১০. নতুন রক্ষিদল
[ আমেদে ফ্লরেঁসের নোটবই থেকে]
সেই একই দিন, সন্ধেয়। না, কোনো বনের কাছে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হ’তে আমার সাধ যাবে না, অথচ এই-তো আমি—বরং আমি তাদের সঙ্গেই আছি, ঝোপের একেবারে মাঝখানে, যেটা আরো-সাংঘাতিক। তো অবস্থা ক্রমেই মধুরতর হ’য়ে উঠছে; অ্যাঁ? জানো-যে তুমি বিপদে পড়তে চলেছো, অথচ জানো না কী বিপদ; অবিশ্রাম কেবল এই চিন্তায় মাথা-ঘামানো : তোমার বোধবুদ্ধির কাছ থেকে সে-কাকে লুকিয়ে-রাখা হচ্ছে; চক্ষু-কর্ণ সবসময়েই সজাগ, যাতে যে- মোক্ষম ঘাটা খাবার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছো, সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারো–অথচ জানো না সেই মারটা ঠিক-কখন আসবে আর এর চাইতে রগরগে রুদ্ধশ্বাস, উত্তেজক আর কী-ই বা হতে পারে। জীবনে যখন এ-রকম মুহূর্ত আসে, তখনই লোকে যা বাঁচার বেঁচে নেয় তীব্রভাবে, প্রখরভাবে; আর পারীর কফিখানার অলিন্দে ব’সে কফির পেয়ালায় চুমুক দেবার বদলে এই উপভোগই হানা দেয় তোমাকে, সারাক্ষণ।
তবে চলুক, যা চলেছে! আর আমি এদিকে আমার পুরোনো চালেই কথার তুফান ছুটিয়ে দিচ্ছি। ভাবছি যে আমাদের নতুন রক্ষিদল আসলে একদল দস্যু, যখন তারা হয়তো নেহাৎই সাধারণ সেপাই-শাস্ত্রী। আমার কল্পনা কি আমাকে নিয়ে একটা ভয়ানক খেলায় মেতে ওঠেনি? আর ঐ এত্তেলা, ঐ তলবপত্র- কর্নেল সাঁৎ-ওবানের কাছ-থেকে-আসা একটা সরকারি চিঠি—কী ছাই মানে করবো তার, তাহ’লে? যা-ই ভাবতে চাই না কেন, ঐ চিঠিটা আমায় গভীর গাড্ডায় ফেলে দেয়। অথচ এই নতুন রক্ষিদল সম্বন্ধে আমার এই বিদঘুটে অনুভূতিটাকে আমি কিছুতেই তাড়াতে পারছি না কেন?
প্রথমত : ঐ লিউটেনান্ট, তাঁর দুজন খাশ সহকারী, এই সেপাই-শাস্ত্রী-এরা কি সত্যি সমরবাহিনীর লোক? আফ্রিকিদের দিকে তাকিয়ে সত্যি-মিথ্যে বোঝবার জো নেই। আর লিউটেনান্ট? মনে হয়, সমরবাহিনীরই তো। কিন্তু তাঁর দুজন সার্জেন্ট? তাদের তো আদপেই পল্টনের লোক ব’লে মনে হয় না! কী ক্রুর, নিষ্ঠুর, নৃশংস তাদের মুখচোখ! ফরাশি সেনাবাহিনীতে এমন লোক আছে নাকি?
প্রথমে যেটাকে একটা তুচ্ছ অনুপুঙ্খ ব’লে মনে হয়েছিলো, সেটাই আমার চিন্তার স্রোত খুলে দিয়েছে; এটা কি একটু অদ্ভুতই নয় যে এই লোকগুলো— সার্জেন্ট দুজন আর আফ্রিকি ঘোড়সোয়াররা এদের সকলেরই তো ধূলিধূসর হবারই কথা, যদি তারা গত পনেরো দিন ধ’রে আমাদের ধাওয়া ক’রে এসে থাকে; কিন্তু তাদের নেতাটিকে দেখাচ্ছে ঝকঝকে তকতকে, যেন এইমাত্র ধোবিখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কারণ, সত্যি তাঁকে কড়া ইস্ত্রি করাই দেখাচ্ছে, মাঞ্জা দেয়া প্রায় যেন আজগুবি একটা পর্যায়েই উঠে গিয়েছে এই পরিচ্ছন্নতা! ধবধবে কাচা উর্দি, ঝকঝকে-পালিশ বুট-জোড়া, মোমমাখানো গোঁফজোড়া – অতীব সুদৃশ্য এই লিউটেনান্ট। আর তাঁর ভাবগতিক? দেখে মনে হয় লিউটেনান্ট ল্যকুর বুঝি এক্ষুনি সমরবাহিনী পরিদর্শনে বেরুবেন। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি পুরোদস্তুর যেন সমরবাহিনীর লোক। কিচ্ছু খুঁত নেই কোথাও, একটা বোতাম নয়, একটা সুতো নয়, পালনের ভাঁজটা অব্দি এমন যে আনকোরা কিনে আনা হয়েছে যেন। আফ্রিকার বনে- জঙ্গলে সচরাচর এমন চমৎকার বেশভূষা তারিফ করবার সুযোগ সহজে কারু-একটা বোধহয় জোটে না। উর্দিটা একডাকে সব্বাইকে ব’লে দিচ্ছি এর ভেতরে এর আগে আর-কেউ শরীর গলায়নি, এটা একেবারে নতুন, আর যে-লোকটা সেটা প’রে আছে তাকে যেন লিউটেনান্ট ব’লে দেখায়, এই ভাবটা বোঝাবার জন্যে সে এতই উৎসুক হ’য়ে আছে যে সব সম্ভাবনারই পরপারে সে চ’লে গিয়েছে। তাঁরে অধীনস্থ লোকরা যখন এমন ধুলোয় মাখামাখি হ’য়ে আছে, তখন এত ঝকঝকে তকতকে দেখাচ্ছে কেন তাঁকে? লিউটেনান্ট ল্যকুর তো তাঁদেরই মতো, একসাথেই, আমাদের পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন?
গোরা সার্জেন্ট দুজন ভীষণ নোংরা হ’য়ে আছে; কিন্তু তাদের যদি তাদের অফিসারের মতো বাড়াবাড়িরকম পরিচ্ছন্নতা না-থেকে থাকে, তবে তারা বোধহয় বড্ড-বেশি নোংরা সেজেই গোল বাধিয়ে বসেছে। তাদের উর্দিগুলোকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন ফকিরের আলখাল্লা – ছেঁড়াখোঁড়া, তাগ্গিমারা, রংচটা। তাদের ট্রাউসারগুলো ঢলঢলে, আর বড্ড-বেশি তাপ্পিলাগানো, আর তারা যে কোন রেজিমেন্টের লোক, তার কোনো ইঙ্গিতই নেই কোথাও-না নম্বর, না কোনো প্রতীক। বিশ্বাস করা কঠিন ফরাশি সেনাবাহিনীর লোককে এমন অবস্থায় কোনোখানে পৌঁছুতে দেয়া হবে। আরো-বেশি কঠিন এই অনুভূতিটা : এই-যে পুরোনো উর্দিটুর্দি লোকগুলো প’রে আছে, এরা যেন এ-সব পরতে মোটেই অভ্যস্ত নয়। কেন আমার এমন মনে হচ্ছে তা হয়তো স্পষ্ট ক’রে বুঝিয়ে বলতে পারবো না, তবু মনে হচ্ছে এমন অনভ্যস্ত পোশাক প’রে তারা যেন বেশ-একটু অস্বস্তিতেই আছে।
আমার তো অন্তত এইরকম মনে হচ্ছিলো। তাদের দেখে ঠিক নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি, আর তাই হয়তো এ-সব তুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। হয়তো তাদের এমনতর হালচালের পেছনে অত্যন্ত-সরল কোনো ব্যাখ্যা আছে। বলবো না যে আমার অনুভূতিগুলোতেই সত্যতা আছে। আমার এই সন্দেহের কারণগুলো লিখতে গিয়ে, লিখে নিজের কাছেই পরিষ্কার করতে গিয়ে, নিজেই কবুল করছি যে সন্দেহের ভিত্তিগুলো ভারি-দুর্বল, ভারি-পলকা। কিন্তু সন্দেহ বা অবিশ্বাস তো প্রথমত এবং প্রধানত অনুভূতিরই ব্যাপার-তাকে ঠিক, যুক্তিসংগত কথায়, ব’লে বোঝানো যায় না।
যদি রীতিশৃঙ্খলার কথা ওঠে তো কিছুই বলবার নেই। বরং আমার মনে হয়েছে এই শৃঙ্খলার মধ্যেও বড্ড-কড়াক্কড়ি আছে। নিয়ম করেই একজন পাহারার শাস্ত্রীকে আরেকজন গিয়ে ছুটি দেয়। ক্রমগুলো সব নিখুঁতমসৃণ ছিমছাম। তবে বড্ড বেশি ছিমছাম।
রক্ষিদল চট ক’রে তিনটে ভাগে ভাগ হ’য়ে গেছে, কনভয়ের কারু সঙ্গেই তাদের ঠিক বনিবনা হচ্ছে ব’লে মনে হচ্ছে না। প্রথম দলে আছে কুড়িজন সুদানি সেপাই। পাহারার সময় বাদে তারা সবাই একসঙ্গে থাকে দল বেঁধে- আফ্রিকিদের মধ্যে এমনতর অভ্যাস একটু অস্বাভাবিক ঠেকে—কারণ তারা কেউ কখনও একটাও কথা বলে না। নীরবে তারা তাদের খানা পাকায়, বাকি সময় ঘুম যায়, তাদের কাছ থেকে টু শব্দটা কানে আসে না। তাদের গোরা সার্জেন্টের সামান্য কটাক্ষে তারা তটস্থ হ’য়ে ওঠে হুকুম তামিল করতে—এই সার্জেন্টদের তারা যেন ভয়ই পায়। দেখে মনে হয় এই কুড়িজন আফ্রিকি যেন বিষম অস্বস্তিতে আছে—বেশ ভয়ে-ভয়ে আছে।
দ্বিতীয় দলটায় ঐ দুজন গোরা সার্জেন্ট। এরা কথা বলে বটে, তবে নিজেদের মধ্যে, আর সবসময়েই চাপাস্বরে। আমার এই বড়ো-বড়ো সাংবাদিকের কানদুটি অব্দি তাদের কাছ থেকে এমন-একটা কথাও শুনতে পায়নি যেটা একটু জরুরি ব’লে মনে হ’তে পারে।
তৃতীয় দলটায় সবেধন লিউটেনান্ট ল্যকুরই আছেন—একাই একশো। মানুষটি এমনিতে ছোটোখাটো, ফিকে-নীল চোখ, ইস্পাতের মতো চোখ—খুব সুহৃদয় ঠেকে না তাঁকে। কথা বলা মোটেই পছন্দ করেন না। তার ওপর কেমনতর যেন অসামাজিক। সারা বিকেলবেলাটায় মাত্র দু-বারই তাঁকে তাঁর তাঁবু থেকে বেরুতে দেখেছি, তাও বেরিয়েছেন নিজের সাঙ্গোপাঙ্গর ওপর চোখ বুলিয়ে নিতে।
এবং এই কর্মসূচির কোনো বদলই হয় না। তাঁকে দেখবামাত্র সেপাইরা সবাই লাফিয়ে খাড়া হ’য়ে ওঠে, সার বেঁধে দাঁড়ায়। লিউটেনান্ট, লোহার শিকের মতো আড়-ধরা, তাদের ওপর চোখ বোলান, তাঁর হিমজমাট দৃষ্টি নিরীক্ষণ করে আফ্রিকিদের আপাদমস্তক; তারপর তিনি ফের গিয়ে ঢুকে পড়েন তাঁর তাঁবুতে, কারু সঙ্গে একটা কথাও বলেন না। উঁহু, অন্যরকম অবস্থাতেও ইনি যে খুব- দিলখুশ সঙ্গী হতেন, তা আমার আদৌ মনে হয় না।
সারাদিনের মধ্যে আর-একবারও মাদমোয়াজেল মোর্নাসকে আমি চোখে দেখিনি। ৎশুমুকিকেও খুঁজে পাইনি কোথাও। অস্যার্থ : আমার লেখাটা এখনও আমার পকেটেই আছে।
১৫ই ফেব্রুয়ারি। সকালবেলায় যখন শিবিরের ঘুম ভাঙাবার জন্যে শিঙা বেজেছে, আমি তখন যাত্রার কোনো প্রস্তুতিই দেখতে পাইনি। তোঙ্গানেকে জিগেস ক’রে জেনেছি সারাদিনে নাকি আমরা একপাও নড়বো না। গতকালকার বিশ্রামের পর আজকের এই বিরতিটা একটু অদ্ভুতই ঠেকেছে।
দৈবাৎ একসময় লিউটেনান্ট ল্যকুরের সঙ্গে আমার দেখা হ’য়ে গেছে, সারাক্ষণ ঋজু, সটান এবং নিখুঁতভাবে সাজগোজ করা। আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জিগেস করেছি এই বাড়তি-বিশ্রামের কারণ কী।
তিনি নিস্পৃহ সুরে জানিয়েছেন : ‘মঁসিয় বারজাকের হুকুম।’
তিনটি শুধু কথা, তারপর সামরিক কায়দায় সেলাম ঠুকে, জুতোর গোড়ালিও ঠুকে, তিনি ফিরে গেছেন। আলাপচারী ল্যকুর নামে কোনো কেতাব কেউ কোনোদিন লিখবে ব’লে মনে হয় না।
অভিযানের নেতা হঠাৎ কেন এমনভাবে প্রহর গুনছেন? রক্ষিদের সংখ্যা পাঁচভাগের চারভাগ ক’মে গেছে ব’লেই কি অভিযান মুলতুবি রেখে দিতে চান তিনি? এটা একটু ধাঁধাতেই ফেলে দিয়েছে আমাকে। খানিকটা অস্বস্তিও জাগিয়েছে। কারণ অভিযান মাঝপথে বন্ধ হ’য়ে গেলে আমারও লেখা-টেখা খতম : ঠিক যখন অভিযানটা রহস্যময় ও রোমাঞ্চকর হ’য়ে উঠছে তখনই কি না এই কাণ্ড!
ঠিক দশটার সময় মঁসিয় বারজাকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাঁবুর মধ্য থেকে বেরিয়েছেন, হাত-দুটো পেছনে, চোখ মাটিতে নামানো, মেজাজটা তেমন সুবিধের ঠেকেনি। এটা হয়তো তাঁর অভিসন্ধি জেনে নেবার শুভ-মুহূর্ত নয়। তবু আমি একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছি।
না, মঁসিয় বারজাক মোটেই চ’টে যাননি। থেমে প’ড়ে, বরং চুপচাপ স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকেছেন। শেষে বলেছেন : ‘এই একই প্রশ্ন আগেও জিগেস করেছেন, মঁসিয় ফ্লরেঁস, এবং তারপর মাত্র কয়েকটা দিনই কেটেছে। সেবার আপনার কথার কোনো উত্তর দিইনি। আজ অন্তত এই উত্তর দেবো যে আমি নিজেই জানি না কেন এখানে থেমে আছি।’
‘তাহ’লে আপনি এখনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোননি, মঁসিয় ল্য দেপুতে?’
‘না। ভেবেছি বটে, একটু দোনোমনাও করেছি, ভালোমন্দ খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছি…’
আবার চুপচাপ। তারপরেই আচমকা ব’লে উঠেছেন : ‘বাস্তবিকই, আমরা দুজনে একসঙ্গে কেন এটা নিয়ে আলোচনা করছি না? আপনি সুবিবেচক মানুষ, কাণ্ডজ্ঞানও আছে।’ (ধন্যবাদ, মঁসিয় বারজাক।) ‘আমি আপনার মতটা জানতে চাই।’
আমি নুয়ে প’ড়ে অভিবাদন ক’রে বলেছি, ‘অধম আপনার সেবাতেই নিয়োজিত, মঁসিয় ল্য দেপুতে।’
‘প্রথমেই ভেবে দেখা যাক ঝুঁকি না-নিয়ে এই অভিযানটা চালানো ঠিক হবে কিনা।’
‘বরং এটাই জিগেস করা যেতে পারে, তার আর-কোনো দরকার আছে কি না।‘
‘না-না, দরকার তো আছেই। এর মূল্য অনেকখানি।’
আমি একটু ঘাবড়েই গেছি। মঁসিয় বারজাক কিন্তু কথা থামাননি। ‘প্ৰশ্ন হ’লো, অভিযানটা সম্ভব কি না? সমীচীন—কিন্তু সমস্যাটা এই—সম্ভব কি না। গতকাল অব্দি এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠেনি, কেননা সত্যিকার কোনো বড়ো-ঝামেলায় আমরা অ্যাদ্দিন পড়িনি। সেটা কি আপনারও মত নয়?’
তা ঠিক। কোনো বড়োরকমের কোনো গণ্ডগোল হয়নি।’
‘সবচেয়ে-গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা ঘটেছে কাল : আমাদের রক্ষিদলের এই অদৃষ্টপূর্ব বদল—শুধু তা-ই নয়, একলাফে সংখ্যাটা একশো থেকে কুড়িতে নেমে এসেছে। এই নাইজার নদীর তীর ধ’রে যাবার সময় মাত্র কুড়িজন লোক আমাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে তো? আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না তো তাতে? আমার প্রশ্ন এখন এটাই।’
‘ঐভাবে প্রশ্নটা সাজালে উত্তর অবিশ্যি একটাই হয় : না, তাতে আমাদের নিরাপত্তার কোনো হানি হবে না। রাস্তায় শুধু-যদি দু-একটা আফ্রিকি দল আমাদের ওপর হামলা করে, তাহলে এই কুড়িজন লোকই যথেষ্ট। অন্যান্য অভিযানকারীরা এর চেয়েও কম রক্ষী নিয়ে আফ্রিকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, কারু-কারু সঙ্গে তো কোনো রক্ষীও ছিলো না—তবে—’
‘আমি জানি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন,’ মঁসিয় বারজাক আমায় থামিয়ে দিয়েছেন। ‘আপনি সেই রহস্যময় অজ্ঞাত লোকটার কথা তুলবেন তো—আমরা যে আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেটা তার মনঃপুত নয়। এ-সম্বন্ধে আমার মতামত আমি কখনও চেপে রাখিনি, আর অন্যরাও আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। তারপর থেকে নতুন-কোনো উৎপাতই আর হয়নি। কাজেই সে নিয়ে আর আলোচনা করে কী লাভ?’
‘মাফ করবেন, মঁসিয় ল্য দেপুতে, তবে আমার মনে হয় তারপর একটা মস্ত- বড়ো উপদ্রবেরই সূত্রপাত হয়েছে।’
‘বাঃ!’ মঁসিয় বারজাক চমকে উঠেছেন। ‘নতুন-কোনো উপদ্রব? আর, আমার কাছে সেটা চেপে যাওয়া হয়েছে?’
এভাবে কোনঠাশা হ’য়ে একটু সংকোচই পড়তে হয়েছে আমাকে। আমি নোটবইতে যে-সব কথা লিখেছি, যা তখন আমার গুরুতর ব’লেই মনে হয়েছে, আর তা থেকে যে অনুমানটা করেছিলুম, তাকেও তখন যুক্তিযুক্ত ব’লেই মনে হয়েছে। কিন্তু এখন মুখের কথায় প্রকাশ করতে গিয়ে দেখি, আমার নিজেকেই তা বিশ্বাস হচ্ছে না –মনে হচ্ছে তুচ্ছ, নগণ্য-সব খুঁটিনাটি। কিন্তু ঝুলি থেকে খরগোশ যখন একবার বেরিয়ে প’ড়ে ছুট লাগিয়েছে তখন তাকে তাড়া ক’রে যেতে হবে বৈ-কি!
এবং আমি তাড়া ক’রেই গিয়েছি। আমাদের রক্ষিদল এবং তার লিউটেনান্ট সম্বন্ধে আমি যা-যা ভেবেছি, সব আমি খুলে বলেছি মসিয় বারজাককে। বলেছি যে, রক্ষিদেরও আমার সত্যিকার-সৈন্য ব’লে মনে হয়নি, আর তাদের লিউটেনান্টকেও মনে হয়েছে নাটমঞ্চের অভিনেতা। হয়তো সেই অজ্ঞাত শত্রুটিরই ভাড়াটে লোক এরা।
শুনে হো-হো ক’রে হেসে উঠেছেন মঁসিয় বারজাক। ওঃ, কী-একখানা রহস্য উপন্যাস ফেঁদেছেন! মসিয় ফ্লরেঁস, আপনার কল্পনাশক্তি তো দুর্বার! আপনি নাটক-নভেল লিখলেই পারেন। তবে সত্যিকার জীবনে অমন ক’রে কল্পনার অনুপ্রবেশ দয়া ক’রে আর ঘটাবেন না।’
‘অবশ্য…’ আমি একটু বিরক্তই হয়েছি এই হাসাহাসিতে।
‘অবশ্য-টবশ্য কিছু নেই। তথ্যগুলো দেখছেন না কেন? ফরমানটা সরকারি, লিখিত, স্বাক্ষরিত এবং সীলমোহর সংবলিত … ‘
‘জালও তো হ’তে পারে।’
‘না, কারণ কাপ্তেন মার্সেনের মনে হয়েছে এটা একটা খাঁটি হুকুমনামা, তিনি কোনো দ্বিধা না-ক’রেই হুকুমটা তামিল করেছেন।’
‘সেটা কেউ হয়তো আসল লোকের কাছ থেকে চুরি ক’রে নিয়েছে…’
‘এ-তো আরেকখানা রহস্য উপন্যাস! সত্যিকার রক্ষিদলের বদলে তার এই বিকল্প ঠিক-কোনোখানে পাওয়া যাবে, বলতে পারেন? নতুন রক্ষিদলের সব্বাইকে কচুকাটা ক’রে খতম ক’রে দেবার মতো লোকবল এবং অস্ত্রবল তো তাদের চাই—সব্বাইকে খতম ক’রে দিতে হ’তে হবে তাদের, সব্বাইকে, বুঝেছেন?- তারপর একটা নকল রক্ষিদল বিকল্প হিশেবে খাড়া করতে হবে—হুবহু এরকম নতুন একদল বদলি এনে দাঁড় করাতে হবে। তাও আগেভাগে ফন্দি এঁটে, যখন কারুই ধারণা নেই নতুন রক্ষিদলে কারা থাকবে, সেটা কেমন হবে, এমনকী সাঁৎ-ওবান কোনোদিন যে এ-রকম কোনো হুকুম দেবেন তাও যখন কেউ জানে না।
‘আর লিউটেনান্ট ল্যকুরের দলবলের গায়ে যখন আঁচড়টুকুও পড়েনি, তখন ধরে নিতে হবে অজ্ঞাত শত্রুর লোকবল ছিলো প্রচণ্ড! কেননা এটা নিশ্চয়ই আশা করেন না যে আসল রক্ষিদল বিনাযুদ্ধের হার মেনে ব’সে থাকবে! আর আপনি কি ভাবেন এমন-একটা প্রচণ্ড দস্যুদলের কথা কেউ কোথাও ঘুণাক্ষরেও জানবে না? আর এ-রকম যুদ্ধেরও অন্তত কানাঘুষো আমরা শুনতে পাবো না- যখন টেলিগ্রামের চাইতেও দ্রুতবেগে ঢাকের আওয়াজে জঙ্গলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অব্দি সব খবর পৌঁছে যায়? তবেই দেখুন কল্পনার রাশ একবার আলগা ক’রে দিলেই সে কেমন তুলকালাম ছুট লাগায়!’
মঁসিয় বারজাক ঠিকই বলেছেন। তলবপত্রটা চোরাই হ’তেই পারে না।
‘আর এই-যে আপনি লিউটেনান্ট আর তার দলবল সম্বন্ধে এত-বড়ো তাজ্জব- একটা জিনিশ কল্পনা ক’রে ব’সে আছেন, তার ভিত্তিগুলোই বা কী? এই আফ্রিকি সেপাইরা অন্য আফ্রিকি সেপাইদের চাইতে আলাদা কিসে?’
আমি তাদের একবার চোখ বুলিয়ে আবারও সায় দিতে বাধ্য হয়েছি, মঁসিয় বারজাক ঠিকই বলেছেন। কাল সন্ধেয় আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব কি আমি শিকেয় তুলে রেখে দিয়েছিলুম? নিশ্চয়ই নিজেকে আমি যা-তা ভুল বুঝিয়েছি। এই আফ্রিকি সেপাইরা অন্যসব আফ্রিকি সেপাইদের মতোই তো! সত্যিই, হুবহু একরকম।
‘আচ্ছা না-হয় গোরা সার্জেন্টদের কথাই ধরুন।’ মঁসিয় বারজাকের আপত্তি তখনও শেষ হয়নি। ‘ওদের সম্বন্ধে হঠাৎ কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য আপনি লক্ষ করেছেন? সত্যি-যে তারা ভারি নোংরা, কিন্তু কাপ্তেন মার্সেনের কোনো-কোনো সার্জেন্টের চাইতে বেশি-নোংরা নয়। বিদেশ-বিভুঁয়ে, সারাক্ষণ যেখানে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়, সেখানে উর্দিটুর্দি সবসময় কড়া ইস্ত্রিকরা ধবধবে কাচা হবে, এটা ভাবাই ভুল।’
আমি কোনোরকমে তো-তো ক’রে একটা কথা পাড়বার চেষ্টা করেছি। ‘কিন্তু লিউটেনান্ট ল্যকুর… ‘
‘এ তো ভারি-আজব নালিশ। বোঝাই যাচ্ছে নিজের সাজগোজ সম্বন্ধে তিনি খুব সচেতন। সে তো আর কোনো অপরাধ নয়।
না, তা নয়। তবু একটা শেষ চেষ্টা করেছি আমি : ‘তবে যে-উর্দি দেখে মনে হয় সদ্য-সদ্য দরজির দোকান থেকে বেরিয়েছে, সেটা একটু আজব ব্যাপার।’ তার কারণ তাঁর অন্য উর্দিটা তাঁর কিটব্যাগে আছে। সেটা নিশ্চয়ই অমনি ধুলোয় মাখামাখি হ’য়ে আছে। মঁসিয় ল্যকুর ভেবেছেন আমাদের সামনে আসার আগে ফরশা জামাকাপড় প’রে আসবেন যাতে তাঁকে দেখে আমাদের বিরাগ না জ’ন্মে যায়। তাছাড়া লিউটেনান্ট ল্যকুরের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা হয়েছে, কাল বিকেলবেলাতেই। মানুষটা চমৎকার, যদিও এই সাজগোজের ব্যাপারটায় একটু বেশিই খুঁতখুঁতে—সেটা আমিও মানি। ভদ্র, শিক্ষিত, মার্জিত, এবং অন্যদের সন্মান করতে জানেন। হ্যাঁ, আদবকায়দায় শুধু নয়, ওপরওলাদের শ্রদ্ধাসন্মান করতেও জানেন। ভারি উপাদেয় ব্যবহার আর ওপরওলার কথা মন দিয়ে শোনেন।’
হ্যাঁ, এবার মঁসিয় বারজাকের থলে থেকে তাঁর খরগোশটা বেরিয়ে পড়েছে। এটাই আসল কথা। সংসদের সদস্যকে হয়তো সাতবার সেলাম ঠুকেছেন ল্যকুর। তা এই লিউটেনান্ট কি,’ আমি তখন জিগেস করেছি, ‘মনে করেন যে এ- অবস্থায় আমাদের যাত্রা অব্যাহত রাখার কোনো অসুবিধে হবে?’
‘মোটেই না।’
‘অথচ আপনার তবু দ্বিধা ঘুচছে না, মঁসিয় ল্য দেপুতে!
‘আর আমি দ্বিধা করবো না।’ আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়েই মনস্থির ক’রে নিয়েছেন মঁসিয় বারজাক। ‘সব দ্বিধা আমি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা কালকেই আবার রওনা হ’য়ে পড়বো।’
‘এমনকী এটা না-ভেবেই যে এই অভিযান কোনো কাজে লাগবে কিনা— যদি শেষ অব্দি যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবও হয়?’
আমার কথার সূক্ষ্ম টিটকিরিটা মঁসিয় বারজাক খেয়ালই করেননি। ‘এই অভিযান শুধু কাজেরই নয়, এটা একান্তই জরুরি।’
জরুরি?
এতক্ষণে মঁসিয় বারজাকের মেজাজ বেশ খুশ হ’য়ে এসেছে। অন্তরঙ্গভাবে আমার হাতটা ধ’রে গোপন কথা ফাঁস ক’রে দেবার ভঙ্গিতে বলেছেন : ‘আমাদের নিজেদের মধ্যে ব’লেই বলছি, দেখবেন আবার যাতে পাঁচকান না-হয়, এখন আমি মেনে নিতে রাজি আছি, সম্প্ৰতি যে-সব আফ্রিকিদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে, তাদের ভোটের অধিকার দেয়াও যা, না-দেয়াও তাই–ইওরোপিয় গণতন্ত্রের কোনো ধারণাই এদের নেই। আপনি যদি চাপ দেন, তবে এও মানতে রাজি আছি যে উপকূল ছেড়ে যত-ভেতরে যাবো ততই এই ধারণা পালটাবার তেমন- একটা কারণও হয়তো হবে না। তবে আপনাকে এ-কথা এখানে দাঁড়িয়ে বলছি বটে, কিন্তু সংসদে দাঁড়িয়ে এ-কথা আমি কিছুতেই বলবো না। কিছুতেই না।
‘ধরুন, আমরা যদি অভিযানের শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছই, তবে যা হবে তা এই: বোদ্রিয়ের আর আমি-আমরা দুজনে এমন-দুটো প্রতিবেদন পেশ করবো, যা পরস্পরের একেবারে বিপরীত হবে—তারপরে একটা কমিশন বসবে এগুলো নিয়ে বিচার-বিবেচনা করতে। তারপর আমরা যদি একটু আপোষরফা করি, তাহ’লে উপকূলের কাছাকাছি যে-সব উপজাতি থাকে তাদের ভোটের অধিকার দেয়া হবে, যার মানে দাঁড়াবে আমারই জয় হয়েছে—আর নয়তো কোনো রফা- টফা না-হলে ব্যাপারটা মুলতুবি থাকবে এবং ধামাচাপা প’ড়ে যাবে। একহপ্তা বাদে কেউই এ নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না, কেউই জানতে চাইবে না আমি যে-প্রতিবেদন পেশ করেছি তার কতটাই বা ঠিক, আর কতটাই-বা অলীক, মনগড়া। এ-দুটোর মধ্যে যা-ই হোক না কেন, বোদ্রিয়ের বা আমি—কেউই কোনোদিনও উপনিবেশ দফতরের ভার পাবো না। কিন্তু আমি যদি মাঝপথেই ফিরে যাই, শেষ যদি আর না-যাই, তবে এ প্রায় প্রকাশ্যেই ঘোষণা ক’রে দেয়া হবে যে আমি ভুল করেছিলাম : আমার শত্রুরা গলা ফাটিয়ে বলবে যে আমি নিতান্তই একটা গণ্ডমূর্খ বৈ কিছু নয়-এবং তা যদি হয়, তবে আমি চিরকালের মতো রাজনৈতিক জগৎ থেকে হারিয়ে যাবা।’
মঁসিয় বারজাক একটু থেমে, দম নিয়ে, এই ব’লে শেষ করেছেন : ‘এই সত্যটা কখনও ভুলে যাবেন না, মসিয় ফ্লেরেঁস : রাজনীতিতে যে-কেউই ভুল করতে পারে, তাতে কিছুই এসে যায় না, কিন্তু যেই এ-কথা সে একবার কবুল করেছে তবে তার ভবিষ্যৎটাই ঝরঝরে হয়ে গেছে।’
তাঁর এই প্রজ্ঞাবাক্য শুনে আমি পরম পরিতোষ লাভ করেছি। যাক, এবারে আমি সকলেরই অভিপ্রায় জানি-কে কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে, এই অভিযানে বেরিয়েছে।
বিকেলবেলায় আমি তোঙ্গানেকে নিয়ে ঘোড়ায় চ’ড়ে বেরিয়েছিলুম-এখন সে ৎশুমুকিরই ঘোড়ায় চড়ছে, কেননা তার নিজের ঘোড়ার চাইতে এটা অনেক ভালো জাতের। আমরা দুলকিচালে চারপাশ দেখতে-দেখতে এগুচ্ছি, এমন সময়- নিশ্চয়ই তার জিভ চুলবুল করছিলো- তোঙ্গানে হঠাৎ বলেছে : ‘শুমুকি যে কেটে পড়েছে, খুব-ভালো হয়েছে। সে একটা কালো শয়তান! পাজির পাঝাড়া! বেইমান!’
অ্যা? ৎশুমুকিও তাহ’লে আমাদের ভেলকি দেখাতে চাচ্ছিলো না কি? শুনেই আমার আক্কেলগুড়ুম হ’য়ে গেছে। কিন্তু এবার পুরো ব্যাপারটাই ভালো ক’রে তাহ’লে যাচিয়ে নেয়া উচিত। আমি অবাক হবার ভান ক’রে বলেছি : ‘ও! তুমি মোরিলিরের কথা বলছো?’
‘মোরিলিরেটাও পাজির পাঝাড়া।’ তোঙ্গানে সোৎসাহে ব’লে উঠেছে। ‘তবে ৎশুমুকিটাও নচ্ছার-ঠিক মোরিলিরেরই মতো। আমাদের চলায় যাতে ফ্যাসাদ বাধায় সেইজন্যে পাজিগুলো বিস্তর দোলো তুবাব (শাদাদেবরৈাণ্ডি), আর অনেক সোনাদানা ছড়িয়েছে, কুলি আর সহিসদের মধ্যে।’
মোরিলিরে আর ৎশুমুকির হাতে সোনাদানা? এ-যে অবিশ্বাস্য। ‘তুমি বলতে চাচ্ছো তারা যাতে যেতে না-চায় সেইজন্যে মোরিলিরেরা তাদের কড়ি দিয়েছে?’
‘না, কড়ি নয়। সোনা। অনেক সোনা।’ ব’লে সে আরো-একটা কথা বলেছে, তাতে আবারও আমার আক্কেলগুড়ুম হ’য়ে গেছে। অনেক সোনা—ইংরেজি সোনা!’
‘তুমি তাহলে ইংরেজদের টাকা চেনো, তোঙ্গানে? ‘
‘ইও,’তোঙ্গানে বলেছে। ‘আমরা হলাম আশান্তি। আমি পাউন্ড-স্টার্লিং চিনি।’
সোনা—ইংরেজদের পাউন্ড-স্টার্লিং-আর তা কিনা ৎশুমুকি আর মোরিলিয়ের হাতে!…সত্যি, আমর চোখ কপালে উঠেছে। কিন্তু আমি এমন ভান করেছি যেন খবরটায় আমি কোনো গুরুত্বই দিচ্ছি না। তুমি বেশ লোক, তোঙ্গানে। আমি তোমার কথা সবাইকে বলবো। আর তুমি যখন পাউন্ড-স্টার্লিং চেনো, তখন এই নাও ফরাশি সোনা-এ টাকার ওপর ফরাশি প্রজাতন্ত্রের ছাপ মারা আছে।’
‘ভালো প্রজাতন্ত্র! ফরাশিদেশ! আহ্লাদে আটখানা হ’য়ে তোঙ্গানে ব’লে উঠেছে। আমি তাকে যে ফ্রাংকটা দিয়েছি সেটা সে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে খুশিতে ডগমগ হ’য়ে ফের লুফে নিয়েছে, তারপর নিজের পাশে লাগানো থলেটায় সেটা পুরতে গেছে-কিন্তু ভেতরে হাত ঢোকাবামাত্র তার মুখে-চোখে একটা বিস্ময়ের ছাপ খেলে গেছে—ভেতর থেকে সে একবাণ্ডিল কাগজ বার ক’রে এনেছে। দেখেই, আমি অস্ফুট একটা চীৎকার ক’রে তার হাত থেকে কাগজের তাড়াটা ছিনিয়ে নিয়েছি।
আরে! এ-যে আমার সেই লেখাগুলো। যে-প্রতিবেদনগুলো আমি ৎশুমুকিকে দিয়েছিলুম ডাকে দিতে! সব কি না—হায়!—এই পাজির পাঝাড়া ৎশুমুকির ঘোড়ার জিনের থলেতে! ল্যক্সপানসিয় ফ্রাঁসেঈতে সবাই আমাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাববে! আমার মানসন্মান ধুলোয় লোটাবে, চিরকালের মতো সাংবাদিক হিশেবে আমার মুখে চুনকালি প’ড়ে যাবে!
আমার মাথাটা বোঁ ক’রে ঘুরে গেলেও, আমরা আগের মতোই দুলকিচালে ঘোড়ার পিঠে ক’রে চলেছি। শিবির থেকে মাইল-তিনেক দূরে এসেই আমি হঠাৎ লাগাম টেনে থমকে গিয়েছি। এ-কী অদ্ভুত দৃশ্য চোখের সামনে?
প্রায় রাস্তার পাশেই, ছ-সাত গজ চওড়া আর প্রায় পঞ্চাশ গজ লম্বা, একটুকরো জমি, ঝোপের ঠিক মাঝখানেই সাফ করা। সে জায়গাটায় ঘাস চেপটে গিয়েছে, থেঁৎলে জমির সঙ্গে মিশে গিয়েছে, কোনো অতিকায় কাস্তে দিয়ে কেউ আবার সেগুলো যেন কেটেওছে জায়গায় জায়গায়, তার ওপর—আর তাইতেই আমার ছানাবড়া চোখ আটকে গিয়েছে-অমনভাবে সাফ-করা জমির ওপর সমান্তরাল দুটো গভীর দাগ, যেমন আমরা দেখেছিলুম, কান্কানের কাছে, প্রায় চার ইঞ্চি- গভীর লম্বা দাগ। এবার দাগটা পুবদিকে যেন গভীরভাবে ডেবে বসেছে। এই গভীর-খাঁজ-ক’রে বসা দাগগুলো সঙ্গে কেমন ক’রে যেন আমার স্মৃতিতে সেদিন সন্ধেয় যে অদ্ভুত-গুমগুম গর্জনটা শুনেছিলুম, তা ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। কান্কানেও অমন অদ্ভুত গুমগুম কানে এসেছিলো, আর তারপরেই মাটির ওপর অমন চারইঞ্চি-গভীর সমান্তরাল দাগগুলো দেখেছিলুম আমরা।
কী সম্পর্ক আছে এগুলোর মধ্যে? এই-যে গুমগুম গর্জন, জোড়া-জোড়া সমান্তর খাঁজ, আর কান্কানের সেই কেনিয়ালালার? নিশ্চয়ই কোনো সমন্ধ আছে, নইলে আমার স্মৃতির মধ্যে তারা এমনভাবে জড়িয়ে যাবে কেন। এই দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার মতো গভীর খাঁজগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি যখন ব্যাসকূটটা ভাঙবার চেষ্টা করেছি, অমনি আমার অবচেতন মন ঐ ভেলকিবাজ কেনিয়ালালার মূর্তিটা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছে। এখন যেন অদ্ভুত-ক্রুর ও কুৎকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ঐ কেনিয়ালালা বলছে: কেমন? চারটে ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে, দুটো তো আগেই ফলেছিলো—এখন তৃতীয়টাও মিলে গেলো তো? ফ্লরেঁস, তোমার প্রতিবেদন ফ্রাসে গিয়ে পৌঁছতেই পারেনি!
সেখানে, ঐ পরিত্যক্ত জঙ্গলের কাছে, ধূ-ধূ মাঠের মধ্যে, আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা ঠাণ্ডা শিহরণ খেলে গেলো –কালই একবার শিউরে উঠেছিলুম- অতএব এই দ্বিতীয়বার একটা ঠাণ্ডা শিহরণ আমার সর্বাঙ্গে খেলে গিয়েছে। আর এই প্রথমবার এই দুর্বোধ প্রহেলিকাজালের মধ্যে কেঁপে উঠে আমি আবিষ্কার করেছি আমি সত্যিই এবারে বিষম ভয় পেয়ে গিয়েছি।
তবে ভয়ের ভাবটাকেই পরক্ষণে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে উগ্র কৌতূহল। এমনিতেই আমি ভয় পেতে খুব-একটা অভস্ত নই-আমার দুর্বলতা, ঔৎসুক্য। তাই ফিরে যেতে-যেতে আমি বারে বারে ঐ প্রহেলিকাটার একটা মীমাংসা করবার চেষ্টা করেছি, আর উত্তর হাড়াতে গিয়ে আমার মাথাটা বোঁ ক’রে ঘুরে উঠেছে।
শিবিরে পৌঁছেই আমি লাফিয়ে নেমেছি ঘোড়া থেকে। তোঙ্গানে, বলা নেই কওয়া নেই, আচমকা ব’লে উঠেছে : তুলতিগুই মোটেই ভালো লোক নয়। মুখপোড়া বাঁদরের মতো মুখ!’
আমি না-ভেবেই ব’লে উঠেছি (কিছুই যে ভাবিনি, এটাই আমার কৈফিয়ৎ হবে), ‘তা-ই নিশ্চয়ই!’
১৭ ফেব্রুয়ারি। আজ একটা লম্বা সফর। কাল ছিলো আরো-লম্বা। দু-দিনের মধ্যে তিরিশমাইল। ৎশুমুকি আর ফিরে আসেনি-রাস্কেল!—কেউ তাকে চোখেও দ্যাখেনি। তোঙ্গানেই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, আর আমাদের কুলি আর ০সহিসরা চমৎকারভাবে সাড়া দিয়েছে-তাদের পায়ে যেন নতুন ফুর্তি, নতুন উৎসাহ এসে ভর করেছে।
এটা কবুল করা ভালো, গত দু-দিনে আমার সন্দেহ অনেকটাই উবে গিয়েছে। রক্ষিদল বিনাবাক্যব্যয়ে তাদের দায়িত্ব পালন ক’রে গেছে, তবে তেমন-একটা কঠিন-কোনো দায়িত্বও ছিলো না। দুটো সারে কুড়িজনে পাশে-পাশে গেছে। কনভয়ের, ক্যাপ্তেন মার্সেনের সেপাইরা যেমন যেতো। শুধু একটা জিনিশ লক্ষ করেছি : আগে কাপ্তেন মার্সেনের লোকজন কুলি-সহিসদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি ক’রে সারাটা পথ জমিয়ে রাখতো, এরা যেন মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে, কেউ একটা কথাও বলে না। একেই বলে আইনশৃঙ্খলার পরাকাষ্ঠা।
সার্জেন্ট দুজন যদি মাঝে-মাঝে অন্য সেপাইদের তদারক না-করে তো পেছনেই থাকে কনভয়ের। তারা নিজেদের সেপাই ছাড়া কারু সঙ্গে কোনো কথা বলে না। মাঝে-মাঝেই তারা কড়াসুরে তাদের সেপাইদের হুকুম দেয়, আর তারাও অমনি কোনো কথা না-ব’লে নীরবে তা তামিল করে। আমাদের রক্ষিদল সংখ্যায় নগণ্য হ’তে পারে, কিন্তু শৃঙ্খলায় সবাইকেই ছাপিয়ে যায়।
লিউটেনান্ট ল্যকুর থাকেন কনভয়ের সামনে, মঁসিয় বারজাকের পাশে, ঠিক যেমন কাপ্তেন মার্সেনে থাকতেন। মাদমোয়াজেল মোর্নাস-লক্ষ করলুম-কয়েক কদম পেছিয়ে পড়েছেন। ডাক্তার শাতোনে আর মঁসিয় পঁসার পেছনে, সাঁৎ- বের্যার সঙ্গেই তিনি থাকেন সবসময়। তাঁকে দেখে মনে হয় না লিউটেনান্টের সান্নিধ্য তাঁর খুব একটা ভালো লাগছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার গাটা ছমছম করে। হয়তো মঁসিয় বারজাকই ঠিক। সবটাই আমার কল্পনা। তবু মনে হয় না কেন যেন সবকিছুই বেঢপ আর বেখাপ্পা। আমি যেন ঝোপে-ঝোপে নেকড়ে দেখতে শুরু ক’রে দিয়েছি, যেদিকেই তাকাই সেদিকেই যেন নেমকহারাম বেইমানদের দেখি। কেন দেখি, বলি, শুনুন।
আজকেই সকালে, নটা নাগাদ। আমরা একটা ছোট্ট গাঁয়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, পুরো গাঁটাই কেমন খাপছাড়ারকম ফাঁকা, হঠাৎ এমন সময় একটা কুঁড়ের মধ্য থেকে কার যেন গোঙানির আওয়াজ কানে আসে।
মঁসিয় বারজাকের নির্দেশে কনভয় তক্ষুনি থেমে গিয়েছে, আর ডাক্তার শাতোনে –লিউটেনান্ট ল্যকুর আর দুজন সেপাইয়ের সঙ্গে—সেই কুড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। বলাই বাহুল্য, সংবাদপত্রের প্রতিনিধিও গিয়েছে সঙ্গে।
আর কুঁড়েটায় ঢুকেই এক করুণ দৃশ্য চোখে পড়েছে আমাদের। সেখানে দুটো মৃতদেহ পড়ে আছে, আর একজন আহত লোক-সারাগায়ে জখম। বীভৎস দৃশ্য, ভয়াল—মৃতদেহ দুটো বয়স্ক নারীপুরুষের-সে-দুটো ভয়াবহভাবে ছিন্নভিন্ন! বেচারাদের এমনভাবে খুন করেছে কে? কে-ই বা লোকটাকে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত ক’রে রেখে গেছে?
ডাক্তার শাতোনে তক্ষুনি আহত লোকটিকে নিয়ে পড়েছেন। কুঁড়ের ভেতরটা বেজায় অন্ধকার ব’লে সেপাই দুজনকে বলেছেন এই আহত লোকটিকে বাইরে ব’য়ে নিয়ে আসতে—বাইরে। লোকটা এক বুড়ো আফ্রিকি। কাঁধটার চোটই ভয়ংকর—পুরো অক্ষকাস্থিটাই হাঁ হ’য়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি শুধু ভেবেছি, সে- কোন সাংঘাতিক অস্ত্র এমন ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।
ডাক্তার শাতোনে ক্ষতটা পরিষ্কার করেছেন আর সেখান থেকে অজস্র লোহাচুর বেরিয়ে এসেছে। তিনি মাংস টেনে জুড়ে দিয়ে শেলাই ক’রে দিয়েছেন। তারপর ভালো ক’রে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন-আর লিউটেনান্ট ল্যকুর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সব জিনিশপত্র জুগিয়ে গেছেন। আর সারাক্ষণ রুগি অসহ্য যন্ত্রণায় কারে উঠেছে। ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হ’য়ে যেতেই মনে হ’লো তার যন্ত্রণা বোধহয় একটু কমেছে। অথচ ডাক্তারের মুখচোখে তখনও উদ্বেগের চিহ্ন মোছেনি। তিনি দ্বিতীয়বার কুঁড়েটার মধ্যে গিয়ে মৃতদেহ দুটোকে আরেকবার দেখে এসেছেন এবং তাঁর মুখে উদ্বেগের চিহ্নটা আরো-উগ্র হ’য়ে ফুটে উঠেছে। তোঙ্গানের সাহায্যে জখম লোকটাকে তারপর তিনি জেরা করেছেন। আর এই হতভাগ্য আফ্রিকির কাহন থেকে এটাই ফুটে বেরিয়েছে যে, ছ-দিন আগে—তাহ’লে সে নিশ্চয়ই ১১ই ফেব্রুয়ারি, আমাদের রক্ষিদল বদল হবার তিন দিন আগে—এই একরত্তি গ্রামটা দুই-দুজন গোরা লোকের নেতৃত্বে একদল আফ্রিকির হাতে একেবারে ছারখার হ’য়ে যায়। যে-নারীপুরুষের মৃতদেহ আমরা দেখেছি, তারা দুজন সময়মতো পালাতে পারেনি—গাঁয়ের বাকি সবাই প্রাণ হাতে ক’রে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। এই আহত লোকটাও অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু ছোটবার সময় তাঁর কাঁধে এসে একটা গুলি লাগে। তবু সে তখন লুকিয়ে পড়তে পেরেছিলো। পরে
সঙ্গীরা তাকে কাঁধে ক’রে ব’য়ে এনেছে গাঁয়ে, কিন্তু যেই দেখেছে আরেকদল সেপাই আসছে, অমনি সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে চম্পট দিয়েছে। প্রথম দলটা যেদিক দিয়ে গিয়েছিলো, সেপাইদের দ্বিতীয় দলটা ঠিক সেদিক থেকেই আসছিলো।
খুব-একটা উপাদেয় কাহিনী। এমন সব নরাধম যে এমনভাবে ঘুরে-ঘুরে লুঠতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এটা মোটেই প্রাণের আরাম এবং আত্মার শান্তি বাড়িয়ে দিতে পারে না। ভাগ্যিশ এই নরাধমদের সঙ্গে পথে আমাদের মোলাকাৎ হয়নি।
এই বেচারা উচ্ছ্বসিতভাবে ডাক্তার শাতোনেকে তার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলো, এমন সময় হঠাৎ তার চোখে এক বিজাতীয় আতঙ্ক ফুটে উঠেছে এবং সে চুপ ক’রে গেছে—যেন আমাদের আশপাশে বা পেছনেই সে কোনো বিভীষিকা দেখতে পেয়েছে। আমরা তড়াক ক’রে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি আমাদের সার্জেন্ট দুজনের একজন—তাকে দেখেই যেন আহত লোকটা বিভীষিকা দেখে আঁৎকে উঠেছে।
সার্জেন্টকে মোটেই কিন্তু বিচলিত দেখা যায়নি। সে শুধু বিচলিত হয়েছে তখনই, যখন হিমজমাট কড়াচোখে লিউটেনান্ট ল্যকুর তার দিকে তাকিয়েছেন— সে-দৃষ্টিতে তিরস্কার বা ভৎর্সনা আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে হুমকির ভাব। এই জ্বলন্ত চাউনিটার অর্থ আমি কিন্তু ঠিক ধরতে পারিনি। সার্জেন্ট শুধু তার মাথাটা ছুঁয়েছে একটা আঙুল দিয়ে, এমন ভঙ্গি করেছে যেন জখম লোকটা বিকারের ঘোরে বেদম ভুল বকতে শুরু করে দিয়েছে।
আমরা আবার আমাদের রুগির দিকে তাকিয়েছি। কিন্তু কৃতজ্ঞতা যে-কুহক সৃষ্টি করেছিলো সেটা তখন আর সেখানে নেই। আতঙ্কে তার চোখদুটি বিস্ফারিত। আর আমরা তার কাছ থেকে একটা কথাও বার করতে পারিনি। তাকে আবার ব’য়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কুঁড়েটাতেই, আর এ-যাত্রায় সে বুঝি বেঁচেই গেলো এই ভরসা নিয়েই আমরা ফিরে গিয়েছি। কেননা ডাক্তার শাতোনের ধারণা ঘাটা শিগগিরই শুকিয়ে যাবে।
আমার সঙ্গীরা কী ভেবেছে জানি না, তবে ফিরে যেতে-যেতে আমি সারাক্ষণ এই নতুন ধাঁধাটাকে মনের মধ্যে উলটে-পালটে দেখেছি। ঐ আফ্রিকি হঠাৎ অমন- অস্বাভাবিক ভয় পেয়ে গেলো কেন? লিউটেনান্ট ল্যকুরকে দেখে সে তো ঘাবড়ে যায়নি, তাহ’লে তাঁর একজন গোরা সার্জেন্টকে দেখে সে অমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে কেন?
সন্ধেবেলায়, বেশ-একটু রাত হ’য়ে যাবার পরই, আমরা কাদু নামে একটা ছোট্ট গাঁয়ের ধারে আমাদের তাঁবু ফেলেছি। কাদুতে পৌঁছেই আমাদের মনটা খারাপ হ’য়ে গেছে, কেননা এখানেই মাদ্মোয়াজেল মোর্নাস আর সাঁৎ-বেরা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য-একটা পথ ধরবেন। আমরা যাবো নাকবরাবর, সোজা সামনে, উয়াগাদুগু আর নাইজারের দিকে, তাঁরা যাবেন গাও— আর সেই একই নাইজারকে তাঁরা ধরবেন অন্যখানে।
বলাই বাহুল্য, আমরা তাঁদের অনেক সমঝেছি, এই বাতুল সফরের পরিকল্পনাটা বাতিল ক’রে দিতে। কিন্তু আমাদের যুক্তিতর্ক অনুরোধে কোনোই ফল হয়নি। কাপ্তেন মার্সেনের ভাবী-অর্ধাঙ্গিনী খুব যে একটা নরম ধাতের মানুষ হবেন, তা আমার মনে হয় না। তাঁর মাথায় যদি কোনো বাই চাপে, তবে শয়তানেরও সাধ্য নেই তাঁকে একফোঁটা টলাতে পারে।
শেষটায়, মরীয়া হ’য়ে, আমরা লিউটেনান্ট ল্যকুরকেই অনুরোধ করেছি, তিনি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন—আলাদা পথটায় গিয়ে কী বিপদের মধ্যেই না তাঁদের পড়তে হবে! সন্দেহই ছিলো না তাঁর সব চেষ্টাও নিশ্চয়ই মাঠে মারা যেতো, কিন্তু তিনি মাদ্মোয়াজেল মোর্নাসকে বোঝাবার কোনো চেষ্টাই করেননি, উলটে বরং মুচকিই হেসেছেন একটু, কিন্তু এই মুচকি হাসির কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
তো, আমরা তো কাদুর কাছে এসে তাঁবু গেড়েছি। যেই আমি আমার তাঁবুতে ঢুকতে যাবো, হঠাৎ ডাক্তার শাতোনে আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। ‘একটা কথা আপনাকে আমি বলতে চাই, মঁসিয় ফ্লরেঁস, যে-বুলেট ঐ আফ্রিকিদের গায়ে গিয়ে লেগেছিলো সেগুলো ছিলো বিস্ফোরক-শরীরের মধ্যে গিয়ে ফেটে যায়।’ তারপর, আমার উত্তরের কোনো অপেক্ষা না-ক’রেই তিনি চ’লে গিয়েছেন।
এ-যে দেখছি আরো-একটা রহস্য! বিস্ফোরক বুলেট? ভেতরে গিয়ে ফেটে পড়ে? কারা এমন বুলেট ব্যবহার করে? আর এ-দেশে এমন অস্ত্রশস্ত্রই বা এলো কোত্থেকে?
১৮ই ফেব্রুয়ারি। কোনো মন্তব্য বিনাই, সর্বশেষ সংবাদ। আমাদের রক্ষিদল কেটে পড়েছে। কেটে পড়েছে, মানে উধাও, অদৃশ্য, না-পাত্তা
এ, অথচ, একেবারেই অবিশ্বাস্য, আবারও জানাচ্ছি : আমাদের রক্ষিদল আমাদের ফেলে রেখে চ’লে গেছে। তিন-চার ঘণ্টা আগে, ঘুম থেকে উঠে, তাদের কাউকেই আর আমরা দেখতে পাইনি। তারা যেন কর্পূরের মতোই উবে গিয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো মিলিয়ে গেছে রাত্রির অন্ধকারে, আর তাদের সঙ্গে গেছে সব সহিস, সব কুলি, আমাদের সঙ্গে যারা ছিলো, সবাই।
স্পষ্ট তো? লিউটেনান্ট ল্যকুর, তাঁর দুই গোরা সার্জেন্ট, তাঁর কুড়িজন আফ্রিকি সেপাই আজ সকালে হজমের গোলমালের জন্যে হাঁটতে বেরোয়নি, ব্যায়াম করতেও বেরোয়নি। তারা লাঞ্চের সময় ফিরে আসবে না। তারা চ’লে গেছে—সদলবলে অ-ন্ত-হি-ত।
এইখানে, বিদেশ-বিভুঁয়ে জঙ্গলের মধ্যে, আমরা পাঁচজন, আমরা আর তোঙ্গানেই শুধু আছি-সঙ্গে আছে আমাদের ঘোড়া, আমাদের যার-যার নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র, ছত্রিশটা গাধা, আর পাঁচদিনের উপযোগী রসদ।
বাঃ, আমি-না অ্যাডভেনচার চেয়েছিলুম…