।। তেরো।। মিস থাম্পির অভিজ্ঞতা
সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে সঞ্জয় দেখল বাড়ি সরগরম। হাসি—গল্পে ভরপুর। একে মান্তু এসেছে সেই সঙ্গে সেই ম্যাড্রাসি মহিলা। তিনিও যে আসবেন, মান্তু ফোনে না বললেও, সঞ্জয় অনুমান করেছিল। রীণা তো এই মহীয়সী অতিথিটির আপ্যায়নে মহা ব্যস্ত।
আজ ওকে দেখলে কে বলবে এই রীণাই এই বাড়িতে এতদিন ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এমনকি ওর মুখের ওপর যে ফ্যাকাশে ভাবটা ছিল সেটাও যেন আজ আর নেই। রীণা ঠিক আগের মতোই প্রাণচঞ্চল, উচ্ছল হয়ে উঠেছে।
দেখে সঞ্জয়ের ভালো লাগল। কিন্তু দূর থেকে ওই মহিলাটিকে দেখে মোটেই ভালো লাগল না। বরঞ্চ তাঁর মুখখানা দেখে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল।
সঞ্জয়কে সিঁড়ির মুখে প্রথম দেখল মান্তু। হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সে।
—খুব তাড়াতাড়ি তো এসেছেন মশাই! এদিকে আমরা হোস্টের অপেক্ষায় বসে আছি। আসুন এ ঘরে। বলে সঞ্জয়কে একরকম টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল।
মিস থাম্পির সঙ্গে আলাপের পর্বটা মান্তুই সেরে দিল।
মিস থাম্পি হ্যান্ডশেক করে হেসে বললেন, আপনি ছিলেন না, আপনার বাড়িতে সম্ভবত আমার অনধিকার—প্রবেশ হয়ে গেছে।
সঞ্জয় সসংকোচে বলল, সে কী কথা! আমি না থাকলেও আমার স্ত্রীকে তো আপনার হাতেই দিয়ে গেছি। আপনি অনুগ্রহ করে এদের সঙ্গে এসেছেন এ আমার সৌভাগ্য।
মিস থাম্পি বললেন, আজ সকালে আপনার মিসেসের মুখে সব ব্যাপারটা শুনলাম। শুনে খুব কৌতূহল হল। ভাবলাম জায়গাটা একবার দেখেই আসি।
—ভালোই করেছেন। রীণা, চা—টা দিয়েছ তো?
রীণা ভ্রূভঙ্গি করে বলল, তুমি কি মনে করেছ, তুমি ছিলে না বলে হোস্টের কর্তব্য করতে পারব না?
মিস থাম্পি উত্তরটা শুনে খুব হাসলেন।
মান্তু, রীণা দুজনেই লক্ষ করল এ বাড়িতে এসে মিস থাম্পি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। এমন করে প্রাণখোলা হাসতে দেখা যায়নি। ভালোই লাগল।
—নিন মশাই, গরম চা। খেয়ে দেখুন আমার হাতে কীরকম লাগে। আর এটা কী বলুন তো?
—পাঁউরুটি তো দেখতেই পাচ্ছি। তা ছাড়া নিশ্চয়ই ঘুগনি।
—আশ্চর্য! এতও বোঝেন!
—তা আর এতদিনে বুঝব না? আপনার বান্ধবীটি তো ঘুগনি—স্পেশালিস্ট। সারা জীবনে ওই একটিই জলখাবার শিখে রেখেছেন।
—উঃ কী মিথুক! রীণা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল—সেদিন অমন নিজে হাতে কেক করলাম! কী বেইমান!
সঞ্জয় ততক্ষণে চামচে করে মুখে দিয়েছে। না, ঘুগনি নয়—মাংসের কিমা। সঞ্জয় আর কোনো মন্তব্য না করে চুপচাপ খেয়ে গেল।
মিস থাম্পি একটা শাল ভালো করে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
—আপনারা গল্প করুন। আমি একটু ঘুরে আসি।
মান্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—সন্ধে হয়ে গেছে। এখন কোথায় যাবেন এই ঠান্ডায়?
মিস থাম্পি টর্চটা নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, নীচটা একবার দেখে আসি।
রীণা বলল, একাই যাবেন? ওঁকে বলব?
মিস থাম্পি তাড়তাড়ি বললেন, না না, কাউকে লাগবে না। আমি এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই আছি।
আধঘণ্টার মধ্যেই মিস থাম্পি ফিরে এলেন। সঞ্জয় হেসে বললে, কিছু পেলেন?
মিস থাম্পি দাঁতের ফাঁকে একটু হাসলেন। ছেলেমানুষের মতো বললেন, বলব কেন?
কিন্তু সবাই লক্ষ করল ওঁর হাতে একটু শুকনো মাটি।
.
খেতে বসতে একটু রাত হল। একসঙ্গেই সবাই বসল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। রীণা মান্তুকে বলল, মিসেস লাহিড়ির বাড়ির ঘটনাটা একবার ওকে বল। বলে সঞ্জয়কে দেখিয়ে দিল।
সঞ্জয় মুর্গির হাড় চিবুতে চিবুতে নিস্পৃহ সুরে বলল, কী বলবেন? গল্প? তা বলুন শুনি।
—গল্প নয়, ঘটনা মশাই। আমরা দুজনেই তা স্বচক্ষে দেখলাম। বলে ঘটনাটা রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে গেল।
সঞ্জয় শুনে যে কোনো মন্তব্য করল না, মিস থাম্পি তা লক্ষ করলেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই ঘরে শুনলাম মাঝে মাঝে কারো আবির্ভাব হয়। আপনি ভয়টয় পান না তো?
সঞ্জয় হেসে বলল, না ম্যাডাম, ভয়টা আমার এমনিতেই কম। ভূত—প্রেতের ভয় তো জীবনে কোনোদিন করিনি। ওসব আমি মানিও না।
একটু থেমে বলল, তা ছাড়া আমি ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া—
—বিজ্ঞানই কি শেষ কথা? বিজ্ঞানের এক্তিয়ারের বাইরে কি কিছু থাকতে পারে না?
—থাকতে পারে। তবে তা নিয়ে অকারণে মাথা ঘামাবার মতো যথেষ্ট সময় আমার নেই।
মিস থাম্পি তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি মনে করেন এ বাড়িতে ও—সব কিছু নেই? সবটাই আপনার ওয়াইফের মনের ভুল?
সঞ্জয় সেই দৃষ্টির সামনে তাকাতে পারল না। চোখ নীচু করে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, এই তো গতকালই সারারাত এ ঘরে আমি একা ছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কোনো কিছুই দেখিনি, কোনো শব্দও না।
মিস থাম্পি বললেন, আপনার সঙ্গে তো তার ব্যাপার নয়। কাজেই আপনাকে শুধু শুধু দেখা দেবে কেন?
সঞ্জয় হেসে অবিশ্বাসের সুরে বলল, তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার স্ত্রীর সঙ্গেই শুধু তার কিছু ব্যাপার আছে। তাই সে তাকে ভয় দেখায়।
—হয়তো তাই।
—কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করব কী করে? বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ কই?
মিস থাম্পি একটু যেন কঠোর সুরে বললেন, এসব জিনিস জনসমক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
রীণা ইশারায় সঞ্জয়কে চুপ করতে বলল। সঞ্জয় চুপ করে গেল।
মিস থাম্পি তাঁর কথার জের ধরে বললেন, প্রমাণ দিতে আমিও পারব না, হয়তো প্রতিকারও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আজ রাতে একবার পরীক্ষা করে দেখব বলেই এলাম।
সঞ্জয় বলল, ভালো কথা। আপনি নিজে থেকে দেখুন কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা।
তারপর রীণার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আজই ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ হয়ে যাচ্ছে। কি বল?
রীণা কোনো উত্তর দিল না।
সঞ্জয় কথাটা বলল বটে কিন্তু বিশ্বাস না করেই। মিস থাম্পি যদি পরদিন সকালে কফি খেতে খেতে গল্প ফাঁদেন যে তিনিও সেই কালো—সুট—পরা লোকটিকে ‘স্বচক্ষে’ দেখেছেন তা হলেও সে বিশ্বাস করবে না। কেননা তা বিশ্বাস করা যায় না।
.
খাওয়া অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছিল। শীতের রাতও গভীর হয়ে উঠছিল।
হঠাৎই মিস থাম্পি রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা সিঁড়িটা সম্বন্ধে আপনার অভিজ্ঞতা কীরকম? তার মানে আমি বলতে চাইছি সিঁড়ি দিয়ে যখন আপনি ওঠা—নামা করেন তখন কি কিছু ফিল করেন?
রীণা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল, না তো!
সঞ্জয় হেসে বলল, রীণার মনে নেই—ওর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম দিনই বেচারি উঠতে গিয়ে আচমকা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।
মিস থাম্পি এক মুহূর্ত যেন থমকে গেলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
.
রাত সাড়ে দশটা বাজল। তবু কেউ শোবার নাম করছে না। মিস থাম্পিও না। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কলকাতার হালচাল জিজ্ঞাসা করছিলেন।
একসময়ে মান্তু বলল, মিস থাম্পি, আপনি যদি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে দু—একটা গল্প শোনান তাহলে শীতের রাতে বেশ জমবে।
একথায় মিস থাম্পি গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন আপনারা যাকে ‘গল্প’ বলেন, আমি দুঃখিত, সেরকম কিছু আমার জানা নেই। আমি সারাজীবন দেশ—বিদেশ ঘুরে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি তা গল্প নয়। তা নিয়েই আমার সাধনা। সেসব আমার নিজস্ব সম্পদ।
মান্তুর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বলল, excuse me! আমি দুঃখিত।
মিস থাম্পি আর কিছু বললেন না। কিন্তু পরিবেশটা ভারী হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ কাটল। তার পর নীরবতা ভাঙলেন মিস থাম্পি নিজেই। হাসতে হাসতে বললেন, আমার কথায় আপনারা ক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারছি। আচ্ছা, একটা সত্য ঘটনা বলছি শুনুন, যার মীমাংসা এখনো হয়নি।
মিস থাম্পি একটু থামলেন। সকলেই নড়েচড়ে বসল। কেবল সঞ্জয়ের মধ্যে তেমন কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেল না।
—কলকাতা থেকে কাল আমার ভুটান যাবার কথা। ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পেয়েছি। বলে মিস থাম্পি থামলেন। সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ডাঃ গুপ্ত, ঘটনাটা আপনার বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এঁদের শোনাচ্ছি। ‘অলৌকিক’ শব্দটা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি এবং নানা প্রসঙ্গে ব্যবহারও করে থাকি। অলৌকিক অর্থাৎ এমন—কিছু যা বাস্তব জীবনে সচরাচর ঘটে না বা যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক সাধকই তাঁদের কঠোর সাধনালব্ধ বিভূতি বা অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তন্ত্রমন্ত্রের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। আমাদের দেশের বৌদ্ধ আর হিন্দু তান্ত্রিকেরা নির্জনে এমন অনেক কিছু করতেন যা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে।
মিস থাম্পি একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, অনেকের বিশ্বাস বৌদ্ধরাই আদি তান্ত্রিক।
এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও একটা কথা মনে রাখবেন—এই তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তি হিমালয় অঞ্চলে। অর্থাৎ কৈলাস, চিন, নেপাল, তিব্বত প্রভৃতি জায়গায়।
আমার এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য অলৌকিকতত্ত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বোধহয় নেপাল, তিব্বত, ভুটানেই বেশি। এই অলৌকিকতত্ত্বের মধ্যে প্রেততত্ত্বও জড়িয়ে আছে।
দুঃখের বিষয় অলৌকিকতত্ত্ব ও প্রেততত্ত্ব এখন ভয়—পাওয়ানো গাঁজাখুরি গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারও একটা কারণ বোধহয় এই যে, মানুষ ভয় পেতেও চায়। অশরীরী আত্মা আর তথাকথিত ভূত—প্রেত এক কথা নয়। কিন্ত সে কথা সাধারণ মানুষকে বোঝানো যায় না। অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব আছে। অনেকেই তা প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকি তাদের কথা বলতেও শুনেছে। আশ্চর্য নয় কি? দ্বন্দ্ব এখানেই, আমি বলব আত্মা শরীর ধারণ করতে পারে—যে শরীর দেখা যাবে কিন্তু স্পর্শ করা যাবে না—যে শরীর কোনো চিহ্ন রেখে যেতে পারে না। ডাঃ গুপ্ত বলবেন, অসম্ভব। কিন্তু মিসেস গুপ্ত যাঁকে প্রায়ই দেখেন তিনিও যে ওইরকম কোনো শরীরী আত্মা তা আমি বিশ্বাস করি। কেননা ওই ধরনের শরীরী আত্মার আমি প্রত্যক্ষদর্শী।
একটু থেমে বললেন, শরীর ধারণ ছাড়াও এই আত্মার আবার অন্যরকম প্রক্রিয়াও আছে। জানেন কি যোগীরা তাঁদের অসাধারণ ক্ষমতায় নিজেদের দেহ থেকে আত্মাকে কিছুকালের জন্যে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারতেন? সেও এক অলৌকিক ব্যাপার—বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
মিস থাম্পি রীণার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ঘুম পাচ্ছে?
রীণা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে বলল, না। আপনার কথা শুনতে বেশ ভালোই লাগছে।
মিস থাম্পি হেসেই বললেন, ধন্যবাদ।
বেশ, তাহলে প্রথমে যোগীদের দেহ থেকে আত্মাকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করার একটা ‘গল্প’ বলি। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
সঞ্জয় চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললে, চালিয়ে যান।
—অনেক দিন আগের কথা। এক ইংরেজ দম্পতি ভারতে কার্যরত থাকাকালীন বায়ু পরিবর্তনের জন্যে সিমলা পাহাড়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজ ভদ্রলোক ছিলেন ব্রিটিশ—ভারতের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। দেশ তাঁর ইংলন্ডে।
সিমলায় আসবার আগেই মেমসাহেবের শরীর খারাপ হয়েছিল। অল্প অল্প জ্বর হত। সেটা খুব খারাপ লক্ষণ। সিমলাতে চেঞ্জে এসেও শরীর ঠিকমতো সারল না।
এই সময়েই আবার এক দুঃসংবাদ এল, সাহেবের বাবা লন্ডনে মারা গেছেন। সেই খবর পেয়েই সাহেব চলে গেলেন। মেমসাহেব শরীর খারাপের জন্য যেতে পারলেন না।
লন্ডনে পৌঁছে সাহেব নিয়মিত চিঠি দিয়ে স্ত্রীর খবর নিতেন। প্রতি চিঠিতেই আশ্বাস—শিগগিরই যাচ্ছি।
মেমসাহেব পথ চেয়ে থাকেন। কিন্তু বেশ কিছুকাল হয়ে গেল—স্বামী আর ফেরেন না। চিঠিপত্রও পান না। তাঁর মন খুব খারাপ।
একদিন ভোর রাত্রে মেমসাহেব ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠলেন। ঘরে তাঁর যে খাস—পরিচারিকা ছিল সে ইংরেজ রমণী। তাড়াতাড়ি মেমসাহেবের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
মেমসাহেব পরিচারিকার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলার জন্যে লজ্জিত হলেন। বললেন, স্বপ্ন দেখছিলাম সাহেব কঠিন রোগে মৃত্যুশয্যায়। তাই তিনি আসতে পারছেন না।
মেমসাহেব খাঁটি ইংরেজ মহিলা। তাই স্বপ্নকে স্বপ্ন বলেই মেনে নিলেন। গুরুত্ব দিলেন না।
কিন্তু গুরুত্ব না দিলেও তাঁর মনটা অত্যন্ত ভার হয়ে রইল।
মেমসাহেবের অন্য যে দাসী, সে ছিল তিব্বতীয়। মনিবের মন খারাপ তারও দৃষ্টি এড়ায়নি। রোজই দেখে—আর ভাবে মেমসাহেবকে জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। শেষে খাস—পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করে কারণটা জানতে পারল। তখন সে সসংকোচে তাকে বলল, মেমসাহেব যদি চান তাহলে সাহেবের খবর আজকের মধ্যেই আনিয়ে দিতে পারি।
খাস—পরিচারিকা অবাক হয়ে বলল, কী করে?
তিব্বতী দাসী তখন তাকে তার উপায়ের কথা জানাল।
ইংরেজ দাসী তা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও এ দেশের অনেক ভোজবাজির কথা ছোটোবেলা থেকে শুনেছে। তাই তিব্বতীর কথা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে মেমসাহেবকে বলল। মেমসাহেব তখনই তিব্বতী দাসীকে ডেকে পাঠালেন। দাসী এলে তাকে বললেন, তুমি যে লোকটির কথা বলছ সে কী করে? কোথায় থাকে?
দাসী বিনীতভাবে জানাল যে, যাঁর কথা সে বলছে তিনি একসময়ে লামা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কী কারণে যেন তিনি সেই পদ ছেড়ে দিয়ে এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে একটা পাহাড়ের নীচে আত্মগোপন করে থাকেন।
মেমসাহেব সকৌতূহলে জিজ্ঞেস করলেন, আত্মগোপন করে কেন?
দাসী বললে, তিনি এক বিশেষ সাধনায় সিদ্ধ বলে ঈর্ষাকাতর অন্য দল তাঁকে মেরে ফেলতে চায়।
শুনে মেমসাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
—সত্যিই তিনি এত গুণী লোক?
—হ্যাঁ, মেমসাহেব, আমি নিজে চোখে তাঁর সেই গুণ দেখেছি।
—কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে তাঁকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আর পেলেও হয়তো আসতে চাইবেন না।
দাসী অন্যমনস্কভাবে বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি পাওয়া যায় তাহলে আজই উনি সাহেবের খবর এনে দেবেন।
মেমসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কত দূরে—কোন পাহাড়ের নীচে উনি থাকেন?
দাসী বলল, এখান থেকে ক্রোশ তিনেক দূরে—ওই যে ধোঁওয়ার মতো তিনচুড়ো পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ওরই কাছে উনি থাকেন।
মেমসাহেব বললেন, উনি যদি তোমার কথায় আসতে না চান—আমি কি গিয়ে request করব?
দাসী বলল, তার দরকার হবে না। তা ছাড়া পথ দুর্গম। গাড়ি চলবে না। আপনার পক্ষে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়।
মেমসাহেব চুপ করে রইলেন। দাসী বলল, আর তাঁর কাছে যেতে হলে যেতে হবে গোপনে। কেননা তাঁর শত্রুরা তঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
শুনে মেমসাহেব হতাশ হয়ে পড়লেন। তখন দাসী বলল, আপনি অনুমতি করলে আমি নিজে গিয়ে একবার চেষ্টা করতে পারি।
মেমসাহেব সানন্দে অনুমতি দিলেন।
পরের দিন ভোরবেলায় তিব্বতীয় দাসীটি লামার খোঁজে বেরিয়ে গেল। আর সন্ধেবেলা ফিরল লামাকে নিয়ে।
লামা এসেছে শুনে মেমসাহেব খুশি মনে দোতলা থেকে নেমে এলেন। কিন্তু লামার চেহারা দেখে তাঁর ভক্তি হল না। যেমন আমাকে দেখে আপনাদের হয়েছে। বলে মিস থাম্পি একটু হাসলেন।
—যাক, যে কথা বলছিলাম। মেমসাহেব দেখলেন লোকটি বৃদ্ধ। মাথায় দীর্ঘ পাকা চুল, পাতলা পাকা গোঁফ—দাড়ি। হাত, পা শীর্ণ। দেহ তো নয় যেন একখানা কঙ্কাল। দুই চোখ কোটরাগত। চোখের নীচে কালি পড়েছে। তাঁর সারা মুখের চামড়া কুঁচকানো। গলায় নীল পাথরের একটা মালা। অমন গাঢ় নীল পাথর মেমসাহেব কখনো দেখেননি।
লোকটি এমন ক্ষীণ স্বরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল যে মেমসাহেব তার একবর্ণও বুঝতে পারছিলেন না। যাই হোক সেই তিব্বতী দাসীর সাহায্যে কথাবার্তাটা এইরকম হল—
মেমসাহেব বললেন, শুনেছি আপনার নাকি এমন ক্ষমতা আছে যে আপনি এখানে বসেই বহুদূরের খবর এনে দিতে পারেন। তাই যদি হয় তাহলে আপনি দয়া করে আমার স্বামীর খবর জানান। তিনি এখন লন্ডনে আছেন। বেশ কিছু দিন খবর পাচ্ছি না। স্বপ্নে দেখলাম তিনি নাকি শয্যাশায়ী। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।
লামা পথশ্রমে ক্লান্ত বলে সেদিনটা বিশ্রাম করে পরের দিন খবর এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
কিন্ত মেমসাহেব আর এক দণ্ডও অপেক্ষা করতে চাইলেন না। অগত্যা বৃদ্ধ লামাকে সম্মত হতে হল। তখন শ্রাবণ মাসের বেলা প্রায় শেষ। লামা প্রথমে আনুষঙ্গিক কতকগুলি কাজ শেষ করে নিয়ে সাহেবের ঠিকানা জেনে নিলেন। আর তাঁর একটা ছবি দেখে নিলেন। তারপর খালি গায়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে বললেন, আমি আপনার স্বামীর খবর আনতে চললাম। আমার দেহ এখানে পড়ে রইল। যদি বাধা—বিঘ্ন না ঘটে তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব। তবে একটা অনুরোধ—আমার জীবন—মরণ সব দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।
মেমসাহেব চমকে উঠলেন।—কেমন করে?
লামা বললেন, আমার দেহ যেন কেউ স্পর্শ না করে, এইটুকু দেখবেন।
—নিশ্চয়ই দেখব। মেমসাহেব প্রতিশ্রুতি দিলেন।
—আরও একটি কথা—আমি যখন এখানে আসছিলাম, বুঝতে পারছিলাম আমার শত্রুরা আমায় অনুসরণ করছে। তারা হয়তো একটু পরেই এখানে এসে হানা দেবে। আমার দেহটা কেড়ে নিয়ে যেতে চাইবে। আপনি দয়া করে বাধা দেবেন। কথা দিন—পারবেন তো?
মেমসাহেব ইংরেজ রমণী। অসুস্থ হলেও তাঁর মনের জোর ছিল অসাধারণ। সব দিক ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। দায়িত্ব নিলাম। আপনি নিরুদ্বেগে গিয়ে আমার স্বামীর খবর নিয়ে আসুন।
এই অঙ্গীকার পেয়ে লামা যোগনিদ্রায় সমাহিত হলেন। সকলেই দেখলেন লামার অসাড় দেহটা মাটিতে পড়ে আছে যেন বহুকালের পুরোনো শুকনো একটা মৃতদেহ।
এই সময়ে তিব্বতী দাসীর খেয়াল হল নীচের দরজাটা বোধহয় খোলাই থেকে গিয়েছে। সে নিজেই দেখতে যাবে ভাবছিল কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক লামার দেহ ছেড়ে নীচে যেতে মন চাইল না। তখন সে দরজা বন্ধ করার কথা ইংরেজ পরিচারিকাটিকে নীচু গলায় বলল।
ইংরেজ পরিচারিকা ‘যাচ্ছি’ বলেও সকৌতূহলে লামার নিঃসাড় দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। যাবার কথা ভুলে গেল।
আধঘণ্টাও হয়েছে কি না সন্দেহ হঠাৎ নীচে একটা গোলমাল শোনা গেল। কারা যেন দারোয়ান—বেয়ারা—বাবুর্চিদের ঠেলে জোর করে ওপরে উঠে আসতে চাইছে।
মেমসাহেব বিচলিত হলেন। কীসের এত গোলমাল? তিনি ইংরেজ দাসীকে ব্যাপারটা কি জেনে আসবার জন্যে পাঠালেন। ইংরেজ দাসী ত্রস্তপদে নিচে নেমে গেল। কিন্তু পাঁচ মিনিট যেতে—না—যেতেই ছুটতে ছুটতে এসে জানাল একদল জংলি জোর করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারা লামাকে চায়।
—কেন? মেমসাহেবের ভুরুতে ক্রোধের প্রকাশ ফুটে উঠল।
ইংরেজ দাসী উত্তর দেবার আগেই মেমসাহেব দেখলেন কয়েকজন তিব্বতী জংলি দোতলায় উঠে হই হই করে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।
মেমসাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেন—.Who are you? What makes you to come here?
তারা মেমসাহেবের কথা বুঝল না। বুঝতে চাইলও না। তাদের সকলের দৃষ্টি তখন লামার দেহের ওপর। বাড়িতে তেমন লোকজন নেই যে সেই উন্মত্ত লোকগুলোকে বাধা দেয়। জংলি লোকগুলো বোধহয় তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা নির্ভয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
ইংরেজ দাসী তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সে পুলিশ ডাকার জন্য জানলার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, মেমসাহেব তাকে আটকালেন। কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।
তারপর এক মিনিটের মধ্যে ছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে গুলিভরা রিভলভারটা এনে দু—বার ফায়ার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো যে যেদিকে পারল পালাল।
—যাও! দরজা লাগিয়ে এসো। বলে মেমসাহেব ইজিচেয়ারে বসে হাঁপাতে লাগলেন। তাঁর শরীর একেই দুর্বল, তার ওপর এই উত্তেজনা। রিভলভারটা কিন্তু তখনো তাঁর হাতের মুঠোয়।
তিব্বতী দাসী তখনও লামার দেহের ওপর—তাকে স্পর্শ না করে দু—হাত দিয়ে আগলে বসে ছিল।
এবার সে উঠে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
আরো আধঘণ্টা পরে লামার দেহটা একটু নড়ল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল।
মেমসাহেব আনন্দে লামার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। লামা ইশারায় একটু জল খেতে চাইলেন। মেমসাহেব তিব্বতী দাসীকে জল দিতে বললেন।
জল খেয়ে সেই লামা যোগী আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। তারপর তাঁর সেই ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনার স্বামী ভালোই আছেন। দেখলাম জিনিসপত্র গোছগাছ করছেন। বোধহয় আজ—কালের মধ্যেই এখানে আসার জন্যে রওনা হবেন।
শুনে মেমসাহেব আনন্দে কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন।
তারপর লামা ধীরে ধীরে তাঁর ঘরের বর্ণনা দিলেন। শুনতে শুনতে মেমসাহেব তো অবাক। শেষে লামা বললেন, তবে আপনার বাড়ির দক্ষিণদিকে যে সুন্দর বাগানটা ছিল সেটা সম্প্রতি ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে।
বাগানটাও যোগীর চোখে পড়েছে তা হলে! মেমসাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
লামা সেই রাত্তিরেই চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু মেমসাহেব যেতে দিলেন না। পরের দিন অতি প্রত্যুষে যাবার সময়ে লামা মেমসাহেবের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মেমসাহেবও চোখ নামাতে পারেননি।
মিনিট দুয়েক পরে লামা বললেন, আপনি এখন রোগমুক্ত। বলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মেমসাহেব তাঁকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না।
মেমসাহেব নিজের মনেই শুধু বললেন—.I am grateful to you Indian yogi–I am grateful.
পরের দিনই সাহেবের চিঠি এল। লিখছেন—একটা মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক ঈশ্বরের কৃপায় এখন আমি বিপদমুক্ত। রওনা হচ্ছি।
পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন—খুব আশ্চর্য ব্যাপার হঠাৎ কাল আমার ঘরের সামনে একজন ইন্ডিয়ান যোগীকে দেখলাম। তারপরেই অদৃশ্য। সম্ভবত আমার চোখেরই ভুল।
মিস থাম্পি তাঁর কথা শেষ করে একটু থামলেন। তার পর জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছলেন।
—এ কাহিনি আপনাদের শোনাবার উদ্দেশ্য এটাই বোঝানো যে, এও এক ধরনের অলৌকিক ক্রিয়া। কিন্তু এটা ম্যাজিক বা জাদু নয়। এ যোগসাধনা। এই যোগের দ্বারাই আপনি এই মুহূর্তে কী ভাবছেন তা বলে দেওয়া যায়। এই যোগের দ্বারাই আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনার জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটবে কি না জানানো যায়। কঠিন ব্যাধির কারণ ও উৎপত্তিস্থল ধরা যায়।
এই যোগে যাঁর আয়ত্ত তিনি তেমন—তেমন বাড়িতে ঢুকেই বলতে পারেন সেখানে কোনো অশরীরী আত্মার আবির্ভাব ঘটে কিনা। বিজ্ঞানে কিন্তু এর ব্যাখ্যা মেলে না।
অশরীরী আত্মার টের পাওয়া যায়—মিস থাম্পির এই কথায় সকলেই যেন একটু বিচলিত হল।
একটু থেমে মিস থাম্পি বললেন, এরকম অনেক তথ্য রবার্ট ডাল আওয়েল—এর ‘Foot falls on the Boundary of Another World’ বইটিতে পাওয়া যায়। পুরোনো কোনো বড়ো লাইব্রেরিতে খোঁজ করলে দেখতে পারেন—of course should you be so interested.
মিস থাম্পি থামলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাড়ে বারোটা।
গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেছে। মিস থাম্পি বললেন, তাহলে এবার শুতে যাওয়া যাক?
মান্তু বলল, কিন্তু আপনি ভুটানে কেন যাচ্ছেন বললেন না তো?
—শুনতে চান?
—নিশ্চয়ই। মান্তু আর রীণা দুজনেই উৎসাহে বলে উঠল।
—আপনি? মিস থাম্পি সহাস্যে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।
সঞ্জয় সলজ্জভাবে বলল, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কাল সকালেই তো আবার ছুটতে হবে।
রীণা বলল, তুমি তবে ওঘরে গিয়ে শোও গে।
সঞ্জয় অবশ্য গেল না। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল।
মিস থাম্পি বললেন, বিস্তৃত করে বলতে গেলে রাত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি। —ভুটানে যাচ্ছি সেখানকার একটি মেয়েকে স্টাডি করতে। ডাঃ কুমার আমার খুব পরিচিত। তিনি সম্প্রতি সাদার্ন ভুটানের ডিস্ট্রিক্ট টাউন সারভং—এ গিয়েছেন সেখানকার হাসপাতালের এম. ও. হয়ে। ওখান থেকে তিনি আমায় কয়েকখানা চিঠি লিখেছেন।
ডাঃ কুমার ওখানে কোয়ার্টারে একা থাকেন। রাঁধা—বাড়া করার জন্যে উনি একটি লোক খুঁজছিলেন। অনেক কষ্টে একটি মেয়ে পান। মেয়েটির নাম সুখমতী। বয়েস উনিশ—কুড়ি। মেয়েটি কথা বলে না। কিন্তু সে বোবা নয়। কেননা সে শুনতে পায়। মেয়েটির কোনো অভিব্যক্তি নেই। শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। সে সারাদিন কোয়ার্টারে থাকে। কিন্তু ঠিক রাত নটা বাজলেই সে বাড়ি চলে যায়। ব্যতিক্রম হয় না।
ডাঃ কুমার হুঁশিয়ার লোক। তিনি যখনই কোনো কাজের লোক লাগান তখনই তার ঠিকানা নিয়ে রাখেন। সুখমতীরও ঠিকানা নিয়েছিলেন।
এদিকে সুখমতী কাজে লাগার দুদিন আগে পাহাড়তলিতে একটা জিপ অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেটাও নাকি অদ্ভুত ঘটনা। যাই হোক, জিপে যে সব লোক ছিল তারা সবাই থেঁতলে মরে যায়। ওদের মধ্যে একটি যুবতী মেয়ে ছিল। তার লাশ কিন্তু পাওয়া যায়নি। অথচ সেই নিদারুণ অ্যাকসিডেন্ট থেকে কেউ যে বেঁচে পালাবে তাও নাকি অসম্ভব।
যাই হোক, সেদিনের মতো লাশ তিনটে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি—ঘরের কাছে রাখা হয়।
একদিন হাসপাতালের দারোয়ান দীন বাহাদুর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ কুমারকে বলল, সাব, বকসী!
—ওদেশে ভূতকে বকসী বলে।
ডাঃ কুমার অবাক হয়ে বললেন, বকসী! কোথায়?
দীন বাহাদুর বলল, ল্যাবরেটরির পাশে যে ঘরে লাশ ছিল সেখানে।
তার বক্তব্য—রাত্রে পাহারা দিতে দিতে ও একটা শব্দ শুনে লাশ—ঘরের দিকে যায়। সেখানে একটি গোঙানি শুনতে যায়। কৌতূহলী হয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যেখানে তিনটে লাশ ছিল সেখানে একটা মেয়ে শোবার জায়গা করে নিতে চাইছে। কিন্তু যেন কিছুতেই জায়গা পাচ্ছে না। মেয়েটার গায়ে জামা—কাপড় কিছুই ছিল না।
তারপর যে কথাটি দীন বাহাদুর নাকি এতটুকু ইতস্তত না করেই বলে ফেললে তা এই যে—সে মেয়েটি সুখমতী ছাড়া আর কেউ নয়।
ডাক্তার কুমার তো চমকে উঠলেন। তিনি অবিশ্বাস করলেন। দীন বাহাদুর হলপ করে বলল, সে খুব ভালো করে নজর করে দেখেছে সে সুখমতীই।
ডাক্তার কুমার তবু যখন বিশ্বাস করতে চাইলেন না তখন দীন বাহাদুর বলল, ঠিক আছে আজই দেখা যাক, সুখমতী রাত্তিরে কী করে।
সেদিনও সুখমতী ঠিক রাত ন’টার কাজ সেরে চলে গেল। দীন বাহাদুর তখন ডাক্তার কুমারের কোয়ার্টারে। সুখমতী যখন চলে যাচ্ছে দীন বাহাদুর তখন ফিস ফিস করে বলল, সাব, দেখুন ওর হাঁটাটা কী রকম।
ডাঃ কুমার এতদিন লক্ষ্য করেননি। আজ দেখলেন—হ্যাঁ, হাঁটাটা একটু অস্বাভাবিক। কেমন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তার লম্বা হাত দুটো যেন বড্ড বেশি দুলছিল।
রাত দুটোয় ডাক্তারকে নিয়ে দীন বাহাদুর সুখমতীর ঠিকানা খোঁজ করতে বেরোল। বেরোবার আগে একটুকরো ন্যাকড়া ডাক্তারের হাতে দিয়ে বলল, এটা সঙ্গে রাখুন সাব। অনিষ্ট করতে পারবে না।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর যে ঠিকানাটা ওরা খুঁজে পেল সেটা একটা ভাঙা ঘর, একেবারে লোকালয়ের বাইরে।
—সুখমতী—সুখমতী করে ডাক্তার ডাকাডাকি করলেন। কিন্তু কারো সাড়া পেলেন না। তখন দুজনে দুটো টর্চ জ্বেলে ভেতরে ঢুকলেন। কেউ কোথাও নেই। শুধু সুখমতীর ছাড়া কাপড়টা পড়ে আছে।….
এই পর্যন্ত বলে মিস থাম্পি থামলেন।
—খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। এ বিষয়ে আপনার কী মনে হয়? মান্তু জিজ্ঞেস করল।
—আগে ভুটানে গিয়ে সুখমতীকে দেখি। নিজে না দেখে, না কথা বলে আমি কোনো কমেন্ট করব না। তবে আমার শুধু একটাই জানার আছে—সুখমতী কেন চাকরি নিল? কেন ডাক্তার কুমারের কাছেই? কিন্তু আর নয়। এবার সবাই শুয়ে পড়ুন ।
.
শীতের রাত। গোটা শহর যেন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সামনে যশোর রোড যেন দেহ প্রসারিত করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। ওদিকে সঞ্জয় বসে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা হেলে পড়েছে চেয়ারে। শুধু এরা তিনজনই জেগেছিল এতক্ষণ।
এই সময়ে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠা। রীণা চমকে উঠে ছুটে গিয়ে পুপুকে বুকে তুলে নিল। ঘুম ভেঙে গেল সঞ্জয়ের। লাফিয়ে ছুটে গেল পুপুর বিছানায়। এ কান্না তাদের চেনা।
মান্তু ‘কী হল? কী হল?’ বলে রীণার কাছে গিয়ে বসল। শুধু মিস থাম্পি স্থির হয়ে বসে পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কান্না থামে না। দেখতে দেখতে পুপুর সমস্ত মুখটা যেন কী রকম হয়ে গেল। রীণা আর্তস্বরে বলে উঠল—কী হবে? কান্না থামছে না যে?
রীণা জানে, এ কান্না থামাবার সাধ্য ডাক্তারের নেই।
মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। একবার ভুরু কুঁচকে খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। তারপর গায়ের চাদরটা ফেলে দিয়ে পুপুর কাছে এগিয়ে গেলেন। পুপু তখন কাঁদতে কাঁদতে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। রীণা পাগলের মতো মিস থাম্পির হাত দুটো চেপে ধরে কেঁদে উঠল। কী হবে? এমন করে তো ও কখনো কাঁদে না।
সেই অশরীরীর আবির্ভাব হলেই যে পুপু কেঁদে ওঠে, মিস থাম্পি আগে তা শুনেছিলেন। তিনি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ পুপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে আস্তে একবার তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। রীণাকে বললেন, তুমি এবার ওকে বুকে তুলে নাও।
—ও ঘুমোতে পারবে না। দেখছেন না—
—আমি বলছি, ঘুমোবে। তুমি বুকে নাও। আদেশের সুরে বললেন মিস থাম্পি।
রীণা পুপুকে বুকের কাছে টেনে নিতেই পুপুর কান্না আস্তে আস্তে থেমে গেল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
এবার মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। স্থির গম্ভীর স্বরে বললেন, সে বোধহয় এসেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন।
সঞ্জয়ও কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে যে আজ কোথায় শোবে ভেবে পেল না।
মিস থাম্পি বললেন, শোবার ব্যবস্থা আমিই করে দিচ্ছি।
—বাইরের ঘরে এই ডিভানে মিসেস গুপ্ত যেমন বাচ্চাকে নিয়ে শুয়েছেন শোন। আপনি শোন মেঝেতে এইখানে। বলে মান্তুকেও জায়গা নির্দেশ করে দিলেন।
—ডাঃ গুপ্ত, আপনি প্লিজ চলে যান ভেতরের ঘরে। নিশ্চিন্তে ঘুমোন গিয়ে।
—আপনি?
মিস থাম্পি একটু হাসলেন।—আমি শোব না। বসে থাকব সিঁড়ির মুখে। আজকের রাতের মতো আমার কথা অনুগ্রহ করে শুনবেন। বলে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউই ঘুমোতে পারল না। কীসের যেন দুঃসহ প্রতীক্ষা! তারপর এক সময়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
সবার আগে ঘুম ভাঙল মান্তুর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রীণার। দুজনেই একবার মুখ চাওয়া—চাওয়ি করল। রাত্তিরটা তাহলে নিরাপদেই কেটেছে।
সঞ্জয় তখনো ঘুমোচ্ছে। কিন্তু মিস থাম্পি? তিনি কি এখনও বাইরে বসে আছেন?
তাড়াতাড়ি এরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মিস থাম্পি নেই। শূন্য চেয়ারটা শুধু পড়ে রয়েছে।
দুজনের মুখ শুকিয়ে গেল।
—উনি কোথায় গেলেন? মান্তুর গলার স্বর ভয়ে কাঁপছে।
—তাই তো। বলেই রীণা সঞ্জয়কে ঘুম থেকে তুলে সব কথা বলল। সঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল।
তখনো ভোর হয়নি। শীতের কুয়াশায় চারিদিক পর্দাঢাকা। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেরা তখনো সুখনিদ্রায় নিশ্চিন্ত।
সঞ্জয় কী করবে ভাবছে। এমনি সময়ে সিঁড়িতে হালকা চটির শব্দ। মিস থাম্পি ওপরে উঠে আসছেন।
—বাবাঃ! এই কুয়াশায় কোথায় গিয়েছিলেন?
মিস থাম্পি হেসে বললেন, প্রাতঃভ্রমণে। কম্পাউন্ডের মধ্যেই ঘুরছিলাম। বেশ পুরোনো আমলের বাড়ি। ফোয়ারার সামনে যে স্ট্যাচুটা—সেটা কোনো অবস্থাপন্নরই কীর্তি। তাঁর রুচিটা পবিত্র ছিল না। চলুন ভেতরে গিয়ে বসি। একটু গরম কফি খাব।
কফি খেতে খেতে সকলেই উদগ্রীব হয়ে মিস থাম্পির দিকে তাকিয়ে রইল কিছু শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু মিস থাম্পি একটিও কথা বললেন না।
কফি খাওয়া শেষ হলে মান্তুকে বললেন, এবার আমাদের যেতে হবে।
সঞ্জয় আর থাকতে পারল না। বলল, কিন্তু কাল রাত্তিরের experience তো কিছু বলছেন না।
—বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?
মিস থাম্পি একটু হাসবার চেষ্টা করলেন।
—শুনতে দোষ কি?
—তবে শুনুন। একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র আত্মা এ বাড়িতে আছেই। সে ক্ষতি না করে যাবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। প্রমাণ দিতে পারব না।
—তাহলে, আপনি বলছেন রীণা যা দেখে তা ঠিক?
—হ্যাঁ। অবশ্যই।
—প্রতিকার?
—আমার মনে হয় বাড়িটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সে কী করে সম্ভব? আমি নিজে ডাক্তার। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব মানতে পারি না।
মিস থাম্পি তাঁর বিশেষ হাসিটি একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।
আধঘণ্টার মধ্যেই মান্তু আর মিস থাম্পি প্রস্তুত হয়ে নিল। যাবার সময় মিস থাম্পি বললেন, ডাঃ গুপ্ত, আপনার সংস্কারমুক্ত মন আর সাহসের প্রশংসা করি। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রাখবেন—যদি দেখেন আপনার ছেলেটি ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তা হলে তদ্দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে দেবেন।—বলে হাতে ব্যাগটা তুলে নীয়ে নিচে নামতে লাগলেন।
রীণা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।