।। এগারো।। মিস থাম্পি
সাতাশে নভেম্বর।
মিস থাম্পি এসেছেন। রীণাও এসেছে। রীণাকে মান্তুই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে। একদিন থাকবে।
আসল উদ্দেশ্য মিস থাম্পির মতো মানুষ যখন আসছেন তখন রীণাকে একবার দেখিয়ে নেওয়া। মিস থাম্পি তো সারাজীবন প্রেতচর্চাই করছেন। রীণাকে দেখলে, তোর মুখ থেকে সব শুনলে হয়তো মিস থাম্পি বলতে পারবেন মানসিক ব্যাধি না অন্য কিছু। মান্তুর উদ্দেশ্যটা রীণাও জানত না।
এখানে এসেই শুধু এক পেয়ালা কফি খেয়ে বেরোবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মিস থাম্পি। রীণার সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ দেখালেন না। মান্তু তবু এক নিশ্বাসে পরিচয়টুকু মাত্র দিতে পারল। তাও তিনি ভালো করে শুনলেন বলে মনে হল না।
—চলুন মিস্টার চৌধুরী, আগে পার্ক স্ট্রিটের সিমেট্রিটা দেখে আসি।
বলে তখনই ললিতবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
পার্ক স্ট্রিটের সেই দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো কবরখানাটা মিস থাম্পি অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। মিস থাম্পির খুব ভালো লাগল।
কয়েক জায়গায় কয়েকটা কবর পরীক্ষা করলেন। ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে খানিকটা কবরের মাটি পুরে নিলেন। একটা পুরনো কবরের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে কান পেতে কী যেন শুনলেন। এমনি করে সারা সকাল কাটালেন।
মিস থাম্পি বেরিয়ে গেলে মান্তু দু পেয়ালা কফি নিয়ে রীণার কাছে এসে বসল।
—কী রে! মুখ অমন ভার কেন? মন কেমন করছে বুঝি?
রীণা ম্লান হাসল। বলল, মন বলে বোধহয় আর কিছু নেই। হ্যাঁরে, আমায় কি রাত্তিরে থাকতেই হবে?
মান্তু হেসে বলল, বরকে ছেড়ে বুঝি এক রাত্রিরও থাকতে ইচ্ছে করে না?
রীণার ফ্যাকাশে মুখে লালচে আভা ফুটে উঠল।— তা নয়। ওই বাড়িতে একা থাকা—
—দূর! তুই একটা পাগল! বলে মান্তু রান্নাঘরের দিকে উঠে গেল।
রাত্তিরে সঞ্জয় বাড়িতে একা থাকবে এ দুর্ভাবনা তো রীণার ছিলই, তাছাড়া এখানেও তার ভালো লাগছে না। সে এসেছিল নিরিবিলিতে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে। কিন্তু এদিনই একজন ভিআইপি এসে হাজির। এই মহিলাটিকে রীণার মোটেই ভালো লাগছিল না যেন কেমন ধারা। একে তো অবাঙালি, চালচলন আলাদা। কথাও কম বলেন। তাছাড়া কীসব প্রেতচর্চা করেন। নিজের ঘরেই নিত্য ভূতের আতঙ্ক তারপর এখানে এসেও—
চিন্তায় বাধা পড়ল। একজন মহিলাকে নিয়ে মান্তু ঘরে ঢুকল। রীণার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
ভদ্রমহিলা মান্তুদের প্রতিবেশিনী। মিসেস লাহিড়ী। ছোটোখাটো হাসিখুশি মানুষটি। ফর্সা রং। গোল মুখ। কপালে বড়ো একটা টিপ।
মিসেস লাহিড়ী আলাপ করতে আসেননি। এসেছিলেন অন্য উদ্দেশ্যে। তাই রীণার সঙ্গে আলাপটা হল দায়সারা গোছের।
তারপরেই মান্তকে বলল, তাহলে বিকেলে ওঁকে নিয়ে যাবেন।
রীণা ভেবেছিল বুঝি তাকেই নিয়ে যাবার কথা বলছেন। না, তা নয়। নেমন্তন্নটা ওই মাদ্রাজি মহিলাকে।
মান্তু বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। উনি ফিরে এলে বলব আমি নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন।
.
বেলা দুটো নাগাদ মিস থাম্পিকে নিয়ে ললিতবাবু ফিরলেন। খাওয়া—দাওয়া সেরে মিস থাম্পি বসলেন লিখতে।
বিকেল সাড়ে তিনটের সময় এক কাপ কফি খেলেন। তখন মান্তু খুব বিনীতভাবে মিসেস লাহিড়ির কথা বলল।
—আপনার কখন সুবিধে হবে?
মিস থাম্পি প্রথমে একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এর—ওর বাড়ি যাবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। শেষে মান্তুর বিশেষ অনুরোধে রাজি হলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন—
—সাড়ে চারটেয়।
ইতিমধ্যে মিস থাম্পির সঙ্গে রীণার অনেকবারই দেখা হল, কিন্তু তিনি কোনো কথা বলেননি। কোনো আগ্রহই যেন নেই।
মিস থাম্পির এই ব্যবহারে মান্তু বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। ওঁর কাছে ধীরেসুস্থে বসে রীণা কথা বলবে এইজন্যেই তো রীণাকে আনা। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। যাই হোক ঠিক সাড়ে চারটের সময়ে মিস থাম্পিকে নিয়ে মান্তু মিসেস লাহিড়ির বাড়ি চলল। রীণা যেতে চায়নি। মান্তু জোর করে নিয়ে গেল।
মান্তুদের দুখানা বাড়ির পরেই মিসেস লাহিড়ির বাড়ি। বাড়ির সামনে উঁচু রোয়াক। দু—পাশে খুবই সাধারণ ফুলের বাগান।
মিস থাম্পি এখানে নতুন অতিথি। তবু তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে আগে আগে হাঁটছিলেন। যেন নিজের পরিচিত জায়গাতে যাচ্ছেন। নিজেই গেট খুলে খোশ মেজাজে বাগান দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকলেন।
রোয়াকে দাঁড়িয়েছিলেন কর্তা—গিন্নি অতিথিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে। পাশে ওঁদের ছেলে, বছর তেরো বয়েস।
মিস থাম্পি রোয়াকে উঠে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন। কপালে যেন একটু ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য।
মিসেস লাহিড়িই অভ্যর্থনা করলেন, আসুন। ইনি আমার হাজব্যান্ড—
ভদ্রলোক নিজেই বাকি পরিচয়টুকু দিলেন।
—নির্মল লাহিড়ি।
মিস থাম্পি গভীর আন্তরিকতায় হ্যান্ডশেক করলেন।
—আমার ছেলে দেবল। ক্লাস এইটে পড়ছে।
মিস থাম্পি হেসে তার চুলের ওপর একটু আদর করে দিলেন।
নির্মলবাবু সবাইকে নিয়ে ভেতরের ঘরে বসালেন। মিসেস লাহিড়ি অস্বস্তিতে পড়লেন—কোন কথা দিয়ে কীভাবে আলাপ শুরু করবেন। বাংলায় বলতে পারলে সুবিধে হত।
নির্মলবাবুই কথা শুরু করলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল প্রেততত্ত্ব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু আমল পেলেন না। তিনি একবারই শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, সত্যি কি আপনি অশরীরী কিছুতে বিশ্বাসী?
মিস থাম্পি একটু হেসেছিলেন। উত্তর দেননি। এতে স্বামী—স্ত্রী দুজনেই ভারি লজ্জিত হয়েছিলেন।
এরপর খাওয়া। কফি আর কেক। সঙ্গে পোটাটো চিপস। মিস থাম্পি বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন। খেতে খেতেই মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন, লোডশেডিং হয় কিনা, হলে কী করেন? তারপর হঠাৎ মান্তুকে ইশারায় বললেন, ছেলেটিকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে।
মান্তু হতভম্ব।
মিসেস লাহিড়িও প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না তাঁর ছেলেকে ঘর থেকে চলে যেতে হবে কেন? ও তো চুপচাপ একপাশে বসে আছে। কোনোরকম অভদ্রতা করেনি। কিন্তু মিস থাম্পি আবার চোখের ইশারা করতেই দেবলকে উনি বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। একটা অজানা আশঙ্কায় স্বামী—স্ত্রীর বুক কাঁপতে লাগল। মিস থাম্পি গৃহকর্তাকে লক্ষ করে হেসে বললেন, মিস্টার লাহিড়ি, আপনি কিন্তু আপনার ফ্যামিলির সকলের কথা বলেননি।
লাহিড়িবাবু মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, আমি তো সকলের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সকলে বলতে—আমার মিসেস আর ওই ছেলে।
মিসেস লাহিড়ি যোগ করলেন, শুধু মেয়েটা এখানে নেই। মামার বাড়ি গেছে।
মিস থাম্পিও হেসে বললেন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গেই আছেন এমন একজনকে আপনারা বাদ দিয়েছেন।
স্বামী—স্ত্রী দুজনেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মিস থাম্পির দিকে তাকালেন।
মিস থাম্পি বললেন, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়ি ঢুকেই তাঁকে দেখতে পেয়েছি। বলে হাসতে লাগলেন।
অবাক নির্মল লাহিড়ি বললেন, আরও একজনকে দেখেছেন?
—হ্যাঁ, আপনারা যখন আমায় রিসিভ করছিলেন, তিনিও পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গেছেন। আমি ঘরে ঢুকেই তাঁকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু তখন আর দেখতে পেলাম না। দেখলাম পরে খাবার সময়ে। টেবিলের অল্প দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারি shy type-এর soft ভদ্রমহিলা।
মিস থাম্পি থামলেন।
সারা ঘর জুড়ে কেমন একটা অস্বস্তি। কেউ সেই মুহূর্তে কোনো কথা বলতে পারল না।
—এখন বলুন ইনি কে?
স্বামী—স্ত্রী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলেন। নির্মলবাবু একটু সামলে নিয়ে বললেন, আর তো কেউ নেই মিস থাম্পি।
—নেই, কিন্তু একসময়ে ছিলেন। একজন মহিলা। বয়েস বছর কুড়ি—বাইশ। পাতলা গড়ন। শ্যামবর্ণা। লম্বা চুল—একটু যেন কুঁজো হয়ে হাঁটেন—
শুনতে শুনেত লাহিড়িবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
—বলুন মিস্টার লাহিড়ি, এইরকম কেউ কি কখনো ছিলেন এ বাড়িতে? মিস থাম্পির গলার স্বরটা কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনাল।
কয়েক মিনিট নিরেট স্তব্ধতা। তারপর নির্মল লাহিড়ি অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনি যে রকম বর্ণনা দিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি আমার ফার্স্ট ওয়াইফের কথা বলছেন। কিন্তু সে তো অনেকদিন হল—
কথা শেষ হল না। হঠাৎ মিসেস লাহিড়ি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপরই অচৈতন্য।
বিমূঢ় নির্মল লাহিড়ি দু হাতে মিসেস লাহিড়ির দেহটা ধরে রইলেন।
Dont worry! মিস থাম্পি বললেন—একটু পরেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ওঁকে বলবেন—nothing to fear. এই মহিলা যখন জীবিত ছিলেন তখন আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। এখনো ভালোবাসেন। আর জেনে রাখুন যে spirit ভালোবাসতে পারে সে কারো ক্ষতি করে না।
বলে দু—হাত তুলে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন।
বাড়ি ফিরে মান্তু ললিতবাবুকে সব ব্যাপারটা বলল। ললিতবাবু স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন। মিস থাম্পি হঠাৎই যেন এদের কাছে সাধারণ সম্মানীয় অতিথি থেকে ভয়—বিস্ময়—শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠলেন। এও একরকম অস্বস্তি। এই সব মানুষের কোথায় কীসে তুষ্টি কীসে বিপত্তি বোঝা দায়। তাছাড়া অন্য অস্বস্তিও রয়েছে মান্তুর। যে জন্যে রীণাকে আনা তা আর কিছুতেই হচ্ছে না। ওকে নিয়ে যে নিরিবিলিতে মিস থাম্পির কাছে বসবে, মিস থাম্পি তার ফুরসতটুকুও দিচ্ছেন না। মিসেস লাহিড়ির বাড়ি থেকে ফিরে এসে আবার খাতাপত্র নিয়ে বসেছেন উনি। হয় তো আরো দু—একদিন থাকবেন। কিন্তু রীণা আর কিছুতেই থাকবে না। ওকে কাল সকালেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।
রীণার ওপরই মান্তুর রাগ হল। ও যদি নিজে মিস থাম্পির কাছে গিয়ে সোজাসুজি ওর বিপদের কথা বলত, তাহলে হাঙ্গামা চুকে যেত। কিন্তু ও তো ত্রিসীমানায় ঘেঁষছেই না।
রাত নটা বাজল। মিস থাম্পি তাঁর খাতা নোটবই ব্যাগে পুরে বেরিয়ে এলেন।
—আপনার খাবার ব্যবস্থা করি? মান্তু বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল।
—করুন। আজ তাড়াতাড়ি শোব। খুব টায়ার্ড।
খাওয়া—দাওয়া চুকে গেল খুব তাড়াতাড়ি আর নিঃশব্দে। যা সচরাচর হয় না। কারণ যাঁর সঙ্গে ওরা গল্প করবে ভেবেছিল, তিনিই তো অতিশয় গম্ভীর।
মান্তু দেখল আর সময় নেই। খাওয়ার পরই মিস থাম্পি শুয়ে পড়বেন। আর রীণাও কাল সকালে চলে যাবে। কাজেই খাওয়ার পরই রীণাকে নিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকতে হবে।
মান্তুকে দুর্ভাবনার হাত থেকে বাঁচালেন মিস থাম্পিই।
খাওয়া শেষ করে রীণা থালায় আঙুল দিয়ে আঁক কাটছিল। হঠাৎ মিস থাম্পি জিজ্ঞেস করলেন—Why you look so pale? রাত্রে ভালো ঘুম হয় না?
রীণা চমকে মিস থাম্পির দিকে তাকাল।.
–Are you a victim of any nightmare? রাতে কোনো দুঃস্বপ্ন দ্যাখ?
রীণা প্রথমে কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তার পরই সংকোচ কাটিয়ে বলল, Not dream madam! something else.
মিস থাম্পি ভুরু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকালেন।
রীণা বলল, Not only at night–constantly haunted by a feeling of an unknown fear.
মান্তু এই সুযোগে বন্ধুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, শুধু রাত্তিরেই নয়, দিনেও খুব ভয় পায়।
–What is that fear?
–That I do not know myself, ভয়টা কী ম্যাডাম, আমি নিজেও তো জানি না।
মিস থাম্পি কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, আজ আমি খুব টায়ার্ড। কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলব। ঠিক সকাল ছটায়।