১.০৭ এলাহাবাদ
বারাণসী থেকে এলাহাবাদের দূরত্ব বড়জোর আশি মাইল। চব্বিশে সকালেই আমরা এলাহাবাদের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়লুম, ঘণ্টায় তিন-চার মাইল মাত্র বেগে, অর্থাৎ বেহেমথ যথার্থই গজেন্দ্রগমনে চলছিলো তখন। আসলে কলকাতায় আমাদের দিন যেমন কাটতো, এই চলন্ত বাড়িতেও তেমনিই কাটছে : ছোটোহাজরি, মধ্যাহ্নভোজ, দিবাতন্দ্রা, সান্ধ্যভোজ—সবই একইভাবে হচ্ছিলো নিত্য, কেবল দিগন্ত বদলে যাচ্ছিলো। তার মধ্যে; দৈনন্দিন কাজ ছিলো রোজই একরকম, শুধু পারিপার্শ্বিক কেবলই বদলেবদলে যাচ্ছে।
কাশিম-সুলেমানের সমাধিস্তম্ভ, চুনার দুর্গ, মির্জাপুর সব পেরিয়ে আমরা যখন যমুনা ও গঙ্গার সংগমস্থলে এসে পৌঁছলুম তখন ২৫ শে মে সন্ধে সাতটা। নদী পেরুতে অবশ্য খুব অসুবিধে হলো, সারি-সারি নৌকো দিয়ে ভাসা সেতু চলে গেছে এপারওপার, টিকিয়ে-টিকিয়ে তারই উপর দিয়ে চলে এলো বেহেমথ : এলাহাবাদে আর নাঢুকে আমরা শহরতলিতেই সে-রাতটা কাটিয়ে দেবো স্থির করলুম।
পরের দিন আমরা সবাই বেরুলুম শহর দেখতে। ঠিক ছিলো এলাহাবাদ থেকেই আমরা উত্তরমুখো এগুবো নাকবরাবর। কানপুর-লক্ষ্ণৌ যাতে পথে না-পড়ে, মানরো যাতে কিছুতেই অস্বস্তিতে না-পড়েন, সেদিকে আমরা লক্ষ রাখবার চেষ্টা করছিলুম।
বিখ্যাত খশরুবাগ আর আকবরের প্রকাণ্ড কেল্লাটা ছাড়া এলাহাবাদে সেই অর্থে বিশেষ কিছু দেখার ছিলো না, যদিও তার ভূদৃশ্য ছিলো অতীব সুন্দর। বেড়াতে বেরিয়ে আমি আর ব্যাঙ্কস এবার প্রথম থেকেই সাবধানে লক্ষ করছিলুম কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কিনা। কিন্তু না, এখানে সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়লো না।
আমরা আলাদা-আলাদা দলে বেরিয়েছিলুম। আগের মতোই আমি আর ব্যাঙ্কস গিয়েছিলুম শহর দর্শনে, মানরো আর ম্যাক-নীল আশপাশে ঘুরে বেড়াতে, আর হুড গিয়েছিলো ক্যানটনমেন্টে তার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। ফিরে এসে দেখি মানরো আগেই ফিরে এসে আমাদের অপেক্ষা করছেন। তার চোখের তারা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, যেন কোনো বিষম প্রতিজ্ঞায় জ্বলে উঠেছে। হঠাৎ কী-যে হলো আমরা কিছুই বুঝতে পারলুম না। ম্যাক-নীল তখনও ফেরেনি; মানরো তাকে নাকি কোথায় জরুরি কাজে পাঠিয়েছেন। কাজেই কিছু যে জিগেস করে জানবো, তারও উপায় ছিলো না।
খাবার টেবিলে মানরো সাধারণত দু-চারটে কথা বলতেন। কিন্তু আজ তিনি রইলেন অস্বাভাবিক গম্ভীর। বোঝা গেলো তিনি ম্যাক-নীলের প্রতীক্ষ্ণ করছেন। ব্যাপার কিছু বুঝতে না-পেরে হুড জিজ্ঞাসু চোখে আমাদের দিকে তাকালে; কিন্তু আমরা কীই বা জানি যে বলবো।
অস্বাভাবিক স্তব্ধতার মধ্যে আমাদের সান্ধ্যভোজ শেষ হলো; তারপর হঠাৎ মানরো বলে উঠলেন, ব্যাঙ্কস, হুড-আর আপনিও মঁসিয় মোক্লের-দয়া করে আমার সঙ্গে একটু ক্যান্টনমেন্ট অব্দি যাবেন?
তক্ষুনি আমরা তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। খানিক দূর যাবার পর হঠাৎ মানরো। রাস্তার পাশে একটা থামের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। থামটার গায়ে একটা সরকারি ফতোয়া আঁটা।
এটা পড়ে দ্যাখো-মানরো বললেন।
ফতোয়াটা আসলে দু-মাস আগের সেই বিজ্ঞপ্তি, যাতে বম্বাই প্রেসিডেন্সির রাজ্যপাল নানাসাহেবের মাথার মূল্য নির্ধারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে জানিয়েছিলেন নানাসাহেব নাকি বম্বাইতে হাজির হয়েছেন। বিজ্ঞপ্তিটা দেখে ব্যাঙ্কস আর হুড তাদের হতাশা চাপতে পারলে না। এই দু-মাস তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে খবরটা চেপে রাখার, কিন্তু কে জানতো যে হঠাৎ তা এমনিভাবে খোদ মানরোরই চোখে পড়ে যাবে।
ব্যাঙ্কস, সার এডওয়ার্ড বললেন, তুমি এই বিজ্ঞপ্তিটার কথা জানতে?
ব্যাঙ্কস কোনো কথা বললে না।
দু-মাস আগেই তুমি জানতে পেরেছিলে যে নানাসাহেব বম্বাই প্রেসিডেন্সিতে এসে হাজির হয়েছে, অথচ আমাকে সে-কথা একবারও বললানি!
ব্যাঙ্কস ভেবে পেলে না এ-কথার উত্তরে কী বলা যায়।
হুড বললে, জানতুম কর্নেল, যে এমন একটা বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে। কিন্তু আপনাকে সে-কথা বললে কী হত? নানাসাহেব যে সত্যি-সত্যি বম্বাই এসেছে, তা আপনি জানতেন কী করে? মাঝখান থেকে আপনার মনে কষ্ট দিয়ে কী লাভ হতো?
ব্যাঙ্কস, মানবোর মুখ যেন মুহূর্তে মন্ত্রবলে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, নানাসাহেবের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়াবার অধিকার যে কেবল আমারই আছে, এ-কথা কি তুমি ভুলে গেছো? আমি যে কলকাতা ছেড়ে তোমাদের সঙ্গে বেরিয়েছি তা তো কেবল এইজন্যই যে নেপালের কাছাকাছি যেতে পারবো{ নানাসাহেব মারা গেছে, এ-কথায় আমার মোটেই কোনোদিন বিশ্বাস হয়নি। তার মৃত্যুর খবরটা সত্যি না মিথ্যে, তা আমি নিজে যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলুম!
ব্যাঙ্কস এতক্ষণে মুখ খুললে। আপনাকে কেন ও-কথা বলিনি, জানেন সার এডওয়ার্ড? নানাসাহেব যে বম্বাই এসেছে এ-কথা আমি আদৌ বিশ্বাস করিনি।
কর্নেল মানরো এ-কথা শুনে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি ম্যাক-নীলকে এলাহাবাদের গবর্নরের কাছে পাঠিয়েছি এ-সম্বন্ধে সব তথ্য জোগাড় করে আনার জন্যে 1 নানাসাহেব সত্যি বম্বাই এসেছে কি না, তা আমরা এক্ষুনি জানতে পাবো।
ধরুন যদি জানা গেলো যে সত্যি সে বম্বাই এসে হাজির হয়েছে, তখন? তখন আপনি কী করবেন? ব্যাঙ্কস উৎকণ্ঠায় ভরে গিয়ে জিগেস করলে।
তাহলে এক্ষুনি আমি বম্বাই চলে যাবো।
এই আপনার স্থির সিদ্ধান্ত? কিছুতেই নড়চড় হবে না?
কিছুতেই না। তোমরা বরং আমাকে ছাড়াই বেহেমথকে নিয়ে এগোও–আমি আজ রাতেই বম্বাইয়ের ট্রেন ধরবো।
কিন্তু একা নয়, কর্নেল। আমরাও আপনার সঙ্গে থাকবে। ব্যাঙ্কস বলে উঠলো।
নিশ্চয়ই—আমরা আপনাকে একা যেতে দেবো না, কর্নেল, হুড জানালে।
কর্নেল মানরো, আমি বললুম, আপনি আমাকেও বন্ধু হিশেবে সঙ্গে নেবেন তো?
নিশ্চয়ই, মঁসিয় মোক্লের। আজ রাতেই আমরা সবাই মিলে এলাহাবাদ ছাড়বো-, ব্যাঙ্কস আমাকে জানালে।
তার আর দরকার হবে না, পিছনে কার গম্ভীর গলা শোনা গেলো।
সবাই এক সঙ্গে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি সার্জেন্ট ম্যাক-নীল হাতে একটা খবর-কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই যে, এটা পড়ে দেখুন, মানরোর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে ধরলো সে, আপনাকে এটা দেখাতে বললেন গবর্নর।
সার এডওয়ার্ড পড়ে শোনালেন : বম্বাই প্রেসিডেন্সির রাজ্যপাল এতদ্বারা ৬ই মার্চের বিজ্ঞপ্তিটি খারিজ করিয়া জানাইতেছেন যে গতকল্য সাতপুরা পর্বতে ইংরেজ বাহিনীর সহিত একটি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রচণ্ড সংঘর্ষে ধুন্ধুপ ওরফে নানাসাহেব নিহত হইয়াছেন। লক্ষ্ণৌ এবং কানপুরের বাসিন্দারা মৃতদেহটি শনাক্ত করিয়াছে। মৃতদেহের বাম হাতের একটি অঙ্গুলি ছিন্ন : নকল অন্ত্যেষ্টির সময় উহা কর্তিত হইয়াছিল। এ-বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নাই যে নানাসাহেবের নিকট হইতে ইংরেজদের আর-কোনো ভয় নাই।
পড়তে-পড়তে মানরোর গলা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেলো। কাগজটা তার হাত থেকে খসে পড়ে গেলো। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম। নানাসাহেবের মৃত্যু সম্বন্ধে আর-কোনো সংশয়ই নেই।
মানরো একটু চুপ করে থেকে শেষটায় গম্ভীরভাবে ব্যাঙ্কসকে বললেন, উত্তরে যাবার আগে একবার কানপুর হয়ে যাওয়া যায় না।
আপনি কানপুর যেতে চান?
হ্যাঁ, শেষবারের মতো কানপুর হয়ে যেতে চাই আমি, তারপর উত্তরদিকে যাবো আমরা-উত্তরদিকে।