মৃত্যুবাণ
কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
চরিত্রলিপি
মৃত্যুবাণ উপন্যাসটির মধ্যে বহু বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ দেখা দিয়েছে, বহু বিচিত্র চরিত্র। পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার জন্যই একটি সম্পূর্ণ চরিত্রলিপি দেওয়া হল।
রাজা যজ্ঞেশ্বর মল্লিক – রায়পুর স্টেটের রাজা
রাজেশ্বর মল্লিক – যজ্ঞেশ্বরের খুড়তুতো ভাই
রাজা রত্নেশ্বর মল্লিক – যজ্ঞেশ্বরের একমাত্র পুত্র
রাজা শ্ৰীকণ্ঠ মল্লিক – রত্নেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র
কুমার সুধাকণ্ঠ মল্লিক – ঐ মধ্যম পুত্র
রাজা বাণীকণ্ঠ মল্লিক – ঐ কনিষ্ঠ পুত্র
কাত্যায়নী দেবী – ঐ একমাত্র কন্যা ও নায়েব শ্রীবিলাস মজুমদারের ভ্রাতৃবধু
হারাধন মল্লিক – সুধাকণ্ঠের পুত্র, রায়পুর আদালতের মোক্তার
নিশানাথ মল্লিক – বাণীকণ্ঠের পুত্র, শোলপুর স্টেটের চিত্র-শিল্পী, বিকৃত-মস্তিষ্ক
রাজাবাহাদুর রসময় মল্লিক – নিষ্পুত্রক রাজা শ্রীক মল্লিকের দত্তক পুত্র
রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিক – রসময় মল্লিকের প্রথম পক্ষের পুত্র
কুমার সুহাস মল্লিক – ঐ দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র
প্রশান্ত মল্লিক – সুবিনয় মল্লিকের একমাত্র পুত্র
জগন্নাথ মল্লিক – হারাধন মল্লিকের পৌত্র
সুরেন চৌধুরী – কাত্যায়নী দেবীর পুত্র
ডাঃ সুধীন চৌধুরী – ঐ পৌত্র বা সুরেন চৌধুরীর ছেলে
সুহাসিনী দেবী – সুরেন চৌধুরীর স্ত্রী
মালতী দেবী – ছোট রাণীমা, রসময়ের দ্বিতীয় স্ত্রী
দীনতারণ মজুমদার – রাজা যজ্ঞেশ্বরের নায়েব
শ্রীবিলাশ মজুমদার – দীনতারণের পুত্র ও শ্রীকণ্ঠ ইত্যাদির নায়েব
শিবনারায়ণ চৌধুরী – নৃসিংহগ্রামের নায়েব
দুঃখীরাম – শিবনারায়ণের ভৃত্য
সতীনাথ লাহিড়ী – রায়পুরের সদর ম্যানেজার ও সুবিনয়ের সেক্রেটারী
তারিণী চক্রবর্তী – রায়পুর স্টেটের খাজাঞ্চী
মহেশ সামন্ত – ঐ তহবিলদার
সুবোধ মণ্ডল – ঐ বাজার সরকার
হরবিলাস – নৃসিংহগ্রামের নতুন ম্যানেজার
সতীশ কুণ্ডু – স্টেটের একজন কর্মচারী
ছোট্টু সিং – ঐ দারোয়ান
শম্ভু – রাজা সুবিনয় মল্লিকের খাসভৃত্য
মহীতোষ চৌধুরী – ঐ দূরসম্পর্কীয় ভাই
ডাঃ কালীপদ মুখার্জী – প্রথিতযশা চিকিৎসক
ডাঃ অমর ঘোষ – ডাঃ মুখার্জীর সহকারী
ডাঃ অমিয় ঘোষ – রাজবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক
বিকাশ সান্যাল – রায়পুর থানার ও.সি.
কর্ণেল মেনন – বম্বে প্লেগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ
মুন্না – সাঁওতাল সর্দার
কিরীটী – রহস্যভেদী
সুব্রত – কিরীটীর সহকারী
জাস্টিস মৈত্র – হাইকোর্টের জজ
ভবানীপ্রসাদ – উচ্ছৃঙ্খল বিত্তহীন ধনীর পুত্র
ন্যাপা, বিষ্টুচরণ, কৈলাস – ঐ দলের লোক
নির্মল, মিঃ হুড – কোর্ট অফ অর্ডারস্-এর ম্যানেজার
ডঃ আমেদ – কলিকাতার পুলিস সার্জেন
.
প্রথম পর্ব
০১. ২৯শে ফেব্রুয়ারী
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
জজসাহেব রায় দিলেন, জুরীদের সঙ্গে একমত হয়ে সুহাস মল্লিকের হত্যা-মামলার অন্যতম আসামী ডাঃ সুধীন্দ্র চৌধুরীকে।
অবশেষে একদিন সেই দীর্ঘপ্রতীক্ষিত রায়পুরের বিখ্যাত হত্যা-মামলার রায় বের হল। বিহার প্রদেশে অবস্থিত ছোটখাটোর মধ্যে অত্যন্ত সচ্ছল রায়পুর স্টেট; সেই স্টেটের ছোট কুমার শ্রীযুক্ত সুহাস মল্লিকের রহস্যজনক হত্যা-সম্পর্কিত মামলা।
জনসাধারণের চাইতেও কলকাতার ও আশেপাশের শহরতলীর বিশেষ করে চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মধ্যে মামলাটি শুরু হতেই একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। বলতে গেলে প্রত্যেকেই মামলার ফলাফলের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত মামলার ফলাফল কি দাঁড়ায়। সেই মামলার রায় আজ বের হয়েছে।
শীতের সন্ধ্যায় মজলিসটা সেদিন বেশ জমে উঠেছিল। বহুকাল পরে সেদিন আবার কিরীটীর টালিগঞ্জের বাসায় সকলে একত্রিত হয়েছে। কিরীটী, সুব্রত, রাজু, নীতিশ, ইন্সপেক্টার মফিজুদ্দীন তালুকদার, পুলিস সার্জেন ডাঃ আমেদ।
আলোচনা চলছিল রায়পুরের বিখ্যাত খুনের মামলা সম্পর্কে।
আজ জজ সাহেব রায় দিয়েছেন, আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ জারি হয়েছে।
রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের রহস্যজনক হত্যা-সম্পর্কিত মামলায় তিনিই ছিলেন প্রধান আসামী।
তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল। কারণ এদের মধ্যে কেউই আসামী সুধীন্দ্র চৌধুরীর দোষ সম্পর্কে একমত নয়।
কেবল ওদের মধ্যে একা কিরীটীই একপাশে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে পাইপ টানতে টানতে সকলের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এবং এতক্ষণও কোনো মতামত প্রকাশ করেনি।
এই মামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও, কিরীটী কাগজে পড়েছে এবং আগাগোড়াই মামলাটিকে লক্ষ্য করেছে। কিন্তু হঠাৎ একসময় যখন সুব্রত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কিরীটী, তোর কি মনে হয়? তুইও কি মনে করিস ডাঃ সুধীন্দ্র চৌধুরী এই হত্যার ব্যাপারে সত্যিই দোষী? তাঁর বিরুদ্ধে যেসব এভিডেন্স খাড়া করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কোনো ত্রুটিই নেই?
কিরীটী সুব্রতর প্রশ্নে চোখ মেলে তাকাল, ব্যাপারটা বিশেষ রকম জটিল ও রহস্যপূর্ণ। কিন্তু সে কথা যাক, মোটামুটি এই হত্যার ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে গিয়ে গোড়া থেকেই তোমরা সকলেই একটা মস্তবড় ভুল করছ বলেই আমার কিন্তু মনে হয়।
সুব্রত প্রশ্ন করে, কেন? কোথায় ভুল করছি?
কিরীটী বলে, এই ধরনের হত্যা-ব্যাপারের যত কিছু রহস্য সব হত্যার গোড়াতেই থাকে। হত্যা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকল রহস্যের ওপরে যবনিকাপাত। কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারে, কতকগুলো বিশেষ লোক, কোনো একটা বিশেষ কাজ করেছে। এই যে কতকগুলো লোকের একটা বিশেষ সংস্থান, একটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, একটা বিশেষ সময়ে, এইখানেই আমাদের যত কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে। কাজে কাজেই ঐ খুন বা হত্যার ব্যাপারের রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদের হত্যা-ব্যাপারের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যাবতীয় সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করে দেখতে হবে। সমগ্র রহস্যটুকুর মধ্যে হত্যাটাই তো শেষ পরিচ্ছেদ বা সমাপ্তি মাত্র।
কিরীটী বলে চলে, তোমরা সকলে এবং অনুসন্ধানকারীরাও ঐ শেষ পরিচ্ছেদ থেকেই বার বার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করছ। তাই তোমরা সত্যের শেষধাপে কোনমতে পৌঁছাতে পারছ না। শুরু কর সেই প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে এবং তাহলেই আসল সত্যের মূলে আসতে পারবে।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলতে লাগল, ধর আমাদের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরীর ব্যাপারটাই। সুহাস মল্লিকের হত্যার সময়টিও ঠিক সে অকুস্থানে অর্থাৎ কলকাতায় ছিল না অর্থাৎ মৃত্যুর সময়টায় সে কয়েকদিনের জন্য বেনারসে চলে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর দিন পাঁচেক বাদেই আবার সে ফিরে আসে। মাঝখানে মাত্র পাঁচ-সাতটা দিন, এতেই সে জড়িয়ে · পড়ল হত্যাপরাধের ব্যাপারে। কেননা প্রথমত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে শেষবার সুহাস মল্লিক যখন রায়পুরে যান, মামলায় জানা যায় শিয়ালদহ স্টেশনে তখুনি নাকি ছোট কুমারের দেহে প্লেগ ব্যাসিলাই ইজেশন করা হয় এবং সুধীন চৌধুরী তখন সেই দলের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয়ত সুধীন চৌধুরী একজন ডাক্তার। ডাঃ চৌধুরীর প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সটা হঠাৎ গত মাস দুয়ের মধ্যে বিশেষরকম ভাবে কেঁপে উঠেছিল, যেটা তাঁর দশ বছরের ইনকামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো গেল না, এবং তিনিও নিজে তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে একপ্রকার রাজীই হলেন না আদালতে বিচারের সময়। তাহলেই ভেবে দেখ, ব্যাপার যাই হোক না কেন, স্থূল দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে গেলে ডাঃ সুধীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্যিই কি বেশ জটিল নয়?
ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট সব কটি প্রাণীই যেন রুদ্ধ নিশ্বাসে কিরীটীর কথাগুলো শুনছিল। কারও মুখে একটি টু শব্দ পর্যন্ত নেই। জমাট স্তব্ধতা। ঠিক এভাবে তো ওদের মধ্যে কেউই বিচার বা বিশ্লেষণ করে দেখেনি মামলাটা সত্যিই।
তোমরা হয়ত বলবে, কিরীটী আবার শুরু করে, মামলার that black man with the umbrella, সেই ছাতাওয়ালা কালো লোকটি, যার সব কিছু শেষ পর্যন্ত মিস্ট্রিই রয়ে গেল, আগাগোড়া মামলাটায়, সেই যে আসল কালপ্রিট নয় তাই বা কি করে বলা যায়?
সুব্রত প্রশ্ন করে, তুমি কি তাই মনে কর?
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, মনে আমি অনেক কিছু করি, আবার করিও না।
সুব্রত বলে, কিন্তু আমারও মনে হয়, এ ব্যাপারে he was only an instrument, তাকে সামান্য একটা instrument হিসাবেই এ হত্যার ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল। আসলে নাটকের সেই অপরিচিত কালো লোকটি (?) একটা side character মাত্র। তার কোনো importance-ই নেই এই হত্যা-মামলায়।
প্রত্যুত্তরে কিরীটী বলে, হয়তো তোমার ধারণা বা অনুমান মিথ্যা নাও হতে পারে সুব্রত, কিন্তু তবু সেই অজ্ঞাত ছাতাওয়ালার আগাগোড়া movementটা যদি trace করা যেত, তবে আসল হত্যাকারীর একটা কিনারা করা যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে? Side character হলেও un-important তো নয়?
মৃদুস্বরে সুব্রত বলে, আমার কিন্তু মনে হয় তা সম্ভব হত না।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হয়ত যেত না—তবু কথাটা ভাববার কারণ, প্রথমত এই মামলার আসল হত্যাকারীর সঙ্গে ঐ বিশেষ লোকটির কোনো যোগাযোগ ছিল বা ছিল না—কিংবা হত্যাকারী অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে সেই লোকটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রেখেছে বা রাখেনি—এবং নিজে আড়ালে থেকে লোকটিকে দিয়ে কৌশলে কাজটুকু করিয়ে নিয়েছে সব কিছুই ভেবে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত সেই ছত্রধারী লোকটি আসল ব্যাপারটা–তাকে দিয়ে যে অন্য একটি লোকের দেহে প্লেগের বিষ সংক্রামিত করা হচ্ছে, সেটা সে বুঝতে শেষ পর্যন্ত পেরেছিল কিনা—আমি স্থিরনিশ্চিত যে সেই লোকটি হাতে ছাতাটা আসবার আধ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও সেই কালোলোকটি ছাতার কোনো অস্তিত্বও। জানতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। এবং সেই ছাতাটাই যে ছিল সকল রহস্যের মূল সে কথাটা ভুললে চলবে না।
একটা সামান্য তুচ্ছ ছাতার মধ্যে এমন কি মিস্ট্রি থাকতে পারে, তা তো বুঝে উঠতে পারছি না, বলল মিঃ তালুকদার।
ছাতাটা যে তুচ্ছ তা আপনাকে বললে কে মিঃ তালুকদার? আমার যতদূর মনে হয়, এই হত্যা-রহস্যের মূল সূত্রই, সেই তুচ্ছ ছাতাটার মধ্যেই আমাদের সকলের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে হয়ত লুকিয়ে রয়ে গেছে। The brain behind it—তার আমি প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। হত্যা-রহস্যের মজাই ঐ! সামান্যতম ঘটনা বা বস্তুর সঙ্গে যে কত সময়। কত মূল্যবান সূত্র জট পাকিয়ে থাকে, আমাদের দৃষ্টিশক্তি বা বিচার-বুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে বা আমাদের দৃষ্টিশক্তির বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে যা হয়ত আমরা কত সময় লক্ষ্যই করি না। রায়পুরের হত্যা-রহস্যের মধ্যেও তেমনি মূল্যবান একটি সূত্র ঐ তুচ্ছ ছাতাটা, যা তদন্তের সময় বা আদালতে বিচারের সময় কেউই আবশ্যকীয় বলে এতটুকু নজর দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু কথার তর্কে-বিতর্কে রাত্রি অনেক হয়েছে। এবারে এস, আজকের মত সভা ভঙ্গ করা যাক। নাসারন্ধ্রে সুমধুর খিচুড়ির ঘ্রাণ আসছে। এই শীতের রাত্রে গরম গরম খিচুড়ি সহযোগে ফুলকপির চপ ও আলুর ঝুরিভাজা নেহাৎ মন্দ লাগবে না, কি বল হে?
কিরীটী যেন কতকটা ইচ্ছে করেই সভা ভঙ্গ করে উঠে দাঁড়াল। কাজেই অন্যান্য সকলকেও উঠে দাঁড়াতে হল সেই সঙ্গে।
সত্যিই রাত্রি বড় কম হয়নি। দেওয়াল-ঘড়িটা সগৌরবে ঘোষণা করলে রাত্রি দশটা ঢং ঢং করে।
***
আহারাদির পর সকেলই বিদায় নিয়েছেন।
কিরীটী তার শয়নকক্ষের পশ্চিমদিকের ভোলা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছে। কৃষ্ণা শুয়ে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, জানালাপথে দেখা যায়, রাত্রির একটুকরো আকাশ; কয়েকটি মাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে।…সুদূরের কালো ভীরু চাউনির মত মৃদু কম্পিত। খোলা জানালাপথে শীতরাত্রির ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে হিমকণাবাহী।
কিরীটী ভাবছিল কত না হত্যা-ব্যাপার নিয়েই সে এ জীবনে ঘাঁটাঘাঁটি করলো! কত বৈচিত্র্যই যে হত্যা-রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। কিরীটী মধ্যে মধ্যে ভাবে এমন যদি হত হত্যাকারী অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধি ও বিবেচনার দ্বারা হত্যার। পূর্বেই চারিদিক বাঁচিয়ে সমস্ত পরিকল্পনামত একান্ত সুষ্ঠুভাবে হত্যা করতে পারত, তবে কার। সাধ্য তাকে ধরে! কিন্তু এরকম কখনও আজ পর্যন্ত সে হতে দেখল না। সামান্য একটু গলদ, সামান্য একটু ভুল। হত্যাকারীর সমগ্র পরিকল্পনা সহসা বানচাল হয়ে যায়। নিজের ভুলে নিজেই বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে ফেলে। এমনিই নিয়তির মার!
বাবু!
কিরীটী চমকে ফিরে তাকায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভৃত্য জংলী।
কি রে জংলী?
একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
এত রাত্রে কে আবার ভদ্রমহিলা দেখা করতে এলেন? বসতে দিয়েছিস তো?
হুঁ, বাইরের ঘরে বসিয়েছি। বললেন আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ কি দরকার, এখুনি দেখা হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি।
কিরীটী আদৌ আশ্চর্য হয় না, কারণ এরকম অসময়ে বহুবার বহু লোকই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এবং অনেক সময় অনেক ভদ্রমহিলাও দেখা করতে এসেছেন।
কিরীটী গরম ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে একতলায় নামবার সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হল।
সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই আগন্তুক ভদ্রমহিলা সোফা হতে উঠে দাঁড়ালেন।
ঘরের উজ্জ্বলবৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী দেখল, ভদ্রমহিলা বেশবর্ষীয়সী। বয়স পঁয়তাল্লিশের ঊর্দ্ধে নিশ্চয়ই। পরিধানে সাধারণ মিলের একখানা সাদা থানকাপড়। গায়ে একটা ছাই রঙের পুরনো দামী শাল জড়ানো। মাথার ওপরে ঈষৎ ঘোমটা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মুখে। বয়সের বলিরেখা পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। একদা যে ভদ্রমহিলা বয়সের সময়ে অতীব সুশ্রী ছিলেন, প্রথম দৃষ্টিতেই তা এখনও বেশ বোঝা যায়, বিগত সৌন্দর্যের এখনও অনেকখানিই। যেন সমগ্র দেহ ও বিশেষ করে মুখখানি জুড়ে বিরাজ করছে। লম্বাটে বোগা চেহারা। চোখে শান্ত স্থির দৃষ্টি।
বসুন মা, আপনি উঠলেন কেন? কিরীটী ভদ্রমহিলাকে সম্বোধন করে।
তোমারই নাম কিরীটী রায়? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, বসুন। কিরীটী এগিয়ে এসে একখানা সোফা অধিকার করে সামনাসামনি বসল।
ভদ্রমহিলাও আবার উপবেশন করলেন। হাতের আঙুলগুলি পরস্পর জড়িয়ে, হাত দুটিকোলের উপর রাখলেন, এই অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করবার জন্য সত্যিই বড় লজ্জা বোধ করছি বাবা। তারপর একটু থেমে, আবার ধীর শান্তস্বরে বললেন, মা বলে যখন তুমি আমায় সম্বোধন করলে প্রথমেই, নিজের সন্তানের মতই তোমাকে আমি তুমি বলে সম্বোধন করছি। তাছাড়া তুমি তো আমার সন্তানেরই মত।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল; কেন যেন মনে হচ্ছিল মুখখানি খুবই চেনা। কবে কোথায় ঠিক এমন একটি মুখ না দেখলেও অনেকটা এমনি একখানি মুখের আদল দেখেছে ও।
অস্পষ্ট একটা ছায়ার মতই মনের কোণে ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠে আবার যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট হয়ে।
কিরীটীকে সামনে বসে একদৃষ্টে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, আমার মুখের দিকে অমন করে তাকিয়ে কি দেখছ?
কিছু না মা! ভাবছিলাম আপনার মুখখানি যেন বড় চেনা-চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। এবারে মনে পড়েছে। রায়পুরের আসামী ডাঃ সুধীন চৌধুরী কি–
ঠিক ধরেছ, আমি—আমি তারই হতভাগিনী মা। কিন্তু আমার পরিচয় তো এখনও তোমায় আমি দিইনি বাবা! কেমন করে বুঝলে?
না, দেননি, নিম্নস্বরে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিন্তু আপনার ছেলের মুখখানি যেন আপনারই মুখের হুবহু একখানি প্রতিচ্ছবি। আপনি তাহলে রায়পুরের মামলা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার নিয়েই আমার কাছে এসেছেন?
হ্যাঁ। রায়পুরের ছোট কুমার সুহাসের মৃত্যুর ব্যাপারটা তো সবই বোধ হয় তোমরা জান?
সব নয়, তবে কিছুটা কিছুটা জানি। মামলার সময় সংবাদপত্র পড়ে যতটুকু জেনেছি।
রায়পুরের মল্লিক-বাড়ির অনেক কথাই তোমরা জান না। এবং যাঁরা বিচারের নামে দীর্ঘদিন ধরে একটা নিছক প্রহসন করে আমার একমাত্র নির্দোষ ছেলেকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দিলেন, তাঁরাও জানতেন না বা জানবার জন্য এতটুকু চেষ্টাও করেননি। অথচ বিচার হয়ে গেল, এবং দোষী সাব্যস্ত করে দ্বীপান্তরের আদেশও হয়ে গেল।
কিন্তু মা, আপনার ছেলের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলিও তো আইনের চোখে খুবই সাংঘাতিক এবং বেশ জোরালো। তাছাড়া আইনের বিচারে তার দোষও প্রমাণিত হয়ে গেছে।
আমি সবই জানি বাবা, প্রমাণিত ঠিক না হলেও প্রমাণিত ধরে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এও জানি, এ ধরনের রায় আবার উচ্চতর আদালতে নাকচও হয়ে গেছে বহুবার। সেই আশাতেই তোমার শরণাপন্ন হয়েছি বাবা।
বলুন মা, এ ব্যাপারে কিভাবে ঠিক আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি?
তোমার সঙ্গে ঠিক চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও, তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অনেকখানি আশা বুকে নিয়েই তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ছেলেকে মুক্ত করে এনে দাও বাবা। জীবনে আমার মুখ দিয়ে কোনো দিনও মিথ্যা কথা বের হয়নি। আমি জানি, ছেলে আমার। নির্দোষ। ঘটনার দুর্বিপাকে সে এই হত্যার মামলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাকে বাঁচাও।
স্নেহসিক্ত কাকুতিতে ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর যেন শেষের দিকে রুদ্ধ হয়ে আসে। কিরীটী ঠিক কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরের মধ্যে একটা দুঃসহ স্তব্ধতা যেন থমথম করে। বাইরে জমাট-বাঁধা শীতের অন্ধকার।
ভদ্রমহিলা আবার একসময় বলতে শুরু করেন, বড় দুঃখে তাকে আমি মানুষ করেছি বাবা। ওইটিই আমার একমাত্র সন্তান; ওর বয়স যখন মাত্র তিন বৎসর তখন আমার স্বামী অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।
কিরীটী যেন ওর শেষের কথা কটি শুনে হঠাৎ চমকে ওঠে। বলে, কি বললেন?
ভদ্রমহিলা কিরীটীর আকস্মিক প্রশ্নে বিস্মিতভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরভাবে বললেন, বলছিলাম আমার স্বামীর কথা।
কিরীটী আবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, গোড়া থেকে সব কথা আমাকে যথাসম্ভব খুলে বলুন তো মা।
গোড়া থেকে বলব?
হ্যাঁ, এইমাত্র আপনার স্বামীর কথা যা বলছিলেন, সব একেবারে গোড়া থেকে বলুন।