ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

১.১২ ডাক্তার রুদ্র

।। বারো।। ডাক্তার রুদ্র

বাড়িতে রীণা নেই, কাজেই ফেরার তাড়া নেই। রীণাকে ছেড়ে দিতে খুব একটা ইচ্ছে ছিল না ওর। তার কারণ, রীণা যেন ক্রমশ মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে সঞ্জয়ের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় রীণাকে চোখের আড়াল করার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না সঞ্জয়ের। অবশ্য মান্তু কথা দিয়েছে সে যেমন নিজে রীণাকে নিয়ে যাচ্ছে, রাত পোহালেই তেমনি নিজেই পৌঁছে দিয়ে যাবে। মান্তু আড়ালে ওকে মিস থাম্পির কথাও বলেছে। অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলা, প্রেতচর্চাই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মান্তুর ইচ্ছা রীণাকে একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এসব হাস্যকর কথা। মহিলাটি কি ঝাড়ফুঁক করে রীণাকে সুস্থ করে তুলবেন? তবু সঞ্জয় বাধা দেয়নি। ভেবেছে মান্তুর বাড়িতে এক রাত্রি থাকলে রীণার হয়তো ভালোই লাগবে। মান্তুও তাকে বোঝাতে পারবে।

সারাদিন হাসপাতালে কাজের মধ্যে কেটে গেল। রীণা যে বাড়ি নেই এ কথা একবারও তার মনে হল না। মনে পড়ল বিকেলে হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর। ভাবল এখনই গিয়ে কী করবে? বাড়ি তো খালি।

সঞ্জয়ের অবশ্য হুটহাট যাওয়ার মতো জায়গা একটা আছে। সেটা ডাক্তার রুদ্রর বাড়ি। সঞ্জয় ঠিক করল ওখানেই যাবে। রীণার ব্যাপারে একটু কথা বলা দরকার।

ডাঃ অবিনাশ রুদ্রের বাড়ি বেলগাছিয়ায়। গেটের ভেতর মোরাম বিছানো পথ। দক্ষিণ দিকে গ্যারেজ। নীচের ঘরে চেম্বার। সকালে রুগি দেখেন। সন্ধেবেলায় বসেন না। ওই সময়টা মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মিটিং না থাকলে বই পড়েন।

ডাঃ রুদ্রের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ছে। বাড়িতে শুধু স্ত্রী। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার।

সঞ্জয় কলকাতায় এসেই ভেবেছিল রীণাকে নিয়ে ডাঃ রুদ্রের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। কিন্তু তখন রীণাকে নিয়ে সিনেমা—থিয়েটার দেখাতেই দিন কেটে গেল। তারপরই রীণা ভয় পেতে আরম্ভ করল। আর বেরোনো হল না। শেষ পর্যন্ত ডাঃ রুদ্রকেই আসতে হল রীণাকে দেখতে। রীণার সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম পরিচয়। যাবার সময়ে তিনি বার বার করে বলেছিলেন—সঞ্জয় যেন রীণাকে একদিন নিয়ে যায় তাঁর বাড়িতে। কাকিমা দেখবে।

সঞ্জয় একদিন নিয়ে গিয়েছিল রীণাকে। রীণার মনে অস্বস্তি ছিল ডাঃ রুদ্র হয়তো কাকিমার সামনেই তাকে ঠাট্টা করবেন। কিন্তু ডাঃ রুদ্র ওসব কোনো কথাই তোলেননি। রীণার খুব ভালো লেগেছিল।

মুখে চুরুট, সোফায় গা এলিয়ে ডাঃ রুদ্র বই পড়ছিলেন। সঞ্জয়কে আসতে দেখে বই মুড়ে রেখে সহাস্য অভ্যর্থনা করলেন, এসো এসো।

সঞ্জয় সামনের কোচে বসল।

—কী খবর বলো। রীণা কেমন আছে? বলেই ভেতরের দরজার পর্দা সরিয়ে হাঁকলেন, ওগো, সঞ্জয় এসেছে।

একটু পরেই ডাক্তার রুদ্রের স্ত্রী হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন।—রীণাকে নিয়ে এলে না কেন?

সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, আজ আমি হাসপাতাল থেকে আসছি। ছুটির দিনে নিয়ে আসব।

—বোসো। আমি আসছি। বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

সঞ্জয় তখন রীণার কথা বলল। প্রথম দিনের ঘটনা ডাঃ রুদ্রের জানা ছিল। সঞ্জয় পরের দিকের সব ঘটনা খুলে বলল। গেলাস ভাঙা, ছবি চুরি থেকে আরম্ভ করে মান্তুর বাড়ি একা বেড়াতে যাওয়া পর্যন্ত সব। বলল না শুধু মান্তুর সঙ্গে আজকে যাওয়ার কথাটা। লুকোবার তেমন কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মিস থাম্পির কথায় উনি হয়তো রাগ করবেন, কিংবা হাসবেন।

সব শুনে ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে রইলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, কেসটা আপনার কীরকম মনে হয়? মানসিক ব্যাধিই?

ডাঃ রুদ্র বললেন, ওর সঙ্গে ভালো করে কথা না বললে বুঝতে পারব না।

সঞ্জয় বলল, মানসিক ব্যাধি ছাড়া আর কী হতে পারে? আপনি কি মনে করেন ও সত্যি কোনো অশরীরী আত্মাকে দেখে?

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তার পর বললেন, দ্যাখো, এ সম্বন্ধে চট করে কিছু বলা ঠিক নয়, আমি অলৌকিক ব্যাপার নিজে দেখিনি। তবে রুগি দেখেছি।

—তারা কেউ সেরেছে?

—হ্যাঁ, সবাই। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন চালাচ্ছে।

—নিশ্চয় ঝাড়—ফুঁক করে নয়?

ডাক্তার রুদ্র বললেন, না। চিকিৎসা করেই। তবে সে চিকিৎসা ওষুধ—ইনজেকশান দিয়ে নয়, পেশেন্টের মনস্তত্ত্ব স্টাডি করে কিংবা জায়গা বদল করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য উপায়ও নিতে হয়েছে।

ডাঃ রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই ঠিক। রীণা সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়েছে।

সঞ্জয় এতেও সন্তুষ্ট হল না। জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়ে পড়ল কেন? তারও তো কারণ থাকবে।

—হ্যাঁ, কারণ তো থাকবেই।

—কিন্তু আমি তো কোনো কারণ দেখছি না।

ডাঃ রুদ্র একটু হাসলেন। বললেন, তুমি আর কত দিন ওকে দেখছ? তিন বছর? চার বছর? তার আগেও তো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে যা তুমি জান না। এমনকি ওর মা—বাবাও জানে না। এমনও হতে পারে ব্যাপারটা ওর নিজেরও মনে নেই।

সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী?

—হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। খুব অল্প বয়সে হয়তো কোনো কিছুতে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। সেই ভয়ের কারণ বা স্বরূপ আজ আর মনে নেই। কিন্তু ভয়ের তীব্র অনুভূতিটা থেকে গিয়েছে সাব—কনসাস মাইন্ডে।

ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, ছোটোবেলায় একবার নররাক্ষসের জ্যান্ত মুর্গি খাওয়া দেখে ভয় পেয়েছিল, সেদিন তুমি বলছিলে না?

—হ্যাঁ। এবারও মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে কথাও আপনাকে বলেছি। কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার মানসিক—

এই পর্যন্ত বলে সঞ্জয় একটু থামল। ডাক্তার রুদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি কাকাবাবু। রীণা যাকে দেখে তার পরনে কালো কোট—প্যান্ট। রীণা ছোটোবেলায় যে নররাক্ষসকে দেখেছিল সেও আসলে ম্যাজিশিয়ান। আমার বিশ্বাস সেও কালো পোশাক পরত।

ডাঃ রুদ্রের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ভালো কথা বলেছ। রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো দিকি, সেই ম্যাজিসিয়ানের পোশাকটা মনে আছে কিনা।

—করব।

এই সময়ে ডাঃ রুদ্রের স্ত্রী দুজনের জন্য চা, টোস্ট আর ওমলেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্লেট নামিয়ে কাজ সারতে মিসেস রুদ্র ভেতরে চলে গেলেন।

ডাঃ রুদ্র সোফায় আধশোয়া হয়ে খেতে খেতে বললেন, তবে আমার মনে হয় ওটা ঠিক কারণ নয়। ধরো, সেই ম্যাজিশিয়ানের কালো পোশাকটাই যদি ভয়ের কারণ হয় তাহলে তো যে কোনো কালো কোট—প্যান্ট পরা লোক দেখলেই ভয় হবে। মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখার আগে কি কখনো কালো পোশাক পরা লোক দেখেনি?

সঞ্জয় চুপ করে গেল। নিঃশব্দে দু—চুমুক চা খেয়ে বলল, ধরেই নিলাম না হয় ছোটোবেলার স্মৃতি থেকেই মহাজাতি সদনে ম্যাজিক দেখতে গিয়ে কিংবা ম্যাজিশিয়ানকে দেখে ভয় পেয়েছিল। তার সঙ্গে বাড়িতে ভয় পাবার কারণ কী? আর কলকাতায় এসেই বা এতদিন পর ভয় পেতে লাগল কেন? সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কাকাবাবু।

ডাঃ রুদ্র চা শেষ করে একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, গোলমাল কিছুই নয়। ব্যাপার একটাই—ভয় পাওয়া। সেই সঙ্গে একটা কিছু দেখা।

সঞ্জয় একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনিও বিশ্বাস করেন ও কিছু দেখে?

—আমি তো আগেই বলেছি, ও বিষয়ে চট করে কিছু বলা যাবে না। রোগের বিকারে মানুষ নিজে থেকেই বকে। কিন্তু যা বকে তা ভুল বকা। মানসিক রোগে লোকে নানা কারণে ভয় পায়—কখনো কোনো শব্দ শুনে, কখনো কোনো বিশেষ গন্ধ পেয়ে, কখনো বা কিছু দেখে। অথচ সেই শব্দ, গন্ধ বা বস্তু হয়তো আদপেই কিছু নেই।

—তাহলে আপনি সেই আমার কথাতেই আসছেন—রীণা সাইকোপ্যাথির পেশেন্ট?

—হ্যাঁ, তাই।

সঞ্জয় নিজেই কতবার রীণাকেই বলেছে, তুমি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছ। আর আজ ডাঃ রুদ্রের মুখে ওই একই কথা শুনে তার মুখটা শুকিয়ে গেল। ম্নান মুখে জিজ্ঞেস করল, তাহলে ট্রিটমেন্ট?

—আমিই করব। অবশ্য যদি বুঝি সত্যিই ওর মানসিক রোগ হয়েছে।

এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সঞ্জয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, শুনে অবাক হবে, আমি এখন মেসমেরিজম নিয়ে কিছু পড়াশোনা করছি। বলতে বলতে সামনের র‌্যাক থেকে কতকগুলো ফাইল বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, একসময়ে ওদেশের ডাক্তার ফিশার (Dr. Fisher), রিচার (Richer), বিনেট (Binet), ফেরি (Fere), বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানবিদ ডাক্তার লুই আর স্বয়ং মেসমার যিনি মেসমেরিজমের আবিষ্কর্তা এঁরা সকলেই মেসমেরিজমের সাহায্যে কঠিন কঠিন রোগ সারাতে পারতেন। সেই সব খবরের কাটিং এই ফাইলে আছে। কৌতূহল থাকলে একটা ছুটির দিনে এসে পড়ে দেখতে পার। একটু থেমে বললেন, এখনও এদেশে বহু জটিল রোগ মেসমেরিজমের সাহায্যে সারানো যায়। আমাদের দেশে ঝাড়—ফুঁক করে রোগ সারানো হতো। এখনও পল্লিগ্রামে ঝাড়—ফুঁকের ব্যবস্থা চলে। এই ঝাড়—ফুঁকও এক ধরনের মেসমেরিজম। তুমি কখনো দেখেছ কি না জানি না ওঝারা রুগির কাছে বসে রুগিকে না ছুঁয়ে কিংবা তার দেহের ওপর দিয়ে খুব আলগাভাবে হাত চালায়। একে বলে ‘পাস দেওয়া’। মাথা থেকে পা পর্যন্ত এইরকম কয়েকবার ‘পাস’ দিলেই রুগি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙলে দেখা যায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। অনেক মহাপুরুষই তো রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের রোগমুক্ত করতেন। এটা অস্বাভাবিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে তাঁরা প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী। ওই শক্তির বলেই তাঁরা রোগীকে রোগমুক্ত করতে পারতেন। আর মেসমেরিজমের গোড়ার কথাই হচ্ছে ‘প্রচণ্ড মানসিক শক্তি’। বুঝতেই পারছ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এই মেসমেরিজম কত শক্তিশালী চিকিৎসা।

সঞ্জয় বলল, তাহলে কি আপনি রীণাকে হিপনোটাইজ করে সারাবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, তাহলে তো খুব ভালোই হত। কিন্তু হিপনোটাইজ করি সে শক্তি আমার কই? আজকের দিনে ক’জনারই বা সে শক্তি আছে? তবে এ—বিষয়ে আমার ইনটারেস্ট আছে বলেই তোমাকে এত কথা বললাম।

সঞ্জয় একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তাহলে আপনি কীভাবে সারাবেন?

সঞ্জয় না হয়ে অন্য কেউ এ কথা জিজ্ঞেস করলে ডাঃ রুদ্র হয়তো বিরক্ত হতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি শুধু একটু হাসলেন। বললেন, প্রথমে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে চাপা কোনো ভয়ের স্মৃতি আছে কিনা।? কোনো মানসিক আঘাত পেয়েছে কিনা। অনেক মানসিক আঘাত নিঃশব্দে সহ্য করতে হয়, তার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া অতৃপ্ত যৌন—কামনারও একটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে যারা উগ্রবিকৃত যৌন—কামনায় কাতর তাদের মানসিক বিকার জন্মাতেই পারে। বিকৃত যৌন—কামনায় কাতর এমন একটি পেশেন্ট আমিই পেয়েছিলাম।

সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বলল, রীণার ক্ষেত্রে এসবের কোনো প্রভাবই নেই। কলকাতায় আসার আগে পর্যন্ত সে সবদিক দিয়েই সুখী ছিল। এখনও তার কোনো কিছুরই অভাব নেই।

ডাঃ রুদ্র স্নিগ্ধ হেসে বললেন, তা হয়তো ঠিক। তবু তুমি নিজে ডাক্তার। এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা জেনে রাখা ভালো। সেই পেশেন্টটির কথা শোনো।

ডা রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন। দুটি সন্তানও হয়েছে। স্বামীটি সুদর্শন, ভদ্র, মার্জিতরুচি, সলজ্জ প্রকৃতির। স্ত্রীটি মোটামুটি সুন্দরী। পাতলা গড়ন। গাল দুটি একটু বসা। কিন্তু ঝকঝকে চোখ। মোটেই মুখরা নয়, বরঞ্চ স্বল্পভাষী। তাকে দেখেই মনে হয়েছিল তার জীবনের অনেক সুখ—দুঃখের কথা সে যেন ঠোঁটে কুলুপ এঁটে আছে। দশ বছর শান্ত দাম্পত্য জীবন কাটাবার পর স্ত্রীটি হঠাৎ কীরকম অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। কোনো কিছুতেই আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই, কারো সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে না, এমনকি—এমনকি রাত্রে স্বামীর পাশে শুয়েও পাশ ফিরে থাকত। স্বামীর মনে হত যেন একতাল বরফ তার পাশে পড়ে আছে। অগত্যা স্বামী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। প্রথমে স্ত্রী চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি। বিরক্ত হয়ে বলত—আমার কী হয়েছে যে চিকিৎসা করাব?

শেষে অবশ্য রাজি হয়েছিল। গোপন সাক্ষাৎকারের সময় হিতৈষী ডাক্তারের কাছে সে যা বলেছিল তা এই—প্রথম কৈশোর কালেই সে একটা ছেলের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ছেলেটি শুধু যে উপভোগ করত তা নয়, উপভোগের সময় নানা রকম খারাপ কথা বলত, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত। তাতে মেয়েটি রাগ তো করতই না, বরঞ্চ তার ভালো লাগত। পরবর্তী জীবনে স্বামীর কাছ থেকেও ওই রকম আচরণ আশা করত। কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে সেরকম ব্যবহার পেত না। শেষ পর্যন্ত—মানে দশ বছর পর তার হঠাৎ এমন অবস্থা হল যে, পাগলের মতো সেই ছেলেটির খোঁজ করতে লাগল। ছেলেটি এই পরিবারের এতই পরিচিত ছিল যে তাকে কেউ সন্দেহ করত না। মেয়েটি এই ব্যাধিরই শিকার।

এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন।

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল—মহিলাটির শেষ পর্যন্ত কী হল?

—চিকিৎসা শুরু হল। চিকিৎসা কী জান? চিকিৎসা আর কিছুই নয়, মাস ছয়েকের জন্য তাকে তাদেরই অতি সাধারণ এক গৃহস্থ যৌথ পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার স্বামীকে বলা হল—এই ছ’মাসের মধ্যে সে যেন স্ত্রী কাছে না যায়। শুধু তখনই যাবে যখন তার স্ত্রী তাকে চিঠি লিখে আসতে বলবে। সেই যৌথ পরিবারে গিয়ে বধূটি প্রথম সুস্থ স্বাভাবিক ব্যস্তসমস্ত জীবনের আস্বাদ পেল। তারপর থেকেই তার পরিবর্তন। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক।

সঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, রীণার ট্রিটমেন্ট তাহলে কীভাবে করবেন?

ডাঃ রুদ্র হেসে বললেন, রীণার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ট্রিটমেন্ট করব তার সঙ্গে কথা বলার পর ঠিক করব। অবশ্য রীণা যদি সত্যিই সাইকোপ্যাথিক পেশেন্ট হয়।

বড়ো ঘড়িটায় ঢং ঢং করে নটা বাজল। সঞ্জয় উঠে পড়ল। এখন তাকে হোটেলে ছুটতে হবে।

.

রাতে সাড়ে দশটা শহর কলকাতায় এমন কিছু নয়। কিন্তু যশোর রোডের ধারে এই অঞ্চলটা এরই মধ্যে নিঝুম হয়ে গেছে। বিশেষ করে এই বাড়ির একতলা—দোতলার ভাড়াটেরা দশটার আগেই খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে। একমাত্র গরমকালে লোডশেডিং হলে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে এসে বসে।

সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। প্যাসেজটা অন্ধকার। বাড়িতে কে আছে যে আলো জ্বেলে রাখবে?

অন্ধকারেই সঞ্জয় তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ঢুকতেই গা—টা কেমন ছমছম করে উঠল। এর আগেও একদিন এরকম হয়েছিল, যেদিন রীণা একা মান্তুদের বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। তবে সেদিনের অস্বস্তিটা অন্য কারণে। রীণার জন্য দুর্ভাবনায়। দুর্ভাবনা আর গা ছমছম করা এক নয়।

কিন্তু আজই বা গা ছমছম করল কেন?

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি আলো জ্বালল। আলোয় ঘর ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গা—ছমছমানি থেমে গেল। নিজেকে ধমক দিল—ডাক্তার মানুষের অন্ধকারে ভয়? তাও তেতালার নিজের ঘরে ঢুকতে?

দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সঞ্জয় বিছানায় এসে বসল। হোটেলে খেয়ে এসেছে। কাজেই শোওয়া ছাড়া এখন আর অন্য কাজ নেই। কিন্তু শুতে ইচ্ছে করল না। শুলেও ঘুম আসবে না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরাল।

ডাঃ রুদ্রের কথাগুলো তার মনে পড়ছিল। আচ্ছা, রীণার প্রসঙ্গে হঠাৎ উনি ওই মহিলাটির কথা টানলেন কেন? তিনি কি রীণার ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু সন্দেহ করেন? মান্তুর দাদার সঙ্গেও ওর খুব ভাব ছিল নাকি—কী জানি বাবা! পরক্ষণেই অবশ্য সঞ্জয় সে কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না।

তার কেবলই সেইসব রাতগুলোর কথা মনে হতে লাগল যেসব রাতে রীণা ভয় পেয়েছিল। ওই তো বসার ঘরে টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই টেবিলের কাছেই রীণা কী যেন দেখেছিল। ওই টেবিল থেকেই গেলাস পড়ে ভেঙেছিল। আচ্ছা—সেই ছবিটার কী হল? সত্যিই কি কেউ নিয়ে গেছে? কিন্তু কে নেবে? এ ঘরে তো বাইরের কেউ আসে না।

ভাবতে ভাবতে সঞ্জয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে জোর করে অন্য দিকে মন সরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু মনটা সেই অশরীরী আত্মার মতো টেবিলটার চারদিকেই ঘুরতে লাগল।

কী মুশকিল! ভয় পাচ্ছে নাকি? সঞ্জয় জোর করে নিজেকে সচেতন করার চেষ্টা করল।

কই? অন্য দিন তো ভয় পায় না। ঘরে সঙ্গী তো শুধু রীণা। তাও সে তো নিজেই ভয়ের শিকার।

আশ্চর্য! আজ সেই একটা ভীতু মানুষই কাছে না থাকাতে সঞ্জয়ের মতো ডাক্তারও কেমন ভয় পাচ্ছে।

সঞ্জয় উঠে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ ও চমকে উঠল। ঘরে কি আর কেউ আছে? তার পিছনে!

নাঃ, ওটা ওর নিজেরই ছায়া।

আশ্চর্য! মেঝেতে নিজের ছায়া দেখেই বুকের মধ্যে কীরকম করে উঠেছিল। বুঝতে পারল, এই জন্যেই মানুষ বোধহয় জায়গা—বিশেষে একা থাকতে পারে না। সঙ্গী চায়। ঘরে একটা কুকুর থাকলেও যেন অনেক নিশ্চিন্ত।

নাঃ, ঘুমোনো যাক। সঞ্জয় মশারি টাঙিয়ে নিল। বিছানায় ঢুকে বেডসুইচ টিপে আলো নিভোতে যাচ্ছিল, কী মনে হল, আবার উঠে দরজাটা দেখে নিল ঠিক মতো বন্ধ হয়েছে কি না। সিঁড়ির দিকের জানলাটা অন্য দিন খোলা থাকে। আজ বন্ধ করে দিল।

বিছানার কাছে আসছিল—ফিরে গিয়ে একবার বাথরুমটা দেখে নিল। তারপর খাটের তলা।

নাঃ, কেউ কোত্থাও নেই। নিশ্চিন্ত। মনকে বোঝাল—অন্য কিছুর জন্যে নয়, চোর—ডাকাতের জন্যেই এত সাবধানতা।

বিছানায় শুয়ে বেডসুইচ অফ করে দিল।

তবু ঘুম আসছে না। তখন সঞ্জয় ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে যে কথা হল তাই নিয়ে আবার ভাবতে লাগল। ডাঃ রুদ্র যে কী বলতে চাইলেন সঞ্জয়ের কাছে তা মোটেই পরিষ্কার নয়। উনি কি এই বয়েসে এখন মেসমেরিজম শিখে চিকিৎসা করবেন? পাগল নাকি?

উনি রীণার সঙ্গে ভালো করে কথা বলবেন। তা তিনি হাজার বার বলুন। কিন্তু রীণাকে কোথাও চিকিৎসার জন্যে পাঠানো যাবে না। ও কিছুতেই রাজি হবে না।

তা ছাড়া ডাঃ রুদ্র যদিও বলছেন মানসিক রোগ, তবু প্রতিবারই বলেছেন, ‘যদি সত্যিই মানসিক রোগ হয়’—

উনি কি তবে মানসিক রোগ ছাড়া অন্য কিছু আশঙ্কা করছেন? ডাঃ রুদ্রের মতো একজন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্টও কি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাসী?

এক ঘুমেই রাত শেষ।

ঘুম ভাঙার পরই সঞ্জয়ের মনে পড়ল রীণা নেই। কাজেই চা নিয়ে কেউ আজ মুখের সামনে ধরবে না।

বিছানা থেকে উঠে পড়ল ও। মনটা খুশি খুশি, কাল রাতে কিছু হয়নি। সত্যি কিছু থাকলে তো হবে।

চা খেয়ে শেভিং—এর কাজ সেরে স্নানের ঘরে যখন ঢুকল তখন বেলা আটটা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রীণা এসে পড়বে, তবু আজ আর বাড়ির ভাত জুটবে না। ক্যান্টিনেই খেয়ে নিতে হবে। তার আগে সকালে পেটে কিছু পড়া দরকার। সঞ্জয় একটা ডিম সেদ্ধ করে নিল। তারপর কোথায় নুন, কোথায় গোলমরিচ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠল।

বেলা সাড়ে আটটা। হাসপাতালে যাবার জন্যে সঞ্জয় তৈরি। কিন্তু রীণার পাত্তা নেই। অথচ সকালেই ওর আসার কথা। মান্তুই পৌঁছে দিয়ে যাবে। কই?

পৌনে নটা হতে চলল।

নাঃ, আর দেরি করা যায় না। সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তালা লাগাল। এমনি সময়ে সিঁড়ির মুখে বন্দনা এসে দাঁড়াল।

—আপনার ফোন।

—ফোন! সঞ্জয় চমকে উঠল। কার ফোন হতে পারে? সেদিন রাতে ফোন এসেছিল থানা থেকে। আজ? আজ নিশ্চয়ই মান্তু—

বন্দনাদের বসার ঘরে ঢুকে সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।—হ্যালো!

—কী মশাই! কাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

মহিলা কণ্ঠস্বর। কিন্তু কেমন অস্পষ্ট।

—কে বলছেন?

—ও বাবা! এত মিষ্টি করে বললাম, তবু চিনতে পারলেন না? ডাক্তাররা এমনি ভোঁতাই হয়।

সঞ্জয় এবার হেসে উঠল।

—ওঃ শ্রীমতী মান্তু! বলুন কী খবর? বেরোবার মুখে এমন একটি মধুর স্বর উপহার পাব ভাবতে পারিনি।

—চুপ করুন মশাই। বেশি গলে যাবেন না। পাশেই আপনার অর্ধাঙ্গিনী আছেন। শুনতে পাবেন।

সঞ্জয় জোরে হেসে উঠল।

—হাসিটা এখন তুলে রাখুন। শুনুন এবেলা যাচ্ছি না। ওবেলা। দু’জন নয়, তিনজন। পুপুকে যদি ধরেন তা হলে সাড়ে তিনজন।

—তিনজন?

—না না, এখন কিছু বলব না। ভয় নেই, পুরুষ নন। মহিলাই। একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে চেষ্টা করবেন। জমিয়ে আড্ডা দেব। ছাড়বেন না। রীণা কথা বলবে।

সঞ্জয় রিসিভারটা কান বদল করে নিল।

—হ্যালো! আমি রীণা। কাল ভয়টয় পাওনি তো?

—ভয়? কীসের ভয়? ধুৎ!

—তাড়াতাড়ি ফিরছ তো?

—দেখি। বলে রিসিভারটা রেখে বন্দনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।