেই মহাত্মাও সেখানে গিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, একই সময়ে। তারপর মনে পড়ে, তোর ঘরে কোনো মহাত্মার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং তোর গোপন চিঠিপত্র হাতিয়ে চলে যায় সেদিন সে? ঐ একই ব্যক্তি—সেই দিনই তোর আসল পরিচয় তার কাছে পরিস্ফুট হয়ে গেছে।
কথাগুলো নিঃশব্দে সুব্রত শুনে গেল। তারপর বললে, তাহলে?
চিন্তার কোনো কারণ নেই। মহাপুরুষটি জানে না যে, তার পশ্চাতে একা সুব্রতই নয়, আরও একজন আছে যার চোখের দৃষ্টি এড়ানো তার পক্ষে শুধু কষ্টকরই নয়, দুঃসাধ্য। যে জিনিসটা সে হয়তো পরে তার বিবেচনা ও বুদ্ধির দ্বারা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা কিরীটী রায় তোকে এখানে পাঠাবার আগেই এমনটি হলে কি করতে হবে তা ভেবে রেখেছিল। এবং সেই মত সে কাজও করেছে।
সিগার প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল, কিরীটী আর একটা নতুন সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।