১.০৫ মাকড়সার জাল

মাকড়সার জাল

যাঁর প্রতিবন্ধকতায় ডাঃ মুখার্জীর জামিন পাওয়া কোনোমতে সম্ভব হচ্ছিল না, তাঁর আকস্মিক অভাবনীয় মৃত্যুতে এতদিন পরে তা সম্ভব হল।

ডাঃ মুখার্জীর বৃদ্ধ পিতা তান্ত্রিক, কালীসাধক।

লোকে বলত, তিনি নাকি বলেছিলেন, যেমন করেই হোক কালীকে আবার আমি মুক্ত করেই আনব, আমার মা-কালীর সাধনা যদি সত্য হয়। সত্যিসত্যিই যদি আমি দীর্ঘ আঠারো  বছর একাগ্রচিত্তে মা-কালীর পূজা করে এসে থাকি, তবে এ জগতে কারও সাধ্য নেই আমার একমাত্র সন্তানকে আমার বুক থেকে এমনি করে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে।

তান্ত্রিক কালীসাধক পিতা ঘরের দুয়ার বন্ধ করে মা-কালীর সাধনা শুরু করলেন। মধ্যরাত্রে পাড়ার লোকেরা শুনত, তন্ত্রধারী কালীসাধকের পূর্ণ হোমের গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ। ভয়ে বুকের মধ্যে যেন সবার ছমছম করে উঠত!

গগন মুখার্জী যখন আকস্মিক অভাবনীয়রূপে ম্যানিজাইটিস হয়ে মাত্র তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, অনেকেই বলেছিল সেই সময়কালীসাধক তান্ত্রিক ডাঃ মুখার্জীর পিতা নাকি মৃত্যুবাণ চালিয়েছিলেন। অমোঘ সে মৃত্যুবাণ।

একবার কারও প্রতি নিক্ষিপ্ত হলে, সে নিক্ষিপ্ত বাণাঘাতে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। কারও সাধ্য নেই ধ্বংস হতে তাকে রক্ষা করে।

কিন্তু সে যাই হোক, এর পর আদালতে রায়পুরের বিখ্যাত হত্যা-মামলা শুরু হল। বর্তমান উপাখ্যানের সে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়।

আদালতে তিলধারণের স্থান নেই, অগণিত দর্শক। হত্যাপরাধে অন্যতম অভিযুক্ত আসামী, শহরের স্বনামধন্য প্রখ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী। তাছাড়া সেই সঙ্গে আছেন নিহত ছোট কুমারের জেষ্ঠ ভাই, রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক ও রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ অমিয় সোম।

বিচিত্র মামলার বিচিত্র আসামী!

একজন চিকিৎসক, যার পেশা মানুষের সেবা, যার হাতে নির্বিচারে মানুষ মানুষের অতি প্রিয় আপনার জনের মরণ-বাঁচনের সকল দায়িত্ব অকুণ্ঠিত চিত্তে নির্ভয়ে ও আশ্বাসে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। আর একজন একই পিতার সন্তান, একই রক্তধারা হতে জন্মেছে যে ভাই সেই ভাই। সত্যিই কি এক বিচিত্র নাটক!

পাবলিক প্রসিকিউটার গগন মুখার্জী যখন ডাঃ কালীপদ মুখার্জীর নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন, তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছিলেন, এ ভয়ংকর হত্যারহস্যের পিছনে আসল মেঘনাদই হচ্ছে শয়তানশিরোমণি চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী! সেই হচ্ছে আসল brain, তারই বুদ্ধিতেই এ হত্যার ব্যাপার ঘটেছে। অন্যান্য সবাই হত্যার ব্যাপারে instrument মাত্র! এও নিশ্চিত, সুহাসের শরীরে শত্রুতা করে Plague Bacilli inject করে দেওয়া হয়েছে কোনো উপায়ে এবং সেই উপায়ে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করবার যে বিচিত্র প্রচেষ্টা, তা একজন ডাক্তারের brain ছাড়া সাধারণ লোকের মাথায় আদপেই সম্ভবপর নয়। It is simply impossible for a common man-with a common ordinary brain. আরও ভেবে দেখবার বিষয়, ডাঃ রায় রোগী দেখে যখন সন্দেহ করেন তখন ডাঃ মুখার্জী কেন blood culture-এ বাধা দেন! এসব ছাড়াও গগন মুখার্জীর সরকারী মহলে ছিল অসাধারণ প্রতিপত্তি—তিনি বলেছিলেন, কোনো বিশেষ কারণবশতই বর্তমানে এ কেস্ সম্পর্কে যাবতীয় evidences তাঁকে গোপন করে রাখতে হচ্ছে। যা হোক তাঁর দুর্ভাগ্যবশত ও আসামীদের সৌভাগ্যবশতঃ, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে সব ওলটপালট হয়ে গেল, গোপনীয় দলিলপত্রের কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না—তবু মামলা চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রমাণিত হল, ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের দেহে Plague Bacilli inject করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গগন মুখার্জীর মৃত্যু হওয়ায় ডাঃ মুখার্জীর স্বপক্ষে নানাপ্রকার সাক্ষীসাবুদ খাড়া করে প্রমাণিত করা হল যে অতীতে পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য ডাঃ সুধীন চৌধুরীই সেদিন অর্থাৎ ৩১শে মে শিয়ালদহ স্টেশনে রায়পুর যাওয়ার সময় ছোট কুমারের দেহে অলক্ষ্যে প্লেগ ব্যাসিলাই inject করে দিয়েছিল।

তাছাড়া আরও একটা কথা, যে কলকাতা শহরে আজ আট-দশ বৎসরের মধ্যে একটি প্লেগ কেসও দেখা দেয়নি, সেখানে কারও প্লেগে মৃত্যু হওয়াটা সত্যিই কি বিশেষ সন্দেহজনক নয়? কোথা থেকে শরীরে তার প্লেগের বীজাণু এল? এই প্রকার সব সাত-পাঁচে ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।

যা হোক-ডাঃ মুখার্জীর বিপক্ষে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা গেল না। ডাঃ মুখার্জী ও সুবনিয় মল্লিক দুজনেই বেকসুর খালাস পেলেন আর হত্যাপরাধে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ হল ও তার মেডিকেল ডিগ্রী ও রেজিস্ট্রেশন বাজেয়াপ্ত করা হল। নাটকের উপর যবনিকাপাত হল।

কিন্তু আসল নাটকের শুরু কোথায়?

যবনিকাপাতের পূর্বে যে নাটকের মহড়া বসেছিল, তার মূল কোথায়?

হতভাগ্য ডাঃ সুধীনের মাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী নিজের শয়নকক্ষে এসে শয্যার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কাল রাত্রের সেই কথাই ভাবছিল।

এ কথা অবশ্যই অবধারিত সত্য যে, ছোট কুমারকে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করেই হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু আদালত স্থির করতে পারে নি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই এল কোথা থেকে? এবং এলই যদি, সেই প্লেগ ব্যাসিলাই কে আনলে এবং কেমন করেই বা আনলে!

কারণ একমাত্র সারা ভারতবর্ষে বম্বেতে প্লেগ ইনসটিটিউট আছে; সেখানে প্লেগ রোগ সম্পর্কে রিসার্চ করা হয়। সে রিসার্চ ইনসটিটিউট সম্পূর্ণরূপে গভর্ণমেন্টের কর্তৃত্বাধীনে। ইনসটিটিউটের কর্তৃপক্ষের আদেশ বা সম্মতি ব্যতীত সেখানে কারও প্রবেশ অসম্ভব। একমাত্র যারা সেখানে কর্মচারী ছাত্র বা ও-ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট তারা ভিন্ন সেখানে কারও প্রবেশও নিষেধ। তাছাড়া সেই ইনষ্টিটিউটের প্রতিটি জিনিসপত্রের চুলচেরা হিসাব প্রত্যহ রাখা হয় সুষ্ঠুভাবে, সেখান থেকে কোনো জিনিস ওখানকার কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে সরিয়ে আনা কেবল কঠিনই নয়,একপ্রকার অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু সুহাস মল্লিকের হত্যা যখন প্রমাণিত হয়েছে-আদালত ব্যাসিলাইয়ের প্রয়োগ ব্যতীত প্লেগ এবং প্লেগে মৃত্যুর যখন অন্য কোনো কারণ প্রমাণ করতে পারেনি; সে অবস্থায় একমাত্র বম্বের ইনসটিটিউটের ব্যাসিলাই ছাড়া প্লেগ কালচার অন্য কোথা হতেই বা সংগৃহীত হতে পারে? অবিশ্যি মামলার সময় বিভিন্ন বাদী ও প্রতিবাদীর জবানবন্দি থেকেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে একপ্রকার যে বম্বে থেকেই প্লেগবীজাণু আনা হয়েছিল। বাংলাদেশে আজ দীর্ঘকাল ধরে কোনো প্লেগ কেস হয়নি।

তাই চারিদিক বিবেচনা করে এইটাই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্লেগ ব্যাসিলাই আনা হয়েছে নিশ্চিত বম্বে হতে এবং তারই সাহায্যে এই দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে ষড়যন্ত্র করে।

অবিশ্যি মামলার সময় প্রমাণিত হয়নি সঠিকভাবে যে কেমন করে আনীত হয়েছে বম্বে হতে প্লেগ ব্যাসিলাই। শুধুমাত্র এইটুকুই প্রমাণিত হয়েছে যে, সুহাস মল্লিককে হত্যা করা হয়েছে প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেক্ট করে। কেননা মৃত্যুর পূর্বে তার রক্তের কালচার-রিপোর্ট থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এই গেল মামলার মূল প্রথম কথা।

দ্বিতীয় কথা : ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন সুহাসের হত্যা-মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হল বিচারে? অবিশ্যি গত ৩১শে মে রাত্রে শিয়ালদহ স্টেশনে যখন সুহাস মল্লিককে আততায়ী। (?) প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেকট করে (?), সেই সময় সুধীন সুহাসের একেবারে পাশটিতেই ছিল। এবং একমাত্র নাকি সেই কারণেই জজসাহেব ও জুরীদের বিচারে সুধীনের পক্ষে। সুহাসকে ঐ সময় প্লেগ ব্যাসিলাই ইনজেকট করা খুবই সম্ভবপর ছিল—যদিও সেটা প্রমাণিত হয়নি এবং এও প্রমাণিত হয়নি যদি তাই ঘটে থাকতো, কিভাবে সেই প্লেগ ব্যাসিলাই সুধীন ডাক্তার যোগাড় করেছিল। সুধীন ডাক্তারও বটে। এ ছাড়া মোটিভ বা উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে। একটা ছিল, যেমন প্রতিহিংসা। এবং প্রতিহিংসা যে নয় তাই বা কে বললে? পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোেধ প্রত্যক্ষে সন্তানের পক্ষেই নেওয়া স্বাভাবিক বলতে হবে। কিন্তু সুধীন ও সুহাসের পরস্পরের মধ্যে ইদানীং যে সৌহার্দ্য বা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, সেই দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে গেলে সুধীনের পক্ষে সুহাসকে ঐরকম নৃশংসভাবে হত্যা করাটা কি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়?

বিচারক ও জুরীদের মত, ডাঃ সুধীন চৌধুরী নাকি সময় ও সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয় ছিল এতদিন। এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করছে।….এও তাদের মত যে, পিতার হত্যার প্রতিশোধলিন্দু সুধীন অদূর ভবিষ্যতে যাতে করে অনায়াসেই অন্যের সন্দেহ বাঁচিয়ে সুহাসকে হত্যা করতে পারে, সেই জন্যই একটা লোক-দেখানো ঘনিষ্ঠতা বা সৌহার্দ্য সুহাসের সঙ্গে ইদানীং কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কিরীটী ভাবে, তাই যদি সত্যি হয়, তবে সুধীন প্রতিহিংসার পাত্র হিসাবে রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর অন্য সকলকে বাদ দিয়ে নিরীহ গোবেচারী সুহাসকেই বা বেছে নিল কেন? সুধীনের পিতাকে যখন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তখন সুহাসের তো মাত্র তিন বৎসর বয়স। এবং তার সেই শিশুবয়েসে আর যাইহোক সেদিনকার সেই নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনোক্রমেই জড়িত থাকাটা তো সম্ভবপর নয়—সেদিক দিয়ে তাকেই প্রতিশোধের পাত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হল কেন?

তবে যদি এই হয় যে, রাজগোষ্ঠীর একজনকে কোনোমতে হত্যা করতে পারলেই তার পিতার প্রতিশোধটা অন্তত নেওয়া হয়, সেটা অবশ্য অন্য কথা। কারণ মানুষের সত্যিকারের মনের কথা বোঝা শুধু অসম্ভবই নয়, একেবারে হাস্যকর বলেই মনে হবে।

তারপর একটু আগে শোনা সুধীনের মার মুখে সেই সুধীনের পিতার অতীতের নৃশংস হত্যাকাহিনী, সেও শুধু একমাত্র সুধীনের পিতার হত্যাই নয়, তার আগে শ্রীকণ্ঠ মল্লিককেও তো হত্যা করা হয়েছিল একই ভাবে এবং একই স্থানে! আগাগোড়া সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমগ্র কাহিনীটি বিবেচনা করে দেখতে গেলে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত হয়ত বা দেখা যাবে, সব কিছুই একই সূত্রে গাঁথা।

অবিশ্যি এও হতে পারে, শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক ও সুধীনের পিতার হত্যা-ব্যাপারে সুহাসের হত্যা-রহস্য হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো যোগসূত্ৰই নেই।

কিরীটীর মনের মধ্যে নানা চিন্তা এলোমেলো ভাবে যেন একটার পর একটা আনাগোনা করতে থাকে। এ যেন মাকড়সার জাল, কোথায় শেষ কে জানে! যেমন অসংবদ্ধ তেমনি জটিল।

ইতিমধ্যে কখন একসময় প্রথম ভোরের আলো শীতরাত্রির অবসান ঘটিয়েছে, তা কিরীটী টেরও পায়নি।

প্রভাতের ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া খোলা বাতায়নপথে এসে জাগরণক্লান্ত কিরীটীর চোখেমুখে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।

আর ঘুমের আশা নেই। কিরীটী শয্যা থেকে উঠে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়।

রাস্তার ধারের কৃষ্ণচূড়ার গাছটার পত্রবহুল শীর্ষ ছুঁয়ে ভোরের শুকতারা তখনও জেগে আছে দেখা যায়।

কিরীটী চিন্তা করতে থাকে, এখন কি কর্তব্য? কোন্ পথে কোন্ সূত্র ধরে এখন সে। অগ্রসর হবে? তবে এটা ঠিক, অগ্রসর হতে হলে আগাগোড়া আবার সমস্ত মামলাটাকেই তীক্ষ্ণ বিচার দিয়ে গোড়া হতে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আর তাই যদি হয়, এ-ব্যাপারে বর্তমানে যিনি তাকে সত্যি সাহায্য করতে পারেন, তিনি হচ্ছেন জাস্টিস্ মৈত্র। হ্যাঁ ঠিক, জাস্টিস্। মৈত্র!

আর বৃথা সময়ক্ষেপ না করে সোজা কিরীটী ঘরের কোণে ত্রিপয়ের উপর রক্ষিত ফোনটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফোনের রিসিভার তুলে নেয়—Put me to B. B…please!

একটু পরেই ফোনের ওপাশ থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, Yes!

কে, সুব্রত? আমি কিরীটী কথা বলছি। হ্যাঁ, এখুনি একবার আমার এখানে চলে আসতে পারিস? কি বললি—হ্যাঁ, খুব দরকারী কাজ। অ্যা—হ্যাঁ—আরে আয়ই না, সব শুনবি। এখানেই চা হবে, বুঝলি?

সারাটা রাত্রি জেগে চোখমুখ জ্বালা করছে।

কিরীটী অতঃপর স্নানের ঘরে ঢুকে ভিতর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

ঠাণ্ডা জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে জাগরণক্লান্ত শরীরটা যেন জুড়িয়ে স্নিগ্ধ হয়ে গেল। বড় টার্কিস তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে ঘরে এসে ঢুকতেই দেখলে, সুব্রত ইতিমধ্যেই কখন এসে ঘরের মধ্যে একখানি সোফা অধিকার করে সেদিনকার প্রাত্যহিক সংবাদপত্রটা খুলে। বসে আছে।

কি ব্যাপার রে? হঠাৎ এত জরুরী তলব? কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সুব্রত মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে।

বোস, আমি চট করে জামাকাপড়টা ছেড়ে আসি।

প্রায় আধঘণ্টা পরে এসে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করল, পরিধানে নেভি-র সার্জের লং প্যান্ট, গায়ে হাতকাটা স্ট্রাইপ দেওয়া গরম সার্ট। মুখে পাইপ।

কৃষ্ণা ইতিমধ্যে ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে গেছে, সুতর সামনে ধূমায়িত চায়ের কাপ। পাশে বসে কৃষ্ণা।

কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতর পাশ ঘেঁষে সোফার ওপরে বসে পড়ল। কৃষ্ণা হাত বাড়িয়ে কাপের মধ্যে দুধ চিনি ঢেলে টি-পট থেকে চা ঢালতে লাগল।

তারপর, হঠাৎ এত জরুরী তলব কেন?

কিরীটী কোনো মাত্র ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করে, জানিস, রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যা-মামলায় দণ্ডিত অপরাধী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর মা গতরাত্রে তোরা সব চলে যাওয়ার পর এসেছিলেন এখানে আমার কাছে!

কৃষ্ণা বললে, কাল রাত্রে কখন?

কিরীটী বললে, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, তোমায় জাগাইনি–

সুব্রতও কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়, বলে, সত্যি? তা হঠাৎ তাঁর তোর এখানে আসার কারণ? মামলার তো রায় বেরিয়ে গেছে! নাটকের পরে তো যবনিকাপাত হয়ে গেছে!

তা হয়েছে, তবে দেখলাম তাঁর ও আমার মতটা প্রায় একই, মামলার একটা লোক-দেখানো সমাপ্তি ঘটলেও আসলে এখনও অনেক কিছুই অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, সে এক কাহিনী।

বুঝলাম। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি বল তো?

আসল ব্যাপারের জন্যই তো এই এত সক্কালেই তোকে ডাকতে হল। কিরীটী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদুভাবে বলে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

কিরীটী তখন গতরাত্রের সমস্ত কথা যথাসম্ভব বিশদভাবে সুব্রতকে বলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে।

হুঁ—তাহলে তুই কেসটা হাতে নিলি বল?

হ্যাঁ—উপায় ছিল না।

কিন্তু

যতদূর মনে হয় ডাঃ সুধীন চৌধুরী নিদোষ। অবিশ্যি যদি আমার বিচারে ভুল না হয়ে থাকে।

তা যেন হল, কিন্তু আইনের চোখে যে একবার দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাগারে গিয়ে ঢুকেছে, তাকে মুক্ত করা ব্যাপারটা কি খুব সহজ হবে বলে ভাবিস তুই?

তার নির্দেষিতা প্রমাণ করতে পারলে কেসটা রি-ওপেন করা হয়তো কঠিন হবে বলে মনে হয় না। শোন্এখন তোকে আমার একান্ত প্রয়োজন, যার জন্য তোকে এত সকালে তাড়াহুড়ো করে টেনে নিয়ে এলাম। এই মামলার বিচারক ছিলেন জাস্টিস্ মৈত্র। তাঁর সঙ্গে আমার কিছুটা আলাপ-পরিচয় আছে, তোকে এখুনি একটিবার ল্যান্সডাউন রোডে জাস্টিস মৈত্রের ওখানে আমার একটা চিঠি নিয়ে যেতে হবে। রায়পুরের মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষের সমস্ত সাক্ষীসাবুদের প্রসিডিংসগুলো পড়ে যথাসম্ভব নোট করে আনবি, যেমন যেমন প্রয়োজন বুঝবি। আমাদের এখন শুরু করতে হবে শেষ থেকে। শেষের দিক থেকে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে আমরা গোড়ার দিকে যাব এগিয়ে।

বেশ। তাহলে আমি উঠি, তুই চিঠিটা লিখে ফেল্।  

তুই বোস্ একটু, চিঠিটা এখুনি আমি লিখে দিচ্ছি।

কিরীটী সোফা থেকে উঠে রাইটিং টেবিলের সামনে বসে তার লেটার প্যাডে একটা চিঠি লিখে খামে এঁটে সুব্রতর হাতে এনে দিল, এই নে।