।। পনেরো।। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে
শীতের বিকেল।
কম্পাউন্ডের মধ্যে লাঠি হাতে বার পাঁচেক পাক দিয়ে অমৃতবাবু বেঞ্চিতে এসে বসলেন।
ওপাশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চের উপর পা তুলে বসেছিলেন বিভূতিবাবু। পাশে মহিমাবাবু। গায়ে পুরোনো একটা অলেস্টার। মাথায় মাংকি—ক্যাপ।
অমৃতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, পৌষ—সংক্রান্তিটা কবে?
ওদিকের বেঞ্চিতে শচীনবাবু বিকেলের ম্লান আলোতেও কাগজ পড়বার চেষ্টা করছিলেন। বয়েস এঁদের চেয়ে কিছু কম। রসিকতা করে তিনি বললেন, পৌষ সংক্রান্তিটা পৌষ মাসের শেষ দিন।
—আহা তা তো জানি। ইংরিজির কত তারিখ?
এবার আর শচীনবাবু উত্তর দিতে পারলেন না।
—তা সংক্রান্তির খোঁজ কেন? পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে নাকি? অমৃতবাবুর দিকে মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে মহিমাবাবু হা—হা করে হাসলেন।
—হ্যাঁ, কত দিন যে পিঠে খাইনি!
—তা গিন্নিকে বলবেন। পিঠে ভেজে দেবেন।
—তা হলেই হয়েছে। ওসব পাট বহুকাল চুকে গিয়েছে। বৌমাও পিঠে করতে জানেন না।
—যা বলেছেন। বিভূতিবাবু নড়েচড়ে বসলেন।
—এমন শীতে বেগুন পোড়া কাঁচালংকা দিয়ে খাব তার উপায় নেই। বৌমাকে বললাম, তো উনি বললেন, গ্যাসের উনুনে বেগুন পোড়াব কী করে?
শচীনবাবু বললেন, আমি তো এই জন্যেই গ্যাসের উনুন নিইনি।
বিভূতিবাবু বললেন, বেগুন পোড়ানো যাবে বা বলেই গ্যাস—উনুন নেননি?
—না, ঠিক তা নয়। তবে অন্যতম কারণ বটে।
—তা বাকি কারণগুলি কি? অ্যাকসিডেন্ট?
—নিশ্চয়ই। প্রায়ই তো শুনি গ্যাস লিক করে আগুন ধরে গেছে।
—তা কয়লার উনুনে কি অ্যাকসিডেন্ট হয় না? এখন কি সব শাড়ি উঠেছে—সিন্থেটিক না কী ছাইভস্ম—তা সেই সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলটি একবার উনুনে পড়লেই—
অমৃতবাবু হাসলেন।—ঠিক বলেছেন। একবার আঁচল ধরলেই আর দেখতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে বধূহত্যার দায়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের কোমরে দড়ি। তা পুত্রবধূই হন আর নিজের বৃদ্ধা বধূই হন।
—তা বটে। কোনটে যে অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটে যে আত্মহত্যার প্ররোচনা, কে বিচার করবে? বাড়ির বৌ মরল তো ধর ছেলেকে আর ছেলের বাপকে।
—অ্যাকসিডেন্ট কি শুধু আগুনে পুড়েই হয়? এ বাড়িতেই সেদিন কী কাণ্ডটা হতে যাচ্ছিল ভাবুন তো। সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখলাম।
—হ্যাঁ, ভাগ্যি ঠিক সময়ে ডাক্তারবাবু এসে পড়েছিলেন?
—কিন্তু ছেলেকে নিয়ে ঝাঁপ?
—অশান্তিটা বোধহয় খুবই গুরুতর। নীচু গলায় বললেন বিভূতিবাবু।
—একে ডাক্তার তার ওপর জোয়ান বয়েস। আবার হাসপাতালে নার্সদের নিয়ে কাজ— কারবার…!
—কিন্তু উনি কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন?
—তা ছাড়া কি?
—তা ছাড়া ব্যাপার আছে মশাই, ব্যাপার আছে। আমার ওয়াইফ তো সঙ্গে সঙ্গে ওপরে গিয়েছিল। নিজে কানে শুনেছেন—কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে নাকি ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল।
মহিমাবাবুর কথায় হঠাৎ যেন সবাই থমকে গেলেন। অমৃতবাবু আরও কাছে সরে এসে বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপার যে কিছু আছে সে বিষয়ে আমারও সন্দেহ নেই। মনে আছে মাস দেড়েক আগে অনেক রাত্তিরে ওপরের ঘরে চেঁচামেচি?
—হ্যাঁ, গেলাস ভাঙার শব্দ!
—ডাক্তার তো বলে দিলেন বেড়ালে ভেঙেছে। কিন্তু আমার খটকা যায়নি।
—তা তো বটেই। অবশ্য আর কী—ই বা হতে পারে? চোর—ডাকাত হলে ধরা পড়ে যেত।
—যাই হোক ব্যাপারটা রহস্যজনক।
—রহস্যজনক বলে রহস্যজনক! পুরোনো বাড়ি। কী দোষ আছে কে জানে!
—তুমি থামো বিভূতিবাবু! সন্ধেবেলা আর ভয় ঢুকিয়ে দিয়ো না। মনে রেখো আমরাও এক বাড়িতে থাকি।
—কিন্তু একটা মীমাংসা হওয়ার তো দরকার।
—কীসের মীমাংসা?
—বাড়িতে যদি কোনো দোষ থাকে—
—দোষ থাকলেই কি আমরা বাড়ি ছাড়তে পারব?
সবাই একটু থতোমতো খেয়ে শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শচীনবাবু কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, আমি তো পারব না। এত কম ভাড়ায়, সেলামি ছাড়া আর কোথায় বাড়ি পাব?
যুক্তি অকাট্য। সত্যিই তো। যতই ভূতের উপদ্রব হোক এ বাড়ি ছাড়া যাবে না। ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু একটা বাড়ি ছেড়ে দিলে বাড়ি পাওয়া দায়।
—শান্তি—স্বস্ত্যয়ন তো করা যায়।
—তা যায়। তবে তার আগে আসল ব্যাপারটা জানা দরকার।
—তাহলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
—ডাক্তার কিছু বলবে মনে করেছ? দেখছ না লোকটা কারো সঙ্গে মেশে না।
—তা হোক, তবু একবার সবাই মিলে—ওই তো ডাক্তার ফিরছেন। চলো—চলো—খুব উৎসাহে বিভূতিবাবু সবাইকে বললেন বটে কিন্তু আর নড়তে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত শচীনবাবু একাই এগিয়ে গেলেন।
—নমস্কার, ডাক্তারবাবু।
—নমস্কার, ভালো আছেন?
—এই চলছে আর কী! আপনার কথাই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন?
—ভালোই আছেন। কেন বলুন তো?
—যাক। নিশ্চিন্ত হলাম। সেদিন যা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল—খুব সময়ে আপনি এসে পড়েছিলেন। তারপরই উনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
—হ্যাঁ, নার্ভাস ব্রেকডাউন। সঞ্জয় সংক্ষেপ করতে চাইল।
ইতিমধ্যে সকলেই এসে দাঁড়িয়েছেন সঞ্জয়কে ঘিরে। মহিমাবাবু বললেন, এমনি—এমনি কি নার্ভাস ব্রেকাডাউন হয় ডাক্তারবাবু? নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছিলেন।
—ভয়! না, না, ভয় কীসের? কলকাতার মতো জায়গায়—আমরা সকলে মিলে মিশে রয়েছি—একবার চেঁচিয়ে উঠলে পাঁচজনে ছুটে আসবে। এখানে চোর—ডাকাতের সাধ্য কী ঢোকে। না—না, কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। বলতে বলতে সঞ্জয় সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
মহিমাবাবুরা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলেন তো। আমাদের কিছু বলতেও দিলে না।
ওদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিরক্ত সঞ্জয় মনে মনে বলল, এদের জন্যেই দেখছি বাড়িটা ছাড়তে হবে। প্রেস্টিজ বলে কিছু আর রইল না।