।। দশ।। অদৃশ্য মানুষ—দৃশ্য চোখ
সঞ্জয়ের ইচ্ছা ছিল না মান্তুদের বাড়ি রীণা একা যায়। মান্তু অবশ্য দুজনকেই যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের তো সপ্তাহে একটি দিনই ছুটি। আর সপ্তাহে এই একটি দিন সঞ্জয় কোথাও নড়তে চায় না। তাই ছ’মাসের বেশি হল ওরা এখানে এসেছে, অথচ একদিনও মান্তুর কাছে যাওয়া হয়নি। শেষে মান্তুই একদিন সকালে এসে রীণাকে নিয়ে গিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। দুই সখীতে ঠিক করেছিল—এরপর রীণা একাই যাবে—আসবে। মান্তুও মাঝে—মাঝে আসবে।
এই প্রস্তাব শুনে সঞ্জয় মান্তুকে হেসে বলেছিল—বেশ তো আপনি এসে নিয়ে যাবেন। শুনে রীণা ফোঁস করে উঠেছিল—আহা, আমি কচি খুকি! যেন একা যেতে পারি না।
হয়তো পারে কিন্তু মহাজাতি সদনে সেই ঘটনার পর রীণার সম্বন্ধে সঞ্জয় খুব সতর্ক। একা ছেড়ে দিতে ভরসা পায় না। আবার একটু—আধটু ছেড়ে না দিলে মনটাও ঠিক হবে না। এইসব ভেবে শেষ পর্যন্ত একা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল।
সকালে বেরোবার সময়ে সঞ্জয় রীণাকে বার বার করে বলল, সাবধানে যেও। বাসের নম্বর ভালো করে দেখে উঠো। কোলে বাচ্চা। তাড়াহুড়ো করে উঠো না। ভিড় থাকলে সে বাস ছেড়ে দেবে। বাস থেকে নামার সময়ে পেছন দিকে তাকিয়ে নামবে। সাবধানে রাস্তা ক্রস করবে। আচ্ছা, দাঁড়াও। টাকা কটা রেখে দাও। দরকার হলে ট্যাক্সি করবে। তবে ফেরার সময় করো না। তখন সন্ধে হয়ে যাবে। ট্যাক্সিতে—একা—অচেনা—
উত্তরে রীণা মুখ টিপে একটু হাসল। বলল, আমি বোধহয় একেবারে গেঁয়ো মেয়ে নই। লেখাপড়াও জানি একটু—আধটু।
.
বেরোতে বেরোতে শেষ পর্যন্ত বেলা দেড়টা হয়ে গেল।
নভেম্বর মাস। অল্প অল্প শীত পড়েছে। বেলা দুপুরেও রোদের তাত তেমন অসহ্য নয়। ফিরতে ফিরতে যদি সন্ধে হয়ে যায় ভেবে ব্যাগের মধ্যে পুপুর একটা সোয়েটার আর নিজের একটা শালও ভাঁজ করে নিয়েছে।
রীণা বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ওর বেশ ভালো লাগছিল। বন্ধুর কাছে যাচ্ছে বলেই নয়, বাড়িটা থেকে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচে।
রীণা ফুটপাথ থেকে নেমে বাস—স্টপেজের দিকে চলল। হঠাৎ একেবারে পিছনে গাড়ির শব্দ শুনে এক লাফে ফুটপাথে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিনিবাস শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে আর—একটা বাসকে ওভারটেক করে বেরিয়ে গেল।
উঃ! হয়েছিল এখুনি! আশ্চর্য, বাসটা হর্ন পর্যন্ত দেয়নি।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়েছে। রীণাকে বললে, খুব বেঁচে গেলেন দিদি! কাউকে কিছু বলার নেই। নিজে সাবধানে যাবেন।
রীণা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মনটা খচখচ করতে লাগল—কেন এমন হল?
তারপরেই নিজেকে বোঝাল সাবধানে না চললে দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে। ফুটপাথ থেকে নামা উচিত হয়নি।
একজন মহিলা স্টপেজে দাঁড়িয়েছিলেন। রীণার হাবভাব দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন?
—হাওড়া।
—এই তো চলে গেল হাওড়ার বাস। লক্ষ করেননি!
অন্য রুটের একটা বাস এসে পড়ায় ভদ্রমহিলা তাতে উঠে চলে গেলেন।
রীণার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা তাকে লক্ষ করছিলেন কেন? তবে কি সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে? কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে?
ঘড়ির দিকে তাকাল। সোয়া দুটো। অর্থাৎ আধঘণ্টারও বেশি দাঁড়িয়ে আছে। একশো উনিশ নম্বর বাসও এসেছিল। খেয়াল করেনি।
মনটা ঠিক করে নিয়ে রীণা বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই আর একটা একশো উনিশ নম্বর এল। বেশ ভিড়। তবু রীণা উঠল। লেডিজ সিট একটাই খালি ছিল। রীণা বসে পড়ল।
বাস চলেছে। লোক নামছে, উঠছে। যত লোক নামছে তার চেয়ে ঢের বেশি উঠছে। রীণা জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। এসব রাস্তা সে চেনে না। বাসটা কোন কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে তাও জানে না। শুধু এটুকু জানে বাসটা হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে।
পুপু এতক্ষণ বেশ শান্ত হয়ে ছিল। এখন দুষ্টুমি শুরু করেছে। তার আর দোষ কী? মায়ের কোলে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে থাকা কতক্ষণ আর সম্ভব? একবার ও হাত—পা ছুড়তে ছুড়তে কোল থেকে পড়ে যায় আর কী! রীণা জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে পুপুকে জোর করে কোলে তুলে নিল।
সামনে লোক সার সার দাঁড়িয়ে। লেডিজ সিটের সামনেই রড ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেঞ্জাররা। বাসের ওদিকেও একই অবস্থা।
—বাবাঃ! সবাই হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে নাকি? তাহলে ওই ভিড় ঠেলে পুপুকে নিয়ে নামবে কী করে?
তারপরেই ভাবল অসুবিধে আর কী? সবাই নেমে গেলে ধীরেসুস্থে নামবে।
হঠাৎ রীণা দেখল বাসের সামনের দিকে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন তাকে লক্ষ করছে।
কয়েকবারই চোখ পড়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারল—হ্যাঁ, তাকেই দেখছে। কিন্তু লোকটিকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ে আড়াল পড়ে গেছে। এমন—কি মাথা—মুখও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের ভাষায় বলতে চাইছে—”আমায় চিনতে পারছ না?”
রীণারও মনে হল ওই চোখ যেন তার খুব পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছে।
রীণা কয়েকবার তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল লোকটি কে হতে পারে? ওই চাউনি যে তার খুবই চেনা।
বাসটা প্রথমে বেশ জোরেই চলছিল। তারপর ক্রমশ কেমন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলতে লাগল। প্যাসেঞ্জাররা তো চেঁচামেচি শুরু করে দিল।—বাস চলছে, না গোরুর গাড়ি?
বাসটা একটা বড়ো ক্রসিং—ওর স্টপেজে এসে থামল। অনেক প্যাসেঞ্জার নামল, উঠল। কন্ডাক্টার দুবার ঘণ্টি বাজাল। কিন্তু হঠাৎই বাসটির ইঞ্জিন থেমে গেল। আর স্টার্ট নিল না।
কন্ডাক্টর বলল, গাড়িটা ঠেলার দরকার।
কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেমে গিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে গাড়ি ঠেলতে লাগল।
গাড়ি একবার স্টার্ট নিল। তারপর আবার থেমে গেল।
গতিক সুবিধে নয় দেখে অনেকেই নেমে পড়ে অন্য বাস ধরতে গেল। কেউ কেউ কন্ডাক্টরের কাছে টিকিটের পয়সা ফেরত চাইতে লাগল। বাস খালি হয়ে গেল। শুধু রীণা চুপ করে বসে রইল। বুঝতে পারছিল না—কী করবে?
কন্ডাক্টর এসে বলল, আপনি বসে আছেন কেন? বাস যাবে না।
রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে নিয়ে উঠে পড়ল।
কন্ডাক্টরটি বোধহয় হৃদয়বান। বলল, টিকিটের পয়সা ফেরত নিন।
বলে টিকিটটা নিয়ে পয়সা ফেরত দিল। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?
—ক্ষীরোদতলা।
—সেটা আবার কোথায়?
—হাওড়ায়।
পিছনে তখন অনেকগুলো বাস এসে পড়েছিল। কন্ডাক্টর ঝুঁঁকে পড়ে একটা বাস দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই বাসে চলে যান।
রীণা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। একবার সেই লোকটিকে খুঁজে দেখার কথা মনে হল। চারদিকে তাকাল। কিন্তু এমন কাউকে দেখতে পেল না যে তাকে দেখছে। বুঝল—যে দেখছিল সে এতক্ষণে নেমে অন্য বাসে চলে গেছে।
কাছেই বাসটা দাঁড়িয়ে ছিল। রীণা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
এ বাসটাতেও ভিড় কম ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় আরো বেড়ে গেল। সেই ঠাসাঠাসি ভিড়।
বাস যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ যেন আর শেষ হয় না। বাসে বসে রীণার ঘুম এল। দু—একবার ঢুলুনি। তার পর কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ঠিক নেই। পুপুর কান্নায় ঘুম ভেঙে গেল। রীণা পুপুকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল সেই অদৃশ্য মানুষটার চোখ। আগের মতোই দূর থেকে তাকে একদৃষ্টে দেখছে। এবারও তার মুখ বা দেহ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ের আড়ালে অদৃশ্য।
রীণা খুব অবাক হল। লোকটা এ গাড়িতেও উঠেছে! তাহলে আগের বাসটা খারাপ হলে সে যখন নেমেছিল তখন লোকটাকে দেখা গেল না কেন?
রীণা চোখ সরিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে দেখতে লাগল।
একটু পরে বাসটা এক জায়গায় এসে থামল। রাস্তাটা আগের মতো চওড়া নয়। খুব ঘিঞ্জি। একপাশে দোকানপাট। অন্যপাশে বোধহয় মিনিবাস, সাইকেল—রিকশার স্ট্যান্ড। লোকজন ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। মিনিবাসের কন্ডাক্টর কর্কশ গলায় হাঁকছে—ঢাকুরিয়া— পার্কসার্কাস—সল্টলেক। সাইকেল—রিকশওয়ালা ঘন ঘন হর্ন বাজিয়ে সোয়ারি ডাকছে।
বাস এখানে থামতেই প্যাসেঞ্জাররা নেমে গেল। এখানে সবাই নামল কেন? এই কি হাওড়া ময়দান? যাই হোক পুপুকে কোলে নিয়ে রীণাও নামল।
নেমেই হকচকিয়ে গেল। না, এ তো হাওড়া ময়দান নয়, হাওড়া স্টেশনও নয়।
তাহলে?
তাহলে কোথায় এল?
ওরই মধ্যে একবার সেই চোখ দুটোকে খুঁজল। না, কেউ তাকে দেখছে না।
রীণার কীরকম ভয় করতে লাগল। সেই অদৃশ্য মানুষটার জন্যে নয়, তার মনে হতে লাগল নিশ্চয় ভুল বাসে উঠে পড়েছিল। নিশ্চয় অন্য কোথাও এসে পড়েছে।
কিন্তু জায়গাটা কী?
ভাবল কাউকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু যাকে—তাকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল। তা ছাড়া আনাড়ি মেয়ে ভেবে যদি কেউ তাকে ফলো করে? রীণা ঠিক করল কোনো প্রবীণ মানুষ দেখতে পেলে তাকে জিজ্ঞেস করবে।
এদিক—ওদিক তাকাতে তাকাতে সে দেখতে পেল একটা দোকানের রোয়াকে বসে একজন বৃদ্ধ খবরের কাগজ পড়ছেন।
রীণা পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধ চোখ তুলে তাকালেন। রীণা জিজ্ঞেস করল, এটা কোন জায়গা?
বৃদ্ধ বললেন, যাদবপুর।
—যাদবপুর! রীণা থমকে গেল।
রীণার মুখের অবস্থা লক্ষ করে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কোথায় যাবে মা?
রীণা লজ্জায় সংকোচে ইতস্তত করতে লাগল। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা যাদবপুর স্টেশন রোড। এখানেই কোনো নম্বর খুঁজছ?
রীণা মাথা নাড়ল।
—তবে?
রীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি হাওড়া যাব।
—হাওড়া যাবে! আসছ কোথা থেকে?
রীণা বলল, বাঙ্গুর থেকে।
—বাঙ্গুর মানে?
—লেকটাউন, বাঙ্গুর।
—সেখান থেকে এখানে!
রীণা তখন সব ঘটনা বলল।
শুনে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কি হাওড়া স্টেশনেই যাবে?
—না, হাওড়া ময়দান।
—তাহলে তো তুমি অনেকটা এগিয়ে এসেছ মা। যেখানে নেমেছিলে সেখানেই বাস পেতে। তুমি ওখানেই চলে যাও।
রীণা একটু ভেবে বলল, আমি বাঙ্গুরেই ফিরে যাব ভাবছি।
বৃদ্ধ বললেন, সেই ভালো। তুমি নতুন। সন্ধের পর হয়তো জায়গা চিনতে পারবে না। অবশ্য এখান থেকে বাঙ্গুর যাবার টানা বাসও নেই। বাস চিনে বদলাতে পারবে?
রীণা মাথা নাড়ল।
বৃদ্ধ বললেন, আমারও তাই মনে হয়।
একটু ভেবে বললেন, তুমি এক কাজ কর। সামনেই যাদবপুর স্টেশন। ওখান থেকে শিয়ালদা চলে যাও। তিনটে স্টেশন—ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, পার্কসার্কাস। যেখানে নামবে সেটা সাউথ স্টেশন। সেখান থেকে নর্থ স্টেশনে এসে যে কোনো গাড়িতে উঠলেই উলটোডিঙ্গি পৌঁছে যাবে—একটাই স্টেশন। তারপর ওখান থেকে একটা রিকশা নিয়ে নেবে—আমার ধারণা উলটোডিঙ্গি থেকে বাঙ্গুর রিকশা যায়।
রীণা খুশি হয়ে বৃদ্ধকে নমস্কার করে যাদবপুর স্টেশনে গেল। দু—দিকে প্ল্যাটফর্ম।
তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা আর চলতে পারছিল না। কোনোরকমে শিয়ালদার একটা টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল।
একটুপরেই ট্রেন এল। রীণা গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়িতে এত ভিড় যে রীণা বসার জায়গা পেল না। দাঁড়িয়ে থাকতে হল। একে মানসিক উদ্বেগ,—কত দূরে শেয়ালদা স্টেশন, সেখান থেকে কোন ট্রেনে উল্টোডিঙ্গি; তারপর কোথায় পাবে বাঙ্গুর যাবার রিকশা! এসব চিন্তা তো আছেই, তার ওপর পরিশ্রম। রীণার শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল। তবু অনেক কষ্টে এক হাতে পুপুকে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
ট্রেন ছুটছে। কোন স্টেশন কখন যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেছিলেন, মাত্র তিনটে স্টেশন পরেই শিয়ালদা। তিনটে স্টেশন কি এখনও যায়নি? একজনকে জিজ্ঞেস করতে গেল কিন্তু গলায় ভালো করে স্বর ফুটল না। ট্রেনের মধ্যে গোলমালে কেউ তার কথা শুনতে পেল না। ট্রেনটা একটা স্টেশনে থেমেই আবার চলতে শুরু করল। কেমন একটা দম—আটকানো কষ্ট হচ্ছে। পুপুকেও আর কোলে রাখতে পারছে না। পুপু যেন কোল থেকে পড়ে যাচ্ছে। রীণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। রড ধরে মেঝেতেই বসে পড়ল…
একসময়ে তার কানে এল কে যেন বলছে—আপনি কোথায় যাবেন?
রীণা অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল। দেখল সে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে আছে।
—পু—পু! বলে ধড়মড় করে উঠে বসল।
একজন ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁর স্ত্রীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে এঁর কোলে।
—আমি কোথায়?
—এটা মল্লিকপুর স্টেশন।
—মল্লিকপুর!
—হ্যাঁ, ডায়মন্ড হারবার লাইনে। এর পরেই বারুইপুর। আপনি কোথায় যাবেন?
—শেয়ালদা!
—শেয়ালদা। তো এদিকে এলেন কী করে?
রীণা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, জানি না।
—আপনি তো উলটোদিকে এসে পড়েছেন।
রীণা বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোকের স্ত্রী পুপুকে রীণার কোলে তুলে দিয়ে বললেন, আজ আপনি আমাদের বাড়ি চলুন। আমরা এখানেই থাকি। কাল সকালে উনি না হয় আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন।
রীণা একটু চুপ করে থেকে ছেলেমানুষের মতো বললে—আমি বাড়ি যাব।
—বাড়ি কোথায়?
—বাঙ্গুর।
তখন ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে চলুন, আপনাকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।
পরের ট্রেনে ভদ্রলোক রীণাকে নিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনে এলেন। এই সময়ে উঠল প্রচণ্ড ঝড়।
ভদ্রলোক এমনও ভেবেছিলেন রীণাকে না হয় বাঙ্গুর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই আসবেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড় ওঠায় এত দেরি হয়ে গেল যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল না। তিনি রীণাকে নিয়ে এলেন বালিগঞ্জ থানায়।
সেখানে পুলিশ রীণাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করল। স্বামীর নাম, ঠিকানা। রীণার তখন ঘোর কেটে গিয়েছিল। সব কিছুই বলতে পেরেছিল।
ভদ্রলোক, ও. সি—কে বললেন, যদি আপনারা অনুগ্রহ করে এঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেন—
ও.সি বললেন, অনুগ্রহ কেন বলছেন, এ তো আমাদের কর্তব্য। তবে একটু দেরি হবে। পুলিশ ভ্যানগুলো—
বলেই রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়িতে ফোন আছে?
রীণা বললে, দোতলায় এক ভদ্রলোকের ঘরে আছে।
—নম্বর?
—নম্বর! রীণা মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগল।
—মনে নেই?
রীণা চোখ বুজিয়ে একটু ভাবল। তারপর ভেবে ভেবে খুব আস্তে গুনে গুনে ঢিল ছোড়ার মতো একটি একটি সংখ্যা বলে গেল।
ও.সি তখনই রিসিভার তুললেন।
.
মান্তু দারুণ উদ্বেগে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে পুরুষের সাড়া পাওয়া গেল।
—কে?
—আমি মান্তু—
ব্যাকুল কণ্ঠস্বর যেন বন্ধ দরজার ওপর আছড়ে পড়ল।
দরজা খুলে দিল সঞ্জয়। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল মান্তু।—রীণা কোথায়? ভালো আছে তো?
উত্তর পাবার দরকার ছিল না। মান্তু দেখল ম্লান ক্লান্ত মুখে বিহ্বলদৃষ্টিতে রীণা তাকিয়ে আছে।
সঞ্জয় হেসে বলল, আসুন, কাল অনেক রাত্তিরে আপনার বান্ধবীকে উদ্ধার করে এনেছি।