১.১০ পরিত্রাণ

দশম পরিচ্ছেদ – পরিত্রাণ 

জয়বন্ত বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন; কিন্তু প্রাণরক্ষা করিবার ইচ্ছা মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি; তিনি উঠিবেন, যদি কোন একটা উপায় থাকে; কিন্তু চল্লিশ হাত নিম্ন হইতে কিরূপে উপরে উঠা সম্ভব? 

যদি কূপের প্রাচীর স্থানে স্থানে ভাঙা থাকে, তাহা হইলে সেই ভগ্ন স্থানগুলি ধরিয়া বা পা লাগাইয়া তিনি উপরে উঠিলেও উঠিতে সক্ষম হইতে পারেন; কিন্তু ঘোর অন্ধকার, কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না; তবুও তিনি একবার উঠিয়া চারিদিক হাতড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু এটা ইঁদারা, চারিদিক গাঁথা, বহুকাল হইতে জল থাকায় চারিদিকের প্রাচীর এত মসৃণ হইয়াছে যে, তাহাতে হাত দিলে হাত পিছলাইয়া যায়। এরূপ অবস্থায় এ প্রাচীর বহিয়া উপরে উঠিবার কোনই আশা নাই। 

জয়বন্ত হতাশ হইয়া আবার বসিয়া পড়িলেন। আবার স্তম্ভিতপ্রায় হইয়া বহুক্ষণ বসিয়া রহিলেন, কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তবে কি এই কূপের মধ্যে পড়িয়া তিনি অনাহারে মারা যাইবেন! ভগবান তাঁহার অদৃষ্টে কি এমন ভয়ানক মৃত্যুর ব্যবস্থা করিয়া তাঁহাকে এ সংসারে প্রেরণ করিয়াছেন! 

তিনি আবার উঠিলেন। সহসা তাঁহার মনে একটা কথা উদিত হওয়ায় তিনি উৎসাহ ও আবেগে প্রায় আত্মহারা হইলেন, তাঁহার মনে হইল, এত বড় কূপের ভিতর নামিবার জন্য কতকগুলি কড়া থাকা সম্ভব, এরূপ কূপের প্রাচীরে প্রায় লৌহনির্ম্মিত কড়া লাগান থাকে, এই কড়া অবলম্বনে লোকে নীচে নামিয়া আসিয়া, কূপ পরিষ্কার বা মেরামত করিয়া আবার উপরে উঠিতে পারে। এ রকম গভীর ও প্রকাণ্ড ইঁদারায় নামিবার-উঠিবার অন্য উপায় নাই। 

এত বড় ইঁদারায় কি কড়া থাকিবে না? খুব সম্ভব আছে। এই ভাবিয়া তিনি সত্বর উঠিলেন। অন্ধকারে আবার হাতড়াইতে হাতড়াইতে তিনি কূপের প্রাচীর ধরিলেন। তৎপরে প্রাচীর ধরিয়া তিনি চারিদিকে 

ঘুরিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনখানে তিনি কড়া দেখিতে পাইলেন না। 

তিনি হতাশ হইয়া, কূপের প্রাচীরে পৃষ্ঠরক্ষা করিয়া বসিয়া পড়িলেন সহসা পৃষ্ঠে তাঁহার কি ঠেকিল—হাত দিয়া দেখিলেন; দেখিলেন, একটা লোহার কনা, সহসা তিনি আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইলেন। 

অন্ধকারে আর কড়া আছে কি না, তাহা তিনি দেখিতে পাইলেন না; কিন্তু যখন একটা রহিয়াছে, তখন মধ্যে মধ্যে নিশ্চয়ই আরও কতকগুলা আছে। কিন্তু অন্ধকারে কড়া দেখিতে না পাইলে উপর হইতে আবার নীচে পড়িবার সম্ভাবনা—ইহাতে বিপদ আছে, হাত পা ভাঙিবার সম্ভাবনাও আছে; কিন্তু এই কূপের মধ্যে অনাহারে ধীরে ধীরে, তিল তিল করিয়া অসহ্য যন্ত্রণায় মরিতে হইবে! তাহাপেক্ষা একেবারে মরা ভাল। প্রাণ যায় তাহাও স্বীকার, চেষ্টা করিয়া একবার দেখিতে হইবে। 

জয়বন্ত কাপড় ভাল করিয়া আঁটিয়া পরিয়া লইলেন। তৎপরে সেই কড়াটায় পা দিয়া, বাম হস্তে প্রাচীরে ভর করিয়া উপরের কড়া খুঁজিতে লাগিলেন। উপরে সমব্যবধানে আরও অন্যান্য কড়া ছিল, খুঁজিতে কষ্ট হইল না। তিনি দক্ষিণ হস্তে আর একটা কড়া ধরিলেন। 

এইরূপে অতি কষ্টে, অতি সাবধানে কড়া ধরিয়া ধরিয়া প্রায় এক ঘন্টা পরিশ্রমের পর জয়বন্ত উপরে উঠিলেন। দেখিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে শোভনা প্রকৃতির মুখে কৃষ্ণাবগুন্ঠন। 

তিনি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছিলেন, অবসন্নভাবে সেই অন্ধকারে নির্জ্জনে বসিয়া পড়িলেন। মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা পাইলে মানুষের প্রাণে যে ভাব হয়, তাহা যিনি কখনও সে অবস্থায় না পড়িয়াছেন, তিনি তাহা বুঝিতে পারিবেন না। কিয়ৎক্ষণ তথায় বিশ্রাম করিয়া জয়বন্ত গৃহের দিকে ফিরিলেন। পথে আসিতে আসিতে ভাবিলেন, “প্রথমে তুলসীর সম্মুখে যাইতে হইবে; দেখি, হঠাৎ আমাকে সে দেখিয়া কি করে? সে জানে, আমি কূপের ভিতরেই আবদ্ধ আছি। অথবা পড়িয়াই মরিয়া গিয়াছি।” 

এই ভাবিয়া মনে মনে হাসিয়া জয়বন্ত হরকিষণ দাসের বাড়ীর পশ্চাদ্দিকে যেখানে তুলসী বাঈ থাকিত, সেইদিকে আসিলেন। তাহার ঘরের জানালা উন্মুক্ত ছিল, তিনি দেখিলেন, ঘরে আলো জ্বলিতেছে। উন্মুক্ত জানালা দিয়া আলোকশিখা বাহিরের অন্ধকার বক্ষে উজ্জ্বলভাবে প্রসারিত হইয়াছিল। জানালার পার্শ্বে গিয়া মাথা তুলিয়া জয়বন্ত দেখিলেন, তুলসী বাঈ চিন্তামগ্নভাবে বসিয়া আছে। জয়বন্ত জানালায় ঘা দিয়া একটী শব্দ করিলেন, অমনি তুলসী তাঁহার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিল। তৎপর সে বিকট চীৎকার করিয়া বলিল, “ভূত—ভূত–ভূত—” 

তাহার চীৎকারে চারিদিক হইতে লোক সেইদিকে ছুটিয়া আসিল। জয়বন্তও সম্মুখদ্বার দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। গোলযোগ শুনিয়া হরকিষণ দাসও অন্যান্যের ন্যায় তুলসী বাঈর বাড়ীর দিকে চলিলেন। সেখানে জয়বন্তকে দেখিয়া হরকিষণ দাস বলিলেন, “তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সন্ধ্যা হইতে আমি তোমকে খুঁজিতেছি।” 

জয়বন্ত তুলসী বাঈকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এ পাগল হইয়াছে, দেখিতেছি।” 

হরকিষণ বলিলেন, “পাগল — সে কি?” 

জয়বন্ত বলিলেন, “হয় ত আমি যাহা বলিব, শুনিলে আপনি বিশ্বাস করিবেন না। এ এখন অজ্ঞান — হইয়াছে — পরে—’ 

“এখানে অনেক লোক আছে, উহাকে দেখিবে—এইদিকে এস।” 

উভয়ে বাহিরে আসিলে হরকিষণ দাস বলিলেন, “ব্যাপার কি—কি হইয়াছে—তুমি নিজেই–”

“শুনুন সব” বলিয়া জয়বন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, সমস্ত তাঁহাকে বলিলেন। তুলসী বাঈ কূপের উপর হইতে তাঁহাকে যাহা শাসাইয়া বলিয়াছিল, তাহাও বলিলেন। শুনিয়া হরকিষণ দাস বলিলেন, “তাহার মানে কি? তবে কি গোপাল দাস মারা গিয়াছে?” 

“তুলসী বাঈ ত বলিল, — কেমন করিয়া বলিব?” 

“ইহার কিছুই আমি বুঝিতে পারিতেছি না।” 

“তুলসীর জ্ঞান হইলে সে নিশ্চয়ই সব বলিবে।” 

“যদি না বলে?” 

“যাহাতে বলে তাহা করিতে হইবে।” 

সহসা তাঁহারা এক বিকট চীৎকার শুনিয়া চমকিত হইয়া উঠিলেন—তুলসী আবার চীৎকার করিয়া বলিতেছে, “ভূত—ভূত—ভূত।” 

সেইদিন হইতে তুলসী ঘোরতর জ্বরে আক্রান্ত হইল। তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল, অবস্থা দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়, জীবনের আশা খুব কম। 

একাদশ পরিচ্ছেদ – রোষান্বিতা 

হরকিষণ দাস তুলসী বাঈ এর সুচিকিৎসার জন্য ব্যয় করিতে ত্রুটি করিলেন না। সুচিকিৎসায় তুলসী বাঈ সে যাত্রা রক্ষা পাইল। 

প্রায় পনের দিন পরে সে পথ্য পাইল, উঠিয়া বসিতে পারিল। ডাক্তার সাহস দিয়া বলিলেন, “আর কোন ভয় নাই, আপনারা এখন ইহাকে যাহা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।” 

পর দিবস বৈকালে হরকিষণ দাস ও জয়বন্ত উভয়ে তুলসীর ঘরে আসিলেন। তুলসী তাঁহাদের মুখের দিকে কেবল একবার ব্যাকুলভাবে চাহিল, কোন কথা কহিল না। 

জয়বন্ত বলিলেন, “তুলসী বাঈ, যেমন করিয়া হউক, আমি রক্ষা পাইয়াছি, সে কথা শুনিবার তোমার আবশ্যক নাই। এখন আমি জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, তুমি আমাকে কূপের ভিতর ফেলিয়া দিয়া হত্যা করিতে গিয়াছিলে কেন?” 

তুলসী বাঈ কোন উত্তর দিল না। 

জয়বন্ত বলিলেন, “আমি তোমার উপরে রাগ করি নাই। নিশ্চয়ই কোন কারণে তুমি আমার উপরে রাগ করিয়াছ, সে কারণ কি?” 

এবারও তুলসী বাঈ কথা কহিল না। 

জয়বত্ত বলিলেন, “তুমি সেদিন বলিয়াছিলেন, আমি তোমার স্বামীকে খুন করিয়াছি। আমি কখনও তাহাকে দেখি নাই, আমি তাহার নাম পর্য্যন্ত জানিতাম না। আমি জীবনে খুন করা দূরে থাক, কখনও কাহাকে সামান্য একটা আঘাত পর্য্যন্ত করিতে সাহসী হই নাই।” 

এবার তুলসী বাঈ তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। জয়বন্ত বলিলেন, “তোমাকে মুখ দেখাইতে আমি লজ্জিত নই। তোমার স্বামীকে যদি আমি খুন করিতাম, তাহা হইলে কি আমি তোমার সম্মুখে এইরূপভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিতাম?”

তথাপি তুলসী বাঈ নিরুত্তর। 

জয়বন্ত বলিতে লাগিলেন, “আমি যে জাহাজে এখানে আসিয়াছিলাম, সে জাহাজে একটি লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়, কিন্তু সেই লোক আত্মহত্যা করিয়াছিল, কি খুন হইয়াছিল, তাহা আমি জানি না; তাহার নাম পর্য্যন্ত শুনি নাই। সে-ই কি তোমার স্বামী? না অন্য সেই লোক, যে ব্যক্তি খুন হইয়াছিল?” 

এবার তুলসী বাঈ কথা কহিল, বলিয়া উঠিল, “অন্য লোক! সে আবার কে?”

জয়বন্ত কহিলেন, “হাঁ, জাহাজে দুইজন লোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল।”

তুলসী বাঈ কহিল, “আমি কেবল একজনের মৃতদেহ দেখিয়াছিলাম।”

হরকিষণ দাস বলিয়া উঠিলেন, “কি আশ্চর্য্য! তুমি কিরকমে দেখিলে?” 

তুলসী বাঈ কথা কহিয়া ধরা পড়িয়াছে দেখিয়া আর কোন কথা কহিল না। কেবল একবার বিরক্তদৃষ্টির দ্বারা জয়বত্তকে বিদ্ধ করিতে চেষ্টা করিল। 

জয়বন্ত সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া আবার বলিলেন, “তুলসী বাঈ, তুমি ছেলেমানুষ হইয়ো না। আমি তোমার স্বামীকে খুন করি নাই, ইহা তুমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিতেছ? যদি যথার্থই তিনি খুন হইয়া থাকেন, তবে তোমার জানা উচিত যে, কিরূপে খুন হইয়াছেন। জাহাজে দুইটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা শুনিয়াছি, কিন্তু কোনটিই দেখি নাই। কাপ্তেন কাহাকেও দেখিতে দেয় নাই। যদি তাঁহাদের মধ্যে কেহ তোমার স্বামী হন, তাহা হইলে তিনি কিরূপে খুন হইয়াছেন, তাহা তোমার জানিবার চেষ্টা করা উচিত। সেইজন্য বলিতেছি যে, তুমি সব আমাদিগকে বল।” 

তুলসী বাঈ ক্ষণেক নীরবে থাকিয়া কহিল, “আমি তোমকে বিশ্বাস করি না।” 

“অবিশ্বাসের কারণ নাই, বরং বিশ্বাস করিলে ফল আছে। আমি এক সময়ে ডিটেকটিভগিরি শিখিয়াছিলাম। আমায় সব বলিলে আমি এ বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে পারিব।” 

তুলসী বাঈ আবার কহিল, “আমি তোমায় বিশ্বাস করি না।” 

জয়বন্ত কহিলেন, “আমি জানি, কিন্তু কেন অবিশ্বাস করিতেছ, বল। তাহল হইলে আমি তোমায় বুঝাইয়া দিতে পারি যে, অবিশ্বাসের কোন কারণ নাই।”

তুলসী বলিল, “আমি তোমাকে আমার স্বামীর কাপড় পরিতে দেখিয়াছি।” 

“কি! তোমার স্বামীর কাপড়!” বলিয়া জয়বন্ত বিস্ময়-ব্যাকুলনেত্রে তুলসীর মুখের দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “আমি আমি তোমার স্বামীর কাপড় পরিতেছি, সে কি? সত্যই তোমার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে, দেখিতেছি।” 

তুলসী বলিল, “হাঁ, তোমার কাপড়ে আমার নিজের হাতের চিহ্ন রহিয়াছে, আর ঐ কাপড় পরিয়াই আমার স্বামী বাহির হইয়াছিলেন। 

জয়বন্ত বলিলেন, কি—কি—দেখি—হাঁ—মনে পড়িয়াছে—একটা বালিকাকে রক্ষা করিবার জন্য সমুদ্রে লাফাইয়া পড়ায় আমার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছিল। জাহাজে উঠিলে একজন ভদ্রলোক আমাকে তাড়াতাড়ি একখানা কাপড় আনিয়া দেয়, হয়ত ভুলিয়া অন্যের কাপড় আনিয়া দিয়াছিল—তাহা হইলে দেখিতেছি, তোমার স্বামী নিশ্চয়ই সেই জাহাজে ছিলেন। আচ্ছা, তিনি খুন হইয়াছেন, কিসে জানিলে?” 

তুলসী বাঈ বলিল, “আমি সে জাহাজে গিয়াছিলাম।” 

“কেন?” 

“আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করিতে।” 

“তাহা হইলে তুমি জানিতে যে, তোমার স্বামী সেই জাহাজে আসিতেছেন?” 

“হাঁ, তাহার পত্র পাইয়াছিলাম।” 

“সব খুলিয়া বল।” 

“এখন বুঝিতেছি, অপর মৃতদেহ-ই আমার স্বামীর।” 

“সব খুলিয়া বল।” 

“আমি সব বলিতেছি, বোধ হয়, সব বলাই ভাল।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – বিস্ময়ান্বিত 

হরকিষণ এতক্ষণ নীরব ছিলেন, এইবার তিনি তুলসীকে বলিলেন, “তাহা হইলে গোপাল দাস বোম্বাই গিয়াছিল?” 

তুলসীবাঈ বলিল, “মনিবজী, সব বলিতেছি, আমার স্বামী আপনার টাকা চুরি করিয়াছিল।”

“আমার টাকা।” 

“হাঁ, লাখ টাকা।” 

“লাখ টাকা।” 

হরকিষণ দাস মৃদুহাস্য করিলেন। লাখ টাকা তিনি একসঙ্গে নিজেই কখনও দেখেন নাই; মনে করিলেন, তুলসীর উন্মাদরোগ এখনও সারে নাই। 

তুলসী বাঈ বলিল, “আপনি আমাকে পাগল মনে করিতেছেন, আমি পাগল নই। আপনার এক মামী বোম্বাই ছিলেন।” 

হরকিষণ দাস চমকিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলেন; তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “তাহা তুমি জানিলে কিরূপে?” 

“স্বামীর কাছে শুনিয়াছিলাম। আপনার সেই মামী মারা গিয়াছেন, আপনার মামী লাখ টাকার সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন।” 

হরকিষণ দাস বিস্মিত হইয়া বিস্ফারিত নয়নে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন! মুখ দিয়া কথা সরিল না।

তুলসী বাঈ বলিল, “আমার স্বামী আপনার সমস্ত চিঠি-পত্র খুলিত। তাহাই সে আপনার মামীর উকীলের পত্রে তাঁহার মৃত্যুর কথা ও সম্পত্তির কথা জানিতে পারে। টাকার লোভে সে আপনার নাম লইয়া বোম্বাই গিয়াছিল।” 

হরকিষণ দাস ভয়ানক ভ্রুকুটি করিলেন। তৎপরে ধীরে ধরে বলিলেন, “বুঝিতেছি।” 

জয়বন্ত বলিলেন, “এখন বুঝিতেছি।” 

হরকিষণ দাস ক্রোধভরে বলিয়া উঠিলেন, “বুঝিতেছি আমার মাথা! আমার সে লাখ টাকা কই?”

তুলসী বাঈ বলিল, “নিশ্চয় কেহ আমার স্বামীকে খুন করিয়া এ টাকা চুরি করিয়াছে।” 

জয়বন্ত বলিলেন, “তোমার স্বামী যে তোমাকে চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহা তোমার কাছে আছে?”

“আছে, ঐ বাক্সে।” 

জয়বন্ত বাক্স হইতে চিঠীখানি লইয়া পড়িলেন। তৎপরে বলিলেন, “আর তুমি কিছু জান না?”

“না।” 

“ভাল, আমি এ বিষয় সন্ধান করিব, যদি কিছু জানিতে পারি, তোমায় বলিব।” তাহার পর তিনি হরকিষণ দাসের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আসুন।” 

তাহার বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারী গোপাল দাস চোর—তাঁহার টাকা চুরি করিয়াছিল, ক্রোধে হরকিষণ দাসের আপাদমস্তক পূর্ণ হইয়া গেল। কোন কথা কহিলেন না। জয়বত্তের সহিত বাহিরে আসিলেন। 

হরকিষণ বাহিরে আসিয়া বসিয়া পড়িলেন। জয়বন্ত বলিলেন, “যাহা শুনিলেন, আপনার বিশ্বাস হয়?” 

“বিশ্বাস হয়? কেন হইবে না, চোর-বদমাইস-জালিয়াৎ—” 

“আপনার হইয়া এ বিষয়ের অনুসন্ধানের ভার আমাকে দিবেন?”

“আমার হইয়া।” 

“হাঁ, আপনার লাখ টাকা চুরি গিয়াছে।” 

“তা ত স্পষ্ট দেখিতেছি।” 

“এই টাকা কে চুরি করিয়াছে, তাহার অনুসন্ধান আমি করিব।”

“তুমি করিবে?” 

“কেন নয়? আমি দিনকতক গোয়েন্দাগিরি শিখিয়াছিলাম।” 

“তুমি কি করিতে চাও?” 

“বোম্বাই গিয়া ইহার অনুসন্ধান করিতে হইবে। প্রথমে দেখিতে হইবে, যে লোকটার মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে, সে যথার্থ গোপাল দাস কিনা।”

“তাহার পর কি করিবে?” 

“তাহার পর অনুসন্ধান করিতে হইবে, কে আপনার মাতুলানীর উকিল ছিলেন, তিনি যথার্থ গোপাল দাসকে সে লাখ টাকা দিয়াছিলেন কি না।”

“তাহার পর?” 

“খুব সম্ভব, নোটই দেওয়া হইয়াছিল, লাখ টাকা এত ভারি যে কেন নগদ লইতে পারে না। যদি নোট হয়, তাহা হইলে তাহার নম্বর পাওয়া যাইবে।” 

“এ কথা মন্দ শুনাইতেছে না।” 

“এই টাকার জন্য খুন, সুতরাং পুলিসও যথেষ্ট সাহায্য করিবে।” 

“সে সব কথাই ঠিক, তবে আমি যে সে টাকা আর পাইব, তাহার কোন আশা নাই।” 

“সামান্য খরচ-” 

“আমার মুখে রক্ত ওঠা টাকা—এই বাইশ-হাত-জলে পড়া টাকার আশায় আমি খরচ করিতে ইচ্ছা করি না।” 

“সামান্যই খরচ হইবে।” 

“কত?” 

“এই খুব বেশী হয় ত এক শত টাকা।” 

“এক শত টাকা! ইহাও জলে যাইবে।” 

“যাইবে না।” 

“তুমি ত দেখিতেছি, আকাশের চাঁদ হাতে তুলিয়া দিতেছ।” 

“আমার বিশ্বাস, চেষ্টা করিলে এ টাকা পাওয়া যাইবে।” 

“আচ্ছা, একশত টাকা খরচ করিতে রাজী আছি, তাহার উপর এক পয়সাও নয়।” 

“ইহার বেশী এক পয়সাও খরচ করিতে হইবে না।’ 

(উদ্দেশ্য) “চোর-বদমাইস-” 

“তাহাকে এখন গালি দিয়া কেন ফল নাই, এখন আপনার মামীর বিষয় কি জানেন, তাহাই আমায় বলুন।” 

“আমি কিছুই জানি না। শুনিয়াছিলাম, বোম্বাই সহরে আমার এক মামী আছেন, এইমাত্ৰ।”

“যাহাই হউক, আমি সে সব সন্ধান করিয়া বাহির করিব—তিনি যখন মারা গিয়াছেন, তখন তাঁহার সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য আদালতের হুকুম লইতে হইয়াছে, আদালতে সন্ধান করিলেই তাঁহার বিষয় জানিতে পারিব। আজ এখন টাকা দেন ত, আজই এ সন্ধানে বাহির হই।” 

“তাহাল যেন দিলাম, তুমি যে আমার জন্য এত খাটিবে, তুমি কি চাও? আগে সব কথা হওয়া ভাল।”

“আমি এখন কিছু চাহি না। আগে আপনার টাকা আপনাকে দিই, তাহার পর সে সম্বন্ধে কথা হইবে। আর আমি ভৃত্যতুল্য—যাহাদিয়া আমাকে সন্তুষ্ট হইতে পারেন, তাহাই দিবেন।” 

“আগে এ বিষয়ে কথা হওয়াই ভাল।” 

“কাজ আগে হউক।” 

“আমি সে কথা ভাল বুঝি না।” 

“আমি টাকা চাহি না।” 

“টাকা চাও না?” 

“হাঁ, আমি টাকা চাহি না।” 

“তবে তুমি কি চাও?” 

“একান্তই শুনিতে চাহেন, যদি আমি আপনার কার্য্যোদ্ধার করিতে পারি–যে টাকার আশাই নাই, তাহা যদি আমি আপনার হাতে আনিয়া তুলিয়া দিতে পারি, তাহা হইলে পুরস্কার স্বরূপে আপনার কন্যা হিঙ্গনকে আমি প্রার্থনা করি।”