১.০৯ অগ্নিকুণ্ডলী
হিন্দুস্থানও ব্রাজিলের মতো এই গর্ব করতে পারে যে তারও ঝড়, বৃষ্টি, কালো মেঘের কোনো তুলনাই হয় না। অন্তত রাগি, বদরাগি একটি ঝড় যে আশু আসন্ন, সে-বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিলো না। তাপমান যন্ত্রও তা-ই বললে। হঠাৎ অন্তত দুইঞ্চি নেমে গিয়েছে পারদের স্তম্ভ।
হুডদের জন্যে ভারি দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার, মানরো বললেন, ঝড় আসছে, রাত্রিও আসন্ন, অন্ধকারও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। শিকারিরা অনেক সময় খেয়াল না-করেই শিকারের পিছু-পিছু অনেক দূরে চলে যায়। ওরা ফিরে আসতে পারবে তো?
হুড একটা আস্ত পাগল! বললে ব্যাঙ্কস, কোনো যুক্তির কথায় ওকে কর্ণপাত করানো ভগবানেরও অসাধ্যি। যাওয়াটাই ওর অন্যায় হয়েছে।
বললুম, কোনোভাবে ওদের কোনো সংকেত করতে পারি না আমরা?
নিশ্চয়ই পারি। এক্ষুনি আমি বৈদ্যুতিক মশাল জ্বেলে দিচ্ছি, বললে ব্যাঙ্কস।
ম্যাক-নীল জিগেস করলে, আমি ক্যাপ্টেন হুডের খোঁজে বেরুবো?
না-না, মানরো বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, অন্ধকারে এই বনজঙ্গলে ওদের তো খুঁজে পাবেই না, মাঝখান থেকে নিজেই আবার হারিয়ে যাবে।
ব্যাঙ্কস বোতাম টিপতেই বেহেমথের মস্ত চোখ দুটো মশালের মতো আলো হয়ে উঠলো, আর সেই আলো পড়ে অশ্বথ বনের সামনেটা থেকে অন্ধকার যেন লাফিয়ে ভয় পেয়ে সরে গেলো। অনেক দূর থেকেই এই আলো হুডের চোখে পড়া উচিত।
হঠাৎ এমন সময় প্রবল পরাক্রান্ত হাওয়া এলো সবেগে, বাঁকিয়ে দিলে গাছের ডগা, নুয়ে পড়লো ডালপালা সমেত ঝকড়ামাথা অশ্বথবন, নুয়ে পড়লো আর লাফিয়ে উঠলো ম্প্রিঙের মতো, আর সেই স্তম্ভের মতো সারি-সারি অশ্বথের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া বেজে উঠলো যেন কোনো গম্ভীর আকুল অগ্যান।
ঝড় এলো এতই আচম্বিতে যে মনে হলো যেন ফেটে পড়লো বিস্ফোরণের মতো। ঝরে পড়লো রাশি-রাশি হলুদপাতা, মরা ডাল-হাওয়া তাদের তাড়িয়ে নিয়ে এলো আমাদের শকট পর্যন্ত। আমরা তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে দিলুম। কিন্তু তখনও বৃষ্টি পড়লো না।
টাইফুন যে! ব্যাঙ্কস যেন আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠলো, স্টর! কালু কোথায়?
শেষ জ্বালানিটুকু চুল্লিতে ফেলছে এখন কালু।
ঝড় থেমে গেলে আমাদের কাঠ কুড়িয়ে নিতে হবে-হাওয়া যেন বিনি মাইনের কাঠুরের মতো সব কেটেকুটে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে-আমাদের অনেক পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিলে। যা-ই হোক, তুমি চুল্লিটা সব সময় গনগনে করে রেখো—যাতে চট করে রওনা হতে পারি।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে অনবরত, আর বারে-বারে গর্জে উঠছে বাজ। গরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে জোরে, যেন কোনো গনগনে উনুনের ঢাকা খুলে বেরিয়েছে সে। মাঝে-মাঝে বারান্দায় এসে আমরা অশ্বখবনের দিকে তাকাচ্ছি-আঁকাবাঁকা ডালপালাগুলো যেন ঝলসে-ওঠা আকাশের গায়ে আঁকা কোনো ভীষণ চিত্রকরের এক অফুরান স্তব্ধ কালো আর্তনাদেরই প্রতিভাস।
হুডের জন্যে আমাদের দুর্ভাবনা ক্রমশ বেড়েই চললো। রাত যখন নটা, শুরু হলো মুষলধারে বর্ষণ। আর সেই আকাশভাঙা বাদলের মধ্যে প্রচণ্ড ঘূর্ণিহাওয়া রাশিরাশি ঝরাপাতা উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোনো প্রকাণ্ড খ্যাপার মতো। প্রতি মুহূর্তে ছিঁড়ে যাচ্ছে মেঘ, অবিরাম বিদ্যুতের শাসানি আর গর্জনে। আমরা ভিতরে এসে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলুম। বাইরের বিদ্যুৎজ্বলা চীৎকৃত আলোর ঠিক উলটো যেন আমাদের বৈঠকখানা, শান্ত স্নিগ্ধ এক অন্ধকার ছেয়ে আছে সারা ঘরে।
হুডদের জন্যে আমাদের উদ্বেগ আর অস্বস্তি ক্রমশই বেড়ে উঠছিলো। এই ঝড়ের মধ্যে গাছতলায় আশ্রয় নিলেও তো তাদের রেহাই নেই। গাছ ভেঙে পড়তে পারে, বাজ ফেটে পড়তে পারে তাদের উপর।
আর এ-কথা আমার মনে জেগে উঠতেই ভীষণ শব্দ করে প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো–ঠিক যেন আমাদের মাথার উপর এবার; আর পরক্ষণেই একটা পোড়া গন্ধে সারা ঘর ভরে গেলো।
বাজ পড়লো। ম্যাক-নীল আতঙ্কে ভরে গেলো! কাছেই!
স্টর! কালু! পারাজার! ব্যাঙ্কস চেঁচিয়ে ডাক দিলে।
তিনজনে ছুটে এসে ঢুকলো আমাদের ঘরে; ব্যাঙ্কস অলিন্দে গিয়ে দাঁড়ালো দেখবার জন্যে। দ্যাখো! দ্যাখো! চেঁচিয়ে উঠলো সে।
রাস্তার ঠিক বামপাশে, প্রায় দশ হাত দূরে, একটা মস্ত অশ্বত্থ গাছ মাটিতে উলটে পড়ে গেছে। তার মস্ত ডালপালাগুলো পড়েছে আশপাশের গাছপালার গায়ে, আর প্রবল হাতে কে যেন ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে গাছটার, সেই ঝুরি আর ছাল হাওয়ায় এঁকেবেঁকে যাচ্ছে ভীষণ সাপের মতো। সোজাসুজি পড়েছে বাজটা, আর একেবারে চিরে, টুকরো করে ফেলেছে অত-বড়ো গাছটাকে।
বড্ড বেঁচে গেলো আমাদের স্টীম হাউস, বললে ব্যাঙ্কস, এখানেই থাকতে হবে আমাদের, ফাঁকায়—ওই গাছপালার তলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়ার চেয়ে এখানেই আমরা অনেক বেশি নিরাপদ?
ব্যাঙ্কসের কথা শেষ হবার আগেই চীৎকার শোনা গেলো পিছনে। তবে কি ডরা ফিরে এলো?
স্টর বললে, এ তো পারাজারের গলা।
সত্যি, বাবুর্চি পারাজারেরই গলা; পিছনের অলিন্দ থেকে চেঁচিয়ে ডাকছিলো সে আমাদের। তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে আমরা ছুটে গেলুম। গিয়ে কী দেখলুম! দেখলুম : আমাদের থেকে প্রায় দুশো হাত দূরে ডান দিকে অশ্বথ বনে আগুন ধরে গিয়েছে। এর মধ্যেই উঁচু ডালপালাগুলো যেন কোনো জ্বলন্ত পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, সেই আগুন উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে-করতে এগিয়ে আসছে আমাদের এই স্টীম হাউসেরই দিকে। সর্বনাশ আসন্ন। এই ক-দিন এই জ্বলন্ত প্রখর তাপ আর শুকনো গরম হাওয়া গাছপালার আর্দ্রতা শুষে নিয়েছে, গাছপালা ঘাসবন আর ঝোপঝাড় এতই শুকনো ও দাহ্য হয়ে উঠেছে যে মুহূর্তে এই বিপুল বনও বুঝি আদিম সর্বভুক। অগ্নিদেবতার জঠরে চলে যাবে। অগ্নিকুণ্ডলীর দ্রুত অগ্রসর দেখে এটা বুঝতে মোটেই অসুবিধে হলো না যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের গোটা শিবির ভস্মীভূত হয়ে যাবে। এই ভীষণ বিপদের সামনে পড়ে আমাদের স্তম্ভিত মুখ থেকে কোনো কথাই বার হচ্ছিলো না। শেষকালে মানরো শান্ত গলায় বললেন, ব্যাঙ্কস, এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করার ভার তোমার উপর।
ব্যাঙ্কস বললে, উদ্ধার আমাদের পেতেই হবে। এই দাবানল নেভাবার ক্ষমতা যখন আমাদের নেই, তখন এই অগ্নিকুণ্ডের ত্রিসীমানা থেকে চম্পট দিতে হবে আমাদের।
আর ক্যাপ্টেন হুড? তার কী হবে? জিগেস করলে ম্যাক-নীল।
এখন তাদের জন্যে কিছুই করার উপায় নেই। এক্ষুনি যদি তারা এখানে এসে পৌঁছোয়, তাহলে তাদের ফেলে রেখেই আমাদের রওনা হয়ে পড়তে হবে।
কিন্তু তাদের ফেলে চলে-যাওয়া আমাদের উচিত হবে না, ব্যাঙ্কস, বললেন মানরো।
ফেলে চলে-যাওয়া নয়—প্রথমে বেহেমথকে এই আগুনের খপ্পর থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পরে তাদের আমরা খুঁজে বার করবো।
ব্যাঙ্কসের কথা যে যুক্তিযুক্ত, এ-কথা অস্বীকার করতে পারলেন না মানরো। তা-ই করো তাহলে।
স্টর! এক্ষুনি এঞ্জিনে গিয়ে বোসো! কালু-স্টীম চাপিয়ে দাও হাতির শুঁড় দিয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে এলো।
ততক্ষণে দাবানল প্রায় পঞ্চাশ হাত এগিয়ে এসেছে। এত বড়ো-বড়ো গাছগুলোকে। যেন মুহূর্তে জঠরে পুরে দিচ্ছে ওই সর্বগ্রাসী আদিম দেবতা। বন্দুকের গুলির মত শব্দ করে ফুটছে ডালপালা, আগুনের তীরের মতো ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে চারপাশে–আর গাছ থেকে গাছে, লাফিয়ে চলে যাচ্ছে আগুন।
ব্যাঙ্কস বললে, আর সময় নেই। এক্ষুনি রওনা হতে হবে।
মানরো বললেন, ইশ, যদি হুডরা ফিরে আসতো!
সিটি বাজাও-বাঁশি বাজাও। চেঁচিয়ে বললে ব্যাঙ্কস, হয়তো বাঁশির শব্দ শুনতে পাবে তারা!
গর্জে-ওঠা বাজ, বৃষ্টির ঝমঝম, শব্দ-করে-ফুটে-ওঠা ডালপালার আওয়াজ ছাপিয়ে বাঁশির তীক্ষ্ণ্ণ-প্রবল চীৎকারে হাওয়া বারেবারে কেঁপে উঠলো। নিশ্চয়ই অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছেছিলো সেই বাঁশির শব্দ। কিন্তু হুড, ফক্স বা গৌমির কেননা চিহ্নই নেই কোথাও।
ব্যাঙ্কস, মানরো অস্থিরভাবে বলে উঠলেন, আরো কয়েক মিনিট অপেক্ষা করো, ব্যাঙ্কস!
অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় ব্যাঙ্কস বললে, বেশ, আর তিন মিনিট কেবল অপেক্ষা করবো আমি যদিও ওই তিন মিনিটে কিন্তু পুরোপুরি আগুনের পাল্লায় চলে যাবে বেহেমথ!
দু-মিনিট কেটে গেলো। আগুনের হলকা পৌঁছুলো বারান্দায়; ইস্পাতের খোল গরমে তেতে যেন লাল হয়ে উঠেছে। আরো-অপেক্ষা-করা নিছক পাগলামি ছাড়া আর-কিছু নয়।
স্টর! এঞ্জিন চালিয়ে দাও!
আরে! ম্যাক-নীল চেঁচিয়ে বলে উঠলো।
ওই তো ওরা! বলে উঠলেন কর্নেল।
রাস্তার ডান দিক থেকে ক্যাপ্টেন হুড আর ফক্সকে দেখা গেলো; গৌমিকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে তারা।
মারা গেছে নাকি?
না। ঠিক ওর পাশেই বাজ পড়েছিলো—বন্দুকটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে চুরমার, বাঁ-পা-টা একেবারে অবশ হয়ে গেছে।
ব্যাঙ্কস, বেহেমথ ওই বাঁশি না-বাজালে আমরা বোধহয় কিছুতেই ফিরে আসতে পারতুম না!
শিগগির করো! জলদি! ব্যাঙ্কস চাচালে।
হুড আর ফক্স লাফিয়ে উঠলো আমাদের এই অদ্ভুত গাড়িতে, আর গৌমি প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়লেও তখনও সংজ্ঞা হারায়নি–ধরাধরি করে তাকে এনে তার কামরায় শুইয়ে রাখা হলো।
তখন প্রায় সাড়ে-দশটা বাজে। ব্যাঙ্কস আর স্টর হাওদায় গিয়ে বসলো; আর, .তিন আলোর ঝলকানির মধ্যে এগিয়ে চললো বেহেমথ, দাবানল, বেহেমথের বৈদ্যুতিক মশাল, আর বিদ্যুৎজ্বলা আকাশ—এই তিনরকম আলোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের অতিকায় ইম্পাতি হাতি, তার শুঁড় থেকে বেরিয়ে এলো কালো ধোঁয়ার সর্পকুণ্ডলী।
দু-এক কথায় হুড তার অভিযানের বর্ণনা দিলে। কোনো বন্য জন্তুর দেখাই তারা পায়নি, চিহ্নমাত্রও না। এদিকে ঝড় যখন এলো, অন্ধকার যে তাদের তখন এত তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেলবে তা তারা কেউই আশঙ্কা করেনি। তারা তখন মাইল তিনেক দূরে গেছে, এমন সময় বাজের শব্দ গর্জে ওঠে মাথার ওপর। তক্ষুনি ফিরে আসার চেষ্টা করে তারা, কিন্তু সেই ঝুরি-নামা ডালপালা-ভরা অশ্বথ বনে তারা আতঙ্কিত হয়ে আচমকা আবিষ্কার করে যে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে। ঝড় ততক্ষণে রেগে উঠে গাছপালার ঝুঁটি ধরে নাড়াচ্ছে। এতদূরে তারা চলে গিয়েছিলো যে বেহেমথের বৈদ্যুতিক মশালের আলো সেখানে পৌঁছোয় না। পথ হারিয়ে ফেলে তারা কেবলই গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো, কেমন করে যে বেহেমথে পৌঁছুবে বুঝতেই পারেনি। ততক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে, এমনকী ডালপালা ও নিবিড় পাতার চন্দ্রাতপ ভেদ করে অঝোর ধারায় ঝরতে লেগেছে সেই বিষম বৃষ্টি–ভিজে তারা যেন ঝোড়ো কাক হয়ে গেলো একেকজনে। আর এমন সময় এক প্রচণ্ড ঝলসানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো তাদের, ঠিক যেন মাথার ওপরেই বাজ ফেটে পড়লো বিষম রোষে, আর গৌমি সংজ্ঞা হারিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে, ক্যাপ্টেন হুডের পায়ের তলায়। তার বন্দুকটা তার হাত থেকে কে যেন হ্যাচকা টানে ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেললে, কুঁদোটা ছাড়া ধাতুনির্মিত খোলনলচের কিছুই আর থাকলো না। প্রথমটায় তারা ভেবেছিলো গেমি বুঝি মরেই গেলো, কিন্তু পরীক্ষা করে বুঝলো যে ওই ভীষণ বিদ্যুৎ তার গায়ে বয়ে যায়নিকাছে পড়েছে, আর সেই ধাক্কায় তার পা-টা অসাড় হয়ে গেছে। বেচারার হাঁটবার ক্ষমতাই ছিলো না; তারা তাকে ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে এলো, সেই কালো বনের মধ্যে দিয়ে কোনোমতে সামনে এগুতে লাগলো। দুঘণ্টা তারা সেই আঁধারবনের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সংশয়ে পা চলেনি; থেমে বোঝবার চেষ্টা করেছে কোথায় পৌঁছেছে, তারপর আবার শুরু করেছে তারা সেই হতাশ কুচকাওয়াজ। অবশেষে যখন তারা একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় কোথায় যেন তীক্ষ্ণ্ণ ধাতব স্বরে বাঁশি বেজে উঠলো, বেহেমথের। তার মিনিট পনেরোর মধ্যেই তারা এসে পৌঁছুলো-আরেকটু দেরি হলে বেহেমথ হয়তো তাদের ফেলে রেখেই চলে যেতো।
হুড যতক্ষণে তাদের ওই দুর্বিপাকের বর্ণনা দিলে, বেহেমথ ততক্ষণে প্রশস্ত মসৃণ অরণ্যপথ ধরে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু দাবানলও যেন তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছে; হাওয়ার গতি যদি বদলে যায়, তাহলে এই অবস্থায় আমাদের বিপদের আর শেষ থাকবে না। লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে আগুন–পিছু-নেয়া কোনো বিষম ভয়ের মতো—আর বেহেমথ যেন প্রাণপণে ছুটে চলেছে তার হাত এড়াবার জন্যে। হঠাৎ কিন্তু সত্যিই বদলে গেলো হাওয়ার গতি, ছাই আর ফুলকি উড়লো ঘূর্ণি দিয়ে চরকির মতো পাক খেয়ে-খেয়ে, আর আগুনের বেগ যেন আরো বেড়ে গেলো।
ব্যাঙ্কস তক্ষুনি বেহেমথের গতি বাড়িয়ে দিলে, কিন্তু সেই চঞ্চল অগ্নিকাণ্ডের কাছে শেষ পর্যন্ত তাকে যেন হার মানতেই হবে। আমরা আতঙ্কে ও ভয়ে কেবল সেই প্রচণ্ড, অবিশ্বাস্য, ভয়ংকর দাবানলের দিকে তাকিয়ে আছি! অসহায়ের মতো সমস্ত বোধ আর চেতনা যেন টান হয়ে প্রতীক্ষ্ণ করছে ভীষণ মুহূর্তের, কখন পথ আটকে দু-পাশের অরণ্যেই জ্বলে ওঠে আগুন; এমন সময়, তখন সাড়ে-এগারোটা হবে, ঠিক যেন বেহেমথের মাথার উপর বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়লো বাজ! কী সর্বনাশ! স্টর আর ব্যাঙ্কস যে হাওদায় রয়েছে! আমি ভয়ে চোখ বুঝে ফেললুম।
বাজটা কিন্তু সরাসরি হাওদার উপর পড়েনি; বেহেমথের লম্বা পাখার মতো কানে পড়েছে, আর ওই ইস্পাত শুষে নিয়েছে সব বিদ্যুৎ। এঞ্জিনের কোনো বিপদ হয়নি। বরং সেই বিকট বক্সনাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেহেমথ যেন তার শুঁড় তুলে বার কয়েক বাঁশি বাজিয়ে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘোষণা করে দিলে!
ক্যাপ্টেন হুড ফুর্তিতে লাফিয়ে উঠলো!রক্তমাংসের হাতি হলে কখন ডিগবাজি খেয়ে পড়তো, চার পা শূন্যে তুলে গড়াগড়ি যেতে! কিন্তু দেখেছো আমাদের বেহেমথকে–বজ্রবিদ্যুৎ ঝড়বৃষ্টি দাবানল কাউকেই কোনো পরোয়া করে না।
আরো-আধঘণ্টা এগুবার পর আমরা এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেলুম। জ্বলন্ত গাছপালার আলোয় দেখা গেলো সারি-সারি ভীত ও কাতর, আতঙ্কিত ও মরীয়া জীবজন্তু–দাবানলের হাত থেকে পালাবার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে তারা—কোনোদিকেই দৃকপাত করছে না মোটেই। আর তাদের দেখে হুড কেবল সশব্দে কপাল চাপড়াতে লাগলো। যখন সে শিকারে বেরিয়েছিলো, তখন কারু ল্যাজের ডগাটিও চোখে পড়েনি —অথচ এখন যখন চায় না, তখন তারা পাল্লার মধ্যে ছুটোছুটি করে মরছে। পোড়া কপাল আর কাকে বলে?
রাত একটার সময় আমাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠলো। হাওয়া হঠাৎ তিনবার পাক খেয়েই বদলালো দিক, উড়ে গেলো ফুলকি আর ছাই, আর ওপাশের প্রস্তুত ও আগ্রহী অশ্বথ বনেও ধরে গেলো আগুন। অর্থাৎ বেহেমথ মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে, এবং সামনে ও দু-পাশে লেলিহান শিখা উঠে গেছে ঊর্ধ্বে, উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছে যেন ভয়ংকর আহ্বাদে। এই আগুনের কুণ্ডের মাঝখান দিয়েই এগুতে হবে আমাদের : দুই ধারে গনগনে বিপুল উনুন, তার মধ্য দিয়ে ছুটে যেতে হবে বেহেমথকে কোনো জাদুজানা অতিকায় ঐরাবতের মতো। হিন্দুদের বজ্রের দেবতা ইন্দ্রের হাতি ছাড়া কে আর উদ্ধার পাবে এই সংকট থেকে?
ব্যাঙ্কস কিন্তু হাল ছাড়েনি। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তারই মধ্য দিয়ে সে পূর্ণবেগে চালনা করলে বেহেমথকে, দু-পাশে গর্জমান জ্বলন্ত উনুন, প্রজ্বলন্ত ডালপালার উপর দিয়ে ঘুরে-ঘুরে যাচ্ছে বেহেমথের চাকা, আর জ্বলন্ত দম-বন্ধ-করা আবহাওয়া ঢেকে ফেলছে আমাদের।
এইভাবে কতক্ষণ কেটেছিলো, জানি না। হঠাৎ…হঠাৎ একঝলক খোলা হাওয়া যেন শোঁ-শোঁ করে বয়ে গিয়ে আমাদের বলে গেলো, বিপদ আর নেই! রাত তখন দুটো বাজে। আমরা অবশেষে সেই অশ্বথ বন পেরিয়ে এসেছি। আমাদের পিছনে পড়ে রয়েছে সেই বিশাল অরণ্যদেশ, যেখানে শিখা কেবল ছড়িয়েই যাবে নৃত্য করতেকরতে, শেষ অশ্বথ গাছটা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ অব্দি সেই আগুনের নাচ আর থামবে না।
সকালবেলায় ঝড় থেমে গেলো-যেমন হঠাৎ এসেছিলো, তেমনিই হঠাৎ তার রোষ আর আক্রোশ মিলিয়ে গেলো দিগন্তে—যেন এই ভয়ংকর কয়েক ঘণ্টায় নিজেকে সে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলেছে।
বেহেমথ যখন বিশ্রামের জন্যে থামলো, তখন বেলা বারোটা বাজে, আর আমরা অবিরাম চলে রেওয়া প্রদেশের কাছে এসে পড়েছি।