সকালবেলা আমাদের বাসস্থান থেকে বেরুলেই দেখতে পাই চতুর্দিকে টুরিস্টদের মেলা। ওয়ারশ শহরের এই ‘ওল্ড টাউন’ টুরিস্টদের অবশ্য দ্রষ্টব্য। একটা প্রকাণ্ড চত্বর ঘিরে সব পুরোনো আমলের বাড়ি, গির্জা, মিউজিয়াম। অনেক রকম জিনিসপত্তর নিয়ে সকাল থেকেই এখানে বসে যায় সার সার নারী-পুরুষ ফেরিওয়ালা। কাছাকাছি অনেক বিখ্যাত হোটেল-রেস্তোরাঁ, খুচরো খাবারের দোকান। খোয়া-পাথর বাঁধানো এই চত্বরটায় ঘুরলে খানিকটা মধ্যযুগীয় আবহাওয়া অনুভব করা যায়। আবার একটা বিস্ময়বোধও জেগে থাকে। এই যে সব বিশাল বিশাল প্রাসাদ, এর কোনওটাই আসল নয়, সব নকল। গোটা পুরোনো শহরটাই প্রকৃতপক্ষে অর্বাচীন।
ওয়ারশ শহরের প্রায় পুরোটাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পোলিশ জাতি দারুণ অধ্যবসায়ে সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে সমস্ত পুরোনো বাড়িগুলো আবার নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছে। ঐতিহ্য রক্ষা করার প্রতি মমতায় তারা পুরোনোর জায়গায় নতুন গড়েনি, সবকিছুই পুনর্নির্মাণ করেছে। কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সর্বত্রই ঐতিহ্য রক্ষার এই আন্তরিক প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাড শহরে এবং অন্যত্র অনেক ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক বাড়ি আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে হুবহু আগের মতন গড়ে তোলা হয়েছে। চিনেও আছে এরকম সংরক্ষণের নিদর্শন। একমাত্র রুমানিয়ায় চাউসেস্কু ঐতিহ্যের কোনও তোয়াক্কা করেননি, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর আমল থেকেই নতুন ইতিহাস শুরু হোক। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে এবং তাঁর পত্নীকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করল নির্দয়ভাবে।
নাতসিরা ওয়ারশ শহরটা দখল করেও এক সময় ক্রুদ্ধ হয়ে পুরো শহরটা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। যুদ্ধের সময় অন্যান্য অনেক শহর ধ্বংস হয়েছে বোমাবর্ষণে, কিন্তু ওয়ারশ ধ্বংস হয়েছিল ডিনামাইটে। যে কারণ উপলক্ষে এমনটি ঘটেছিল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যেমন চরম দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে পোল্যান্ডকে, তেমনি পোলিশ জাতি অসম সাহসিকতারও পরিচয় দিয়েছে। অসম্ভব অমানুষিক অত্যাচারেও তারা মাথা নত করেনি। পোলান্ড কোনও কুইশলিং-এর জন্ম দেয়নি। যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই তারা বিনা প্রতিরোধে এগোতে দেয়নি জার্মানদের। ডানজিগ বন্দরে মাত্র ১৮৯ জন পোলিশ বীর সাতদিন ধরে শ্লেসুইটগ হলস্টিন নামে রণতরীকে আটকে রেখেছিল। পশ্চিম সীমানা দিয়ে যখন জার্মান ট্যাংক বাহিনী ঢোকে তখন তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়েছিল পোল্যান্ডের পো মোরস্কা বিগ্রেড নামে অশ্বারোহী বাহিনী। কামানের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লড়তে যাওয়ার মতন ঘটনা। শত্রুর গোলায় সেই অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সেই শৌর্যের কাহিনি অবিস্মরণীয়।
জার্মান অধিকারের সময় দেশের ভেতরে ও বাইরে পোলিশ প্রতিরোধ বাহিনী আগাগোড়া সক্রিয় ছিল। এই প্রতিরোধ বাহিনী ছিল দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একটি গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী, নাম আরমিয়া ক্রাজাওয়া বা হোম আর্মি, অন্যটি ছিল কমিউনিস্ট গোয়ারডিয়া লুডো, বা পিপলস গার্ড। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি যুদ্ধের গতি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বোঝা গিয়েছিল যে জার্মানদের শেষ পর্যন্ত হারতেই হবে। সেই সময় ওয়ারশ-তে লুকিয়ে থাকা পোলিশ প্রতিরোধ বাহিনী একটা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিল। তারা চেয়েছিল সোভিয়েত ও ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সাহায্য নিয়ে নিজেরাই ওয়ারশ-কে শত্রুমুক্ত করবে। সোভিয়েত বাহিনী ততদিনে ভিসটুলা নদীর দক্ষিণ তীরে পৌঁছে গেছে। শহরের মধ্য থেকে প্রতিরোধ বাহিনীর অভ্যুত্থানে নাতসিদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হবে, সেই সুযোগে সোভিয়েত বাহিনী নদী পেরিয়ে এসে আক্রমণ করলেই নাতসীরা ফাঁদে পড়ে যাবে। লন্ডন থেকেও প্রতিরোধ বাহিনীর এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানানো হল। অভ্যুত্থানের দিন ঠিক হল। ১ আগস্ট। যথাসময়ে অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেল, ওয়ারশ-এর পথে পথে শুরু হল লড়াই, কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে এল না সাহায্য করতে। জার্মানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতন অস্ত্রও ছিল না প্রতিরোধ বাহিনীর, তবু তারা একমাস পাঁচ দিন ধরে দুরন্ত লড়াই করার পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল, ততদিনে আড়াই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছে।
এই প্রতিরোধ দমন করার পর, ওয়ারশ শহরে যারা বেঁচেছিল তাদেরও শহর থেকে তাড়িয়ে দিল নাতসিরা। তারপর এক একটা পাড়া ধরে-ধরে সমস্ত বাড়িঘর ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে লাগল। ওয়ারশ শহরটাকেই তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। তিন মাস পরে সোভিয়েত বাহিনী যখন বিজয়ীর বেশে এখানে প্রবেশ করল, তখন চতুর্দিকে শুধু ধ্বংসস্তূপের নীরবতা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পোল্যান্ডের জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ, প্রায় ষাট লক্ষ নারী-পুরুষ নিহত হয়, তার মধ্যে অর্ধেক ইহুদি।
এখন আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, চুয়াল্লিশ সালে সেই ওয়ারশ অভ্যুত্থানের সময় সোভিয়েত বাহিনী নদী পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এল না কেন? এই নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতার কারণ কী? আজও এর সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। স্টালিন পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ওই ওয়ারশ অভ্যুত্থান ছিল প্রি-ম্যাচিওর, আরও প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা উচিত ছিল। তাহলে লন্ডন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অভ্যুত্থান শুরু করার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছিল কেন? লন্ডন-মস্কো তখন তো মিত্র পক্ষীয় আঁতাতে ছিল। আসলে যুদ্ধের সময়েও হৃদয়হীন রাজনীতির খেলা চলে, যুদ্ধ যখন চলছে, তখনই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কে কোন অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করবে, সেই হিসেব কৰা হয়। ওয়ারশ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল অ-কমিউনিস্ট জাতীয়তাবাদী হোম আর্মি, চার্চিল ট্রুম্যানের পশ্চিমি জোট মনে করেছিল, এই অভ্যুত্থান সফল হলে জার্মানদের হঠিয়ে দিয়ে হোম আর্মি পোল্যান্ডে সরকার গড়তে পারবে। অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইচ্ছে কমিউনিস্ট পিপলস গার্ডের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। সুতরাং ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর হোম আর্মির মুক্তিযোদ্ধারা যখন জার্মানদের হাতে কচুকাটা হতে লাগল, তখন নদীর অপর পারে সোভিয়েত বাহিনী রয়ে গেল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। হোম আর্মির আর বিশেষ কেউ অবশিষ্ট রইল না, এরপর পোল্যান্ড যুদ্ধ শেষে স্বাভাবিক ভাবেই পিপলস গার্ডের হাতে চলে এল। যে নাতসিরা ছিল কমিউনিস্টদের ঘোর শত্রু, তারাই কিন্তু এখানকার সমস্ত জাতীয়তাবাদীদের হত্যা করে সমগ্র পোল্যান্ড কমিউনিস্টদের হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করে গেল।
পশ্চিমি জোট কিংবা সোভিয়েত পক্ষ, কেউই তাদের বিশেষ স্বার্থসম্পন্ন মনোভাবের কথা এ পর্যন্ত স্বীকার করেনি। কিন্তু পোল্যান্ডের তরুণ সমাজ ওয়ারশ অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার এইরকম ভাবেই ব্যাখ্যা করে।
সকালবেলা আকুমল ও শিল্পী জাসেক আমাদের সঙ্গী। জাসেক আমাদের নিয়ে এল ইতিহাস-মিউজিয়াম দেখাতে। ওয়ারশ-তে এই মিউজিয়ামটি একটি অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। এটি পোল্যান্ডের সমগ্র ইতিহাস ও পুরাতত্বের একটি মূল্যবান সংগ্রহশালা তো বটেই। তা ছাড়া এখানে প্রতিদিন সকালে একটি ফিলম শো হয়, তাতে বোঝা যায়, যুদ্ধে এই নগরীর কতখানি ধ্বংস হয়েছিল, এবং আবার কত নিখুঁত সুন্দরভাবে তা গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি সরকারের পালা বদলের পর নতুনভাবে সাজানো হয়েছে মিউজিয়ামটিকে। জাসেক মাঝে মাঝেই দেওয়ালের দু-একটি ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, এই ছবি আগে ছিল না। আগের সরকার টাঙাতে দিত না। তার মধ্যে কোনও কোনওটি নিরীহ ঐতিহাসিক যুদ্ধের আঁকা ছবি। তার মধ্যে নগ্নতা, অশ্লীলতা বা বিমূর্ততা কিছুই নেই। আমি সেরকম একটা ছবি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, এই ছবিটার কী দোষ ছিল? এটা টাঙাতে দিত না কেন? পুরোনো ঐতিহাসিক ছবি সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক সরকারের কী আপত্তি থাকতে পারে?
জাসেক হাসতে-হাসতে বলল, এটা কোন যুদ্ধের ছবি জানো? চারশো বছর আগে রাজা প্রথম সিগিসমুণ্ডের আমলে পোলান্ড খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেই সময়ে আমাদের রেনেশাঁস আসে। প্রথম সিগিসমুণ্ডের নেতৃত্বে পোল্যান্ড আর লিথুয়ানিয়া এক হয়ে যায়, আমাদের সামরিক বাহিনী রাশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার প্রতিহত করে। এটা সেই যুদ্ধের ছবি। এটা টাঙাতে দেওয়া হয়নি, কারণ এখনকার রাশিয়ানরা এবং মস্কোপন্থীরা মনে করত, কোনও কালে, এমনকি সুদূর অতীতেও পোল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘর্ষ হয়েছিল, তা দেখানো উচিত নয়। তা হলে সোভিয়েত পেপাল্যান্ড মৈত্রী নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আসলে পোল্যান্ডের মানুষ যে কখনও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সেটাই ও ব্যাটারা দেখাতে চাইত না।
আমি স্তম্ভিত। সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য ইতিহাসের এমন বিকৃতি কিংবা ইতিহাস এমনভাবে মুছে ফেলার চেষ্টারও যে প্রয়োজন আছে, তা কখনও শুনিনি। মার্কস কিংবা লেনিন কখনও এরকম কথা বলেছেন? নিশ্চিত কিছু মাথামোটা লোক এরকম নীতি নির্ধারণ করেছিল। এরাই সেনসারশীপ চাপাতে চাপাতে ক্রমশ একটা কুৎসিত অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। বই ছাপার আগেই সেনসরশিপ, সিনেমা তোলার আগেই সেনসরশিপ। রেডিও, টিভি, খবরের কাগজে শুধু প্রচার আর প্রচার। শিল্পগুণহীন একঘেয়ে প্রচারে মানুষ যে অনেক ভালো জিনিস সম্পর্কেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে তা এইসব নীতি নির্ধারকরা বোঝে না। দেশের সব মানুষ কি শিশু যে একই কথা বারবার বোঝাতে হবে তাদের? একই ধরনের সাহিত্য, একই ধরনের ছবি কিংবা গান দেওয়া হবে! সোভিয়েত ইউনিয়নের কত ভালো দিক আছে, কিন্তু এখানে অতিরিক্ত সোভিয়েত পক্ষপাতিত্বে অনেক মানুষ সে দেশ সম্পর্কে বিরূপ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানরা পোলান্ডের ওপর কত অত্যাচার করেছে তা আমরা জানি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসেছিল পরিত্রাতা হিসেবে। কিন্তু জাসেক এবং আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, নাতসি বাহিনী এবং সোভিয়েত বাহিনীর ওপর এদের সমান রাগ রয়ে গেছে। জাসেক বলল, তার দুই দাদু, মায়ের বাবা এবং বাবার বাবা, দুজনেই গত মহাযুদ্ধে মারা গেছে, একজন রাশিয়ান কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে, অন্যজন জার্মানদের। ওয়ারশ অভ্যুত্থানের সময় নাতসী বাহিনী আড়াই লক্ষ নাগরিককে হত্যা করেছে তা যেমন ক্ষমার অযোগ্য, তেমনি কমিউনিস্ট নয় বলেই তাদের সাহায্যের জন্য সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে আসেনি, এটাও এরা ভুলতে পারে না।
স্টালিন আমলের দর্পের প্রতীক হয়ে আছে ওয়ারশ শহরের মাঝখানে একটা তিরিশতলা বাড়ি। পোলান্ডের প্রতি এটা জোসেফ স্টালিনের উপহার, এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘প্যালেস অফ কালচার’। মস্কো শহরে হোটেল ইউক্রাইন আমি দেখেছি, হুবহু তারই অনুরূপ এই বিশাল বাড়িটি ওয়ারশ শহরের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই বেমানান ও খুবই দৃষ্টিকটু দেখায়। একটা শহরের গঠনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হল কি না তা তোয়াক্কা না করে, এ যেন এক রাজা তাঁর ইচ্ছে মতন একখানা বাড়ি চাপিয়ে দিয়েছেন। বাড়িটি দেখলে জোর জবরদস্তি করে কালচার চাপিয়ে দেওয়ার কথাও মনে হয়। যে-কোনও টুরিস্টের চোখেও বাড়িটি বিসদৃশ লাগে, ওয়ারশ নাগরিকরা এর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়। জাসেক-এর মতে এই বাড়িটি এখন ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা উচিত। আমরা বলি, এত বড় একটা বাড়ি ভেঙে নষ্ট করবে কেন, হোটেল-টোটেল বানালেই তো হয়। জাসেক-এর মতন অনেকেই ওই দর্পের আর কোনও চিহ্ন রাখতে চায় না।
এ বাড়িটি নিয়ে অনেক রসিকতা চালু আছে তার মধ্যে একটা এরকম :
বলতে পারো কোন জায়গা থেকে ওয়ারশ শহরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়?
হ্যাঁ পারি। এই প্যালেস অফ কালচারের ছাদ থেকে।
কেন? কেন?
কারণ এই একমাত্র জায়গা থেকেই এ বাড়িটা দেখা যায় না।
এই শহরে যাতায়াতের পথে আর একটি বড় বাড়িও চোখে পড়বেই। এটার নাম ‘পার্টি হাউজ’। কিছুদিন আগেও এটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর। এতবড় বাড়িটিকে পার্টির বিলাসিতার চিহ্ন প্রকট। বাড়িটা এখন খাঁ খাঁ করছে। পোলান্ডে এখন কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব নেই, সুতরাং বাড়িটার দাবিদারও কেউ নেই, কেউ আর এখানে ঢোকে না। এখন কী হবে এই বাড়ি নিয়ে? শোনা যাচ্ছে সরকার থেকে কোনও ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হবে।
আগের আমলে সরকারি প্রচারযন্ত্র কত নির্লজ্জ অবস্থায় পৌঁছেছিল, তার একটি কাহিনী শুনলাম প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জানুসির বাড়িতে গিয়ে। জানুসি এখানে বিশেষ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। পোলান্ডের চলচ্চিত্র বিশেষ উন্নত, আমরা আন্দ্রে ওয়াইদার ভক্ত অনেকদিন থেকেই। এখন ওয়াইদা’র পাশাপাশি জানুসির স্থান। শিল্পী জাসেক-এর মতে, ওয়াইদা’র চলচ্চিত্রকে যদি কনসার্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে জানুসির ছবিগুলিকে বলা যেতে পারে চেম্বার মিউজিক।
জানুসি যেখানে থাকেন, সেটা মনে হয় ওয়ারশ’র অভিজাত পাড়া। নিরিবিলি রাস্তা, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে আগেকার দিনের গ্যাসের আলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আকুমলের সঙ্গে জানুসির বিশেষ বন্ধুত্ব, আমার সঙ্গেও তাঁর আগে পরিচয় হয়েছে, সেই সুবাদে আমরা তাঁর বাড়িতে এক সন্ধেবেলা চায়ের নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম।
জানুসির সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই বেশ একটা মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিভাবান মানুষটির ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির প্রখর্য অনুভব করা যায় অবিলম্বে, তবু তাঁর ব্যবহারে রয়েছে বিনীত ভদ্রতা। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে তিনি তাঁদের ছবি তুলে রাখেন, একটা বড় খাতায় অতিথিদের নাম ঠিকানা ও কিছু একটা বক্তব্য লিখে দিতে অনুরোধ করেন। এই ভাবে তাঁর অনেক খাতা জমেছে। তিনি নিজে পৃথিবীর যত দেশে গেছেন, যত মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে, সেইসব জায়গা ও মানুষজনের ছবি তিনি সেঁটে রাখেন আলাদা একটি অ্যালবামে। সেই অ্যালবামটা খুলে তিনি কলকাতা ও আমার ফ্ল্যাটের ছবি দেখিয়ে চমকে দিলেন। জানসি বললেন, অনেক বই পড়ার মতন, মাঝে মাঝে এই খাতা ও অ্যালবামের পাতা উলটে স্মৃতি-রোমন্থন করাও বেশ আনন্দদায়ক।
জানুসির বাড়িটি যথেষ্ট বড়। তিনি আর একটা ছ’খানা ঘরওয়ালা বাড়ি বানাচ্ছেন, সেই পুরো বাড়িটাই হবে অতিথিশালা। যে-কোনও সময় সেখানে বারোজন অতিথি থাকতে পারবে। অতিথি আপ্যায়ন করা তাঁর বিশেষ শখ। তাঁর মতে, হোটেলে কিংবা কনফারেন্স রুমে মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ঠিক মতন জমে না, বাড়িতে এসে কেউ থাকলে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হতে পারে। কতরকম অতিথি যে তার বাড়িতে এসে থেকে যায় তার ইয়ত্তা নেই! (তিনি আমাদেরও থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন!) এই সন্ধেবেলা মস্কো থেকে তাঁর কয়েকজন অতিথি আসবার কথা। কিছুদিন আগে জানুসি মস্কো গিয়েছিলেন, তখন এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের কাহিনি মস্কোতে অনেকটা বিকৃতভাবে পরিবেশিত হয়েছে, সেইজন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারটি জানুসিকে হঠাৎ বলেছিল, পোল্যান্ডের লোকেরা অকৃতজ্ঞ। একথা শুনে জানুসি রাগ করেননি, তিনি বলেছিলেন, পোল্যান্ডের অবস্থা নিজের চোখে দেখলে তুমি সব বুঝতে পারবে, তুমি ওয়ারশ-তে চলে এসো, আমার বাড়িতে থাকবে। তোমার কোনও খরচ লাগবে না। লোকটি এই প্রস্তাবে হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল, বিনা পয়সায় ওয়ারশ ঘুরে আসতে পারব? তা হলে আমার স্ত্রীকে…। জানুসি বললেন, তাঁকেও নিয়ে এসো। লোকটি বলল, আমার তিনটি ছেলেমেয়ে…। জানুসি বললেন, তাদেরও। এমনকি তোমার যদি শাশুড়ি থাকেন…
আজ সন্ধেবেলা সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের সপরিবারে পৌঁছবার কথা।
খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর জানুসি জানতে চাইলেন, আপনারা কী খাবেন, বলুন! চা, কফি, হুইস্কি, রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন?
আমি বললাম, কফি, দুধ চিনি ছাড়া!
জানুসি হেসে বললেন, দুধ অবশ্য চাইলেও দিতে পারতাম না। দুধ কোথায় পাব?
জানুসির মতন সচ্ছল ব্যক্তির বাড়িতেও দুধ নেই, এতে বোঝা যায়, ওয়ারশ-তে দুধের অভাব কত প্রকট।
কয়েকদিন আগে বাইরে কোথাও শুটিং করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল, জানুসির পায়ে বেশ চোট লেগেছে, তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার কথা, তবু তিনি একটা লাঠি হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে তার বাড়ির নানান ছবি দেখিয়ে, নিয়ে এলেন চায়ের টেবিলে। চা-কফির সঙ্গে নানারকম নোতা মিষ্টি খাবারও রয়েছে। এ বাড়িতে থাকেন জানুসি, তাঁর স্ত্রী ও মা। কয়েকজন অন্য অতিথিও রয়েছেন। খাবার টেবিলে অনেক গল্প হতে লাগল, তার মধ্যে জানুসির দাড়ির গল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কোনও কারণে আমি দাড়ির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, জানুসি তাঁর গালের অল্প অল্প দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, এই দাড়ি আমি কবে থেকে রাখতে শুরু করেছি, শুনবেন? এই দাড়ির সঙ্গে আমাদের বিপ্লবের সম্পর্ক আছে।
জানুসি সলিডারিটির সক্রিয় সমর্থক ছিলেন তা জানি। পূর্বতন সরকার পরিবর্তনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। নতুন সরকার গঠনের সময় জানুসির মন্ত্রিত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি রাজি হননি। কিন্তু তার সঙ্গে দাড়ির সম্পর্ক?
গত কয়েক দশক ধরে পোলান্ডের প্রচার ব্যবস্থা অতি বিশ্রী অবস্থায় পৌঁছেছিল। রেডিও, টিভিতে শুধু সরকারি প্রচার। বিবেকবান বুদ্ধিজীবীরা কেউ রেডিও টিভির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত না। টিভির খবরে এত বেশি মিথ্যে কথা থাকত যে কেউ তো শুনতোই না, ওই সময় টিভি বন্ধ করে অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসত, যাতে প্রতিবেশীরা বোঝে যে টিভির খবর বয়কট করা হয়েছে।
এইরকম একটা সময়ে জানুসি ফিলমের কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকতে থাকতেই তিনি কানাঘুষো শুনলেন যে ফেরার সময় তিনি যখন প্লেন থেকে নামবেন, তখন টিভি ক্যামেরায় তাঁর ছবি তোলা হবে। তাঁর অনেক পুরোনো যে-সব সাক্ষাৎকার ছিল তার থেকে কিছু কিছু ক্লিপিং বাছাই করে, প্লেন থেকে নামার ছবির সঙ্গে জুড়ে টিভিতে প্রচার করা হবে যে জানুসি বিদেশ থেকে ফিরে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
সরকারি প্রচারযন্ত্রে এই ষড়যন্ত্র বানচাল করার জন্য জানুসি বিদেশে বসেই দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিলেন। এক মুখ দাড়ি নিয়ে যখন ফিরলেন, তখন তাঁর সেই মুখের সঙ্গে আগের কোনও ছবিই মিলবে না। পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়ে গেলে তখনকার প্রচারমন্ত্রী জানুসিকে একদিন ডেকে জিগ্যেস করলেন, টিভিতে অশংগ্রহণ করতে তোমার এত আপত্তি কেন? জানুসি উত্তর দিলেন, তোমরা একটাও সত্যি কথা বলতে দাও না, সেইজন্যই আপত্তি? মার্শাল ল’ তুলে নাও, সেনসরশিপ তুলে নাও, আমাদের সত্যি কথা বলতে দাও, তাহলে নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করব। প্রধানমন্ত্রী তখন মৃদু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বললেন, ঠিক আছে, দাড়ি যখন রেখেছ, তোমার পাশপোর্টের ছবি বদলে এই দাড়িওয়ালা মুখের ছবি বসাতে হবে। তুমি আর দাড়ি কামাতে পারবে না। ভুল করেও যদি দাড়ি কামিয়ে ফেলল, তারপর দেশের বাইরে যেতে গেলে তোমাকে আটকানো হবে!
কাহিনিটি শেষ করে জানুসি হাসতে-হাসতে বললেন, এখন অবশ্য আর কোনও অসুবিধে নেই। এখন দাড়ি কামিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু এই দাড়ির ওপর মায়া পড়ে গেছে!
এরপর আমাদের একটা ব্যালে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল বলে আর বেশিক্ষণ গল্প করা গেল না।
কিন্তু আর একটা ঘটনারও উল্লেখ করা দরকার। আমাদের দলটিতে ওম চৌহান নামে আর এক ভারতীয় ছিলেন। ইনি একজন লন্ডন-প্রবাসী ব্যবসায়ী, আকুমলের পূর্ব পরিচিত। বেশ ধনী ব্যক্তি। পোল্যান্ড এখন পশ্চিম দুনিয়ার দিকে ব্যাবসা-বাণিজ্যের দ্বার খুলে দিয়েছে, সেইজন্য শ্রীযুক্ত চৌহান লন্ডন থেকে এসেছেন ওয়ারশ-তে তাঁর ব্যবসায় কোনও শাখা খোলা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে। এমনকি স্বল্পভাষী ভদ্রলোক, কিছু কিছু বাংলা জানেন, কারণ অল্পবয়েসে কলকাতায় পড়াশুনো করেছেন। জানুসির বাড়িতে পৌঁছবার পর আলাপ-পরিচয় পর্বের সময় জানুসি বাদল বসুর পরিচয় জানলেন, তারপর চৌহানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও কি কলকাতার? আপনার সঙ্গে কি আমার দেখা হয়েছিল? শ্রীযুক্ত চৌহান তক্ষুনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, আপনি আমাকে চেনেন না, তাই না? আপনার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি? বেশ ভালো কথা!
শ্ৰীযুক্ত চৌহানের কথার এরকম তীব্রতায় আমরা চমকে উঠলাম। জানুসি বিব্রতভাবে আকুমলের দিকে তাকালেন। আকুমলও লজ্জা পেয়ে বলল, ওম চৌহানের সঙ্গে আপনার লন্ডনে একবার দেখা হয়েছিল, আরও অনেক লোক ছিল তাই আপনার মনে নেই, আমরা একসঙ্গে ডিনার খেয়েছিলাম, উনি কিছু সাহায্য করেছিলেন।
ওম চৌহান আরও উগ্রভাবে বললেন, আপনারা বিখ্যাত লোক, তাই ইচ্ছে মতন অন্যদের ভুলে যেতে পারেন, আমি সেই সময় পাঁচ হাজার পাউন্ডের ওষুধ দান করেছিলাম, পাঁচ হাজার পাউন্ড, তাও আপনার মনে নেই নিশ্চয়ই।
জানুসি বারবার বলতে লাগলেন, অবশ্যই, অবশ্যই। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমায় ক্ষমা করবেন।
ওম চৌহান আবার বললেন, পাঁচ হাজার পাউন্ড দান করেছি, কম নয়, আপনার মনে রাখা উচিত ছিল…
জানুসি আমাদের দিকে তাকিয়ে কাতরভাবে বললেন, আমারই দোষ, পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরতে হয়, অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, সব মুখ মনে না রাখতে পারাটা আমার অন্যায়।
জানুসির প্রতি এরকম আক্রমণে আমরা মর্মাহত বোধ করছিলাম। এরকম ভুল তো হতেই পারে, আমাদের সকলেরই হয়। পোল্যান্ডের যখন খুবই দুঃসময় চলছিল, তখন জানুসি বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিলেন। সেই সময় আকুমলের দৌত্যে লন্ডনের ব্যবসায়ী চৌহান কিছু ওষুধ দান করেছিলেন, তাঁর ওষুধের ব্যাবসা। পাঁচ হাজার পাউন্ডের ওষুধ তিনি জানুসিকে দান করেননি। করেছিলেন পোল্যান্ডের মানুষকে। তবু সেই দানের কথা তিনি এতবার উল্লেখ করতে লাগলেন যে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যেতে লাগল। দান তাকেই বলে, যার বিনিময়ে কোনও প্রত্যাশা থাকে না। তিনিই প্রকৃত দাতা, যিনি আত্মগোপন করে দান করেন। এইরকমই ভারতীয় ধারণা। সেসব ধারণা কবে চুকে বুকে গেছে। এখন লোকে দান করে আত্মপ্রচার কিংবা ইনকাম ট্যাক্স বাঁচাবার জন্য! বুদ্ধ-গান্ধির দেশের মানুষ নাকি শান্তিপ্রিয় জাতি, আজ সারা ভারত জুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখলে তা কে বলবে? ভারতীয়দের কি ভদ্রতা ও সৌজন্যর খ্যাতি ছিল? আজ আর তা বোঝার উপায় নেই।
আকুমল আমাদের জন্য গ্র্যান্ড থিয়েটারে একটি ব্যালের টিকিট কেটে রেখেছিল। এসব টিকিট যেমন দামি, তেমনই দুষ্প্রাপ্য। ওম চৌহানদের মতন মানুষদের ঠিক বিপরীত চরিত্র আকুমল। যত উপার্জন তার চেয়েও বেশি ব্যয় করাই যেন আকুমলের ব্রত। অন্যদের জন্য খরচের কোনও প্রসঙ্গই সে তুলতে দেয় না। সকলের পীড়াপীড়িতে তার একটাই উত্তর। আমার পয়সা ফুরিয়ে গেলে আমি চাইব।
আকুমল বিভিন্ন শিল্পীকে জনসমক্ষে তুলে ধরে। আপাতত সে পোল্যান্ডের তরুণ শিল্পীদের লন্ডনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার চেষ্টায় মেতে আছে। পোল্যান্ডে যে যাওয়া-আসা করছে বহুবার, এ দেশের অনেক কিছু সম্পর্কেই সে উচ্ছ্বসিত। ওয়ারশ শহরটিকে সে এত ভালোবেসে ফেলেছে যে তার মতে এ শহর প্যারিসের সঙ্গে তুলনীয়। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না অবশ্য। প্যারিসের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনও শহরেরই তুলনা চলে না। এমনকি বুড়াপেস্ট নগরও দৃশ্যত ওয়ার’শর চেয়ে রূপবান। তবে, ওয়ারশ’রও এক ধরনের সাদামাটা সৌন্দর্য আছে। কোপারনিকাস ও সপ্যাঁর এই শহর, বিজ্ঞান-সঙ্গীত-শিল্প-সাহিত্য-চলচিচত্র নিয়ে অতি জীবন্ত।
আকুমলের মতে, এখানকার গ্র্যান্ড থিয়েটারও বিশ্বে অতুলনীয়। এটাও ঠিক মেনে নেওয়া যায় না, এর চেয়ে আরও বড়, আরও সুসজ্জিত থিয়েটার হল আমরা দেখেছি। পূর্ব ইউরোপে এমন থিয়েটার হল আর নেই শুনেছি। আমাদের ভারতে নেই, জাপানের কথা জানি না, এশিয়ার অন্য কোনও দেশেও নেই। আরও বিস্ময়ের কথা এই যে, এই বিশাল, জাঁকজমকপূর্ণ থিয়েটার হলটিও জার্মানরা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল, পোল্যান্ডের মানুষ অবিকল আগের মতন গড়ে তুলেছে।
ব্যালে বলতেই আমাদের মনে পড়ে ধপধপে সাদা পোশাক পরা, পুতুল-পুতুল নারী পুরুষদের রূপকথা আশ্রয়ী নাচ, সমগ্র মঞ্চের দৃশ্যটা স্বপ্নের মতন। এটা কিন্তু তা নয়, এই ব্যালেটির নাম ‘ফাউস্ট গোজ রক’, একেবারে অত্যাধুনিক, পাত্র-পাত্রীদের সাজ পোশাক নানা রঙে উদ্ভট, ব্যাক ড্রপে কখনও আগুন জ্বলে উঠছে, কখনও ধোঁয়ায় সব কিছু ঢেকে যাচ্ছে। সঙ্গীত একেবারে হার্ড রক। কাহিনির পারম্পর্য রক্ষার কোনও চেষ্টাই নেই। পালাটি পুরোপুরি অ্যাবস্ট্রাকট। বছর কয়েক আগে এখানে এরকম প্রোডাকশান সম্ভব ছিল না। সোসালিস্ট রিয়েলিজম-এর সঙ্গে অ্যাবস্ট্রাকশানের কেন যেন একটা বিরোধ ছিল। কিন্তু সব শিল্পই অ্যাবস্ট্রাকশানে যেতে চায়। এই যে এখানে অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যালেটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মার্কসীয় নীতিবাগীশরা কেন একে সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করত, তা আমি বুঝতে পারি না। এখন কয়েক হাজার মানুষ গভীর মনোনিবেশে দেখছে, এতে কার কী ক্ষতি হচ্ছে? এর বদলে একটা প্রচারমূলক, শ্লোগানমুখর অনুষ্ঠান দেখলেই বা কী উপকার হত?
অনেক রাত্তিরে, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। ওয়ারশ শহরে গুণ্ডামি ডাকাতির মতন উপদ্রব বিশেষ নেই, তবে চুরি হয়, গাড়ি বেশ চুরি হয়, চোর বিষয়ে সাবধানতা দেখেছি। এত আত্রেও রেস্তোরাঁটি জমজমাট। অনেক রকম খাদ্যই পাওয়া যায়। আমি নতুন খাদ্য নিয়ে পরীক্ষা করি। বাদল পছন্দমতন একটা বড় মাছ পেয়ে গেল, খুব সুস্বাদু। আকুমল নিরামিষাশী, তার জন্য কোনও পদই নেই। কিন্তু আকুমল ছাড়বার পাত্র নয়, অতি ব্যস্ত ম্যানেজার-মহিলাকে ডেকে সে নিরামিষ খাদ্যের মাহাত্ম্য বোঝাতে লাগল, শেষ পর্যন্ত একজন রাঁধুনীকে ডেকে আকুমল বিশেষ নিরামিষ
রান্নার প্রণালী বর্ণনা করার পর সেইরকমই খাবার রান্না হয়ে এল তার জন্য। ম্যানেজার জানাল যে, এখন থেকে এই পদটি তাদের রেস্তোরাঁর মিনিউতে স্থান পাবে, এর নাম হবে ইন্ডিয়ান ভেজিটেরিয়ান আকুমল!
একটু দূরে কয়েকটা টেবিল জুড়ে বসেছে একটা বিয়ের পার্টি। সুন্দরী পরির মতন সাজপোশাক করা কনেটি চুমু খাচ্ছে অনেকের গালে। এক সময় তারা একটা গান গেয়ে উঠল, অন্যান্য টেবিল থেকে অনেকে গলা মেলাল।
শিল্পী জাসেকও সেই গান গাইতে-গাইতে বলল, আগেকার সঙ্গে এখনকার কী তফাত জানো? এরকম একটা খোলামেলা পরিবেশের অভাব ছিল। মার্শাল ল’ জারি থাকলে সব সময়েই মানুষ গম্ভীর, থমথমে হয়ে থাকে। গলা খুলে হাসতে কিংবা গান গাইতেও লজ্জা পায়। কিন্তু ইচ্ছে মতন চলাফেরার স্বাধীনতা থাকবে না, ইচ্ছেমতন হাসি-ঠাট্টা ইয়ারকির স্বাধীনতা থাকবে না, এরকম পরিবেশ মানুষ বেশিদিন সহ্য করতে পারে না।