১.১২ নিশানাথ

নিশানাথ

অত্যন্ত দ্রুতপদে পথটা অতিক্রম করে সুব্রত যখন প্রাসাদে এসে পৌঁছল, দেখলে তার অনুমানই ঠিক। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে বিকাশ সান্যালের আবির্ভাব হয়েছে এবং তদন্তও শুরু হয়ে গেছে হত্যা-ব্যাপারের, তবে সেজন্য সুব্রতর খোঁজ এখনও পড়েনি।

বিকাশ মৃতদেহটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াতেই সুব্রতর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কি একটা কথা সুব্রতকে বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ সুব্রতর চোখের ইঙ্গিতে নিজেকে সে সংযত করে নিল।

কতক্ষণ হল এ ব্যাপার হয়েছে? বিকাশ রাজাবাহাদুরকেই প্রশ্ন করলে।

তা ঘণ্টা দুই হবে, কি বলেন কল্যাণবাবু! রাজাবাহাদুর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন।

তা হবে বৈকি, সুব্রত সায় দেয়।

মৃতদেহ যেভাবে পড়ে আছে, তা দেখেই মনে হয়, উনি প্রাসাদের দিকেই যাচ্ছিলেন। রাত্রি এখন প্রায় একটা হবে। ঘণ্টা দুই আগে যদি ঘটনাটা ঘটে থাকে, তাহলে তখন বোধ করি রাত্রি এগারোটা আন্দাজই হবে। তা এত রাত্রে উনি প্রাসাদের অন্দরমহলেই বা যাচ্ছিলেন কেন? উনি কি আপনারই কোনো কাজে বা আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন রাজাবাহাদুর?

না, আমিও আশ্চর্য হচ্ছি, হঠাৎ উনি এত রাত্রে এদিকে আসছিলেন কেন?

এ সময় সুব্রত সহসা একটা চাল দেয়, বলে ওঠে, শুনেছি প্রায়ই রাত্রে উনি নাকি আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন, দাবা খেলতেই আসছিলেন না তো?

কথাটা ঠিকই, তবে আজ আমার শরীর ভাল না থাকায়, সন্ধ্যার আগেই বলে দিয়েছিলাম, আজ আর দাবা খেলা হবে না। বললেন রাজাবাহাদুর।

সতীনাথবাবুর বাড়ির চাকরদের একবার ডাকাতে পারেন রাজাবাহাদুর? বললে বিকাশ।

আমি এখুনি তাদের ডাকতে লোক পাঠাচ্ছি। বলে রাজাবাহাদুর চিৎকার করে ডাকলেন, শম্ভ, এই শম্ভ–

রাজবাড়ির পুরাতন চাকর শম্ভু, বর্তমানে শম্ভ রাজাবাহাদুরের খাসভৃত্য, রাজাবাহাদুরের ডাকে এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। যথেষ্ট বয়েস হলেও শরীরের বাঁধুনি খুব চমৎকার শম্ভর।

এই,এখুনি একবার কাউকে বলে দে, ম্যানেজারবাবুর বাসা থেকে বংশী আর জগন্নাথকে ডেকে আনুক, বলে যেন আমি ডাকছি।

কিন্তু শম্ভর আর তাদের ডাকতে যেতে হল না, ভিড়ের মধ্য হতে কে একজন বলে উঠল, রাজাবাবু, তারা এখানেই আছে। এই বংশী, যা রাজাবাবু ডাকছেন।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মিলে একপ্রকার ঠেলেই লাহিড়ীর ভৃত্য বংশীকে সামনের দিকে এগিয়ে দিল।

লাহিড়ীর বংশীই ছিল একমাত্র ভৃত্য ও জগন্নাথ উৎকলবাসী রসুয়ে বামুন। বংশীর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, জাতিতে সদগোপ। অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, চকচকে কালো গায়ের রং, মাথার চুলগুলো লম্বা লম্বা, তার প্রায় তিনের-চার অংশ পেকে সাদা হয়ে গেছে।

তোর নাম কি রে? বিকাশ প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে বংশী কতা, বংশী কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দেয় কোনোমতে, একটা বড় রকমের ঢোঁক গিলে। লোকটা যে ভয় পেয়েছে তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। সেই কারণেই হয়ত সে ভিড়ের মধ্যে আত্মগোপন করতেই চেয়েছিল। প্রভুর আকস্মিক মৃত্যুতে সে রীতিমত ভয় তো পেয়েই ছিল, হকচকিয়েও গিয়েছিল।

বাসা থেকেই গোলমাল শুনতে পেয়েছিস?

হ্যাঁ বাবু।

কতদিন বাবুর বাসায় কাজ করছিস?

প্রায় দেড় বছর হবে বাবু।

এখানে তুই কতক্ষণ এসেছিস?

আজ্ঞে বাবু, গোলমাল শুনেই তো ছুটে এলাম।

তাহলে বাসায় ছিলি বল?

হ্যাঁ বাবু।

তোর বাবু কতক্ষণ বাসা ছেড়ে এসেছে বলতে পারিস?

এই তো সবে এক ঘণ্টাও হবে না, কে একটা লোক একটা চিঠি নিয়ে এল। বাবু বাইরের বারান্দায় বসেছিলেন। খাবার হয়ে গেছে, খেতে আসবেন, এমন সময় চিঠি পেয়ে আমাকে বললেন, বংশী, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুরে আসছি, ঠাকুরকে খাবার এখন দিতে বারণ। করে দে। ফিরে এসে খাবখন।

কে চিঠি নিয়ে গিয়েছিল? কোথা থেকেই বা চিঠি নিয়ে এল, জানিস কিছু? বাবু বলেননি, কোথা যাচ্ছেন?

আজ্ঞে না, শুধু বলে এলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন।

যে লোকটা চিঠি নিয়ে গিয়েছিল তাকে তুই ভাল করে দেখেছিলি? চিনতে পেরেছিলি লোকটাকে?

আজ্ঞে না কত, তাকে আমি আগে কখনও দেখিনি।

লোকটা লম্বা না বেঁটে? রোগা না মোটা? দেখতে কেমন?

আজ্ঞে লোকটার মাথায় একটা পাগড়ী বাঁধা ছিল, লম্বাই হবে, হাতে একটা টর্চবাতি ছিল। তার মুখ আমি দেখিনি।

লোকটা চিঠিটা দিয়েই চলে গেল, না সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল?

আজ্ঞে আমি বারান্দার অন্য ধারে বসেছিলাম, লোকটা চিঠি দিয়েই চলে গেল।

কোনো দিকে গেল?

আজ্ঞে বাড়ির বাইরে চলে গেল, দেখতে পাইনি কোন্ দিকে গেল তারপর।

লোকটা চলে যাওয়ার পরই তোর বাবু চলে আসেন?

হ্যাঁ, ভিতরে গিয়ে একটা জামা গায়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন।

বাবু বাড়ি থেকে বের হয়ে আসবার কতক্ষণ পরে তুই গোলমাল শুনতে পাস?

তা পনের-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই হবে হুজুর।

এর পর বিকাশ মৃতদেহের জামার পকেটগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। লাহিড়ীর পরিধানে ধুতি ও একটা সাধারণ সিল্কের পাঞ্জাবি। কিন্তু পাঞ্জাবির কোনো পকেট থেকেই কোনো কাগজ বা চিঠিপত্র পাওয়া গেল না, একটা সাদা ক্যালিকো মিলের রুমাল, একটা চাবির রিং ও পার্স পাওয়া গেল মাত্র, কিন্তু সেগুলো হতে কোনো সূত্রই পাওয়া যায় না।

রাজাবাহাদুর বললেন, দারোগাবাবু, এখানে এত লোকজনের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে এদের জেরা না করে, আমার খাস কামরায় চলুন না? সেখানে বসেই যাকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় করবেন।

সেই ভাল কথা, চলুন।

এর পর সকলে রাজাবাহাদুরের খাস কামরায় এসে প্রবেশ করল, সুব্রতও সঙ্গে সঙ্গে গেল।

বিকাশ একটা আরাম-কেদারায় বেশ জাঁকিয়ে বসল। তারপর বললে, রাজাবাহাদুর, সর্বাগ্রে আপনার সঙ্গেই আমার কয়েকটা কথা আছে। তারপর যাকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবার করবখন।

রাজাবাহাদুর ক্লান্ত স্বরে বললেন, বেশ। বলুন কি জানতে চান?

আপনার ম্যানেজার ও সেক্রেটারী লাহিড়ীর মৃত্যু-ব্যাপারটা যে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন! এই মাত্র অল্প কিছুদিন হবে আমার এখানে বদলি হয়ে আসবার আগে আপনাদের পরিবারের মধ্যে একটা বিশ্রী হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। যার ফলে আপনাদের কম ধকল সহ্য করতে হয়নি, অর্থব্যয়ও কম হয়নি, আবার আজকের এই ব্যাপার!

বিকাশবাবুর কথা শেষ হল না, সহসা যেন প্রচণ্ড একটা অট্টহাসির শব্দ নিশীথের নিথর স্তব্ধতাকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল—হাঃ হাঃ হাঃ…!

ও কি! অমন করে হাসলে কে? চমকে উঠে প্রশ্ন করলে বিকাশ। প্রথমটায় রাজাবাহাদুরও যেন একটু চমকে গিয়েছিলেন, কিন্তু করে সামলে নিলেন যেন, বললেন, আমার দূরসম্পকীয় খুড়ো নিশানাথ মল্লিক। শোলপুর স্টেটে চিত্রকর ছিলেন, মাসপাঁচেক হয় মাথার গোলমাল হওয়ায় চাকুরি গেছে। বুড়ো মানুষ, বিকৃতমস্তিষ্ক, অথর্ব, আমার এখানে এনে রেখেছি। সংসারে ওঁর আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ে-থাও করেনি। অকারণ অমনি হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠা, চিৎকার করা, আবোল-তাবোল বকা…এই করছেন আর কি।

এরপর ঘরের সকলেই কিছুক্ষণের জন্য যেন চুপ করে রইল, কারও মুখেই কথা নেই।

বিকাশই সর্বপ্রথমে আবার ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, আচ্ছা রাজাবাহাদুর, বলতে পারেন, সর্বপ্রথম কে লাহিড়ীর মৃতদেহ দেখতে পায়?

তাও ঠিক বলতে পারি না, তবে আমি পড়াশুনা সেরে বিছানায় শুতে যাচ্ছিলাম, এমন ১ময় হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেয়েই ছুটে জানলার সামনে যাই। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখলাম, (কেননা আমার ঘরের জানলা থেকে সুস্পষ্ট ভাবে অন্দর ও বহির্মহলের মধ্যকার  সংযোগস্থল, ঐ আঙিনাটা দেখা যায়) কে একজন আঙিনায় শুয়ে ছটফট করছে। তখুনি ছুটে নীচে যাই। আমার পোঁছবার আগেই বাড়ির অন্যান্য ভৃত্য ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই চিৎকার শুনে সেখানে ততক্ষণে জুটেছে গিয়ে দেখি।

আপনি যখন আপনার শয়নকক্ষে জানলাপথে নীচের দিকে তাকান, তখন সেখানে আর কাউকেই দেখতে পাননি?

রাজাবাহাদুর সুস্পষ্ট স্বরে বললেন, না।

এমন সময় অতর্কিত একটা কণ্ঠস্বর শুনে সকলেই যুগপৎ সামনের খোলা দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলে।

মিথ্যে কথা। আমি দেখেছি, সেই কালো শয়তানটা! কিন্তু এবারে আর তার হাতে ছাতা ছিল না, একটা মস্তবড় টর্চবাতি ছিল…

একজন দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ, খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে এসে ইতিমধ্যে কখন দাঁড়িয়েছেন, এ তাঁরই কণ্ঠস্বর। আগন্তুকের বয়স প্রায় পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে। মাথায় ঢেউ-খেলানো শ্বেতশুভ্র বাবরি চুল, মুখের ওপর বার্ধক্যের বলিরেখা সুস্পষ্টভাবে রেখাঙ্কিত হয়ে উঠেছে। আগন্তুক যে যৌবনে একদিন অসাধারণ বলিষ্ঠ সুপুরুষ ছিলেন, বার্ধক্যেও তা বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও গায়ে সেরওয়ানী, পায়ে রবারের চপ্পল। তাই কখন যে তিনি নিঃশব্দে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ টের পায়নি!

রাজাবাহাদুর দ্রুতপদে এগিয়ে গেলেন, এ কি কাকা, আপনি এখানে কেন?

কে, বিনু? এখনও তুমি এ বাড়িতে আছ? পালিয়ে যাও! পালিয়ে যাও! এ বাড়িতে সর্বত্র বিষের ধোঁয়া? বিষে জর্জরিত হয়ে মরবে!

চলুন কাকা, আপনার ঘরে চলুন।

কোথায় যাব, ঘরে? না না, সেখানেও মৃত্যু ওৎ পেতে আছে, মৃত্যু-বিষ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। That child of the past, again he started his old game-ভুলে গেলে এরই মধ্যে সেই শয়তান ছোটলোকটিকে?…মনে পড়ছে না তোমার? বলতে বলতে বৃদ্ধ একবার ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে, কতকটা যেন স্বগত ভাবেই বললেন, এরা কারা বিনু? এরা এখানে কি চায়? আমি একটা চমৎকার অয়েল পেনটিং করছি, ছবিটা প্রায় শেষ হয়ে এল। একটি তেরো-চোদ্দ বছরের ছোট কিশোর বালক, শয়তানীতে সে এর মধ্যেই পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে। উঃ, কি শয়তান! ধনুবান খেলার ছলে, খেলার তীরের ফলার সঙ্গে কুঁচফলের বিষ মাখিয়ে, তারই একজন খেলার সাথীকে মারতে গেল। কিন্তু ভগবানের মার যাবে কোথায়? সব উল্টে দিল। বিষ মাখানো তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগল গিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় বল তো, কিছু দূরে মাঠের মধ্যে একটা গরু ঘাস খাচ্ছিল, তারই গায়ে। ছেলেটা বেঁচে গেল, কিন্তু দিন-দুই বাদে গরুটা মরে গেল। কিন্তু, তুমি কি সেই মস্তবড় টর্চ হাতে কালো পোশাক পরা লোকটাকে দেখতে পাওনি বিনু? ছায়ার মতই মিলিয়ে গেল, আমি দেখেছি তাকে। কেউ না দেখতে পেলেও আমি দেখেছি। … হ্যাঁ, আমি দেখেছি সেই শয়তানটাকে!

আঃ কাকা, ঘরে চলুন, অনেক রাত্রি হয়েছে, চলুন এবারে একটু ঘুমোবেন। রাজাবাহাদুর যেন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন বোঝা যায়।

রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ সোম পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন, রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার, এঁকে ঘুম পাড়াবার ব্যবস্থা কর।

ডাঃ সোম এগিয়ে এলেন, ধীর সংযত কণ্ঠে ডাকলেন, মিঃ মল্লিক! সুব্রত অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল আগন্তুক আর কেউ নয়, সুবিনয় মল্লিক বর্ণিত তাঁর বিকৃতমস্তিষ্ক দূরসম্পর্কীয় খুড়ো, আর্টিস্ট নিশানাথ। স্তব্ধ বিস্ময়ে সে নিশানাথের কথাগুলো শুনছিল। সত্যিই কি নিশানাথের কথাগুলো একেবারে স্রেফ প্রলাপোক্তি! মনের মধ্যেই যেন একটা সংশয় জাগছে। কিছুদিন আগে জাস্টিস্ মৈত্রের বাড়িতে বসে রায়পুর মার্ডার কেসের প্রসিডিংস পড়তে পড়তে কয়েকটা লাইন সহসা যেন মনের পাতায় স্মৃতির বিদ্যুতালোক ফেলে যায়, কালো ছাতাওয়ালা সেই কালোলোকটা!