২. একটি সরেজমিন তদন্তের উদ্দেশে
সেই সময়ে কোনাক্রি, যদিও ছিলো ফরাশি-গিনির রাজধানী আর খোদ লাটসায়েবের আবাসস্থল, সাধারণ একটা অজপাড়াগাঁর মতোই ছিলো। সাতাশে নভেম্বর সে-বছর এই কোনাক্রিতে একটা মেলা বসেছিলো। স্বয়ং লাটসায়েবের আমন্ত্রণে ঝেঁটিয়ে এসেছে গ্রামগঞ্জের লোক, সবাই দল বেঁধে চলেছে সমুদ্রতীরে, সেখানে তারা স্বাগত জানাবে কয়েকজন বিখ্যাত মানুষকে, তাঁরা সদ্য এসে নেমেছেন তাঁদের পোত থেকে।
বিখ্যাত বলে বিখ্যাত। এঁরা সবাই সবমিলিয়ে সাতজন-ফ্রান্স্ থেকে এসেছেন-লোকসভা নিয়োজিত এক অতিরিক্ত কমিশন, তাঁরা সন্ধান ক’রে দেখবেন ফরাশি সুদানের সেই অংশটাকে, স্থানীয় লোকেরা যাকে বলে নাইজার নদীর বাঁক। সত্যি-বলতে, এই কমিশন স্বেচ্ছায় এখানে আসেনি–সদস্যসভার সভাপতি এবং উপনিবেশ দফতরের মন্ত্রীমহোদয় যে এই সরেজমিন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, তাও খুব গায়ে প’ড়ে নয়। মন্ত্রীসভার সদস্যদের চাপে প’ড়েই তাঁরা বাধ্য হয়েছেন এই তদন্তের ব্যবস্থা করতে-না-হ’লে বাগ্মিতার ফুলঝুরিতে মন্ত্রিসভা দিনের পর দিন শুধু ঝলমলই ক’রে উঠতো, কাজের কাজ কিছু হ’তো না। বক্তৃতার সুযোগ পেলে কোন ফরাশিই বা সহজে বা স্বেচ্ছায় মুখে কুলুপ আঁটে?
এই মিশনকে আফ্রিকার যে-অংশে সন্ধান চালাতে বলা হয়েছে, তা নিয়ে কয়েক মাস আগে প্রচণ্ড তর্কাতর্কির ফলে মন্ত্রিসভা একেবারে যেন দু-আধখানাই হ’য়ে যায়। দুই দুর্ধর্ষ নেতার দ্বন্দ্বযুদ্ধে-বাগ্মিতার অবিশ্যি গোটা সংসদই এমনভাবে তেতে উঠেছিলো, শুধু-কথায়, আপোষে, তার কোনো রফা হ’তো ব’লে কারুরই মনে হয়নি। একদলের নেতা বারজাক, আর অন্যদলে বোদ্রিয়ের। বারজাক মানুষটি বেশ গোলগাল, নধরকান্তি, নাদুশনুদুশ, মুখে প’রে আছেন ঘন- কালো দাড়ি-কোনো পাখার মতো। প্রভঁসের লোক, শক্ত-শক্ত দাঁতভাঙা কথা বলেন, আর তাঁর খটোমটো বক্তৃতায় সহজ-সাবলীল কোনো ছন্দ না-থাকুক বেদম তোড় ছিলো-এমনিতে মানুষটি বেশ হাসিখুশি, আর যাঁকে বলা যায়, কেতাবিভাষায়, সংবেদনশীল। অন্যজন উত্তরের মানুষ, আর বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর চেহারাতেই সেটা মালুম হ’তো। শুকনো চিমশেপানা মুখ, শরীরটা লিকলিকে কাঠখোট্টা, চিবুকের দু-পাশে ঝুলে পড়েছে একটা গোঁফ কিন্তু সেটা নামেই—কেননা বিরলশ্মশ্রুই বটে আদপে, অলবড্যে আর একগুঁয়ে, তিনি প্রকৃতির এক স্বভাবমন্দদৃষ্টি সৃষ্টি। এঁর প্রতিদ্বন্দ্বী যেকালে বপুদেশ আরো প্রসারিত করতে পারলেই খুশি হতেন, ইনি যেন পারলে ভাঁজ হ’য়ে আরো-গুটিয়ে গিয়ে শুটকোমতো হ’য়ে যেতে চাইতেন, হৃদয়টাও তাঁর যেন কৃপণের সিন্দুকের মতো তালাবন্ধ। দীর্ঘদিনের দুই সাংসদ, তাঁরা দুজনেই উপনিবেশ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ- উপনিবেশ সম্বন্ধে কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হ’লেই তাঁদের কাছে মতামত চাওয়া হ’তো। অথচ বিস্তর কেতাব, পুঁথি, নথিপত্র, প্রতিবেদন গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন ক’রে দুজনে ঠিক বিপরীতধর্মী দুই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতেন। কেননা তথ্য হ’লো এটাই যে এঁরা ক্বচিৎ-কখনও একমত হতেন। বারজাক কোনো মন্তব্য করলেই হ’লো, এক ফ্রাঙ্কে দশ ফ্রাঙ্ক দেবো, বোদ্রিয়ের ঠিক তার উলটো কথা বলবার জন্যে নাছোড় বায়না ধরে বসবেন। আর দুজনের বক্তৃতায় যখন কাটাকুটি খেলা হ’তো, সংসদ বাধ্য হ’য়ে ভোট নেবার ব্যবস্থা করতো—আর সেই ভোটাভুটি হ’তো মন্ত্রীমহোদয়ের অভিরুচি অনুযায়ী।
এবার কিন্তু বারজাক, বা বোদ্রিয়ের কেউই সূচ্যগ্র ভূমি ছাড়তেই রাজি ছিলেন না, মনে হচ্ছিলো এই তুলকালাম তর্কাতর্কিটা বুঝি অনন্তকাল ধ’রেই চলবে। শুরু হয়েছিলো বারজাকের প্রস্তাবিত উপনিবেশ-বিধি প্রণয়ন নিয়ে : সেনেগাল, সামরিয়া, আপার-গিনি আর নাইজারের পশ্চিমে যে ফরাশি-সুদান আছে, তাদের প্রত্যেকটির একজন ক’রে সাংসদ চাচ্ছিলেন বারজাক, শুধু তা-ই নয়, বর্ণবৈষম্যের বালাই না-রেখে কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধিদেরও ভোট দেবার অধিকার দিতে হবে—এটাই ছিলে। বারজাকের প্রস্তাব। তক্ষুনি ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে গেলো : বোদ্রিয়ের এই প্রস্তাবে তড়াক ক’রে লাফ দিয়ে উঠেছিলেন তাঁর আসন ছেড়ে, আর দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই পরস্পরকে লক্ষ্য ক’রে যুক্তির কামান দাগতে শুরু করেছিলেন। বারজাক বিস্তর সরকারি-বেসরকারি তথ্য উল্লেখ ক’রে দাবি করেছিলেন কাল। আদমিরাও সভ্য লোক, ক্রীতদাসপ্রথা রদ ক’রে ফায়দাই বা কী –যদি-না তাদের কোনো অধিকার দেয়া যায়, নিজেদের ভাগ্য তাঁরা নিজেরাই নির্ধারণ করুক, আর তাঁর ভাষণ তিনি সাঙ্গ করেছিলেন মন্ত্রের মতো তিনটি কথা ব’লে : সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা। তাঁর যুযুধান প্রতিপক্ষের বক্তব্য : কালা আদমিরা সভ্য তো নয়ই, বর্বরের চুড়ান্ত, আর শাদা আদমিদের দায় হচ্ছে সভ্যতার আলোকবর্তিকা জ্বেলে তাদের অন্ধকার থেকে আলোকছটায় নিয়ে-আসা, আর কেউ কি কোনোদিন কোনো অসুখ-ভোগা বাচ্চাকে জিগেস ক’রে : বাছা, এই ওষুধটা তোমার মনে ধরবে কি? এ-রকম একটা ভয়ালভংকর পরীক্ষানিরীক্ষার সময় এটা নয়, বরং সেখানে আরো-বেশি ক’রে ফৌজ পাঠানো-উচিত, যে-সব কালো আদমি একটু- একটু ট্যা-ফোঁ করছে তাদের পিটিয়ে ঠাণ্ডা ক’রে দেয়া উচিত, অঙ্কুরেই বিনাশ ক’রে ফেলা ভালো বিদ্রোহের স্পর্ধা বা আগাছা। তিনিও বিস্তর সরকারি- বেসরকারি প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, বললেন যে যার গায়েই বিশুদ্ধ ফরাশি রক্ত আছে তারই আফ্রিকার ঐসব এলাকায় চিরকাল ফরাশি রাজত্ব কায়েম ক’রে রাখার চেষ্টা করা।
উপনিবেশ দফতরের মন্ত্রি তো মহা ফাঁপরে পড়লেন। তাঁর মনে হলো দুই তরফের কথাতেই কিঞ্চিৎ সত্য আছে। নাইজারের বাঁকে যে-সব কালো আদমি থাকে, তারা ফ্রান্সের সুশাসনে বেশ অভ্যস্ত হ’য়ে গেছে, অজ্ঞানের অন্ধকারে যে-আফ্রিকা ছায়াছন্ন ছিলো সেখানে শিক্ষার আলোক বেশ ভালোভাবেই ঢুকে পড়েছে—হ্যাঁ-হ্যাঁ, পাশ্চাত্য শিক্ষাই আর জনজীবনের নিরাপত্তার কোনোপ্রকারে বিঘ্নিত হবার কোনো লক্ষণই সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তবে কিছু-কিছু কালা আদমি আস্কারা পেয়ে-পেয়ে একেবারে মাথায় উঠেছে—তাদের একটু কড়কে দেয়াই ভালো। প্রায়ই খবর আসছে গণ্ডগোলের, অতর্কিত উপদ্রব আর হামলার; কোনো কারণ নেই, গাঁকে গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছে—লোকজন সব ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আর, এখনও গুজব ব’লেই মনে হয়, তবে একটু কি আর সত্য নেই, যে আফ্রিকার মাটিতে কোনো-একটা অজ্ঞাত স্বাধীন শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। পিঁপড়ের পাখার মতোই কালা আদমিদের এ-সব শখসাধ গড়াচ্ছে বুঝি-বা।
প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন কিন্তু মন্ত্রীমহোদয়ের ভাষণে নিজের-নিজের বক্তব্যের সমর্থনে বিস্তর যুক্তি-তথ্য খুঁজে পেলেন। শেষটায় তর্কাতর্কি এমন-এঁড়ে আর অসহ্য হ’য়ে উঠলো যে, একজন সাংসদ অসহিষ্ণু হ’য়ে ব’লেই বসলেন : ‘এতই যদি মতবিরোধ, তবে অন্য লোকের কথায় কান দেয়া কেন—গিয়ে নিজের চোখে দেখে এলেই হয়। সারেজমিন তদন্ত ক’রে।’
মন্ত্রীমহোদয় উবাচ : ও-অঞ্চলটায় এতবার লোকজন গিয়ে সে নিয়ে এত কথা লিখেছে যে সেখানে নতুন ক’রে কিছু আবিষ্কার করার নেই। তবে সংসদ চাইলে তিনি সংসদের মতেই সায় দেবেন। সাংসদরা যদি মনে করেন যে কোনো সরেজমিন তদন্তের বিশেষ দরকার আছে, তাহ’লে, বেশ, তিনি সানন্দেই নিজেকে সেই তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে নেবেন-আর এই অভিযানের নেতৃত্ব কে দেবেন, বেশ-তো, সাংসদরাই তা ঠিক ক’রে দিন না।
এ-প্রস্তাবটার সাফল্য একেবারে চোখধাঁধানো। সভা আপাতত মুলতুবি রইলো, মন্ত্রীমহোদয় মিশনের সভ্য বাছাই ক’রে দেবেন, যদ্দিন-না এই মিশন তার সুচিন্তিত প্রতিবেদন জমা দেয় ততদিন সংসদ এ-বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
কিন্তু বললেই হ’লো, অমুকের ওপর মিশনের নেতৃত্ব দেয়া হ’লো? অত- সোজা নাকি ব্যাপারটা? ভোটাভুটি ক’রে দেখা গেলো বারজাক আর বোদ্রিয়ের দুজনেই সমান-সমান ভোট পেয়েছেন। অথচ ব্যাপারটার তো একটা-কিছু নিষ্পত্তি করতেই হয়। ফরাশি সংসদে রসিক লোকের কোনো খামতি নেই। তাঁদের একজন ফোড়ন কাটলেন : ‘তাতে আর কী? দুজনকেই যুগ্মভাবে মিশনের নেতা ক’রে দেয়া হোক!’ আর অমনি প্রস্তাবটা সাগ্রহে সবাই লুফে নিলেন : দুজনকেই যদি মিশনের সঙ্গে আফ্রিকায় চালান ক’রে দেয়া যায়, তাহ’লে চমৎকার হয়—অন্তত কয়েক মাস আর সংসদভবনে কেউই ছায়াচ্ছন্ন আফ্রিকার নামটাও করবে না। দুজনকেই তক্ষুনি মিশনের যুগ্ম-নেতা ব’লে ঘোষণা ক’রে দেয়া হ’লো। তবে চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকবে যাঁর বয়েস বেশি, তাঁর ওপর। আর হিশেব ক’রে দেখা গেলো, বারজাকই জিতেছেন, তিনি বোদ্রিয়েরের চাইতে তিনদিনের বড়ো, বোদ্রিয়ের তো মহাখাপ্পা, কিন্তু কী আর করেন, সবকিছুতেই বাগড়া দেবার জন্যে তিনি থেকে গেলেন সহ-নেতা।
এই দুজন বাদে সরকার থেকে নিয়োগ করা হয়েছে আরো কয়েকজনকে, এঁদের মতো এতটা রংদার লোক নন হয়তো, তবে এঁদের চেয়ে হয়তো বেশিই যোগ্য এবং করিৎকর্মা। তাঁদের একজন হলেন ডাক্তার শাতোনে, নামজাদা চিকিৎসক, আর এলেমও আছে বিস্তর, তাঁর প্রফুল্ল আনন মাটি থেকে পাঁচফিট আটইঞ্চি ওপরে বিরাজমান, এবং তাঁর মাথাটি ঘেরা তুষারধবল কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলে, ঝাঁটার মতো একজোড়া গোঁফও আছে তাঁর-সেও তাঁর কেশগুচ্ছেরই মতো তুষারধবল। চমৎকার মানুষ এই ডাক্তার শাতোনে, বুদ্ধিমান, তরলমতি নন কিন্তু হালকা মেজাজের, সারাক্ষণই হাসছেন-এবং বাষ্প ছাড়লে যেমন আওয়াজ হয়, সেইরকমই কোনো-একটা আওয়াজ হয় তাঁর হাসির। আর তাঁরই মতো চোখে পড়বার মতো মানুষ হলেন মঁসিয় ইসিদোর তসাঁ, ভৌগোলিক সমিতির বার্তাপ্রেরক, কিঞ্চিৎ শুস্কস্বভাব রগচটা কর্তৃত্বপ্রিয় মানুষ, ভুগোলবিদ্যায় তিনি যে মনপ্রাণই শুধু সমর্পণ ক’রে বসে আছেন তা নয়, প্রায় খ্যাপার মতোই তাঁর কাছে আরাধ্য এই বিদ্যা। আর মিশনের অন্য সদস্যরা? মাদাম, পঁসাঁ, কিরিউ, আর এইরিউ বিভিন্ন মন্ত্রীর দফতরে কাজ করেন, এমনিতে চট ক’রে কারু নজরে পড়বার মতো পাত্রী নন তাঁরা-তাঁদের ব্যক্তিত্বও কখনও উগ্রস্বভাব নয়, তাঁরা মানুষ হিশেবে অন্য-পাঁচজনের মতোই। এই সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অষ্টম একজন অভিযাত্রীও আছেন, তাঁর নাম আমেদে ফ্লরেঁস, আর তাঁর কাজ হ’লো প্রাণপণে যে-খবরকাগজে তিনি কাজ করেন তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা, অর্থাৎ তিনি একজন চটপট, ক্ষিপ্র, প্রাঞ্জল সংবাদদাতা—আর তাঁর কাগজ হচ্ছে সেই বিখ্যাত দৈনিক ল্যাক্সপাসিয়ঁ ফ্রাঁসেঈ।
এই মহোদয়গণের শুভাগমন—বলাই বাহুল্য-বচনভাষণের কারদানি দেখাবার সুবর্ণসুযোগ। যে-ই সরকারে বা শাসনব্যবস্থায় কেউকেটা লোক, সে কি আর কারু সঙ্গে দেখা হ’লে নিছকই হাতে-হাতমিলিয়ে সুপ্রভাত ব’লে তুষ্ট থাকে, তার বরং মনে হয় ইতিহাসের পৃষ্টপোষণ করার জন্যে তাঁর অন্তত ছোটোখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলা উচিত। এদিকে শ্রোতারা, যৎকিঞ্চিৎ আমোদ পেয়েই, একই কথা আগেও বার-বার শোনা সত্ত্বেও, বাগ্মীদের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘিরে থেকে একটা বলয়ই রচনা ক’রে বসে।
কেতামাফিক, খোদ লাটসায়েব, মসিয় বালদোন, তাঁর উচ্চপদস্থ সাগরেদদের নিয়ে, গম্ভীর গলায় মিশনের প্রতিটি সদস্যকে স্বাগতম্ জানালেন, নিজের সহকারীদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয়ও করিয়ে দিলেন : স্বর্গ থেকে এসে যদি এঁরা উদয় না-হ’য়ে থাকেন, তবু তো প্রায়-স্বর্গ থেকেই এসেছেন, সাতসাগর পাড়ি দিয়ে স্বেতাঙ্গভূমি থেকে এখানে –এই ছায়াচ্ছন্ন আফ্রিকায়। তবে তাঁকে কটাক্ষ করা ঠিক উচিত হবে না-তাঁর ভাষণটি ছিলো হ্রস্ব ও সুচিন্তিত। এ-রকম সারগর্ভ সংক্ষিপ্ত ভাষণের জন্যে হাততালি পাওয়াই উচিত।
বারজাক, তাঁর উত্তরে মিশনের তরফ থেকে নিচের কথাগুলো বললেন : ‘মঁসিয় ল্য গবনির্ভর, মেসিউর,’ গলা ঝেড়ে শুরু করলেন, তিনি : ‘এক্ষুনি আমরা যে-স্বাগতভাষণ শুনলুম, তাতে আমি ও আমার সহযোগীরা অভিভূত হ’য়ে গেছি। আপনাদের এই সহৃদয় আপ্যায়নকে আমরা শুভলক্ষণ ব’লেই মনে করছি। —বিশেষত আমরা যেহেতু এমন-একটা অভিযানে বেরিয়ে পড়তে চলেছি, যার কঠিন বাধাবিপত্তিকে কোনোভাবেই অত্যুক্তিভূষিত করা যাবে না—তখন সকলের শুভেচ্ছাই আমাদের যথার্থ পাথেয়। আমরা জানি যে সদাশয় সরকারের তৎপরতায় এ-সব অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রায় ফ্রাসেরই দূরভূমি এ-সব, আগের মতো রাস্তায় এখন আর তেমন হয়তো বিপদ-আপদ নেই, তবু শুভেচ্ছা সবসময়েই কাঙ্ক্ষণীয়।
‘সেইজন্যেই আজ, এই চমৎকার নগরী কোনোক্রির দেহলিতে দাঁড়িয়ে, আমার স্বদেশের কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মচারীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে, আমাদের মনে হচ্ছে আমরা যেন ফ্রান্স ছেড়েই বেরুইনি—এখনও ফরাশিদেশেই আছি। সেইজন্যেই, যখন আমরা এ-দেশের দুর-দুর্গম অভ্যন্তরে গিয়ে ঢুকবো, তখনও মনে হবে আমরা ফ্রান্স ছেড়ে দূরে যাইনি, কেননা এ-সব দেশের শ্রমনিষ্ঠ মানুষজন এখন বৃহৎ-কোনো সম্প্রসারিত-ফ্রানসেরই বাসিন্দা হ’য়ে উঠেছে। আমাদের উপস্থিতি থেকেই প্রতীয়মান হবে সদাশয় সরকার এঁদের ওপর কতটা নজর রেখেছেন! পিতৃভূমির প্রতি, ফ্রাসের প্রতি, তাদের আনুগত্য আরো-বর্ধিত হোক, আরো-গৌরবান্বিত হোক প্রজাতন্ত্র, এই কামানই মিশনের পক্ষ থেকে করছি আমি।’
মসিয় ল্য গবর্নিউর বালদোন তার পরেই স্বতঃস্ফূর্ত করতালির জন্যে ইশারা করলেন, আর বারজাক দু-পা পেছিয়ে যেতেই তাঁর জায়গায় এসে দাঁড়ালেন বোদ্রিয়ের। উপনিবেশ দফতরের মন্ত্রীর দফতরে অন্তহীন কচকচির ফলে এটাই স্থির হয়েছে বোদ্রিয়ের আদৌ বারজাকের সহকারী নন, সহযোগী নেতা। শব্দের কী—অহো!—রহস্যময় ক্ষমতা। তার মানে দাঁড়িয়েছে অবশ্য এটাই যে বারজাক যদি কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে অংশ নেন, পরক্ষণেই তাতে অংশ নেবেন বোদ্রিয়েরও। এইভাবে সমাধান হয়েছে চুলবুলে জটিলতার। বারজাক যদি এগিয়ে আসেন, তবে ব্রোদ্রিয়েরও কি আর খুব-একটা পেছনে থাকবেন।
মঁসিয় ল্য গবনির্ভর, মেসিউর,’ বোদ্রিয়ের সুকৌশলে হাততালিটাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে শুরু করলেন : ‘আমার প্রখ্যাত সহযোগী এবং বান্ধবের সুমধুর সুভাষিতের সঙ্গে আমি নিজেকেও সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে নিচ্ছি। তিনি যেমন বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকেরই এই অভিযানের আপদবিপদ সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে আর স্পষ্ট ক’রে সেই আশঙ্কাটাও ব্যক্ত করতে হবে। বাধা-বিপত্তি যা আসবে, আমরা নিজেরাই তা অতিক্রম করার চেষ্টা করবো। আর আপদ- বিপদ? আমরা তাকে ডরাবোই না, কেননা বিপদ আর আমাদের মাঝখানে উঁচনো থাকবে ফ্রাসেরই শানিতফলা সঙিন।
‘সেইজন্যেই আমাকে এই শুভমুহূর্তে, আফ্রিকার মাটিতে পা দেবার এই শুভলগ্নে, সেই সঙ্গীসাথীদেরই অভিবাদন জানাতে দিন, যাঁদের অস্ত্রশস্ত্র সমস্ত বিপদকে ঠেকিয়ে রাখবে। সেই সঙ্গীসাথীরা সংখ্যায় বেশি না-হ’লেও তাঁরা তো আসলে ফ্রাসেরই বিপুল সামরিক শক্তির প্রতীক আর ফ্রাসের সেই সামরিক শক্তিকেই আমরা এখানে সেলাম ঠুকছি। ফ্রান্সের জনগণেরই হৃদয়স্পর্শ ক’রে আছে যে-সামরিক বাহিনী তারই সাহায্যে আমাদের অভিযান সর্বার্থসাধক ও সাফল্যমণ্ডিত হবে—এই দৃঢ়-আস্থা আমি এখানে ঘোষণা করছি!’
আবারও করতালির ধুম প’ড়ে গেলো-আগের মতোই স্বতোৎসারিত ও সাগ্রহ। তারপর জমায়েৎ বিপুল দর্পে চললো রাজভবনের দিকে—মিশনের সদস্যরা সেখানে তিনদিন শুধু বিশ্রাম ক’রে বা আড্ডা দিয়েই কাটাবেন না, সেখানে ব’সে- ব’সেই তাঁরা স্থির করবেন পরবর্তী কার্যক্রম।
কার্যক্রমটি যেমন-তেমন বা নগণ্য-কিছু নয়-সুবিশাল। বারজাকের প্রস্তাবিত বিধিপ্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অঞ্চলটি ১,০০০,০০০ বর্গমাইলকেও ছাড়িয়ে যায়। অতবড়ো জায়গাটার সর্বত্র ঘুরে-ঘুরে তদন্ত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না-এ তো ফ্রাসের তিনগুণ বাড়া! শুধু এর মধ্য দিয়ে এমন-একটা রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে যাতে মনে হয় সারা আফ্রিকাই বুঝি স্বচক্ষে দেখা হয়ে গেছে। সত্যি- বলতে, সে রাস্তাটা মিশনের কারু-কারু পক্ষে ১,৫০০ মাইল দীর্ঘ, আর কারু- কারু কাছে ২,৫০০ মাইলেরও বেশি।
কেননা এমন বিপুল একটা অঞ্চলে অভিযান চালাতে গিয়ে, মিশন একসময়ে দু-ভাগে ভাগ হ’য়ে দুটো আলাদা পথে পাড়ি জমাবে। কোনোক্রি ছেড়ে মিশন প্রথমে যাবে কানকান, সেখান থেকে কেনেদুগুর সবচেয়ে-বড়ো শহর সিকাসোতে গিয়ে পৌঁছুবে। এখানেই, সমুদ্রতট থেকে অনুন্য সাড়ে সাতশো মাইল দূরে এসে মিশনটি ভাগ হ’য়ে যাবে। একদল যাবে, বোদ্রিয়েরে নেতৃত্বে, দক্ষিণে এবং শেষটায় গিয়ে পৌঁছুবে আইভরি কোস্টে। অন্যটা চলবে পুবমুখো, স্বয়ং বারজাকের নেতৃত্বে, গিয়ে পৌঁছুবে সায়ীতে, নাইজারে; তারপর নদীর সমান্তরাল পথ ধ’রে এগিয়ে সে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছবে দাহোমের উপকূলে। যেহেতু অভাবিত বিলম্ব হ’তে পারে, কোথাও-কোথাও ঘুরপথেও যেতে হ’তে পারে, তাই ব্রোদিয়ের হয়তো আগস্টের মাঝামাঝির আগে গ্রাঁ-বাসাম পৌঁছুতে পারবেন না, আর বারজাকের পক্ষেও হয়তো অক্টোবরের আগে কেতোনু পৌঁছুনো সম্ভব হবে না।
অর্থাৎ এটা একটা দীর্ঘ যাত্রারই প্রশ্ন, তবে মঁসিয় ইসিদোর তসাঁ এটা ভেবে মোটেই কোনো পরিতোষ পেলেন না যে এই দীর্ঘ ভ্রমণপথটায় তিনি এমন- কোনো চমকপ্রদ ভৌগোলিক আবিষ্কার ক’রে ফেলতে পারবেন, ইওরোপের লোক যা আগে জানতো না। সত্যি বলতে, কেন-যে ভৌগোলিক সমিতির একজন বার্তাসচিবকে এই অভিযানের সঙ্গে ল্যাংবোটের মতো জুড়ে দেয়া হয়েছে সেটা বোঝা একটু মুশকিলই ছিলো, কেননা নাইজার নদীর বাঁক আবিষ্কার করা আর আমেরিকা আবিষ্কার করা প্রায় একই কথা। তবে মঁসিয় তসাঁ নামের কাঙাল নন ভূ-গোলকটার সর্বত্রই লোক গিয়ে আগে হাজির হয়েছে, আগে মানে তাঁর আগে, ফলে নাল্পে সুখমস্তি তাঁর অন্তত বলা সাজে না। তাঁকে বরং উচ্চাশা পরিত্যাগ করতেই সুপরামর্শ দিয়েছিলো ভৌগোলিক সমিতির বন্ধুবান্ধবেরা। নাইজারের বাঁক অনেকদিন হ’লো মোটেই আর অনধিগম্য অথবা রহস্যময় অঞ্চল নেই। পশ্চিম সুদানকে কেউই আর এখন বন্য বলে না। ইওরোপ গিয়ে রাজ্য বিছিয়েছে সেখানে, শাসনযন্ত্র একটু বাড়াবাড়ি-রকমই কাজ করে সেখানে- সদাশয় ফরাশি সরকারের আনুকুল্যে বিস্তর জনপদ গজিয়ে উঠেছে এখানে। তবু, এই বারজাক মিশন যে– সব অঞ্চল দিয়ে যাবে, তাদের সর্বত্র শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজ তেমন এগোয়নি। তবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জমকালো, সঙ্গে সেপাই-শাস্ত্রী থাকবে, অর্থাৎ বোদ্রিয়ের সামরিক বাহিনীর লোকজন, ফলে অভিযানের উদ্দেশ্য সফলই হবে-ঘটনাবিহীন যদি নাও হয়, অপঘাতহীন হবে ব’লেই আশা করা যায়। আসলে এ–তো শান্তিপ্রিয় কতগুলো জনপদের মধ্য দিয়ে পদযুগলকে আশ্রয় ক’রে গিয়ে বেড়িয়ে-আসা, বারজাক তাঁর সংবেদনশীল ভাষণে যে-শান্তিপ্রিয় মানুষদের হাতে একটু-আধটু রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। স্থির হয়েছে যে, মিশন রওনা হবে পয়লা ডিসেম্বর।
তার আগের রাত্তিরে সরকারি একটা নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে, স্বয়ং লাটসায়েবের টেবিলে শেষবারের মতো মিশনের সদস্যরা মিলিত হবেন! পানভোজনের শেষে, নতুন ক’রে পানীয়র ব্যবস্থা করতেই নিশ্চয়ই, টোস্ট পান করা হবে—কামনা করা হবে পরস্পরের কীর্তি ও সাফল্য, এটাই তো রীতি যে তার পরেই ঝমঝম ক’রে বেজে উঠবে জাতীয়সংগীত-প্রজাতন্ত্রের জয়গাথা!
সেদিন, জ্বলন্ত-এক সূর্যের তলায় সারাদিন এলোমেলো ঘুরে বেরিয়ে বড্ড ক্লান্ত হ’য়েই বারজাক তাঁর ঘরে ফিরেছেন, আর ফিরে পাখার হাওয়া খেতে খেতে আরামের একটা আঃহ্ ছেড়েছেন, অপেক্ষা ক’রে আছেন কখন সেই শুভলগ্ন আসে যখন তিনি তাঁর গায়ের ভারি কালো কোটটা খুলে নিতে পারবেন, যতক্ষণ কাজ ততক্ষণ গায়ে কোট—এইই হচ্ছে সরকারি রীতি তা গরম যতই তপ্ত কটাহের মতোই হোক, এমন সময় আর্দালি-তাকে ঔপনিবেশিক দফতরের কাজ থেকে সরিয়ে এনে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে—এসে বললে যে তাঁর সঙ্গে দুই অভ্যাগত দেখা করতে চান।
‘কারা তারা?’ জিগেস করলেন বারজাক!
‘এক সায়েব আর তাঁর সঙ্গিনী।’
‘ঔপনিবেশিক?’
‘মনে হয় না। অন্তত চেহারা-ছিরি দেখে,’ আর্দালি উত্তর দিলে, পরের ঢাঙা মতন, তবে নুড়ির ওপর ঘাস গজায়নি তেমন।’
‘নুড়ি?’
‘টেকো যে! শনের ফেঁসোর মতো জুলফি, চোখদুটো যেন সিঁড়ির পইঠার মতো।’
‘তোমার কল্পনাশক্তি দেখছি বড্ড সৃজনশীল!’ বললেন বারজাক, ‘আর তার সঙ্গিনীটি?’
‘সঙ্গিনীটি?’
‘হ্যাঁ। দেখতে কেমন? তরুণী?’
‘তা, বলা যায়।’
‘সুন্দরী?’
‘হ্যাঁ, তায় ফ্যাশনদুরস্ত—জেল্লা দিচ্ছে।’
বারজাক অন্যমনস্কের মতো গোঁফ চুমরে বললেন, ‘নিয়ে এসো ওদের।’ এই নির্দেশটা দেবার সময়, বারজাক প্রায় অসচেতন ভাবেই, আয়নাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন, যাতে প্রস্ফুটিত তাঁর নধর বপু। যদিও তিনি আদপেই খেয়াল করেননি, ঘড়িতে কিন্তু তখন ঢংঢং ক’রে ছ-টা বাজছিলো, সেই কুখ্যাত সময়—অবশ্য দ্রাঘিমার জন্যে অন্য জায়গার সঙ্গে তার তারতম্য কিছু থাকতেই পারে —যখন সেনট্রাল ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়েছিলো।
অভ্যাগতরা—একজন পুরুষ, বছর-চল্লিশ বয়েস, সঙ্গিনীর বয়েস কুড়ি থেকে পঁচিশ, কচিমেয়েই–বারজাকের ঘরে এসে পৌঁছুলেন, বারজাক ততক্ষণ মনে- মনে নিজেকে সরকারি নৈশভোজের ক্লান্তিকর ক্রমের জন্য তৈরি ক’রে নিচ্ছিলেন। পুরুষটি সত্যি ভারি ঢ্যাঙা। যেন অন্তহীন দুই ঠ্যাঙের ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে শুটকোমতো একটা শরীর, ঘাড়গদান দীর্ঘ, মাথাটা দীর্ঘ, কৃশ। তার চোখ দুটি যদি সিঁড়ির পইঠার কথা মনে করিয়ে নাও-দেয়-আর্দালি তাদের যেমনতর তাজ্জবভাবে তুলনা করেছিলো –কেউ বলতে পারবে না যে মণিদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে না, নাকটা মুখের তুলনায় বড়োই, ওষ্ঠাধর পুরু, আর কোনো ক্ষুর নিশ্চয়ই নিষ্ঠুরভাবে গোঁফজোড়া চেঁছে দিয়েছে। ওদিকে জুলফিদুটো, অস্ট্রিয়ার লোকদের যা জমকালোভাবেই থাকে, আর মাথায় নামেমাত্র কোঁকড়ানো বিরল চুল সযত্নে টাকের ওপর বেছানো, ঠিক শনের ফেঁসোর মতো নয়, আর্দালি যথার্থকথাটা প্রয়োগ করতে পারেনি। পুরুষটি আর্দ্রকবৎ ঝাঁঝালো, চুলের রঙও আদার মতোই। তবে, যতই কিম্ভূত দেখতে হোক না কেন, তার এই বেঢপ চেহারাতেও কেমন-একটা টান আছে। মুখে একটা অকপট সরলভাব, চোখে মিশুকে দৃষ্টি, খানিকটা গায়ে-পড়া বন্ধুতারই ভাব।
আর তার পেছন-পেছন আগমন হয়েছে মহিলাটিব। না, তাকে সুন্দরী ব’লে বর্ণনা করে আর্দালি মোটেই রং চড়ায়নি, কোনো অত্যুক্তিই করেনি। দীঘল, হালকা ফুরফুরে, মনোরম সুগঠন, লাল টুকটুকে সুঠাম মুখ, সুশ্রী নাসা, আয়ত দুটি চোখ—প্রায়-জুড়ে-যাওয়া বাঁকানো দুই সুশ্রী ভুরুর তলায়, মাথা ভর্তি রাত্রির মতো নিবিড়কালো গহীন চুল –ইনি শুধু-যে পরমা সুন্দরী তা-ই নয়, সেজেছেনও চমৎকার।
বারজাক চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বলতেই, পুরুষটি কথা বলতে শুরু ক’রে দিয়েছেন। ‘আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন, মঁসিয় ল্য দেপুতে, যে এভাবে এসে গায়ে প’ড়ে আপনার সাহায্য চেয়ে বিরক্ত করছি। কিন্তু আপনার সঙ্গে যে আলাপ করিয়ে দেবে, এমন-কাউকেই আমরা চিনি না-ফলে আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দিই, তাহ’লে মাফ ক’রে দেবেন। আমার নাম—অনুগ্রহ ক’রে জানাতে দিন নামটা একটু বেয়াড়ারকম, উদ্ভটই—আমার নাম অজেনর দ্য সাঁৎ- বেরা, ভূস্বামী, চিরকুমার, আর র্যন্ নগরীর বাসিন্দা।’ নাটুকেভাবে এই পর্যন্ত ব’লে অজেনর দ্য সাঁৎ-বেরা একটু থেমে আরো-নাটুকেভাবে ঝুঁকে হাত নেড়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন : ‘মিস্ জেন মোরনাস –আমার মাসি।’
আপনার মাসি?’ কি-রকম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন বারজাক।
হ্যাঁ। মিস মোরনাস সত্যিই আমার মাসি-যে-কেউই যে-কারু মাসি হ’তে পারে তো।’ অজেনর দ্য সাঁৎ-বেরা বারজাককে যখন এইভাবে আশ্বস্ত করছেন তখন তরুণীর মধুর অধরে ক্ষীণ-একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
‘মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা,’ একটু ইংরেজির ঝোঁকে ফরাশি বলেছে তরুণী, ‘সবসময়েই আমার ভাগ্নে ব’লে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন—কখনো আমার আত্মীয়তাসম্বন্ধের কথা জাহির করতে ভোলেন না…’
‘তাতে নিজের বয়েস অনেক কম লাগে,’ ভাগিয়েনটি জুড়ে দিয়েছেন।
‘তবে,’ জেন মোরনাসের কথা তখনও ফুরোয়নি, ‘একবার সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি তাঁর বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করবার পর, তিনি সম্বন্ধটা উলটে দিতে রাজি হ’য়ে যান এবং পুনর্বার রূপান্তরিত হ’য়ে যান আমার অজেনর মামায়— ইনি আমার মাতুলই বটেন, অন্তত জন্মাবধি আমি এইই জানি।’
‘এবং সেটা অবশ্য আমার বয়েসের সঙ্গে খাপই খায়,’ যুগপৎ মামাভাগ্নে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে আসল কথাটা পাড়ি। নিজেদের পরিচয় দেবার পর আপনি নিশ্চয় আমাদের অনুমতি দেবেন আমাদের অনাহুত আগমনের উদ্দেশ্য কী—খুলে বলতে। মিস্ মোরনাস আর আমি-আমরা দুজনে অভিযাত্রী। আমার মাসি-ভাগ্নি এক ভয়ডরহীনা পর্যটক, আর আমি তার বাধ্য মামা-ভাগ্নের মতো আমাকে সারা পৃথিবীটায় টেনে-হিঁচড়ে বেড়াতে অনুমতি দিই তাকে। আমরা এই কোনাক্রিতে এসেই পা গুটিয়ে ব’সে থাকতে চাই না, আমরা অভ্যন্তরেও যেতে চাই, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চাই। আমরা যাবো ব’লে প্রস্তুতিও নিয়েছিলুম, ঠিক যখন বেরিয়ে পড়বো তখন শুনতে পেলুম, যে আপনার নেতৃত্বে একটি অভিযাত্রী মিশনও ঠিক ঐ পথ ধ’রেই যাবে। আমি মিস্ মোরনাকে তখন বলেছি অজানা- অচেনা বিদেশবিভুঁয়ে সঙ্গে আরো-লোক থাকলে ক্ষতি কী—আপনারা অনুমতি দিলে আমরা আপনাদের সঙ্গেই যেতে পারি। তাই আজ আপনার কাছে অনুমতি চাইতে এসেছি : অনুগ্রহ ক’রে আমাদেরও সঙ্গে যেতে দিন।
‘এমনিতে তো আপত্তির কোনোই কারণ দেখছি না,’ বললেন বারজাক, ‘তবে বুঝতেই তো পারছেন, আমার সহযোগীদের সঙ্গে একবার কথা ব’লে নেয়া উচিত।’
‘হ্যাঁ, তা তো ঠিকই,’ সায় দিয়েছেন সাঁৎ-বেরা।
‘তারা হয়তো ভয় পেয়ে বসবে যে সঙ্গে কোনো মহিলা থাকলে রাস্তাঘাটে অহেতুক দেরি হ’য়ে যাবে। তাতে আমরা যে-ক্রম স্থির করেছি, সেই অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারবো না। তা যদি হয়…’
‘তা নিয়ে কারুরই চিন্তার কোনো কারণ নেই,’ অজেনর মামা বাধা দিয়ে বললেন: ‘মিস মোরনাস প্রায় পুরুষমানুষই অন্তত পথে বেরুবার বেলায়। তিনি চাইবেন আপনারা তাঁকে লাজুক বা ললিতলবঙ্গলতা না-ভেবে আপনাদেরই একজন ব’লে ধ’রে নেবেন।’
জেন বললে, ‘আর আমাদের যানবাহন সাজসরঞ্জাম নিয়েও আপনাদের আদৌ উত্ত্যক্ত হতে হবে না। আমাদের নিজেদের ঘোড়াও আছে, তল্পিবাহকও আছে। এমনকী দুজন বাম্বারাও পেয়েছি আমরা, আগে সেনেগলে পথপ্রদর্শকের কাজ করতো, তারাই আমাদের গাইড আর দোভাষীর কাজ করবে। আপনাদের সঙ্গে আমাদের যেতে অনুমতি দিলে আমরা কোনো বাড়তি ঝামেলা করবো না…’
হ্যাঁ, সে-ক্ষেত্রে অবিশ্যি,’ আমতা-আমতা ক’রেই সায় দিলেন বারজাক, ‘আমি সহযোগীদের সঙ্গে কথা ব’লে নেবো। কারু যদি কোনো আপত্তি না-থাকে, তাহ’লে তো কোনো আপত্তি নেই, আপনারা আমাদের সঙ্গেই যাবেন। তবে আমাদের সিদ্ধান্তের কথাটা আপনাদের জানাবো কখন?’
‘কালকে, আপনারা যখন রওনা হবেন। সত্যি-বলতে এমনিতেই আমরা ঠিক ঐ সময়েই রওনা হ’য়ে পড়তুম।’
এই কথাই স্থির হ’লো। অভ্যাগতরা বিদায় নিয়ে গেলেন।
লাটসায়েবের নৈশভোজে অসংকোচেই কথাটা পেড়েছিলেন বারজাক, তাঁর সহযোগীদের কাছে। কারুরই তাতে আপত্তির কিছু আছে ব’লে মনে হয়নি, শুধু বোদ্রিয়ের সন্দেহ প্রকাশ ক’রে একটু তা-না-না-না করেছিলেন। এমন সুন্দরী তরুণীর সঙ্গসুধা ছেড়ে দিতেও মন চাচ্ছিলো না—বারজাক নিশ্চয়ই গায়ে প’ড়ে আদিখ্যেতা করেছেন –তবে কোথায় যেন তাঁর একটু খটকা লাগছিলো, আড়ালে কিছু-একটা আছে যেন। এ-রকম একটা অভিযানে এত কষ্ট স’য়ে কোনো সুন্দরী তরুণী যাবে কেন? শুধু দেশ বেড়াবার জন্যে? উঁহু, এ-কৈফিটা ঠিক গ্রাহ্য করা যায় না—তরুণীটি নিশ্চয়ই তার আসল-মলব ফাঁস করেনি। আর তাতেই কি মনে হয় না এর পেছনে একটা গূঢ় অভিসন্ধি আছে-হয়তো কোনো-একটা ফাঁদেই পা দেবেন তাঁরা, রাজি হ’লে। মন্ত্রিসভার সঙ্গে সংসদের সম্বন্ধ নিয়ে যা-সব গুজব রটছে, তার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই তো?
মুচকি হেসে, অন্যরা তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন।
‘মঁসিয় দ্য সাঁৎ-বেরা অথবা মিস মোরানাস,’ মঁসিয় বাদোন বলেছেন, ‘কারু সঙ্গেই আমার কোনো পরিচয় নেই। তবে তাঁরা পক্ষকাল ধ’রে কোনোক্রিতে আছেন—পথে-ঘাটে তাঁদের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে।
তাঁদের অন্তত একজনকে চোখে না প’ড়ে যায় না,’ বারজাক বেশ-জোর দিয়েই বলেছেন।
হ্যাঁ, তরুণীটি পরমাসুন্দরীই বটে,’ সায় দিয়েছেন মঁসিয় বাদোন, ‘শুনেছি এঁরা সেনেগলের সাঁৎ সুইস থেকে এসেছেন, স্টীমারে ক’রে। শুনে কারু-কারু তাজ্জব মনে হ’তে পারে, তবে এঁরা নাকি দেশবিদেশ বেড়িয়েই আনন্দ পান- ঠিক যে-কথাটা তাঁরা বলেছেন মঁসিয় বারজাককে। তাঁরা সঙ্গে গেলে আমাদের কী অসুবিধে হ’তে পারে, সেইটেই আমার মাথায় ঢুকছে না।’
আর-কোনো আপত্তি ওঠেনি, অতএব তাঁদের সঙ্গে যেতে দেয়া হবে ব’লেই ঠিক হয়েছে।
আর এইভাবে বারজাক মিশন তার অভিযানে জুটিয়েছে নতুন দুই রংরুট। সবশুদ্ধু তাহ’লে দশজন সদস্য মিশনের, যদি আমরা ল্যাক্সপাসিয়ন ফ্রাঁসেঈর বিশেষ সংবাদদাতা আমেদে ফ্লরেঁসকে হিশেবে ধরি-আমরা অবশ্য তল্লিবাহকদের বা সেপাইশাস্ত্রীদের হিশেবে ধরছি না। পরের দিন সকালবেলায়, নিশ্চয়ই দৈবাৎই বলতে হবে, বারজাক যখন বিশালবৰ্ত্তুল বপু নিয়ে হন্তদন্ত হ’য়ে মিস মোরনাসকে ঘোড়ায় উঠে বসাবার জন্যে ছুটেছেন, তখন উপনিবেশের পদাতিক বাহিনীর কাপ্তেন এবং এই অভিযানের অধিনায়ক পিয়ের মার্সেনে ক্ষিপ্রভাবে গিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় মিস মোরনাসকে সাহায্য করেছে।
‘আমিস সেদাৎ ইনসিনিয়ে,’ ধ্রুপদী লাতিন বচন তখন আউড়েছিলেন বারজাক, তবে যে-কেউ বুঝতে পারতো কাপ্তেন পিয়ের মার্সেনের আগ বাড়িয়ে হাত লাগাবার আদিখ্যেতাটা এই অভিযানের সরকার অনুমোদিত নেতাটির আদপেই পছন্দ হয়নি।