১.০৫ ফল্গুনদীর তীর্থযাত্রী
এখন যাকে বিহার বলে, আগে তার নাম ছিলো মগধ। বৌদ্ধ ধর্মের উজ্জ্বল দিনে মগধ ছিলো দিব্যভূমি, এখনও বহু মঠ আর বিহার তার সাক্ষী। তারা বানিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিহার; দেশবিদেশ থেকে সবাই পড়তে আসতো; জাতপাতের ভেদ ছিলো না। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের জায়গা নিয়েছে ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ; তারা বানিয়েছে টোল, চতুম্পাঠী, সেখানে সবাই নয়—অধ্যয়নের অধিকার শুধু ব্রাহ্মণদের। গঙ্গাস্নান, জগন্নাথ মন্দিরের উৎসব, কাশীযাত্রা—এইসব পূণ্যকর্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানেও নানা অনুষ্ঠান হয়।
আমাদের বাষ্পেচলা বাড়ি (ওরফে বেহেমথ) এখন বিহারে এসে পড়েছে। প্রচণ্ড গরম; তপ্ত হাওয়া জানলার বাইরে স্বচ্ছ শিখার মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে; কখন আষাঢ় আসবে, সেই স্বপ্নে বুক বেঁধে পড়ে থাকে মাঠঘাটপ্রান্তর, মোহ্যমান মানুষজন।
১৯ শে মে দুপুরবেলায় আমরা চিত্রা শহর ছাড়লুম, আর পরদিন রাত্রে এসে পৌঁছুলুম গয়ার কাছে—সারাদিন দুর্দান্ত গরম গেছে, তাপমান যন্ত্রে ১০৬ ডিগ্রিও পেরিয়ে গিয়েছিলো, তাই আমরা নদীর ধার দেখে ছায়ায়-হাওয়ায় আস্তানা করলুম। নদীটির নাম ফল্প; গঙ্গার মতো ফল্গু নদীতেও সবসময় পুণ্যার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে।
শহর থেকে মাইল দু-এক দূরে গাছপালার ভিড়ের মধ্যে আমাদের বাড়ি দুটো, থুড়ি, গাড়ি দুটো, থামানো হয়েছিলো। সেখানে তারপর সারা দিন বিশ্রাম। পরদিন সকালে চারটে নাগাদ আমরা গয়া শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লুম-দুপুরবেলার রোদের তাতের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যেই এত ভোরে বেরিয়ে পড়েছিলুম আমরা-আমরা, মানে ব্যাঙ্কস, ক্যাপ্টেন হুড আর আমি। কর্নেল মানরো বেহেমথেই থেকে গেলেন।
গয়া হিন্দুদের খুব নামজাদা তীর্থস্থান; রাস্তায়-ঘাটে পুণ্যার্থীদের ভিড়ে চলার উপায় নেই, সারা বছরই এমনি মারাত্মক ভিড় থাকে এখানে। তবু এরই মধ্যে দিয়ে কোনোমতে পথ করে নিয়ে আমরা গিয়ে একে-একে বোধিম, বিষ্ণুমন্দির ও আবো-সব দ্রষ্টব্য স্থান দেখে এলুম। লোকজনের ভিড়ে কোনোখানেই তিষ্ঠোবার জো নেই। অবশেষে সব দেখেশুনে আমরা এলুম ফল্লু নদীর তীরে, যেখানে নদীর জলে গয়ার পাথর ধুয়ে যাচ্ছে। সেখানে যা ভিড় তা অবর্ণনীয় : নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, চাষী-জমিদার, শৌখিন বাবু আর গরিব রায়, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, পারিয়া, ব্রাহ্মণ, সবল রাজপুত, কাহিল বাঙালি, জোয়ান পঞ্জাবি আর সুদর্শন সিন্ধি-কেউ পাল্কিতে, কেউ বলদে-টানা গাড়িতে, কেউ উটের পিঠে এসে এখানে হাজির হয়েছে। ভারতের কোনো অঞ্চল বাদ পড়েনি। তাবু ফেলেছে কেউ, কেউ ডালপালা দিয়ে কুটির বানিয়ে নিয়েছে, কেউ-বা তার গাড়ির ভিতরেই আশ্রয় নেবে দরকার হলে।
উঃ, কী ভিড়। হুড বলে উঠলো।
আজ আর ফল্গু নদীর জল খাওয়া যাবে না, ব্যাঙ্কস সব দেখে-শুনে মন্তব্য করলে।
জিগেস করলুম, কেন?
কারণ এর জলকে পবিত্র বলে মনে করে হিন্দুরা—দলে-দলে গিয়ে এরা আজ স্নান করবে; আর কাদা করবে সবখানে, টলটলে জলও ঘোলা করে দেবে; গঙ্গায় যেমন করতো। কলকাতায় দ্যাখোনি?
আমরা কি ভাটির দিকে নাকি? আমাদের ডেরার দিকে আঙুল দেখিয়ে হুড আঁৎকে ওঠার ভঙ্গিতে বললে।
না, না, তার কাচুমাচু ভঙ্গিতে ব্যাঙ্কস হেসে উঠলো, আমরা অনেক উপরে রয়েছি–ঘোলাজল ওখানে পৌঁছুবে কী করে?
এই ভিড়ের মধ্য দিয়েই আমরা অতি কষ্টে এগিয়ে চললুম। ছাই-মাখা সাধু, নগ্ন সন্ন্যাসী, আলখাল্লা-ঢাকা ফকির, ভাং খেয়ে বুদ-হয়ে থাকা ভক্ত-দেখে আমার বিস্ময়ের আর শেষ থাকে না। কোথাও দেখলুম শিবের ভক্তরা তীর দিয়ে হাত-পা বিধছে ক্রমাগত, আর সেই হাত-পা দিয়ে বেরুনো রক্ত জিভ দিয়ে চেটে খাচ্ছে বিষাক্ত সাপেরা। দেখে আমার বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেলো। নিশ্বাস রোধ হয়ে আসে প্রায়। তাড়াহুড়ো করে চলে আসবো, ব্যাঙ্কস আমাকে হাত ধরে থামালে যাচ্ছো কোথায়? পুজোর সময় হলো—দেখে যাই!
তার কথা শেষ হবার আগেই ভিড়ের মধ্যে এক ব্রাহ্মণের আবির্ভাব হলো, ডান হাত তুলে সে বাড়িয়ে ধরলো উদয়সূর্যের দিকে, আর প্রথম আলোকরেখা বেরিয়ে এলো গয়ার মস্ত শিলাতলের উপর থেকে। সেটাই বুঝি সংকেত ছিলো, অমনি দলে-দলে নরনারী পুণ্য জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। সমবেত মন্ত্রোচ্চারণের কোলাহল উঠলো ফল্গু নদী থেকে, আর তারই মধ্যে স্নানার্থীরা দিব্য জলে যেন এই মরদেহ ও অমর আত্মা ধুয়ে-মুছে দেবতার সান্নিধ্যের জন্য তৈরি হয়ে নিলে। কারণ জল থেকে উঠেই তারা কৈলাসে যাবে দেবসন্নিধানে।
আমরা আর দেরি না-করে আমাদের আস্তানায় ফিরে এলুম। ছোটোহাজরি তৈরি ছিলো : খাবার টেবিলে বসে আমরা এই কল্পনাতীত দৃশ্যের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলুম। ইতিমধ্যে রোদের তেজ বাড়তে লাগলো ক্রমশ, আর চারপাশ যেন এই গরমে ধুকতে লাগলো। যেন আমাদের সব ইন্দ্রিয়কে ভোতা ও নিস্তেজ করে সূর্যের প্রখর রথের চাকা চলে গেলো আমাদের উপর দিয়ে।
সারাদিনে আর-কোনো ঘটনাই ঘটলো না। পরদিন সকালে রওনা হবো বলে ঠিক ছিলো, তাই স্টর, কালু আর গৌমি জ্বালানি আর জলের ব্যবস্থা করতে বেরিয়েছিলো সন্ধেবেলায়। তারা সব ব্যবস্থা করে ফিরে এলো।
দিনের বেলা আবহাওয়া ছিলো শুকনো, কিন্তু রাতের বেলা ছেড়া-ছেড়া মেঘ ঝুলে রইলো আকাশে, আর্দ্রতা এত বেড়ে গেলো যে ঘেমে-নেয়ে আমাদের কষ্ট যেন শতগুণ বেড়ে গেলো। রাত নটার সময়েই আমরা আচ্ছন্নের মতো গিয়ে শুয়ে পড়লুম—সব কেমন যেন ঝিম ধরা অথচ তবু কিন্তু ঘুম আসছিল না।
হঠাৎ রাত একটা নাগাদ দূরাগত মর্মর শুনতে পেলুম আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে। ভাবলুম, বুঝি বৃষ্টি হবে, তাই বজ্রবিদ্যুতের আনাগোনা শুরু হলো। কিন্তু তা তো নয়। গাছের একটা পাতাও কাপছে না, সব থম মেরে আছে, হাওয়া মোটেই নেই। উঠে আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালুম। অন্ধকার—কিছুই দেখা যাচ্ছে না—অথচ সেই দূরাগত ধ্বনি তখনও কানে আসছে। ফল্প নদীর জল শান্ত নিস্তরঙ্গ; আকাশে বজ্রবিদ্যুতের কোনো চিহ্ন নেই। কীসের শব্দ তাহলে এটা? বুঝতে পারলুম না। কিন্তু অবসাদে তখন এমন অবস্থা যে বাইরে বেরিয়ে ভালো করে সন্ধান করার মতো মনোবল নেই। আমি আচ্ছন্নের মতো চুলতে লাগলুম-এবং মাঝে-মাঝে তার ভিতর কেবল সেই রহস্যময় আওয়াজ কানে আসতে লাগলো, আর-কিছুই না।
ঘণ্টা দুয়েক পর অন্ধকার যখন ফিকে হয়ে আসছে, তখন হঠাৎ আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। বাইরে বারান্দা থেকে কে যেন এঞ্জিনিয়ারকে ভাক দিচ্ছে : মিস্টার ব্যাঙ্কস!
কী চাই?
আপনি দয়া করে একবার বাইরে আসবেন? স্টরের গলা।
আমি গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালুম। কর্নেল মানরো বারান্দাতেই ছিলেন, হডও পরক্ষণে এসে হাজির।
কী ব্যাপার? ব্যাঙ্কস জিগেস করলে।
একবার কেবল তাকিয়ে দেখুন ওদিকে, স্টর বললে।
তখন এতটা আলো হয়েছে যে নদীর পাড় আর সামনের রাস্তা আবছা মতো দেখা যায়। তাকিয়ে দেখি কয়েকশো সাধু-সন্ন্যাসী রাস্তার উপর শুয়ে আছে।
এরা তো কালকের সেই তীর্থযাত্রী দেখছি! হুড বললে।
জিগেস করলুম, কিন্তু এরা এখানে কী করছে?
হয়তো সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করছে-তারপর সূর্যের পুজো করবে আর-কি! বললে হুড।
উঁহু, আমার তা মনে হয় না, বললে ব্যাঙ্কস, তাই যদি উদ্দেশ্য হবে তো গয়া ছেড়ে অ্যাম্বুরে এখানে আসবে কেন? আমার ঘোরতর সন্দেহ হয় যে তারা এখানে এসেছে
বেহেমথকে দেখতে, বাধা দিয়ে বললে হুড, কারণ বেহেমথ যথারীতি তাজ্জব করে দিয়েছে তাদের। তারা হয়ত শুনেছে যে মস্ত একটা হাতি-অতিকায় এক হাতি–এত-বড়ো যে কেউ কোনোদিন অমনটি দ্যাখেনি—এসেছে এখানে, তাই তারা হাতিটাকে তারিফ করতে এসেছে।
ব্যাঙ্কস মাথা নাড়লে, তারিফ করতে এসে থাকলেই সবদিক থেকে মঙ্গল!
কেন? আবার কীসের ভয় জিগেস করলেন মানরো।
হয়তো রাস্তা আটকে বসবে এরা—কে জানে!
যা-ই করো, অতি সাবধানে। খুব হুঁশিয়ার! এ-সব সাধু-সন্ন্যাসীর গায়ে যেন আঁচড়টি নালাগে!
কালু! ব্যাঙ্কস হাঁক পাড়লে, আগুন জ্বেলেছো?
হ্যাঁ, সাহেব!
ভালো করে স্টীম চাপিয়ে দাও।
তখন সাড়ে-তিনটে বাজে। ক্রমশ পুবদিক আলো হয়ে উঠছে। বেহেমথের শুঁড় থেকে পেঁচিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে, মাঝে-মাঝে গর্জন করে উঠছে বেহেমথ। কিন্তু সমবেত জনতা তাকে কিংবদন্তির ঐরাবত বলেই মেনে নিলে। দলে-দলে এগিয়ে আসতে লাগলো তারা সামনে কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সম্ভ্রমের সঙ্গে—আর এসে, হাতির পায়ের সামনে দণ্ডবৎ হয়ে পড়ে রইলো।
চারটের সময় পুরো স্টীম পাওয়া গেলো, থরথর করে কাঁপতে লাগলো বেহেমথ। ব্যাঙ্কস নিজেই স্টরের সঙ্গে হাওদায় গিয়ে বসলে। সে নিজেই চালাবে বেহেমথকে। বারান্দা থেকে মানরো চেঁচিয়ে উঠলেন, সাবধান, ব্যাঙ্কস; এদের গায়ে যেন আঁচড়টিও না-লাগে।
উত্তরে বেহেমথ তীক্ষ্ণ্ণ স্বরে শিটি দিলে, আর তারও উত্তরে সেই বিপুল ভিড় সমস্বরে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে উঠলো।
পথ ছেড়ে দাও, পথ ছেড়ে দাও! ব্যাঙ্কস চেঁচিয়ে বললে। চাকাগুলো অর্ধেক ঘুরে এলো, বেহেমথের শুঁড় দিয়ে এক ঝলক শাদা ধোঁয়া বেরিয়ে এলো। মুহুর্তে ভিড় দু-ভাগ হয়ে গেলো! বেহেমথ কয়েক পা এগিয়ে গেলো।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলুম, সাবধান ব্যাঙ্কস, দেখে-বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে পেলুম জনা দশ-বারো বিষম ভক্ত রাস্তায় শুয়ে পড়েছে চিৎপাত হয়ে-উদ্দেশ্য এই অতিকায় শকটের চাকার তলায় পিষে-যাওয়া।
মানরা চেঁচিয়ে তাদের বললেন, সরো-সবো, সরে দাঁড়াও!
কী আহাম্মক এগুলো! বেহেমথকে কি এরা জগন্নাথের রথ পেয়েছে যে দেবতার রথের তলায় মরে গিয়ে স্বর্গে যেতে চায়, হুড রেগে উঠলো!
ব্যাঙ্কসের ইঙ্গিতে কালু স্টীম বন্ধ করে দিলে। সেই ভক্তরা যে ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠবে কোনো কালে, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। এদিকে ভিড় তাদের চেঁচিয়ে খুব উৎসাহ দিচ্ছে শুয়ে থাকতে! ব্যাঙ্কস কিরকম বিমূঢ়, লজ্জিত আর অসহায় বোধ করলে।
হঠাৎ কী-একটা ফন্দি খেলে গেলো তার মাথায়। বয়লারের তলায় যে কতগুলো পাইপ ছিলো, তা দিয়ে হুঁশহুঁশ করে স্টীম ছেড়ে দিলে সে তাদের লক্ষ্য করে, আর সেই সঙ্গে বাঁশির তীক্ষ্ণ্ণ ধাতব শব্দ বারেবারে জনতার কোলাহল চিরে দিলে।
এটাই কিন্তু কাজে লাগলো। গরম বাষ্প পিচকিরির মতো গায়ে পড়তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো তারা চাচাতে-চাচাতে। রথের তলায় চাপা পড়তে কোনো ভয় নেই তাদের, কিন্তু এ-রকমভাবে মিছেমিছি ঝলশে আধপোড়া হয়ে যেতে চায়নি তো তারা।
ভিড় সরে দাঁড়ালো, বেহেমথ এগিয়ে গেলো কয়েক পা, তারপর রাস্তা ফাঁকা দেখে বাম্পের মেঝের মধ্য দিয়ে সেই স্তম্ভিত জনতার চোখের সামনে থেকে বেহেমথ কোন দূরে মিলিয়ে গেলো।