১.০৬ বারাণসীতে কয়েক ঘন্টা
এখন কেবল খোলা বড়ো রাস্তা পড়ে আছে আমাদের চলন্ত বাড়ির সামনে; সাসারাম হয়ে গঙ্গার ডান তীর ধরে একেবারে বারাণসী পর্যন্ত নিয়ে যাবে আমাদের এই রাস্তা। রোটাসের কাছে পেরিয়ে এলুম শোন নদী—আরা আর দিনাজপুরের কাছে এসে সব শাখা নিয়ে যে গঙ্গায় এসে মিশেছে। গাজিপুরের গোলাপবন, মুঘলসরাইয়ের রেলপথ, পঁয়ত্রিশ মাইল দূরের গোমতীর অধিত্যকার জৌনপুর—সব পেরিয়ে এলো বেহেমথ।
বারাণসী গঙ্গার বাম তীরে; এখানে নয়, এলাহাবাদে আমাদের গঙ্গা পেরুতে হবে। বাইশে মে রাত্রে বেহেমথ গঙ্গার তীরে শিবির ফেলেছিলো, তেইশে সকালবেলায় ঠিক ছিলো—আমরা বারাণসী দেখতে যাবো। তীরে অনেকগুলো নৌকো নোঙর-করা, ঠিক ছিলো এরাই আমাদের নিয়ে যাবে।
এ-সব জায়গায় আগে অনেকবার ঘুরেছেন কর্নেল মানরো, তাই তার আর দেখার কিছু ছিলো না; তবু প্রথমে তিনি ঠিক করেছিলেন আমাদের সঙ্গেই প্রাচীন শহরে বেড়াতে যাবেন, কিন্তু পরে ম্যাক-নীলকে নিয়ে গঙ্গার তীর ধরেই বেড়াতে যাবেন বলে ঠিক করলেন। হুড আগে কিছুদিন বারাণসীতে ছিলো, এই সুযোগে সে তার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেলো। ফলে আমি আর ব্যাঙ্কসই কেবল বারাণসীর ঘিঞ্জিগলি, বিপুলবপু ধর্মের ষাঁড়, জীর্ণ মন্দির আর বিখ্যাত ঘাটগুলো দেখবার জন্য বেরিয়ে পড়লুম।
অন্য-সব প্রধান নগরের মতো বারাণসীতেও ১৮৫৭ সালে বিক্ষোভের আগুন জ্বলেছিলো, আর সেই বিদ্রোহ কেমন করে কর্নেল মানরো ও ম্যাক-নীল কঠোর ও নির্দয়ভাবে দমন করেছিলেন, নৌকোয় বসে-বসে সেই কাহিনীই আমাকে শোনাচ্ছিলো ব্যাঙ্কস। হয়তো কর্নেল মানরো বিক্ষোভের কোনো চিহ্নমাত্র দেখতে চান না বলেই শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এলেন না, ব্যাঙ্কস তার ধারণা ব্যক্ত করলে।
আমাদের নৌকো তখন ধীরে ভেসে চলেছে, আর বাম তীরে বারাণসী তার জীর্ণ গোল গম্বুজ, শ্যাওলাজমা প্রাসাদ, ত্রিশূল-বসানো মন্দির আর স্নানাথী-ভিড়-করা ঘাট সমেত উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এই প্রথমবার কাশী দেখতে যাচ্ছো তুমি, ব্যাঙ্কস বললে, কিন্তু আশা কোরো না যে এই পুরোনো শহরটিতে তিনশো বছরের পুরোনো স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখতে পাবে। কিংবা পাবে শুধুমাত্র নিদর্শনই। কিন্তু তাতে অবাক হয়ো না। কতবার যে আগুন আর তরবারি খেলা করেছে এই শহরে, তার ইয়ত্তা নেই। বিদেশীরা লুঠতরাজ করেছে, আগুন জ্বালিয়ে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। কিন্তু তাহলেও কাশী তোমার কাছে অদ্ভুত ঠেকবে, বলে রাখলুম। এ-রকম শহর তুমি আগে কখনও দ্যাখোনি।
নাপোলির নীল জলের মতো জল এখানকার। দূরে, নৌকো থেকেই তাকিয়ে দেখলুম, অদ্ভুত-সব বাড়িঘর জলের উপর ঝুঁকে আছে, একেবারে জলের থেকে উঠে গেছে কতগুলো বাড়ির সিঁড়ি। দেখতে পেলুম চৈনিক ধরনে নির্মিত একটি ভাঙাচোরা বুদ্ধমন্দির-গম্বুজ, বুরুজ আর মিনার-বসানো; দেখতে পেলুম মসজিদ আর মন্দির–মন্দিরের চুড়োয় শিবলিঙ্গ বসানো, মসজিদের গম্বুজে আরব্য লতাপাতার কাজ। ঘাটেঘাটে স্নানার্থীর ভিড় : অনেকটা যেন ফল্প নদীর স্নানের দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি।
অবশেষে আমাদের নৌকো মণিকর্ণিকা ঘাটে এসে থামলো। ঘাটের পাশে কত জ্বলন্ত চিতা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে; সেই চিতার আগুন আর ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে সন্তর্পণে এসে আমরা শহরে পা দিলুম।
সারাটা দিনই কেটে গেলো শহর দেখতে। দেখলুম শহরের বিরাট স্তম্ভ ও স্মৃতিমন্দিরগুলি, আরব্য বাজারের মতো অন্ধকার-ভরা ঘিঞ্জি দোকানবাড়ির সারি; সূক্ষ্ম মশলিন, রেশমি কিংখাব, জরি-করা রেশমি বসন— এই সবই এখানে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়; রাস্তাগুলি ঘিঞ্জি, আর দিনের বেলাতেও অন্ধকার—ধর্মের ষাঁড় ছাড়া কোনোদিন যে সূর্যের আলো এখানে এসে ঢোকে তা মনে হয় না। আর তারই মধ্যে দিয়ে বেহারারা হুম-হুম করে আমাদের পাল্কি বয়ে নিয়ে চললো। এই গরমে আমাদেরই কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু তাদের মুখে কোনো নালিশ নেই। তা তারা না-হয় পাল্কি বওয়ার জন্যে টাকা পাবে, কিন্তু যে-বাঙালিটি সেই থেকে ফেউয়ের মতো আমাদের পাছু নিয়েছে, তার ধূর্ত ও তীক্ষ্ণ্ণ চোখে আর যা-ই থাক, অর্থলাভের কোনো আশা নেই। সে কেন এমনভাবে অনুসরণ করছে . আমাদের? মণিকর্ণিকা ঘাটে যখন নামি, তখন আমি ব্যাঙ্কসের সঙ্গে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছিলুম, আর সেই সময় আমি হঠাৎ জোরে কর্নেল মানরোর নাম বলে ফেলি। এই বাঙালি লোকটা তখন ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলো–হঠাৎ মানরোর নাম শুনে সে যেন চমকে ওঠে। তখন আমি সেদিকে তেমন নজর দিইনি, কিন্তু এখন এই পাছু-নেয়া টিকটিকিটিকে দেখতে-দেখতে সেই কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। কে সে? আমাদের বন্ধু, না শত্রু? জানি না। শুধু এটুকু জানি মানরোর নাম শুনেই সে আমাদের পাছু নিয়েছে। আর তাইতেই মনে হয় সে আদৌ আমাদের বন্ধু নয়, দুশমন।
আমাদের পাল্কি তখন ঔরঙজীবের সেই মসজিদের কাছে গিয়ে থেমেছে–আগে এখানে নাকি ছিলো এক বিষ্ণুমন্দির, কিন্তু ঔরঙজীব সেই মন্দিরের ধ্বংসস্তৃপেই তার এই বিরাট মসজিদ রচনা করেছিলেন। মিনারের উপরে কাউকে উঠতে দেয়া হয় না, কারণ এর মধ্যেই দুটি মিনার পিসার স্তম্ভের মতো হেলে পড়েছে—কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা না-থাকলে যে-কোনো দিন ধ্বসে পড়তে পারে।
মসজিদের ভিতর থেকে বেরিয়েই আবার দেখি সেই বাঙালিটি বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নিলে। কিন্তু সন্দেহ আরো পাকা হবার আগে আমি ব্যাঙ্কসকে এ-বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলুম না।
বিশ্বেশ্বর মন্দির, মণিকর্ণিকা ঘাট, আকবরের তৈরি সেই বিখ্যাত মানমন্দির, বানরবহুল দুর্গাকুণ্ড—সব দেখে যখন আবার আমরা নৌকোয় উঠতে যাবে, তখন আবার দেখি সেই বাঙালিটি আমাদের পিছু-পিছু আসছে। সেও কি নৌকোয় করে ওপারে . যাবে নাকি? কোথায় আমাদের শিবির, তা-ই কি সে দেখতে চায়। ব্যাপারটা তো বড় গোলমেলে ঠেকছে।
ফিশফিশ করে বললুম, ব্যাঙ্কস, ও-লোকটা নিশ্চয়ই একটা টিকটিকি। সারা রাস্ত লোকটা শুধু আমাদের পিছু-পিছু এসেছে।
ব্যাঙ্কস বললে, আমিও তাকে লক্ষ করেছি; তুমি কর্নেলের নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা যে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিলো তা আমার নজর এড়ায়নি।
কিন্তু তাকে এড়াবার–
না, এ-সম্বন্ধে আমাদের কিছুই করার নেই। বরং আমরা যে তাকে সন্দেহ করেছি তা যেন ও জানতে না-পারে—আর তাছাড়া লোকটা তো এইমাত্র উধাও হয়ে গেলো।
ওই বাঙালিটির ছোট্ট ডিঙিটা ততক্ষণে সত্যি গঙ্গার অত নৌকো ও বজরার আড়ালে মিলিয়ে গিয়েছিলো। ব্যাঙ্কস আমাদের নৌকোর মাঝির দিকে ফিরলে; উদাসীনতার ভান করে বললে, ওই লোকটাকে তুমি চেনো?
না তো, এই তাকে প্রথম দেখতে পেলাম আমাদের মাঝি বললে।
রাত নেমে এলো আস্তে-আস্তে। নানা রঙের লণ্ঠন-জ্বলা নৌকোর সারি; মাঝিদের গলায় গান; বাম তীরে ঝলমল করে উঠলো হাউই, আতশবাজি ও রংমশাল : সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নের মতো মনে হলো বারাণসীর গঙ্গাকে। এই আশ্চর্য রঙের ঝরনা ক্ষণিকের জন্যে আলো করে তোলে কালো আকাশ, তারপর আবার অন্ধকার ছড়িয়ে যায় সবখানে।
শিবিরে ফিরে এসে দেখি কর্নেল মানরো আর সার্জেন্ট ম্যাক-নীল ততক্ষণে ফিরে এসেছেন। ব্যাঙ্কস ম্যাক-নীলকে জিগেস করলে তাদের অনুপস্থিতির সময় বিশেষ-কিছু হয়েছে কিনা।
না তো, উত্তর দিলে ম্যাক-নীল।
কোনো সন্দেহ-জাগানো লোককে আশপাশে ঘুরঘুর করতে দ্যাখোনি এখানে?
না। কেন, আপনি কি কোনো-কিছু আশঙ্কা করছেন নাকি
বারাণসীতে একটা লোক আমাদের পিছন নিয়েছিলো, বললে ব্যাঙ্কস, লোকটাকে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগেনি।
টিকটিকি? কোথাকার লোক সে?
লোকটা বাঙালি। কর্নেল মানরোর নাম শুনেই লোকটা আমাদের পাছু নেয়–
আমাদের সঙ্গে তার আবার কী দরকার? কী চায় সে?
জানি না, ম্যাক-নীল। তবে আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। কড়া নজর রাখতে হবে আশপাশে।
হুঁ! ম্যাক-নীল বললে, তাহলে তা-ই করবো।