দি মিস্ট্রি অফ্ ব্লু ট্রেন (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
০১.
সাদা চুলের লোকটি
প্রায় সারারাত। জানুয়ারির কনকনে শীতে সারা প্যারী শহরটা যখন ঝিমিয়ে পড়েছে তখন প্রেস দ্য লা কনকর্ড দিয়ে একটি লোক হনহন করে চলছে। নাম বোরিস আইভনোভিচ। খর্বাকৃতি সাধারণ চেহারা সেভিয়েট দূতাবাসের একজন পদস্থ কর্মচারী। তার দেহের শীর্ণতা গায়ের পুরু ফার কোটেও ঢাকা পড়েনি।
সে হাঁটতে হাঁটতে সীন নদীর ওপরে যে ব্রীজটা আছে সেটা পার হয়ে অখ্যাত পল্লীর ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেশ কিছুদূর যাবার পর সে একটা আধভাঙা বড় ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চারিদিকটা দেখে সে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে একেবারে সিঁড়ি বেয়ে সোজা পাঁচ তলায় উঠে একটা ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে দেখা দিল এক তরুণী– ওলগা ডেমির। সেও সেভিয়েত দূতাবাসের কর্মচারী।
কোনোরকম অভ্যর্থনা বা কোনো কথা বলল না ওলগা। বোরিসও কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওম্মা দরজা বন্ধ করে দিল।
–এদিকে সব ঠিক আছে তো? চাপাকণ্ঠে জিজ্ঞেসা করল বোরিস।
– মনে হয় আমার আসার পথে কেউ পিছু নেয়নি। কথাগুলো আপনমনে বলেই জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই কয়েক পা পিছিয়ে এল।
– কি ব্যাপার?– ওলগা জিজ্ঞেস করল।
–সামনে ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে দুটো লোক এই ঘরটার দিকে তাকিয়ে আছে– বোরিসের বিস্মৃত কণ্ঠস্বর।
– ওরা তোমার আসার আগে থেকেই আছে। ওলগা আশ্বাস দিল।
–কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ওরা আমাদের দিকে নজর রাখছে।
– হতে পারে, কারণ সন্ধ্যার ঠিক আগেই ওই লোক দুটোকে একটা সাদা চুলওয়ালা লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখছি। লোকটার চাল চলন যেন কেমন, আমার মনে হচ্ছিল ওদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল।
-তাহলে তো মনে হয় তোক দুটো তার ভাড়া করা গুণ্ডা।
— ঐ রকম একটা কিছু মনে হয়।
— তাহলে তো রীতিমত ভয়ের কথা।
–তোমার আবার ভয় কিসের? তুমি তো আর বামাল সমেত যাচ্ছ না।
–বামাল সমেত না হলেও টাকা নিয়ে তো যেতে হবে। যাকগে, এখন সেই আমেরিকান সময়মত এলে হয়। ভালো কথা, প্যাকেটটা ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, ওটা যথাস্থানেই আছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেলটা বেজে উঠল।
– এলেন বোধ হয়– মন্তব্য করল বোরিস।
ওলগা দরজা খুলতে গেল। ভদ্রলোক দেখছি খুবই পাংচুয়াল।
এক দশাসই প্রৌঢ়কে নিয়ে একটু পরেই ফিরে এলো।
তিনি বোরিসের দিকে তাকিয়ে : মঁসিয়ে, ক্রাসনিন?
–হ্যাঁ, আমিই সেই সেই লোক। কাজটা খুবই গোপনীয় বলে আপনাকে কষ্ট দিয়ে এতদূর আনার জন্য ক্ষমা চাইছি।
– আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কেউ আমাদের লেনদেনের ব্যাপারে জানবে না। নিন্ মালটা বের করুন এবার।
টাকা এনেছেন তো?
— নিশ্চয়ই।
বোরিস্ ওলগাকে ইশারা করল। ও চুল্লীর কাছে গিয়ে ভেতরে হাত দিয়ে ছাই আর পোড়া কয়লার মধ্যে থেকে একটা কাগজ মোড়া প্যাকেট বার করে আনল।
প্যাকেটটা নিয়ে বোরিস কাগজের মোড়কটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ভেলভেটের বাক্স।
গভীর আগ্রহে বোরিসের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ভদ্রলোক ঢাকনিটা খুলে ফেলল। ভেতরে পায়রার ডিমের মতো একটা নিটোল রুবী এবং সঙ্গে আরও কয়েকটা ছোট রুবী।
জিনিসগুলো দেখে আপন মনে বুঝে সে নিশ্চিন্ত হল। বাক্সটা বন্ধ করে বেলটের পাশের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে ভেতরের পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে বোরিসের হাতে দিয়ে দিল।
নোটগুলো সবই ছিল হাজার পাউণ্ডের। গুণতে বেশি সময় লাগল না। এবার সে বলল, ঠিক আছে স্যার।
এবার তাহলে চলি। গুড নাইট। ওলগা দরজা খুলে দিল। ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে এসে বলল, এবার আমার পাওনা মিটিয়ে দাও তো।
দুখানা নোট তার হাতে দিল বোরিস। খুশী তো? আশাতীত পেয়ে খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল সে। নোট দুটোকে ভাজ করে সে তার মোজার ভেতরে রাখল।
জানলার কাছে গিয়ে ওরা দেখল ভদ্রলোক দ্রুতপায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তারপরেই দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
–যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হলো দেখছি। চাপাকণ্ঠে বলল বোরিস।
একটু বাদেই দেখা গেল আরেকটি লোক তাদের অনুসরণ করছে। ওগাঁ লোকটিকে চিনতে পারল।
ওই দেখ সেই লোকটা। বোরিস সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দিকে তাকাল। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে একটি লোক–তার মাথার চুলগুলো বেশ ঘন আর ধবধবে সাদা।
.
০২.
মঁসিয়ে নে মার্কুইস
সাদা চুল লোকটা গদাইলস্করি চালে হাঁটছে। যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তারপর একটা মোড়ের কাছে সে হাজির হলো। দুটো রাস্তা দুদিকে গেছে। সে ডানে না গিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরল। কিছুদূর গিয়েই আরেকটি মোড় এবার ডানদিকে গেল।
কয়েক মিনিট বাদেই দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল। থমকে দাঁড়িয়ে লোকটা বুঝতে চেষ্টা করল আওয়াজটা কোনোদিক থেকে এসেছে। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল কুর হাসির রেখা।
আবার সে চলতে শুরু করল ঠিক আগের মত করে। একি! সামনে ওটা কিসের ভিড় জমেছে। সে ভিড়ের কাছে গেল।
কালো ওভারকোট পরা একটি লোক কি যেন লিখছে নোট বইতে। তাকে ঘিরেই ভিড় জমেছে।
–কি হয়েছে এখানে? সাদা চুলওলা লোকটি একজনকে প্রশ্ন করল।
–খুনের চেষ্টা। খুব বেঁচে গেছেন ভদ্রলোক।
— কি রকম?
–দুজন গুণ্ডা একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল।
–তারপর?
–তারপর আর কি? পালাতে পথ পায় না বাছাধনরা; ভদ্রলোকের বাহাদুরি আছে বলতে হবে। গুণ্ডা দুটো গুলি করার আগেই ভদ্রলোকটি গুলি করে! আর ওরা লেজ গুটিয়ে চম্পট।
লোকটা কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে সীন নদীর ব্রীজের দিকে এবং পায়ে পায়ে কখন পৌঁছেও যায়।
ব্রীজ পার হয়ে আবার হাঁটতে লাগল সামনের দিকে এবার দ্রুত গতিতে।
রাত বারোটা বেজে গেছে। লোকটা একটা বন্ধ জুয়েলারী দোকানের সামনে দাঁড়ায়। তারপর দোকানের পাশে সরু গলিতে ঢুকে দোকানের ওপর তলায় ওঠবার সিঁড়ির দরজায় পরপর তিনবার কলিং বেল টিপল। একটু পরেই দারোয়ান দরজা খুলে বিরক্তিতে বলল; কি চান?
–আমি মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
–এত রাত্রে তার সঙ্গে দেখা হবে না। আপনি বরং কাল দিনের বেলায় আসুন।
–না, দিনের বেলা আসা সম্ভব নয়। তুমি মনিবকে বলো মার্কুইস এসেছে। দারোয়ান সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে দরজাটা বন্ধ করে দিল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল।
–আপনি ভেতরে আসুন মঁসিয়ে। মালিক আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।
মার্কুইস ঘরে ঢুকতেই মালিক অভ্যর্থনা জানালেন। এই যে মঁসিয়ে নে মাকুইস! দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।
মার্কুইস ধন্যবাদ বলতেই পপোপুলাস তাকালেন; কি খবর বন্ধু! মাল এনেছেন?
– না, আমার প্রথম প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে তবে হাল ছেড়ে দিইনি। এবার অন্য পথে যেমন করে থোক ও জিনিস আমার চাই-ই।
-আপনার হাতযশের নাম আছে সুতরাং আপনি সফল হবেন।
– সফল হতেই হবে। ও জিনিস চাই-ই। আপনার সঙ্গে যে ব্যবস্থা হয়েছে তা যেন ঠিক থাকে।
–আমার কথার নড়চড় হয় না। মাকুইস, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
–গুড নাইট মঁসিয়ে।
–গুড নাইট মার্কুইস, আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।
মার্কুইস বেরিয়ে যেতেই ভেতরের দরজায় খট করে একটা শব্দ হলো। উঠে গিয়ে পপোপুলাস দরজা খুলতেই একটি মেয়ে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি উঠে লজ্জিত দৃষ্টিতে পপোপুলাসের দিকে তাকাল।
–কি ব্যাপার জিয়া। এখানে কি করছিলে?
–আমি চাবির গর্ত দিয়ে লোকটাকে দেখছিলাম।
–দেখতে পেয়েছ তাকে?
– না, ভালো করে দেখতে পাইনি। তবে একটা জিনিস দেখেছি মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। পপোপুলাস হেসে বললেন : ওটা পরচুল।
.
০৩.
হার্ট অফ ফায়ার
স্যাভয় হোটেল।
আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধন কুবের মিঃ রিউফাস ভ্যান আলডিন একটা স্যুট নিয়ে এই হোটেলে বাস করছেন। রীতিমত অফিস চালাচ্ছেন তিনি। কেরানি, টাইপিস্ট, বয়, বেয়ারা তো আছেনই, একজন সেক্রেটারীও নিযুক্ত করেছেন।
দুদিন মিঃ আলডিন ছিলেন না এবং কেউ জানত না যে তিনি কোথায় আছেন। সেক্রেটারী মিঃ কিংটন তো রীতিমত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন।
বেলা প্রায় নটায় মিঃ আলডিন এলেন।
কিংটন হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল; গুড মর্নিং স্যার। আপনার জন্যে আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম।
-হ্যাঁ এত দেরি হবে ভাবিনি, জরুরী কিছু খবর আছে কি?
–আছে স্যার, মিসেস ক্যাথারিন দুবার ফোন করেছিলেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছেন।
খবরটা শুনে আলডিন ভাবলো, নিশ্চয়ই রুথ কোনোরকম ঝামেলায় পড়েছে। হয়তো ড্রেক ক্যাথারিন আবার তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।
অস্থির ভাবে পায়চারি করতে শুরু করলেন আলডিন। ঘরে ঢুকে ওভারকোটটা আবার পরে ফেললেন তিনি।
–আপনি কি আবার বাইরে যাচ্ছেন স্যার?
–হ্যাঁ, আমি রুথ-এর কাছে যাচ্ছি।
–কলিটন থেকে কেউ ফোন করলে কি বলবো?
–বলবে, জাহান্নামে যাও।
–বেশ, তাই বলব স্যার। কিন্তু সে হয়তো সেই উৎকৃষ্ট জায়গায় যেতে রাজী হবে না।
মিঃ আলডিন এবার হেসে ফেললেন, তোমার এই গুণের জন্যেই তোমাকে আমি পছন্দ করি। ওদের লোক এলে বলবে আমি পরে দেখা করবো। এখন আমি খুবই ব্যস্ত।
ঘর থেকে বেরিয়ে দু-পা এগিয়েই হঠাৎ থামলেন।
কিংটন এগিয়ে গেল তার কাছে, আমাকে কিছু বলবেন? স্যার
হ্যাঁ, তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।
পকেটে হাত দিয়ে একটা ভেলভেটের বাক্স বের করে ঢাকনিটা খুলে –এই দেখো।
কিংটন- এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হল।
–এত সুন্দর এবং এত বড় রুবী আগে দেখিনি স্যার? খুব দামী নিশ্চয়ই?
–দামী বলে দামী। এ জিনিস অমূল্য। মাঝখানে যে বড় রুবীটা–ওটি রাশিয়ান জারিনার কণ্ঠে শোভা পেত। ওর নাম হার্ট অফ ফায়ার। ইতিহাসে প্রসিদ্ধ মণি এটা।
–এই মহামূল্য রত্ন নিয়ে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্যার! দুষ্ট লোকে জানতে পারলে হয়তো….
–ছিনতাই করবে–তাই তো? সে চেষ্টা করেছিল বৈকি।
–বলেন কি স্যার।
-হ্যাঁ, দুটো গুণ্ডা লোক আমাকে আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার রিভলবারটা গর্জে উঠলে ওরা পালায়।
–জিনিসটা বোধ হয় মিসেস ক্যাথারিনকে উপহার দিতে চাইছেন, তাই নয় কি?
–ঠিকই ধরেছ। রুথের জন্যেই আমি এটা কিনেছি!
–এতক্ষণে বুঝলাম মিসেস ক্যাথারিন-এর উৎকণ্ঠার কারণ।
-তোমার এবারের অনুমান ঠিক হলো না। রুথ কিছুই জানে না! এটা উপহার দিয়ে আমি ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে চাই। ওর মুখের হাসির দাম আমার কাছে হার্ট অফ ফায়ার-এর চেয়ে অনেক বেশি।
বাক্সটা বন্ধ করে পকেটে রাখলেন আলডিন।
–ঘন্টা খানেক বাদেই আমি ফিরে আসছি।
.
০৪.
রুথ ক্যাথারিন
কার্জন স্ট্রীটে বড় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করে রুথ। মিঃ ভ্যান আলডিন-এর একমাত্র সন্তান। লর্ড লুকোবারীর একমাত্র পুত্র ড্রেক ক্যাথারিন-এর সঙ্গে রুথ-এর বিয়ে দিয়েছেন।
ড্রেক-এর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন অনেক রঙীন আশা নিয়ে। বৃদ্ধ লর্ড-এর মৃত্যুর পরে তার জামাই হবে লর্ড লুকোনবারী এবং রুথ হবে লেডি লুকোনবারী। কিন্তু ড্রেক আজ স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে লম্পটের জীবন যাপন করছে।
মেয়েকে সুখী করতে গিয়ে আলডিন তাকে চরম অসুখী করে ফেলেছেন। এই কারণেই তিনি মেয়েকে ঐতিহাসিক হার্ট অফ ফায়ার দিয়েও খুশী রাখতে চাইছেন।
রুথ-এর বাড়িতে প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ হাজির হলেন। বাড়িতে ঢুকেই নুতন মেইড মিস ম্যাসনকে দেখে বলেন, রুথ কোথায়?
মিস ম্যাসন আলডিনকে দেখেই অভিবাদন করে বলল, তিনি এখন দোতলায় ড্রয়িং রুম-এ আছেন স্যার।
মিঃ আলডিন ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই রুথ এসে তার গলা জড়িয়ে ধরল। দুদিন তুমি হোটেলে ছিলে না। আমি দুবার ফোন করেছি। কোথায় গিয়েছিলে, বাপি?
–হ্যাঁ, বিশেষ একটা কাজের জন্য বাইরে ছিলাম দুদিন এবং বাইরে ছিলাম তোমার জন্যেই।
–আমার জন্যেই!
–হ্যাঁ, তোমারই জন্যেই। কিন্তু সে কথা পরে হবে। এবার বলো, আমার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চাইছিলে কেন? ড্রেক কি আবার দুর্ব্যবহার করেছে।
নতুন করে ও আর কি দুর্ব্যবহার করবে। গত তিন সপ্তাহ ওর সঙ্গে দেখাই হয়নি। আগে যদিও বা মাঝে মাধ্যে বাড়িতে আসতো। ও এখন মেতে উঠেছে এক নাচনেওয়ালীকে নিয়ে।
–নাচনেওয়ালী! কে সে?
–তার নাম মিরেলী। পেশাদার নাচিয়ে।
–এ খবরটা আমার কানেও গেছে। আমি তাই গত সপ্তাহে লুকোবারীর কাছে এ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছি।
–তিনি কি বললেন?
–আমার সঙ্গে তিনি ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ড্রেক সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বেচারার জন্য আমার কষ্ট হয়।
-বেচারা মানে? কার সম্বন্ধে বলছ কথাটা?
–বলছি লর্ড লুকোবারীর সম্বন্ধে। আমার মনে হল ড্রেক এখন ওকে পাত্তাই দেয় না। জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ পিতাকে সে পথের কাঁটা মনে করে।
এ ব্যাপারে তুমি কিছু করতে পার না, বাপি?
–হয়তো পারি। কিন্তু ওর সঙ্গে আমি সম্পর্কই রাখতে চাই না। তুমিও ওর সম্পর্কটা শেষ করে দাও।
–তার মানে?
–ডিভোর্স। হ্যাঁ, ডিভোর্স। যত তাড়াতাড়ি পার ততই ভাল।
–কিন্তু…..
-না রুথ, এর মধ্যে আর কিন্তু নয়। তোমার মনে এখনো ওর জন্যে কিছুটা দুর্বলতা আছে। কিন্তু সে দুর্বলতা তোমাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
কথা বলতে বলতে আলডিন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ও তোমাকে টাকার জন্যে বিয়ে করেছিল। ওর মত স্কাউনড্রেল-ব্রুট এর উপরে আর কোনো টান রাখার দরকার নেই! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ছাঁটাই কর।
–ও যদি রাজী না হয়?
-রাজী ওকে হতেই হবে। রাজী হওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তুমি এতে রাজী আছ কি? তোমার মত বলল।
–ও যদি কেসটা কনটেস্ট করে?
–না, ও তা করবে না। করতে পারবে না।
–কিন্তু খবরের কাগজে ব্যাপারটা নিয়ে হৈ চৈ পড়বে। কাগজওলাদের আমি ভয় করি।
–ওদের মুখ বন্ধ করার মহৌষধ আমার জানা আছে। সেই মহৌষধটি কয়েকটা ডোজ খাওয়ালেই মুখ বন্ধ।
-বেশ, তুমি যখন বলছ….
–আমি বলছি মানে? তোমার কি সম্মতি নেই না কি?
–না, তা বলছি না। আমার সম্মতি আছে বৈকি।
–এই তো আমার মেয়ের মতো কথা! এতে তোমার ভালোই হবে। এবার দেখ তোমার জন্যে কি জিনিস এনেছি আমি।
পকেট থেকে সেই ভেলভেটের বাক্সটা বার করে রুথকে দিলেন। বাক্সটা খুলেই রুথ বিস্ময়ে আর আনন্দে আত্মহারা হলো। কি সুন্দর! অপূর্ব! এরকম সুন্দর আর এত বড় রুবী আগে কোনোদিন দেখিনি।
–ঠিক বলেছ। এ রত্ন অদ্বিতীয়, অমূল্য। এবার বল, তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
–খু-উ-ব! কিন্তু এটা তুমি কিভাবে যোগাড় করলে বাপি?
–সে অনেক কাহিনী। এটা যোগাড় করতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। তাছাড়া এর জন্যে ব্যয় হয়েছে কয়েক লাখ ডলার।
–কয়েক লাখ ডলার! বলো কি!
–ঠিকই বলছি। রুবীটার সত্যিকারের দাম অনেক বেশি। পৃথিবীতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে কটি মণিমাণিক্য আছে, এটি তারই একটি। এর নাম হার্ট অফ ফায়ার।
হার্ট অফ ফায়ার! রাশিয়ার জারিনা যে রুবীটা গলায় পরতেন?
–হ্যাঁ, এটা সেই রুবীই।
রুথ বাক্স থেকে সেই রুবীটা বের করে বুকের ওপর চেপে ধরল আর খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল ওর মুখ।
–আমাকে এত ভালোবাস, বাপি!
–তোমাকে ভালোবাসব না তো কাকে ভালোবাসব? তুমি আমার চোখের মণি একমাত্র সন্তান। তোমাকে খুশী করতে কোহিনুর পেলে তা কিনতেও রাজী আছি। তোমার মুখে যদি হাসি ফোঁটাতে না পারি তাহলে আমার ধনদৌলতের দাম কি?
এতক্ষণে রুথের মনে হলো যে, তার বাপির বোধহয় খাওয়া হয়নি। এবেলা এখানেই খেয়ে নাও, বাপি।
-না। আমাকে এখুনি যেতে হবে। অনেক জরুরী কাজ পড়ে আছে।
উঠে দাঁড়ালেন আলডিন, আমি এখন যাচ্ছি রুথ। কাল তোমাকে নিয়ে একবার সলিসিটার অফিসে যাব। তুমি তৈরি হয়ে থেকো। সাড়ে বারটায় আসব না হলে ফোন করে দেব।
–বেশ, তাই হবে। কিন্তু
–কিন্তু কি রুথ?
–আমি যে রিভিয়ারায় যাব বলে সব কিছু ঠিক করে ফেলেছি। যাওয়াটা বন্ধ হবে না। তো?
–বন্ধ হবে কেন? কালই তো আর মামলা দায়ের করা হচ্ছে না। কালকে শুধু আলোচনা হবে সলিসিটারের সঙ্গে। তুমি ফিরে এলেই হবে। হ্যাঁ, কবে রওনা হচ্ছ?
–আগামী ১৪ই, ব্লু ট্রেনে।
–ঠিক আছে। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে যাবার আগে রুবীটাকে ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্ট-এ রেখে যেও।
–কেন বাপী? এটা সঙ্গে থাকলে অসুবিধা কি?
–অসুবিধে বিশেষ কিছু নেই, তবে….
–তবে কি বাপি?
–এ ধরনের দুর্লভ-রত্নের জন্য বিপদ ঘটা বিচিত্র নয়। রত্নচোরেরা খবর পেয়ে আমাকে আক্রমণ করেছিল।
-তাই নাকি?
–হ্যাঁ, রুবীটা কিনে যখন ফিরছিলাম দুজন আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিলো তার আগেই আমার রিভলবারটা গর্জে উঠে, ওরা দ্রুত পালায়।
–অসাধারণ তোমার সাহস বাপি।
আলডিন বললেন, এই জন্যে রুবীটা ব্যাঙ্কে রাখতে বললাম!
–বেশ, আমি দু-একদিনের মধ্যেই রুবীটা ব্যাঙ্কে রাখব।
মিঃ আলডিন তখন মেয়ের কপালে স্নেহচুম্বন দিয়ে বিদায় নিলেন। হোটেলে ফিরে তিনি সেক্রেটারীকে বললেন, এখুনি মিঃ গোবির কাছে যাও তো। তাকে বলবে সে যেন আমার সঙ্গে আগামীকাল সকাল নটায় দেখা করেন।
.
০৫.
গোপন সংবাদের সন্ধানে
গোবি পরদিন সকালেই হাজির হলো ঠিক নটায়। তার সময়ানুবর্তিতার জন্যে খুশী হলেন আলডিন।
–বসুন মিঃ গোবি, আপনার সঙ্গে কিছু কাজের কথা আছে।
-বলুন।
–একটা লোকের সম্বন্ধে কিছু গোপন খবর দিতে হবে?
–গোপন সংবাদ বিক্রি করাই তো আমার পেশা।
–আপনি নিশ্চয়ই জানেন, লর্ড লুকোনবারীর ছেলে ড্রেক ক্যাথারিন আমার জামাই।
–তা জানি।
-আমার মেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করবে। মামলা দায়ের করাটা সলিসিটার-এর কাজ কিন্তু যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেই জন্যেই আমি ড্রেক সম্বন্ধে সব কিছু গোপন খবর জানতে চাই।
-অর্থাৎ, আপনি তার ব্যক্তিগত চরিত্র এবং আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান, এই
-হ্যাঁ, খবরগুলো কখন পেতে পারি?
–আপনার কি খুব তাড়া আছে।
–হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানতে চাই।
-ঠিক আছে, আজ দুটোর সময় আমি আসছি। আশা করি সব খবর জানতে পারবেন। এবার তাহলে আমি আসি, গুড মর্নিং।
–আসুন মিঃ গোবি, গুড মর্নিং। মিঃ গোবি চলে যেতেই আলডিন সেক্রেটারীকে ডেকে বললেন, এবার আমি অফিসের কাজ করব। আজকের করনীয় কাজ সব ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ, স্যার, সবই ঠিক করে রেখেছি। আপনি আসুন।
সাড়ে নটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করলেন আলডিন। তারপর স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম করলেন।
একটু পরেই হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক টেলিফোন করে জানালেন মাননীয় ড্রেক ক্যাথারিন তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাকে কি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব স্যার?
–হ্যাঁ, দিন। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ক্যাথারিন এসে হাজির হল।
–আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
–হ্যাঁ, বসো।
–গতকাল আমি রুথের কাছে গিয়েছিলাম। আমার উপদেশমত সে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করছে।
–আর কিছু বলবার আছে কি?
-না, আর বিশেষ কিছু বলবার নেই। রুথ-এর সঙ্গে তুমি যে ব্যবহার করেছ–তারপরে এখন নাকি এক নাচনেওয়ালীর পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
–ব্যক্তিগত কথা যখন তুললেন তাহলে আমার কথাটাও শুনে নিন। আমি ঘরছাড়া হয়েছি আপানার মেয়ের জন্যেই। নিজের স্ত্রী, কোনো পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম করবে সেটা কোনো পুরুষই সহ্য করবে না।
-তুমি জানো তুমি কি বলছ?
–ঠিকই বলছি। একটু খোঁজ নিলেই সত্যাসত্য জানতে পারবেন। আপনার মেয়ে আমাকে বিয়ে করেছিল বংশ মর্যাদার জন্যে আর ভবিষ্যতে লেডী লুকোনবারী হবে সেই আশায়।
আলডিন বেশ একটু ঝঝের সুরেই বললেন, উপাধির এখন কোনো মূল্য নেই, এখন কোনো সম্মান যে কোনো উপাধিকারী অপেক্ষা কম নয়। আমার সংকল্প সফল হবেই। আমি তাই আশা করি যে, মামলা আদালতে উঠলে তুমি কনটেস্ট করবে না।
–আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
–তা যদি মনে হয় তবে তাই।
–আমি যদি কনটেস্ট করি তাহলে আপনি কি করবেন?
কনটেস্ট করবে! বেশ, তাহলে সেই চেষ্টাই করো?
-আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার। ও ব্যাপারে আমি কোনো উপদেশ শুনতে চাই না।
উপদেশ দেওয়া আমার স্বভাব নয়।
–কিন্তু আপনি তো সেটাই করছেন। আপনার মেয়েকে উপদেশ দিয়েছেন মামলা করতে, আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন মামলায় কনটেস্ট না করতে।
–হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার একমাত্র সন্তানের ভালোমন্দ জড়িত বলেই আমি রুথকে উপদেশ দিতে বাধ্য হয়েছি।
-বেশ, আপনি ভালোমন্দ দেখতে থাকুন, আমি বিদায় হচ্ছি। তবে এটুকু বলে যাচ্ছি যে পরের ছিদ্র দেখার আগে নিজেদের ছিদ্র সম্বন্ধেও কিছু খোঁজ খবর নেবেন।
–কে সে লোক?
–আপনি তাকে চেনেন। তিনি হলেন মহামাননীয় কাউন্ট দ্য লা রোচি। আচ্ছা চললাম।
ক্যাথরিন চলে যেতেই মেয়ের কাছে টেলিফোন করেন। কিন্তু ম্যাসন জানায় যে মিসেস ক্যাথারিন কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছেন।
সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আলডিন-এর মনে হলো যে তিনি বেলা সাড়ে বারটায় সলিসিটারের কাছে যাবেন বলেছিলেন রুথকে। তাই বোধ হয়…. তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।
সলিসিটার-এর অফিস থেকে দুটো বেজে পাঁচ মিনিটে ফিরে এলেন আলডিন। এসে দেখেন মি গোবি বসে আছেন।
তাকে দেখে বললেন, কি! যোগাড় হয়েছে?
–এ শর্মা যে কাজের ভার নেয় তা অসম্পূর্ণ থাকে না স্যার। এই নিন।
পকেট থেকে একটা নোট বের করে দিলেন, সব খবর এতে লেখা আছে স্যার।
নোটবই পড়া শেষ হলে আলডিন খুব খুশী হয়ে বললেন, ধন্যবাদ মিঃ গোবি। আমি যা জানতে চেয়েছিলাম সবই আছে এতে।
নোটবইটা সযত্নে ড্রয়ারে রেখে দিলেন। তারপর আলডিন একতাড়া ব্যাঙ্ক নোট মিঃ গোবির হাতে দিলেন, এই নিন আপনার পারিশ্রমিক। নোটগুলো পকেটে রেখে গোবি উঠে দাঁড়ালেন, এবার তাহলে আসি স্যার। দরকার হলে আবার ডাকবেন।
নিশ্চয়ই ডাকব। আপনার কাজে আমি খুব খুশী।
গোবি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ আলডিন নোট বইখানা সঙ্গে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুথের বাড়িতে পৌঁছলেন। রুথ বিস্মিত হলেন, কি হয়েছে বাপি?
–তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম। সলিসিটারের সামনে সে কথা বলা ঠিক হতো না।
–কি কথা, বাপি?
-ক্যাথারিন আমাকে বলেছে, তুমি এখনও সেই হতভাগাটার সঙ্গে মেলামেশা করো। একথা কি সত্যি?
–কার কথা বলছ, বাপি?
-বলছি সেই লম্পট কাউন্ট দ্য লা রোচির কথা। আমি জানতে চাই, তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে কিনা?
-ও তোমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। কাউন্টের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই, বাপি। ও নিজের দোষ ঢাকবার জন্যেই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে।
মেয়ের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি গোবির দেওয়া নোটবইখানা মেয়েকে দিলেন। ড্রেক-এর যাবতীয় গোপন খবর পড়ে দেখো।
রুথ নোটবইখানা শেষ করে বাপিকে ফেরৎ দিয়ে বলল, ও যে এত নিচে নেমে গেছে তা আমি জানতাম না বাপি।
-এবার তাহলে বুঝতে পারছ, যে এই অস্ত্রেই আমি ওকে ঘায়েল করতে পারব। ও যাতে মামলাটা কনটেস্ট করতে না পারে তার জন্যেই এটা আমি সংগ্রহ করেছি। এবার তুমি নিশ্চিন্তে মামলা রুজু করতে পার।
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর মিঃ আলডিন মেয়ের কাছে বিদায় নিলেন।