১.১১ কিংকর্তব্য

১১. কিংকর্তব্য

১৮ই ফেব্রুয়ারি কাদুতে বারজাকের মিশনের সদস্যরা ঘুম থেকে উঠেই ভড়কে গেলেন। তাঁদের রক্ষিদল আর যত কালো সহিস বা কুলি ছিলো সবাই উধাও! দেখে সকলেরই চক্ষুস্থির! এই দু-পল্লা দলত্যাগ এমনই অপ্রত্যাশিত ও চমকপ্রদ, বিশেষ ক’রে রক্ষিদলের পিঠটান, যে গোড়ায় ব্যাপারটা তাদের বিশ্বাসই হতে চায়নি। চোখ রগড়ে গোড়ায় তাঁরা ভেবেছেন সবাই একযোগে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন না তো! কিন্তু তারপরেই এসেছে প্রমাণ, এরা গেছে আর-কখনও ফিরবে না ব’লেই।

আমেদে ফ্লরেঁস, তাঁর আক্কেলগুড়ুম ভাবটা কেটে যাবার পর, সকলের কাছে গিয়ে দুঃসংবাদটা ভেঙেছেন, আর অমনি সবাই এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমটায়, স্বভাবতই, কারু কোনো বাক্যস্ফূর্তি হয়নি—অস্ফুট বিস্ময়ধ্বনি করা ছাড়া চিন্তাভাবনা করার মতো দশাই কারু ছিলো না। এবার তাঁরা কী করবেন, এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাঁদের কণ্ঠ থেকে শুধু বিস্ময়ধ্বনিই বেরিয়েছে।

পাশের ঝোপটার মধ্য থেকে যখন গোঙানির শব্দ কানে এসেছে, তখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁরা যে ভেবেছিলেন শুধু-তাঁরাই এখানে প’ড়ে আছেন, এই ধারণাটা আদপেই ঠিক নয়। অমনি তাঁরা ছুটে গিয়েছেন যেখান থেকে ঐ গোঙানিটা আসছিলো, গিয়ে দ্যাখেন তোঙ্গানে সেখানে প’ড়ে আছে হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় বাঁধা, আর তার ওপর গায়ের একপাশে একটা ক্ষতচিহ্ন।

তার বাঁধন খুলে দিয়ে প্রাথমিক শুশ্রূষার পর, একটু যখন চাঙ্গা ক’রে তোলা গেছে, তখন তাকে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন তাঁরা। কিছুটা তার নিজের ভাষায়, কিছুটা বাম্বারায়, একটা-দুটো ভাঙা ফরাশিতে, সে তাঁদের খুলে বলেছে এই দলত্যাগের দৃশ্যের সে যা-কিছু দেখেছে।

কতগুলো অদ্ভুত আওয়াজ শুনে শেষরাতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। অবাক হ’য়ে তাকিয়ে দ্যাখে কুড়িজন সেপাই ঘোড়া ছুটিয়ে চ’লে যাচ্ছে। এদিকে লিউটেনান্ট ল্যকুর তাঁর দুই সার্জেন্টকে নিয়ে সব কুলি আর সহিসকে তাড়া লাগিয়েছেন—তারা যে কী করছিলো তোঙ্গানে তা দেখতে পায়নি। এতক্ষণ অব্দি তার কোনো সন্দেহ হয়নি, শুধু কৌতূহলের বশে সে উঠে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো—এমন শেষরাতে উঠে তারা করছেটা কী।

সে তাদের কাছেই যেতে পারেনি। মাঝপথেই দুটি ষণ্ডামতো লোক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, একজন এমনভাবে তার টুটি টিপে ধরেছে যে সে টু শব্দটিও করতে পারেনি। তক্ষুনি তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে মুখটা বেঁধে হাত-পা বেঁধে, তাকে ওভাবে ফেলে রেখেছে। তবে তখন সে এটুকু দেখতে পেয়েছে আফ্রিকিরা সবাই তল্পিবাহক এবং সহিস, সবাই- অগুনতি বান্ডিল তাদের কাঁধে চাপিয়ে নিচ্ছে। সব রসদপত্র, সব তোঙ্গানেকে ওভাবেই মাটিতে ফেলে রেখে ষণ্ডা দুটো চ’লে যাচ্ছিলো, এমন সময় লিউটেনান্ট ল্যকুর চাপাগলায় জিগেস করেছেন : ‘ওদিককার সব ব্যবস্থা হ’য়ে গেছে তো?’

‘হ্যাঁ,’ উত্তর দিয়েছে গোরা সার্জেন্টের একজন।

একটু চুপ হ’য়ে গিয়েছে সবাই। তোঙ্গানের মনে হয়েছে কে যেন ঝুঁকে প’ড়ে তাকে লক্ষ ক’রে দেখছে। হাত দিয়ে কে যেন তার শরীরে পরীক্ষা ক’রে দেখছে!

‘আহাম্মক একেকটা!’ রূঢ় স্বরে বলেছেন লিউটেনান্ট। ‘তোমরা কেটে পড়ছো, অথচ যাবার আগে একটা বদমায়েশকে ফেলে রেখে যাচ্ছো, যে হয়তো বড়- বেশি চোখে দেখে ফেলেছে। বুড়বাক কাঁহাকা! রবার্ট, একটা সঙিনের খোঁচায় এটাকে সাবাড় ক’রে দাও তো!’

তক্ষুনি হুকুম তামিল করেছে গোরাদের একজন, কিন্তু শেষমুহূর্তে তোঙ্গানে তার শরীরটায় একটা মোচড় দিতে পেরেছিলো। বুকে বিঁধে যাবার বদলে সঙিনের ফলাটা তার পাশ দিয়ে হড়কে গেছে, তাতে জখমটা দেখতে যত-জমকালো, হয়েছে, ততটা সাংঘাতিক হয়নি। অন্ধকারে লিউটেনান্ট আর তাঁর স্যাঙাত্রা ভালো ক’রে দেখতে পায়নি, বিশেষ ক’রে তোঙ্গানে তখন এমন-জোরে আর্তনাদ ক’রে উঠেছে যেন তার প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর দম বন্ধ ক’রে প’ড়ে থেকেছে নিঃসাড়। সঙিনের ফলায় রক্তের দাগ দেখেও আততায়ীরা ঠ’কে গিয়েছে।

‘খতম তো?’ জিগেস করেছেন লিউটেনান্ট ল্যকুর।

‘খতম!’ রবার্ট নামে লোকটা বলেছে।

তারপর তিনজনে দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছে, তোঙ্গানে আর- কিছুই শুনতে পায়নি। তারপরেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে, মুখের মধ্যে গোঁজা কাপড়টা তার প্রায় দম আটকেই দিচ্ছিলো, আর ক্ষত থেকে রক্তও পড়েছিলো প্রচুর। তারপর আর- কিছুই সে জানে না।

এ থেকেই বোঝা গেছে এটা কোনো আকস্মিক অন্তর্ধান নয়, পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। আর এটা বুঝতে পেরেই হতবৃদ্ধি হয়ে অভিযাত্রীরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাউয়ি করেছেন। শেষটায় স্তব্ধতা ভেঙেছেন আমেদে ফরেন, ‘গোছানে কাজ। জলদিই সেরেছে সব।’

এই মন্তব্যটাই বুঝি অধিজ্যতাটা ভেঙে দিয়েছে। কীভাবে এই বিষম পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, তক্ষুনি তার জন্যে একটা মন্ত্রণাসভা ব’সে গেছে। প্রথমে অস্ত্রশস্ত্রের একটা খতিয়ান নেয়া দরকার। সাতটা বন্দুক, তার মধ্যে ছটা ছিলো শিকারের জন্যে; দশটা রিভলবার, অজস্র গোলাবারুদ, সাতটা ঘোড়া, ছত্রিশটা গাধা, প্রায় একহাজার পাউন্ড উপহার-উপঢৌকনের সামগ্রী, আর চার-পাঁচ দিনের উপযোগী রসদ। আপাতত আত্মরক্ষার জন্যে যথেষ্ট হাতিয়ার আছে, বাহনও আছে, আর রসদ নিয়ে ততটা মাথা না ঘামালেও চলবে, কেননা গাঁয়ে-গঞ্জে খাবারদাবার মিলবে, আর এখন থেকে শিকারও করা যাবে—জঙ্গলের এদিকটায়। কাজেই যেখানেই গিয়ে পৌঁছোন না কেন, ঘরছাড়া দিকহারা, অভিযাত্রীদের দলটাকে অন্তত পার্থিব জিনিশপত্রের জন্যে খাবি খেতে হবে না।

প্রথমে গাধাগুলোর একটা ব্যবস্থা করা জরুরি : অভিজ্ঞ সহিস বা রাখাল ছাড়া এই গাধার দল রাস্তায় একটা মস্ত বাধাই হ’য়ে উঠবে। তারপর ছক ক’ষে নেয়া হ’লো। যদি তাঁরা অনেকটা পথ পেরিয়ে যাবার কথা ঠিক ক’রে নেন, পথে অন্তত পাঁচ-ছ জন কুলি ভাড়া ক’রে নিতে হবে, অন্তত উপঢৌকনগুলো ব’য়ে নিয়ে যাবার জন্যে-সেগুলোর বদলেই গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে তাঁরা তাঁদের জন্যে দরকারি রসদপত্র জোগাড় ক’রে নিতে পারবেন। না-হ’লে এই এতসব উপহারসামগ্রী যতই দুর্মূল্য হোক না কেন, সব পথেই ফেলে রেখে যেতে হবে। সঙ্গে ব’য়ে নিয়ে যেতে হ’লে কুলি চাই, না-হ’লে এ-সব পদে-পদে শুধু বাধারই সৃষ্টি করবে।

জেন মোর্‌নাস আর সাঁৎ-বেরা-এই দুজনেই শুধু এখানকার লোকজনের কথাবার্তা বুঝতে পারবে : তারা তক্ষুনি কাদুর বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ক’রে ফেললে। গাঁয়ে লোকেরা তাদের সাদরেই অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো, আর যৎকিঞ্চিৎ উপহার অবিলম্বেই অর্জন করেছিলো গ্রামপ্রধানের অনুকম্পা—যতটা পারে, সে তাদের সাহায্য করলে।

তারই সাহায্যে গাধাগুলো বিক্রি ক’রে দেয়া হ’লো, একেকটার দাম পড়লো দশহাজার কড়ি (তিরিশ ফ্রাংকের মতো হবে), আর সবশুদ্ধু পাওয়া গেলো ৩৫০,০০০ কড়ি। এই কড়ির মারফৎই অন্তত আগামী কুড়িদিনের রসদের মামলাটা চুকলো, এই কড়িতেই পাঁচজন কুলিরও মাইনে দেয়া যাবে—গ্রামপ্রধানই এই পাঁচজন কুলির ব্যবস্থা ক’রে দিলে।

এইসব আদানপ্রদান বিলিব্যবস্থাতেই কয়েকটা দিন কেটে গেছে অভিযাত্রীদের, কিন্তু এ-সময়টা নষ্ট হ’য়েছে বলা যাবে না : তোঙ্গানের পক্ষে এর আগে পথের ধকল সহ্য করা সম্ভব হ’তো না। শেষটায় তার ক্ষত-তেমন গভীর-কোনো ক্ষত ছিলো না-ক্রমেই শুকিয়ে আসতে শুরু করলে।

আর তাই, ২৩শে সকালবেলায়, ছ-টা ক্যাম্পচেয়ারে গোল হ’য়ে ব’সে, মাঝখানটায় মানচিত্রগুলো বিছিয়ে রাখা হ’লো। তারপর তোঙ্গানে আর মলিককে শ্রোতা হিশেবে পাশে রেখে মঁসিয় বারজাকের সভাপতিত্বে শুরু হ’লো আলোচনা-সভা।

‘সভা তাহ’লে শুরু হ’লো,’ প্রায় যান্ত্রিকভাবেই বলেছেন তিনি, যেন সংসদের সব দস্তুর তাঁর অজান্তেই তাঁর মুখ ফসকে বেরিয়েছে। ‘আমি অধিবেশন শুরু হয়েছে ব’লে ঘোষণা করছি। প্রথমে কে বলতে চান?’

একটু মুচকি হাসি খেলে গিয়েছে সকলের মুখে। আমেদে ফ্লরেঁস, তাঁর আবার শ্লেষপরিহাস খুব আসে, একবারও গলা, না-ঝেড়েই বলেছেন, ‘আমরা আপনার ভাষণের পরেই বলবো মঁসিয় ল্য প্রেসিদেনৎ।’

‘যা আপনাদের অভিরুচি,’ তাঁকে মসিয় ল্য প্রেসিদেনৎ বলায় তিনি একটুও অবাক হননি। ‘প্রথমে আমাদের বর্তমান অবস্থাটা পর্যালোচনা ক’রে নিতে হবে। এক. আমরা অপস্তুত অবস্থায় অকস্মাৎ আবিষ্কার করেছি আমাদের রক্ষিদল আমাদের ফেলে রেখেই চ’লে গিয়েছে, তবে, দুই. আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে বেশ, আর আছে সদাগরি পণ্য, এই বেসাতি প্রধানত উপহারের জন্যেই ছিলো, এবং তিন. আমরা এখন আছি সুদানে, উপকূল থেকে অনেকটাই দূরে।’

এই কথা শুনে মঁসিয় পঁসাঁ তাঁর মস্ত নোটবইটা বার ক’রে এনেছেন তাঁর পকেট থেকে, নাকের ডগায় একটা প্যাশনে চাপিয়ে-যে-পঁসাঁ ককখনো কিছু বলতেন না-বলেছেন : ‘ঠিক আটশো আশি মাইল নশো আটত্রিশ গজ একফুট এবং পৌনে-পাঁচ ইঞ্চি দূরে-দূরত্বটা আমি মেপেছি আমার তাঁবুর মাঝখানের খুঁটিটা থেকে।’

‘এতটা-যথাযথ হবার ঠিক দরকার ছিলো না, মঁসিয় পঁসাঁ,’ বারজাক মন্তব্য করেছেন। ‘এটা বললেই চলবে যে আমরা প্রায় নশো মাইল চলে এসেছি কোনাক্রি থেকে। আপনারা নিশ্চয়ই অনবগত নন, আমাদের অভিপ্রায় ছিলো আরো-এগিয়ে-যাওয়া, কিন্তু এই নূতন পরিস্থিতিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করে আমাদের একটি পরিমার্জিত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হবে। আমার প্রস্তাব, আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হওয়া উচিত যে-ক’রেই হোক—সত্বর না-হ’লেও—নিরাপদে নিকটবর্তী কোনো ফরাশি বসতিতে গিয়ে পৌছুনো। সেখানে আমরা সকলের পরামর্শ নেবো পরবর্তী কার্যক্রম আমরা সেখানেই শান্তভাবে স্থির ক’রে নিতে পারবো।’

সর্বসম্মতিক্রমেই প্রস্তাবটা গৃহীত হ’লো।

‘মানচিত্র অনুযায়ী,’ বারজাকের ভাষণ তখনও থামেনি, ‘আমাদের অবশ্য নাইজারের তীরে কোনো-একজায়গায় গিয়ে পৌঁছনো উচিত। তাহ’লে কি উয়াগাদুগু আর এদিয়াঙ্গো হ’য়ে আমরা সায়ীতে পৌছুবার চেষ্টা করবো না? টিমবাকটু দখল ক’রে নেবার পর থেকে ফরাশি সেনাবাহিনী ভাঁটির দিকে ক্রমশ চারপাশের এলাকা দখল করতে করতে এগিয়েছে; কবুল করি, আমার মোটেই জানা নেই, তারা সায়ীও দখল করেছে কি না—তবে মনে হয় সেটাও তাদের এক্তিয়ারে এসে পড়েছে—মনে হয় কেন, এসেই গেছে সম্ভবত। তারপর আমরা যদি সেখানে নতুন-কোনো রক্ষিদল নিয়োগ করতে পারি, তাহ’লে আমরা পূর্বতন পরিকল্পনা অনুযায়ীই এগুতে পারবো।’

‘কিন্তু তাতে যে কতগুলো অসুবিধের সৃষ্টি হবে, মঁসিয় ল্য প্রেসিদেনৎ, ‘ নোটবইতে জ্বরাতুর হাতে অঙ্ক কষতে কষতে ব’লে উঠেছেন মঁসিয় পঁসাঁ, আমাদের পাঁচশো মাইল পথ যেতে হবে। আমাদের প্রতিকদম গড়ে পঁচিশ ইঞ্চি পথ পেরোয়। পাঁচশো মাইল যে তাহ’লে হবে ১,০১১,১১১ কদম এবং তপুপরি আরেকটি ভগ্নাংশ।’ তাঁর মুখ দিয়ে তুবড়ির মতো নানারকম সংখ্যা ছুটতে শুরু করেছে।

‘ওঃ! ওঃ! ওঃ!’ অমনি পরিস্ফুট আর্তনাদের প্রস্রবণ ছুটেছে আমেদে ফ্লরেঁসের মুখ থেকে, এত-সব সংখ্যা শুনে তাঁর প্রায় মাথাখারাপ হ’য়ে যাবারই দাখিল। নার্ভাস ব্রেকডাউনের চোটটা সামলাতে সামলাতে তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি সোজাসুজি বলতে পারতেন না দিনে দশ মাইল ক’রে এগুলো সবশুদ্ধু আমাদের তিপান্ন দিন লাগবে-আর যদি দিনে সাড়ে-বারো মাইল পথ মেরে দিতে পারি, তবে মাত্র চল্লিশ দিনেই পৌঁছে যাবো। ঐ লক্ষ-কোটি সংখ্যা দিয়ে আপনি আসলে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন?’

‘শুধু এই,’ ঠাণ্ডাগলায় বলেছেন মসিয় পঁসাঁ, তাঁর সেই ভয়াবহ নোটবইটা সরিয়ে রাখতে-রাখতে। ‘যে, দিজেনে দিয়েই নাইজারে গিয়ে পৌঁছুলে আমরা ভালো করবো। তাতে দূরত্বটা অর্ধেক হ’য়ে যাবে-পাঁচশোর বদলে সেটা তখন আড়াইশো মাইল হ’য়ে যাবে।’

‘তার চেয়েও ভালো আরেকটা উপায় আছে,’ মানচিত্রে আঙুল দেখিয়ে আমেদে ফ্লরেঁস বলেছেন, ‘সেগু-সিকারোতেই নাইজারে পৌঁছুনো যাবে, তাতে বামার ওপর দিয়ে যেতে হবে। তাতে মোটে একশো মাইল পথ পেরুতে হবে। তাছাড়া বসতিটাও সেখানে বেশ বড়ো, আমরা যে সেখানে সাহায্য পাবোই, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

চমৎকার প্রস্তাব, ডাক্তার শাতোনে সায় দিয়েছেন, ‘তবে আমার মনে হয় তার চেয়েও ভালো একটা পথ আছে। আমরা বরং ফিরে যাই—আমি উপকূলে ফিরে যেতে বলছি না, তবে অন্তত সিকাসো অব্দি ফিরে যেতে বলছি। মাত্র একশোকুড়ি মাইল পেরুতে হবে। সেখানে আমরা ফরাশি ছাউনিতে দেশের লোক পাবো, মনে আছে নিশ্চয়ই কী-রকম হুল্লোড় ক’রে তারা আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলো। সেখানেই সকলের সঙ্গে আলোচনা ক’রে আমরা স্থির করতে পারবো আমরা বামাকো যাবো, না মঁসিয় আমেদে ফ্লরেঁস যেমন বলেছেন এবং আমিও যার সঙ্গে একমত, সেগু-সিকোরো যাবো।’

‘ডাক্তারই ঠিক বলেছেন,’ ফ্লঁরেস সায় দিয়েছেন, ‘সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

‘মঁসিয় ফ্লরেঁস,’ একমিনিট কী যেন ভেবে, নিজের বীরত্ব দেখিয়ে সঙ্গীদের তাক লাগিয়ে দেবার জন্যেই, বারজাক ফের ব’লে উঠেছেন, ‘আপনি আর ডাক্তার হয়তো সমীচীন প্রস্তাবই করেছেন। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, সিকাসোতে ফিরে- যাওয়ার মানে কি এই দাঁড়াবে না যে আমরা মিশনের পরিকল্পনাটা মাঝপথেই বাতিল ক’রে দিয়েছি। কিন্তু, মহোদয়গণ, এটা খেয়াল করবেন, যে-ব্যক্তি আরব্ধ কর্তব্যকর্মকেই সর্বাগ্রে স্থাপন করেছে…’

আমরা আপনার অনীহা বুঝতে পারি, মঁসিয় বারজাক,’ কথার তোড়ের মাঝখানেই বাধা দিয়েছেন ফ্লরেঁস, বয়ানটা যে কোনোদিকে চলেছে সেটা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি, ‘কিন্তু প্রশ্নটা এখানে কর্তব্যের নয়, বিচক্ষণতার।’

‘কর্তব্য, না বিচক্ষণতা—কীসের যে প্রশ্ন, সেটা অবশ্য ঠিক ক’রে নিতে হবে,’ মঁসিয় বারজাককে থামাবে কে? ‘আবারও ভেবে দেখুন অবস্থাটা : এটা ঠিক যে আমাদের রক্ষিদল আমাদের ছেড়ে রেখে পালিয়েছে, কিন্তু আমরা তো নিজেদের একবার জিগেস ক’রে নেবো যে তাতে আমাদের কী বিপদআপদে পড়তে হ’তে পারে। আমাদের একমাত্র ঝামেলা এসেছে কোনো কল্পিত শত্রুর কাছ থেকে—দুশমন যে কেউ-একজন আছে, সেটা আমারও মনে হয় কিন্তু তার অস্তিত্বের কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ আমরা পাইনি –কেননা তার সম্বন্ধে যা-কিছু আমরা জানি সব কতগুলো উৎপাত-উপদ্রবের মধ্যে দিয়ে, আর এই উৎপাতগুলো সে-ই ঘটিয়েছে কি না, তা কি আমরা নিশ্চিত ক’রে জানি? একেকটা ক’রে উৎপাতগুলো নিয়ে ভাবুন, দেখবেন সে-সব নিতান্তই তুচ্ছ। শুধু আমাদের বিরক্ত করা ছাড়া আর কী কে করেছে? মঁসিয় ফ্লরেঁসের মতে : গোড়ায় কে যেন আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিলো; এবং আবারও এই অজ্ঞাত দুশমনটি আমাদের লোকজনদের মধ্যে কতগুলো ঘোঁট পাকিয়ে তুলতে চেয়েছিলো, আর কোনোভাবে, কোন পদ্ধতিতে তা আমি জানি না, যে নাকি আমাদের ওপর এক নকল রক্ষিদল চাপিয়ে দিয়েছিলো –এবং তারা যা করেছে, তার মোকাবিলা করবার জন্যেই আজকের এই সভা। কিন্তু অনুগ্রহ ক’রে মনে রাখবেন, সে বিস্তর সংযমের পরিচয় দিয়েছে, তার পদ্ধতিও বেশ-মোলায়েম। নকল-রক্ষিদল আমাদের ফেলে পিঠদান না-দিয়ে আমাদের ০সবাইকে হত্যা ক’রে যেতেও পারতো। আমাদের যদি তারা খুন করতে চাইতো, তবে তাদের ঠেকাতো কে! কিন্তু তারা ও-রকম কিছুই করেনি। বরং আমাদের জন্যে সব রসদ, সব অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ, গাধাঘোড়া এবং বেসাতিপণ্য রেখে দিয়ে গেছে। তারা এ-সব কেড়েও নিতে পারতো। উত্ত্যক্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও সাংঘাতিক-কিছু করেনি।’

‘কেন? তোঙ্গানে,’ ডাক্তার শাতোনে মনে করিয়ে দিয়েছেন তোঙ্গানেকে তারা খুনই করতে চেয়েছিলো।

‘তোঙ্গানে একজন নিগ্রো,’ বারজাক উত্তর দিয়েছেন, ‘আর অনেকেরই কাছে, নিগ্রোদের প্রাণ কোনো প্রাণই নয়।’

ফ্লরেঁস বাধা দিয়ে বলেছেন, মসিয় বারজাকের এ-কথাটা ঠিক যে আমাদের অজ্ঞাত শত্রুর আচারআচরণ বেশ-মোলায়েমই—এবং এখনও-অব্দি কেউ আমাদের প্রাণে মারেনি। আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি, এখনও-অব্দি, কিন্তু আমরা যেদিকটায় যাচ্ছি, সেদিকে কারু যাওয়া যে এই অজ্ঞাত শত্রু পছন্দ করে না, এটা বেশ-স্পষ্ট—এ-যাবৎ সে যা করেছে তাতে যদি দ্যাখে কোনো কাজ হয়নি তবে সে-যে ভয়ংকর-কিছু ক’রে বসবে না, তা-ই বা কে জানে। তোঙ্গানেকে যে-রকমভাবে তারা খুন ক’রে ফেলতে চেয়েছিলো, তাতে বোঝা যায় যে দরকার হ’লে আঘাত হানতেও তারা ছাড়বে না, আর তখন যে আঘাত হানবে সেটা হবে মোক্ষম মার, আর তেরিয়া ও ক্ষিপ্ৰ ‘

‘ঠিক,’ ডাক্তার সায় দিয়েছেন।

ডাক্তার শাতোনের সমর্থনের পর কয়েক মিনিট সবাই চুপচাপ হ’য়েই ছিলেন, মঁসিয় বারজাককে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে সাত- পাঁচ ভেবে নিচ্ছেন। আমেদে ফ্লরেঁস কোনো অন্যায্য যুক্তি তোলেননি, আর মিদির মাননীয় সাংসদ নিশ্চয়ই পারীতে তাঁর শত্রুপক্ষকে কী কটাক্ষ করবে তার দুর্ভাবনাতেই নিজের জীবনটা এখানে আফ্রিকার জঙ্গলে বিপন্ন করবেন না-আর অভিযানটা অসমাপ্ত রেখে মাঝপথেই যদি ফিরে-যাওয়া যায়, তখন তাঁর সমালোচকদের জব্দ করবার জন্যে কোনো জবরদস্ত বয়ানই কি তিনি খুঁজে পাবেন না?

‘সবদিক বিবেচনা ক’রে,’ যে-সব যুক্তি খাড়া ক’রে সংসদে তিনি তাঁর বিপক্ষ সদস্যদের মুখ বন্ধ ক’রে দেবেন, তারই দু-একটা এখানকার শ্রোতাদের ওপর পরখ ক’রে দেখতে চেয়েছেন তিনি, ‘সবদিক বিবেচনা করে, আমি মঁসিয় আমেদে ফ্লরেঁসের প্রস্তাবটাকেই সমর্থন করছি—বিশেষত আমাদের মাননীয় সহকর্মী ডাক্তার শাতোনে যেভাবে সে-প্রস্তাবটা পরিমার্জিত ক’রে সভার সামনে উপস্থাপিত করেছেন, তাতে এ-প্রস্তাব সমর্থন না-করার কোনো যুক্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তাই সিকাসোতে ফিরে যাবার পক্ষেই ভোট দিচ্ছি-আর পরে সেগু- সিকোরোই হবে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তাহ’লে, মহোদয়গণ….’

এখানে আমেদে ফ্লরেঁসের কাছে পুরো বয়ানটাই একটু ভারি মনে হওয়ায় তিনি আর তাতে কর্ণপাত না-ক’রে অন্য-কী-একটা বিষয় ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

‘তাহ’লে, মহোদয়গণ, কেউ যদি অহেতুকভাবে অভিযান পথেই বন্ধ ক’রে দেবার জন্যে অভিযোগ তোলে, আমি উত্তর দেবো, এর দায় সরকারেরই ওপর বর্তাবে, কারণ সরকারেরই উচিত ছিলো, আমাদের যথোচিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যখন রক্ষিদলকে অমনভাবে, কোনোকিছু না-বলে-ক’য়ে, দুম ক’রে বদলে দেয়া হয়েছে একদল দস্যুদলে, যখন এই দস্যুদল কোনোভাবেই আমাদের আগেকার রক্ষিদলের বিকল্প হবার যোগ্যতা রাখে না, তখন আমরা নাচার হ’য়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি এমন-কোনো বিকল্পের ব্যবস্থা করা না-হ’তো, কিংবা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন কারু হাতে আমাদের নিরাপত্তার দায় তুলে দেয়া হ’তো, তাহ’লেও না-হয় কথা ছিলো। এই আমাদের বিবেচ্য নয় যে কেন এমন করা হয়েছে। তার জন্যে বরং আমি দাবি করবো একটা নিরপেক্ষ তদন্তকমিশন বসানো হোক। যে-তদন্তকমিশন সবদিক খতিয়ে দেখে আমাদের বলবে…’

‘মাফ করবেন, মঁসিয়,’ আমেদে ফ্লরেঁস বাধা দিয়ে বলেছেন, ‘যদি আমাকে একটা কথা বলবার অনুমতি দেন…’

সাংবাদিকটিই প্রথমে সবচেয়ে বিচক্ষণ রাস্তাটি বাৎলেছিলেন, কেননা পৃথিবীর ঘাৎ-ঘোঁৎ তিনি ভালোই জানেন, অনেক ঠেকে-বুঝে শিখেছেন, কিন্তু যেই তিনি দেখেছেন তাঁর প্রস্তাবটাই গ্রহণ করা হবে, অমনি সে-সম্বন্ধে সমস্ত উৎসাহ তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক-মিনিট বাদেই তাঁর মনে হয়েছে, এ-নিয়ে চাপ না-দিলেই ভালো হ’তো, কারণ ঠিক যখন অভিযানটা চমৎকারভাবে রোমাঞ্চকর ও উত্তেজক হ’য়ে উঠছে, তখনই এমনভাবে ফিরে না-যেতে হ’লেই ভালো হ’তো, তাহলে হয়তো অনেক কিস্তি চিত্তাকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক রচনাই তাঁর লেখনী থেকে নিঃসৃত হ’তো। আর ঠিক তখনই তাঁর নজর পড়েছে তাঁর আরো দুজন সহযাত্রীর ওপর। অমনি তিনি বাধা দিয়ে ব’লে উঠেছেন, ‘মঁসিয় ল্য প্রেসিদেনৎ যদি অনুমতি দেন… আমরা এত-বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, অথচ একবারও মাদ্‌মোয়াজেল মোর্‌নাস বা মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরার কোনো মতামত জিগেস করিনি। আমার মনে হয়, এই আলোচনাসভায় তাঁদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য থাকতে পারে।’

সত্যি, যতক্ষণ ধ’রে এই সাংসদীয় অধিবেশনের নকলে সভাটি চলেছে, এঁরা দুজনে চুপচাপ ব’সে সবকিছু শুনছিলেন, আলোচনায় তাঁরা কোনোই অংশ নেননি।

মঁসিয় ফ্লরেঁস হক কথাই বলেছেন,’ বারজাক স্বীকার করেছেন। ‘যদি দয়া ক’রে আপনি আপনার মতটা বলেন, মাদমোয়াজেল…’

‘আমার মত জিগেস করার জন্যে ধন্যবাদ,’ শান্ত গলায় বলেছেন মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস। ‘তবে যে-আলোচনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্বন্ধ নেই, তাতে যোগদান করা আমাদের পক্ষে উচিত হবে না।’

আপনাদের কোনো সম্বন্ধ নেই? কেন নেই, মাদ্‌মোয়াজেল? আমার তো মনে হচ্ছে আমরা সবাই একঝাঁকেরই পাখি।’

‘মোটেই তা নয়, মসিয়,’ জেন মোর্‌নাস উত্তর দিয়েছেন, ‘যদি পরিস্থিতির চাপে প’ড়ে, এই দুর্বিপাকের মাঝখানে, আপনারা আপনাদের অগেকার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন, সে আপনাদের ব্যাপার। আমি আমাদের সংকল্প থেকে চ্যুত হবো না। যখন আপনারা এ-রকম একটা বিপাকে পড়েছেন তখন আমাদের ছেড়ে চ’লে-যাওয়াটা আমাদের ঠিক মনঃপূত হয়নি। না-হ’লে আমরা তো সারাক্ষণই ব’লে এসেছি আমরা আমাদের পরিকল্পনামাফিক আমাদের নিজেদের পথেই যাবো।’

‘তাহ’লে আপনারা এখনও গাও অব্দি যেতে চাচ্ছেন?’

‘এখন তো আরো-বেশি ক’রেই চাচ্ছি।’

‘একা-একাই? কোনো রক্ষিদল ছাড়াই?’

‘আমরা তো কখনও অন্যকিছু আশা করিনি। ‘

‘কোনো কুলিও চাই না?’

আমরা অন্য কুলি ভাড়া করে নেবার চেষ্টা করবো। যদি কাউকেই না- পাই, অগত্যা তাদের ছাড়াই যেতে হবে বৈ-কি।’

‘এই অজ্ঞাত-কারু দুশমনি সত্ত্বেও?’

‘এই অজ্ঞাত-কারু শত্রুতা সত্ত্বেও। আমার মনে হয় আমরা কখনোই শত্রুর লক্ষ্য ছিলুম না—বরং বারজাক মিশনকেই সে বাধা দিতে চেয়েছে।’

‘সে আপনি বলবেন কী ক’রে-বিশেষত আমরা যখন একই সঙ্গে, একই পথ ধ’রে, এতটা রাস্তা এসেছি? তবে আমাদের অজ্ঞাতে শত্রু নিশ্চয়ই এবার আপনাদের প্রাণটাই অতিষ্ঠ ক’রে তুলবে—বিশেষত যদি আপনারা একা-একাই নাইজার নদীর বাঁকে যেতে চান।’

তা যদি হয়, তবে তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে নিশ্চয়ই।’

‘কিন্তু এ-যে উন্মাদের কাণ্ড হবে!’ আত্মবিস্মৃত হ’য়ে মঁসিয় বারজাক ব’লে উঠেছেন, ‘এ-রকম অবিবেচকের মতো আপনাদের আমরা যেতে দিতে পারি না, মাদমোয়াজেল। একটা খামখেয়ালের বশে আপনারা এত-বড়ো একটা ঝুঁকি নিতে যাবেন, আর আমরা তা হাত-পা গুটিয়ে ব’সে-ব’সে দেখবো, তা হয় না। তার জন্যে যদি জোর খাটাতে হয়, তবু…’

মাদমোয়াজেল মোর্‌নাস একমুহূর্ত কী ভেবে বিষণ্ণ গলায় বলেছেন দুর্ভাগ্যবশত, এটা মোটেই কোনো খামখেয়ালের প্রশ্ন নয়।’

‘তবে কীসের প্রশ্ন?’ এবার একটু অবাকই হয়েছেন মঁসিয় বারজাক।

জেন মোর্‌নাস একটু ইতস্তত করেছেন। তারপর গম্ভীর গলায় বলেছেন : কর্তব্যের প্রশ্ন।’

অন্যরা কী-রকম ভ্যাবাচাকা খেয়ে এই রূপসীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থেকেছেন। এমন-কোন কর্তব্য তাঁকে টান দিয়েছে যে তাঁকে নাইজার নদীর বাঁকে যেতেই হবে? সাংবাদিকটি অবশ্য প্রথম থেকেই ভেবে এসেছেন, এঁদের এই সফরে বেরুবার মধ্যে নিছকই আষাঢ়ে-কোনো খেয়ালিপনা নেই। এখন তাঁর উৎফুল্লই লেগেছে নিজেকে-অ্যাদ্দিনে তিনি জানতে পারবেন কেন এঁরা নাছোড়ভাবে এতটা পথ এসেছেন।

জেন মোর্‌নাস বিষাদগম্ভীর সুরে বলেছেন : ‘আমাকে মাফ করবেন আপনারা। আমি আপনাদের প্রতারিত করেছিলুম।…

আরো-তাজ্জব হ’য়ে বারজাক ব’লে উঠেছেন : ‘প্রতারিত করেছিলেন?’ হ্যাঁ, আপনাদের অ্যাদ্দিন প্রতারিত ক’রেই এসেছি আমি। মসিয় দ্য সাঁৎ- বেরা তাঁর আসল পরিচয়ই দিয়েছেন আপনাদের-আপনাদেরই মতো ফরাশি তিনি। কিন্তু আমি মিথ্যে পরিচয় দিলে ফরাশি সেজে আপনাদের সঙ্গে এত দূর

এসেছি। আমি আসলে ইংরেজ, আমার নাম জেন ব্লেজন। আমি লর্ড রেজনের মেয়ে আর কাপ্তেন ব্লেজন আমার দাদা। আর আমার সেই দুর্ভাগা দাদাটি কুবোতেই মারা যান ব’লে শোনা যায়। তাই আমায় কুবো অব্দি যেতেই হবে, কারণ সেখানেই আমি এতদিন ধ’রে যে-কাজটা করতে চেয়েছি, সেটা শেষ করতে পারবো।

তারপর থেকে জেন ব্লেজন-এখন থেকে তাকে এই-নামেই ডাকা হবে—খুলে বলেছে কী শোচনীয় ও দুঃসহ কাণ্ড ঘটেছিলো কুবোয় : কী কুখ্যাত অভিযোগ উঠেছিলো জর্জ ব্লেজনের বিরুদ্ধে, তার মর্মান্তিক মৃত্যুর রহস্যময় পরিস্থিতি, আর তার বাবার আত্মধিক্কার ও হতাশা। এবারে সে খুলে বলেছে তার এই কর্তব্য কী : পবিত্র দায়িত্ব : তার দাদার হৃতমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, বংশের ইজ্জতের ওপর যে কালির দাগ লেগেছে সেটা মুছে ফেলা, আর সেই বৃদ্ধের মনে আবার শান্তি ফিরিয়ে দেয়া, যিনি শোচনীয় নিঃসঙ্গতার মধ্যে উল্টোক্সোটার দুর্গে আস্তে- আস্তে মরণের কোলে ঢ’লে পড়ছেন।

তার অবরুদ্ধ আবেগ বাঁধভাঙা বন্যার মতো এতদিন বাদে খুলে এসেছে, আর তার তোড়েই যেন শ্রোতারা ভেসে গিয়েছেন। এই কচি-মেয়েটির তারিফ ক’রে যেন পার পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই কাজগুলো করবে ব’লেই সে এতটা পথশ্রম সহ্য করেছে, এতটা বিপদ-আপদ মাথা পেতে নিয়েছে! এখনও যে কত বিপদ তার সামনে আছে, কে জানে! কত বিপদ, কত অবসাদ!

সে থামতেই আমেদে ফ্লরেঁস ব’লে উঠেছেন, একটু রূঢ় স্বরেই, মিস ব্লেজন, আপনার বিরুদ্ধে আমার একটা নালিশ আছে।’

নালিশ?… আমার বিরুদ্ধে?’ এ-রকম একটা অদ্ভুত সাড়া পেয়ে জেন একেবারে হকচকিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, নালিশ… এবং এই-অভিযোগ বেশ গুরুতরই! ফরাশিদের সম্বন্ধে কী- সব অদ্ভুত কথা ভেবেছেন আপনি, মিস ব্লেজন-আর তাদেরও মধ্যে আমেদে ফ্লরেঁস সম্বন্ধেই বা কী ভেবেছেন আপনি?’

একটু ভড়কে গিয়ে তো-তো ক’রে জেন বলেছে, ‘আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, মসিয় ফ্লঁরেস?’

‘কী? আপনি কি ভেবেছেন আমেদে ফ্লরেঁস আপনাকে এরা-একাই কুবো যেতে দেবে—যদি তাকে আপনি সঙ্গে নিয়ে না-যান?’

‘ওহ্, মঁসিয় ফ্লরেঁস…’ এতক্ষণে জেন বুঝতে পেরেছে তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। চমৎকার! তোফা! বাহবা! শাবাশ!’ যেন বিষম চ’টে গিয়েছেন, এমনি ভঙ্গি ক’রেই বলেছেন আমেদে ফ্লরেঁস। ‘সত্যি! এত স্বার্থপর!’

‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…

‘দয়া ক’রে আমাকে আগে শেষ করতে দিন। আপনি দেখছি বেমালুম ভুলেই গেছেন যে আমি একজন সাংবাদিক, আর আমার এক কিমাশ্চর্য বস্তু আছে, যার নাম সম্পাদক! আপনার কি কোনো ধারণা আছে ব্লেজন-রহস্য সম্বন্ধে কিছু জানবার পরেও অমন-চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর ব্যাপারটা নিয়ে যদি কিছু না- লিখি, তবে আমার সেই বিদঘুটে সম্পাদকসাহেব কী বলবেন? বলবেন, ‘ওহে খোকা ফ্লরেঁস, তুমি নিতান্তই একটি কচিখুকু ছাড়া আর কিছু নও!’ তারপর সোজা আমায় আঙুল তুলে দরজাটা দেখিয়ে দেবেন। উঁহু, মিস ব্লেজন, এমনভাবে আমার চাকরিটা থেকে আমি বরখাস্ত হ’তে চাই না। অতএব আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যাবো-নাছোড়বান্দার মতো আপনার সঙ্গে এঁটে থাকবো!’

‘ওহ, মঁসিয় ফ্লরেঁস।’ জেন একেবারে অভিভূত হ’য়ে গিয়েছে।

সাংবাদিক সোজাসুজি তার মুখের দিকে তাকিয়েছেন। ‘আমি আপনার সঙ্গে যাবো, মিস ব্লেজন। আর আমাকে মানা করবার চেষ্টা ক’রে মিথ্যে সময় নষ্ট করবেন না—’

জেনের চোখ ফেটে প্রায় জল বেরিয়ে এসেছে। মঁসিয় ফ্লরেঁসের হাত ধ’রে সে ধরাগলায় বলেছে : ‘আপনাকে আমি বারণ করবো না, মঁসিয় ফ্লরেঁস।’

‘আর আমি, মিস ব্লেজন? আমাকেও আপনি সঙ্গে নেবেন তো?’ হঠাৎ ডাক্তার শাতোনের গম্ভীর-গম্ভীর গলা শোনা গেছে।

‘আপনি, ডাক্তার?’

নিশ্চয়ই। কোনো ডাক্তারকে বাদ দিয়ে এ-রকম কোনো সফর হয় না কি? আপনাকে তো মনে হয় দুরাত্মারা কুচিকুচি কেটে ফেলবে—তখন সেগুলো শেলাই ক’রে জুড়ে দেবার জন্যে আমাকে সঙ্গে থাকতে হবে না?’

‘ওহ্, ডাক্তার,’ এবার জেন কেঁদেই ফেলেছে।

কিন্তু বারজাক যখন ক্রুদ্ধস্বরে ব’লে উঠেছেন, ‘বাঃ! আর আমার বেলায় কী! আমাকে দেখছি কেউ হিশেবেই ধরছে না—কারণ আমার মতটা নেবার কথা অব্দি কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি!’ তখনই বা জেন কী ভেবেছে?

বারজাক সত্যি খেপেই গিয়েছেন। তিনিও, পুরো কাহিনীটা শোনবামাত্র, মিস ব্লেজনের সঙ্গে যাবার কথা ভেবেছিলেন। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন তিনি। কারণ এই তরুণী যে-পথ ধ’রে যাবে সেটা প্রায় তাঁর যাবার পথ। তাছাড়া যতই অবিমৃশ্যকারিতা হোক না কেন, জেনের অভিযানের পেছনকার মূল উদ্দেশ্যের গভীরতা তাঁর অন্তর স্পর্শ করেছিলো। তাছাড়া চার- চার জন পুরুষ, চারজন ফরাশি পুরুষ, তারা কি ককখনো জঙ্গলের মধ্যে এমন- একটি কচি-মেয়েকে একা ছেড়ে দিয়ে চ’লে যেতে পারে? ফ্লরেঁস আর শাতোনে ঠিক তাঁরই মুখের কথাটা কেড়ে নিয়েছেন –আর নাটকের অভিনয়ের সময় কেউ যদি অন্য-কারু মুখের কথা কেড়ে নেয়, তবে কি ঝামেলা বাধে না?

আমি মঁসিয় ফ্লরেঁসের হ’য়ে কথা বলছি না,’ তাঁর বিরক্তিটাকে একটু বাড়াবাড়িভাবেই প্রকাশ করেছেন তিনি, ‘তিনি স্বাধীন মানুষ। কিন্তু, ডাক্তার, আপনি –আপনি তো এই বারজাক মিশনের সদস্য-যার নেতৃত্বের ভার, আমার ধারণা ছিলো, আমারই ওপর দেয়া হয়েছে। আপনিও কি আপনার নেতাকে অসহায় ফেলে মাঝরাস্তায় দল ছেড়ে চ’লে যাবেন? ঐ রক্ষিদলের মতো?’

‘মানে… আমি…’ ডাক্তার তোৎলাতে শুরু করেছেন। মারটা যে এদিক থেকে আসবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।

‘আর তা যদি আপনি ভেবে না-থাকেন, ডাক্তার, তাহ’লে আপনি কি ধ’রে নেননি যে আমিও কুবো যাচ্ছি? কিন্তু আমরা কীভাবে, কখন, কোন্ রাস্তা দিয়ে যাবো, সেটা ঠিক করে দেবার ভার কি আপনার ওপর এসে বর্তেছে? আপনার দায় তো, যত দূর জানতুম, এটাই খেয়াল রাখা আমি যাতে বহালতবিয়ৎ থাকি, সুস্থ…’

‘মানে… আমি…’

‘না, ডাক্তার, না। আমি তা কিছুতেই মানবো না।’ বারজাকের গলার স্বর ক্রমশই চড়েছে। আর এটা মনে ক’রে রেখে দেবেন, নাইজার মিশনের দলপতি আপনার মলবটা মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। তবে, অন্যদিক থেকে, আমাদের একমাত্র যে-গাইড আছে এখন, সে যেহেতু মিস ব্লেজনেরই চাকরি করে, সে যেহেতু তাঁরই কথায় চলবে, এবং এটাও মনে রেখে যে মঁসিয় সাঁৎ- বেরা ও মিস ব্লেজনের ভাষাতাত্তিক কৃতিত্ব ছাড়া আফ্রিকিদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার কোনো উপায় আমাদের নেই, আমি চাই, অর্থাৎ, এটা বলতে চাই, এটাই আমার অনুজ্ঞা, যে…’

বারজাক, যাঁর গলাটা সপ্তমে চ’ড়ে গিয়েছিলো এতক্ষণে, হঠাৎ নাটুকেভাবে গলার স্বরটা নামিয়ে এনে বলেছেন : আমরা সবাই কুবো হ’য়ে নাইজার নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছুবো।’

‘মঁসিয় বারজাক…’ শুনতে ভুল করেছে কি না বুঝতে না-পেরে জেন তোলাতে শুরু করেছে।

‘ঠিকই শুনেছেন, মিস ব্লেজন। আপনি চান বা না-চান, আমাদের সাহচর্য আপনাকে মেনে নিতেই হবে।’

‘ওহ, মঁসিয় বারজাক…’ আবারও শুধু এই-পর্যন্তই তোৎলাতে পেরেছে জেন। ‘এ-সফরটা মোটেই কঠিন হবে না,’ ঘোষণা করেছেন ফ্লরেঁস, ‘কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবারদাবার আছে।’

‘পাঁচদিনের মতো তো বটেই,’ এমনভাবে বলেছেন ডাক্তার শাতোনে যে তিনি যেন আসলে বোঝাতে চেয়েছেন- ছ-মাসের মতো তো বটেই।

‘উহুঁ, মাত্র চারদিনের উপযোগীই আছে,’ শুধরে দিয়েছেন বারজাক, ‘কিন্তু পথে আমরা আরো কিনে নিতে পারবো।’

তাছাড়া শিকারও জুটবে,’ ডাক্তার মনে করিয়ে দিয়েছেন।

‘বাঃ, আর মাছ নেই বুঝি জলে?’ এতক্ষণে একটা কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন বেচারি সাঁৎ-বেরা।

‘আর ফলমূল—কী খাওয়া যায় তা আমি ব’লে দিতে পারতো।’—এটা, ডাক্তার।

‘আমি কন্দমূল চিনি,’ তোঙ্গানের কণ্ঠস্বর।

‘হিপ, হিপ, হিপ, হুরে!’ অতএব হর্ষধ্বনি করেছেন আমেদে ফ্লরেঁস। ‘এ তো দেখছি আসল কাপুয়া, কানানের দেশ, যথার্থ ভূস্বৰ্গ!’

‘কালকেই তাহ’লে আমরা রওনা হ’য়ে পড়বো,’ বারজাক অমনি সংক্ষেপে ব’লে দিয়েছেন। ‘একমুহূর্তও সময় নষ্ট না-ক’রে আমাদের তৈরি হ’য়ে নিতে হবে।’

এটা কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে মসিয় পঁসাঁ সেই-থেকে একবারও মুখ খোলেননি। কিন্তু যেই ঠিক হয়েছে যে সদলবলে এবার কুবো যাওয়া হবে, অমনি তিনি তাঁর নোটবইটা বার ক’রে এনেছেন, আর হিশেব করতে শুরু ক’রে দিয়েছেন ক-কদম ফেলে শেষঅব্দি কুবো গিয়ে পৌঁছুনো যাবে।

‘এ তো ভালোকথাই,’ বারজাকের সিদ্ধান্তের উত্তরে অবশেষে তিনি জানিয়েছেন, ‘কুবোর রাস্তা, সেগু-সিকোরোর তুলনায়, আরো আড়াইশো মাইল লম্বা। আমাদের একেক কদমে—আমরা তো জানিই যে আমরা মাত্র পঁচিশ ইঞ্চি যেতে পারি, অতএব…’

কিন্তু কেউ তাঁর কথায় কান দিচ্ছিলো না। অন্যরা পরদিনের যাত্রার প্রস্তুতিতে এর মধ্যেই সব তোড়জোড় শুরু ক’রে দিয়েছে। মঁসিয় পঁসাঁ মিথ্যেই আফ্রিকার জঙ্গলে তাঁর এমন দুর্লভ গাণিতিক প্রতিভাটাকে অপচয় করছিলেন।