আরও সাংঘাতিক
গরম গরম চা-পান করতে করতে সুব্রত গভীর মনোযোগের সঙ্গে গতরাত্রের ঘটনা সম্পর্কে বিকাশের নেওয়া জবানবন্দি ও অন্যান্য নোটগুলি পড়ছিল। বিকাশের একেবারে শতকরা নিরানব্বইজন দারোগাবাবুর মত কেবল পকেটভর্তির দিকেই নজরটা সীমাবদ্ধ নয়। বেশ কাজের লোক এবং একটা জটিল মামলার মধ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বেছে নেওয়ার একটা ন্যাক আছে বলতেই হবে। বিকাশের নেওয়া নোট ও জবানবন্দির কতকগুলো কথা সুব্রতর মনে যেন একটু নাড়া দিয়ে যায়। কথার পিঠে কথা হলেও, কথাগুলোর মধ্যে বেশ একটু গুরুত্ব আছে বলে যেন মনে হয়।
চা পান ও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা চালাবার পর বিকাশ সুব্রতর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তখনকার মত। বলে গেল সন্ধ্যার দিকে আবার এদিকে আসবে। বিকাশের যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সুব্রতও আর মুহূর্ত দেরি না করে গতরাত্রে লাহিড়ীর ঘর থেকে চুরি করে সংগৃহীত কাগজপত্রগুলো ও হিসাবের খাতাটা খুলে নিয়ে বসল।
কাগজপত্রগুলো, সাধারণ কয়েকটা ক্যাশ-মেমো—সেগুলো পরীক্ষা করে তার মধ্যে এমন কোনো বিশেষত্ব পাওয়া গেল না। তবে তার মধ্যে গোটা দুই ইনভয়েস ছিল,-৬০টা ড্রাই সেল ব্যাটারী (সাধারণ টর্চবাতির জন্য যা ব্যবহৃত হয়) কেনা হয়েছে, তারই ইনভয়েস। এতগুলো ব্যাটারী একসঙ্গে কেনবার লোকটার হঠাৎ কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল? একমাসের মধ্যে প্রায় ১২০টা ব্যাটারী কেনা হয়েছে।
যা হোক ক্যাশমেমোগুলো পরীক্ষা করে হিসাবের খাতাটা সুব্রত খুললে। সাধারণ দৈনন্দিন হিসাব নয়, মাসিক মোটামুটি একটা আয় ও ব্যয়ের হিসাব মাত্র।
৫ই নভেম্বর : দু হাজার টাকা ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়েছে।
৭ই নভেম্বর : তারাপ্রসন্ন নামক কোনো ব্যক্তির নামে দশ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
লোকটা কত মাইনে পেত তা সুব্রত জানে। মাসে মাত্র তিনশত টাকা, ইদানীং মাস-দুই হবে চারশত টাকা বেতন পাচ্ছিল। অথচ সুব্রত হারাধনের ওখানে শুনেছে, এখানে আসবার পূর্বে সতীনাথের সাংসারিক অবস্থা খুব খারাপই ছিল। ইদানীং এই কয়েক বৎসর চাকরি করে সে কেমন করে এত টাকার মালিক হতে পারে? এর মধ্যে যে একটা গভীর রহস্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে সে বিষয়েও কোনো ভুল নেই। এসব ছাড়া দেখা যাচ্ছে,ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে কোনো শ্রীপতি লাহিড়ীর নামে প্রতি মাসে ছশত থেকে সাতশত টাকা জমা দেখানো হয়েছে। এই শ্রীপতি লাহিড়ীই বা কে? এ কি লাহিড়ীর কোনো আত্মীয়? না আগাগোড়া শ্রীপতির ব্যাপারটা একটা চোখে ধুলো দেবার ব্যাপার মাত্র!
কিরীটী ওকে ঠিকই লিখেছিল। সতীনাথ একটি গভীর জলের মাছ, তার প্রতি ভাল করে নজর রাখতে। কিন্তু সতীনাথের কর্মময় জীবনের ওপরে যে এত তাড়াতাড়ি যবনিকা নেমে আসবে তা সুব্রত স্বপ্নেও ভাবেনি। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতই আকস্মিক ও অচিন্তনীয়। তারপর আরও একটা জিনিস ভাববার আছে। লাহিড়ীর এই হত্যা-ব্যাপারের সঙ্গে পূর্বতন সুহাসের হত্যা-ব্যাপারের কোনো সংস্পর্শ বা যোগাযোগ আছে কি না। এটা সেই কয়েক মাস আগেকার পুরাতন ঘটনারই জের, না নতুন কোনো হত্যা-ব্যাপার? রাজাবাহাদুরের কাছে জানা গেল ঐ নিশানাথ লোকটা বিকৃত-মস্তিষ্ক একজন আর্টিস্ট। অথচ ওর কথা কালই সর্বপ্রথম সুব্রত জানতে পারল। ইতিপূর্বে ঘুণাক্ষরেও নিশানাথের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুব্রত জানতে পারেনি। গতরাত্রের ব্যাপার দেখে মনে হল, নিশানাথ লোকটিকে রাজাবাহাদুর সযত্নে আড়াল করে যেন রাখতে চান। সেই কারণেই হয়ত তাড়াতাড়ি তাকে অন্য সকলের সামনে থেকে সরাবার জন্য তিনি অতি মাত্রায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কেন? লোকটা যদি সত্যিই বিকৃত-মস্তিষ্ক হয়, তবে তাকে এত ভয়ই বা কেন? তারপর নিশানাথের কথাগুলো! সেগুলো কি নিছক প্রলাপোক্তি ভিন্ন আর সত্যিই কিছু নয়?
এখন পর্যন্ত সুব্রত নৃসিংহগ্রামে একটিবার গিয়ে উঠতে পারেনি। তারপর সাঁওতাল প্রজা! হ্যাঁ, শুনেছে বটে ও, নৃসিংহগ্রামের অর্ধেকের বেশীর ভাগ প্ৰজাই সাঁওতাল ও বাউড়ী জাতি, এখানেও নদীর ধারে রাজাদের প্রায় একশত সাঁওতাল প্রজা আছে। এখানে আসবার পর, কাজ করবার কোনো সূত্রই আজ পর্যন্ত সুব্রত পায়নি। অথচ প্রায় দেড় মাস হতে চলল এখানে সে এসেছে!
ঐ তারিণী চক্রবর্তী, মহেশ সামন্ত, সুবোধ মণ্ডল—লোকগুলো যেন এক-একটি টাইপ চরিত্রের। সকলেই রাজবাড়িতে বহুকালের পুরাতন কর্মচারী।
সুহাসের মা, রসময়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মালতী দেবী, সুব্রত এখনও তাঁকে একটি দিনের জন্যও দেখেনি। শোনা যায়, একটিমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি সহসা যেন অন্তঃপুরে আত্মগোপন করছেন। দিবারাত্র ঠাকুরঘরে পূজা-আর্চ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কোথাও বড় একটা বের হন না বা তেমন কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও করেন না।
রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের স্ত্রীও মৃতা এবং তাঁর একটিমাত্র পুত্র প্রশান্ত কলকাতায় তার মামার বাড়ীতে থেকেই পড়াশুনা করে। ছুটিছাটায় রায়পুরে আসে কখনও কচিৎ।
সুব্রত কেবল ভেবেই চলে, ভাবনার যেন কোনো কূল-কিনারা পায় না। যা হোক ঐ দিনই দ্বিপ্রহরের দিকে ও একটা দীর্ঘ চিঠি কিরীটীকে লেখে, সব ব্যাপারটা জানিয়ে।
***
দিন-পাঁচেক বাদে কিরীটীর চিঠির জবাব আসে।
কলিকাতা
২৬শে ফাল্গুন
কল্যাণ,
তোর চিঠি পেলাম। তোর চিঠি পড়ে মনে হল যেন তুই অত্যন্ত গোলমালে পড়ে গেছিস। সতীনাথের জন্য এত চিন্তার কোন কারণ নেই তো। একটু ভাল করে ভেবে দেখলেই বুঝতেই পারবি আমার সন্দেহ ও গণনা ভুল হয়নি, এবং ক্রমে সেটাও প্রমাণিত হতে চলেছে। সতীনাথের মৃত্যুর প্রয়োজন হয়েছিল, তাই তাকে ঐভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল। শুনেছি রহস্যময়ী পৃথিবীতে এক ধরনের নাকি সাপ আছে, যারা ক্ষুধার সময় নিজেদের দেহ নিজেরাই গিলতে শুরু করে। হতভাগ্য সতীনাথও সেই রকম কোনো ক্ষুধার্ত সাপের পাল্লায় পড়েছিল হয়ত। নইলে–যাক গে সে কথা, কিন্তু তোর শেষ চিঠিটা পড়ে আমি ভাবছি আর একজনের কথা। তারও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে, তবে এই ভরসা সতীনাথের মত অত চট করে তাকে হত্যা করা হয়ত চলবে না। রীতমত ভেবেচিন্তে তাকে এগুতে হবে। তুই লিখেছিস হাতের কাছে কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিস না! তোদের ঐ রাজবাটির অন্দরের দারোয়ান শ্ৰীমান ছোট্ট সিং, তার জবানবন্দি তো নিসনি? খোঁজ নিয়ে দেখিস দেখি, লোকটা মাথায় পাগড়ী বাঁধে কিনা? আর কয় সেট পেটেন্ট দারোয়ানী লোহার নাল-বসানো নাগরা জুতো সে রাখে? তারিণী আর মহেশের উক্তি একান্ত পরস্পরবিরোধী! ওদের মধ্যে একজন সম্ভবত সত্যি বলেনি। ঘড়ি ধরে দেখিস তো, তারিণীর ঘর থেকে অন্দরে যাওয়ার দরজাটার গোড়ায় পৌঁছতে কত সময় ঠিক লাগে? গোলমালের সময় ছোট্টু সিং কোথায় ছিল? শ্রীমান সুবোধ পরিপূর্ণ সজ্ঞানেই ছিলেন, যদি আমার কথা বিশ্বাস করিস! মহেশের কথাগুলোও অবহেলা করলে চলবে না। বেশ ভাববার। টিউবওয়েল দেখেছিস কখনও? তাতে যখন জল পাম্প করলেও জল বের হতে চায় না, তখন তার মধ্যে কিছু জল ঢেলে পাম্প করলেই জল উঠে আসে। তাকে বলে জল দিয়ে জল বের করা। এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবি না যে, সুবোধ জল ও দুধের পার্থক্য বোঝে না!
তবে হ্যাঁ, সবই শ্রমসাপেক্ষ। তোকে তো আগেই বলেছি, হত্যাটাই সমস্ত হত্যারহস্যের শেষ! তরুশাখা সমন্বিত বিষবৃক্ষ! যা কিছু রহস্য থাকে, সবই সেই হত্যার পূর্বে। সমস্ত রহস্যের পরে যবনিকাপাত হয় হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই। সেই জন্যেই রহস্যের কিনারা করতে হলে তোকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমার যতদূর মনে হয়, সতীনাথের হত্যারহস্যের মূলের সঙ্গে সুহাসের হত্যার মূল জড়িয়ে জট পাকিয়ে আছে। এখন গিটগুলো খুলতে হবে আমাদেরই। নৃসিংহগ্রামে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার ঘুরে আয়। একটা ভাল সার্ভে করবি। চোখ খুলে রাখবি সর্বদা। পারিস তো দু-একদিনের ছুটি নিয়ে একবার এদিকটা ঘুরে যাস। তুই তো জানিস, আমার কলমের চাইতে মুখটা বেশী সক্রিয়। তোর পত্রের আশায় রইলাম। ভালবাসা নিস, তোর ক।
কিরীটীর চিঠিটা সুব্রত আগাগোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চার-পাঁচবার পড়ে ফেলল।
এই দীর্ঘ পাঁচদিনে অনেক কিছুই সুব্রত দেখেছে। ইতিমধ্যে ময়না-তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে, সতীনাথের মৃত্যু ঘটেছে তীরের ফলার সঙ্গে মাখিয়ে তীব্র কোনো বিষ-প্রয়োগের ফলে। যে তীরটা সতীনাথের বুকের মধ্যে গিয়ে বিধেছিল, সেটার গঠনও আশ্চর্য রকমের। তীরটি লম্বায় মাত্র ইঞ্চি-চারেক, সরু একটা ছাতার শিকের মত, কঠিন ইস্পাতের তৈরী। তীরের অগ্রভাগে ১/৩ ইঞ্চি পরিমাপের একটা ছুঁচলো চ্যাপটা ফলা আছে। তাতেই বোধ করি বিষ মাখানো ছিল। তীরটা বিকাশের কাছেই আছে। তীরটাকে হত্যার অন্যতম প্রমাণ হিসাবে রাখা হয়েছে। আজ পর্যন্ত সুব্রত অনেক ভেবেও ঠিক করে উঠতে পারেনি, কি উপায়ে এবং কি প্রকারে যন্ত্রের সাহায্য এই সরু ছোট্ট তীরটা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। তবে যেভাবেই তীরটা ছোঁড়া হোক না কেন, তীর নিক্ষেপের যন্ত্রটি যে অতীব শক্তিশালী তাতে কোনো সংশয়ই থাকতে পারে না। কারণ তীরটার অংশ মৃতদেহের বুকের মধ্যে অনেকটা ঢুকে ছিল। হত্যাপরাধে এখনও কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি বটে, তবে হত্যাপরাধকে কেন্দ্র করে রায়পুরে বেশ যেন একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক লোকটা অত্যন্ত আমুদে ও মিশুঁকে। সতীনাথের হত্যার পর থেকে সেই যে তিনি প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন, আজ পর্যন্ত তাঁকে আর কেউ বের হতে দেখে নি। স্টেটের অতি আবশ্যকীয় বা বিশেষ প্রয়োজনীয় কোনো কাজে রাজাবাহাদুরের পরামর্শ নিতে হলে সতীনাথের অভাবে আজকাল সুব্রতকে রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে হয়। এবং সেই ধরনের কাজে ইতিমধ্যে দু-তিনবার সুব্রতর রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ যা হয়েছে, সেও খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য।
সুব্রত নিজেই গায়ে পড়ে একটিবার নৃসিংহগ্রাম মহালটা দেখে আসবার প্রস্তাব রাজাবাহাদুরের কাছে উত্থাপন করেছিল। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক সম্মতিও দিয়েছেন। ঠিক হয়েছে, আগামী পরশু সুব্রত সেখানে যাবে। আজকাল আর সুব্রতর হারাধনদের ওখানে নিয়মিত সন্ধ্যায় যাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রায় সুব্রত হাঁটতে হাঁটতে থানার দিকে যায়। তারপর সেখানে থানার সামনে খোলা মাঠের মধ্যে দুটো ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ার পেতে বিকাশ ও সুব্রত দুজনের মধ্যে সতীনাথের হত্যা সম্পর্কে নানাপ্রকার আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।
আজও সন্ধ্যার দিকে কিরীটীর চিঠিটা নিয়ে সুব্রত থানার দিকে অগ্রসর হল। ইদানীং সতীনাথের হত্যা-ব্যাপারের পর থেকে সুব্রতর যেন মনে হয়, সর্বদাই কে যেন তার পিছু পিছু ছায়ার মত তাকে অলক্ষ্যে অনুসরণ করে ফিরছে। কিন্তু কোনোরূপ চাক্ষুষ প্রমাণ আজ পর্যন্ত সে পায়নি। কতবার সে চলতে চলতে ফিরে তাকিয়েছে হঠাৎ, কিন্তু কেউ নেই। অথচ মনে হচ্ছিল একটু আগেও, যেন কারও সুস্পষ্ট পায়ের শব্দ সে শুনেছে। হয়ত এটা কিছুই নয়, তার সদাসন্দিগ্ধ মনের বিকারমাত্র। কিন্তু তথাপি মনের মধ্যে একটা সন্দেহের অস্বস্তিকর কালো ছায়া তাকে সর্বদা পীড়ন করেছে। থানার সামনেই ভোলা মাঠ, রুক্ষ। থানার একপাশে একটা অনেক কালের পাকুড় গাছ। প্রথম রাত্রে আজ চাঁদ উঠেছে, পাকুড় গাছের পাতার ওপরে সামান্য মলিন আলোর আভাস। ঝিরঝির করে শেষ ফাল্গুনের হাওয়া বয়ে যায়।
বিকাশ প্রতিদিনের মত, বোধ হয় হয়ত সুব্রতর প্রতীক্ষ্ণয়, ক্যাম্বিসের চেয়ারটার উপর গা ঢেলে দিয়ে একটা সিগারেট টানছিল। অদূরে সব্রতকে আসতে দেখে সোজা হয়ে বলে, আসুন সুব্রতবাবু! আজ যে এত দেরি?
সুব্রত ঠোঁটের ওপরে তর্জনীটা বসিয়ে বলে, বিকাশবাবু, আপনি বড় অসাবধানী। কতবার আপনাকে সাবধান করে দিয়েছি, এখানে আমি সুব্রত রায় নয়, কল্যাণ রায়! মনে রাখবেন আমি শক্ৰবেষ্টিত পুরীর মধ্যে বাস করছি, কখন কার কানে কি কথা যাবে, সর্বনাশ হয়ে যাবে!
বিকাশ হাসতে হাসতে জবাব দেয়,বসুন, কল্যাণবাবু। কি করি বলুন, অভ্যাসের দোষ, মনে থাকে না,ভুলে যাই। তারপর বন্ধুর চিঠি পেলেন?
হ্যাঁ, এই নিন পড়ুন। সুব্রত বুকপকেট থেকে খামসমেত কিরীটীর চিঠিটা বের করে বিকাশের হতে তুলে দেয়।
অন্ধকারে পড়া যাবে না। এই চৌবে, একটা লণ্ঠন নিয়ে আয়! বিকাশবাবু হাঁক দেয়।
একটু পরেই চৌবে একটা হ্যারিকেন বাতি নিয়ে এসে সামনে রাখে।
হ্যারিকেনের আলোয় তখুনি বিকাশ চিঠিটা আগাগোড়া পড়ে ফেলে। তারপর চিঠিটা পুনরায় ভাঁজ করে খামের মধ্যে ভরে সুব্রতর দিকে এগিয়ে দেয়।
সত্যি, এ কথাটা আমার একবারও মনে হয়নি যে সেরাত্রে ঘোটু সিংয়ের একটা জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল! বিকাশ বলে।
আমি অবিশ্যি ছোট্টু সিংকে ডেকে দুচারটে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব, আমার পক্ষে ততটা করা সম্ভব নয়। লোকের সন্দেহ জাগতে পারে, কেন আমি এত আগ্রহ দেখাচ্ছি!
করেছিলেন নাকি? কই এতদিন এ কথা তো আমায় বলেননি? বিকাশ বললে।
বলিনি তার কারণ, ছোষ্ট্র সিংকে যেসব প্রশ্ন আমি করেছি, একান্ত মামুলী। সে বলে, সে নাকি সেই রাত্রে রাজাবাহাদুরের হুকুমে রাত্রি সাড়ে দশটার সময়েই অন্দরমহলের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাছাড়া আগের দিন থেকে তার শরীরটা সুস্থ ছিল না, তাই ঘরের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল, তারপর চিৎকার ও গোলমালের শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে যায় এবং সব দেখে। তার আগে নাকি সে কিছুই টের পায়নি।
ছোট্টু সিংয়ের ঘরটা ঐ দরজা থেকে কত দূর?
তা প্রায় হাত-দশ-বারো দূরে তো হবেই! সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।
কিন্তু আপনার বন্ধুর চিঠি পড়ে তো মনে হয়, তিনি ঐ দারোয়ান ছোট্টু সিংকে যেন একটু সন্দেহ করছেন!
কেন, কিসে আপনি তা বুঝলেন?
প্রথম কথা ধরুন, সতীনাথের কাছে যে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল, আমরা জানতে পেরেছি। তার মাথায় ছিল পাগড়ী বাঁধা। দ্বিতীয়, মহেশ সামন্ত যে জুতোর শব্দ পেয়েছিল, তার ধারণা সেই জুতোর তলায় কোনো নাল-বাঁধানো থাকলে যেমন শব্দ হয় শব্দটা তেমনি এবং আপনার বন্ধুও চিঠির মধ্যে ঐ কথা লিখেছেন। এখন খোঁজ নিতে হবে সত্যিই ছোট্টু সিংয়ের কজোড়া পেটেন্ট দারোয়ানী লোহার নাল-বসানো নাগরাই জুতো আছে?
তাতে কি?
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—ঐ ছোট্টু সিংয়ের উপরেই আপনার বন্ধুর সন্দেহটা বেশী পড়েছে।
চিন্তিত হবেন না বিকাশবাবু। তাই যদি হয় তো,যথাসময়ে পাকড়াও তাকে করা যাবে, এখন থেকে কেবল শুধু তার সকলপ্রকার গতিবিধির ওপরে আমাদের সদা সজাগ দৃষ্টি রাখলেই চলবে। এবং তাতে করে সত্যিই যদি তাকে গ্রেপ্তার করা আমাদের প্রয়োজন হয়, তবে বেগ পেতে হবে না।
মুখে সুব্রত বিকাশকে যাই বলুক না কেন, দিন-দুয়েক আগে ছোট্টু সিংয়ের সঙ্গে দু-চারটে কথাবার্তা বলে মনে মনে সে যে বেশ একটু চিন্তিত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ভুলই নেই। কিন্তু বিকাশ পুলিশের লোক, তাকে সে কথা বললে এখুনি হয়ত সে বিশেষ রকম তৎপর হয়ে উঠবে, ফলে তার প্ল্যান হয়ত সব ভেস্তে যাবে। তাই সে ছোট্ট সিংয়ের ব্যাপারটা কতকটা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করল। সুব্রত যে একটু আগে বিকাশকে বলছিল ছোষ্ট্র সিংকে সে জেরা করেছে, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে এই
দিন দুয়েক আগে ছোট্টু সিংকে সুব্রত কয়েকটা প্রশ্ন সত্যিই করেছিল। স্টেট সংক্রান্ত কাজের নির্দেশ নিয়ে ছোট্টু সিং সেদিন বিকেলের দিকে রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে সুব্রতর কাছে এসেছিল, কাজ হয়ে যাবার পর দু-চারটে অপ্রাসঙ্গিক কথাবাতার ফাঁকে আচমকা সুব্রত প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেছিল। ছোষ্ট্র সিং এ বাড়িতে মাত্র বছর পাঁচেক হল কাজ করছে, বয়েস চল্লিশের বেশী নয়। বেরিলীতে বাড়ি। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকের ও সীতনাথের অত্যন্ত বিশ্বাসের পাত্র। অন্দরমহলের পাহারাদারীর ভার ছোট্টু সিংয়ের ওপরই ন্যস্ত। লোকটা লম্বাচওড়া এবং গায়ে শক্তি রাখে প্রচুর। পরিধানে সর্বদাই প্রায়-ঈষৎ গোলাপী আভাযুক্ত আট-হাতি একখানা ধুতি। গায়ে সাদা মেজাই, মাথায় প্রকাণ্ড সাদা পাগড়ী। পায়ে লোহার নাল-বসানো হিন্দুস্থানী নাগরা জুতো। হাতে পাঁচহাত প্রমাণ একখানা স্টিলের পাত দিয়ে মোড়া তেল-চকচকে লাঠি। দাঁড়িগোঁফ একেবারে নিখুঁতভাবে কামানো। উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। কথায় কথায় ছোট্টু সিং বললে, কি বলব বাবু, আগাগোড়া ব্যাপারটা যে টেরই পেলাম না, না হলে–
কেন, তুমি তো ভেতরেই থাকতে!
থাকতাম তো বাবু, কিন্তু সেদিন সিদ্ধির নেশাটা বোধ হয় একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। বিছানার ওপরে সাঁঝ থেকেই কেমন ঝিম্ মেরে শুয়েছিলাম, অনেক হাল্লা চেঁচামেচি হতে তবে টের পেলাম।
বল কি! অত গোলমাল তুমি শুনতে পাওনি?
নেশা বড় বদ জিনিস বাবু, একেবারে অজ্ঞান করে দেয়। হুঁশ কি ছাই ছিল! কিন্তু একথা রাজাবাবু জানেন না, জানলে এখুনি আমার চাকরি চলে যাবে।
তাহলে তুমি সেরাত্রে দরজাটাও বন্ধ করেই রেখেছিলে, কি বল?
হ্যাঁ বাবু। দরোয়াজা তো সেই রাত্রি বারোটায় বন্ধ হয় সাধারণত। তার আগে দরোয়াজা বন্ধ করার হুকুম নেই, তবে সেদিন রাজাবাবুর হুকুমেই রাত্রি দশটায় দরজা বন্ধ করা হয়েছিল। তাছাড়া ভারী বজ্জাত ও লহাড়ী বাবু, বলব কি বাবু, শালা মরেছে তাতে আমার এতটুকুও দুঃখ হয়নি, ওর জ্বালায় রাত্রে কতবার যে আমাকে দরোয়াজা খুলে দিতে হয়েছে, যখন-তখন ও অন্দরে রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেত।
রাত্রেও বুঝি তিনি প্রায়ই রাজবাড়ির মধ্যে যেতেন?
হ্যাঁ বাবু, প্রায়ই। যত সলা-পরামর্শ রাজাবাবুর তা হত ঐ লহাড়ীবাবুর সঙ্গেই।
শুনেছি লাহিড়ীবাবু নাকি প্রায়ই রাত্রে রাজাবাবুর সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন?
হ্যাঁ বাবু। রাজাবাবু খুব ভালো দাবা খেলতে পারেন।
এর পর সুব্রত ছোট্টু সিংকে বিদায় দিয়েছিল সেদিনকার মত।
সুব্রতর মনে মনে খুবই ইচ্ছা ছিল সমগ্র রাজবাটীর অন্দরমহলটাও একবার ঘুরে দেখে। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারেনি আজ পর্যন্ত। এমন কোনো একটা ছল-ছুতো ও ভেবে ভেবে আজও বের করতে পারেনি, যাতে করে ওর ইচ্ছেটা ও পূরণ করতে পারে।
কিন্তু নৃসিংহগ্রামে যাবার আগে রাজবাড়ির ভিতর-মহলটা ও একটিবার দেখতে চায় এবং নিজের চোখে দেখবার যখন কোনো সুবিধাই নেই, বিকাশের উপরেই ওকে নির্ভর করতে হবে। সেই কথাটাই আজ ও বিকাশের কাছে উত্থাপন করবে, আগে হতেই ভেবে ঠিক করে এসেছিল।
ভৃত্য দুগ্লাস সরবৎ ও কিছু ফল ডিশে করে সাজিয়ে নিয়ে এল। দুজনে কথাবার্তা বলতে বলতে সরবৎ পান করছে, এমন সময় রাজবাড়ির একজন কর্মচারী সাইকেল হাঁকিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে বিকাশের হাতে একখানা খাম দিল, রাজাবাহাদুর পাঠিয়েছেন।
কি ব্যাপার সতীশ? বিকাশ ব্যগ্রভাবে প্রশ্নটা করতে করতেই খাম ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে দিল। চিঠিটা পড়তে পড়তে বিকাশের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সুব্রত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলে, কিসের চিঠি?
এখুনি আমাকে একবার উঠতে হবে মিঃ রায়। রাজাবাহাদুরকে কে বা কারা তাঁর নিজের শয়নকক্ষের হাতের উপরে ছুরি মেরে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল।
অ্যাঁ! সে কি! সুব্রত চমকে ওঠে।
দেখুন দেখি কি ঝামেলা! বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে বিকাশ বলে।
সতীশ স্তব্ধ হয়ে একপাশে আদেশের প্রতীক্ষ্ণয় দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি, এবারে সে প্রশ্ন করলে, আমি যেতে পারি হুজুর?
হ্যাঁ যাও, রাজাবাহাদুরকে বল গিয়ে এখুনি আমি আসছি।
উনি আহত হয়েছেন নাকি?
সে সম্পর্কে তো কিছুই লেখেননি। কেবল অনুরোধ জানিয়েছেন, এখুনি একবার যেতে।
সতীশ সাইকেলে উঠেছিল, সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, অন্ধকারে ভাল করে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি স্যার। রাজাবাহাদুর আপনাকেও যেতে বলেছিলেন রায়বাবু, কিন্তু আপনার বাসায় গিয়ে আপনাকে আমি দেখতে পেলাম না, চাকরও বলতে পারল না, আপনি কোথায় গেছেন!
তুমি যাও সতীশ, আমিও বিকাশবাবুর সঙ্গেই আসছি।
সতীশ আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে পা-গাড়িতে চেপে রওনা হয়ে গেল।