৭. সিকাসোয়
বারোই জানুয়ারী বারজাক মিশন এসে সিকাসো পৌঁছুলো, উপকূল থেকে কম ক’রেও সাতশো মাইল দূরে।
ল্যক্সপান্সিয়ঁ ফ্রাঁসেঈ যদিও আমেদে ফ্লরেঁসের কাছ থেকে আর-কোনো নিবন্ধ পায়নি, সেই বিখ্যাত সাংবাদিকটি কিন্তু রোজকার ঘটনা সব খুঁটিনাটি সমেত এখনও তাঁর নোটবইতে লিখে চলেছেন : তাঁর সেই নোটবই থেকেই পরের বৃত্তান্তটা নেয়া হয়েছে।
তাঁর নোটবই প’ড়ে জানা যায়, কান্কান থেকে সিকাসো অব্দি প্রায় একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন ভাবেই এগিয়েছে বারজাক মিশন, এমন-কোনো ঘটনাই ঘটেনি, যেটা অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত ছিলো। কতগুলো রসিকতাও ছিলো তাতে, সাঁৎ- বেরাকে চাঁদমারি ক’রে, তাঁর সেই নামজাদা ভুলোমনের কাজকারবার নিয়ে। এছাড়া যেমন হয় পথে-ঘাটে, কতগুলো ঘটনা ঘ’টে যায়, কিন্তু কৌতূহল উসকে দেবার মতো উপকরণ তাতে কিছুই থাকে না। ৎশুমুকিকে দেখা গেছে তার পুরোনো দোস্ত তোঙ্গানেকে এড়িয়ে চলতে, বরং তার খাতির ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে অভিযানের প্রথম গাইড মোরিলিরের সঙ্গে—তবে এদের দোস্তি-দুশমনিতে কারুই কোনো আগ্রহ ছিলো না।
কেনিয়ালালার ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যে শিগগিরই একদিন ফ’লে যাবে, এমন কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি কোথাও। আমেদে ফ্লরেঁস নিয়মিত তার নিবন্ধগুলো লিখেই চলেছেন, কিছুতেই তাঁর সাংবাদিকের রুটিনে ফাঁক পড়ে না, আর নিয়মিত সেগুলো ৎশুমুকির হাতে তুলেও দিচ্ছেন-আর সে একগাল হেসে ব’লেও যাচ্ছে যে সেগুলো সে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে; আর কোনোকারণে সেগুলো যদি যথাস্থানে না-পৌঁছে থাকে, সাংবাদিকের তা জানবার কোনোই উপায় ছিলো না। সাঁৎ-বেরা এখনও অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট হ’তে পারে। জেন মোনাসের হৃদয়েও কোনো মস্ত আঘাত পড়েনি—অন্তত প্রকাশ্যে দেখা যায় এমন-কোনো মর্মভেদী-কিছু ঘটেছে ব’লে মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে আলংকারিক অর্থে হৃদয়ের আঘাতটা ফ’লে-যাবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে বটে—অন্তত ফ্লরেঁস সেই-মর্মে একটা-দুটো মন্তব্য ক’রে রেখেছেন। আর ঐ চতুর্থ ভবিষ্যদ্বাণী—যেটা সবচেয়ে গুরুতর এবং সাংঘাতিক, সেটা ফলবার কোনো, আবারও জোর দিয়ে বলা যায় কোনোই, লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মিশন ধ্বংস হ’য়ে যায়নি এখনও —মিশনের কেউই ক্রীতদাস হিশেবে এখনও হাটে-বাজারে বিক্রি হয়নি। কাপ্তেন মার্সেনের তত্ত্বাবধানে শান্তিপূর্ণভাবেই অভিযাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে : দুশো খোলাতলোয়ার বজায় রেখেছে শান্তি, গাধাঘোড়াগুলোর ওপর দিয়ে ধকল গেলেও তাদের কারু মুখ থুবড়ে প’ড়ে টেশে যাবার কোনোই সম্ভাবনা নেই, আর সেই-যে নদীতে কিছু-কিছু মালপত্তর ভেসে গিয়েছিলো, তারপর তাঁদের লটবহর থেকে আর-কিছুই খোয়া যায়নি।
তাছাড়া, আমেদে ফ্লরেঁস তাঁর তৃতীয় নিবন্ধের শেষে যে অস্বস্তিকর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, সেটাকে সমর্থন ক’রে নতুন-কিছুই ঘটেনি। অভিযানের সারের ওপর অতর্কিতে এসে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে কেউ কোনো হামলা চালায়নি, আর নতুন- কোনো কেনিয়ালালারও মুখোমুখি পড়তে হয়নি যে অভাবিত-সব ভাবী দুর্ঘটনার কথা ব’লে তাদের ঘাবড়ে দেবে। কাজেই মনে হয়, সাংবাদিকের অনুমান যদি ঠিকই হ’য়ে থাকে, কেউ-কেউ যদি এই মিশনকে ঘাবড়ে দিয়ে ফেরৎ পাঠাবার কোনো উদ্ভট মলবও এঁটে থাকে, সব দেখেশুনে এখন মনে হচ্ছে সে তার ঐ বদমলবটা বুঝি ত্যাগ করেছে।
সত্যি বলতে, ফ্লরেঁস নিজেও এই চক্রান্তটা সম্বন্ধে পুরোপুরি মনস্থির ক’রে উঠতে পারেননি। যে-আড়াইখানা তথ্যের ওপর ভর করে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, সেগুলো ক্রমেক্রমে নিতান্তই অস্পষ্ট মনে হয়েছে-পরে মন থেকে মিলিয়ে গেছে। যদিও অভিযান গিয়ে সিকাসো পৌঁছোয়নি—ভবিষ্যৎবাণী তো বলেছিলো তার পর থেকেই শুরু হবে উৎপাত—তবু প্রতিদিনই ফ্লরেঁস আরো- বেশি আশ্বস্ত বোধ করেছেন: দিনের আলোয় সবসময়েই মনে হয়েছে কথাটা নিতান্তই-উদ্ভট আর আজগুবি : নিরীহ কালো লোকেরা হঠাৎ এমন-একটা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে যাবেই বা কেন?
ফ্লরেঁস অবশ্য যদি খেয়াল করতেন কিছুদিন পরেই অভিযান দু-ভাগ হ’য়ে দুটো দল দুটো ভিন্ন পথে পাড়ি জমাবে, তাহ’লে হয়তো তাঁর অস্বস্তিটা তিনি এমনভাবে উড়িয়ে দিতেন না।
কারণ সিকাসো থেকেই বারজাক মিশন দু-ভাগ হয়ে যাবে। একদল যাবে, খোদ বারজাকের নেতৃত্বে, নাইজার নদীর তীর ধ’রে, আর দাহোমে ঘুরে ফের ফিরে যাবে কোনোক্রিতে, অন্যদলটা বোদ্রিয়েরের নেতৃত্বে যাবে দক্ষিণদিকে– গ্রাঁ-বাসাম-এ। দুটো দলেরই সুরক্ষার জন্যে সশস্ত্র পাহারা দরকার হবে—ফলে যে সেপাইশাস্ত্রীরা সঙ্গে আসছে তারাও দুটো ভাগ হ’য়ে যাবে—একেক দলে থাকবে মোটে একশোজন সৈন্য।
সিকাসো আসলে পর-পর পাশাপাশি কতগুলো গ্রামকে ঘিরেই গ’ড়ে উঠেছে— গ্রামগুলোর মধ্যে আছে চাষের জমি, যথারীতি তাতা দিয়ে ঘেরা; তারই মধ্যে ফরাশি সরকার গ’ড়ে তুলেছেন একটা গড়, আর সৈন্যসামন্তের থাকার জন্যে ছাউনি আর ব্যারাক।
ঔপনিবেশিক পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে-সঙ্গেই আছে সেনেগলি সেনাবাহিনী- অফিসাররা সবাই ফরাশি, এন-সি-ওও [নন-কমিশান্ড অফিসাররাও] তাই। এই তরুণ অফিসারদের আনন্দ উপচে পড়েছে, এই বারজাক মিশন এসে হাজির হ’তেই : কতদিন তারা দেশের লোকের মুখ দ্যাখেনি, প’ড়ে আছে এই বিদেশ- বিভূঁইতে। আনন্দটা উল্লাস হ’য়ে ফেটে পড়লো, যখন তারা আবিষ্কার করলে যে এই সেপাইশাস্ত্রীদের দায়িত্বে আছেন খোদ কাপ্তেন মার্সেনে, তাদেরই পুরোনো বন্ধু। আর উল্লাস প্রায় মহোল্লাসে পরিণত হ’য়ে গেলো যখন তারা দেখতে পেলে অভিযানের সঙ্গে আছে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী –এবং নিছক তরুণীই নয়, বুকের রক্ত চলকে দেবার মতো অপরূপ রূপসীও।
একটা পোশাকি স্বাগতম্ জানানো হ’লো নবাগতদের। হাওয়ায় উড়লো তেরঙ্গা, তুরী-ভেরী বাজালো লা মার্সাঈ, ঢাক-ঢোল তুলে দিলে চনমনে নাচের ছন্দ, আর তোরণ সাজানো হ’লো ফুলে-পাতায়-আর চারপাশে ঘিরে রইলো আশপাশের গাঁ থেকে মেলা-দেখতে-আসা স্থানীয় লোকজন। কিছুই বাদ যায়নি, এমনকী সাংসদ বারজাকের শ্রীকণ্ঠ-নিঃসৃত আলংকারিক বচনে ভরপুর এক ভাষণও না।
সেদিনই সন্ধেবেলায় তরুণ অফিসাররা ফুর্তির হাট বসালে এক মজলিশের ব্যবস্থা করে। তার মধ্যমণি মক্ষিরানি জেন মোর্নাস-আর তার সাফল্য এমনকী স্বয়ং ভীনাসও বোধকরি স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না। সব্বাই তাঁকে ঘিরে থাকতে চায়, সকলেই চায় তাঁর কৃপাকটাক্ষ, তাদের এই নির্বাসনে এই সুন্দরীর একঝলক মৃদুহাসির জন্যে তারা হয়তো নিজেদের মধ্যে ডুয়েল লড়তেও রাজি ছিলো। তবে জেন মোরনাসের বিচক্ষণ মাথাটি কিন্তু এই দারুণ জনপ্রিয়তায় আদপেই ঘুরে যায়নি। যত স্তবস্তুতি কানে গেছে তাদের মধ্যে কাপ্তেন মার্সেনের স্তবস্তুতিই হয়তো সহজেই গিয়ে পশেছে তার মরমে। আর সে-যে পক্ষপাত দেখাচ্ছে একটু, এটা তার খেয়ালই হয়নি—এত-সহজ, এত-সরল, এত-স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো তার কৃপাকটাক্ষ। ব্যাপার দেখে কাপ্তেন মার্সেনের পুরোনো বন্ধুরা পরে একটু দূরেই সরে গেলো, ব্যক্তিগতভাবে নিজেরা কৃতার্থ বোধ করেনি বটে, তবে তাদেরই এক বন্ধুর তো কপাল খুলে গেছে, এটাই যেন ছিলো তাদের মনের ভাব। তারা বরং গোপনে অভিনন্দন জানিয়েছে কাপ্তেন মার্সেনকে—আর মার্সেনে বৃথাই চেষ্টা করেছেন তাদের বোঝাতে যে, ‘না-না, এর মধ্যে হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপার নেই’। মার্সেনে বরং তাদের দৃষ্টি থেকেই স’রে যেতে পারলে বাঁচতেন, বারে- বারে মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝালেন যে এখনও হৃদয়ের কোনো গাঁটছড়া বাঁধবার মতো অবস্থা হয়নি, এমনকী এক-আধবার যেন বলবারও চেষ্টা করলেন, ‘তোমরা যে কী বলতে চাচ্ছো, তা-ই আমি বুঝতে পারছি না’। অথচ-কিন্তু না-বোঝবার মতো অসাড়-গবেট তিনি নন মোটেই, এই আমাদের কাপ্তেন মার্সেনে, উল্লাসে বরং তাঁর গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে ওঠবার ইচ্ছে করছিলো। তাহ’লে তাঁর দিবাস্বপ্নগুলো ফ’লে গিয়েছে! জেন মোরনাসের মনের ভাব এতই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে সকলেই তা বুঝতে পেরেছে—তিনি মিথ্যে ব্যাখ্যা ক’রে নিজেকে স্তোক দেননি! অর্থাৎ, এই সিকাসোয় এসেই এই তরুণ-তরুণী নিজেরাও উপলব্ধি করেছে পরস্পরের প্রতি তাদের মনের ভাব কী
পরের দিন বসলো এক আলোচনা সভা। কেমন ক’রে দু-ভাগ করা হবে মিশনকে? বোদ্রিয়েরের সঙ্গে যাবেন মাদাম এইরিউ আর কিরিউ, তাঁদের ওপর ফ্রাসের নির্দেশ ছিলো সেইরকম, আর মসিয় তসাঁও তাঁদের সঙ্গ নেবেন, সেটা তাঁর নিজেরই অভিরুচি। বারজাকের দলে যাবেন মঁসিয় পঁসাঁ আর ডাক্তার শাতোনে! আমাদে ফ্লরেঁসও সেই দলেই যাবেন ব’লে ঠিক করেছেন। কেননা এ-পথটাই লম্বা বেশি, প্রতিবেদনের মালমশলাও এ-পথেই বেশি-জোটবার সম্ভাবনা।
কাপ্তেন মার্সেনের নির্দেশে তাঁর সেপাইশাস্ত্রী থেকে একশোজনকে বেছে বেছে বোদ্রিয়রের দলটার সঙ্গে দিয়ে দেয়া হ’লো, তাদের নেতৃত্ব দেবে গড়েরই একজন লিউটেনান্ট। বাকি অর্ধেক লোকলস্কর নিয়ে মার্সেনে নিজেই থাকবেন বারজাকদের সঙ্গে। এ-সমস্ত ঠিকঠাক হচ্ছে, আর ভেতরে-ভেতরে তিনি জ্ব’লে-পুড়ে মরছেন : জেন মোর্নাস কোন দলের সঙ্গে যাবেন? প্রসঙ্গটা উত্থাপন করার পর যখন উত্তর মিললো যে জেন মোর্নাসও বারজাকের দলের সঙ্গে যাবেন, তখন কী- যে একটি স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো তাঁর বুক চিরে। কিন্তু স্বস্তিটা খুব-একটা স্থায়ী হলো না, যখন শুনতে পেলেন যে জেন মোর্নাস ও সাঁৎ-বেরা মিদির মাননীয় সাংসদের সঙ্গে মাত্র কয়েকদিনই যাবেন কেননা কিছুটা যাবার পরেই তাঁরা ভিন্নরাস্তা ধরবেন, কেননা তাঁদের গন্তব্য আরো-উত্তরে, গভীর জঙ্গলে।
সমবেত সমস্ত অফিসারদের মুখ থেকেই একসঙ্গে একটা আপত্তি উঠলো : ও-রকম ভাবে উত্তরের পথে এগুবার মস্ত ঝুঁকি আছে, দলছাড়া হ’য়ে নিজেরা ও-পথে গেলে কখন যে কী বিপদ-আপদ ঘ’টে যাবে তা কেউ জানে না-আর এ-বিষয়ে অফিসারদের কারু মধ্যেই কোনো মতভেদ নেই। কোনো লোকলস্কর সেপাইশাস্ত্রী বিনাই ঐ একেবারে-অচেনা-অজানা দুর্গম-পথে কেউ যায়? ওখানে তো এখনও ফরাশি শাসন কায়েমই হয়নি। এ-রকম কোনো অভিযান-তারা দৃঢ়স্বরে জানালে—সম্পূর্ণ-অসম্ভব, মিথ্যেই প্রাণ হাতে ক’রে যেতে হবে ওখানে, সমস্ত গ্রামপ্রধানরাই তাঁর রাস্তায় উপদ্রব করবে, বাধাবিপত্তি যে কত তার কোনো ইয়ত্তাই নেই।
এত-সব বোলচালে কোনো ফলই হ’লো না। জেন মোর্নাস অনড়, অটল, অবিচল, –কেউ, এমনকী খোদ কাপ্তেন মার্সেনে শুদ্ধু, কেউই তাঁর ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
‘আপনারা খামকা আপনাদের সময় নষ্ট করছেন,’ হেসে বলেছেন জেন মোর্নাস, ‘তাতে ফল হবে শুধু এই যে আমার মামা মিথ্যেমিথ্যি ঘাবড়ে যাবেন- ঐ তাকিয়ে দেখুন কেমনভাবে ছানাবড়া চোখগুলো কপালে তুলে তিনি তাকিয়ে আছেন।’
‘আমি! ভয় পেয়েছি! কে বলে?’ অজেনর অমনি প্রতিবাদ তুলেছেন- তর্কাতর্কিতে এর পর তাঁরও প্রবেশ ঘ’টে গেছে।
‘হ্যাঁ, তুমি,’ জেন মোর্নাস নাছোড়। ‘তুমি তো ভয়েই আধমরা হ’য়ে গিয়েছো। জিগেস করো এঁদের—সবাই তা-ই বলবেন। তুমি কি এ-সব দুঃসংবাদের পাখিদের কিচির-মিচিরকে পাত্তা দেবে না কি?
‘আমি!’ বেচারা সাঁৎ-বেরা আকাশ থেকে পড়েছেন।
‘কীসের অত ভয় তোমার, বলো তো?’ স্ফুরিত অধরে চমৎকার হেসে জিগেস করেছেন জেন মোর্নাস। ‘ভাগ্নে, আমি তো তোমার সঙ্গেই থাকবো।’
‘কিন্তু কে বলে যে আমি ভয় পেয়েছি!’ সকলের দৃষ্টির সামনে অস্বস্তিতে ছটফট ক’রে জিগেস করেছেন সাঁৎ-বেরা।
প্রসঙ্গটাকে ধামাচাপা দিয়ে, জেন মোর্নাস তারপর অন্যদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছেন, ‘না। আমি ইওরোপ ছেড়েছিলুম ওম্বোরি পেরিয়ে গিয়ে ঠিক নাইজার নদীর বাঁকে গিয়ে পৌঁছুবো ব’লে, গাও-য়ের কাছে ঠিক যেখানে নাইজার তার অদ্ভুত বাঁকটা ফিরেছে। এবং আমি ওম্বোরি পোরুবোই, গাওতে নাইজার নদীর বাঁকের কাছেও গিয়ে পৌঁছুবো।’
‘আর তুয়ারেগ বা আউয়েলিমিদেনের কথাটাও ভাবুন-ও-অঞ্চলে, নাইজার নদীর দু-তীরে, কাদের প্রতাপ, জানেন?’
‘তুয়ারেগের আমি থোড়াই পরোয়া করি, জেন মোর্নাস জানিয়েছেন, ‘ওরা আমায় ঠেকাতে পারবে না-হাজার বাধা দিলেও আমি আমার লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছুবো।’
‘কিন্তু গাও কেন? অন্য কোথাও তো হ’তে পারতো? আপনাকে যে ওখানেই যেতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? আপনি তো বেড়াতেই বেরিয়েছেন- এই সফর তো আনন্দ উপভোগ করবার জন্যেই?’
‘যেতে চাই আর-কি,’ জেন মোরনাসের নাছোড় সংকল্প।
হ্যাঁ, তা বটে, অফিসাররা সবাই একমত। খুবই সাধু সংকল্প, আদ্যোপান্ত ফরাশি; খেয়ালকে অমনভাবে আর কেই-বা অমন সমীহ করে কোথাও?
কম্যান্ডন্ট বের্গেজ বলেছেন, ‘তা ঠিক-এর চাইতে চমৎকার উদ্দেশ্য আর কী হ’তে পারে? কোনো মহিলা যখন কিছু চান, তখন তিনি কিছুই চান, আর এটাই শেষ কথা। সেখানে তর্ক তোলে কোন নচ্ছার? অন্তত আমি নই।’
দলটা—অতএব—ভাগাভাগি হ’য়ে গেলো। লটবহর কিছু বেশি পড়লো বারজাকের দলে, সহিস এবং তল্পিবাহকও তাঁর দলেই কিছু বেশি, কেননা তাঁদের পথটা অন্যদের চাইতে দীর্ঘ। আর মোরিলিরেই তাঁদের গাইড হবে-এর লম্বাপথটার বেশির ভাগ জায়গাই তার চেনা।
কিন্তু ব্যবস্থাটা পাকা করতে গিয়েই প্রথম গণ্ডগোলের সূত্রপাতটা হ’লো। তাকে কথাটা খুলে বলবামাত্র মোরিলিরে সোজাসুজি না ক’রে দিলে—তার না-র আর নড়চড় হবে না—মোটেই তাকে টলানো যাবে না তার গোঁ থেকে—কোনো যুক্তিতর্কে কান দেবার পাত্রই সে নয়। সে সোজাসুজি ব’লে দিলে, এই সিকাসো অব্দি আসবার জন্যেই তাকে নিয়োগ করা হয়েছিলো। তারপরে সারা জগতের ধনদৌলত উপঢৌকন দিলেও সে এখান থেকে আর একপাও যাবে না। যুক্তিতর্কে যখন কোনো কাজ হ’লো না, তখন তাকে শাসানো হ’লো, হুমকি দেয়া হ’লো, কিন্তু ঐ তর্জন গর্জনই সার : সে বরং বোদ্রিয়েরদের সঙ্গে দক্ষিণমুখো যাবে— কিন্তু বারজাকের সঙ্গে পুবমুখো–উঁহু, নৈব নৈব চ।
শেষটায় তার জেদের কাছেই নতিস্বীকার করতে হ’লো অভিযাত্রীদের, কিন্তু গণ্ডগোলটা তাতেই কিন্তু মিটে গেলো না। সহিস আর তল্পিবাহকদের বেলায় ঝামেলাটা আরো-চরমে উঠলো। শুধু জেন মোর্নাস আর সাঁৎ-বেরা যাদের বহাল করেছিলেন, তারা ছাড়া আর সবাই একবাক্যে প্রস্তাবটায় বেঁকে বসলো। সিকাসো পেরিয়ে তারা আর কোথাও যাবে না। সাধাসাধি, ইনামের লোভ, কঠোর সাজার হুমকি-কিছুতেই কোনো ফল হ’লো না। বারজাক মিশন যেন মিথ্যেই একটা পাথরের দেয়ালের গায়ে মাথা ঠুকছে! এদের বুঝিয়ে-শুঝিয়ে আর-কিছুতেই রাজি করানো যাবে না।
তখন খোঁজ-খোঁজ প’ড়ে গেলো, কোথায় মিলবে নতুন গাইড, নতুন সহিস, নতুন কুলিমজুর। সহিস বা তল্পিবাহক পেতে কোনো অসুবিধেই হলো না, কিন্তু নতুন-কোনো স্থানীয় লোক—যে এদিককার পথঘাট চেনে এবং তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, এমন লোককে খুঁজে পেতে কয়েকটা দিন লেগে গেলো
আর তৎক্ষণাৎ মোরিলিরের একটা হার্দ্য পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো। এতদিন সে নির্বিকার ঔদাসীন্যের সঙ্গে এ-কান দিয়ে কিছু শুনেছে এবং ও-কান দিয়ে বার ক’রে দিয়েছে, এমনকী তাঁর গোঁয়ার্তুমির মধ্যে একটা বিজাতীয় বিতৃষ্ণাই লক্ষ করা গেছে এতদিন; কিন্তু যেই নতুন-একজন পথপ্রদর্শক জুটে গেলো, অমনি তার মধ্যে মস্ত-একটা বদল লক্ষ করা গেলো। সে নিজেই গিয়ে বারজাকের কাছে দরবার করলে, নিজের গোঁয়ার্তুমির জন্যে কান-টান মূলে মাফ চাইলে, বললে সে নানারকম গুজব শুনে বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ব’লেই অমন নারাজ হয়েছিলো, তবে সে এখন দাহোমে অব্দি মিশনের সঙ্গে যেতে একপায়ে রাজি, আসলে সে ভুলেই গিয়েছিলো যে তাকে দাহোমে অব্দি যাবার জন্যেই বহাল করা হয়েছিলো। আর তারই সঙ্গে-সঙ্গে পুরোনো সহিস আর কুলিদের মধ্য থেকেও সব-প্রতিরোধ উধাও, তারা একবাক্যে বললে তাদের গাইড তাদের যেখানে নিয়ে যবে, তারা সেখানেই যেতে রাজি—তবে রাজি হবার শর্ত একটাই : মোরিলিরেকেই তাদের গাইড করতে হবে।
এই আকস্মিক ঐক্যমত্য দেখে এটাই বোঝা গেলো যে এই অপ্রত্যাশিত হরতালটার জন্যে মোরিলিরেই দায়ী ছিলো, সে-ই এদের পালের গোদা; গোড়ায় একঝলক তাই ভাবা হয়েছিলো তার প্রস্তাবে আর রাজি হওয়া ঠিক হবে না। তবে অভিজ্ঞ কোনো গাইডের সহায়তা সবসময়েই কাজে লাগে, তার ওপর সে তো মূলত এদিকটাতেই জন্মেছে, শেষে তার ঐ অবাধ্য আচরণটাকে আপাতত ভুলে-যাওয়াই ঠিক হবে ব’লে সাব্যস্ত হ’লো। ঠিক হ’লো, নতুন যে-গাইডকে নিয়োগ করা হয়েছে সে যাবে মঁসিয় বোদ্রিয়েরের দলটার সঙ্গে, আগেকার সহিস ও কুলিদেরও একটা দল যাবে সেইসঙ্গে—আর নতুনদের মধ্যে জনাকয়েক। মসিয় বারজাক সঙ্গে নেবেন মোরিলিরেকে, আর আগেকার সহিস ও তল্পিবাহকদের বড়োদলটাকে।
এত-সব তর্কাতর্কি, দ্বিধা, এত-সব অদলবদল-এতে বেশ-কিছুটা সময়ের অপচয় হ’লো। তাঁরা সদলবলে বারোই জানুয়ারি এসে সিকাসোয় পৌঁছেছিলেন, কিন্তু একুশে জানুয়ারির আগে বোদ্রিয়ের আর বারজাকের পক্ষে তাঁদের ভিন্ন- ভিন্ন পথে যাওয়া আদপেই সম্ভব হয়নি।
সেদিন, ঐ একুশে জানুয়ারি ভোরবেলায়, আবার সৈন্যদের একটা জমকালো কুচওয়াজ হলো, আবার হাওয়ায় পৎপৎ ক’রে উড়লো তেরঙ্গা, আবার বেজে উঠলো তুরী-ভেরী, আর বারজাক মিশন-তার পেছনে বোদ্রিয়ের মিশন- সৈন্যদের দুই সারের মাঝখান দিয়ে সারি বেঁধে রওনা হ’লো। গড় থেকে সৈন্যদল ‘সঙ্গে গেলো তাদের, শহরের শেষ মাথা অব্দি-সেখান থেকেই তারা বিদায় নেবে।
তাতার ওপারে বিদায়সম্ভাষণের বহর আর বাহারা চললো, কোলাকুলি ক’রে গড়ের অফিসাররা শুভেচ্ছা জানালে মিশনকে, আর কিঞ্চিৎ আবেগতাড়িত হ’য়েই বারজাক আর বোদ্রিয়ের, সব মতভেদ-সত্ত্বেও, পরস্পরের করমর্দন করলেন। অবশেষে সেনাবাহিনী ফিরে গেলো ব্যারাকে, দুটো কনভয়ই রওনা হ’য়ে পড়লো— দুটো দল এবার দু-দিকে যাবে। বোদ্রিয়ের তাঁর দলবল নিয়ে যাবেন দক্ষিণমুখো, বারজাকরা রওনা হ’য়ে পড়েছেন পুবদিকে যাবেন ব’লে।
এই দুই কনভয়, দুই সার লোক, সংখ্যায় প্রায়-সমান, অথচ এদের দুটির কপালে দু-রকম দশা জুটবে। বোদ্রিয়ের দলটাকে আদপেই কোনো বিপদে পড়তে হবে না, কোনো মুশকিলও তাদের হবে না। বোদ্রিয়ের বরং তাঁর অভীষ্ট মিশন ক’রে সংসদে গিয়ে তাঁর নিজের প্রতিবেদন পেশ করবেন যথাসময়েই। বারজাক ও তাঁর দলবল গিয়ে পড়বে এমন রগরগে, রুদ্ধশ্বাস, ও রোমাঞ্চকর অ্যাডভেনচারের মাঝখানে, এমনভাবে ঝাঁপ খাবে অদ্ভুত-কিম্ভূত যত বিপদ- আপদের মাঝখানে যে আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কল্পনার অমন তুলকালাম দৌড়ই বোধহয় এর আগে আর দেখা যায়নি।
কাজেই বোদ্রিয়েরের দলবলের পথে তুচ্ছ ও নগণ্য যে-সব ঘটনা ঘটবে, সেগুলোকে উপেক্ষা ক’রেই এই আখ্যায়িকা অতঃপর শুধু তাদেরই পেছন-পেছন যাবে, যারা গেছে পুবমুখো, যাদের পথপ্রদর্শক অভিজ্ঞ গাইড মেরিলিরে, যারা গিয়ে ঢুকবে আফ্রিকার অন্ধকারতম নিবিড় অরণ্যে।