আর ইউ অ্যাফ্রেড অফ দ্য ডার্ক (অন্ধকারের হাতছানি) –- সিডনি সেলডন
গল্প শুরুর আগে
০১.
শহরে একসঙ্গে পাঁচজন মানুষের মৃত্যু হল। ভয়ংকর এবং রহস্যজনকভাবে। তাঁদের মধ্যে একটা ব্যাপারে মিল আছে, তারা সকলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। দুজন মৃতের বিধবারা আসারে নামলেন। একজন বিখ্যাত শিল্পী ডায়না স্টিভেন, অন্যজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুপার মডেল কেলি হ্যারিস। প্রতি পদক্ষেপে তাঁদের আতঙ্কঘন প্রহরের মধ্যে দিয়ে সময় কাটাতে হয়েছে। একে অন্যকে সন্দেহ করতে শুরু করলেন। সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার অপূর্ব সংমিশ্রণে তাঁরা কি শেষ পর্যন্ত এই লড়াইতে জয়যুক্ত হয়েছিলেন, নাকি তাদের পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়? কী আশ্চর্য, যে পুরুষদের তারা ভালোবাসতেন, তাদের মৃত্যু রহস্য অজানা থেকে গেল কি? এক হাড় হিম করা ষড়যন্ত্রের কাহিনী, আরও একবার আমাদের অবাক করে দেয়।
অবতরণিকা
বার্লিন, জার্মানি
সোনঝা ভারব্রুগ ভেবেছিলেন কি, এই পৃথিবীতে আজই তার শেষ দিন? তিনি ব্যস্ত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন পর্যটকদের দিকে। বার বার ভাবছিলেন, না, ভয় পেয়ে কী লাভ? আমাকে এখন ধৈর্য ধরতে হবে।
ফ্রানজের কাছ থেকে একটা খবর এসেছে, কম্পিউটারে। বলা হয়েছে সোনঝা পালিয়ে যাও, হোটেলে চলে যাও। সেখানে গেলে তুমি নিরাপদ, আমি তোমাকে ফোন না করা পর্যন্ত তুমি সেখানেই থাকবে…
মেসেজটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। কেন ফ্রানজ এটা শেষ করেনি? কিছু একটা হয়েছে কি? আগের রাতে সোনঝা শুনেছিলেন, তাঁর স্বামী কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। প্রাইমার নামটা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। যে করেই হোক প্রাইমারকে বাধা দিতে হবে, কে এই প্রাইমার?
শ্রীমতী ভারব্রুগ রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। একটু দূরেই ওই হোটেলটার অবস্থিতি। এখানে শুধুমাত্র মেয়েরা প্রবেশ করতে পারে।
তিনি ভাবলেন, আমি ফ্রানজের জন্য অপেক্ষা করব। ফ্রানজ এলে সব কথা শুনব।
সোনঝা যখন পাশে এগিয়ে গেছেন, হঠাৎ ট্রাফিক আলো লাল হয়ে গেল। মনে হল, কেউ বোধহয় সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে। সোনঝা মাটিতে পড়ে গেলেন। উন্মুক্ত আচরণ। একটা লিমুজিন ধাক্কা দিয়েছে। লোজন হৈ-চৈ করতে করতে ছুটে এসেছে।
আপনি ঠিক আছেন?
একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে গেল, দুজন সহকারী নেমে এসেছে। তারা বলল, আমরা এই আহত মহিলার দেখাশোনা করছি।
একটু বাদে সোনঝা ভারব্রুগ নিজেকে অ্যাম্বুলেন্সে দেখলেন। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
সোনঝা বললেন আমি ভালো আছি, আমায় ছেড়ে দিন। অ্যাম্বুলেন্সের দরকার নেই।
একজন সহকারী হাসতে হাসতে বলল- শ্রীমতী ভারব্রুগ, শুয়ে থাকুন, চিন্তা করছেন কেন?
সোন অবাক হয়ে তাকালেন আপনি আমার নাম জানলেন কী করে
মনে হল, একটা হাইপোডারমিক উঁচ তার শরীরে প্রবেশ করেছে। একটু বাদে সব কিছু ঘন অন্ধকার!
.
প্যারিস, ফ্রান্স
মার্ক হ্যারিস ইফেল টাওয়ারের অবজারভেশন ডেস্কে একা বসে আছেন। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। না, সময়টা মোটেই ভালো না।
সিনে নদীর ধারে বিখ্যাত বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সুসজ্জিত উদ্যান। তিনি কেবল প্রাইমারের কথা ভাবছেন। প্রাইমার সম্পর্কে যে আশ্চর্য খবরটা শুনেছেন, তার সত্যতা যাচাই করতে হবে।
বাতাস আরও বেগবতী হয়ে উঠেছে। মার্ক ঘড়ির দিকে তাকালেন, ওরা দেরী করছে কেন? ওরা কেন মধ্যরাতে এখানে আসতে চাইছে? হঠাৎ এলিভেটরের দরজাটা খুলে গেল। দুজন নোক ঢুকে পড়েছে।
মার্ক তাদের চিনতে পেরেছেন, মার্কের মনে আনন্দ দেরী হল কেন?
–মার্ক দুঃখিত, হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটাই আটকে দিল।
–ওয়াশিংটনের মিটিং-এর কী খবর?
–সে বিষয়ে কথা বলতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আজ সকালে অনেকক্ষণ আলোচনা হয়েছে।
ওরা কথা বলছিল, হঠাৎ দ্বিতীয় ব্যক্তি মার্কের পেছনে এসে দাঁড়াল। দুটো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল। ভেতা ধাতব খণ্ড দিয়ে মার্কের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করা হল। তারপর তার আহত শরীরটা ঠেলে ফেলে দেওয়া হল। আটত্রিশতলা থেকে শরীরটা ক্রমশ নীচে নেমে এল।
.
ডেনভার, কলোরাডো
গ্যারি রেনল্ডস ভ্যাঙ্কুবারের কাছে একটা বিচ্ছিরি জায়গায় বড়ো হয়েছেন। তিনি ছোটো থেকেই ছিলেন বেপরোয়া। আকাশে উড়তে ভালোবাসতেন। যত্নে প্রশিক্ষণ নিলেন। পাইলট হবার স্বপ্ন সফল করলেন।
প্লেনটাতে এমন ককপিট আছে, যেখানে দুজন পাইলট থাকতে পারে। কিন্তু আজ সহকারী পাইলট বলতে কেউ নেই।
রেনল্ডস ভাবলেন।
তাকে কেনেডি এয়ারপোর্টে যেতে হবে। ডেনভারের কেউ এই ব্যাপারটা ভাবতেই পারবে না, প্রাইমার বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। সারারাত বোনের বাড়িতে কাটাবেন। সকালবেলা যাত্রা শুরু হবে।
রেডিয়োতে একটা শব্দ শোনা গেল।–আমরা কন্ট্রোল টাওয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ডেনভার ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট, শুনতে পাচ্ছেন তো?
গ্যারি রেনল্ডস বোতামটা টিপে বললেন- হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, রাস্তা পরিষ্কার করুন।
-ঠিক আছে।
পনেরো মাইল উত্তর পূর্বে আছে, ডেনভার এয়ারেগোর্ট, পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে।
পরিষ্কার আকাশ ঘন নীল, আবহাওয়াতে কোনো গোলমাল নেই।
কিছুক্ষণ নীরবতা, আবার টাওয়ার থেকে শব্দ ভেসে এল হ্যাঁ, আমি বলছি, ২৬ নম্বর রানওয়েতে বিমানটি অবতরণ করাবেন।
–ঠিক আছে।
গ্যারি রেনল্ডসের মনে হল, হঠাৎ এই প্লেনে বোধহয় কোনো বিপর্যয় ঘটে গেছে। তিনি ককপিটের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। শক্তিশালী একটা মেঘ উড়ে আসছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে পড়ল এই বিমানটি। অসহায়ভাবে একবার এদিক ওদিক করল। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন বিমানের গতিপথে ফিরে আসতে। না, সম্ভব নয়। কিছুতেই আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না, রেডিও বোতামে হাত দিলেন।
দরকারি খবর আছে।
কী হয়েছে?
গ্যারি রেনল্ডস চীৎকার করছেন মাইক্রোফোনে আমি প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে পড়েছি। অসম্ভব ঝড়। হ্যারিকেন মনে হচ্ছে।
–ডেনভারের থেকে আপনি মাত্র সাড়ে চার মিনিট দূরে আছেন। কই আমাদের স্ক্রিনে। তো ঝড়ের চিহ্ন মাত্র নেই।
-আঃ, স্ক্রিনে কী হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তা করব কেন?
–হয়তো… হয়তো…
আর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না, র্যাডার স্ক্রিন থেকে বিমানটা হারিয়ে গেল।
.
ম্যানহাট্টান, নিউইয়র্ক
ভোর হয়েছে, ম্যানহাট্টান বীচ, ইসটু রিভার, পুলিশ অফিসাররা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাদা পোশাকের ডিটেকটিভ এসেছেন। মৃতদেহটা পাওয়া গেছে। জলের মধ্যে ডুবছে আর ভাসছে।
ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ এগিয়ে এলেন। তিনি ম্যানহাট্টান স্কোয়াড থেকে এসেছেন। তাকে এখন অনেকগুলো কাজ করতে হবে। ছবি নেওয়া শুরু হয়েছে। আহা, কীভাবে ঘটনাটা ঘটে গেছে।
কার্ল ওয়ার্ড হলেন মেডিকেল পরীক্ষক। তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তিনি ট্রাউজারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গকে আমরা পেশাদারী ভদ্রলোক বলতে পারি। অত্যন্ত ভালো রেকর্ড আছে তাঁর। আরেক ডিটেকটিভ রবার্টের মাথার চুল ধূসর হয়ে গেছে।
ওয়ার্ড গ্রিনবার্গকে বললেন- আর্ল, কাজ শেষ হয়েছে।
–আমরা কী পেয়েছি?
-বুঝতে পারছি না, কীভাবে মৃত্যুটা হয়েছে, গলা কেটে মেরে ফেলা হয়েছে। পায়ে আঘাতের ছাপ আছে। মনে হচ্ছে পায়ের কটা হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
কখন মৃত্যুটা হয়েছে বলে মনে হয়।
ওয়ার্ড ওই মৃতের মুখের দিকে তাকালেন বলতে পারছি না। মধ্যরাতেই বলে মনে হচ্ছে। মর্গের রিপোর্ট পেলে আমি সব কিছু বুঝিয়ে বলতে পারব।
গ্রিনবার্গ আবার মৃতদেহটার দিকে তাকালেন, ধূসর রঙের জ্যাকেট, ঘন নীল ট্রাউজার, হালকা নীল টাই, বাঁ হাতে একটা অত্যন্ত দামী ঘড়ি আছে।
লোকটা কে? কী পরিচয়? সবকিছু সাবধানে জানতে হবে।
উনি মৃতের পকেটে হাত দিলেন। একটা চিরকুট পাওয়া গেল। লেখা আছে ওয়াশিংটন, সোমবার, সকাল দশটা, প্রাইমার।
উনি অবাক হয়ে গেলেন। গ্রিনবার্গ আরেকটা পকেটে হাত দিলেন। আরেকটা চিরকুট পাওয়া গেল। ইটালীয় ভাষাতে লেখা।
একজন পুলিশ অফিসারকে বলা হল- আপনি এর মানে উদ্ধার করুন তো?
উনি পড়তে থাকলেন- শেষ সুযোগ, এখনই আমার সঙ্গে দেখা করো, না হলে সব হাতের বাইরে চলে যাবে।
রবার্ট অবাক হয়ে তাকালেন মাফিয়াদের আক্রমণ? এইভাবে, প্রকাশ্য দিবালোকে।
গ্রিনবার্গ বললেন- হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
মৃতের অন্যান্য পকেটে হাত দেওয়া হল।
ওয়ালেট পাওয়া গেল, টাকায় ভর্তি।
–এত টাকা? কিন্তু টাকা তো চুরি যায়নি? এই লোকটার নাম রিচার্ড স্টিভেন্স।
এক ডিটেকটিভ অবাক হয়েছেন খবরের কাগজে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছু কথা বেরিয়েছিল।
গ্রিনবার্গ বললেন– না, ওঁর বউ ডায়না স্টিভেন্স, উনি এখন কোর্টে আছেন, টনি মার্ডার ট্রায়ালে অভিযুক্ত।
এক ডিটেকটিভ বললেন হ্যাঁ, খেলাটা এবার জমে উঠেছে।
তারা সকলে রিচার্ড স্টিভেন্সের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছেন।
.
০১.
ডাউনটাউন, ম্যানহাট্টান, কোর্ট রুম
সুপ্রিম কোর্টের ৩৭ নম্বর ঘর। বিচার চলেছে। অ্যানথনির কোর্টরুমে অনেক মানুষের ভিড়।
অ্যানথনিকে দেখা গেল, হুইল চেয়ারে বসে আছেন। বিবর্ণ চেহারা, কিন্তু চোখ দুটো জীবন্ত। মাঝে মধ্যে তিনি ডায়ানা স্টিভেন্সের দিকে তাকাচ্ছেন, চোখ থেকে ঘৃণা উপছে পড়ছে।
তার পাশে জ্যাক রুভেন্স টাইনস, তার ডিফেন্স অ্যাটর্নি। রুভেন্স টাইনসের দুটো বিষয়ে খ্যাতি আছে। অত্যন্ত উঁচু মানুষদের সাথে যোগাযোগ, এ-ছাড়া তার অধিকাংশ মক্কেল কেসে ছাড়া পেয়ে যায়।
রুভেন্স টাইনসের চেহারাটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেঁটে খাটো চেহারার মানুষ। মনে কল্পনা আছে।
আইনজীবীরা এবার সওয়াল জবাব শুরু করবেন। ডায়ানা স্টিভেন্স, বছর ত্রিশ বয়স। আভিজাত্যের ছাপ আছে। চুলের রং সোনালী। সবুজ চোখ। চেহারাটা আবেদনী।
সুন্দর কালো পোশাক পরেছেন। রুভেন্স টাইনস জানেন, এইভাবে মেয়েটি হয়তো জুরিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন।
রুভেন্স টাইনস সময় নিলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সাক্ষ্যদানের বাক্সের দিকে। শান্তভাবে বললেন–শ্রীমতী স্টিভেন্স, গতকাল আমি যেখানে শেষ করেছিলাম, অক্টোবরের ১৪ তারিখ, আপনি হেনরী হাডসন পার্কওয়ে থেকে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলেন। ১৫০ স্ট্রিটের পাশে এলেন। ফোক ওয়াশিংটন পার্কে যাবার ইচ্ছে ছিল।
-হ্যাঁ, কণ্ঠস্বর কোমল এবং আবেদনী।
–আপনি ওখানে থামলেন কেন?
–আমি প্রধান রাস্তা থেকে একটা গলিতে ঢুকতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারে। গাড়িটা খারাপ হয়েছিল।
–আপনি কি কোনো অটোক্লাবের মেম্বার?
–হ্যাঁ।
–আপনার গাড়িতে ফোন আছে?
–হ্যাঁ।
–আপনি কেন অটোক্লাবকে ফোন করলেন না?
–আমি ভেবেছিলাম অনেকটা সময় লাগবে।
–কেবিন ঠিক ছিল?
–হ্যাঁ।
–আপনি কেবিনে গেলে সাহায্য পেতেন।
ঠিক বলেছেন।
বাইরে আলো ছিল?
–হ্যাঁ, বিকেল পাঁচটা।
আপনি পরিষ্কার দেখলেন?
–হ্যাঁ।
–কী দেখলেন মিসেস স্টিভেন্স?
–আমি অ্যানথনিকে দেখতে পেলাম।
–তাকে কি আপনি আগে দেখেছিলেন?
–না।
–তাহলে কী করে বুঝলেন যে উনিই অ্যানথনি?
–আমি খবরের কাগজে ওনার ছবি দেখেছি।
–তাহলে? ছবি দেখে চিনতে পেরেছেন।
–হ্যাঁ।
–কেবিনে কী দেখলেন?
ডায়ানা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন। বললেন– ঘরে চারজন মানুষ ছিল। একজন চেয়ারে বসে ছিল, তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। অ্যানথনি প্রশ্ন করছিলেন। দুজন পাশে দাঁড়িয়েছিল। অ্যানথনির হাতে একটা বন্দুক ছিল, তিনি কিছু বলার চেষ্টা করলেন। লোকটার মাথায় গুলি করলেন।
জ্যাক রুভেন্স টাইনস জুরিদের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, তাদের চোখমুখ থমথম করছে।
–মিসেস স্টিভেন্স, এরপর আপনি কী করলেন?
আমি আমার গাড়িতে ফিরে এলাম। সেলফোন থেকে ৯১১ ফোন করলাম।
–তারপর?
–আমি গাড়ি চালিয়ে দিলাম।
–ওই ভাঙাচোরা টায়ার নিয়ে?
হ্যাঁ।
পুলিশের জন্য অপেক্ষা করলেন না কেন?
ডায়ানা চারদিকে তাকালেন। তারপর বললেন– আমি ওখানে থাকতে সাহস পাচ্ছিলাম না,, আমি ভাবছিলাম কেবিন থেকে ওই লোকটা হয়তো বাইরে বেরিয়ে আসবে এবং আমাকে মেরে ফেলবে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, রুভেন্স টাইনের কণ্ঠস্বর শান্ত। কিন্তু পুলিশ যখন ৯১১ কল শুনল, তারা কেবিনে গেল, সেখানে কেউ ছিল না। মিসেস স্টিভেন্স, ব্যাপারটা কী বলুন তো?
–আমি কী করে জানব?
–আপনি তো একজন শিল্পী তাই না মিসেস স্টিভেন্স?
–হ্যাঁ।
–আপনি কি এই কাজে সফল?
–হ্যাঁ, কিন্তু তার সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক?
–একটু প্রচার তাই তো? টেলিভিশনে আপনার দিকে সকলে তাকিয়ে থাকবে, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আপনার ছবি।
ডায়ানা রেগে গেছেন- আমি একাজ কখনোই করব না। আমি কি একটা সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলতে পারি?
না, এই শব্দটা সম্পর্কে আপত্তি আছে শ্রীমতী স্টিভেন্স। আমি প্রমাণ করব আজ যাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তিনি নিরাপরাধ। আমার কথা বলা শেষ হয়ে গেছে।
ডায়ানা স্টিভেন্স তাকালেন, বললেন আমি কী এখন যেতে পারবো।
কাউকে সঙ্গে দেব?
না, দরকার নেই।
উনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, পার্কিং গ্যারেজের দিকে পা রাখলেন। অ্যাটর্নির কথা তার কানে বাজছে। আপনি একজন শিল্পী তাই না? অতিরিক্ত প্রচার?
না, ব্যাপারটা মন থেকে সরাতে হবে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেছে, উনি এখন বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন।
.
লাল আলো জ্বলে উঠেছে। ডায়ানা ব্রেক কষলেন। কালো পোশাক পরা এক যুবা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি হারিয়ে গেছি, আপনি কি আমাকে পথ দেখাবেন?
ডায়ানা তাকালেন।
কীভাবে আমি হল্যান্ড টানেলে যাব বলবেন কি? কথার মধ্যে ইতালীয় ছাপ আছে।
–প্রথমে ডানদিকে যান…
ওই ছেলেটি হাত তুলল, সাইলেন্সর লাগানো একটা বন্দুক।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসুন, তাড়াতাড়ি।
ডায়ানার মুখ বিবর্ণ- ঠিক আছে।
উনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন। লোকটা পেছন দিকে ফিরল, ডায়ানা একসেলেটারে চাপ দিলেন। গাড়িটা অত্যন্ত দ্রুত সামনের থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, বুলেট এসে আঘাত করল। কাঁচের জানলা ভেঙে গেল। আবার আরেকটা বুলেটের আঘাত। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়েছে।
ডায়ানা স্টিভেন্স পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি জানেন, এইভাবে গাড়ি হাইজ্যাক করা হয়। তবে ব্যাপারটা এত সহজে ঘটে না।
তাহলে? ওই লোকটা কি আমাকে মারতে চেয়েছে। কিন্তু কেন? ডায়ানা সেলফোন থেকে ৯১১ ডায়াল করলেন। দু-মিনিট বাদে অপারেটরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
বলুন কী দরকার?
ডায়ানা সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। উনি জানেন এটা বৃথা। ওই লোকটা নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে।
আমি এখানকার একজন অফিসারকে খবর দিচ্ছি। আপনার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর দেবেন কি?
ডায়ানা সবকিছু দিলেন। তিনি জানলা দিয়ে তাকালেন। অবাক হলেন। রিচার্ডকে পাওয়া যাবে কি? সবকথা খুলে বলতে হবে।
হঠাৎ একটা ধারণা তার মনে এল, ওই লোকটা কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে? নাকি এটা নেহাতই একটা সমাপতন।
রিচার্ডের সঙ্গে যে কথা হয়েছিল মনে পড়ল, বলা হয়েছিল- ডায়ানা, তুমি এর মধ্যে নিজেকে জড়িও না, বিপদের সম্ভাবনা আছে।
-না-না, ভয় নেই, ওই লোকটাকে নিশ্চয়ই ফাঁসি দেওয়া হবে। অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
–কিন্তু ওর বন্ধুরা আছে, ওরা ভয়ংকর।
রিচার্ড, আমি এখন কী করে পিছিয়ে আসব?
ডায়ানা ভাবলেন, না, এই ব্যাপারে যুক্ত থেকে লাভ নেই।
ডায়ানার গাড়ি এখন হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ৬৭০ ফিট স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ পৌঁছে গেলেন। গাড়িটাকে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত নিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। সবকিছু শান্ত এবং স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।
অ্যাপার্টমেন্টটা ভালো, ডুপ্লেট ধরনের। মস্ত বড়ো লিভিংরুম আছে, বিরাট জানলা, মার্বেল দিয়ে তৈরি একটা ফায়ার প্লেস। সুন্দর সাজানো সোফা, আঁরাম চেয়ার, বুককেস, টেলিভিশন স্ক্রিন। দেয়ালে নানা রঙের কারুকাজ। ভালোভাবে বেঁচে থাকার চমৎকার সমারোহ।
একটা বেডরুম আছে দোতলাতে। বাথরুম, অতিথিদের থাকার জন্য আলাদা একটা বেডরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আছে একুটকরো সুন্দর অলিন্দ যেখানে ডায়ানা বসে ছবি আঁকেন। দেয়ালে তার আঁকা বেশ কয়েকটা ছবি ঝুলছে। ঘরের মধ্যে একটা ইজেল আছে, অসমাপ্ত একটি পোর্ট্রেট।
ডায়ানা এখন কী করবেন? তিনি অর্ধসমাপ্ত ছবিটা সরিয়ে ফেললেন। ক্যানভাসটা এখন একেবারে ফাঁকা। তিনি ওই লোকটার ছবি আঁকতে শুরু করলেন, যে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। দুটো হাত ঠকঠক করে কাঁপছে, ছবিটা মোটেই ভালো হল না।
.
ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ বললেন– এই কাজটা করতে আমি ভালোবাসি না। তারা ডায়ানা স্টিভেন্সের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চলেছেন।
রবার্ট বললেন– ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করা দরকার। কিন্তু আমরা ওনাকে কী বলব?
আর্ল গ্রিনবার্গ হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। জনৈক মিসেস স্টিভেন্সকে খবর দিতে হবে, দুর্ঘটনাতে তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর। এইসব খবর দিতে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ডিটেকটিভরা স্টিভেন্সে বাড়ির দরজায় আঘাত করলেন। দরজা খুলে গেল, স্টিভেন্সের স্ত্রী বেরিয়ে এসেছে। একজন গোয়েন্দা প্রশ্ন করলেন
ডোডারবেলের শব্দ, ডায়ানা ইন্টারকমে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কে?
ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
পুলিশ এসে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি?
ডায়ানা বাজারে হাত দিলেন। গ্রিনবার্গ হলওয়েতে প্রবেশ করছেন।
–হ্যালো? মিসেস স্টিভেন্স?
বাঃ, খুব তাড়াতাড়ি এসেছেন তো। আমি লোকটার ছবি আঁকার চেষ্টা করছি, তার চোখের রং বাদামী, গলায় একটা ছোট্ট তিল আছে। তার বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো ছিল।
গ্রিনবার্গ অবাক হয়ে গেছেন– আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমার গাড়িটা চুরি করার চেষ্টা হয়েছিল। আমি ৯১১ ফোন করেছিলাম। তিনি ডিটেকটিভের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন– আপনারা সেই ব্যাপারে এসেছেন তাই তো?
গ্রিনবার্গ বললেন– না, আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
–আসুন। গ্রিনবার্গ অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করলেন। এবার ডায়ানার অবাক হবার পালা– তাহলে? কোনো কিছু ভুল হয়েছে।
–হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, একটা খারাপ খবর আছে। আপনার স্বামী সম্পর্কে।
কী খবর?
তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
কী ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট?
–গতরাতে তার মৃত্যু হয়েছে মিসেস স্টিভেন্স, আমরা ইস্টটিরভার নদীতে একটা মৃতদেহ পেয়েছি।
ডায়ানা তাকালেন অনেকক্ষণ, মাথা নাড়লেন। মনে হচ্ছে, আপনারা ভুল লোককে সনাক্ত করেছেন। আমার স্বামী এখন ল্যাবোরেটরীতে কাজে ব্যস্ত আছে।
ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবুও ডিটেকটিভ জানতে চাইলেন মিসেস স্টিভেন্স, আপনার স্বামী গতকাল রাত্রে বাড়ি এসেছিলেন?
-না, মাঝে মধ্যে রিচার্ড সারা রাত ধরে ল্যাবরেটরীতে কাজ করে। সে একজন বিজ্ঞানী।
ডায়ানা আরও উত্তেজিত।
-মিসেস স্টিভেন্স, আপনি কি জানেন আপনার স্বামী মাফিয়া চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
–মাফিয়া? আপনি কী পাগল?
–আমরা প্রমাণ পেয়েছি।
–দেখি আপনার পরিচিতি পত্র।
–অবশ্যই, ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ তাঁর পরিচয় পত্র দেখালেন। ডায়ানা দেখে ফেরত দিলেন। তারপর বললেন- লোকে কি এইজন্য আপনাদের পুষছে? আমার স্বামীর সম্পর্কে একথা কেন বলছেন? সে মারা যান নি, ল্যাবোরেটরীতে কাজে ব্যস্ত আছে।
গ্রিনবার্গ ডায়ানার চোখের দিকে তাকালেন। বললেন মিসেস স্টিভেন্স, আমি কি আপনার দেখাশোনার জন্য কাউকে পাঠাব?
না, আপনি কারোর সাহায্য নিন।
–মিসেস স্টিভেন্স?
গ্রিনবার্গ তার বিজনেস কার্ডটা ডায়ানার হাতে তুলে দিলেন। বললেন- কথা বলার ইচ্ছে থাকলে এখানে ফোন করবেন।
তিনি দরজা দিয়ে বাইরে এলেন। গ্রিনবার্গ ভাবলেন, না, ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেল।
.
ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ চলে গেলেন। ডায়ানা সদর দরজাটা বন্ধ করলেন। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বোকা, ভুল জায়গাতে এসে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। এই লোকর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকালেন। রিচার্ডের আসবার সময় হল। এবার ডিনার তৈরি করতে হবে।
ডায়ানা কিচেনে ঢুকে পড়লেন। কাজে মন দিলেন।
.
রিচার্ড যে কাজ করেন, তার মধ্যে গোপনীয়তার ছাপ থাকে। ডায়ানা কখনও রিচার্ডকে বিরক্ত করতে ল্যাবোরেটরীতে যায় না। যখনই রিচার্ডের ফিরতে দেরী হয়, ডায়ানা জানেন, আজ নতুন একটা আবিষ্কারের ব্যাপার আছে। আটটা বাজল, খাবার তৈরি হয়েছে। দারুণ হয়েছে খাবারটা। রিচার্ড এটা ভালোভাসে। রাত্রি দশটা, রিচার্ড এখনও এল না কেন? ডায়ানা খাবারটা ফ্রিজে তুলে রাখলেন। এবার কী করা যেতে পারে? রেফ্রিজারেটারের দরজায় একটা চিরকুট লাগিয়ে দিলেন- ডার্লিং, ফ্রিজের ভেতর খাবার আছে। তুমি এসে আমার ঘুম ভাঙিও।
রিচার্ড নিশ্চয়ই ফিরে এসে খেতে চাইবে।
ডায়ানার মনে হল, ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে। তিনি একটা নাইট গাউন পরলেন। দাঁত মাজলেন। বিছানাতে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।
রাত্রি তিনটে, হঠাৎ ডায়ানার ঘুমটা ভেঙে গেল।
.
০২.
এখনও সকাল হয়নি, শীতের হাওয়া, রিচার্ড মারা গেছে, রিচার্ডের সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হবে না? রিচার্ডের কণ্ঠস্বর আর আমি শুনতে পাবো না? তার শরীরের উষ্মতা? এটা আমারই ভুল, আমি কেন কোর্ট রুমে গেলাম? রিচার্ড তুমি আমাকে ক্ষমা করো, আমায় ক্ষমা করো, আমায় ক্ষমা করো। তুমি আমার জীবনের সবকিছু ছিলে।
–এখন ডায়ানা কী করবেন? তিনি কী মরে যাবেন? তিনি কী একটা ছোটো বলের মতো হয়ে যাবেন? তিনি কী চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যাবেন?
অনেক কথাই মনে পড়ল, কীভাবে রিচার্ড তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল।
.
ডায়ানা বেড়ে উঠেছিলেন স্যান্স পয়েন্টে। নিউইয়র্কে। যেখানে অভিজাত মানুষেরা বসবাস করে। তার বাবা ছিলেন সার্জেন্ট, মা একজন শিল্পী। তিন বছর বয়স থেকে ডায়ানার ছবি আঁকার পাঠ শুরু। সেন্ট পলস বোর্ডিং স্কুলে ছিলেন। কলেজে এলেন, অঙ্ক প্রফেসারের সঙ্গে ছোট্ট একটা সম্পর্ক। এটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি।
শিল্পকলা ভালোবাসতেন। যে কোনো ছবির আসরে যেতেন। ডায়ানা শেষ অবধি গ্রাজুয়েট হলেন, নিজের ছবি বিক্রি করা শুরু করলেন। উদীয়মান আর্টিস্ট হিসেবে এখন তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেই সময় বসন্তকালে ফিফথ এ্যাভেনিউর আর্ট গ্যালারিতে ডায়ানার চিত্র প্রদর্শনীর আসর বসল। অসম্ভব সফলতা। ওই আর্ট গ্যালারির মালিকের নাম পল ডেকন, তিনি এক বিশিষ্ট মানুষ। ডায়ানাকে সাহায্য করলেন।
একদিন, ডেকন মুখে হাসি এনে ডায়ানাকে বললেন- ধন্যবাদ, বেশির ভাগ ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে আমরা আরেকটা ছবির প্রদর্শনী করব।
উনি ডায়ানার পিঠে হাত রেখে বললেন– অসম্ভব সফলতা।
ডায়ানা অটোগ্রাফে সই দিচ্ছিলেন। একজন হঠাৎ ডায়ানার কাছে একটা বাজে প্রস্তাব রাখলেন। তিনি বললেন- আপনার শরীরটা তো সাংঘাতিক।
ডায়ানা রেগে গেলেন এই কথা শুনে। কিছু বলার চেষ্টা করলেন। না, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, ছ-ফুটের মতো লম্বা, সুন্দর চেহারা, সোনালী চুল, নীল চোখ। ভালো একটা স্যুট পরেছেন। সাদা শার্ট। বাদামী টাই।
আরেকজন এসে গেছেন, কথা বলার চেষ্টা হচ্ছে।
প্রথমজন জিজ্ঞাসা করলেন– কখন থেকে আপনার ছবি আঁকার কাজ শুরু হয়েছে?
ছোটাবেলা থেকেই, আমার মা ছিলেন একজন শিল্পী।
ভদ্রলোকের মুখে হাসি। আমার মা একজন রাঁধুনি, কিন্তু আমি রান্না করতে জানি না। আমার নাম রিচার্ড স্টিভেন্স।
তখনই পল ডেকনকে দেখা গেল। পল বললেন মি. স্টিভেন্স, এই হল আপনার ছবি।
এবার ডায়ানার অবাক হবার পালা।
–আপনি আমার তিনটে ছবি কিনেছেন?
–আমার অ্যাপার্টমেন্টে আপনার আরও দুটি ছবি আছে।
–আমার খুবই ভালো লাগছে।
–আমি প্রতিভার সম্মান করি।
–অনেক ধন্যবাদ।
–আপনি হয়তো ব্যস্ত আছেন। আমি এখন আসছি।
ডায়ানা বললেন না। আমি ভালোই আছি।
মুখে হাসি মিস ওয়েস্ট, আপনি একটা সাহায্য করবেন?
ডায়ানা ভদ্রলোকের বাঁ হাতের দিকে তাকালেন। না, সেখানে বিয়ের কোনো চিহ্ন নেই।
কাল রাতে আমি একটা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি। আপনি কি ফাঁকা আছেন?
ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। কিন্তু… একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত …ভীষণ বিপদের ব্যাপার
শেষ অবধি ডায়ানা বলেছিলেন- ঠিক আছে আমি সঙ্গে যাব।
.
সন্ধ্যেটা ছিল উজ্জ্বল। রিচার্ড স্টিভেন্সকে এক আবেদনী পুরুষ বলা যেতে পারে। তিনি শিল্প এবং সংগীতের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। ডায়ানা তার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করলেন।
সন্ধ্যেটা শেষ হয়ে গেল, রিচার্ড জানতে চাইলেন- কালকে আপনি ফাঁকা আছেন?
এবার আর কোনো চিন্তা ভাবনা নয়- হ্যাঁ, আছি।
পরের দিন তাদের দেখা গেল শহরের এক শান্ত রেস্টুরেন্টে।
রিচার্ড তার ফেলে আসা দিন যাপনের গল্পকথা শোনালেন। শিকাগোতে জন্ম, বাবা ছিলেন স্থপতি, বাড়িঘরের নকশা তৈরি করতেন। সারা পৃথিবীতে। মার সাথে তিনি নানা দেশ পরিভ্রমণ করেছেন, একাধিক বিদেশী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। অনায়াসে বেশ কয়েকটি ভাষা বলতে পারেন।
-এখন আপনি কী করেন? ডায়ানা জানতে চেয়েছিলেন।
আমি কিনসে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের হয়ে কাজ করি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীরা এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন।
ব্যাপারটা উত্তেজক।
–হ্যাঁ, আমরা তথ্য প্রযুক্তির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করি। ভবিষ্যতে আমরা আরও অনেক বিষয়ের অবতারণা করবো। কিন্তু সবকথা আপনাকে গুছিয়ে বলতে পারছি না!
ডিনার শেষ হয়ে গেল, রিচার্ড ডায়ানাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। হাতে হাতে রেখে বললেন- সন্ধ্যেটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিচার্ড চলে গেলেন, ডায়ানা ভাবলেন, পৃথিবীর সব পুরুষ নেকড়ে নয়!
.
এবার তাদের নানা জায়গাতে একসঙ্গে দেখা গেল, রাতের পর রাত, প্রতিবার ডায়ানার মনে হয়, রিচার্ডের মধ্যে একটা আগুন আঁচ আছে।
শুক্রবারের সন্ধ্যে, রিচার্ড বললেন শনিবার একটা দলের খেলা হবে। আপনি কি দেখতে আসবেন?
ডায়ানা জবাব দিয়েছিলেন- হ্যাঁ, আমি অবশ্যই খেলা দেখতে ভালোবাসি।
পরের দিন সকালবেলা, ডায়ানা অবাক হয়ে দেখলেন, রিচার্ড একমনে ওদের খেলা শেখাচ্ছেন। রিচার্ডের এই রূপটা দেখে ডায়ানা সত্যি সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
শেষ অবধি ডায়ানার মনে হয়েছিল, আমি বোধহয় এই মানুষটিকে ভালোবেসে ফেলেছি।
.
কয়েক দিন কেটে গেছে, ডায়ানা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিলেন। তারা এক জিপসী জ্যোতিষীর পার্লারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ডায়ানা বললেন দেখি আমার ভাগ্য কী বলছে।
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, ডায়ানা এক জিপসী মহিলার সামনে বসে আছেন, ওই মহিলার দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। মাথার ওপর একটা নোংরা শাল।
ব্যাপারটা খুবই খারাপ ডায়ানা ক্ষণমুহূর্ত ভেবেছিলেন। আমি কেন এই দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
তিনি জানতে চেয়েছিলেন রিচার্ডকে বিয়ে করলে বিবাহিত জীবনটা সুখের হবে কি না। নেহাতই এটা একটা কৌতুক।
ভদ্রমহিলা কতগুলো তাসের ওপর চোখ বুলালেন। তারপর বললেন- হ্যাঁ, এটা হল ভালোবাসার তাস।
ডায়ানা হাসলেন– এটার সাহায্যে আমার ভাগ্য বলা যাবে কি?
-হ্যাঁ, এই তিনটি তাস আপনার ভাগ্য বলে দেবে। আপনি চোখ বন্ধ করে একটি তাসে হাত দেবেন।
ডায়ানা জানতে চেয়েছিলেন, কোন্ তাসে কী লেখা আছে?
সোনালী দাঁতে হাসির ঝিলিক ফাঁসি হওয়া পুরুষ, শয়তান, মৃত্যুর জিঘাংসা।
ডায়ানার শরীরে শীতল শিহরণ, তিনি একটা তাসে হাত দিলেন। কী আশ্চর্য সেখানে লেখা আছে মৃত্যুর জিঘাংসা।
ডায়ানা উঠে দাঁড়ালেন, রেগে গিয়ে বললেন- আমি আপনার এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না।
ভদ্রমহিলার মুখে আবার হাসি- আপনি বিশ্বাস না করলে কী হবে? যা ঘটবার তা তো ঘটবেই।
.
০৩.
বার্লিন, জার্মানি
পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট অটো শিফার, দুজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার, এবং অ্যাপার্টমেন্ট লিজিং- এর কর্তৃপক্ষ এরকারল গোয়েজ তাকিয়ে আছেন নগ্নিকা ওই মহিলার শরীরের দিকে। বাথটবের ভেতর শরীরটা শোয়ানো আছে, গলায় ছুরির দাগ।
পুলিশ প্রধান বললেন- নামটা জানা গেছে?
–সোনঝা ভারব্রুগ, স্বামীর নাম কার্ল ভারব্রুগ, তিনি একজন বিজ্ঞানী।
–এই মহিলা কি তার স্বামীর সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন।
সাত বছর ধরে, ভাড়াটে হিসেবে যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল তাদের। ঠিক সময় ভাড়া দিতেন। কখনও কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেননি। সকলেই তাদের ভালোবাসতেন।
ভদ্রলোক গড়গড় করে বলে চলেছেন।
শ্ৰীমতী ভারব্রুগ কী কোনো কাজ করতেন?
–হ্যাঁ, উনি সাইভারলিন ইন্টারনেট কাফেতে কাজ করতেন। সেখানে লোকেরা এসে কম্পিউটার ব্যবহার করত।
-কীভাবে মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হল?
এই বাথটবের সঙ্গে ঠাণ্ডা জলের কল আছে। আমি মাঝে মধ্যে এসে সেটাকে ঠিক করি। কিন্তু কখনও সেটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না।
তার মানে?
নীচের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়াটে বললেন যে তার সিলিং দিয়ে জল ছুঁইয়ে পড়ছে। আমি এখানে এলাম, দরজাতে শব্দ করলাম, কোনো উত্তর পেলাম না। আমি আরেকটা চাবি দিয়ে দরজাটা খুললাম। বাথরুমে এসে এই দৃশ্যটা দেখতে পেলাম।
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর আবেগ এবং ভয়ে বুজে গেছে।
একজন ডিটেকটিভ বাথরুমের কাছে গিয়ে বললেন- ক্যাবিনেটের ভেতর আর কোনো লিকারের বোতল পাওয়া গেল না, শুধু ওয়াইন আছে।
পুলিশ প্রধান বললেন- ঠিক আছে, তিনি লিকার বোতলের দিকে তাকালেন, হাতের চিহ্নগুলোর পরীক্ষা করা হয়েছে।
তিনি কারল গোয়েজের দিকে তাকিয়ে বললেন-কার্ল ভারব্রুগ কোথায় আছেন আপনি জানেন কি?
না, সকালবেলা তাকে দেখি, তিনি কাজে বেরিয়ে যান।
আজ সকালে দেখেছেন?
–না।
–কার্ল ভারব্রুগ কোথায় যেতে পারেন?
–না, স্যার। এ বিষয়ে আমার কোনো জ্ঞান নেই।
পুলিশ প্রধান এবার ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে বললেন- অন্য ভাড়াটেদের সাথে কথা বলুন। দেখুন তো শ্ৰীমতী ভারব্রুগ এখন কী ধরনের মানসিকতার মধ্যে ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে কিনা। মদ খেতেন কিনা। সব খবর জানতে হবে।
উনি কারল গোয়েজের দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি ওর স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন।
কারল গোয়েজ বললেন– আমি জানি না ব্যাপারটা আমাদের কতখানি সাহায্য করবে। একজন ভাড়াটে বলেছেন, গতকাল এখানে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়েছিল। হয়তো কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। উনি বাইরে এসে দেখার চেষ্টা করেছিলেন, ইতিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সটা চলে গেছে।
পুলিশ প্রধান বললেন- ব্যাপারটা মনে রাখতে হবে।
–এই লাশটা নিয়ে এখন কী হবে? কারল গোয়েজ জানতে চেয়েছিলেন।
-ডাক্তার এসে পড়লেন বলে। ওই টাবটা খালি করে দিন, গায়ে একটা তোয়ালে ঢাকা দিন।
.
০৪.
মনে হচ্ছে একটা খারাপ খবর আসবে। ব্রীজের ধারে মৃত দেহ।… ডায়ানা স্টিভেন্সের কাছে সময় বুঝি থমকে গেছে। তিনি তাঁর বিরাট অ্যাপার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে আছেন, কত স্মৃতির উতরোল। সব আনন্দ হারিয়ে গেছে। রিচার্ড বেঁচে নেই, এখন এটা ঠাণ্ডা ইটের সমারোহ ছাড়া আর কিছু নয়। এটা আর কখনও প্রাণবন্ত হবে না।
ডায়ানা কৌচে বসলেন, চোখ বন্ধ করলেন। রিচার্ড, ডার্লিং, যেদিন আমাদের বিয়ে হয়েছিল, তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কী উপহার নেব? আমি বলেছিলাম, আমি কিছুই চাই না, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবে এটাই আমার উপহার। আমাকে হেসে জড়িয়ে ধরবে। আমার মনে হয় তুমি এখানেই আছে। প্রতিটি জায়গায় আমি তোমার স্পর্শ বুঝতে পারছি। তোমার গলা শুনতে পাচ্ছি।
ডায়ানা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না, দুচোখে তখন জলের ধারা!
.
ডায়ানা যখন বুঝতে পারলেন রিচার্ড মারা গেছেন, তিনি অন্ধকার ঘরের ভেতর কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলেন। টেলিফোন ধরেননি। দরজা খোলেননি। মনে হয়েছিল তিনি বুঝি আহত একটা জন্তু। লুকিয়ে আছেন। যন্ত্রণাটা একাই সহ্য করেছিলেন।
রাত ভোর টেলিফোনটা বেজেই চলল, ডোরবেলের শব্দ, ডায়ানা দরজা খুললেন।
ডায়ানার প্রিয়তমা বান্ধবী, ক্যারোলিন, এসে গেছেন, উনি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন- তোকে কেমন দেখাচ্ছে বল তো? আমরা সবাই তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
–আমি দুঃখিত ক্যারোলিন, আমি এই আঘাতটা সহ্য করতে পারছি না।
ক্যারোলিন ডায়ানার হাতে হাত রাখলেন। কিন্তু দেখ, আমাদের মধ্যে তোকে বেঁচে থাকতে হবে। রিচার্ডের জীবন তত শেষ হয়ে গেছে। তোর জীবন এখনও পড়ে আছে। ভালোবাসার মানুষদের ওপর দরজা বন্ধ করিস না, কেমন? আমি এখন থেকে মাঝে মধ্যে তোর কাছে আসব।
.
রিচার্ড এবং ডায়ানার বন্ধুরা বারবার টেলিফোন করতে থাকলেন। অ্যাপার্টমেন্টে এলেন। ডায়ানার মৃত্যুর ধারাবাহিক গল্প শুনতে লাগলেন।
বলা হল, ডায়ানা এভাবে ভাববার চেষ্টা কর, রিচার্ডের আত্মা এখন শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।
–ডার্লিং, ঈশ্বর তাকে ডেকে নিয়েছেন।
রিচার্ড এখন স্বর্গে বাস করছেন।
উনি একটা ভালো জায়গাতে চলে গেছেন।
ডায়ানা আর্তনাদ করার চেষ্টা করেছিলেন।
অসংখ্য মানুষ ডায়ানার সাথে দেখা করতে চাইছে। আর্ট গ্যালারির মালিক পল বেকন এলেন। তিনি ডায়ানার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন- আপনার সঙ্গে দেখা করার কত চেষ্টা করেছি।
–আমি জানি।
রিচার্ডের ব্যাপারটা ভাবলে খুব খারাপ লাগছে। সত্যিকারের ভদ্রলোক ছিলেন। ডায়ানা এভাবে জীবন কাটাতে পারবেন কি? আমরা আপনার আরও হাতের কাজ দেখতে চাই।
না, আমি আর কিছুই করতে পারবো না।
সত্যি ডায়ানা তখন কেমন যেন হয়ে গেছে।
.
পরের দিন, আবার ডোরবেলের শব্দ। ডায়ানা অনিচ্ছুক চিত্তে উঠে গেলেন। কাঁচ দিয়ে দেখলেন, কয়েকজন কিশোর। অবাক হলেন। দরজা খুলে দিলেন। অন্তত দুজন।
একজনের হাতে ফুলের তোড়া।
–গুডমর্নিং মিসেস স্টিভেন্স। সে ফুলের তোেড়াটা ডায়ানার হাতে তুলে দিল।
ধন্যবাদ, ডায়ানার মনে পড়ল এরা হল লিটল লীগের সদস্যরা। এই দলটিকে রিচার্ড প্রশিক্ষণ দিতো।
অনেক অনেক ফুল, কার্ড, ই-মেল, এসেছে ডায়ানার কাছে, কিন্তু এই বাচ্চা ছেলেরা–ডায়ানা একেবারে অভিভূত হয়ে গেলেন।
ছেলেরা ঘরে ঢুকে বলল- আমাদের মন খুবই খারাপ হয়েছে।
আপনার স্বামী কত ভালোবাসতেন আমাদের।
ডায়ানা ভাবতেই পারছেন না, কীভাবে অশ্রু সংবরণ করবেন। শেষ পর্যন্ত ডায়ানা বললেন- হ্যাঁ, তোমাদের জন্য ওঁর গর্বের শেষ ছিল না। তোমরা কিছু খাবে কী?
দশ বছরের একটি ছেলে বললনা, ধন্যবাদ মিসেস স্টিভেন্স, আমরা আপনাকে বলতে এসেছি, স্যার না থাকাতে কতখানি কষ্ট হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে পয়সা জমিয়ে ফুল কিনেছি।
-হ্যাঁ, আমরা ভীষণ দুঃখিত।
ডায়ানা ওই বাচ্চা ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন- ধন্যবাদ। রিচার্ড নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে, জানি না সে এখন কোথায় কী অবস্থায় আছে।
ডায়ানা বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
মনে পড়ল, কত সুখের স্মৃতি, রিচার্ড কোচ করাচ্ছে, সে দৃশ্য কী ভোলা যায়!
বাইরে বৃষ্টির শব্দ, এবং বিদ্যুৎপাত। প্রথম বর্ষণ বর্ষার, মনে হল ঈশ্বরের কান্না বুঝি ঝরে পড়ছে পৃথিবীর ওপর!
.
রিচার্ড বলেছিলেন- তুমি পিকনিকে যাবে?
-হ্যাঁ, যাব।
–একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করব, কাল দুপুরে তোমাকে তুলে নিয়ে যাব।
সূর্যদীপ্ত চমৎকার দিন। সেন্ট্রাল পার্কে একটা সুন্দর বনভোজনের আসর, ডায়ানা সেখানে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন। কত কী রান্না হচ্ছে! শূয়োরের মাংস, গরুর মাংস আরও কত কী।
কী হল? ভালো লাগছে?
রিচার্ড বার বার ডায়ানার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। খাওয়া শুরু হল, খেতে খেতে গল্প। ছোটো খাটো খেলাধুলা। দিনটা আনন্দের মধ্যে কেটে গেল।
.
ডায়ানার অ্যাপার্টমেন্ট, দুটি আগ্রাসী শরীর। একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে। ম্যাজিকের খেলাটা এবার বোধহয় শুরু হবে। ডায়ানা চোখ বন্ধ করলেন, মনে হল সমুদ্র সৈকতে ঝড় উঠেছে। উত্তাল তরঙ্গ ছুটে আসছে।
সমস্ত সন্ধ্যেটা তাঁরা এইভাবে কাটিয়েছিলেন। সারারাত কথা বলেছিলেন, পাগলের মতো ভালোবেসেছিলেন, একে অন্যের কাছে হৃদয়ের সবকটা বাতায়ন খুলে দিয়েছিলেন। এমন কিছু অনুভূতি যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
সকাল হয়েছে, ডায়ানা ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ব্যস্ত। রিচার্ড জানাতে চাইলেন- তুমি কি আমায় বিয়ে করবে ডায়ানা?
ডায়ানা বলেছিলেন- হ্যাঁ, আমি রাজি।
.
একমাস বাদে বিয়ের অনুষ্ঠান। একটা উষ্ণ আনন্দঘন মুহূর্ত। বন্ধু বান্ধবদের এবং পরিবারের সকলকে বলা হয়েছিল। ডায়ানা তাকিয়েছিলেন রিচার্ডের উজ্জ্বল মুখের দিকে।
হনিমুন করতে ফ্রান্সে যাওয়া হবে, বিয়ের একসপ্তাহ বাদে। কিন্তু রিচার্ডের কাজের চাপ। রিচার্ড বললেন- একটা নতুন প্রকল্প শুরু হতে চলেছে। এখন আমি যেতে পারব না। কয়েক মাস পর যাব। তোমার জন্য খারাপ লাগছে।
–ডার্লিং এতে দুঃখ করার কী আছে? কাজের দিকে তো নজর দিতেই হবে।
–তুমি কি আজ আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে?
–হ্যাঁ অবশ্যই খাব।
–ফ্রেঞ্চ ফুড খাবে তো? একটা ভালো ফরাসী রেস্টুরেন্টের সন্ধান আমি জানি। আধঘন্টা বাদে তোমার কাছে আসছি।
তিন মিনিট কেটে গেছে, রিচার্ড বাইরে, উনি বললেন- আমরা একটু এয়ারপোর্টে যাব, আমাদের একজন ক্লায়েন্ট এখানে আছেন। তিনি ইউরোপ যাত্রা করছেন। তাকে বিদায় জানিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ব কেমন?
তারা কেনেডি এয়ারপোর্টে এলেন। রিচার্ড বললেন ওঁর একটা প্রাইভেট প্লেন আছে, এসো আমরা টারম্যাকে যাই।
ওরা সংরক্ষিত অঞ্চলে ঢুকে পড়লেন। একটা চ্যালেঞ্জার দাঁড় করানো আছে।
রিচার্ড বললেন- হ্যাঁ, উনি তো এখানে নেই, আমরা প্লেনে চেপে বসে থাকব।
-ঠিক আছে।
ওনারা প্লেনের ভেতর ঢুকে পড়লেন। ইঞ্জিনটা চালু ছিল।
ফ্লাইট এ্যাটেন্ডেন্স বললেন-শুভ সকাল।
রিচার্ড বললেন গুড মর্নিং।
ফ্লাইট এ্যাটেন্ডেন্স কেবিন ডোরটা বন্ধ করে দিলেন।
ডায়ানা রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার ফ্লাইট আসছে কি?
-হ্যাঁ, এক্ষুনি এসে যাবে।
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল।
ডায়ানা জানলা দিয়ে তাকালেন, তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভয়ে এবং উত্তেজনায় রিচার্ড, প্লেনটা চলতে শুরু করেছে।
রিচার্ড অবাক তুমি ঠিক দেখেছ?
-হ্যাঁ, এক্ষুনি পাইলটকে বলো।
–কি বলব?
–থামাতে।
কী করে থামাবেন উনি? ইঞ্জিন তো চালু হয়ে গেছে।
একমুহূর্তের নীরবতা, ডায়ানা রিচার্ডের দিকে তাকালেন চোখ দুটি বড়ো বড়ো, আমরা কোথায় যাচ্ছি।
-ওঃ আমি কি তোমায় বলিনি? আমরা প্যারিসের দিকে উড়ে চলেছি, তুমি বলেছিলে ফ্রেঞ্চ ফুড খেতে ভালোবাসো?
ডায়ানার চোখে মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি রিচার্ড, আমি এভাবে কী করে যাব? জামাকাপড় নেই, মেকআপ নেই। না-না আমি যেতে পারব না।
রিচার্ড বলেছিলেন- প্যারিসে তুমি সব পাবে।
ডায়ানা অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন– ওঃ, এজন্য তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি।
-তুমি একটা হনিমুন চেয়েছিলে। দেখো এই প্ল্যানটা তোমার কেমন লাগে।
.
০৫.
একটা লিমুজিন দাঁড়িয়ে ছিল ওনাদের হোটেল প্লাজাতে নিয়ে যাবার জন্য।
ম্যানেজার বললেন আপনাদের স্যুইট তৈরি আছে মিস্টার এবং মিসেস স্টিভেন্স।
সুইট নাম্বার ৩১০। ম্যানেজার দরজা খুলে দিলেন। ডায়ানা এবং রিচার্ড ভেতরে ঢুকলেন। আহা, ভাবা যাচ্ছে না, দেওয়ালে তাঁর আকা ছটা ছবি ঝুলছে। তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন
–আমি বুঝতে পারছি না, কী করে এটা সম্ভব হল!
রিচার্ড সঙ্গে সঙ্গে অসহায়ের মতো বললেন আমিও জানি না, মনে হয় এখানকার মানুষ বোধহয় তোমার আঁকা ছবি ভালোবাসে।
ডায়ানা একটা আবেগি উন্মাদনা ভরা চুম্বন উপহার দিলেন।
.
প্যারিস এক অসাধারণ শহর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কদিন ধরে তারা নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়ালেন। ছোটো ছোটো রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাওয়া সারলেন। মিউজিয়ামে গিয়ে প্রাচীন দিনের স্মৃতিচিহ্ন দেখলেন। কখনও বা চলে গেলেন স্থাপত্য উদ্যানে। আহা, প্যারিসকে সত্যি একটুকরো স্বর্গ বলে মনে হয়।
.
একটা ব্যাপার ডায়ানার ভালো লাগল না। মাঝে মধ্যে বিশেষ একটা সময়ে টেলিফোন বেজে উঠত ঢং ঢং শব্দে, রিচার্ড তখন কেমন যেন হয়ে যেতেন।
রাত্রি তিনটে, টেলিফোনের শব্দ।
ডায়ানা জানতে চাইলেন- কী ব্যাপার? এত রাতে?
রিচার্ডের মুখে কষ্টকল্পিত হাসি কিছুই না, কাজের ব্যাপারে শলা-পরামর্শ!
তা বলে? মধ্যরাতে?
.
–ডায়ানা, ডায়ানা– ক্যারোলিন টার দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি ঠিক আছে তো?
–আমি ভালো আছি।
ক্যারোলিন মাথায় হাত দিলেন আরও সময় লাগবে, শোকটা ভুলতে। তুমি কি শোক যাত্রার ব্যবস্থা করেছ?
সবথেকে খারাপ শব্দ, যে কোনো ভাষায়, এর মধ্যে মৃত্যুর গন্ধ আছে। হতাশার প্রতিধ্বনি।
না, ওই ব্যাপারটা আমি এখনও ভেবে দেখিনি।
–আমি কি সাহায্য করব? একটা কাসকেট তৈরি করব?
–না, একটা শব্দ ভেসে এল। ডায়ানা অচেতন হয়ে গেলেন।
ডায়ানার দিকে তাকিয়ে ক্যারোলিন বলতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপর ডায়ানার জ্ঞান ফিরল, কণ্ঠস্বর কাঁপছে– না, রিচার্ডের জন্য আমি এটা করতেই পারব না। রিচার্ডের সব বন্ধুদের ডেকে পাঠাতে হবে। এটাই হবে রিচার্ডের প্রতি আমার শেষ ভালোবাসা।
জল গড়িয়ে পড়ছে গালের ওপর।
-ডায়ানা?
–না, আমি এমন একটা কাসকেট তৈরি করব, যেখানে রিচার্ড শান্তভাবে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে!
এই কথার জবাব কী দেওয়া যায়?
.
সেই সন্ধ্যেবেলা, ডিটেকটিভ আর্ল গ্রিনবার্গ তার অফিসে ব্যস্ত ছিলেন।
ডায়ানা স্টিভেন্সের ফোন এসেছে।
গ্রিনবার্গের মনে পড়ল, ওই মুখখানা।
আহা, নতুন কোনো খবর কী?
টেলিফোন তুলে তিনি বললেন- ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ বলছি।
দুটো কারণে আমি ফোন করেছি। প্রথম কারণ হল, আমার ব্যবহারের জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত।
না-না, এতে দুঃখিত হওয়ার কী আছে? আমি তো জানি, আপনার মানসিক অবস্থা এখন কতখানি বিপর্যস্ত।
নীরবতা।
–আপনি বলেছেন, আর একটা কারণ আছে?
-হ্যাঁ, আমার স্বামী, কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে, পুলিশ কোথাও রেখেছে। আমি কীভাবে মৃতদেহটা ফেরত পাব? আমি শেষযাত্রার ব্যবস্থা করতে চলেছি।
কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে মিসেস স্টিভেন্স, মনে হচ্ছে এখানে বোধহয় লাল ফিতের খেলা চলেছে। করোনার অফিস থেকে একটা রিপোর্ট পাঠাতে হবে। শব ব্যবচ্ছেদ হবে।
-না-না, এসব কথা বলার কী দরকার। দেখুন, আমি চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃতদেহটা ছেড়ে দিতে। দু-দিনের মধ্যেই সব হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ, আপনাকে!
আর্ল গ্রিনবার্গ অনেকক্ষণ বসে রইলেন। ডায়ানা স্টিভেন্সের কথা মনে পড়ল। তারপর চেষ্টা করলেন লাল ফিতের বাঁধন কাটতে।
.
ডালটন শব-গৃহ। ম্যারিসন এভিনিউর পূর্বদিকে অবস্থিত। দোতলা বাড়ি, সাদার্ন ম্যানসনের পাশে।
ডায়ানা রিসেপশনিস্টকে বললেন মি. জোনসের সাথে কথা বলব?
রিসেপশনিস্ট ফোনে কথা বললেন। ম্যানেজার বেরিয়ে এলেন, মাথার চুল ধূসর। তিনি ডায়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি রন জোনস। আমাদের ফোনে কথা হয়েছে। আমি জানি, এখন আপনার মনের অবস্থা কত খারাপ। তাই আর বেশি কথা বলব না।
ডায়ানা বললেন– কী বিষয়ে আলোচনা হবে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–আমি ভালো করে বুঝিয়ে বলছি। আমরা একটা সুন্দর কাসকেট দেব, যাতে আপনার বন্ধুরা সকলে আসতে পারেন এবং এখানে এসে ওই শোকসভায় যোগ দিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করব। আমরা সমাধিক্ষেত্রে এক টুকরো জমি দেব, কাগজে আপনার স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনেছি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি একটা বন্ধ করা কাসকেট চাইছেন?
না।
–সে কী?
–আমি চাই, এটা খোলা থাকুক। বন্ধুরা যেন রিচার্ডকে দেখতে পায়।
ডায়ানার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে।
জোনস তার দিকে সহানুভূতি সম্পন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- ঠিক আছে, আমি দেখছি। এ ব্যাপারে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আর একটা ব্যাপার, কী ধরনের কাপড় পরাবেন?
ডায়ানা তাকিয়ে আছেন। শেষ পর্যন্ত বললেন- ঠিক বুঝতে পারছি না।
কণ্ঠস্বর আবার ভেঙে গেছে।
ডায়ানা যেতে পারছেন না। শেষ অব্দি ওই ভদ্রলোক একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলেন।
.
ডায়ানা তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছেন। রিচার্ডের ক্লোসেটটা খুললেন। দুটো তাক স্যুটে পরিপূর্ণ। আহা, প্রত্যেকটা স্যুটের সাথে একটা সুন্দর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই স্যুট রিচার্ড পরেছিলেন আর্ট গ্যালারিতে। বলেছিলেন আপনার শরীরটা সত্যিই আকর্ষণীয়।
তারপর? পরবর্তী? এই হালকা ধূসর রঙের জ্যাকেট, পিকনিকে যাবার সময় রিচার্ড পরত। বৃষ্টিতে ভেজার মুহূর্তে।
বলা হয়েছিল- এসো, আমরা দুজনে ভিজি।
এই নীল রঙের ব্লেজার, তার সঙ্গে মানানসই জ্যাকেট। ডায়ানার মনে হল, প্রত্যেকটি পোশাকে বুঝি রিচার্ডের গায়ের স্পর্শ মাখা।
পরের দিন বিকেলবেলা, ডায়ানার ভয়েস মেলে একটা খবর এসেছে-মিসেস স্টিভেন্স, আমি ডিটেকটিভ গ্রিনবার্গ বলছি। সবকিছু হয়ে গেছে। আমি ডালটন শবগৃহের সাথে কথা বলেছি। আপনি এগিয়ে যান, অসুবিধা হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। গুডবাই।
ডায়ানা রন জোনসের সঙ্গে কথা বললেন। ব্যাপারটা তা হলে ভালোভাবেই শেষ হতে চলেছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল শুক্রবার দিন রিচার্ডকে সমাহিত করা হবে। সকাল এগারোটার সময়।
এই তিনদিন? এই তিনদিন আমি কী করব? ডায়ানা ভাবলেন, আমি কি রিচার্ডের আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করব?
.
সকাল বেলা, বৃহস্পতিবার, ডায়ানা শোকযাত্রার শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন।
টেলিফোনের শব্দ ভেসে এল- মিসেস স্টিভেন্স, আমি রন জোনস বলছি। আমি আপনার কাগজ পেয়েছি। সবকিছু আপনার মনের মতো এগোচ্ছ। আপনার চিঠিটাও আমার হাতে এসেছে।
ডায়ানা অবাক কী কথা বলছেন?
-কেন? কুরিয়ার গতকাল সেটা পৌঁছে দিয়েছে।
–আমি তো কোনো কিছু পাঠায়নি।
–আমিও অবাক হয়ে গেছি। তবে আপনার সিদ্ধান্ত?
–আমার সিদ্ধান্ত!
–হ্যাঁ, আমরা এক ঘণ্টা আগে আপনার স্বামীকে সমাহিত করেছি।
.
০৬.
প্যারিস, ফ্রান্স
কেলি হ্যারিস মডেল জগতের এক বিস্ময়-রমণী। বছর উনত্রিশ বয়স, গায়ের রং গলানো মধুর মতো। মুখ দেখলে যে কোনো আলোকচিত্রী লালায়িত হতে পারে। শান্ত বাদামী চোখের তারায় বুদ্ধির দীপ্তি। ঠোঁট দুটি আমন্ত্রিত ইশারায় মগ্ন। আবেদনী লম্বা দুটি পা আছে, এমন একটা শরীর যাতে আছে যৌন উন্মাদনা। ঘন চুল, ঠিকমতো কাটা, মাথায় অপূর্ব কারুকাজ। সত্যি, কেলিকে তাই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মডেলের শিরোপা দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত এলি এবং মাদমোজায়েল পত্রিকার তরফ থেকে।
সাজগোজ শেষ হয়ে গেছে। কেলি পেন্টহাউসের দিকে তাকালেন। একটা অদ্ভুত কৌতূহল জেগে উঠেছে তার মনের মধ্যে। এটা একটা সুন্দর সাজানো অ্যাপার্টমেন্ট, রুয়ে স্ট্রিটে, প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার দুটো দরজা আছে। বিরাট একটা হল আছে, উঁচু সিলিং, হলুদ ওয়াল প্যানেল। তারপর লিভিং রুম। ফরাসি এবং আমেরিকান মিশ্রণের ফার্নিচার আছে। টেরেস থেকে সাইন নদী দেখা যায়, নোতরদামও চোখে পড়ে।
কেলি তাকিয়ে আছেন ক্যালেন্ডারের দিকে, সপ্তাহটা শেষ হয়ে আসছে। মার্ক তাকে একটা উপহার দেবে।
কেলি ভাবলেন, কীভাবে স্বামীকে আরও খুশি করা যায়। তার চোখে মার্ক সর্বসেরা একটা মানুষ।
কিছুক্ষণ বাদে কেলি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এলেন। হলওয়ে দিয়ে হেঁটে চললেন। এলিভেটরের কাছে এগিয়ে গেলেন। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল। মাদাম জোসেটি বেরিয়ে এসেছেন করিডরে। কেলির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক।
মাদাম হ্যারিস, শুভ সন্ধ্যা।
কেলি হাসলেন– শুভ সন্ধ্যা মাদাম জোসেটি।
-তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
ধন্যবাদ।
কেলি এলিভেটরের বোম টিপলেন।
কয়েক ফুট দুরে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একটা ছবি ঠিক করছিলেন। দুই ভদ্রমহিলার দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নামিয়ে নিলেন।
মাদাম জানতে চাইলেন মডেলিং এর কাজ কেমন চলছে?
-খুবই ভালো।
একদিন তোমার ফ্যাশান শো দেখতে যাব।
কবে আসবেন জানাবেন।
এলিভেটর পৌঁছে গেছে। কেলি এবং মাদাম সেখানে পা দিলেন। যে মানুষটি কাজ করছিলেন তার হাতে একটা ছোট্ট ওয়াকিটকি। তিনি কী যেন বললেন, দ্রুত চলে গেলেন।
এলিভেটরের দরজা বন্ধ হতে যাবে, কেলি তার অ্যাপার্টমেন্টে ফোনের শব্দ শুনলেন। কী করবেন ঠিক করতে পারলেন না। হয়তো মার্ক ডাকছে।
মাদামকে বললেন– আপনি যান। আমি আসছি।
কেলি এলিভেটর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। অতি দ্রুত অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলেন।
রিসিভার তুলে বললেন মার্ক?
একটা অচেনা কণ্ঠস্বর- না, আমি মার্ক নই।
কেলি অবাক হয়েছেন রং নাম্বার।
কেলি ফোনটা নামিয়ে রাখবেন। তখনই একটা ঘটনা ঘটে গেল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। গোটা বাড়িটা কেঁপে উঠল। কেলি ভীষণ ভয় পেয়েছেন। তিনি ছুটে গেলেন, শব্দটা কোথা থেকে আসছে সেই দিক লক্ষ্য করে। সিঁড়ি দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত নামলেন। যখন লবিতে এলেন, বুঝতে পারলেন, শব্দটা এসেছে বেসমেন্ট থেকে।
বেসমেন্টে চলে গেলেন। দেখলেন এলিভেটরটা ভেঙে গেছে। মাদামের শরীরটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কেলি সভয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন- আঃ, একটু আগেই উনি জীবন্ত ছিলেন।
অনেক মানুষের ভিড়, সাইরেন বেজে চলেছে। আমি তো এখানেই থাকতাম, কেলি ভাবলেন, কেন কে আমাকে বাঁচিয়ে দিল।
তিনি ওই মৃত দেহটার দিকে তাকিয়ে বললেন- দুঃখিত, মাদাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।
.
কেলি ফ্যাশান সেলুনে এসে গেছেন। স্টেজ ফ্লোরের দিকে এগিয়ে চলেছেন। পিয়েরে, ফ্যাশান কোঅরডিনেটর অপেক্ষা করছিলেন।
-কেলি, কেলি। আপনি এত দেরি করলেন কেন? শো-টা শুরু হয়ে গেছে।
–পিয়েরে, আমি দুঃখিত, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
–আপনার কিছু হয় নি তো?
না, এখন কী কাজ কাজ যায়? তবু কেলিকে কাজ করতেই হবে।
কেলি ড্রেসিংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
.
এই বছরের সবথেকে জমজমাট ফ্যাশান শো, ৩১ নম্বর রুয়েতে অনুষ্ঠিত হবে। এটা হল চ্যানেলের নিজস্ব সেলুন। পাপারাৎজিরা চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। তারা হলেন হলুদ সাংবাদিকদের দল। খবরের সন্ধানে ঘোরাফেরা করেন। আহা, অসাধারণ প্রেক্ষাপট। সুন্দর গান শোনা যাচ্ছে। গানের তালে তালে যৌন উন্মাদনা।
সুন্দরী মডেলরা এসে দাঁড়ালেন। সামনের দিকটা উন্মুক্ত করছেন। পেছন দিকে চলে যাচ্ছেন। ফ্যাশানের ওপর ধারা বিবরণী দেওয়া হচ্ছে।
এশিয়ার এক বাদামী চুলের কন্যা এলেন। বলা হল, উনি গায়ে যে জ্যাকেটটা পরেছেন, তার আড়ালে আছে ওনার সম্পদ।
রানওয়েতে আর এক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন। পাতলা রোগা চেহারা। মাথায় সোনালি চুলের বন্যা। তারপর লাল চুলের একটি মেয়ে, ফরাসি মডেল। সুইডেনের কন্যা।
যার জন্যে সকলের অপেক্ষা তিনি কবে আসবেন? লাউডস্পিকারে বলা হল, এবার শুরু হচ্ছে সাঁতারের পোশাকের প্রতিযোগিতা, আমরা আমাদের নতুন সমুদ্র পোশাক সকলের সামনে তুলে ধরব।
কেলি এসে দাঁড়ালেন। তিনি একটা সাদা বিকিনি পরেছেন। একটা ব্রা কোনোরকমে তার স্তন শীর্ষকে ঢেকে রেখেছে। আহা, কচি নরম দুটি বৃন্ত, যে কোনো মুহূর্তে ব্রা-টা খুলে পড়তে পারে।
কেলি এসে হাত তুলে যৌন আবেদনি ভঙ্গিমা করলেন। সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল।
হাততালির ঝড় বয়ে গেল। কেলি হাসলেন, সকলকে অভিবাদন করলেন, তারপর হারিয়ে গেলেন অন্ধকারে।
ব্যাক স্টেজে দুজন তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
-মিসেস হ্যারিস, একটু কথা বলতে চাই।
–আমি দুঃখিত, কেলি বললেন, আমাকে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টাতে হবে।
দাঁড়ান, মিসেস হ্যারিস। আমরা পুলিশ বিভাগ থেকে আসছি। আমি চিফ ইন্সপেক্টর ডুনে আর ইনি ইন্সপেক্টর স্টিনউ।
কেলি অবাক পুলিশ কেন?
আপনি কি শ্রীমতী মার্ক হ্যারিস?
–হ্যাঁ।
–আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি, গতকাল রাতে আপনার স্বামী মারা গেছেন।
কেলির মুখ শুকিয়ে গেছে আমার স্বামী? কী বলছেন?
-হ্যাঁ, মনে হচ্ছে উনি আত্মহত্যা করেছেন।
কেলির কানে নানা শব্দের ভিড়। তিনি চিফ ইন্সপেক্টরের গলা শুনতেই পাচ্ছেন না বলছেন–ইফেল টাওয়ার… মধ্যরাত ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। আমি সহানুভূতি জানাচ্ছি।
কতগুলো শব্দ, মাদাম, আমি দুঃখিত, চিফ ইন্সপেক্টর আবার বলছেন।
কেলির কাছে এগিয়ে তিনি বললেন আপনি ঠিক আছেন মাদাম?
-হা, কেলি বললেন। বুঝতে পারলেন, তাঁর জীবনসূর্য চিরকালের জন্য অস্তমিত হয়ে গেল।
পিয়েরে এসে গেছেন। তারা হাতে একটা সুন্দর কারুকাজ করা বিকিনি। তিনি বললেন কেলি, একদম সময় নেই, তাড়াতাড়ি করতে হবে। আসুন।
কেলি বিকিনির দিকে তাকিয়ে বললেন- পিয়েরে?
কী হয়েছে?
–ওটা আপনিই পরে ফেলুন।
একটা লিমুজিন কেলিকে তার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেল। সেলুন ম্যানেজার চেয়েছিলেন কেলির সঙ্গে কেউ যাক। কেলি চাননি। তিনি একা যেতে চেয়েছিলেন। কেলি দেখতে পেলেন, সেখানে বেশ ভিড় হয়েছে।
একজন বলল- মাদাম, কী ভয়ঙ্কর অ্যাকসিডেন্ট।
কেউ একজন বলল– না, এটা অ্যাক্সিডেন্ট নয় মাদাম। এলিভেটরের সেফটি ব্র্যাকেটটা কেউ ইচ্ছে করে কেটে দিয়েছিল।
.
০৭.
সকাল চারটে। কেলিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটির পর একটি দৃশ্য চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আমরা কথা বলতে বলছি। ইফেল টাওয়ার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী মার্ক মারা গেছেন- মার্ক মারা গেছেন!
মার্কের শরীরটা কেঁপে নীচে পড়ে গিয়েছিল, নীচে আরও নীচে, কেলি সামনে এগিয়ে এলেন। না কেন একাজ তুমি করলে? আমার জন্য? আমি কী করিনি? আমার ওপর অভিমান? মার্ক, কার কাছে আমি জবাবদিহি চাইব?
.
কেলির জন্ম হয়েছিল ফিলাডেলফিয়াতে। এথেলের অবৈধ কন্যা সন্তান হিসেবে। এথেল এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকা। কাজ করেছিল ওই শহরের এক বিশিষ্ট শ্বেতাঙ্গ পরিবারে। এই পরিবারের কর্তা ছিলেন এক বিখ্যাত বিচারক। এথেলের বয়স সতেরো, অসামান্য সুন্দরী। কুড়ি বছরের সোনালি চুলের যুবক পিট তার প্রেমে পড়ে যায়, টারনার পরিবারের উত্তরাধিকারী। শেষ পর্যন্ত শারীরিক সংযোগ। তারপর? একমাস বাদে এথেল জানতে পারল, সে গর্ভবতী।
এ সম্ভাবনার কথা পিটকে জানাল। পিট বলেছিল, ব্যাপারটা দারুণ। সে তার বাবার কাছে চলে যায়। খারাপ খবরটা দিতে।
বিচারক টারনার এথেলকে তার গোপন গৃহে ডেকে পাঠালেন। পরের দিন সকালবেলা। বললেন– আমি চাই না এক বেশ্যা এই বাড়িতে কাজ করুক। তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল।
সে প্রথমে একটা শিল্পসংস্থায় যোগ দিল, ঝাড়ুদারনি হিসেবে। সারাদিন তাকে কাজ করতে হত। নবজাতিকা কন্যাটির জন্য। পাঁচ বছর কেটে গেল। এথেল কিছু টাকা জমিয়েছে। সে একটা বোর্ডিং হাউস চালানো শুরু করল। পুরুষদের জন্য। তারপর? কেলির জীবন সেখানেই কাটতে থাকে।
অনেক পুরুষ সেখানে আসে এবং চলে যায়।
এথেল একবার কেলিকে বলেছিল–এরা সব তোমার কাকার মতো। এদের সঙ্গে কখনও জড়িয়ে পড়ো না।
কেলি এই পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল। বুঝতে পারল, কিছু দিন বাদে, এরা সব অজানা আগন্তুক।
তখন কেলির বয়স আট বছর। এক রাতে সে তার অন্ধকার বেডরুমে শুয়েছিল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন বলছে না, শব্দ করো না। যা করার চুপচাপ করো।
কেলি বুঝতে পারল, তার নাইট গাউন তুলে দেওয়া হয়েছে, বাধা দেবার আগেই তার তথাকথিত কাকাদের একজন তার মুখ চেপে ধরেছে। কেলি আরও বুঝতে পারল, কোনো কিছু একটা তার দুপায়ের ফাঁকে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে নিজেকে সরিয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। মনে হল, তার শরীরটা বুঝি একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যন্ত্রণা–অসম্ভব যন্ত্রণা। লোকটা ভয়ঙ্কর নির্মম। পাশবিক অত্যাচার করেই চলেছে। জোরে আরও জোরে, না, কান্নার কোনো শব্দ নেই। শেষ অব্দি কেলি বুঝতে পারল, উষ্ণ রক্তস্রোত বেরিয়ে আসছে। নীরবে সে আর্তনাদ করতে থাকল। অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর? আর কিছুই তার মনে নেই।
শেষ পর্যন্ত কেলির মনে হয়েছিল, সে বোধহয় অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে চলেছে।
লোকটা বলল- আমি চলে যাচ্ছি, মাকে কিছু বললে আমি তোমার ছাল ছাড়িয়ে নেব। মাকেও বাঁচিয়ে রাখব না।
পরের সপ্তাহটা অসহনীয়। কেলির মনে হত, তার চারপাশে শুধুই অন্ধকার। না, ভীষণ যন্ত্রণা। একা একা ভোগ করতে হচ্ছে। সে মাকে সব কথা বলতে চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত পারেনি।
ঘটনাটা মাত্র কয়েক মুহূর্তের, এই ঘটনা কেলির জীবনধারাকে একেবারে পাল্টে দিল। ছোট্ট একটা মেয়ে থেকে সে পরিণত হল অভিশপ্ত রমণীতে। সংসারের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। স্বামীর কথা সে আর ভাবল না। সে বুঝতে পারল, এই জীবনে আর কখনও কোনো পুরুষকে সে তার দেহ স্পর্শ করতে দেবে না।
সেই রাত থেকেই কেলি অন্ধকারকে ভয় পেতে শিখল।
.
০৮.
কেলির বয়স তখন দশ, এথেল তাকে বিভিন্ন জায়গাতে কাজ করতে পাঠাল। সে হয়ে গেল কাজের মেয়ে। সকাল পাঁচটায় তাকে উঠতে হত। টয়লেট পরিষ্কার করতে হত। রান্নাঘরের মেঝে ধুতো। বোর্ডারদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করত। স্কুল থেকে ফিরে এসে তাকে কাঁচাকুচির কাজ করতে হত। আবার ঘর পরিষ্কার করা। মাকে সাহায্য করা। এইভাবেই তার জীবনটা গতানুগতিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটে চলল।
মাকে সাহায্য করার জন্য সে ছিল আগ্রহী। মাঝে মধ্যেই ভাবত, মায়ের মুখ থেকে যদি প্রশংসার একটা শব্দ ছিটকে আসে। কখনও আসেনি। মা বোর্ডারদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত। মেয়ের দিকে নজর দেবার সময় কোথায়?
কেলি তখন নেহাতই এক কিশোরী, এক সহৃদয় বোর্ডার তাকে অ্যালিসের গল্পকথা শুনিয়ে ছিলেন। কেলি এই গল্প শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। আহা, অ্যালিস কীভাবে একটা ম্যাজিক করে পালিয়ে গিয়েছিল। এই ম্যাজিকটা আমাকে শিখতে হবে কেলি ভেবেছিল। আমাকেও এখান থেকে পালাতে হবে। সারা জীবন আমি টয়লেট পরিষ্কার করব না।
একদিন কেলি তার ম্যাজিক খরগোশের গর্তের সন্ধান পেল। এটা তার স্বপ্ন, নাকি কল্পনা? সে কোথায় যাবে? জীবনটাকে আবার নতুন করে লিখতে হবে।
তার একজন বাবা ছিল, মা এবং বাবা, একই রঙের, কেউ কখনও রাগ করে না। তারা একটা সুন্দর বাড়িতে বাস করে। মা আর বাবা একসঙ্গে তাকে ভালোবাসে। না, এই স্বপ্নটা বোধহয় স্বপ্নই থেকে যাবে।
.
কেলির বয়স চোদ্দো বছর। মা একজন বোর্ডারকে বিয়ে করলেন। একজন বারটেনডার। নাম ড্যান বারকে। মধ্যবয়সী, সব ব্যাপারেই উন্নাসিক। কেলি তাকে খুশি করার চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু ভদ্রলোকের অদ্ভুত স্বভাব। খুঁত ধরে বেড়াতেন।
কেলির বিপিতা মাঝে মধ্যেই মদ খেতেন। মাঝে একটা ছোট্ট দেওয়াল, একদিকে মা-বাবার আনন্দ আসর, অন্যদিকে কেলির একক শয্যা। রাতের পর রাত কেলি চিৎকার শুনতে পেত। আহা, আর্তনাদ এবং শিকার। সকালে এথেল মুখে মেকাপ করতেন। মনে হত, এইভাবেই তিনি বোধহয় রক্তাক্ত আঘাতগুলিকে ঢাকতে চাইছেন। চোখের কোণটা ফুলে গেছে। রাত জাগা কালিমা!
কেলির জীবন তখন আরও অন্ধকারে ঢেকে গেছে। কীভাবে আমি এখান থেকে পালাব। আমার মাকে নিয়ে? কেলির তখন এটাই একমাত্র চিন্তা।
মধ্যরাত। হঠাৎ কেলির ঘুম ভেঙে গেছে। পাশের ঘর থেকে সে সৎপিতার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। উনি বলছেন মেয়েটাকে আগেই খালাস করলে না কেন?
–আমি চেষ্টা করেছি ড্যান, কিন্তু আমার পরিকল্পনাটা ঠিক মতো কাজে লাগেনি।
কেলির মনে হল, এই শব্দগুলো না শুনলেই বোধহয় ভালো হত। সে জানত, মা তাকে কখনওই জন্ম দিতে চায়নি। সে এক অবাঞ্ছিত শিশু।
.
কেলি পালাবার পথ খুঁজছে। এই অন্ধকার থেকে তাকে পালাতেই হবে। শেষ পর্যন্ত সে বইয়ের জগতে আশ্রয় নিল। বই- শুধু বই, পাবলিক লাইব্রেরিতে ভর্তি হল। বইয়ের সমুদ্রে স্নান করল।
সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে। কেলির হাতে কোনো পয়সা নেই, তাকে পয়সা আয় করতে হবে। সে বেবিসটেলে চাকরি পেল। আহা, এমন সুন্দর পরিবার। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য, দেখলে চোখ জলে ভারী হয়ে ওঠে।
.
সতেরো বছর। কেলি এক সুন্দরী রমণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। স্কুলের ছেলেরা তখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অনেকে তার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করছে, দূরে কোথায় গিয়ে নিভৃত আলাপন।
শনিবার, স্কুল নেই। কেলি পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে যেত। সারা সন্ধ্যে বসে বসে বই পড়ত।
লাইব্রেরিয়ান লিসা হাউসটোন, এক বুদ্ধিমতী মহিলা। তাঁর মনের ভেতর ছিল সহানুভূতি। তিনি কেলির সাথে ভালোভাবে কথা বলতেন।
একদিন তিনি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন- তোমার মতো অল্পবয়সী পাঠিকারা আসছে, এটা ভালো লাগছে। তুমি এখানে আরও বেশি সময় কাটাতে পারো।
এইভাবেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। সপ্তাহ গড়িয়ে গেল মাসে। কেলি তার জীবনের সব সুখ-দুঃখের কথা ওই লাইব্রেরিয়ানের কাছে উজাড় করে দিল।
-কেলি, তুমি কী হতে চাও?
–একজন শিক্ষিকা।
-বাঃ, আমার মনে হয়, তুমি একজন ভালো শিক্ষিকা হতে পারবে। এটাই হল পৃথিবীর সবথেকে ভালো পেশা।
কেলি কথা বলার চেষ্টা করেছিল, তারপর চুপ করে গেল। মনে পড়ে গেল, এক সপ্তাহ আগে ব্রেকফাস্টের টেবিলে মা এবং সৎ পিতার মধ্যে কথাবার্তা।
কেলি বলেছিল– আমি কলেজ যাব, আমি শিক্ষিকা হতে চাইছি।
–শিক্ষিকা? ফুঃ। ভদ্রলোক হেসে উঠেছিলেন, এটা একটা বোকার মতো চিন্তাধারা। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? তোমাকে সারাজীবন এই কাজ করতে হবে। তোমার মা আর আমার হাতে এত পয়সা নেই যে, তোমাকে কলেজে পাঠাব।
-আমাকে একটা স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে।
–তাতে কী হয়েছে? তুমি চারবছর সময় নষ্ট করবে? ভেবে দেখো, তোমার যা চেহারা, তুমি অন্য কাজ করতে পারবে।
রাগ করে কেলি টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিল।
এখন সে মিসেস হাউসটোনকে সব কথা বলল। সব কথা শুনে হাউসটোন অবাক হয়ে গেলেন।
কিন্তু কী করা যায়?
তিনি বললেন, প্রথমত তুমি তোমার স্বপ্নকে সফল করার চেষ্টা করো। তুমি একটা উত্তেজক জীবন কাটাতে পারবে। তারপর, আমার কাছে আসবে। আমি তোমার জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দেব।
লাইব্রেরিয়ানের কথা শুনে কেলির মনে হল, এই পৃথিবীতে সবাই মিথ্যে কথা বলে।
কেলি স্নাতক হয়ে গেছে। লাইব্রেরিতে ফিরে এসেছে।
মিসেস হাউসটোন তাকে দেখে বললেন কেলি, আমি তোমায় কী বলেছিলাম? মনে আছে?
কেলি সন্দিগ্ধ চিত্তে বলল– মনে আছে।
মিসেস হাউসটোন তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার হাতে একটা পত্রিকা তুলে দিলেন। সেখানে লেখা আছে– কসমো গার্ল, ১৭, সুন্দরী, মামদেব, এসেনস, অ্যালিওর।
কেলি তাকাল, আমি কী করব?
–তুমি কি কখনও মডেল হওয়ার কথা চিন্তা করেছ?
না।
–এইসব ম্যাগাজিনগুলোর দিকে তাকাও। এই ম্যাগজিনগুলোতে তোমার স্বপ্নপূরণের কথা লেখা আছে। এভাবেই হয়তো তোমার জীবনে একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে।
কেলি ভাবল, কিন্তু কীভাবে? সে বলল- মিসেস হাউসটোন, আপনাকে ধন্যবাদ।
পরের সপ্তাহ থেকে আমাকে চাকরি খুঁজতে যেতে হবে, মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিল কেলি।
.
কেলি ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে তার বোর্ডিং হাউসে ফিরে গেল। এককোণে সেগুলো ফেলে রাখল। সারা দিন ভুলে গেল।
রাত হয়েছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত কেলি এবার ঘুমোতে যাবে। হঠাৎ ম্যাগাজিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে গেল। উৎসাহের চোখে সে পড়তে শুরু করল। এটা আর একটা জগত। আহা, মডেলরা কী সুন্দর পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের পাশে অভিজাত পুরুষরা ঘোরাফেরা করছে। লন্ডন, প্যারিস, পৃথিবীর নানা গুরুত্বপূর্ণ মহানগর। হঠাৎ কেলির মধ্যে একটা ইচ্ছের জাগরণ ঘটে গেল। সে ভোয়ালে জড়িয়ে হল পার হয়ে বাথরুমের দিকে হেঁটে গেল।
আয়নাতে নিজের নগ্নিকা দেহের প্রতিফলন। সে ভাবল, না, আমি খুব একটা খারাপ নই। সকলে আমার রূপের প্রশংসা করে। যদি সত্যি হয়ে থাকে, কিন্তু আমার তো কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সে ফিলাডেলফিয়াতে তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে ভাবল। আয়নার দিকে আবার তাকাল। কোনো একটা জায়গা থেকে শুরু করতে হয় তুমি একজন জাদুকরী, এবার জাদুটা শুরু হোক।
.
পরের দিন সকালবেলা, কেলি লাইব্রেরিতে পৌঁছে গেছে। শ্রীমতী হাউসটোনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
মিসেস হাউসটোন তাকে দেখে অবাক হয়েছেন। তিনি বললেন- শুভ প্রভাত কেলি, তুমি কি ম্যাগাজিনগুলোর দিকে তাকাবার সময় পেয়েছ?
-হ্যাঁ, আমি মডেল হতে চাইছি, কিন্তু কীভাবে আমি শুরু করব?
মিসেস হাউসটোনের মুখে হাসি এই দেখো, নিউইয়র্ক টেলিফোন ডিরেক্টর থেকে আমি ঠিকানাগুলো তুলে রেখেছি।
উনি কেলির হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, এখানে মানহারট্রানের বিখ্যাত মডেলিং এজেন্সিগুলোর নাম আর ঠিকানা লেখা আছে। তুমি প্রথম থেকেই শুরু করো।
কেলি তখনও চিন্তিত কীভাবে প্রস্তাবটা রাখব।
-আমি চাইছি, এসব পত্রিকাতে একদিন যেন তোমার ছবি ছাপা হয়।
.
ডিনারের আসর, কেলি বলল আমি মডেল হব।
সৎপিতা চিৎকার করে বললেন- হ্যাঁ, এটাই তোমার বোকার মতো চিন্তা। তুমি কি জানো, সব মডেলরা বাজারের বেশ্যা মাগী ছাড়া আর কেউ নয়?
কেলির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- কেলি, তুই আমার মতো ভুল করিস না যেন। আমারও এমন অদ্ভুত কল্পনা ছিল, এ স্বপ্ন কখনও সফল হয় না রে। এ স্বপ্ন তোকে হত্যা করবে। তুই কালো আর গরীব, এভাবেই জীবনটা কাটবে।
সেই মুহূর্তে কেলি তার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একটা কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল।
.
পরের দিন সকাল পাঁচটা, কেলি একটা স্যুটকেস নিয়ে বাস স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তার পার্সে দুশো ডলার আছে। বেবিসিটিং করে অনেক কষ্টে জমিয়েছে।
মানহাট্টানে যেতে দুঘণ্টা সময় লাগল। সমস্ত পথ কেলি একটা স্বপ্নের সমুদ্রে সানন্দে স্নান করেছে। হ্যাঁ, আমাকে শেষ পর্যন্ত পেশাদারী মডেল হতেই হবে। এই কাজটা আমাকে করতেই হবে। কিন্তু আমি কোথাও আমার পুরোনো নামটা ব্যবহার করব না। আমি শুধু কেলি নামেই পরিচিত হব।
.
একটা সস্তার মোটেল সে ভাড়া করল। সকাল নটা, কেলি তালিকা অনুসারে প্রথম অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ কোথাও নেই। শেষ পর্যন্ত মধ্যবয়সী একজন লোককে দেখা গেল।
কেলি বলল- ভেতরে আসতে পারি? আপনারা কি কোনে মডেল চাইছেন?
ভদ্রলোক বললেন- না, আমরা মডেল ভাড়া করি না।
কেলি বলল- ধন্যবাদ।
কেলি যাবার জন্য প্রস্তুত। ভদ্রলোক তার দিকে তাকালেন, তার মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেছে। উনি বললেন, ভেতরে এসো তো, তুমি কোথা থেকে আসছ?
কেলি অবাক ফিলাডেলফিয়া।
না, আমি তা বলছি না। তুমি কি এর আগে কখনও মডেল হয়েছ?
না।
–কিছু এসে যায় না। তুমি এখানে থেকে শিখবে।
–তার মানে? কেলির ঠোঁট শুকনো। আমি মডেল হব।
–হ্যাঁ, তুমি হবে। আমার ক্লায়েন্টরা তোমাকে দেখে আনন্দে পাগল হবে।
কেলি বিশ্বাস করতে পারছে না কারণ এটা হল একটা মস্ত বড়ো মডেলিং সংস্থা।
–আমার নাম বিল লারনার। আমি এই এজেন্সি চালাই। তোমার নাম কী?
প্রথমে কেলি তার প্রথম নামটা বলেছিল। তারপর বলল- আমি কেলি হাটওয়ার্ক।
.
০৯.
এরোপ্লেনের শব্দ। লুইস রেনল্ডসের ঠোঁটে হাসি।–গ্যারি, দেরি হয়েছে। লুইস এয়ারপোর্টে গেছে গ্যারির সঙ্গে দেখা করতে।
গ্যারি বললেন চিন্তা করো না। আমি একটা ট্যাক্সি নেব।
–গ্যারি, আমি একটা অন্য কথা ভেবেছিলাম।
–ঠিক আছে, তুমি কি বাড়ি থাকবে? আমার জন্য অপেক্ষা করো।
–হ্যাঁ, তুমি যা বলবে!
.
লুইসের জীবনে তার ভাই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বেড়ে ওঠার দিনে, তখন সে শুধু দুঃস্বপ্ন দেখত। যখন লুইস নেহাতই এক কিশোরী কন্যা, সারা পৃথিবী তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে এইসব গ্ল্যামার পত্রিকা, ফ্যাশান মডেল, মহিলা নায়িকারা। কারণ সে মোটেই আকর্ষণীয়া নয়। বলা হয়, তার মতো পৃথুল পাছাবতীরা নাকি জীবনে উন্নতি করতে পারে না। মাঝে মধ্যেই লুইস রেনল্ডস আয়নাতে তার প্রতিফলন দেখত। তার লম্বা সোনালি চুল আছে। ভারি সুন্দরী চেহারা, কিন্তু শরীরটা কি আকর্ষণীয়া নয়? তার ভুড়ি আছে, বেশ বেড়ে গেছে খুঁড়িটা। আঃ, সকলে আমার দিকে এভাবে তাকায় কেন? সে এই ফিগার নিয়ে কী করবে? ছত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ?
লুইসের মনে পড়ল। স্কুলের বান্ধবীরা তার পেছনে চিমটি কেটে তাকে তিনী বলে ডাকত। এই শব্দ তাকে আঘাত করত।
শেষ পর্যন্ত লুইস টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হল। অনেক দুঃখ-কষ্ট আর জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে। ভাবল, আমি কী কাউকে ভালোবাসতে পারব না?
একদিন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল তার জীবনে। হেনরি লসন এলেন, চার্চে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লুইস তাকে ভালোবাসে। লসন লম্বা রোগা এবং মাথায় সোনালি চুল। চোখে কৌতুক। তার বাবা চার্চের মিনিস্টার।
অনেকক্ষণ হেনরি এবং লুইস পাশাপাশি বসে সময় কাটাল।
ভাব ভালোবাসায় পরিণত হল। শেষ পর্যন্ত তাদের নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। ঠিক হল, তারা পরস্পরকে বিয়ে করবে।
.
হেনরির বাবার চার্চে পাঁচদিন পর বিয়ের আসরটা বসেছিল। গ্যারি এবং তার কয়েকজন বন্ধু এসেছিলেন। এক অসাধারণ অনুষ্ঠান। লুইস এত আনন্দ কোনোদিন পায়নি।
–তোমরা কোথায় হনিমুনে যাবে? রেভারেন্ড লসন জানতে চেয়েছিলেন।
লেক লাউয়ে।
বাঃ, জায়গাটা সুন্দর। রোমান্টিক।
হেনরি লুইসকে আদর করে বললেন আমি জীবনের প্রত্যেকটা রাতকে মধুচন্দ্রিমার রাতে পরিণত করব সোনা, কথা দিচ্ছি।
.
বিয়ের পর তারা লেক লাউয়ের দিকে চলে গেল। অসাধারণ দৃশ্যপট। দূরে কানাডিয়ান পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
সন্ধ্যে হয়েছে। সূর্যের শেষ আলো লেকের জলকে রাঙিয়ে দিয়েছে।
হেনরি লুইসকে আদর করতে করতে বললেন তুমি কি খাবে কিছু?
না।
–তাহলে এস আমরা খেলাটা শুরু করি।
দু মিনিট কেটে গেছে। তারা বিছানার ওপর শুয়ে পড়েছে। হেনরি পাগলের মতো ভালবাসা দিচ্ছে। আহা, উত্তেজনা এবং বাসনা কামনা।
-হেনরি, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
এসো, আমরা আগে পশুর মতো মারামারি করি।
-কী?
তুমি হাঁটু মুড়ে বসো।
তুমি কি ক্লান্ত, ডার্লিং।
না, তুমি হাঁটু মুড়ে বসো।
–ঠিক আছে, বসছি।
লুইস হাঁটু মুড়ে বসল। অবাক হয়ে গেল। হেনরি তার ট্রাউজার থেকে বেল্টটা খুলে নিয়েছেন। হেনরি সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। কিছু বোঝার আগেই তিনি লুইসের নগ্ন নিতম্বের ওপর বেল্টের আঘাত করলেন।
লুইস চিৎকার করছে। বলছে– কী, করছ কী?
হেনরি বললেন- আমি তো বলেছি, আমরা পশুর মতো আচরণ করব। তিনি আবার বেল্টটা তুলে নিয়ে আঘাত করতে শুরু করলেন। উন্মত্তের মতো।
–থামো, থামো।
–ওখানে বসে থাকো।
হেনরির কণ্ঠস্বরে কর্তৃত্ব।
লুইস ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু হেনরি তাকে জোর করে বসিয়ে দিয়েছেন। আবার তার পিঠ ও পাছাতে বেল্ট দিয়ে আঘাত করছেন।
লুইসের মনে হল, সে বুঝি আর সহ্য করতে পারবে না।
-হেনরি, ঈশ্বরের অনুগ্রহ, থামো।
শেষ পর্যন্ত হেনরি উঠে দাঁড়ালেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন এবার ঠিক আছে।
লুইস নড়তে পারছে না। সে বুঝতে পারছে, তার শরীর থেকে রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে। সে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াল। সে তার স্বামীর দিকে তাকাল।
-হ্যাঁ, এই যৌনতা পাপ, আমরা কামনাকে দমন করব।
লুইস বুঝতে পারছে না, কী ঘটে গেল।
–আদম আর ইভের কথা চিন্তা করো। তুমি কি জানো, এভাবেই পৃথিবীতে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছিল।
হেনরি বকে চলেছেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি লুইসকে জড়িয়ে ধরে বললেন–ব্যাপারটা ঠিক আছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
লুইস তখনও বলছে– আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু…
চিন্তা করো না। শেষ পর্যন্ত আমরা বাসনাকে জয় করেছি।
তার মানে? কীভাবে এই কাজটা হবে? না, লুইস কিছু ভাবতে পারছে না।
হেনরি বললেন- চলো, আমরা ডিনার খেতে যাব।
.
রেস্টুরেন্টে লুইস কিছু খেতে পারেনি। তার অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে।
হেনরি বললেন–একটা বালিশের অর্ডার দেব? তুমি বালিশের ওপর বসার চেষ্টা করো।
খাবার দাবার অনেক। ডিনারের আসরে বসে লুইস ফেলে আসা ঘটনার কথা ভাবছে। হেনরিকে এক দারুণ ছেলে বলেই মনে হয় তার। কিন্তু হেনরি এমন আচরণ কেন করল?
হেনরি লুইসের দিকে তাকিয়ে বললেন আমি অনেক মেয়েকে ভালোবাসি।
-আমি তোমাকে সুখী করার চেষ্টা করব।
চলো, আমরা ঘরে ফিরে যাই।
–ঠিক আছে।
তারা ঘরে ফিরে এল। পোশাক খুলে ফেলল। হেনরি লুইসকে আদর করলেন। মনে হল সব যন্ত্রণা বুঝি হারিয়ে গেছে। ভালোবাসার অদ্ভুত উপহার।
লুইস স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল– আঃ, ভীষণ ভালো লাগছে।
–আমরা আবার ওই ঘটনাটি ঘটাব। তুমি হাঁটু মুড়ে বসো।
.
মধ্যরাত, হেনরি ঘুমিয়ে পড়েছেন। লুইস সুটকেস নিয়ে পালিয়ে গেল। সে প্লেন ধরে ভ্যাঙ্কুবারে এল। গ্যারিকে ডাকল। লাঞ্চের আসর। গ্যারিকে সে সব কিছু বলল।
লুইস বলল– আমি ডির্ভোস চাইছি। কিন্তু আমাকে এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে।
গ্যারি বললেন- আমার এক বন্ধু আছে, তার একটা ইনস্যুরেন্স এজেন্সি আছে, ডেনভারে এখান থেকে পনেরোশো মাইল দূরে।
-হ্যাঁ, এটাই ভালো হবে।
আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।
দু-সপ্তাহ কেটে গেছে। লুইস ইনস্যুরেন্স এজেন্সিতে কাজ করছে। ম্যানেজার পদে।
গ্যারি তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। সে একটা সুন্দর বাংলো কিনেছে, সেখান থেকে রকি পাহাড় দেখা যায়। মাঝে মধ্যে ভাই দেখা করতে আসে। সপ্তাহান্তে তারা একসঙ্গে চলে যায় কখনও স্কি-এর আসরে, কখনও মাছ ধরতে, কখনও কোথাও বসে থাকে।
এভাবেই দিন কেটে চলেছে। শেষ পর্যন্ত লুইস আরও ভালো জীবনের সন্ধান পেল। গ্যারি বিজ্ঞানে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করল। ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে চাকরি পেলেন। এখন আকাশে উড়ে বেড়ানোটাই হয়ে উঠল তার অন্যতম হবি।
.
লুইস গ্যারির কথা ভাবছিল, সামনের দরজায় শব্দ হল। সে জানালা দিয়ে তাকাল। কে ডাকছে? চিনতে পারল, টম হাবনার, এক লম্বা রোগা চ্যার্টার পাইলট, গ্যারির বন্ধু।
লুইস দরজাটা খুলে দিল। হাবনার ভেতরে ঢুকলেন।
— হাই টম?
লুইস? গ্যারি…
মনে হচ্ছে, একটু আগে তার প্লেনটা ল্যান্ড করেছে। যে কোনো সময় সে এসে পড়বে। তুমি কি অপেক্ষা করবে?
টম তাকালেন, খবরটা পড়োনি?
লুইস মাথা নাড়ল– না, কী হয়েছে? আমরা কি আর একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছি?
লুইস, একটা খারাপ খবর আছে। সত্যি খারাপ খবর। গ্যারি সম্পর্কে।
লুইসের মনে আতঙ্ক কী হয়েছে?
–গ্যারি তোমাকে দেখার জন্য উড়ে আসছিল। প্লেন দুর্ঘটনায় ও মারা গেছে।
টম দেখতে পেলেন, লুইসের চোখের তারা থেকে আলো নিভে গেছে।
–আমি খুবই দুঃখিত। আমি জানি, তোমরা পরস্পরকে কতখানি ভালোবাসতে।
লুইস কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু বলতে পারছে না। কোনোরকমে সে বলল কীভাবে?
টম তার হাতে হাত রাখলেন। কৌচের দিকে এগিয়ে গেলেন।
লুইস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- কী হয়েছিল?
গ্যারির প্লেনটা ডেনভারের কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে।
লুইস অজ্ঞান হবার মতো অবস্থায় পৌঁছে গিয়ে বলল- টম, আমি একা থাকব।
টম বললেন– সত্যি? লুইস, আমি একটু থাকব?
ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে একা থাকতে দাও।
টম উঠলেন। তারপর বললেন আমার ফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে। দরকার পড়লে আমাকে ফোন করো।
লুইস কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছে না। আচমকা এই আঘাত তাকে শোকে পাথর করে দিয়েছে। যদি আমি মারা যেতাম, তাহলে কত ভালো হত। ছোটোবেলার কত স্মৃতি মনে পড়ে গেল। গ্যারি সবসময় তার চারপাশে নিরাপত্তার পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। যে সব ছেলেরা লুইসের দিকে তাকিয়ে খারাপ ইঙ্গিত করত, গ্যারি তাদের সাথে মারামারি করত। তারা দুজনে বড়ো হল। লুইস গ্যারিকে নিয়ে গেম দেখতে যেত, মুভি এবং পার্টিতে। আহা এক সপ্তাহ আগে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ছবিটা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ছে।
তারা ডাইনিং রুমে পাশাপাশি বসেছিল।
–গ্যারি, তুমি খাচ্ছো না কেন?
–বোন, আমার খিদে নেই।
–তুমি কিছু বলতে চাও?
–তুমি বুঝতে পারো না?
কী বলো তো?
–আমার জীবন সব সময় বিপদে ভরা।
–হ্যাঁ।
পৃথিবীর মাত্র ছজন লোক এ ব্যাপারটা জানে। আমি সামনের সপ্তাহে আবার উড়ব। মঙ্গলবার সকালে আমি আবার ওয়াশিংটনের দিকে যাব।
–ওয়াশিংটন কেন?
–ওদের প্রাইমার সম্পর্কে বলতে হবে।
শেষ পর্যন্ত গ্যারি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলেন।
.
গ্যারি মারা গেছেন, আমার জীবন বিপদে পরিপূর্ণ। তার মানে? ভাইকে খুন করা হয়েছে?
লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকাল, এখন কিছু করা যাবে না। সকালবেলা সে টেলিফোন করবে, ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে। নিশ্চয়ই। এটাই তার জীবনে একমাত্র শপথ। কিন্তু, সে কি জিততে পারবে?
ডিনার খায়নি লুইস। মনে হল, তার খিদে নেই।
সে বেডরুমের দিকে হেঁটে গেল। ভীষণ ঘুম পেয়েছে তার। পোশাক খোলার মতো শক্তিও নেই। সেখানে শুয়ে রইল। আকাশের দিকে তাকিয়ে। তারপর ঘুমের জগতে পৌঁছে গেল।
লুইস স্বপ্ন দেখল, সে আর গ্যারি একটা ট্রেনে বসে আছে। সমস্ত প্যাসেঞ্জারদের মুখে সিগারেটের ধোঁয়া। সিগারেটের ধোঁয়া চারপাশের বাতাস বিষাক্ত করে তুলেছে। লুইসের কাশি হচ্ছে। সে চোখ খুলল, আঃ, বেডরুমে আগুন জ্বলে গেছে। পর্দায় দাউদাউ আগুন জ্বলছে। শুধু ধোঁয়া- কালো ধোঁয়া। লুইসের গলা বসে গেছে।
কী হয়েছে সে বুঝতে পারল না। সে দরজার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। না, এই আগুনের শিখা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।
লুইস রেনল্ডসের শেষ যে ছবিটা মনে আছে তা হল, আগুনের শিখা লকলকে লোভী জিভ বের করে তার দিকে তাকিয়ে হো-হো করে হাসছে।
.
১০.
কেলির কাছে সব কিছুই অত্যন্ত দ্রুত ঘটে চলেছে। সে মডেলিং-এর বিভিন্ন বিষয় জেনে ফেলেছে। যে এজেন্সি প্রশিক্ষণ দেয়, সেই এজেন্সিতে সে এক অনুভবী ছাত্রী। কীভাবে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে আরও সাহস সঞ্চয় করতে হয়, সব কিছু।
এর সাথে অভিনয়ের প্রাথমিক অ-আ-ক-খ।
সারা রাত্রি ধরে তাকে কাজ করতে হয়েছে। কেলি তার আবেদনি ছবি সকলের সামনে তুলে ধরতে চায়। দু-বছরের মধ্যে সে এক সফল মডেল হিসেবে পরিচিত হল। তার ছবি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ সময় তাকে প্যারিসে থাকতে হয়। এখানেই তার এজেন্সির উল্লেখযোগ্য ক্লায়েন্টদের অফিস।
একবার একটা ফ্যাশানের আসর শেষ হয়ে গেছে, নিউইয়র্কে, কেলি প্যারিসের দিকে যাবে। সে মাকে দেখতে গেল। মায়ের অনেক বয়স হয়েছে। কেলি মনে মনে ভাবল, মাকে আমি অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আমি একটা সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট কিনব। মায়ের সেবা করব।
মা কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন– কেলি, তোর খরব শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। তুই মাসে এতগুলো টাকা আয় করছিস?
-মা, আমি তোরার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাইছি। আমি তোমাকে এখন থেকে নিয়ে যাব।
হ্যাঁ, কে এখানে আসে বল?
সৎপিতা ঘরে ঢুকে বললেন- তোমরা এখানে কী করছ?
না, কেলি ভাবল, বাবার সঙ্গে বোঝাপড়াটা এখন বাকি থাকল।
.
কেলিকে আর একটা কাজ করতে হবে। সে পাবলিক লাইব্রেরিতে গেল। যেখানে সে অনেকগুলো সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে। তার হাতে অনেকগুলো ম্যাগাজিন, তার মন আনন্দে ভাসছে।
শ্ৰীমতী হাউসটোন ডেস্কে ছিলেন না। কেলি দেখল, উনি এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন। সুন্দর পোশাক পরেছেন।
শ্ৰীমতী হাউসটোনকে দেখে কেলি বলল- আপনি কেমন আছেন?
কেলি? হাউসটোনের চোখে মুখে বিস্ময়!
তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করল।
শ্ৰীমতী হাউসটোন কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি ভাবতেই পারছি না, ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
আমি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তারপর আপনার সঙ্গে দেখা করে গেলাম।
-তোমার কথা ভেবে আমি গর্ববোধ করি।
–আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই মিসেস হাউসটোন। আপনি সাহস না দিলে আজ আমি কোথায় থাকতাম বলুন তো? আপনি বলেছিলেন, ফ্যাশান ম্যাগাজিনে আমার ছবি দেখবেন। এই দেখুন, কতগুলো পত্রিকাতে আমার ছবি বেরিয়েছে।
কেলি একগাদা ফ্যাশান ম্যাগাজিন মিসেস হাউসটোনের হাতে তুলে দিল। হ্যাঁ, এলিকসমো, পলিটন, মাদমোয়াজেল, প্লে-এই প্রত্যেকটা বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকার কভারে কেলির ছবি।
মিসেস হাউসটোন বললেন- অসাধারণ।
উনি ডেস্কের পেছনে চলে গেলেন। তারপর বললেন- এই দেখো, তোমার প্রত্যেকটা পত্রিকা আমি কিনে রেখেছি।
কেলি অবাক হয়ে গেছে। সত্যি, কোথায় কে কতখানি ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে, কেউ তার খবর রাখে না।
.
কেলির সাফল্য এখন আকাশ ছোঁয়া। তবে এর জন্য মাঝে মধ্যে তাকে অনেক বিরক্তিজনক মুহূর্ত কাটাতে হয়। সব সময় ফটোগ্রাফারদের জ্বালাতন।
একদিন সে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেতে গেছে, পঞ্চম জর্জ হোটেলে। বিচ্ছিরি পোশাক পরা একটা লোক পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার চেহারাই বলে দিচ্ছে, তিনি সবসময় ঘরের ভেতর থাকতে ভালোবাসেন। তিনি এলি পত্রিকার একটা পাতা খুলে কেলির চোখের সামনে তুলে ধরলেন।
তিনি বললেন আমি আপনার ছবি দেখেছি। আপনি নাকি ফিলাডেলফিয়াতে জন্মেছিলেন। আমারও জন্ম সেখানে। আমি আপনার ছবি দেখেছি। আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা উথলে উঠছে।
কেলি শান্তভাবে বলল– অচেতনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে আমি ভালোবাসি না।
না, আমি অচেনা লোক নই। আমার নাম মার্ক হ্যারিস। আমি কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের হয়ে কাজ করছি। আমি ভাবলাম, এখানে যখন এসেছি, তখন আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খাব।
না, আপনার ভাবনা ভুল।
লোকটি বলতে থাকেন– আমি এভাবে বিরক্ত করার কথা চিন্তা করি নি। আমি চলে যাচ্ছি।
কেলি দেখল, তিনি চলে যাচ্ছেন। তার হাতে একটা ম্যাগাজিন রয়েছে।
.
কেলি এক সপ্তাহ বাদে আরও কতগুলি ফ্যাশান ম্যাগাজিনের জন্য সই করল। মার্ক হ্যারিসের সঙ্গে যোগাযোগের পর সে নতুন করে সবকিছু ভাবতে শিখেছে। একটা কার্ড পেয়েছে তার ড্রেসিংরুমে, একগোছা গোলাপের সাথে, লেখা আছে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত- মার্ক হ্যারিস।
কেলি ভাবল, ফুলগুলো হাসপাতালে পাঠালেই ভালো হত।
সকালবেলা ওয়াড্রোব মিসট্রেস এসে বলল- কেলি, কেউ এটা আপনার জন্য ফেলে গেছে।
একটা অর্কিড, কার্ডে লেখা আছে– আমাকে আশা করি ক্ষমা করেছেন, মার্ক হ্যারিস।
কেলি কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে বলল- ফুলটা রেখে দাও।
.
এরপর মার্ক হ্যারিসের উপহার বন্যার মতো আসছে। কখনও বাস্কেট ভরা ফল, কখনও একটা ছোট্ট আংটি, কখনও সান্তাক্লজ। কেলি সবকিছু বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিচ্ছে।
কিছু দিন বাদে একটা অদ্ভুত উপহার এল- কুতকুতে চোখের ছোট্ট কুকুরছানা। গলায় লাল রিবন বাঁধা। সেখানে লেখা আছে–কেলি, আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি। আমার উপহারটা গ্রহণ করবেন, এ হল এক দেবদূত।
রাগের চোটে কেলি কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপকে ফোন করল। মার্ক হ্যারিসের সঙ্গে কথা বলে তাকে লাঞ্চের আসরে নেমতন্ন করল।
হোটেল লরেন, মার্ক হ্যারিস দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কেলি ঢুকে পড়ল। মার্কের মুখে আশার আগুন জ্বলে উঠেছে– শেষ পর্যন্ত আপনি এলেন, এ কী আপনার কোলে কুকুরছানা।
কেলি কুকুরছানাটা মার্কের হাতে দিয়ে বলল- কে আপনার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে? তারপর বলল, ভবিষ্যতে আর কখনও আমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করবেন না। আশা করি আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন।
মার্ক হ্যারিসের মুখ এখন লজ্জায় লাল হয়েছে– হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি, আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনাকে আমি বিরক্ত করতে চাইনি। আপনি কি এক মুহূর্তের জন্য বসবেন?
কেলি বসল। মার্ক হ্যারিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন– আমি আবার ক্ষমা চাইছি। আমি আপনার ছবি দেখেছি, আমার মনে হয়েছে, আপনার ছবি আমার সারা জীবনটা পাল্টে দেবে।
মার্ক হ্যারিস আর কথা বলতে পারছেন না। শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন আপনার মতো কাউকে আমার জীবনে ভীষণ দরকার। বোধহয় আমার কথাগুলো স্কুল বালকের মতো হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। না, সারা জীবন আমি একা। ছ-বছর বয়সে মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
কেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে- হ্যাঁ, ভদ্রলোকের কথাগুলো তাকে অবাক করে দিচ্ছে।
অনেক দিন আগে যে স্মৃতি হারিয়ে গেছে, সেগুলো মনে পড়ছে।
বলা হয়েছিল, বাচ্চাটাকে খালাস করলে না কেন?
আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।
মার্ক হ্যারিস বলতে থাকেন– আমি অনেক বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি।
বলা হয়েছিল, ওরা তোমার কাকা, ওদের সাথে ভাব-ভালোবাসা করো না।
আমার মরতে সাধ জাগে।
তারপর?– আমি গ্যারেজে কাজ করেছি। আমি কিছু হতে চাই। আমি বোকা হাঁদা।
কেলি আরও-আরও আকর্ষিত হল।
আমি একজন মডেল হতে চাইছি।
মডেলরা বাজারে বেশ্যা ছাড়া আর কেউ নয়।
–আমি কলেজে যাব, কিন্তু ওরা বলেছে, আমি নাকি একেবারে বোকা। অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কে যেন বলেছিল, স্কুলে গিয়ে কী হবে? তুমি একটা গাধা ছাড়া আর কিছু নয়।
–আমি এম আই টি থেকে স্কলারশিপ পেলাম, আমার পালক মা-বাবা আমাকে নিয়ে উপহাস করল। বলল– আমি চালাতে পারব না। আমাকে গ্যারেজে কাজ করতে হবে।
একথাই আমাকে শুনতে হত– কলেজ? কলেজে গিয়ে সময় নষ্ট করে কী লাভ?
এই অচেনা আগন্তুকের কথা শুনে কেলি অবাক হয়ে গেল।
–আমি এম আই টি-র পড়াশোনা শেষ করলাম। কিংসলে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপে যোগ দিলাম প্যারিসে। কিন্তু আমি সব সময় একা থাকি। কিছুদিন আগে আমার জীবনটা হঠাৎ পাল্টে গেল। আপনার ছবি দেখে আমি আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছি। বিশ্বাস করুন, এর মধ্যে কোনো বাড়তি বানানো কথা নেই।
কেলি বসে আছে, কথা বলতে পারছে না।
মার্ক হ্যারিস বলে চলেছেন কিন্তু আপনাকে দেখে আমার জীবনটা যেন কেমন হয়ে গেছে।
উনি উঠে দাঁড়ালেন, ছোট্ট কুকুরছানাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমার এই ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আর কখনও আপনাকে আমি বিরক্ত করব না। গুডবাই।
কেলি বলল- একী? কুকুরটা নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ওটা তো আপনি আমাকে উপহার দিয়েছেন।
মার্ক দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়েছেন কিন্তু আপনি তো…
আমি আপনার সঙ্গে একটা চুক্তি সম্পাদন করতে চাই মি. হ্যারিস। আমি অ্যাঞ্জেলকে রাখব, আপনি মাঝে মধ্যে ওকে দেখতে আসবেন।
এক মুহূর্ত, আমন্ত্রণ হাসির চিহ্ন ঠোঁটে তার মানে..
কেলি বলল– আসুন, আজ রাতে ডিনার খেতে খেতে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব।
বেচারী কেলি জানতেই পারলো না, এভাবে সে এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে গেল।