৪. ল্যক্সপানসিয়ন ফ্রাঁসেঈ থেকে একটি নিবন্ধ
ল্যক্সপান্সিয়ন ফ্রাসেঈ-র পাঠকরা পয়লা জানুয়ারি দিব্বি চেখেছিলেন নিচের নিবন্ধটা। বেশ বড়ো-বড়ো হরফে শোভা পেয়েছে তার শিরোনাম, আর নিবন্ধটি নিঃসৃত হয়েছে কোনো-এক কল্পনাবিলাসী উদ্ভট লেখনী থেকেই—যা দূরের, তাকে নিয়ে কল্পনা কত খেলাই যে খেলতে পারে!- ল্যক্সপান্সিয়ন ফ্রাঁসেঈ-র নিজস্ব সংবাদদাতা, মঁসিয় আমাদে ফ্লরেঁস-এর অনুরক্ত পাঠকেরা নিশ্চয়ই সাগ্রহেই ক্ষমা ক’রে দেবেন তাঁদের চিরচেনা লিখনভঙ্গিমাকে :
বারজাক মিশন
[ নিজস্ব সংবাদদাতার কলম থেকে ]
জঙ্গলের মধ্যে, পয়লা-ডিসেম্বর। আগেই জানিয়েছিলুম যে বারজাক মিশন আজ সকাল ছ-টার সময় রওনা হ’য়ে পড়বে। কাঁটায়-কাঁটায় ছটার সময় আমরা সবাই তৈরিই ছিলুম, যে-দুজন স্বেচ্ছাসেবী আমাদের আটজন সদস্যের সঙ্গে এসে সদ্য যোগ দিয়েছে তারা শুদ্ধু, বাকিদের তো আমরা চিনিই, আমলাবাজ এবং ফোঁপরদালাল। কাউকেই তা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতেও দেখি না! স্বেচ্ছাসেবীদের একজন মুণ্ডু-ঘুরিয়ে-দেয়া রূপসী, এক ফরাশিনি কিন্তু ইংলণ্ডে আদবকায়দা লেখাপড়া রপ্ত করেছেন, আর তার ফলে তাঁর ফরাশিতে অ্যাদ্দিনে ক্ষীণ-একটু বিদেশী ঝোঁক লেগেছে। মাদমোয়াজেল জেন মোর্নাস, তাঁর নাম। অন্য স্বেচ্ছাসেবীটি তাঁরই মাতুল, যদি-না তিনি তাঁর বোন-পো হন—কেননা আপাতত এঁদের আত্মীয়তাসম্বন্ধের জট পাকানো ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনোই দরকার দেখি না, এবং তাঁর নাম—অজেনর দ্য সাঁৎ-বেরা। একটু ছিটই আছে তাঁর মাথায়, চূড়ান্ত খামখেয়ালি, এর মধ্যেই কোনোক্রিতে সবাই তাঁকে একডাকে চিনে গিয়েছে, আশা করি তিনি আমাদের যৎকিঞ্চিৎ আমোদ জোগাবেন।
মাদমোয়াজেল মোর্নাস আর মঁসিয়া দ্য সাঁৎ-বেরা প্রমোদভ্রমণে বেরিয়েছেন। এবং আমারই প্রমাদ হবে, যদি এটা কবুল না-করি যে তাতে হয়তো আমাদেরও কিঞ্চিৎ প্রমোদ হবে। তাঁরা সঙ্গে এনেছেন কৃষ্ণাঙ্গ দুই অনুচর, আগে সেনেগলে দোভাষীর কাজ করতো, তবে তারা দোভাষী নয়, পথ দেখিয়েই নিয়ে যাবে, কেননা আমাদের এই দুই বিশ্বপর্যটক শুধু-যে যথেষ্ট বাম্বারাই জানেন তা নয়, এখানকার কোনো-কোনো উপভাষাতেও বেশ সড়গড়। মাদমোয়াজেল মোরনাস ইনিতিয়ে (সুপ্রভাত) ব’লে মধুর ভাবে যখন সম্ভাষণ করেন…কিন্তু এ নিয়ে অধিক বাক্যব্যয় করার কোনোই দরকার নেই। মঁসিয় বারজাক তো দেখা হ’লেই এখন ইনিতিযে ব’লে শুরু করেন, তবে তাঁর মুখে সম্ভাষণটা সে-রকম মধুর শোনায় না।
তো, আজ সকালে, পয়লা ডিসেম্বর, ভোর সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ, এই-যে, আমরা এসে জড়ো হয়েছি কোনোক্রির বড়োচটায়, রাজভবনের সামনে।
আগেই জানিয়েছি, মঁসিয় বারজাক এক নির্বিরোধী, একান্তভাবেই বেসরকারি চালে, অভিযান চালাতে চাচ্ছিলেন। সংসদে যেমন আশাবাদী ব’লে তাঁর নাম, এখানেও সেই সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে চাচ্ছেন; তাঁর ধারণা একগুচ্ছ জলপাই- পল্লব নিয়ে তিনি জনতার সামনে আবির্ভূত হ’লেই, সবাই একেবারে বিগলিত হ’য়ে যাবে; নাইজার নদীর তীর ধ’রে কোনোক্রি থেকে কোতোনু যাওয়ার এই ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিপাকশক্তি বজায় রাখার মতো হন্টন যেন। এটা অবশ্য মাদমোয়াজেল মোরনাসেরও ধারণা, তাঁর মনে হয় বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আস্ফালন করতে-করতে গেলে স্থানীয় অধিবাসীরা বিষম ক্ষুদ্ধ হ’য়ে যেতে পারে-এবং সেটা আদপেই অভিপ্রেত নয়।
তবে বারজাক-মোর্নাস সংঘটি ব্রোদ্রিয়ের সংঘের দেয়ালে এসে মাথা ঠুকেছে। মিশনের এই সহযোগী-কর্তাটি—তাঁর মুখে কেউ কোনোদিন বোধহয় অস্ফুট- কোনো হাসির রেখাও দ্যাখেনি- যতদূর সম্ভব কালো ক’রেই এঁকেছেন, কী-কী বিপদ-আপদ পথে আমাদের জন্যে ওঁৎ পেতে আছে। ফরাশি সংসদের দুই মাতব্বরের নেতৃত্বে আরব্ধ এই মিশনের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি অতিসচেতন, তাঁর ধারণা আস্ত-একটা ফৌজ সঙ্গে নিয়ে গেলে আমাদের মানসম্মান বাড়বে বৈ কমবে না। আর বিস্ময়ের পরে বিস্ময়, খোদ বড়োলাটসায়েব মঁসিয় বালদোন তাঁর মতেই সায় দিয়েছেন।
এ নিয়ে কোনো তর্ক তুলছি না : হয়তো সত্যিই ফরাশি অনুপ্রবেশের ফলে এই কালোদের দেশে অন্তর্কলহ খানিকটা কব্জায় আনা গেছে! উপনিবেশ দফতরের মন্ত্রী যা বলেন বড়োলাট বা দোনও তা তোতাপাখির মতো আওড়ান। মঁসিয় বাল্দোন সেদিন বলেছেন, কতগুলো রহস্যময় তথ্য তাঁর গোচরে এসেছে- রহস্যময় এইজন্যে তার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা তাঁর মালুম নেই—যাতে ভয় হয় কোথাও-কোথাও হয়তো বিদ্রোহের বীজ বোনা হচ্ছে। গত দশ বছর ধ’রে— এবং সম্প্রতি না কি প্রকোপটা বেড়েছে-নাইজারের তীরে স্যা থেকে দজেন অব্দি বিস্তীর্ণ অঞ্চলটায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় ক’রে লোকজন সব আকস্মিভাবে পালিয়ে যাচ্ছে—গ্রামগুলো প’ড়ে থাকছে ভুতুড়ে -পরিত্যক্ত আর ফাঁকা, আর লোক যে কোথাও উধাও হ’য়ে যাচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ দূরের কথা, গোয়েন্দা দফতরও জানে না। তারই পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রাম থচনছ ক’রে লুঠতরাজ চলেছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘরবাড়িখামার, আর কারা যে সে-সব করছে, তাও নাকি কেউই জানে না। গুজবগুলোর উৎপত্তি বা প্রভাব যা-ই হোক না কেন, ছায়ার মধ্যে বেয়াড়ারকম কিছু-একটা যে ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে তাতে নাকি কারুই কোনো সন্দেহ নাই।
অতএব প্রাথমিক সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েই বারজাক মিশন বাধ্য হয়েছে সঙ্গে সশস্ত্র একদল সেপাইশাস্ত্রী নিয়ে অভিযানে বেরুতে। মঁসিয় বোদ্রিয়েরের পাকাহাড়ে সুবাতাস লেগেছে এতে, আর মঁসিয় বারজাককে অগ্যত্যা মেনে নিতে হয়েছে কাপ্তেন মার্সেনে এবং তাঁর দুশো ঘোড়শোয়ারের রক্ষাকবচ।
ছটার সময়, সবকিছু তৈরি। সারিটার গোড়ায় আছে একজন কালো, সে নাকি আগেই কতবার কোনোক্রি থেকে সিকাসো যাতায়াত করেছে, অঞ্চলটা তার কাছে নিজের হাতের চেটোর মতোই জানা ব’লে সে-ই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ব’লে ঠিক হয়েছে। তার বয়েস তিরিশ, স্বাস্থ্যবান, আগে ছিলো দুগুকুলদিগুই অর্থাৎ রাজ্যপালের কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের একজন। লংক্লথের আঁটো ব্রীচেস তার পরনে, আর ঔপনিবেশিক পদাতিক বাহিনীর ছেঁড়া একটা উর্দি তার পরনে, এতই পুরোনো যে ডোরাগুলো নোংরা হ’য়ে রং পালটেছে। খালি-পা হ’লে কী হবে, তার মাথা ঢেকে রেখেছে কাপড়ের টুপি, এককালে শাদার ওপর তাতে তিনরঙের ঝিলিক ছিলো। তার প্রতাপের সাক্ষী তার হাতের মোটা একটা গদা, তাই দিয়েই সে নাকি তল্পিবাহকদের সবকিছু বুঝিয়ে দিতে পারবে।
ঠিক তার পরেই আছেন মাদমোয়াজেল মোর্নাস-দু-পাশে দুই সাথী-মঁসি বারজাক আর কাপ্তেন মার্সেনে। হুম! এবং আবারও হুম! এঁরা তাহ’লে এই সুন্দরী তরুণীর টান সম্বন্ধে নিতান্তই উদাসীন নন! বাজি ধ’রে বলতে পারি অভিযান চলবার সময় বেশকিছু যুযুধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা জ’মে উঠবে। সেই প্রতিযোগিতার ফলাফল কী হয়, সেটা পাঠকদের ভবিষ্যতে জানাতে পারবো ব’লেই প্ৰতিশ্ৰুতি দিচ্ছি।
সেই প্রথম দলটার পেছনেই আছেন মঁসিয় বোদ্রিয়ের, বেশ-ছিমছাম সাজপোশাক করেছেন-আগে কি বলিনি যে আমরা সবাই যাচ্ছি ঘোড়ায় চ’ড়ে— কিন্তু তাঁর ভ্রুকুটিই বুঝিয়ে দিচ্ছে তাঁর সাংসদ সহযোগীর দুর্বলতাটা তাঁর অত্যন্ত অরুচিকর ঠেকছে। আমি আড়চোখে একবার তাঁর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছি, মিশনের এই সহযোগী কর্তার ওপর। কী শুঁটকোমতো দেখতে, চিমশে একটা কাঠিই যেন! আর হিমজমাট! আর কেমন যেন করুণও…সত্যি, শয়তানের কী লীলা, ইনি তো জানেনই না হাসি কাকে বলে!
মাননীয় সাংসদের তিনকদম পেছনেই আছেন অন্যরা। ডাক্তার শাতোনে আর ভূগোলবিশারদ ‘উচ্চকণ্ঠে মানববিদ্যা আলোচনা করতে লেগে দিয়েছেন-এর মধ্যেই।
এর পরেই আছে কনভয়—এটাই নাকি পারিভাষিক নাম। পঞ্চাশটি গাধাকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে পঁচিশজন রাখাল, তাদের মধ্যে দশজন্যই মাদমোয়াজেল মোরনাসের বেতনভূক। আর দু-পাশে পাহারা দিয়ে কদম-কদম চলেছে কাপ্তেন মার্সেনের ঘোড়সোয়ারবাহিনী। আর আপনাদের এই অধম? আমি একবার সামনে একবার পেছনে গিয়ে নজর রাখছি আমাদের প্রগতির ওপর। ৎশুমুকি আর তোঙ্গানে—মাদমোয়াজেল মোরনাসের দুই পরিচারক—চলেছে সব পেছনে
কাঁটায়-কাঁটায় ছটাতেই এসেছে যাত্রার সংকেত। সারিটা সঙ্গে-সঙ্গে নড়তে শুরু করেছে। ঠিক সেইমুহূর্তে রাজভবনের গম্বুজে উঠে গিয়েছে পৎপৎ তেরঙ্গ।। মাফ করবেন। একটু স্থানীয় রং চড়াই। লাটসায়েব তাঁর প্রাসাদের অলিন্দ থেকেই আমাদের বিদায়অভিনন্দন জানিয়েছেন। উপনিবেশের বাদ্য বেজে উঠেছে—জমকালো-তুরীভেরী আর ঢাকঢোল। আমরা উত্তরে মাথার টুপি তুলে অভিনন্দন ঠুকেছি। বেশ একটু ভাবগম্ভীরই ঠেকেছে মুহূর্তটাকে : দোহাই, এ শুনে যেন আবার হাসবেন না। কিন্তু এমন-একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ একটা ঠুনকো খামখেয়ালে হাস্যোদ্রেক করবে কেন?
সাঁৎ-বের্যা? সাঁৎ-বেরা কোথায়? সব্বাই দেখছি তার কথা বেমালুম ভুলেই গেছে! আমরা তাঁকে ঢুড়ে বেরিয়েছি, নাম ধ’রে চেঁচিয়ে ডেকেছি। প্রতিধ্বনিরা অব্দি তাঁর নাম ধ’রে চিল্লিয়েছে। সব খামকা। সাঁৎ-বেরার কোনো সাড়াই নেই। আমরা ভাবতে শুরু করেছি অপঘাত কিছু হয়নি তো? কোনো অভাবিত দুর্ঘটনা? কিন্তু মাদমোয়াজেল মোর্নাস-তাঁকে আদৌ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিলো না—আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। না, উদ্বিগ্ন তিনি নন মোটেই, বরং খেপে লাল! রেগে টং! যাকে বলে ক্ষিপ্ত! দাঁতে-দাঁত চেপে তিনি বলেছেন, ‘আমি যাবো আর আসবো – তিনমিনিটের মধ্যেই সাঁৎ-বেরাকে বগলদাবা ক’রে চ’লে আসবো।’ ব’লে, ঘোড়ার পেটে তিনি নাল ঠুকেছেন।
প্রথমে, অবশ্য, আমার দিকে ফিরে তিনি বলবার ফুরসৎ পেয়েছেন : ‘মসিয় ফ্লরেঁস…’ একটু অনুনয়ের ভঙ্গিতে, যার মর্মার্থ অনুধাবন করতে আমার খুব- একটা দেরি হয়নি। সেইজন্যেই আমিও ঘোড়ার পেটে নালের খোঁচা মেরে তাঁর সঙ্গ ধরেছি।
কয়েক কদম যেতে-না-যেতেই বেলাভূমি, বারদরিয়ার মুখোমুখি- আপনারা নিশ্চয়ই জানেন কোনাক্রি একটা দ্বীপের ওপরকার শহর-আর সেখানে—এ-কী দেখি – চোখ রগড়ে?
মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা। আজ্ঞে হ্যাঁ, মহোদয়া এবং মহোদয়গণ! সাক্ষাৎ সাঁৎ- বেরা, সশরীরে। আপনার আমার মতোই জলজ্যান্ত!
এই তীরে ইনি কী করছেন? একটু থেমে আমরা মালুম করার চেষ্টা করি।
মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা দিব্বি গ্যাঁট হ’য়ে আয়েস করে ছড়িয়ে বসেছেন বালিতে, একটা সরকারি মিশনের সঙ্গে যে তাঁকে যেতে হবে, সে-কথাটা তাঁর মাথাতেই নেই। তিনি দিব্বি খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন এক কালাআদমির সঙ্গে, সে তাঁকে নানারকম বঁড়শি দেখাচ্ছে—সম্ভবত এমনতর বঁড়শি ইওরোপে পাওয়া যায় না, আর হাত-পা নেড়ে তাদের সমূহ গুণপনা ব্যাখ্যানা ক’রে বোঝাচ্ছে। তারপর দুজনে উঠে প’ড়ে অলস গতিতে এগিয়ে গেছেন তীরের ওপর আদ্ধেক-ওঠানো একটা ক্যানুর দিকে, কালোটি গিয়ে তারপর তাতে উঠে গিয়েছে…এ-কী! এ- যে দেখছি মসিয় দ্য সাঁৎ-বেরাও ক্যানুটায় ওঠবার উপক্রম করছেন!
অবশ্য সুযোগটা পাননি।
‘বোন-পো!’ কড়া সুরে হেঁকে উঠেছেন মাদমোয়াজেল মোর্নাস। (হ্যাঁ, ইনি আসলে তাঁর বোন-পোই।)
সেই একটা কথাই যথেষ্ট হ’লো। মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা একপাক ঘুরেই দেখতে পেয়েছেন তাঁর মাসিকে–ইনি তাঁর মাসিই তো বটেন। দেখবামাত্রই সম্ভবত স্মৃতিতে সব চাগাড় দিয়ে উঠেছে, কারণ অমনি তিনি হতাশার একটা আর্তনাদ ক’রে উঠেছেন। হাতদুটি তুলেছেন শূন্যে, তাঁর কালো ইয়ারবন্ধুটির উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়েছেন একমুঠো খুচরো আর পরিবর্তে হাতে তুলে নিয়েছেন গোটা-কয়েক বড়শি, হুড়মুড় ক’রে, সে-সব ঢুকিয়েছেন পকেটে এবং পড়িমড়ি ক’রে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসেছেন আমাদের দিকে। এমন মজার ভাবভঙ্গি তাঁর যে দেখে আমরা হেসেই বাঁচি না। আর সেই খিলখিল হাসির ফাঁকেই মাদমোয়াজেল ‘দেখিয়ে ফেলেছেন চোখধাঁধানো শুভ্র দত্তপক্তি। আবারও বলি, চোখধাঁধানোই!
আমরা আবার ঘোড়ার মুখ ফিরিয়েছি, মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরাও কদম-কদম তাল রেখে আমাদের সঙ্গে ছুটে এসেছেন। শেষটায় মাদমোয়াজেল মোরনাসের বোধকরি একটু দয়াই হয়েছে, ঘোড়ার চলন মন্থর করেছেন তিনি, আর মোলায়েম ক’রে বলেছেন: ‘অমন ক’রে ছুটো না, মামা! শেষটায় মাথা গরম হ’য়ে যাবে।’ (ইনি তবে এঁর মামা।…এ-কী, আমার মাথায় সব যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!)
আমরা ফিরে আসি কনভয়ের কাছে, যেখানে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসি আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু এ-সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা অন্তত মাথা ঘামান না। এত লোকজন দেখে তিনি বরং বিস্মতই হয়েছেন। সরল ভঙ্গি তে জিগেস ক’রে বসেছেন: ‘আমি বুঝি খুব দেরি করিয়ে দিয়েছি?’
তাঁর এই নিরীহ প্রশ্ন শুনে পুরো সারিটাই হো-হো ক’রে হেসে ফেলেছে। এবং মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ভদ্রলোককে আমার ভারি মনে ধরে গেছে।
তবে এখনও কিন্তু আমরা রওনা হ’তে পারিনি।
যেই মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা ঝুঁকে পড়েছেন, ওস্তাদ ঘোড়সোয়ারের মতো, দেখতে যে জিন-লাগাম ঠিকমতো পরানো হয়েছে কিনা, তাঁর ছিপের বাক্সটা, সেটা তিনি প’রে ছিলেন ঠিক বান্দোলিয়ের-এর মতো, বরাৎ-খারাপ, গিয়ে ধাক্কা মেরেছে পাশের একটি গাধার গায়ে। গর্ধবটা নিশ্চয়ই রগচটা, সে উত্তরে বেচারি সাঁৎ-বেরাকে তাগ ক’রে দুম করে এক লাথি কষিয়ে দিয়েছে, অমনি চিৎপটাং, পপাতধরণীতলে এবং ধুলোয় গড়াগড়ি।
আমরা হা-হা ক’রে ছুটে গিয়েছি তাঁকে সাহায্য করতে, বেচারি কিন্তু নিজেই ততক্ষণে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে পড়েছেন।
‘মোসোর কপাল ভালো!’ তোঙ্গানে তাঁকে বলেছে, ‘যদি বোলতা হুল ফোটায় কিংবা ঘোড়ার বাচ্চা লাথি কষায়, তাহ’লে যাত্রা শুভ হয়! খুব ভালো হ’লো!’
তার কথার কোনো জবাব না-দিয়ে, একটু হতোদ্যম এবং অনেকটাই ধূলিধূসর, মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা লাফিয়ে উঠেছেন তাঁর জিনের ওপর, এবং অবশেষে কনভয় রওনা হবার সুযোগ পেয়েছে। ততক্ষণে সূর্যদেব উঠে পড়েছেন, এবং তাঁর প্রথম রশ্মিগুলো সহর্ষে আলো ফেলেছে আমাদের পথের ওপর।
যে-পথটা দিয়ে আমরা যাবো, কোনক্রিকে মূল ডাঙার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে যে-সেতু সেটাকে পেরিয়ে, সেটা বেশ-ভালো রাস্তাই। পাঁচ-ছ ফিট চওড়া, গাড়িঘোড়া যেতে পারে সহজেই, আমরা সে-পথ ধ’রে যাবো তিম্বো, প্রায় আড়াইশো মাইল দূরে। অর্থাৎ, অন্তত তিম্বো অব্দি, আশা করতেই পারি, পথে খুব-একটা অসুবিধে হবে না। আবহাওয়াও ভালো। ছায়ায়, পঞ্চাশ ডিগ্রি ফারেনহাইটও হবে কি না সন্দেহ-আর বর্ষাকাল শেষ হ’য়ে গেছে ব’লে আচমকা যে মুষলধারে বাদল ঝরবে, সে-ভয়ও নেই।
দশটার সময় আমরা একটা নদীর ওপর একটি সেতু পেরিয়েছি—মঁসিয় তসাঁর মতে, সেটা হয় নাকি মানেয়া নয়তো মোরেবাইয়ার শাখানদী–হয় এটার, নয় ওটার। এখনও অব্দি এটা যে কার শাখানদী সে নিয়ে আমরা দ্বিধায় দুলছি। তবে নদী-পেরুনোটা আফ্রিকায় এমন আর কী। কোনো নদী পেরুতে হয় না, এমন দিন এখানে যায় না। ফলে আগেভাগেই জানিয়ে রাখি, আমার লেখাগুলো ভূগোলবিদ্যার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূত হবে না-যদি-না অসাধারণ-কিছু হয়, তাহ’লে এ-সম্বন্ধে কিছুই আমি বলবো না।
কোনোক্রির কাছ দিয়ে রাস্তাটা দু-পাশের মাঠের মধ্য দিয়ে প্রায় সরলরেখার মতো নাকবরাবর এগিয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে কিছু গাছপালা, আর নয়তো ভুট্টা কিংবা জোয়ারের খেত! গাছের মধ্যে আছে শিমুলগাছ, কলাগাছ, এইসব। পথে পড়েছে এঁদো সব ছোটো-ছোটো গাঁ, মঁসিয় তসাঁ অবশ্য তাদের একেকটা নাম বলেছেন, তবে জনান্তিকে ব’লে রাখি, আমার কেন যেন সন্দেহ হয়, সে-সব তাঁর মনগড়া। তবে কে জানে, পুরোপুরি বানানো নাম নাও হ’তে পারে।
দশটার সময় রোদে তেতে ঘেমে-নেয়ে উঠেছি আমরা। আর কাপ্তেন মার্সেনে আমাদের থামতে বলেছেন। আমরা কোনোক্রি থেকে প্রায় দশমাইল দূরে চ’লে এসেছি, প্রগতি, অতএব, সন্তোষজনক। এখানে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা একটু জিরিয়ে নেবো। তারপর বিকেলের নাশ্তা সেরে নিয়ে পাঁচটা নাগাদ ফের রওনা হবো—রাত নটায় আজ ছাউনি ফেলা হবে।
রোজ নাকি এই ক্রমই অনুসরণ করা হবে, অতএব তারও কোনো পুনরাবৃত্তি আমি করবো না। খামকা এ-সব তুচ্ছ এবং একঘেয়ে খুঁটিনাটি দিয়ে লেখাটাকে নিরেস ক’রে তোলবার দরকারটাই বা কী।
বিশ্রামের জায়গাটা কিন্তু চমৎকারই বেছেছেন কাপ্তেন মার্সেনে। একটা ছোটো বনের ছায়ায় আমরা জমিয়ে বসেছি, গাছপালাগুলো প্রচণ্ড রোদ্দুরের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে। সেপাইশাস্ত্রীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে পাহারায়—আর আমরা, অর্থাৎ মিশনের সদস্যরা, মাদমোয়াজেল মোরনাস, কাপ্তেন সাহেব, মসিয় দ্য সাঁৎ- বেরা, এবং আপনাদের এই-অধম-আমরা বেশ মনোরম একটা ফাঁকা জায়গায় গাছপালার আড়ালে আসর জমিয়েছি।
আমাদের সুন্দরী সঙ্গিনীর জন্যে একটা তাকিয়া বাড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি কাপ্তেন মার্সেনে এবং মঁসিয় বারজাক আমাকে কোনো সুযোগ না-দিয়েই দুজনে গিয়ে দুটো জলচৌকি নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। কী-যে লজ্জার ব্যাপার- মাদমোয়াজেল মোর্নাস তো ভেবেই পান না কারটাকে বেছে নেবেন। এরই মধ্যে কাপ্তেনসাহেব এবং অভিযানের নেতা পরস্পরের দিকে একটু ট্যারা চোখে তাকাতে শুরু করেছেন। মাদমোয়াজেল মোর্নাস কারু মনেই কোনো আঘাত না-দিয়ে ধপ ক’রে ব’সে পড়েছেন মাটিতেই –আমার বাড়িয়ে-দেয়া তাকিয়ায়। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তখন এককাট্টা হ’য়ে আমার দিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।
মঁসিয় বোদ্রিয়ের বসেছেন একপাশে, ঘাসের ওপর, যাদের ‘নিরপেক্ষ’ বলা যেতে পারে তাদের মাঝখানে, মধ্যমণির মতো। তাঁরা বিভিন্ন সচিবালয়ের সুযোগ্য প্রতিনিধি –মাদাম এইরিউ, কিরিউ এবং পঁসাঁ। এই শোষোক্ত জন একটু-বেশি বিবেকবান—আমরা রওনা হবার পর থেকে অনবরত তিনি তাঁর ধারণাগুলো খাতায় টুকে গেছেন। আমি অবশ্য, সত্যিই জানি না কী তাঁর টীকাটিপ্পনী। একটু যদি ভারিক্কি ও হোমরাচোমরা ভঙ্গি না-হ’তো তো তাঁকে দেখে বোধকরি আমার মঁসিয় প্রুদোঁর চরিত্রের কথাই মনে প’ড়ে যেতো। কী জমকালো ভুরুযুগল! এ- রকম চওড়া কপাল যাঁর সে হয় দুর্দান্ত-বুদ্ধিমান হবে আর নয়তো অসহ্য-ভোঁতা হবে। মাঝামাঝি কিছু থাকতেই পারে না। মঁসিয় পঁসাঁকে যে কোন দলে ফেলবো, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
ডাক্তার শাতোনে আর মঁসিয় তসাঁ-এমনই অবিচ্ছেদ্য থেকেছেন যে মনে হয়েছে ‘কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে’– থুড়ি বৃক্ষতলে। তাঁরা মাটিতে বিছিয়েছেন নানা ভৌগোলিক মানচিত্র। আশা করি ভূগোলের জাবর কাটতে- কাটতে তাকেই তাঁরা একমাত্র খাদ্য ব’লে ভেবে নেবেন না।
মোরিলিরে এদিকে আমাদের জন্যে একটা টেবিল আর বেঞ্চি এনে হাজির করেছে। আমি ব’সে প’ড়ে মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরার জন্যে পাশের আসনটা খালি রাখি। কিন্তু মাতুল বা বোন-পো-যা-ই হোন না কেন-সাঁৎ-বেরা কোথায়? যখনই খোঁজ করা যায় তখনই দেখা যায় তিনি কোথাও নেই।
মোরিলিরে শিবিরের রসুই পাকাবার আয়োজন করে। ৎশুমুকি আর তোঙ্গ ানের সাহায্যে, সে-ই রান্না করবে আমাদের খাবার; আমরা ঠিক করেছি, নেহাৎ দরকার না-হ’লে ইওরোপ-থেকে-আনা খাবার আমরা খরচ করবো না। যেদিন টাটকা খাবার জুটবে না, সেদিন সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা যাবে। মোরিলিরে মাথাখাটিয়ে কোনক্রিতে কিছু মাংস কিনে নিয়েছিলো। সে সেই মাংস দেখিয়ে আমাদের জানিয়ে গেছে : ‘এই সাদে (ভেড়ার মাংস) দিয়ে চমৎকার স্টু পাকাবো আমি—কচি মাংসের মতো ঠেকবে।
তা, শিবিরের প্রথম ভোজটা অবিশ্যি ঠিক কাফে আংলেইর মতো হয়নি, তবু মানতেই হয় দারুণ-উপাদেয় হয়েছিলো। নিজেরাই ভেবে দেখুন : ভেড়ার রাং, জোয়ারের দানা গুঁড়ো ক’রে মাখানো গায়ে, সঙ্গে কারিতে মাখনের ডেলা গালিয়ে সেটা মাংসের ভেতরে চুঁইয়ে ঢোকানো, কিছু শব্জি, ভুট্টার রুটি, ডুমুর, কলা আর নারকেল। যার ইচ্ছে তার সঙ্গে খেতে পারে ঝর্নার টলটলে শুদ্ধজল, অথবা তাড়ি-যদি তাতে কারু অভিরুচি জ’ন্মে যায়।
মোরিলিরে আর তার দুই সহকারী যখন খামা পাকাতে ব্যস্ত, ডাক্তার শাতোনে হঠাৎ উঠে এসে স্থানীয় খাদ্যরুচি সম্বন্ধে আমাদের বিস্তর জ্ঞান দিয়েছেন বিশেষজ্ঞের মতো, যেমন কারিতে মাখন—যাকে আবার সে মাখনও বলে, যে- গাছ থেকে গজায় তার নাকি দু-দুটো নাম, তাই তা থেকে প্রস্তুত স্নেহপদার্থেরও দু-দুটো নাম। কেমন ক’রে এই মাখন বানায় তার একটা বিশদ বিবরণই দিয়েছেন তিনি, আর শুনে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাঁর পানে তাকিয়ে মাদমোয়াজেল মোর্নাস বলেছেন : ‘আপনি কত জানেন!’
‘না, মাদমোয়াজেল, কতটুকু আর জানি। তবে বইয়ের পোকা কি না, অনেক বই পড়েছি, বিশেষত ভ্রমণবৃত্তান্ত।’
জ্ঞানতাপস ডাক্তার শাতোনে যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক কাহন শোনাতে ব্যস্ত, এমন সময় জঙ্গল-থেকে-ভেসে-আসা আর্তনাদ শুনে আমার চটকা ভেঙে গিয়েছে। কার গলার আর্তনাদ সেটা চিনতে আমাদের মুহূর্তও লাগেনি। বাজি ধ’রে বলতে পারি, পাঠক-পাঠিকাদের আমি যদি জিগেস করি, ‘কার গলা, বলুন-তো?’, অমনি তাঁরা সমস্বরে নিশ্চয়ই ব’লে বসবেন, ‘কার আবার? নিশ্চয়ই মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরার।’ না, পাঠক পাঠিকাগণ, আপনাদের অনুমানে কোনোই ভুল হয়নি। সত্যিই, মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরাই ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ব’লে আতচীৎকার জুড়ে দিয়েছিলেন।
আমি তক্ষুনি ছুটে গিয়েছি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে, পেছন-পেছন ছুটে এসেছেন কাপ্তেন মার্সেনে আর মঁসিয় বারজাক। আমরা গিয়ে আবিষ্কার করি, কাদাজলের মধ্যে কোমর অব্দি ডুবে গিয়েছেন সাঁৎ-বেরা। তাঁকে শুকনো ডাঙায় টেনে তুলে এনে যখন আমরা জিগেস করেছি, ‘কেমন ক’রে ঐ কাদাজলে, অর্থাৎ এ-দেশে যাকে মারিগৎ বলে, তার মধ্যে গিয়ে পড়েছেন, বলুন তো?’ অমনি তিনি কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘আমার পা হড়কে গিয়েছিলো।’ গা-হাত-পা ছুঁড়ে কাদা ছিটিয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাদায় ভরিয়ে দিয়ে তিনি বিশদ করেছেন : ‘মাছ ধরতে গিয়ে হঠাৎ পা হড়কে প’ড়ে যাই।’
‘ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলেন?’
‘না-না, মঁসিয় ফ্লরেঁস, হাত দিয়ে খপ ক’রে পাকড়ে ধরতে গিয়েছিলুম।’ ব’লে তিনি তাঁর হেলমেটটা দেখিয়েছেন আমাদের, গায়ের কোটটা খুলে সেটাকে পেঁচিয়েছেন তিনি। বলেছেন : ‘সবুর। জ্যাকেকটা সাবধানে খুলতে হবে, নইলে হতচ্ছাড়ারা পালিয়ে যাবে।’
হতচ্ছাড়া? মানে?
‘ব্যাঙগুলো।’
আমরা যখন আরাম ক’রে ব’সে আড্ডা দিচ্ছি, তখন কি না তিনি ব্যাঙ ধরতে গিয়েছেন! কী উৎসাহ!
‘অভিনন্দন নেবেন,’ মঁসিয় বারজাকের অনুমোদন এসেছে তৎক্ষণাৎ, ‘চমৎকার খেতে হয় ব্যাঙ…কিন্তু শুনুন তাদের ডাক—ঐ যাদের আপনি পাকড়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তারা কারু পেটে যেতে চাচ্ছে না!’
অতঃপর আমরা শিবিরে ফিরে এসেছি। সাঁৎ-বেরা গিয়ে তার পোশাক পালটেছেন এবং মোরিলিয়ে রান্না করেছে তাঁর ‘শিকার’। তারপর টেবিল সাজানো হয়েছে; আমরা সোৎসাহে আক্রমণ করেছি খাদ্যগুলো—বারোমাইল ঘোড়া ছুটিয়ে আসার চাইতে ক্ষুধার উদ্রেককারী আর কীই-বা হ’তে পারে?
খাবার টেবিলে প্রধানা ছিলেন, বলাই বাহুল্য, মাদমোয়াজেল মোর্নাস। সত্যি ভারি উপাদেয় তিনি। (জানি, আগেই কথাটা বলেছি, তবে এ-কথাটা কখনও ব’লে ফুরুতে পারবো না।) সরলা তরুণী, একটু ডানপিটে গোছের, তাঁর মধুর হাসি মুহুর্তে সব জড়তা ঘুচিয়ে দেয়।
‘আমার মামা…’ (তাহ’লে সত্যি তিনি এঁর মামা? তা-ই কি?’) ‘আমার মামা,’ মৃদু হেসে তিনি বুঝিয়েছেন আমাদের, ‘আমাকে ছেলেদের মতো ক’রেই মানুষ করেছেন—আমাকে তিনি পুরুষই বানিয়ে তুলেছেন। দোহাই, আমি-যে মেয়ে, সে- কথাটা ভুলে যাবেন, নিজেদের একজন ব’লেই ভাববেন আমাকে।
তবু কিন্তু, কথাটা বলতে-বলতেই, কাপ্তেন মার্সেনের দিকে কটাক্ষ ক’রে মধুর হাসতে তাঁর বাধো-বাধো ঠেকেনি-অর্থাৎ, যেন এমনতর যুবাপুরুষদের মধ্যে কটাক্ষ, চোখের হাসি, অধরের স্ফূরণ কিছুই এখনও বাদ যায়নি।
কফি দিয়ে গলা ভিজিয়ে নেবার পর, আমরা শান্ত হ’য়ে এলিয়ে পড়েছি তালগাছগুলোর তলায় ঘাসের জাজিমের ওপর-দিব্বি এক সিয়েস্তার আয়োজন। আগেই তো বলেছি, পাঁচটার সময় ফের আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে, কিন্তু কনভয় সাজাতে গিয়ে দেখা গেলো, মিথ্যেই আমরা এক ইটের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছি। সময় হবার জানান দিয়ে মিথ্যেই ডেকে-ডেকে গলা ভেঙেছে মেরিলিরে-কিন্তু কেউ নড়েনি জায়গা ছেড়ে—একবাক্যে বলেছে তারা এখনও চাঁদ দ্যাখেনি, আর চাঁদ দ্যাখেনি ব’লেই তারা এখন যায় কী ক’রে? আমরা একটু হতভম্ব হ’য়ে পড়েছি দেখে দিব্যদৃষ্টিধারী মঁসিয় তসাঁ হেঁয়ালিটার সমাধান ক’রে দিয়েছেন : ‘ব্যাপারটা কী, জানি। সব ভ্রমণবিদ্ই তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে এ- কথাটার উল্লেখ করেছেন। শুক্লপক্ষের গোড়ার দিকে–অমাবস্যা গেছে মাত্র দু- দিন আগে—এখানকার লোকে বলে ‘চাঁদ না-দেখে বেরুলে নাকি দারুণ- অমঙ্গল হয়। কেউই যখন চাঁদ দ্যাখেনি, রাস্তাঘাট তখন শুভ হবে না আমাদের।’
ইয়ু! ইয়ু! (হ্যাঁ-হ্যাঁ!’ এলো সমস্বর সমর্থন, যখন মেরিলিরে এই তর্জমা ক’রে শুনিয়েছে তল্পিবাহকদের।
‘কারো! কারো!’ (চাঁদ! চাঁদ!)’
বোঝাই গেছে, পৃথিবীর উপগ্রহটি দয়া ক’রে যদি দেখা না-দেন, এরা তবে এক পাও নড়বে না। কিন্তু চাঁদই বা অসময়ে উঠে আসবে কী ক’রে? এখনও তো বেলা প’ড়ে যায়নি—দিন আছে। দয়া ক’রে যদি ছটার একটু-আগে চাঁদ তার রূপটি না-দেখাতো, তবে আমাদের ওখানেই প’ড়ে থাকতে হতো। কিন্তু মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিতেই সবাই সেলাম ঠুকে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছে : ‘আল্লাহ মা তুলা কেন্দে। কারো কুতাইয়ে!’ (ঈশ্বর আমাদের আশীর্বাদ করেছেন! আমরা নতুন চাঁদ দেখতে পেয়েছি!)’ আর অমনি কনভয় হনহন ক’রে চলতে শুরু ক’রে দিয়েছে।
কিন্তু এই-ফাঁকে দু-দুটি ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে আমাদের-ফলে রাতের পথচলার মেয়াদও দু-ঘণ্টা ক’মে যাবে।
নটা নাগাদ, আমরা জঙ্গলের মধ্যেই থেমে পড়েছি। তাঁবু খাটানো হয়েছে। জায়গাটা অবশ্য পুরোপুরি জনবর্জিত নয়। ডানদিকে পায়ে চলার পথ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় কারু কুঁড়েবাড়ি-কোনো অজ্ঞাত রহস্যময় কারণে এখন- পরিত্যক্ত; বামদিকেও মুখোমুখি আরেকটা কুঁড়েঘর, তবে তাতে সম্ভবত লোক আছে।
কাপ্তেন মার্সেনে পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আন্দাজ ক’রে নিয়েছেন সেটা বাসযোগ্যই হবে, মাদমোয়াজেল মোরনাসকে এসে বলেছেন, তাঁর পক্ষে ঐ বাড়িটায় রাত কাটানোই ভালো হবে। মাদমোয়াজেল মোর্নাস অমনি লুফে নিয়েছেন প্রস্তাবটা এবং হাতে-চাঁদ পাওয়ার মতো ভাব ক’রে তক্ষুনি উধাও হয়ে গিয়েছেন ঐ অপ্রত্যাশিত সরাইখানাটায়।
দশ মিনিটও যায়নি, অমনি আমরা শুনতে পেয়েছি কুঁড়েবাড়িটার মধ্য থেকে সকাতর ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ধ্বনি আসছে। আমরা ছুটে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দেখি মাদমোয়াজেল মোর্নাস কুঁড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে বিবমিষার ভঙ্গিতে মেঝের দিকে আঙুল তুলে কী যেন দেখাচ্ছেন।
‘এগুলো কী?’ তাঁর কাতর জিজ্ঞাসা।
এগুলো আসলে অগুনতি শাদা-শাদা শূককীট। ঘুণপোকাগুলো মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে এমন বিপুল সংখ্যায় কিলবিল ক’রে বেড়াচ্ছে যে মনে হচ্ছে গোটা জমিটাই বুঝি ফুলে-ফুলে উঠছে।
‘একবার শুধু কল্পনা ক’রে দেখুন,’ মাদমোয়াজেল মোর্নাস আমাদের অনুরোধ করেছেন, ‘আমার হাত-মুখে এগুলোর হিম ছোঁয়া পেয়ে আমি কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিলুম! দেখি, সবখানেই এগুলো কিলবিল ক’রে বেড়াচ্ছে, এমনকী আমার পকেটেও! যখন গা ঝাঁকিয়েছি, এগুলো জামাকাপাড় থেকেও টুপটাপ ক’রে খ’সে পড়েছে। উঃফ! কী বীভৎস জীব!’
মঁসিয়া দ্য সাঁৎ-বেরা এতক্ষণ বাদে এসে হাজির। এসেই কিন্তু সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেয়েছেন তিনি; এগুলোকে নিরীক্ষণ ক’রে তাঁর মুখচোখ উদ্ভাসিত হ’য়ে উঠেছে, ব’লে উঠেছেন, ‘বাঃ, চমৎকার!… এগুলো ভারি শান্তশিষ্ট—কিছু করে না!’
হ’তেও পারে-বা! কারণ তিনি এদের সম্বন্ধে সব খবর রাখেন, এই মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা। এর মধ্যেই তিনি ঝুঁকে প’ড়ে এদের কুড়োতে লেগে গিয়েছেন।
‘এগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জমাবার কোনো দরকারই নেই,’ তোঙ্গানে তাঁকে বলেছে। ‘আমরা যেদিক দিয়ে যাবো অজস্র দেখা যাবে এদের। ভারি-মন্দ এগুলো, সবখানেই গজাচ্ছে—কিছুতেই এদের আর খতম ক’রে দেয়া যায় না।’
শুনে মহা-আহ্লাদ হয়েছে আমাদের! চমৎকার কাটবে তাহ’লে রাতগুলো— এদের সঙ্গে সহবাস ক’রে! কিন্তু এখানকার স্থানীয় লোকেরা তারা কী করে এই অন্তহীন কিলবিল-করা পোকাগুলো নিয়ে?
সন্দেহ নেই, আমি বোধহয় সশব্দেই ভাবছিলুম। ‘খায় এদের, মোসু।’ তোঙ্গানে ব্যাখ্যা করেছে, ‘ভারি-ভালো খেতে–দারুণ-স্বাদ।’
মাদমোয়াজেল মোরনাসের অবশ্য এ-সব জীবে রুচি নেই, যদিও ব্যাঙ খেতে তাঁর ব্যাজার মুখ দেখা যায়নি। তিনি তৎক্ষণাৎ এই অভাবিত সরাইখানার আতিথ্য ত্যাগ ক’রে তাঁবুর মধ্যেই রাত কাটাবেন ব’লে স্থির ক’রে নিয়েছেন। এমন সময় মোরিলিরে এসে তাঁকে জানিয়েছে এক নিগ্রো তরুণী—তাঁকে খামারেরই একটা কুঁড়েঘরে থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কুঁড়েঘরটা তকতকে ঝকঝকে, নিকোনো, সাফসুতরো-এবং কিমাশ্চর্য!—এমনকী একটা সাহেবি কেতার খাট পর্যন্ত সেখানে আছে।
আপনি বখশিশ দেবেন, টাকা।’ মোরিলিরে জানিয়েছে, ‘তাহ’লেই নিগ্রো মেয়েটি খুশি হ’য়ে থাকতে দেবে।’
মাদমোয়াজেল মোর্নাস সাগ্রহে এই ‘ভাড়াটে’ আতিথ্য গ্রহণে রাজি হ’য়ে গেছেন, এবং আমরা তাঁকে প্রায়-শোভাযাত্রা ক’রেই তাঁর নতুন বাসভবনে পৌঁছে দিতে গিয়েছি। নিগ্রো যুবতীটি আমাদেরই জন্যে একটা গাছের কাছে দাঁড়িয়েছিলো। তরুণী নয়, বালিকাই; বয়েস বোধহয় পনেরো হবে; মাঝারি গড়ন; বেশ রূপবতীই—ঠিক একটা কালো মার্বেল পাথরে কোঁদা মূর্তির মতো দেখাচ্ছিলো তাকে। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছেছি, সেই মর্মরমূর্তি তখন গাছটা থেকে কী যেন পেড়ে নিচ্ছিলো।
‘শুয়োপোকা সংগ্রহ করেছে,’ নিগ্রো-রন্ধনবিদ্যাবিশারদ ডাক্তার শাতোনে আমাদের খুলে বলেছেন, ‘এদের শুঁয়োগুলো সাফ করে রোদে শুকোতে হবে— আর তারপর—মোটেই চমকে যাবেন না—এগুলো দিয়ে সে চাটনি বানাবে। এদের বলে সেতোম্বো। এই জাতের শুঁয়োপোকাই শুধু খায়, আর শুনেছি, ভারি নাকি মুখরোচক।’
তা ঠিক!’ মোরিলিরে জিভ দিয়ে সড়াৎ ক’রে একটা আওয়াজ করেছে। ভারি সোয়াদ।’
আমাদের দেখতে পেয়ে নিগ্রো মেয়েটি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসেছে। ‘আমি, মাদ্মোয়াজেল মোর্নাসকে সে প্রায়-নিখুঁত ফরাশিতে বলেছে, ‘আমি একটা ফরাশি স্কুলে পড়েছি—কিছুদিন এক শ্বেতাঙ্গিনীর পরিচারিকা ছিলুম-এক জাঁদরেল অফিসারের স্ত্রী। গাঁয়ে ফিরে যেতেই ভারি-একটা যুদ্ধ লেগে যায়, আমাকে বন্দী ক’রে নেয়। শ্বেতাঙ্গিনীরা যেমন ক’রে বিছানা পাতা পছন্দ করেন, আমি তা জানি। আমার অসুবিধে হবে না।’
বলতে-বলতে, মাদমোয়াজেল মোরনাসের হাত ধ’রে সে কুঁড়েটার দিকে নিয়ে গেছে।
আমরা ফিরে আসি : এবার আমাদের বান্ধবী অন্তত খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটাতে পারবেন। কিন্তু আমাদের তখনও ঘুমের সময় আসেনি-না তাঁর, না- বা আমাদের! আধঘণ্টাও কাটেনি, মাদমোয়াজেল মোরনাস ফের সাহায্য চেয়ে হাঁকাহাঁকি শুরু ক’রে দিয়েছেন।
ফের-একবার পড়িমরি ক’রে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যেতে হয়েছে আমাদের, আর মশালের আলোয় অপ্রত্যাশিত একটা দৃশ্য দেখে বুঝি আঁৎকেই যেতে হয়েছে।
কচি নিগ্রো মেয়েটি উপুড় হ’য়ে প’ড়ে আছে কুঁড়েটার দেহলির কাছে। জেব্রাদের মতো তার পিঠে লাল ডোরা কাটা, আর বেচারি এমন হাউ-হাউ ক’রে কাঁদছে যে পাষাণেরও বুঝি বুক ফেটে যেতো! তার সামনেই নিজের শরীরটা দিয়ে তাকে আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মাদমোয়াজেল মোর্নাস-খেপে গেলে তাঁকে দারুণ দেখায়!—আর বিশাল-এক নিগ্রোকে ঠেকিয়ে রেখেছেন সামনে, সে তখনও একটা রক্তমাখা ছড়ি হাতে নিয়ে তিড়িংবিড়িং ক’রে লাফাচ্ছে। তক্ষুনি আমরা তার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছি।
কিন্তু মাদমোয়াজেল মোর্নাসই সব খুলে বলেছেন। : ‘শুধু ভাবুন একবার- আমি সবে গিয়ে একটু শুয়েছি। মলিক—এই ছোট্ট মেয়েটির নাম মলিক-আমাকে পাখার হাওয়া করছে, সবে একটু তন্দ্রামতো লেগেছে, এমনসময় এই বিশাল জানোয়াটা এসে হাজির, এ-ই নাকি এই খামারটার মালিক-অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ি ফিরে এসেছে। আমাকে দেখেই সে রেগে-আগুন, হিড়হিড় ক’রে হিঁচড়ে টেনে বার ক’রে নিয়ে গেছে মলিককে, আর বেদম পেটাতে শুরু ক’রে দিয়েছে নির্দয়ভাবে তার বাড়িতে শাদা লোককে নিয়ে-আসার নাকি এটাই উচিত শাস্তি।’ মঁসিয় বোদ্রিয়েরও রসিকতা জানেন! তিনি বলে উঠেছেন : ‘কী আদবকায়দা– আহা, ম’রে যাই!’
অন্তত এটা যদি রসিকতা হয়, তবে খুবই লাগসই হয়েছে বলতে হবে। কিন্তু তারপরেই নিজের বঙ্কিম কটাক্ষটা নিজেরই মাথায় চ’ড়ে গেছে তাঁর, জনসভার ধরনে ভাষণ দিতে লেগে গিয়েছেন তিনি : ‘তবে দেখুন, মহোদয়গণ, এই সব বন্য বর্বর জানোয়ারগুলোকে কি না নাগরিক অধিকার দিতে চাচ্ছেন আপনারা- ভোটের অধিকার দিতে চাচ্ছেন!’
নিশ্চয়ই তিনি ভেবেছেন, তিনি সংসদের সভামণ্ডপে দাঁড়িয়ে আছেন।
মঁসিয় বারজাক এমন জ্ব’লে উঠেছেন মনে হয়েছে বুঝি একটা বোলতা এসে তাঁর গায়ে হুল বিঁধিয়েছে। সামলাতে না-পেরে শুষ্কস্বরে ব’লে উঠেছেন : ‘যেন সুসভ্য ফরাশিরা তাদের বউকে ধ’রে আর পেটায় না!’
তিনিও খুব-একটা ভুল বলেননি, আমাদের এই অপর সাংসদ, মঁসিয় বারজাক তাহ’লে যুযুধান দুই সাংসদের বাচিক মল্লযুদ্ধ দেখতে পাবো আমরা- অভিযানের প্রথম রাতেই? না। মঁসিয় ব্রোদ্রিয়ের এর কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন আছে ব’লেও মনে করেননি। মঁসিয় বারজাক সেই ছড়ি-হাতে-দাঁড়ানো গরজাতে-থাকা খামার-মালিকের দিকে ফিরে বলেছেন : ‘এ আর তোমার কাছে থাকবে না। একে আমরা আমাদের সঙ্গে ক’রে নিয়ে যাবো।’
কিন্তু নিগ্রোটি তা মানবে কেন? এই নিগ্রো মেয়েটি তার সাধের ক্রীতদাসী : সে তাকে দস্তুরমতো দাম দিয়ে কিনেছে। ফরাশি সাম্রাজ্যে যে ক্রীতদাসপ্রথা রদ ক’রে দেয়া হয়েছে, এখন একে সেইকথাই বোঝাতে হবে নাকি? মঁসিয় বারজাক তার ধারকাছ দিয়েই যাননি। তিনি আরো-ভালো একটা উপায় বাৎলেছেন : ‘আমি একে তোমার কাছ থেকে কিনে নেবো। কত দাম?’
শাবাশ, মঁসিয় বারজাক, বাহবা কি বাহবা! সাধে কি লোকে তাঁর বুদ্ধির এত তারিফ করে? এদিকে দাঁও মারবার সুযোগ পেয়ে নিগ্রোটি হম্বিতম্বি একটু থামিয়েছে। দাম হিশেবে সে চেয়েছে : একটা গাধা, একটা বন্দুক, আর পঞ্চাশ ফ্রাংক।
‘পঞ্চাশ ফ্রাংক, না আর-কিছু! লাঠির ঘা পঞ্চাশটা—এই তোমার প্রাপ্য!’ কাপ্তেন বলেছেন : ‘তাহ’লেই তুমি সজুত হবে’
সত্যি, বিপুল এ দরকষাকষির পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি! শেষটায় রফা হয়েছে; একটা পুরোনো গাদাবন্দুক, কয়েক গজ কাপড়, আর পঁচিশ ফ্রাংক। এ যেন প্রায় কন্যাদ্যান-কোনো মুনাফা না রেখেই!
দরকষাকষি যখন চলছে, মাদমোয়াজেল মোর্নাস মলিককে তুলে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কারিতে মাখনের মলম বুলিয়ে ঘাগুলোয় পট্টি বেঁধে দিয়েছেন। বেচাকেনা সাঙ্গ হ’তেই মেয়েটিকে আমাদের শিবিরে নিয়ে এসে শাদা একটা জামা পরতে দিয়েছেন, আর হাতে একমুঠো টাকা দিয়ে বলেছেন : ‘ব্বাস! আর তুমি ক্রীতদাসী নও! আমি তোমায় মুক্ত ক’রে দিলুম!’
মলিক কিন্তু খুশি হবার বদলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বলেছে, তিনকুলে তার কেউ নেই, সে একেবারে একা, ‘এই দয়াবতী শ্বেতাঙ্গিনীর স্নেহপাশ ছেড়ে সে কোত্থাও যেতে চায় না’। বরং তাঁর পরিচারিকার কাজ করবে সে, খাশ পরিচারিকা-তাঁরই সেবায় বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবে!
‘থাকুকই না-হয় মেয়েটি,’ সাঁৎ-বেরা নাক গলিয়েছেন দুজনের মাঝখানে। ‘কাজেও লাগবে তোর। ফাই-ফরমাশ খাটবে। তাছাড়া যতই পুরুষ সাজুক, কোনো মেয়ের কি টুকিটাকি ফাইফরমাশের অন্ত আছে?’
মাদমোয়াজেল মোর্নাস রাজি হ’তেই মলিকের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ দ্যাখে কে! সে সাঁৎ-বেরার কথায় ওষুধ ধরেছে দেখে, তাঁর গলা জড়িয়ে ধ’রে, চুমু-টুমু খেয়ে সে-এক কাণ্ড! পরের দিন সাঁৎ-বেরা নিজের মুখে আমায় বলেছেন, জীবনে কখনও তিনি এমন অস্বস্তিতে পড়েননি।
মাদমোয়াজেল মোর্নাস অবশ্য সে-রাতে আর স্থানীয় আতিথ্য নেবার চেষ্টা করেননি। তাঁরও জন্যে একটা তাঁবু খাটিয়েছি আমরা-আর বাকি রাতটা বেশ- নিরুপদ্রবেই ঘুমিয়ে কেটে গেছে আমাদের
এই হ’লো গিয়ে আমাদের অভিযানের প্রথম দিনের বিবরণ।
বাকি দিনগুলোও সম্ভবত এ-রকমই কাটবে। অতএব আমি আর বিশদভাবে তাদের বর্ণনা দেবো না। অন্যকিছু যদি বলা না-হয়, তবে ভার্জিলের এই কথাগুলোই লাগসই বোধ হবে; আব্ উনা ডিস্কে ওম্সে, যেমন একখানা, তেমনি বাকি সবগুলোই।
আমেদে ফ্লরেঁস