১.০২ কর্নেল মানরো
আমি, মোক্লের, ভারতে পৌঁছেছিলুম ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। গ্রেট ইণ্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের ট্রেনে করে বম্বাই থেকে এলাহাবাদ হয়ে কলকাতা পৌঁছেছিলুম মার্চ মাসে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিলো : ভারত-দর্শন। বিশেষ করে গঙ্গার উপকূল ধরে উত্তরাপথের সেই প্রাচীন নগরগুলো পরিদর্শন করার ইচ্ছে ছিলো খুব : প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন সম্বন্ধে যাতে একটা পূর্ণ ধারণা করে নিতে পারি, সেই জন্যেই এই সশরীরে গমনের অভিলাষ, প্রত্যক্ষ দর্শনের উৎকাঙক্ষা।
এঞ্জিনিয়ার ব্যাঙ্কস-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো পারীতে—শুধু পরিচয় নয়, রীতিমতো বন্ধুতা ও ঘনিষ্ঠতাই হয়েছিলো দুজনের মধ্যে। পারীতেই আমরা ঠিক করেছিলুম যে কলকাতায় এসে তার সঙ্গে দেখা করবো আমি—সে ততদিনে সিন্ধিয়া, পঞ্জাব আর দিল্লির রেলপথ স্থাপন করার তত্ত্বাবধান সম্পূর্ণ করে ফেলবে। কার্যক্রম অনুযায়ীই তার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো কয়েক মাসের ছুটি পেয়েছিলো সে; আর তাই আমি যখন প্রাচীন ভারতের সন্ধানে বেরুবার প্রস্তাব করলুম, উৎসাহে ও উত্তেজনায় সে একেবারে লাফিয়ে উঠলো।
কলকাতায় আসতেই ব্যাঙ্কস তার স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। তাদের একজন ক্যাপ্টেন হুড, অন্যজন কর্নেল মানরো।
সেদিন সন্ধেবেলায় এই কর্নেল মানরোর বাড়িতে বসেই আমরা আড্ডা দিচ্ছিলুম। কর্নেল মানরোর বাড়িটা কলকাতার সাহেব-পাড়ায় এক প্রান্তে, গড়ের মাঠের পাশে, যেদিকে গাড়ি-ঘোড়া বা লোকজনের তেমন ভিড় নেই-ফলে কলকাতার যাবতীয় হট্টগোল থেকে উদ্ধার পেয়ে আমরা ঈষৎ আলস্যভরে নানা বিষয়ে আলোচনা করছিলুম।
কর্নেল মানরোর বয়েস বোধহয় সাতচল্লিশ; তার এই বাংলো-বাড়িটা আসলে দেখাশোনা করে অবশ্য তার ডান হাত ও প্রধান অনুচর সার্জেন্ট ম্যাক-নীল : স্কটল্যাণ্ডের মানুষ, অনেক যুদ্ধেই সে মানরোর সঙ্গী হয়েছিলো—শুধু সার্জেন্ট হিশেবে নয়, তার প্রধান অনুচর হিশেবে। ম্যাক-নীলের বয়েস বছর পঁয়তাল্লিশ, সুগঠিত ও শক্তসমর্থ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল বেশ সুশ্রী। কর্নেলের সঙ্গে-সঙ্গে সেও ভারতীয় পল্টন থেকে অবসর নিয়েছিলো, কিন্তু পুরোেনো অভ্যাসবশত এখনও সামরিক পোশাকই পরে থাকে সবসময়।
মানবরা আর ম্যাক-নীল দুজনেই পল্টন ছেড়েছিলেন ১৮৬০ সালে। কিন্তু দেশে ফিরে না-গিয়ে দু জনেই রাজধানী কলকাতার সাহের-পাড়ায় এসে একটা বাড়ি নিয়েছেন।
ব্যাঙ্কস যখন আমাকে মানরোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়, তখন একটা বিষয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলো : খবরদার! সিপাহী বিদ্রোহ সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য কোরো না কিন্তু—আর, কিছুতেই এবং কখনও, নানাসাহেবের নামটাও উচ্চারণ কোরো তার সামনে।
কর্নেল এডওয়ার্ড মানরো স্কটল্যাণ্ডের মানুষ হলেও তাঁর পূর্বপুরুষ প্রায় একশো বছর আগে ভারতে এসেছিলেন। সার হেক্টর মানরো ১৭৬০ সালে বাঙালি পল্টনের বড়োকর্তা ছিলেন : সার হেক্টর অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম ছিলেন : তাঁর আমলে একবার একটা ছোটোখাটো বিক্ষোভের সূত্রপাত হতেই তিনি একদিনে আটাশজন বিক্ষোভকারীকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন—১৮৫৭ সালে বারেবারে যে-ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিলো।
৫৭-র অভ্যুত্থানের সময় সার জেমস উট্রামের অধীনে কর্নেল মানরো প্রথমে কানপুর, পরে লক্ষ্ণৌ অবরোধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৫৮ সালে কর্নেল মানরো নাইটকম্যাণ্ডার হন, কিন্তু তার স্ত্রী কোনোদিন নামের আগে লেডি কথাটা ব্যবহার করতে পারেননি। ৫৭ সালের ২৭ শে জুন কানপুরে যে-সমস্ত বিদেশীর মৃত্যু হয়, তার স্ত্রী ছিলেন তাদেরই একজন। সার এডওয়ার্ড (বা কর্নেল মানরো) তার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, স্ত্রীর মৃত্যুতে স্ত্রীর অকাল নিধনের জন্যে জীবনে তার একটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলো—যেহেতু নানাসাহেব ছিলেন বিদ্রোহের নেতা, সেইজন্যে যেমন করে হোক তাকে কোতল করতেই হবে। এটাই যেন তার জীবনের চরম উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো–সেইজন্যেই, যাতে কায়মনোবাক্যে নানাসাহেবের সন্ধান করতে পারেন, সমরবিভাগ থেকে তিনি অকালে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেন। সার্জেন্ট ম্যাক-নীলও সেইসঙ্গে কর্মে ইস্তফা দিলে, আর প্রভুর সঙ্গে নানাসাহেবের সন্ধানে গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু নানাসাহেব কেবল এই দুজনের চোখেই ধুলো দেননি, সমগ্র গোয়েন্দাবিভাগকে পর্যন্ত নাজেহাল করে দিয়েছিলেন। কেউ তার খোঁজ পেলে না। তিন বছর একটানা খোঁজবার পর হঠাৎ যখন জনরব উঠলো যে নানাসাহেব নেপালের জঙ্গলে প্রাণত্যাগ করেছেন, তখন সার এডওয়ার্ড আর সার্জেন্ট ম্যাক-নীল কলকাতায় এসে নিরিবিলিতে একটা বাংলোবাড়ি ভাড়া করে অবসর জীবন যাপন করতে লাগলেন। কিন্তু এতদিন কেটে গেলেও সিপাহী বিদ্রোহের কথা উঠলেই তার বুকের ক্ষত যেন আবার নতুন হয়ে ওঠে, হাত মুঠো হয়ে যায়, চোখের তারা ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। বাড়ি ছেড়ে বেরোন না তিনি কখনও, এমন বই তিনি স্পর্শও করে দ্যাখেন না যাতে ঘুণাক্ষরেও ১৮৫৭-র কোনো উল্লেখ আছে।
এত-সব আমাকে বলেছিলো ব্যাঙ্কস। কয়েকদিন ধরে বম্বাইতে যে-গুজবটা শোনা যাচ্ছিলো যে নানাসাহেব নাকি হঠাৎ সেখানে পুনরাবির্ভূত হয়েছেন, তা সম্ভবত সার এডওয়ার্ডের কানে পৌঁছোয়নি—পৌঁছুলে তিনি হয়তো তক্ষুনি আবার নবোদ্যমে বেরিয়ে পড়তেন। এখন তার বন্ধু আর সঙ্গী বলতে আছে ব্যাঙ্কস আর ক্যাপ্টেন হুড। তারাই রোজ দেখা করতে যায় তার সঙ্গে; দু-বেলা গল্পগুজব করে আড্ডা দেয়, আর সার এডওয়ার্ডের বেদনাকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করে।
ব্যাঙ্কস আসলে গ্রেট ইণ্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ের নির্মাতা, কাজ শেষ করে এখন প্রায় এক বছরের ছুটি পেয়েছে; পরের বছর কলকাতা-মাদ্রাজ বা বঙ্গোপসাগর থেকে আরবসাগর পর্যন্ত লম্বা মস্ত-এক রেলপথ বসানো হবে, তারই প্রাথমিক খশড়া শেষ করছে। তার মাথার মধ্যে সবসময়েই কলকজার ঘটাং-ঘটাং বেজে চলেছে। কতযে অদ্ভুত পরিকল্পনা তার মাথায় জাগে, তার কোনো ঠিক নেই। এই মুহূর্তে সে-যে কোনো-একটা অদ্ভুত আবিষ্কার নিয়ে তম্ময় তা তার সঙ্গে আড্ডা দিতে-দিতেই বুঝতে পারলুম। কিছুই খুলে বললে না, বোঝা গেলো হঠাৎ একদিন এক নাম না-জানা কল হাজির করে সবাইকে তাজ্জব করে দিতে চায়।
ক্যাপ্টেন হুড আসলে তারই বন্ধু। ১৮৫৭র বিদ্রোহের সময় সে সমরবিভাগে ছিলো : অযযাধ্যা আর রোহিলখতে গিয়েছিলো সে, পরে মধ্যভারতে গোয়ালিয়র অভিযানের সময় সার হিউ রোজকে সাহায্য করেছিলো। হুডের বয়েস তিরিশের বেশি নয়, ছেলেবেলা থেকেই ভারতে আছে, বিখ্যাত মাদ্রাজ ক্লাবের সে সদস্য। তামাটে তার চুল আর দাড়ি, আর যদিও সে ছিলো গোরা বাহিনীতে—কিন্তু আসলে ভারতবর্ষই যেন তার দেশ-এবং সব দিক দিয়েই সে সম্পূর্ণ ভারতীয়—এই বিচিত্র ও বিপুল দেশকে সে মাতৃভূমির মতো ভালোবাসে। শুধু তা-ই নয়, তার মতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো সে নাকি এখানেই, এখানেই, এখানেই। পাহাড়ে চড়ার খুব শখ, ভালো শিকারি, আর দুর্ধর্ষ পথিক। এখনও হিমালয়ে ওঠবার সুযোগ তার হয়নি, কিন্তু হিমালয়ই তার শেষ স্বপ্ন। ওই তুষারমৌলির ধবল শৃঙ্গই নাকি তার সাফল্য ও সার্থকতার ঝকমকে মুকুট হবে।
ব্যাঙ্কস আর হুড অনেকবার সার এডওয়ার্ডকে নিয়ে দেশ-ভ্রমণে যাবার প্রস্তাব করেছে, কিন্তু কর্নেল অবিচল। সেদিন সন্ধেবেলায় আবার কথাটা উঠলো—সূত্র অবিশ্যি ছিলুম আমি আর ব্যাঙ্কস। আমরা যে উত্তরাপথ ভ্রমণ করার সংকল্প নিয়েছি, সে-কথা শুনে হুড বললে, হেঁটে না-বেড়ালে আর কী মজা! রেলে গিয়ে মজা নেই। ব্যাঙ্কস আবার হন্টন কি অশ্বতরের বিরোধী। ফলে পাল্কি বা চতুর্দোলা ছাড়া আর কীসে যাওয়া যায়?
দূর-দূর, ব্যাঙ্কস বললে, ও-সব আদ্যিকেলে বাহনে আবার কেউ বেরোয় নাকি!
কেন, তোমার ওই ঝমরঝম ঘটাংঘট রেলগাড়ির চেয়ে এখানকার গোরুর গাড়ি ঢের ভালো, হুড জানিয়ে দিলে।
হ্যাঁ, একটা চারচাকার গাড়ি তারা এমনভাবে টেনে নিয়ে যায় যে মনে হয় চিনসমুদ্রে টাইফুন উঠেছে-ব্যাঙ্কস বললে।
তা হয়তো সেকেলে লোকজনের মনে হয়, কিন্তু তাহলেও ছন্দ আর দোলার জন্য চতুর্দোলাই ভালো–তোমার রেলগাড়ির চেয়ে তো ভালো—
চতুর্দোলা! পাল্কি! ব্যাঙ্কস হেসে উঠলো, কফিন বলো না কেন ওটাকে—ভিতরে তো মড়ার মতোই শুয়ে থাকতে হয়।
কিন্তু আরাম কত! শুয়ে বসে যেতে পারবে-প্রত্যেক স্টেশনে তোমাকে কেউ কাঁচা ঘুম থেকে তুলে টিকিট দেখতে চাইবে না—তাছাড়া তোমার ও-সব এক্সপ্রেস ট্রেনের চেয়ে অনেক নিরাপদও বটে!
সবচেয়ে ভালো হয়, আমি বললুম, কেউ যদি নিজের বাড়িটা নিয়েই বেড়াতে বেরুতে পারে!
শামুক কোথাকার! ব্যাঙ্কস হেসে উঠলো!
বন্ধু-হে, আমি বললুম, শামুক ইচ্ছেমতো তার ভোলা থেকে বেরুতে আর ঢুকতে পারে—আর তার ওই খোলার বাড়ি নিয়েই বিশ্বভ্রমণে বেরোয়। তা শামুক হতে পারলে মন্দ হতো নাকি! চলন্ত বাড়ি-নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে পারছে ইচ্ছেমতো-আমার তো মনে হয় যানবাহনের উন্নতির একেবারে চূড়ান্ত স্তরে না-পৌঁছুলে তা আর সম্ভব হবে না!
কর্নেল মানরো এতক্ষণে মুখ খুললেন।একথা ঠিক। যদি বাড়িতে বসে-বসেই দেখতে পাই দিগন্ত ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে, কেবলই বদলে যাচ্ছে পারিপার্শ্বিক কি জলহাওয়া, তাহলে……
তাহলে আর নতুন জায়গায় গিয়ে ডাকবাংলো খুঁজে মরতে হবে না—হুড বললে, কে জানে বাপু অচেনা ডাকবাংলোয় অসুবিধে কত, ঠিকমতো স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যাবে কি না, তার উপর হ্যাঙ্গামের অন্ত আছে? স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়ে এসো—যত রাজ্যের হ্যানোত্যাননা! অথচ নিজের বাড়িটা চলতে পারলে যখন খুশি যেখানে খুশি দিব্যি খুটি গাড়া যেতো। বৈঠকখানা, খাবার ঘর, রান্নাঘর, লাইব্রেরি, শোবার ঘর তো আছেই-সঙ্গে নিজের পছন্দসই বাবুর্চি আছে। আহা-তেমন দিন যদি আসে, বুঝলে ব্যাঙ্কস, তেমন দিন এলেই বুঝবো যে সত্যি-সত্যি সভ্যতার অগ্রগতি হলো। তোমার ও-রেলগাড়ির চেয়ে একশোগুণ ভালো, এ-কথা মানবে তো?
মানবো না কেন, খুব মানি। তবে এর চেয়েও ভালো বাহনের পরিকল্পনা করা যায়, সেটাও বলি এই সঙ্গে।
এর চেয়েও ভালো?
নিশ্চয়ই। তুমি বলেছো যে রেস্তোরাঁ-কার, স্লিপিং-কার-ওলা ট্রেনের চেয়েও তোমার চলন্ত বাড়ি ঢের ভালো—আচ্ছা, তা না-হয় মানলুম। কিন্তু লোকে তো ব্যাবসাসূত্রেও কত জায়গায় যায়, তার বেলা? অত-বড়ো বাড়ি নিয়ে তো তুমি সব জায়গায় যেতে পারবে না। ফলে তুমি তোমার আকল্প জানালে এক স্থপতিকে-খুদে মাপের একটা বাড়ি তৈরি করে দেবার জন্যে, আর সে তোমার ভাবনাকে কাজে তরজমা করলে—তুমি একটা বাড়ি পেয়ে গেলে, যার ভিত মাটির তলায় শিকড় গেড়ে বসেনি–এখানে-ওখানে তাকে সরিয়ে নেয়া যায়। সব আরামের ব্যবস্থাই আছে তাতে, সব রাস্তারই উপযোগী হলো সেটি, সরুগলিতে আটকে যাবার ভয় নেই। ধরো, আমাদের বন্ধু কর্নেল মানরোর জন্যই এ-রকম একটা সচল বাড়ি বানানো হলো; তিনি আমাদের আমন্ত্রণ করলেন তার বাড়িতে করে আর্যাবর্তে বেড়িয়ে আসার জন্যে-শামুকদের মতোই অনেকটা-কিন্তু তার চেয়েও ভালো-খোলার সঙ্গে জন্মসূত্রেই চির-আটক নয়। ঠিকঠাক সব ব্যবস্থা হলো—তোমার বাবুর্চি, রান্নাঘর—কিছুই বাদ গেলো না। যাত্রার দিন ঠিকঠাক। এমন সময়-হা-হতোস্মি!– এ-বাড়ি টেনে নিয়ে যাবে কে?
কেন? গোরু-ঘোড়া-খচ্চর?
ডজন-ডজন গোরু-ঘোড়া লাগবে তো তাহলে—
তাহলে হাতি-হ্যাঁ, হাতিই টেনে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া হাতি হচ্ছে আভিজাত্যের প্রতীক, একেবারে দিগ্বিজয়ী রাজার মেজাজ এনে দেবে। একদল হাতি থাকবে, দিব্যি হেলতে-দুলতে গজেন্দ্রগমনে এগুবে বাড়িটা। কেমন, চমৎকার হবে না?
হুঁ, চমৎকার দেখাবে বটে, কিন্তু—
আবার কিন্তু!—
এই কিস্তুটা বেশ বড়োই! ওই হস্তীযুথের মতোই প্রকাণ্ড!
তোমাদের এঞ্জিনিয়ারদের কারবারই আলাদা। কেবল একটার পর একটা বাধার কথা তোলো—
সে-বাধা আবার জয়ও করে ফেলি, ব্যাঙ্কস জানালে মৃদুস্বরে।
তাহলে তোমার নিজের কিন্তুটাই জয় করে দেখি!
করবো তো বটেই। শোনো তবে! শুনলেন তো মানরো, ক্যাপ্টেন হুড কতকত বাহনের নাম করলে—কিন্তু তারা প্রাণী বলে তাদের অসুখ-বিশুখ হতে পারে, কখনও ক্লান্ত হয়েই পড়বে-বা—আর তাদের খাদ্য-সেটা জোগাবে কে? আসলে চলন্ত বাড়ি ব্যাপারটা তখুনি সম্ভব হবে, যখন এটা বাষ্পে বা স্টীমে চলবে।
আর রেললাইন দিয়ে ঘটাং-ঘটাং ঘটঘট করে এগুবে? হুড কেবল কাঁধ ঝকালে। ব্যাঙ্কস যে এ-কথা বলবে তা আমি জানতুম।
না, রেললাইন লাগবে না। তক্ষুনি বললে ব্যাঙ্কস, লাগবে কেবল একটা উঁচু জাতের ট্র্যাকশন-এঞ্জিন–
শাবাশ! হুড তারিফ করে উঠলো, তোমার ওই চলন্ত বাড়ি যদি রেললাইনের কয়েদি না-হয়, তাহলে আমি ওই স্টীমের কথায় রাজি আছি।
কিন্তু ব্যাঙ্কস, আমি বললুম, তোমার এঞ্জিনেরও খাদ্য চাই গোরু-ঘোড়া হাতির মতো—সে-খাদ্য না-পেলে তোমার ওই কলকারখানাও বিকল হয়ে পড়বে।
একটি স্টীমের ঘোড়া অনেকগুলো সত্যিকার ঘোড়ার চেয়ে বলশালী, বললে ব্যাঙ্কস, আর এই অশ্বশক্তি যত-ইচ্ছে বাড়িয়ে তোলা যায়। স্টীমের ঘোড়ার অসুখ নেই, অবসাদ নেই, রোদে-বৃষ্টিতে, জলে-ঝড়ে সব অবস্থায় সব জায়গায় সে সমানভাবে এগুতে পারে। বুনো জানোয়ারের ভয় নেই তার, সাপে তাকে কাটতে পারবে না, পোকামাকড় হুল ফোঁটাতে পারবে না; বিশ্রাম নেই, নিদ্রা নেই, একটানা সে যেতে পারবে, চাবুক লাগবে না, ধমকাতে হবে না, তাড়া দিতে হবে না। অর্থাৎ রান্না করে খেতে না-চাইলে আসল ঘোড়ার চেয়ে সব দিক থেকেই ভালো এই স্টীমের ঘোড়া। একটু কেবল তেল লাগবে-কলকজা শড়গড় রাখার জন্যে, আর লাগবে কিছু কাঠ বা কয়লা। আর জানোই তো, মোক্লের, ভারতে বন-জঙ্গলের অভাব নেই—কাজেই কাঠের জন্যে তোমাকে একটুও হন্যে হতে হবে না!
বেড়ে বলেছো, চমৎকার। ক্যাপ্টেন হুড বললে, স্টীমের ঘোড়া জিন্দাবাদ! আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি ভারতের দীর্ঘ পথ ধরে চলেছে এক সচল প্রাসাদ-তার নির্মাতা ব্যাঙ্কস নামে এক মস্ত এঞ্জিনিয়ার-জঙ্গল কুঁড়ে সে চলেছে, বাঘ সিংহ ভাল্লুক তার গায়ে আঁচড়টি কাটতে পারছে না, আর আমরা দেয়ালের আড়ালে বসে তোফা শিকার করে যাচ্ছি। আঃ, ভাবতেও আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে, ব্যাঙ্কস। আহারে! যদি আর পঞ্চাশ বছর পরে আমার জন্ম হতো!
কেন? পঞ্চাশ বছর পরে জন্মাতে চাচ্ছো কেন?
কারণ পঞ্চাশ বছর পরেই তো তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে—তখন আমরা বাষ্পেচলা বাড়ি পাবো
চলন্ত বাড়ি তো কবেই বানিয়েছি আমি, ব্যাঙ্কস মৃদুস্বরে জানালে।
বানিয়েছে? তুমি?
ক–বে! দেখলে বুঝবে যে তোমাদের সব কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
তাই নাকি? হুড চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো, তাহলে আর দেরি কেন? এসো, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি।
ব্যাঙ্কস, তাকে শান্ত হতে বলে, সার এডওয়ার্ড মানরোর দিকে ফিরে তাকালে। সার এডওয়ার্ড, যদি আজ থেকে এক মাসের মধ্যে একটা কলে-চলা বাড়ি এনে আপনার হাতে সমঝে দিই, তাহলে মোরে, হুড আর আমার সঙ্গে আপনি উত্তরাপথ বেড়াতে যেতে রাজি আছেন তো?
ব্যাঙ্কসের গলার আগ্রহ দেখে মানরো খানিকক্ষণ একটু সীরিয়াসভাবে ভাবলেন। রাজি আছি! ব্যাঙ্কস, যত টাকা লাগে দেববা—কেবল হুড যা কল্পনাও করতে পারেনি, তেমনি একটা কলে-চলা বাড়ি এক মাসের মধ্যে এনে দাও আমাদের-আমরা তাহলে সারা ভারত ঘুরে বেড়াবো।
অমনি হুড তিনবার জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো। নেপালে শিকারটা এবার তোফা জমবে!
ঘরের ভিতর এই শোরগোল শুনে ম্যাক-নীল অবাক হয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালে।
ম্যাক-নীল, মানরো বললেন, আমরা এক মাসের মধ্যেই উত্তরাপথ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বো। তুমি সঙ্গে যাবে তো?
আপনি গেলে, নিশ্চয়ই যাবো, ম্যাক-নীল তার চিরকেলে শান্ত গলায় জানালে।
–মঁসিয় মোক্রের-এর দিনপঞ্জি আপাতত শেষ–