পুরাতনী
ভদ্রমহিলা ধীর শান্ত স্বরে বললেন, সব জানতে হলে সবার আগে তোমাকে রায়পুরের ইতিহাস জানতে হবে, কিন্তু সে-সব কথা আগাগোড়া বলতে গেলে রাত্রি হয়ত শেষ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে তোমাকে বলব। ভদ্রমহিলা একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। ঘরের ওয়াল-ক্লকটায় রাত্রি বারোটা ঘোষণা করলে ঢং ঢং করে।
ঠিক মধ্যরাত্রি।
ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা। স্তব্ধতা।
উত্তরের খোলা জানালাপথে শীত-রাত্রির ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।
জায়গাটার আসল নাম রায়পুর নয়, যদিও আজ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর ধরেও জায়গাটাকে রায়পুর বলে সকলে জানে। ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন মৃদু ধীর কণ্ঠে, সুহাস ও সুবিনয় মল্লিকের পিতা রায়বাহাদুর রসময় মল্লিক ছিলেন রায়পুরের পূর্বতন রাজা শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের দত্তক পুত্র। শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়রা তিন ভাই। তাঁদের পূর্ববর্তী সাত পুরুষ ধরে জমিদার রাজা ওঁদের উপাধি। বহু ধন-সম্পত্তির মালিক ওঁরা। শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের যখন কোনো। ছেলেমেয়ে হল না, তখন বৃদ্ধ বয়সে তিনি রসময়কে দত্তক গ্রহণ করলেন। শ্রীকণ্ঠ মল্লিকদের একমাত্র সহোদরা বোন কাত্যায়নী দেবীর একমাত্র সন্তান হচ্ছেন আমার মৃত স্বামী। আমার নাম সুহাসিনী। আমি আমার স্বামীর মুখেই শুনেছিলাম, তাঁর দাদামশাই শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিকের পিতা নাকি মরবার আগে একটা উইল করে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃসেই উইল আইনসিদ্ধ করবার পূর্বেই অকস্মাৎ শ্রীকণ্ঠ মল্লিক একদিন ওঁদের মহাল নৃসিংহ গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়ে অদৃশ্য আততায়ীর হস্তে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। উইলের ব্যাপারটা অবিশ্যি তাঁর নিহত হওয়ার পর একান্ত আপনার জনদের মধ্যে অল্পবিস্তর জানাজানি হয়।
উইলের মধ্যে অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ওঁদেরই জমিদারীর নায়েব শ্রীনিবাস চৌধুরী মহাশয় ও শ্রীকণ্ঠের ছোট ভাই সুধাকণ্ঠ মল্লিক। যদিও শ্রীকণ্ঠ মল্লিক মহাশয়ের নিহত হওয়ার পরও প্রায় বৎসর খানেক পর্যন্ত নায়েবজী বেঁচে ছিলেন, তবু উক্ত উইলের ব্যাপারটা বাইরের কেউই জানতে পারেনি; অনাত্মীয় দু-একজন জানতে পারলেন নায়েবজীর মৃত্যুর দু-দিন আগে। যদিচ নায়েবজী নিজেও জানতেন না যে এ ব্যাপারটা তখন কিছুটা জানাজানি হয়ে গেছে। যা হোক, অনেকদিন থেকেই নায়েবজী হৃদরোগে ভুগছিলেন, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি, সেই সময় আমার শাশুড়ী কাত্যায়নী দেবী (সম্পর্কে নায়েবজীর ভ্রাতৃবধূ) নায়েবজীর রোগশয্যার পাশে ছিলেন। মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে নায়েবজী তাঁর বৌদি কাত্যায়নী দেবীকে ঐ উইলের কথা সর্বপ্রথম বলেন এবং এও বলেন, সেই উইলের প্রধান অন্যতম সাক্ষী স্বয়ং তিনি নিজে, এবং উইলের ব্যাপার সব কিছুই জানেন, তথাপি শ্রীকণ্ঠ মল্লিকের মৃত্যুর পর সিন্দুকের মধ্যে সে উইলের আর কোনো অস্তিত্বই নাকি পাওয়া যায়নি। উইলের কোনো হদিস পাননি বলেই এবং আইনের দ্বারা উইলটি সিদ্ধ করা হয়ে ওঠেনি বলেই, নেহাৎ নিরুপায় তিনি ও সম্পর্কে এতদিন কোনো উচ্চবাচ্যই করতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্বগীয় কতার সেই ইচ্ছা, যা কোনোদিনই সফল হতে পারল না, তার আভাস অপূর্ণ খেদোক্তির মধ্য দিয়ে কাত্যায়নী দেবীকে জানিয়ে গেলেন যে কেন, তা তিনিই জানেন।
কাত্যায়নী দেবী সমস্ত শুনে গেলেন নীরবে, এবং ঘুণাক্ষরেও আভাসে বা ইঙ্গিতে প্রকাশ করলেন না যে ঐ ব্যাপার আগে হতেই তিনি কিছুটা জানতেন। ঐ সময় আমার স্বামী সবে ওকালতি পাস করে ওকালতি শুরু করেছেন এবং সুধীন—আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র আড়াই বৎসর। আমার শ্বশুরের মৃত্যু তারও বারো বৎসর আগে হয়। নায়েবজীর মৃত্যুর পর মা গৃহে ফিরে এলেন। এবং তারই মাস তিনেক বাদে হঠাৎ একদিন আমার স্বামী ওকালতি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রায়পুরের স্টেটের ম্যানেজারের পদ নিয়ে রায়পুরে গেলেন। রসময় মল্লিক তখন জমিদারীর সর্বময় কর্তা। এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা থামলেন।
কিরীটী নির্বাক হয়ে একমনে রায়পুরের পুরাতন ইতিহাস শুনছিল।
আমার শ্বশুর মশায়ের মৃত্যুর পর হতেই–উনি আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের সংসারের অবস্থা দিন-দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পরে মার মুখে শুনেছি, কী অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়েই না তিনি আমার স্বামীকে মানুষ করেছিলেন। যা হোক রায়পুরের স্টেটে চাকরি পেয়ে আবার সকলে সুখের মুখ দেখলেন। কিন্তু সেও প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঠিক পূর্বে যেমন ক্ষণিকের জন্য আলোর শিখাটা একটু বেশী উজ্জ্বল হয়েই আবার নিভে যায়, তেমনি। কারণ নূতন চাকরিতে আসবার মাস আষ্টেকের মধ্যেই হঠাৎ আমার স্বামী ঐ সেই নৃসিংহগ্রাম মহাল পরিদর্শন করতে গিয়েই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হলেন। ঐ ঘটনার মাস দুই আগে আমার শাশুড়ীর কাশীধামে মৃত্যু হয়েছিল।
ঠিক কি করে আপনার স্বামী নিহত হন, সে বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি?
এইমাত্র আপনাকে বললাম, আমার স্বামী নৃসিংহগ্রাম মহাল পরিদর্শন করতে গিয়েই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হন—
রায়পুর থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে ওঁদের একটা পরগণা আছে, তাকে বলা হয় নৃসিংহগ্রাম মহাল। শুনেছি সেখানে ওঁদের একটা মস্ত বড় কাছারী বাড়ি আছে ও সংলগ্ন এক বিরাট প্রাসাদ ও অট্টালিকাও আছে। রসময় মল্লিকের পিতাঠাকুরও সেই কাছারী বাড়িতেই নিহত হয়েছিলেন। ঐ নৃসিংহগ্রামে যেতে পথেই পড়ে ওঁদের প্রকাণ্ড এক শালবন, প্রকৃতপক্ষে রায়পুরের স্টেটের যা কিছু আয় বা প্রতিপত্তি ঐ শালবনের বাৎসরিক আয় থেকেই। বছরে বহু টাকার মুনাফা হয় ঐ শালবনের আয় থেকে। মঙ্গলবার আমার স্বামী সেই কাছারী-বাড়িতে যান এবং শুক্রবার রাত্রে তিনি নিহত হন। শনিবার সকালে কাছারী-বাড়িতে তাঁর শয়নকক্ষে মৃতদেহ পাওয়া যায়। কে বা কারা অতি নিষ্ঠুরভাবে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তাঁর দেহটিকে এবং বিশেষ করে তাঁর মুখখানা এমন ভাবে ক্ষতবিক্ষত করে প্রায় দেহ হতে মাথাটি দ্বিখণ্ডিত করে রেখে গেছে যে, নিহত ব্যক্তিকে তখন চেনবারও উপায় নেই। নিষ্ঠুরতার সে এক বীভৎস দৃশ্য। তারপর দুদিন পরে যখন আবার আমার স্বামীর মৃতদেহ রায়পুরে নিয়ে আসা হল, দু-দিনের মৃত সেই পচা গলা বিকৃত ও বীভৎস দৃশ্য দেখামাত্রই আমি জ্ঞান হারিয়ে সেইখানেই পড়ে যাই।
সুহাসিনী দেবী এই পর্যন্ত বলে আবার চুপ করলেন।
রসময় মল্লিকের পিতা শ্রীকণ্ঠ মল্লিককে কি ভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু জানেন? কিরীটী কিছুক্ষণ বাদে প্রশ্ন করে।
আশ্চর্য! শুনেছি ঠিক ঐ একই ভাবে।
তারপর?
তারপর রায়পুরে থাকতে আর আমি সাহস পেলাম না; আমার তিন বৎসরের শিশুপুত্রকে নিয়ে আমি আমার পিতৃগৃহে দত্তপুকুরে আমার দাদার আশ্রয়ে চলে এলাম। পরে অবিশ্যি রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক আরও বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন, এবং তিনি আমাকে সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো সাহায্যই আমি নিইনি; কারণ রায়পুরের কথা মনে হলেই আমার চোখের ওপরে আমার স্বামীর বীভৎস রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটা ভেসে উঠত। আমার স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে আজ চব্বিশ বৎসর হল। তারপর সুধীকে আমি কত কষ্টে মানুষ করলাম। সুধী বরাবর জলপানি নিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বের হল। মেডিকেল কলেজে পড়বার সময়েই এবং প্রথমটায় আমার অজ্ঞাতেই ছোট কুমার সুহাসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা হয়। সেও আজ চার-পাঁচ বছরের কথা হবে। এবং সেই সময় হতেই সুধী আমার অজ্ঞাতেই শুনেছি মাঝে মাঝে রায়পুরেও নাকি যেতে শুরু করে। ইদানীং সুহাস নিহত হবার কিছুদিন আগে হতেই প্রায় বছর দেড়েক ধরে প্রায়ই নানাপ্রকার অসুখে ভুগত। এই তো মরবার মাস পাঁচেক আগেই একবার সুহাস টিটেনাস হয়ে প্রায় যায়-যায় হয়েছিল, তখন সুধীই তার টেলিগ্রাফ পেয়ে রায়পুরে গিয়ে নিজে সঙ্গে করে সুহাসকে কলকাতায় নিয়ে এসে ভাল ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভাল করে তোলে। তুমি হয়ত বোধ হয় মামলার সময়েই শুনে থাকবে সেসব কথা। সুহাস আর সুবিনয় বৈমাত্র ভাই। সুহাসের মা মালতী দেবী আজও বেঁচে আছেন। সুবিনয় রসময় মল্লিকের মৃত প্রথম পক্ষের সন্তান।
হ্যাঁ আমি জানি, কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দেয়, মামলার সময় সংবাদপত্রেই সে সংবাদ ছাপা হয়েছিল।
দেওয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি চারটে ঘোষণা করলে।
আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি আপনার ছেলের ভার হাতে তুলে নিলাম। তবে ভাগ্যের কথা কেউ বলতে পারে না। তবুও এই আশ্বাসটুকু আজ এখন আপনাকে আমি দিতে পারি, সত্যিই যদি আপনার ছেলে নির্দোষ হয়, তবে যেমন করেই হোক তাকে আমি মুক্ত করে আনবই এবং তা যদি না পারি,তাহলে জানবেন—সে কাজ স্বয়ং কিরীটীরও সাধ্যাতীত ছিল।
তোমার ফিসের জন্য বাবা—
রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল মা, এবারে ঘরে ফিরে যান। আগে তো আপনার ছেলেকে আমি আইনের কবল থেকে মুক্ত করে আনি, তারপর না হয় ধীরেসুস্থে একদিন ফি সম্পর্কে আপনার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে।
তোমাকে যে কী বলে আশীর্বাদ করব বাবা—ওঁর কণ্ঠস্বর অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
সেটাও ভবিষ্যতের জন্য ভোলা থাক মা।
তবে আমি আসি বাবা। ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন।
আসুন। হ্যাঁ, আর একটা কথা, আমি যে আপনার কাজে হাত দিলাম, এ-কথা কিন্তু আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কাউকেই আপনি জানাতে পারবেন না, এবং আমার কাছে এসেছেন। সেকথাও গোপন করে রাখতে হবে।
বেশ বাবা, তাই হবে।
আর একটা কথা মা, আমার সঙ্গে আর আপনি দেখা করতেও আসতে পারবেন না। আপনার ঠিকানাটা শুধু রেখে যান, প্রয়োজন হলে আমিই নিজে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব।
২।১ বাদুড়বাগান স্ট্রীটে আমার ছোট ভাই নীরোদ রায়ের ওখানেই আমি আছি। হাইকোর্টে অ্যাপীল করা হয়েছে। বর্তমানে এইখানেই থাকব।
সুহাসিনী দেবী বিদায় নিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।