ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.১৪ সঞ্জয়ের চ্যালেঞ্জ

।। চোদ্দো।। সঞ্জয়ের চ্যালেঞ্জ

ক’দিন হল মিস থাম্পি চলে গিয়েছেন। মান্তুর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। রীণার মনটা তাই একটু খারাপ ছিল। দুঃসময়ে নিজের লোক ছাড়াও প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্য যে কত দরকার হয় মান্তুকে পেয়ে রীণা তা বুঝতে পেরেছে।

বেলা তখন চারটে। পুপুটা ক’দিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। শীতটাও বেশ জোরে পড়েছে। বিকেলবেলায় কখনো কখনো পুপুকে নিয়ে রীণা নীচে কম্পাউন্ডে নেমে আসে। কম্পাউন্ডে বেশি ভিড় থাকলে নীচে নামে না। সংকোচ হয়। তার যেন মনে হয় সবাই তাকে একরকমভাবে দেখছে। তাই নিজেকে মনে হয় যেন তাদের কাছে অতিপ্রাকৃত জগতের কেউ। তাই সে অনেক সময়ে পুপুকে নিয়ে তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে।

এদিনও দাঁড়িয়ে ছিল। মিনিট দশেক হল লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এই এক অসহ্য ব্যাপার। রীণার কাছে আবার শুধুই অসহ্য ব্যাপার নয়, ভীতির কারণ।

নীচে ছেলেরা খেলা করছে, বৃদ্ধরা বেঞ্চিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে সম্ভবত সাংসারিক বিষয় নিয়ে গল্প করছে। বন্দনার মা কোথায় বেরিয়েছিলেন, কিছু জিনিস কিনে রিকশা থেকে নামলেন।

আচ্ছা, মিস থাম্পি যে এসে এক রাত কাটিয়ে গেলেন, বন্দনা বা বন্দনার মা কি তা জানেন?

জানলেও এঁদের সেরকম গায়ে—পড়া কৌতূহল নেই। এটা অবশ্য ভালোই।

বড়ো অদ্ভুত মহিলা মিস থাম্পি। প্রথম যেদিন রীণা ওঁকে দেখে সেদিন ভালো লাগেনি। কিন্তু এ বাড়িতে এসে তাঁকে খুবই ভালো লেগেছে।

মিস থাম্পি এ বাড়ি সম্বন্ধে কী যেন বললেন? ছেড়ে দেওয়াটাই উচিত। একদিক দিয়ে সে খুশি। আর যাই হোক তার মানসিক রোগ হয়নি। এতদিন তাহলে যা দেখেছে, যা বলেছে সব সত্যি। সঞ্জয় কি এবার তা বুঝতে পেরেছে? তাহলে কি আর একদিনও এ বাড়িতে থাকা উচিত? মিস থাম্পির কথায়—evil spirit আছে যে দুরত্মা হিংস্রকুটিল। শাসিয়ে যায়।

রীণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল আবার।

রীণা ভোলাতে লাগল, না না, কান্না কেন বাবুসোনা? ওই দ্যাখো ছেলেরা কেমন বল খেলছে। তুমিও বড়ো হয়ে বল খেলবে। তোমার বাপী তোমায় বল কিনে দেবে—সুন্দর লাল বল—

পুপুর কান্না তবু থামল না। দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগল।

রীণা মনে মনে সঞ্জয়ের জন্য ব্যস্ত হচ্ছিল। সন্ধের সময়ে লোডশেডিং হলে কিছুতেই একলা থাকতে ভালো লাগে না।

কিন্তু পুপু ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কেন? বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে! এ কান্নাটা যেন….

রীণার বুক কাঁপতে শুরু করল। তাহলে কি এই সন্ধেবেলাতেই….

তখনই রীণার মনে হল ঘরের মধ্যে যেন কীসের চাপা শব্দ! তারপরই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের জানলাগুলো সশব্দে খুলে গেল।

ঘরের দিকে তাকাতেই রীণার মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। দেখল ঘরের মধ্যে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী মেঝে থেকে ক্রমাগত ওপরে উঠছে। মনে হচ্ছে নীচের তলায় যেন আগুন লেগেছে। মেঝে ফুঁড়ে তারই ধোঁয়া সমস্ত ঘরটাকে গ্রাস করে ফেলছে। ধোঁয়াটা কীসের বুঝতে বুঝতেই ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ফুটে বেরাল একটা মূর্তি। সে মূর্তি ওর চেনা। সেই কালো প্যান্ট, কোট আর টুপি। টুপিটা নেমে এসেছে আধখানা কপাল পর্যন্ত। তারপরেই মূর্তিটা দূরন্ত গতিতে ঘুরপাক খেতে লাগল।

রীণা ভয়ে কাঠ হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রমে মূর্তির চোখে মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠল। রীণা স্পষ্ট বুঝতে পারল মূর্তিটা দাঁতে দাঁত চেপে কী যেন বলছে!

রীণার শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তার এত ভয় করছিল যে সে থরথর করে কাঁপছিল। তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধেই শোনার জন্যে কান পাততে হল। কেউ যেন হুকুম করছে—আমি যা বলি শোনো!

একটা চাপা হিসহিস শব্দের ভেতর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া কয়েকটা কথা বেরিয়ে এল—আগামী শনিবার…রাত দুটো…আমি আসব—তুমি যাবে….নইলে…..বলেই মূর্তিটার মর্চে ধরা লোহার শাবলের মতো দুখানা অদ্ভুত সরু সরু হাত এগিয়ে আসতে লাগল পুপুর দিকে।

পুপু তখন নেতিয়ে পড়েছে রীণার কাঁধে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। কাঁদবার শক্তিও বুঝি আর নেই।

পালাবার উপায় নেই। সামনেই মূর্তিটা দাঁড়িয়ে। রীণা ব্যালকনির ওপর ঝুঁকে পড়ল। দেখল নীচে ছেলেরা তখনো খেলা করছে, বয়স্করা গল্প করছে।

রীণা চিৎকার করে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরোল না।

এদিকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে সেই অদ্ভুত বিকৃত দুখানা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। হাতের চেটো দুটো অস্বাভাবিক ছোটো!

ঠিক সেই সময় একটা ট্যাক্সি এসে ঢুকল কম্পাউন্ডের মধ্যে। সঞ্জয় নামল ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া চুকিয়ে ওপর দিকে তাকাল। লোডশেডিং। তিনতলাটা অস্পষ্ট। তবুও যা দেখতে পেল তাতেই সঞ্জয় চমকে উঠল। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা যেন ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল সঞ্জয়।—রীণা! পড়ে যাবে—পড়ে যাবে—

রীণা বুঝি মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। নীচে যারা ছিল সঞ্জয়ের চিৎকারে তারাও ওপর দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই চেঁচিয়ে উঠল—গেল—গেল—গেল!

সঞ্জয় ছুটল সিঁড়ির দিকে। তিনতলায় উঠতে তিন মিনিটও লাগল না। সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ঘরের দরজা খোলা কেন? এমন তো কোনোদিন থাকে না!

কিন্তু সেদিকে মন দেবার সময় নেই। দৌড়ে গেল ব্যালকনির দিকে। জাপটে ধরল রীণাকে—এ কী করছিলে?

পুপুকে বুকের মধ্যে দু—হাতে আঁকড়ে ধরে সেখানেই বসে পড়ল রীণা। কোনোরকমে বলল, এসেছ?

—হ্যাঁ, লোডশেডিং—এ ভয় পাবে বলে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।

—সেটা কোথায় গেল?

—কে? কার কথা বলছ?

রীণা আর কথা বলতে পারল না। তার অচৈতন্য দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চেঁচামেচি শুনে বন্দনার মাও উঠে এসেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে তুলে নিলেন।

আর চাপাচাপি রইল না কিছুই। সঞ্জয়ের পিছু পিছু সকলেই ওপরে উঠে এসেছে। ঘরভর্তি লোক। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে রীণা। সঞ্জয় ওর জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছে। সকলের মুখেই চাপা প্রশ্ন—কী হল? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন নাকি? কিন্তু খামোকা আত্মহত্যা করতেই বা যাবেন কেন? দুটি মানুষের সংসার। অশান্তি তো কিছুই নেই।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে রীণা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। কিন্তু সে দৃষ্টি বড়ো স্তিমিত।

—কেমন আছ? সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল রীণার মুখের উপরে। কী হয়েছিল?

ঘরসুদ্ধ সবাই রীণার দিকে তাকিয়ে।

রীণা কোনো উত্তর দিতে পারল না। কেমন একরকম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ রীণাকে লক্ষ করল। তারপর পালস দেখতে লাগল। একবার—দুবার—তিনবার। শেষে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পালস—বিট মেলাতে লাগল। ওর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন?

—ভালো না। বলেই সঞ্জয় উঠে পড়ল।

বন্দনার মা দূরে দাঁড়িয়ে পুপুকে ভোলাচ্ছিলেন। সঞ্জয় বলল, বৌদি, আপনি এখানে একটু থাকুন। আমি আপনার ঘর থেকে একটা ফোন করে আসি।

সঞ্জয়ের উদ্বেগ দেখে এবার ভিড় কমতে লাগল। সঞ্জয় নীচে নামতেই দেখল বন্দনা মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে।

—কাকিমা?

—ভালো না। এখুনি আমায় একটা ফোন করতে হবে।

ভাগ্য ভালো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লাইন পাওয়া গেল। শুধু লাইন নয়, ডাক্তার রুদ্রকেও।

সংক্ষেপে সব ব্যাপার জানিয়ে সঞ্জয় বলল, কাকাবাবু, আপনি এক্ষুনি চলে আসুন। আমি একা ভরসা পাচ্ছি না।

.

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডাঃ রুদ্র এসে পড়লেন। রীণা তখনো মাটিতে চোখ বুজে পড়ে আছে।

ডাক্তার রুদ্র নাড়ি দেখলেন, প্রেশার চেক করলেন। চোখের পাতা ফাঁক করে টর্চ ফেললেন। তারপর সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন—ব্রান্ডি আছে?

সঞ্জয় মাথা নাড়ল।

—গরম দুধ?

বন্দনার মা বললেন, আমি এনে দিচ্ছি। বলে তিনি পুপুকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।

—তুমি বলছ রীণা এখান থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল?

—হ্যাঁ। তখন লোডশেডিং—আবছা অন্ধকার, তবু আমি স্পষ্ট দেখেছি।

—কী দেখেছ?

—রীণা পুপুকে এক হাতে বুকে চেপে ধরে রেলিং—এর উপর উঠছে।

—তুমি ঠিক জানো ঝাঁপ দিতেই যাচ্ছিল? ঝুঁকে কিছু দেখছিল না?

—হ্যাঁ, ঠিক জানি। শুধু আমি কেন নীচে যাঁরা বসেছিলেন তাঁরা সবাই ”গেল গেল” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন।

—তারপর?

—তারপর আমি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম।

—ঘরে ঢুকলে?

—হ্যাঁ।

—দরজা বন্ধ ছিল না?

—না। এটাই আশ্চর্য লাগল।

—কেন?

—রীণা কখনো দরজা খুলে রাখে না।

—হুঁ, তারপর?

—আমি ছুটে ব্যালকনিতে গেলাম।

—কী অবস্থায় দেখলে?

—ও তখন রেলিং ধরে কাঁপছিল। আমি ওকে ধরলাম।

ডাঃ রুদ্র আরও কয়েক মিনিট ব্যালকনিতে রইলেন। তারপর বললেন, ঘরে এসো।

এরই মধ্যে বন্দনার মা গরম দুধ নিয়ে এসেছেন। সঞ্জয় বাটিটা হাতে করে রীণার কাছে গিয়ে বসল।

—দেখি, দুধটা খেয়ে নাও।

ডাঃ রুদ্র বললেন, উঠে বোসো।

রীণা মাথা নাড়ল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, ঠিক পারবে। উঠে বোসো।

রীণা দু—হাতে ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে বসল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি নিজে হাতে বাটিটা ধরো।

রীণার হাত কাঁপছিল তবু কোনোরকমে বাটিটা ধরল।

—খাও।

রীণা বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না।

—তবুও খেতে হবে।

রীণা ধীরে ধীরে বাটিতে চুমুক দিল।

খাওয়া হলে বাটিটা মাটিতে রাখল।

ডাক্তার রুদ্র বললেন, এবার উঠে দাঁড়াতে হবে।

রীণা করুণ চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।

একটু চেঁচিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, ওঘরে গিয়ে বিছানায় শুতে হবে তো।

রীণা বলল, পড়ে যাব।

‘পড়ে যাব’ সামান্য দুটি কথা। কিন্তু ওই কথা দুটিতেই ডাঃ রুদ্রের দু—চোখ ঝকঝক করে উঠল। যেন সঞ্জয়কে লক্ষ করেই নীচুগলায় বললেন—তাহলে দ্যাখো, পেশেন্ট পড়ে যেতে ভয় পায়! তারপর রীণাকে বললেন, না, পড়বে না। চেষ্টা করো। ওঠো বলছি!

—সঞ্জয়, help her বলে ডাঃ রুদ্র নিজেই রীণার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রীণা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

দশ মিনিট পর ডাক্তার রুদ্র সঞ্জয়কে একটা ইনজেকশান দিতে বললেন। ইনজেকশান ডাক্তার রুদ্রর কাছেই ছিল। সঞ্জয় ইনজেকশান দিল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, এসো। বাইরের ঘরে ঘণ্টাখানেক বসা যাক। ও এখন ঘুমোক।

দুজনে বাইরের ঘরে এসে বসলেন।

—কী রকম বুঝলেন?

—না, সিরিয়স কিছু নয়। হঠাৎ ভয় পেয়েছে। ইনজেকশান দেওয়া হল, ঠিক হয়ে যাবে।

সঞ্জয়ের মুখে তবু হাসি ফুটল না।

—কেন যে বার বার এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।

—তোমার স্ত্রী তো আগে এমন ভয় পেত না?

—কোনোদিন তো শুনিনি।

ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। একটু পরে বললেন, বাড়িটা না হয় ছেড়েই দাও।

সঞ্জয়ের ভুরুতে অসহিষ্ণুতার চিহ্ন ফুটে উঠল—আপনিও একথা বলছেন! শেষে ভূতের ভয়ে বাড়ি ছাড়ব।

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। ভূত না অলৌকিক কিছু, নাকি মানসিক ব্যাধি, এসব তর্কে আজ আর যেতে চাই না। এখানে থাকলে যদি ওর ক্ষতি হয় তাহলে এখান থেকে যাওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত নয় কি?

—কিন্তু সেদিন তো আপনিও বললেন, ও সাইকোপ্যাথিক পেশেণ্ট?

ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, এসব ক্ষেত্রে ‘সিদ্ধান্ত’ বলে কিছু নেই। আজ লক্ষণ শুনে যা মনে হবে, কাল রুগিকে দেখে অন্যরকম মনে হতে পারে।

সঞ্জয় অসহিষ্ণু ভাবে বলল, তাহলে কি মানতে হবে এ বাড়িতে আসার পরই কোনো একটি অশরীরী আত্মা কেবলমাত্র রীণার ক্ষতি করতে চাইছে। সে রীণাকে তার সঙ্গে যেতে বাধ্য করবে। But how is it possible and why? একটা অশরীরী আত্মা একটা জীবন্ত মানুষকে…

বাধা দিয়ে ডাঃ রুদ্র বললেন, না, জীবন্ত মানুষকে সে চায় না।

—তার মানে ওকে মেরে ফেলবে?

—হয় তো তাই। তার সূচনাও তো আজ কিছুক্ষণ আগে দেখতে পেলে।

সঞ্জয় চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল।

ডাঃ রুদ্র বললেন, তুমি কি মনে কর রীণা আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিল?

—না, কখনোই না।

ডাঃ রুদ্র একটু ভেবে বললেন, আমারও তাই মনে হয়। ওর মতো সুখী মেয়ে সুইসাইড করতে যাবে কেন?

সঞ্জয় বলল, তবে ফ্রাস্টেশনে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অসহায় বলে মনে হলে মানুষ বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে শান্তি পেতে চায়।

—ফ্রাস্টেশান বলছ কেন?

—ওই যে ওর কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করছি না। তা ছাড়া পুপুকে নিয়ে রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়াটা আত্মহত্যার চেষ্টাই বোঝায়।

ডাঃ রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর অল্প হেসে বললেন, কিন্তু আমি প্রমাণ পেয়েছি ও আত্মহত্যা করতে যায়নি।

অবাক চোখে সঞ্জয় ডাক্তার রুদ্রর দিকে তাকাল।

—হ্যাঁ, অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি। মনে আছে, রীণাকে যখন উঠে দাঁড়াতে বলেছিলাম তখন ও ভয় পেয়ে বলেছিল ‘পড়ে যাব’। যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাবার ভয় পায় সে কি দেড়ঘণ্টা আগে স্বেচ্ছায় তিনতলা থেকে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করতে পারে?

সঞ্জয় থমথমে মুখে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকিয়েই রইল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।

ডাঃ রুদ্র বলতে লাগলেন—এই থেকেই প্রমাণ হয় রীণা যা বলেছে তা সত্যি। ভয়ংকর কিছু দেখেছিল যার জন্যে বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে অমন সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকে পড়ে তার হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার এমন শেষ চেষ্টা করছিল।

সঞ্জয় একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, রীণা কি হিস্টিরিয়ায় ভুগছে? হিস্টিরিয়ার রুগিকে লোকে ভূতে—পাওয়া বলে। এইসব রুগিদের শক্তি নাকি এতদূর হয় যে জলভর্তি ঘড়া দাঁতে করে তুলে উঠোনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কাজেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হলে…

ডাঃ রুদ্র বাধা দিয়ে বললেন, তুমি বলতে চাইছ রীণা হিস্টিরিয়ার পেশেন্ট। আচ্ছা, তোমার স্ত্রী তো সারাদিন দরজা বন্ধ করেই থাকে, তাই না? তাহলে আজ হিস্টিরিয়ার প্রকোপ যখন তার বাড়ল, তখন বুঝি সে তোমার আসার জন্যে দরজা খুলে রেখে ঝাঁপ দিতে গেল?

সঞ্জয় চুপ করে রইল।

—দরজাটা তা হলে খুলল কে?

সঞ্জয় তখনও নিরুত্তর।

নিভে—যাওয়া চুরুটটা আবার দুটো কাঠি ধ্বংস করে ধরালেন ডাঃ রুদ্র। বললেন, উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। দরজা খুলেছিল সে, যে একদিন রাত্রে ওই টেবিলের কাছে ঘুরতে ঘুরতে কাচের গ্লাসটা ভেঙেছিল, যে কুলুঙ্গি থেকে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের ছবিখানা চুরি করেছিল। সে—ই রীণাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দরজা খুলে রেখে গেল।

একটু থেমে বললেন, অবশ্য তুমি জিজ্ঞেস করতে পার—অশরীরী আত্মাকেও কি দরজা খুলে যেতে—আসতে হয়? তাহলে অবশ্যই আমি চুপ করেই থাকব। কেননা তার উত্তর জ্ঞানের বাইরে।

সঞ্জয় মন দিয়ে সব শুনল। কোনো উত্তর দিল না।

কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলেন। পাশের ঘরে রীণা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন বন্দনার মা ট্রেতে দু—কাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে।

সঞ্জয় একটা কাপ এগিয়ে দিল ডাঃ রুদ্রর দিকে। নিজে নিল অন্যটা। বিস্কুটে কামড় দিয়ে সঞ্জয় বলল, কিন্তু শিবানন্দের ছবি চুরি করার উদ্দেশ্য?

—আত্মাটির ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর সোজা। তুমি বলেছিলে ছবির পিছনে ঠিকানা লেখা ছিল। স্পিরিট চায় না শিবানন্দর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়। তাই সে ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে।

সঞ্জয় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, তবে তো শিবানন্দর কাছে আমায় যেতেই হবে। অশরীরী আত্মাটি অনেক কিছুই জানেন, জানেন না যে, ছবি নিয়ে গেলেও ঠিকানাটি আমার মুখস্থ হয়ে আছে।

ডাঃ রুদ্র পেয়ালা নামিয়ে রেখে বললেন, তবে আর কী? একদিন চলে যাও ওঁর কাছে। তবে—তার আগে কিন্তু বাড়িটা ছাড়বে।

—এত তাড়াতাড়ি বাড়ি পাব কোথায়?

—এখনি বাড়ি না পাও আমার ওখানে উঠবে। মোট কথা সামনের শনিবারের আগেই তোমরা এ বাড়ি ছাড়বে।

সঞ্জয় ছেলেমানুষের মতো জেদ ধরে বলল, শনিবার পর্যন্ত তো আমি থাকবই।

ডাঃ রুদ্রের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুমি থাকতে চাও থাকো। আমি ওদের নিয়ে যাব।

সঞ্জয় বলল, না। তা হয় না কাকাবাবু। রীণা না থাকলে তিনি তো আসবেন না। ওই শনিবার আমি সারাদিন রীণাকে পাহারা দেব। দেখব কী করে ওর ক্ষতি করে?

—তাহলে যা ভালো বোঝো করো। এরপর আমার আর কিছু বলার নেই।

তিনি উঠে রীণাকে পরীক্ষা করতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন—ভালোই আছে। ওর যদি ঘুম ভাঙে তাহলে রাতের খাবার খাবে। ঘুম যেন ভাঙিয়ো না।

বলে বেরোতে যাচ্ছেন এমনি সময়ে বন্দনার মা পুপুকে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে ঢুকলেন।—পুপুর জ্বর হয়েছে দেখছি।

—জ্বর! সঞ্জয় চমকে উঠে পুপুর কপালে হাত দিল।—বেশ জ্বর। বলে ডাঃ রুদ্রের দিকে তাকাল। ডাঃ রুদ্র পালস দেখলেন। কিছু বললেন না।

সঞ্জয় চিন্তিতভাবে তাকাল, কী করব?

ডাঃ রুদ্র হাসলেন, তুমি নিজে ডাক্তার। ছেলের একটু জ্বর হয়েছে। তাতেই ঘাবড়ে যাচ্ছ? বলে সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।

—আজকের রাতটা দ্যাখো। কাল জ্বর না ছাড়লে ভাবা যাবে।

ডাঃ রুদ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সঞ্জয় বন্দনার মাকে বলল, আপনি একটু থাকুন। আমি এঁকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।

বন্দনার মা বললেন, আমি থাকছি। আপনি একটু বন্দনাকেও পাঠিয়ে দেবেন।

ডাঃ রুদ্র গাড়িতে উঠে ইঞ্জিনের চাবি ঘোরালেন।—কাল সকালেই তাহলে একটা খবর দেবে। কী এত ভাবছ?

—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই খবর দেব। ভাবছিলাম—আপনিও বাড়ি ছাড়ার কথা বললেন, আর একজনও বলছিলেন।

—কে তিনি?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আপনাকে বলা হয়নি গত সপ্তাহে মিস থাম্পি নামে একজন ম্যাড্রাসি মহিলা আমার এখানে এসেছিলেন রীণার এক বান্ধবীর সঙ্গে। রীণার কথা সব শুনলেন। তিনিও বলছিলেন—

ডাঃ রুদ্র গাড়ির চাবি বন্ধ করে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন—ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট মিস থাম্পি নাকি?

—হ্যাঁ, আপনি চেনেন?

ডাঃ রুদ্র চাবি ঘুরিয়ে ফের ইঞ্জিন চালু করে বললেন, ওঁর সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। নেক্সট ডে যখন আসব ওঁর কথা বলব। গুড নাইট।