মার্ডার ইজ ইজি (উপন্যাস) – আগাথা ক্রিস্টি
সহযাত্রিণী
ইংল্যান্ড! আবার সেই কতদিন পর ইংল্যাণ্ডের মাটিতে! কেমন লাগবে কে জানে?
জাহাজঘাটে যেতে যেতে লিউক ফিৎস উইলিয়াম নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা করলো। একনাগাড়ে বেশি কিছুদিন জলের দেশে বাস করার পর ডাঙ্গায় নেমে জাহাজী ট্রেনে উঠতেই এই চিন্তাগুলোই তাকে বিভোর করে ফেলল।
ইংল্যান্ডে ছুটিতে আসার ব্যাপারটা আলাদা; খুশিমত খরচ করার টাকা (অন্ততঃ প্রথম দিকটায়), পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা, ঠাট্টা-মস্করা করে সময় কাটানো–যেন খেয়াল-খুশির আনন্দমেলা। ভাবটা যেন–আর কটা দিনই বা আছি, এই তো ফিরে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এলো, তারই মধ্যে যতটা করে নেওয়া যায়।
কিন্তু এবার ফিরে যাবার আর প্রশ্ন নেই। সেই ভ্যাপসা গরম রাতের ছটফটানি, নির্জন সন্ধ্যায় একাকীত্ব, পুরোনো টাইমস্ বার বার পড়া–এর কোনোটাই আর লিউকের কাছে ফিরে আসবে না। দেশের মানুষ এবার দেশে ফিরে এসেছে। হাতে অখণ্ড অবসর। নিজেকে নিয়ে এবার ও কী করবে এটাই সমস্যা।
ওর কাছে ইংল্যাণ্ডের এই জুন মাসের আবছা নীল আকাশ আর ধারালো হাওয়ায় বিছুটি দুটোই সমান বিরক্তিকর। এর ওপর মানুষ! আর দেখছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা
নিজের কামরায় চোখ ফিরিয়ে সদ্য কেনা টাইমস, দৈনিক ক্ল্যারিয়ন আর পানচ সবগুলো কাগজ নিয়ে গুছিয়ে বসলো সে। প্রথমেই মন দিলো দৈনিক ক্ল্যারিয়নের ডারবী রেসের পাতায়; আফশোষ হল যদি গতকাল এসে পৌঁছোতে পারতো। যখন ওর উনিশ বছর বয়স, তখন ডারবী দেখেছিল শেষবারের মতো।
ক্লাব সুইপের একটি ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছে লিউক। ক্ল্যারিয়নের ঘোড়দৌড় বিশারদ সেই ঘোড়াটির সম্পর্কে অল্পস্বল্প মন্তব্য করে তার বক্তব্য শেষ করেছিল–এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় জুজুরে সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। বরঞ্চ বাইরের একটি ঘোড়ার কিন্তু লিউকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না বাইরের সেই সম্ভাবনাময় ঘোড়াটি। দ্বিতীয় জুজুবের ওপর ও বাজির সংখ্যা গুণে দেখলো ৪০ঃ১।
সময় দেখলো ঘড়িতে পৌনে চারটে। খেলা শেষ হলো এতক্ষণে : এঃ যদি বাজি ধরতাম ক্ল্যারিগোল্ডের ওপর! দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো ক্ল্যারিগোল্ড।
লিউক এবারে টাইমস খুলে গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখতে লাগল। এমন সময় বিশ্রী দেখতে এক কর্নেল আধঘণ্টা বক বক করে তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। ভদ্রলোক ঘুমোতেই লিউক বাইরের দিকে তাকাল। সামনেই একটা প্ল্যাটফর্ম। তার একটু দূরে একটা প্ল্যাকার্ডের দিকে ওর নজর
পড়লো। তাতে লেখা আছে :
ডারবীর ফলাফল
দ্বিতীয় জুজুব–প্রথম
মাজেপ্পা-দ্বিতীয়
ক্ল্যারিগোল্ড–তৃতীয়
লিউকের মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠলো। ইচ্ছেমতো খরচ করার জন্য ১০০ পাউণ্ড। অথচ কত অবজ্ঞা করেছে এই জুজুবকেই ঘোড়দৌড় বিশেষজ্ঞরা। ও কাগজটা ভাজ করে পেছন ফিরতেই একই বোকা বনে গেল। ট্রেন নেই, প্ল্যাটফর্ম শূন্য। আনন্দের উত্তেজনার মাঝে কখন ট্রেনটা এক ফাঁকে চলে গেছে। একজন কুলিকে জিজ্ঞেস করলো–এই হতচ্ছাড়া ট্রেনটা কখন ছেড়ে গেল?
উত্তরে কুলি বললো–কোনো ট্রেন? ৩-১৪ মিনিটের পর আর কোনো ট্রেন তো এখানে থামেনি।
এক্ষুনি এখানে একটা ট্রেন থেমেছিল–বোট এক্সপ্রেস। আমি ওটা থেকে নেমেছি।
কুলিটি বললো-বোট এক্সপ্রেস লণ্ডনের আগে কোথাও থামে না।
কিন্তু থেমেছিল–জোর দিয়ে বলে লিউক–আমি এখানে নামলাম।
একই উত্তর দিলো কুলিটিলণ্ডনের আগে কোথাও থামে না।
আমি বলছি থেমেছিল।
কুলিটি এবার বললো–আপনার এখানে নামা উচিত হয়নি। ও ট্রেনের এখানে থামার কথা নয়।
তোমার মত অত সূক্ষ্ম বুদ্ধি আমার নেই। সে যাই হোক, কথা হচ্ছে এখন কী করি?
তখনও কুলিটি একই ভাবে বললো–আপনার এখানে নামাই উচিত হয়নি।
সে তো মানলাম। মহাজনেরা বলেছেন, যতই কাঁদ না কেন, মৃত অতীত আর ফিরে আসবে না–এ তো জানা কথা। তুমি আমায় কী করতে বলছো?
৪-২৫ মিনিটে একটা আছে, ওটাই আপনার পক্ষে ভালো হবে।
তা হলে ওতেই আমি লণ্ডন যাবো।
লিউক কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। একটা বড় বোর্ডে স্টেশনের নামটা লেখা-ফেনি ক্লেটন-উইচউড আণ্ডার অ্যাশ-এ যাবার জন্য এখানে ট্রেন বদল করুন। কিছুক্ষণ পরেই দুকামরার একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালো। ট্রেন থেকে দুসাতজন লোক নেমে ওভার ব্রিজ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে এলো।
শেষ পর্যন্ত লণ্ডনগামী ট্রেনখানি স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। তৃতীয় শ্রেণীর কামরাগুলোতে অত্যন্ত ভীড়। প্রথম শ্রেণীর জন্য মাত্র তিনখানি কামরা। প্রথম কামরাটি ধূমপায়ীদের জন্য সংরক্ষিত। সেই কামরাটি পেরিয়ে লিউক দ্বিতীয় কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই কামরায় বেশ কেতাদুরস্ত এক তরুণী বসে, দেখে মনে হলো যেন খুব ক্লান্ত। হয়তো মেয়েটি কোনো নার্সারীর গভর্নেস; কারণ, সঙ্গে তিনটি অল্প বয়সের চঞ্চল ছেলে। পরের কামরায় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে দেখেই লিউকের নিজের মিলড্রেড পিসিকে মনে পড়লো। মিলড্রেড পিসি দুনিয়ার অন্যান্য সব পিসিদের মতোই খুব ভালো ছিলেন। সেই কামরায় উঠে লিউক একটা জায়গা দেখে বসলো।
পাঁচ সাত মিনিট বাদেই ট্রেনটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। লিউক খবরের কাগজ খুলে আকর্ষণীয় সংবাদগুলোতে আবার চোখ বুলোতে আরম্ভ করলো।
কিন্তু লিউক ধরেই নিয়েছে যে, ও বেশিক্ষণ কাগজে মন দিয়ে থাকতে পারবে না। কারণ; ও এই পিসির জাতকে চেনে। ওর অনুমান যে কতখানি সত্যি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা প্রমাণিত হলো। ভদ্রমহিলা সামান্য একটা ছুতো ধরে একেবারে সরাসরি এই ট্রেনের প্রসঙ্গ আরম্ভ করলেন
মাত্র একঘণ্টা দশ মিনিটে আমরা লণ্ডনে পৌঁছে যাবো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকালের ট্রেনে ভীড় বেশি, কারণ এই ট্রেনে দিনের বেলাকার সস্তা টিকিট পাওয়া যায়। আমিও ভেবেছিলাম ঐ গাড়ীতেই যাবো, কিন্তু ওয়াঙ্কিপু–মানে আমার বেড়াল-আজ সকালে ওকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আর এই জন্যই তো সকালের ট্রেনে যেতে পারলাম না।
কোনোরকমে লিউক আস্তে আস্তে তা সত্যি বলেই আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়লো। কিন্তু তাতেও তার কথার প্রশমন হলো না।
আর এইজন্যই তো আমি সকাল বেলায় না গিয়ে বিকেলের গাড়িতেই যাওয়া ঠিক করলাম। যদিও প্রথম শ্রেণীতে কখনোই বেশি ভীড় হয় না। তা সত্ত্বেও আমি প্রথম শ্রেণীতে সাধারণতঃ যাতায়াত করি না। বুঝতেই তো পারছেন এত রকম করের বোঝা, বাড়িতে লোকজন দিয়ে কাজ করাতে গেলে তিনগুণ বেশি খরচা, অথচ আয়ের পরিমাণ কমে গেছে। যে ব্যাপারটার জন্য এখন আমি যাচ্ছি, সেটা খুবই একটা মারাত্মক ব্যাপার। তাই নিরিবিলিতে বসে একটু ভেবে নিতে চেয়েছিলাম যে পুরো ঘটনাটা বলতে গিয়ে ঠিক কীভাবে বক্তব্য রাখবো
এবার আর না হেসে লিউক পারলো না।
কিন্তু বুঝতে তো পারছেন প্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে যদি খানিকটা অতিরিক্ত খরচপত্র হয়েও যায় তা কিছু অন্যায় নয়। তবে আজকাল নোকজন বড় বেশি বাজে খরচ করে।
লিউকের মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন–যদিও আমি স্বীকার করি যে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের প্রথম শ্রেণীতেই যাওয়া উচিত।
লিউক দেখলো একরাশ কৌতূহল নিয়ে ভদ্রমহিলা লিউকের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি কী জানতে চান ও বুঝতে পারলো। ও বললো–আমি কিন্তু সৈনিক নই।
ওহো, আমি বুঝতেই পারিনি–মানে আপনার রংটা বেশ তামাটে কি না, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো পূর্বদেশ থেকে সদ্য ছুটিতে এসেছেন।
ওদেশ থেকে এসেছি ঠিকই, লিউক বলে–তবে ছুটিতে নয়, একেবারে দেশে ফিরে এলাম। আমি ওখানে পুলিশে চাকরি করতাম।
কী আশ্চর্য। আপনি পুলিশের লোক? আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ছেলে প্যালেস্টাইনে পুলিশবিভাগে মাত্র কদিন আগে যোগ দিয়েছে।
আমি ছিলাম মেয়াংস্ট্রেট-এ-লিউক বলল।
আমাদের একই কামরায় একসঙ্গে যাওয়াটা সত্যিই একটা অদ্ভুত যোগাযোগ।
শুধু লিউক বললো–সত্যিই? কিন্তু মনে মনে বললো-লণ্ডন পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই ভদ্রমহিলা ঘড়ির কাঁটার মতো অবিরাম চালিয়ে যাবেন না কি?–ওর মিলড্রেড পিসিও এমনটাই ছিলেন। পিসি ওর ছেলেবেলায় ওর দারুণ প্রয়োজনের সময় ওকে একবার একটা গোটা পাঁচ পাউণ্ডের নোট দিয়েছিলেন। ইংল্যাণ্ডের বাইরে বিদেশে থাকলে এই পিসিদের অভাব যতটা বোঝা যায়, দেশে থাকলে তেমনি এই পিসিদের মাধুর্য ততটা উপলব্ধি করা যায় না।
যাই হোক, তখনও ভদ্রমহিলা স্মিতমুখে তার কথা বলে চলেছেন–
যা বলছিলাম, মানে আমি আজ সকালেই যাব বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি যে আমি ওয়াঙ্কিপুর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় আমি যখন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পৌঁছব, তখন ওঁদের ছুটি হয়ে যাবে? অর্থাৎ ওঁদের কি কোনো বিশেষ সময় নির্দেশ আছে?
জবাবে লিউক বললো–আমার মনে হয় না ওঁরা কোনো বাঁধা ধরা সময় মেনে চলেন।
সে তো নয়ই। মনে করুন, খুন-জখম, চুরি-বাটপাড়ি ইত্যাদি অপরাধগুলো তো আর সময় মেপে হয় না?
লিউক বললো–সেই তো! ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের জন্য চুপ রইলেন। খানিকবাদে আবার বলতে আরম্ভ করলেন।
আমার সব সময় মনে হয় যে একেবারে উৎস মুখে গিয়ে সন্ধান করা ভালো। জন রীড এমনিতে খুব ভালো লোক, কিন্তু কি জানেন, আমার ধারণা কোনো জটিল অপরাধের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই। ধারণাই বা বলছি কেন, আমার স্থির বিশ্বাস খুনের কিনারা করার ক্ষমতা ওর নেই।
খুন?–লিউক প্রশ্ন করলো।
উত্তরে ভদ্রমহিলা বললো–হ্যাঁ, খুন। আমি বুঝতে পারছি আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন। আমিও প্রথমটায় হয়েছিলাম; এমন কি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারিনি। ভেবেছিলাম সবই আমার কল্পনা।
লিউক জিজ্ঞেস করে–আপনি ঠিক জানেন তো যে, এ আপনার কল্পনা নয়?
ভদ্রমহিলা জোর দিয়ে বললেন– কক্ষনো না। একটা হলে হয়তো তাই ভাবতাম, কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ–এতগুলো দেখবার পর আমি নিশ্চিত।
লিউক প্রশ্ন করলো-আপনি কি বলতে চান এতগুলো খুন সত্যিই হয়েছে?
বেশ কয়েকটা; আর সেই জন্যই তো ভাবলাম যে সোজা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে গিয়ে তাঁদের কাছে সব খুলে বলি।
মনে মনে লিউক ভাবলো যে, ইয়ার্ডের লোকজন ঠিক জানে কেমন আচরণ করতে হবে এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। এই বুড়ীদের ঘটনাপঞ্জী শোনবার জন্য হয়তো বা ইয়ার্ডে একটা আলাদা বিভাগই আছে।
লিউক ভাবছিলো, আশ্চর্য! কেন যে এঁদের এমন সব আজ খেয়াল হয়। হয়তো নীরস গ্রাম্য জীবনের একঘেয়েমী–একটা কিছু নাটকীয় করার ইচ্ছা। শোনা যায়, কোনো কোনো বৃদ্ধা এমনও ভাবেন যে, এ বিশ্ব-সংসারে সবাই মিলে তাদের খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। লিউকের তগতভাবে বাধা পড়লো ভদ্রমহিলার গলার শান্ত স্বরে–
জানেন, আমি একবার একটা বইতে পড়েছিলাম–আবার ক্রোম্বি কেস–অবশ্য সেই লোকটাকে সন্দেহ করার আগেই সে বেশ কয়েকজনকে বিষ খাইয়েছিলো। যাকগে, ও হ্যাঁ, কে একজন বলেছিল যে সেই লোকটা যার দিকেই চাইতো–মানে বিশেষভাবে চাইতো, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়তো। আমি গল্পটি পড়ে বিশ্বাস করিনি–কিন্তু এখন দেখছি এমন ঘটনা বাস্তবেও সম্ভব।
কী?
চোখের বিশেষ দৃষ্টি।
ভদ্রমহিলার দিকে লিউক তাকালো। মনে হল, কে যেন ওঁর মুখের গোলাপী রঙের অনেকটা শুষে নিয়েছে।
মহিলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন।
এই যাঃ, আমরা যে এসে গেলাম। বলেই অস্থির হয়ে উঠলেন। ছাতাটা তুলে নিতে গিয়ে দুএকবার হাত থেকে পড়ে গেলে লিউক ছাতাটা তুলে হাতে দিলো।
আপনাকে ধন্যবাদ; আপনি বড় ভালো লোক। আমার কৃতজ্ঞতা রইল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইয়ার্ডের লোকেরা আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে।আবার আন্তরিকতার সুর লিউকের গলায়।
আমার নাম পিঙ্কারটন।
লিউক মৃদু হেসে বলল, খুব উপযুক্ত নাম। সঙ্গে সঙ্গে লিউক বলল–আমার নাম লিউক ফিস্ উইলিয়াম্।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াতেই লিউক বললো–আপনাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবো?
না, না, অনেক ধন্যবাদ।
আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে চলি?
অন্তরঙ্গভাবে ভদ্রমহিলা লিউকের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন–জানেন, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাসই করবেন না।
লিউক এবার লজ্জা পায়–এতগুলো খুন করা তো আর সোজা কথা নয়! খুবই কঠিন।
উনি বললেন-যদি সবার সন্দেহের বাইরে থাকা যায়, তবে খুন করা খুবই সহজ। যে খুনীর কথা বললাম, সে এমনই একজন যাকে কেউ সন্দেহই করবে না।
তা হতে পারে। নমস্কার।–বিদায় জানায় লিউক।
ভীড়ের মধ্যে মিস পিঙ্কারটন হারিয়ে গেলেন। লিউক নিজের মনে ভাবলো–একটু কি ছিটগ্রস্তা? কিন্তু তাও তো মনে হল না। কিন্তু সে যাই হোক, মহিলার স্বভাবটি বড় সুন্দর।
***
শোক-সংবাদ
লিউকের সবচেয়ে পুরনো বন্ধু জিমি লরিমার। লণ্ডনে এলেই ও জিমির কাছেই থাকে। এবারও ও জিমির বাড়িতেই উঠেছে। পরদিন সকাল বেলায় এককাপ কফি নিয়ে খবরের কাগজটার মধ্যে ডুবে গেল। ওর কানেই যাচ্ছিল না জিমির কথা। হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে যেন সচেতন হলো।
দুঃখিত জিমি–বল, কী বলছিলে?
কী পড়ছিলে অত মন দিয়ে?
লিউক বললো–গতকাল এক বৃদ্ধা একই ট্রেনে আমার সঙ্গে এসেছিলেন–উনি গাড়ি চাপা পড়েছেন।
ভারী বিশ্রী ব্যাপার।–জিমি বললো।
হা, বেশ ভালো মহিলা। ওঁকে দেখেই আমার মিলড্রেড পিসির কথা মনে হয়েছিলো।
যে গাড়ি চালাচ্ছিল, সে এর জন্য দায়ী। তাকে হয়তো খুনের দায়ে ফেলা যাবে না। আমি তো লণ্ডনে গাড়ি চালাতে গেলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি।
তোমার এখন কী গাড়ি?
ফোর্ড, ভি, ৮। তোমায় আমি বলছি
জিমি আলোচনায় বাধা দিয়ে বলে ওঠে–তুমি তখন থেকে গুগুন্ করে কী বলছো বলতো?
লিউক নিজের মনে আবৃত্তি করছিলো–
Fiddle de dee, fiddle de dee.
The fly has married the humble bee.
জিমি জিজ্ঞেস করলো ওর দিকে তাকিয়ে–কী হয়েছে?
লিউক মাথা তুলে কেমন যেন এক অদ্ভূতদৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকাতে জিমি একটু ঘাবড়ে গেল।কী হলো লিউক? তোমায় দেখে মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখছো?
লিউক বললো–জিমি, শোন জিমি, তোমার কি মনে পড়ে আমার ইংল্যাণ্ডে আসার দিন একজন বৃদ্ধা মহিলার কথা তোমায় বলেছিলাম, যিনি আমার সঙ্গে একই ট্রেনে এসেছিলেন?
সেই যিনি চাপা পড়ে মারা গেলেন?
হ্যাঁ, সেই। শোন জিমি, এই ভদ্রমহিলা পরপর অনেকগুলো খুনের এক অদ্ভুত গল্প বলার জন্য স্টকল্যাণ্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছিলেন।
তুমি তো বলোনি আমায় যে ভদ্রমহিলার মাথায় একটু ছিট ছিলো।–জিমি বললো।
আমার মনে হয়নি যে, উনি সে ধরনের ছিলেন।
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে–বলল, বলে যাও।
বুঝলে, ভদ্রমহিলা পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ঘটনার সত্যাসত্য স্থির করেছিলেন। যারা খুন হয়েছে তাদের দুএকজনের নামও বলেছিলেন।
জিমি এবার উৎসাহিত হয়ে বলে–আচ্ছা?
লিউক বলে যায়–এই আম্বলবি নামটা আমার মনে ছিলো, কারণ ছেলেবেলায় পড়া বাচ্চাদের এই ছড়াটা আমার মনে ছিলো–
Fiddle de dee, fiddle de dee.
The fly has married the humble bee.
তুমি নিঃসন্দেহে মেধাবী–কিন্তু কী বলতে চাইছো?
আমায় সেই মহিলাটি বলেছিলেন যে, ডাঃ আম্বলবিই হচ্ছেন পরবর্তী শিকার। ভদ্রলোক নাকি খুবই সজ্জন এবং এই জন্যই সেই বৃদ্ধা আরও চিন্তিত ছিলেন।
তারপর?
এই দেখ কাগজটা।–লিউক খবরের কাগজটা দিতেই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে–আম্বলবি : ১৩ইজুন, নিজগৃহ, সানগেট, উইচউড আণ্ডার অ্যাশ, আকস্মিক মৃত্যু। জন এডওয়ার্ড আম্বলবি, এম. ডি., জেসমী রোজ আম্বলবির স্বামী। আগামী শুক্রবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
–দেখছ জিমি? এ থেকে তুমি কি বুঝলে?
অদ্ভুত কাণ্ড! কিন্তু আমার মনে হয় এটা একই সময়ে দুটো ঘটনা ঘটার এক আশ্চর্য নমুনা মাত্র।
এই ঘটনাটা কি শুধুই তাই?–লিউক আবার পায়চারি আরম্ভ করে।
লিউক হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়। ধর সেই বিচিত্র ভদ্রমহিলার সব কথা যদি সত্যি হয়?
এ তুমি বাড়াবাড়ি করছে। এ তো পুলিসওয়ালার মতো কথা।
হয়তো ঠিকই বলেছো। একবারে যে পুলিশ হয়, সে চিরকালই পুলিশ থেকে যায়। আবার ক্রোম্বি যেভাবে দিনের পর দিন সবার নাকের ডগা দিয়ে একটার পর একটা খুন করে যাচ্ছিলো, সেই ঘটনা যদি একবার অজ্ঞাত কুলশীলা বৃদ্ধা মহিলা টের পেয়ে প্রতিকারের জন্য কাউকে বলেন, তাহলে তার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
হেসে জিমি বলে–তা কেউ করবে না।
তবে? ভেবে দেখ, যাকেই তিনি বলবেন, সেই বলবে ওঁর মাথা খারাপ। কিন্তু আমি বলছি জিমি, এ ব্যাপারটাকে এভাবে দেখলে ভুল হবে। সত্যকে হাত চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা অন্যায়।
জিমি বললো–তাহলে ব্যাপারটা তোমার মতে কী দাঁড়াচ্ছে?
ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুর গল্পটা একেবারে আজব নয়। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, মিস পিঙ্কারটন এই অবাস্তব ঘটনা বলতে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে যাচ্ছিলেন প্রতিকারের আশায়। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। আগেই তিনি গাড়ির চাকায় প্রাণ দিলেন এবং গাড়িটা চাপা দিয়ে পালিয়ে গেল।
প্রতিবাদ করে জিমি বললো–কিন্তু তুমি তো জান না যে উনি ইয়ার্ডে পৌঁছতে পেরেছিলেন কিনা?
তা হয়তো হতে পারে, কিন্তু আমার ধারণা মহিলা ইয়ার্ডে যেতে পারেননি।
এ তোমার নিছক অনুমান। মাথা ঝাঁকিয়ে লিউক বললো-না, আমার মোট বক্তব্য–ব্যাপারটার একটা অনুসন্ধান হওয়া উচিত।
তাহলে তুমি কী বলতে চাইছো?
আমার মতে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করাই হবে সবচেয়ে ভালো।
লিউকের দিকে তাকিয়ে জিমি বলে–আচ্ছা লিউক, তুমি কি সত্যিই এ ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছ?
পুরোপুরি।
কিন্তু যদি এমন হয় যে সমস্ত ব্যাপারটাই এক অলীক কল্পনাবিলাস?
তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
গম্ভীর হয়ে জিমি বললো–কোনো পথে এগোবে কিছু ঠিক করেছো? সে জায়গায় যেতে হলে তোমায় একটা কারণ দেখাতে হবে?
তা হয়তো হবে।
কোনো হয়তো এখানে খাটবে না। নতুন কেউ গ্রামে এলে ওরা অনেকদূর থেকেই টের পেয়ে যায়।
লিউক জবাব দেয়–ছদ্মবেশই নিতে হবে। বলতো, কোনো বেশ নেওয়া যায়? চিত্রকর?
তখনও লিউক কিন্তু তার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছিলো।
আচ্ছা, যদি একজন লেখক সাজি, বা জেলে সেজে যাই? এ-ও যদি না হয় অন্ততঃ অন্ধ বা খোঁড়া সেজে যেতে পারি? আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। কিন্তু জিমি, কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে যার সাহায্যে একজন অচেনা-অজানা লোক কিছুদিনের জন্য গ্রামে গিয়ে থাকতে পারে।
এক মিনিট দাঁড়াও–কাগজটার ওপর খানিকক্ষণ চোখ বুলিয়ে বলে উঠল-হা, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। শোনো লিউক, সব সমস্যার সুরাহা। আমি তোমার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
কী ব্যাপার?
জিমি বললো-প্রথম থেকেই ভাবছিলাম নামটা চেনা–উইচউড-আণ্ডার অ্যাশ-হ্যাঁ, এই জায়গাটাই তো! ওখানে আমার এক আত্মীয় থাকে।
সত্যিই জিমি, তুমি একটি আসল রতন।
বেশ ভালো হল, না?
যাই হোক, তোমার সেই আত্মীয়ের পরিচয়টা দাও।
ওর নাম ব্রিজেট কনওয়ে। বছর দুয়েক হল ও ওখানে লর্ড হুইটফিল্ডের সেক্রেটারীর কাজ করছে।
সেই লোকটা–যার কতকগুলো বাজে সাপ্তাহিক কাগজ আছে?
ঠিকই ধরেছে।
আর তোমার সেই বোন ওর সেক্রেটারী?
আগে ছিল। এখন ওর স্থান আরও উঁচুতেও হুইটফিল্ডের বাগদত্তা।
লিউক বললো-ও।
জিমি বললো-তুমি ওখানে গিয়ে সম্পর্কে ব্রিজেটের এক ভাই হয়ে থাকবে। আমি ওকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু তুমি যে কারণে ওখানে যাবে, সেটা হচ্ছে ডাইনীবিদ্যা, বুঝেছো?
ডাইনীবিদ্যা? সে আবার কী?
অর্থাৎ, স্থানীয় ছড়া, কুসংস্কার–এই সব আর কি। উইচউড এই সব ব্যাপারে বেশ বিখ্যাত। ও এমন একটা জায়গা, যেখানে গত শতাব্দী পর্যন্ত ডাইনীদের ধরে পুড়িয়ে মারা হত। তুমি ওখানে যাচ্ছ এই সব ধারাবাহিকতা নিয়ে একটা বই লিখতে। সুতরাং, তোমায় কেউ সন্দেহ পর্যন্ত করবে না।
কিন্তু লর্ড হুইটফিল্ড?
ও কোনো অসুবিধা করবে না। তাছাড়া, ব্রিজেট ওকে মানিয়ে নেবে। আমি ওর হয়ে তোমায় কথা দিতে পারি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে লিউক বললো–জিমি, তুমি একজন সত্যিকারের করিৎকর্মা লোক। তুমি যদি তোমার সেই বোনের সঙ্গে আমার ব্যবস্থা করে দিতে পারো
সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে–তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।
আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।
জিমি বললো–প্রতিদানে শুধু একটা জিনিসই আমি চাই–তোমার সিদ্ধি যদি হয় হন্তার সার্থক সন্ধানে, আমার সাফল্য আসুক মৃত্যুকে খুঁজে বের করার মধ্যে প্রতিদানে এই হলো আমার যাচা।
লিউক বললো–সেই বৃদ্ধা মহিলাকে আমি বলেছিলাম যে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে এতগুলো খুন করা খুবই কঠিন। উনি বলেছিলেন যে, আমার ধারণা ভুল-খুন করা খুবই সহজ।
আচ্ছা, খুন করা কী অতি সহজ?
***
ঝাঁটা-বিহীন ডাইনী
একটা পুরানো স্ট্যাণ্ডার্ড সোয়ালো গাড়ি চালিয়ে লিউক উইচউড–আণ্ডার অ্যাশে এসে পৌঁছলো। গ্রামে ঢুকতেই পাহাড়ি রাস্তাটার একটা ঢালু জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য গাড়িটা থামালো।
লিউক দেখলো সামনে উইচউড গ্রাম সমাহিত আর স্থির হয়ে আছে। গ্রামটিকে আধুনিক যন্ত্র যুগের কলুষতা স্পর্শ করতে পারেনি। লিউকের মনে হচ্ছিলো, ও যেন পৃথিবীর এক সুদূর নির্মল প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে।
চিন্তায় পড়লো লিউক। ভাবলোনাঃ, এমন ঘটনা এখানে ঘটতে পারে না-না কি ঘটতেও পারে?
গাড়িতে চাবি দিয়ে সেই আঁকা-বাঁকা পথ ধরে বড় রাস্তায় এসে পড়ল। রাস্তার দুধারে দোকান-পসার, পুরানো বনেদী ঘর-বাড়ি। রাস্তা থেকে একটু এগিয়ে বে-মোটুলি নামে একটা হোটেল পড়ে। তাছাড়া আছে সবুজ মাঠ এবং পুকুর। আর আছে যাদুঘর এবং পাঠাগার। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে সামনে সাদা রঙের বেশ বড় একটা আধুনিক বাড়ি পেলো। ওটা স্থানীয় যুবকদের একটা ক্লাব।
সেখান থেকে জানতে পারলো যে, আরও আধমাইল গেলে অ্যাশম্যানব পাওয়া যাবে। গাড়িটা নিয়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ লিউকের চোখে পড়লো, এক দুর্গের ভেতর থেকে একটি তরুণী বেরিয়ে এলো। মেয়েটির মাথায় গুচ্ছ-গুচ্ছ কালো চুলের ঢেউ। মেয়েটিকে দেখে ডাইনী ছবিটা মনে পড়লো।
তন্বীতরুণী মেয়েটি সোজা ওর দিকে এগিয়ে ওকে বললো–আপনিই লিউক ফিৎস উইলিয়াম? আমি ব্রিজেট কনওয়ে।
ওর সঙ্গে লিউক করমর্দন করলো। লিউক মেয়েটিকে যে ডাইনী ভেবেছিলো মেয়েটি মোটেই তা নয়।
আপনার ওপর এভাবে চড়াও হবার জন্য খুবই লজ্জিত কিন্তু জিমি বললো যে, আপনি কিছু মনে করবেন না।
না, না, বরং আপনি এসেছেন বলে খুশীই হয়েছি। ব্রিজেট জবাব দিলো। আরও বললো–জিমির আর আমার কখনও মতের অমিল হয় না। তাছাড়া দেখবার মতো সুন্দর জায়গাও এখানে আছে।
অপূর্ব।
বাড়ির দিকে ওরা দুজনে এগোয়। ওর মনে পড়ে, জিমি বলেছিলো যে, বাড়িটা প্রথমে ব্রিজেটের পূর্বপুরুষদের ছিলো।
লিউক, আন্দাজ করলো ২৮/২৯ বয়স ব্রিজেটের হবে।
বাড়ির ভেতরে ওরা ঢুকলো। দুজন লোক ঘরে বসে কথা বলছিলো। ব্রিজেট আলাপ করিয়ে দিয়ে বললো–গর্ডন, ইনি আমার দূর-সম্পর্কের এক ভাই।
লর্ড হুইটফিল্ড দেখতে ছোটোখাটো, মাথায় চকচকে টাক। পোশাকে-আশাকে কিছুটা গ্রাম্য অগোছালো ভাব। যাই হোক, তিনি লিউককে আন্তরিকতার সঙ্গেই স্বাগত জানালেন। তারপর লর্ড হুইটফিল্ড তাঁর চেয়ারে বসে ছিপ ছিপ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে লিউককে যেন পরিমাপ করেছিলেন।
আপনি তাহলে বই লেখেন?
এই প্রশ্নে লিউক একটু ঘাবড়ে গেল।
বেশ আত্মতুষ্ট স্বরে বললেন লর্ড-আমি প্রায়ই ভাবি যে আমি নিজেই একখানা বই লিখবো।
আচ্ছা?–জবাব দেয় লিউক।
ঠাট্টা নয়, আমি এত বিচিত্র ধরনের লোকজন দেখেছি যে তাদের নিয়ে খুবই মনোজ্ঞ একটা বই লিখতে পারি।
সে তো ঠিকই, লিউকের জবাব।
ব্রিজেট বললো–তোমার সঙ্গে কার কথা? তুমি তো মহৎ লোক। নাও আর একটু চা খাও।
লর্ড লিউককে জিজ্ঞেস করলেন–তা, এই অঞ্চলের কারুর সঙ্গে আলাপ পরিচয় আছে?
লিউক বললো, না নেই–তবে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে শুধু একটু দেখা করবার আছে। ভদ্রলোক আমার এক বন্ধুর বন্ধু। নাম—আম্বলবি–ডাঃ আম্বলবি।
লর্ড হুইটফিল্ড বললো–ডাঃ আম্বলবির সঙ্গে দেখা করবেন? খুবই পরিতাপের বিষয়।
কেন? পরিতাপ করার মত কী বললাম?
এই তো, সপ্তাহখানেক হলো ভদ্রলোক মারা গেছেন।
লিউক বলে,–আহা, তা হলে তো সত্যিই দুঃখের ব্যাপার।
লিউক কিছুটা আন্দাজের সঙ্গে বলল–ডাঃ আম্বলবি একজন স্পষ্ট বক্তা ছিলেন তাই না? এবং তার ফলে নিশ্চয়ই ওঁর অনেক শত্রু ছিলো?
না, না, সে কথা ঠিক বলা যায় না। ব্রিজেট, কী বল? –লর্ড হুইটফিল্ড বললেন।
ব্রিজেট বলে–আমার তো ধারণা উনি বেশ জনপ্রিয় লোকই ছিলেন। আমার তো মনে হয় যে, ভদ্রলোক একজন অমায়িক লোক।
ব্রিজেটের কথা লর্ড স্বীকার করে বলেন–তা ঠিক, ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় ছিলেন–তবে ওঁর মত আরও দুএকজন লোককে আমি জানি, তারাও ওঁরই মতো মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন। প্রশ্ন করে লিউক–সেই দুএকজন কি এই গ্রামেই বাস করেন?
লর্ড বললেন–হ্যাঁ, এই গ্রামেই।
একটু ইতঃস্তত করে লিউক বললো–আচ্ছা, এখানে কী ধরনের লোক সবচেয়ে বেশি বাস করে?
ব্রিজেট বললো–বেশির ভাগই সেকেলে লোক–গীর্জার মত পাদ্রী আর তাঁদের যত স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন, ডাক্তারদের বেলাতেও তাই।
উত্তর শুনে লিউক ঘাবড়ে যায়–কিছু পুরুষ মানুষও নিশ্চয়ই আছে?
তা আছে। তবে মাত্র কয়েকজন। মিঃ অ্যাবট–উকিল; ডাঃ আম্বলবি; মিঃ ওয়েকবেস্টর আর মিঃ এলওয়ার্দি-দারুণ ভালো লোক। এছাড়া আছেন মেজর হর্টন আর তার একপাল কুকুর।
লিউক বললো–আমার বন্ধুরা বলেছিলো যে, এখানে তাদের চেনা একজন মহিলা বাস করেন?
ব্রিজেট হেসে ওঠে–হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পিঙ্কারটন।
লর্ড বললো–সত্যিই আপনার কপালটা নিতান্তই খারাপ। সেই ভদ্রমহিলাও মারা গেছেন।
হাল্কা স্বরে লিউক বলে–আপনাদের এখানে দেখছি মৃত্যুর হার বড্ড বেশি।
লর্ড প্রতিবাদ করে ওঠেন–একথা মোটেই সত্য নয়। দুর্ঘটনা সব জায়গাতেই হতে পারে।
লিউক বলে,-ডাঃ আম্বলবিও কি দুর্ঘটনায় মারা যান?
লর্ড বলেন–না, ওঁর হাতে খুব বিষাক্ত ঘা হয়েছিল, কোনো পেরেকে বা ঐ জাতীয় কিছুতে হয়তো হাতে খোঁচা লেগেছিলো এবং ডাক্তারদের যা হয়ে থাকে–প্রথমে খেয়ালই করেননি, ফলে সেই সামান্য ছড়ে যাওয়া থেকে বিশ্রী রকমের ঘা হয়ে গেল আর তাতেই কদিনের মধ্যে ভদ্রলোক মারা গেলেন।
নিয়তির বিধান অলঘ্য।-লর্ড সহজ গলায় বলেন।
.
নিজের ঘরে গিয়ে রাতের পোষাক পরতে পরতে লিউক নিজের মনে বলতে লাগল–সত্যিই কি নিয়তির বিধান? বিষাক্ত ঘা? হয়তো তাই, কিন্তু মৃত্যুটা বড়ই আকস্মিক!–কানে ভাসছিলো ব্রিজেটের কথাগুলো–গত এক বছরে এখানে বেশ কিছু লোক মারা গেছে।
***
লিউকের প্রথম পদক্ষেপ লিউক নিজের পরিকল্পনা গুছিয়ে নিয়ে পরদিন সকালে একেবারে তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে এলো।
টেবিলে লর্ড ও ব্রিজেটকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিউক ডিম আর বেকনের একটা ডিস্ টেনে নিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। খেতে খেতে ও বললো
বুঝলেন, আর সময় নষ্ট না করে এবার আমার যে জন্য এখানে আসা সে কাজে হাত দেওয়াই উচিত। মুশকিল হচ্ছে লোকজনকে দিয়ে কথা বলানো। সবাই তো আর আপনাদের মতো নয়? আপনারা যেটুকু জানেন সবই গুছিয়ে বলবেন। কিন্তু এই সমস্ত গ্রাম্য কুসংস্কার আপনারা কতটুকুই বা জানেন–অথচ আমার আবার সেগুলোই প্রয়োজন।
লর্ড হুইটফিল্ড বললেন–এইসব ঘটনা অদ্ভুত হলেও সত্যি। শিক্ষা-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ না হলে এর হাত থেকে নিস্তার নেই। আপনাকে বলাই হয়নি, আমি এই গাঁয়ে চমৎকার একটা পাঠাগার তৈরি করেছি।
লিউক বললো–খুবই ভালো কাজ করেছেন। আপনি বুদ্ধিমান লোক; নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলি নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকলে মানুষের মোহমুক্তির কোনো আশাই নেই।
এই প্রসঙ্গে লিউক বক্তৃতা দিয়েছিলো, তার কিয়দংশের হুবহু বর্ণনা দেওয়া হলো—
মৃত্যু হচ্ছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গল্পগুলোর প্রধান উৎপত্তিস্থল। কবর দেওয়ার রীতি-নীতি, আচার-বিচার নিয়ে যে কত রকমের কিংবদন্তী আছে! তাছাড়া দেখা গেছে যে, যে কোনো কারণেই তোক গ্রামের লোকেরা মৃত্যু নিয়েই সবচেয়ে বেশি গল্প গুজব করে।
ব্রিজেট বললো–এরা সব সময়ে মানুষের শেষকৃত্বের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়।
লিউক বলে–আমি তো ভেবেছি যে ওখান থেকেই আমি আরম্ভ করবো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের সম্পর্কে যদি আপনাদের চার্চ থেকে একটা মোটামুটি হিসেব পাই, তাহলে যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করবো। আচ্ছা, কাকে দিয়ে আরম্ভ করা যায় বলুন তো? আপনাদের এখানকার পাদ্রীকে দিয়ে?
ব্রিজেট বলে মিঃ ওয়েক অবশ্য এসব ব্যাপারে খুবই উপযুক্ত লোক। উনি আপনাকে অনেক কিছুই বলতে পারেন।
লিউক কিছুক্ষণ চুপ করে বলল–এতো খুব ভালো কথা। আচ্ছা, গত এক বছরের মধ্যে কে বা কারা মারা গেল বলতে পারেন?
ব্রিজেট বললো–প্রথমে গেল কার্টার। ঐ নদীর পারে যে বাড়িতে ছোটো একটা মদের দোকান আছে, সেই বাড়ির মালিক। তারপর মিসেস রোজ, ধোপানী; তারপর গেল টমি পিয়ার্স। এরপর একটি মেয়ে–অ্যামি।
অ্যামি?–পাল্টা প্রশ্ন লিউকের।
অ্যামি গিবস্ এখানে পরিচারিকার কাজ করতো। ওর মৃত্যুতে একটা তদন্ত হয়েছিলো।
কেন?
মেয়েটা অন্ধকারে ওষুধের বদলে কি একটা বিষ খেয়েছিলো।-লর্ড হুইটফিল্ড বললো।
ব্রিজেট বললো–মাথার টুপি রং করবার একটা বোতল রং ছিলো ওর ঘরে। ভুলে রঙের বোতলকে ওষুধের বোতল মনে করে রং খেয়েছিলো।
লিউক বললো–বিশ্রী কাণ্ড তো!
মনে পড়লো লিউকের অ্যামি গিবস?–হ্যাঁ মিস পিঙ্কারটন এ নামও উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া টমি নামে একটি ছোটো ছেলের বিষয়েও বলেছিলেন। এখন পরিষ্কার ওর মনে পড়লো উনি কার্টারের নামও করেছিলেন। বেশ সচেতন গলায় ও বললো–
এইভাবে একই প্রসঙ্গে কথা বলতে নিজেকে বড় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। যেন আমি নিজেই একজন কবরের প্রার্থী। কিন্তু এই নিয়ে লোকজনের কাছ থেকে কথা বের করা বেশ শক্ত।
ব্রিজেট বললো–আমারও তাই মনে হয়।
লিউক বললো–অন্যের ক্ষতিসাধনের চিন্তা যারা করে, তাদের নিয়েও কিন্তু নানা উপকথা প্রচলিত আছে। এখানে ও ধরনের কোনো প্রচলিত গল্প-টল্প আছে নাকি?
লর্ড ও ব্রিজেট বললেন না।
ব্রিজেটের কথার সূত্র ধরে লিউক বললো–সেটা না থাকবারই কথা। আমি প্রথমে চার্চ থেকে আরম্ভ করবো। তারপর যাবো, সেই সেভেন স্টার না কি একটা নাম বললেন সেই মদের দোকানটার আড্ডায়। আচ্ছা, যে বিচ্ছু স্বভাবের ছেলেটি মারা গেল ওর কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে?
মিসেস পিয়ার্সের একটা সিগারেটের দোকান আছে হাইস্ক্রীটে।
লিউক বললো–আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।
যদি আপত্তি না থাকে, আমি সঙ্গে যাবো।–ব্রিজেট বললো।
নিশ্চয়ই।কিন্তু লিউকের মনে হলো যে, এই কৃত্রিমতা হয়তো বা ব্রিজেটের কাছে ধরা পড়েছে–তাহলে কিন্তু বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে।
যাকগে, একটু বেশি সতর্ক হয়ে কথা বললেই হবে।–নিজেকে সাবধান করে লিউক।
আমি তৈরি। চলো।–নিঃশব্দে ওর পেছনে ব্রিজেট কখন যেন দাঁড়িয়েছে–এতক্ষণ ওর উপস্থিতিটা ও টেরই পায়নি।
ব্রিজেট বললো–তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে দেবার জন্যই আমার আসা।
লিউক জবাব দেয়-আমার খুব উপকার করলে।
পেছন ফিরে ও সেই দুর্গ-আকারের বাড়িটা একবার দেখে নিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো–কী একটা বীভৎস কাণ্ড। কেউ কি ওঁকে থামাতে পর্যন্ত পারেনি?
ব্রিজেট বললো–প্রতিটি ইংরেজ পুরুষই তার বাড়িটাকে দুর্গ ভাবে। ও বাড়িটাকে দারুণ ভালোবাসে।
উত্তর দেয় লিউক–ঠিকই বলেছো। আমার নাটুকে কথায় আমি লজ্জিত। আমায় ক্ষমা করো।
মিনিট পাঁচেক যাবার পর ওরা চার্চে এসে পৌঁছলো। চার্চের সংলগ্ন পাদ্রীর বাড়ি। অ্যা
লফ্রেড ওয়েক ছোটোখাটো একজন বয়স্ক লোক, মাথায় সুবিশাল টাক।
আলাপ করিয়ে দেয় ব্রিজেট–মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, আমাদের সঙ্গে অ্যাশম্যানরে আছেন। উনি একটা বই লিখছেন, আর সেই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে এসেছেন।
মিঃ ওয়েক উত্থাপিত প্রসঙ্গে বিশেষ উৎসাহী নন। রোমের পুরাতত্ত্বে ওঁর আগ্রহ। ভদ্রলোক বিনীত স্বরে স্বীকার করলেন যে, ডাইনীতত্ত্বে বা গ্রাম্য ছড়া ইত্যাদি বিষয়ে ওঁর জ্ঞান খুবই সামান্য। তবে উইচউডের কিছু প্রামাণ্য ইতিহাস বললেন।
লিউক খুব হতাশ ভাব দেখিয়ে ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে মৃত্যুর প্রাক্-মুহূর্তে যে সব গালগল্প প্রচলিত তাই উত্থাপন করলো।
এই প্রসঙ্গেও মিঃ ওয়েক তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন–মৃত্যুকালীন ভৌতিক অস্তিত্ব যদি বা কিছু থাকেও–সেই সম্পর্কিত গল্প-গাঁথা স্বাভাবিক কারণেই কেউ আমাকে বলবে না–এটা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন?
তা অবশ্য ঠিক।
এবার লিউক অকুতোভয়ে বললো–আমি মিস কনওয়েকে বলেছিলাম যে, আপনাদের এখানে যারা সম্প্রতি মারা গেছেন তাদের নামের একটা তালিকা পেলে আমার কাজের খুব সুবিধে হতো। আপনি যদি তেমন একটা কিছু দিতে পারেন তবে তার থেকে বিচার করে আমি কাজ আরম্ভ করে দিতাম।
আমাদের এই চার্চের কর্মী গাই এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারতো, তবে ও কানে শুনতে পায় না। তাছাড়া, বেশ কিছু সংখ্যক দুর্ঘটনাও কয়েকটা প্রাণ নিয়েছে। আমাদের এই গ্রামটার খুবই দুঃসময় চলছে।
লিউক বললো–কেউ কেউ বলে যে কখনো কখনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতির ফলে দুঃসময় দেখা দেয়।
ঠিকই বলেছেন, জোনার সেই পুরাকথা। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো বাইরের লোক এসেছে বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, অল্প কয়েকদিন আগেই গেলেন দুজন। ডাঃ আম্বলবি আর ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন। ডাঃ আম্বলবি একজন সাচ্চা লোক ছিলেন–
শত্রুও নিশ্চয়ই ছিলো?–লিউক কথাটা বলেই যোগ করে–মানে, ওঁর বন্ধুদের কাছ থেকে যতটা শুনেছি তার ওপর নির্ভর করেই এ কথা বলছি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মিঃ ওয়েক।
ভদ্রলোক একেবারে মনখোলা মানুষ ছিলেন। স্থানীয় গরীব মানুষদের মধ্যে খুবই সুনাম ছিলো। তবে এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুর ফলে ওঁর পেশাগত অংশীদার ডাঃ টমাসের বহুলাংশেই সুবিধে হবে।
কী রকম?
আমার মনে হয় টমাস খুবই বুদ্ধিমান লোক–ডাঃ আম্বলবিও এই কথাই বলতেন। কিন্তু ওঁদের দুজনের মধ্যে খুব একটা সদ্ভাব ছিলো না। এ নিয়ে হয়তো টমাসের দুশ্চিন্তাও ছিলো। আর এই দুশ্চিন্তাই ওকে আরও দুর্বল করে ফেলতো। মুখ দিয়ে কথাই বের হতো না। এই মাত্র অল্প কদিনেই ওর আচরণে একটা আশ্চর্যরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। যেন, অনেক সতেজ হয়ে উঠেছে–ব্যক্তিত্বও বেড়েছে, একটা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক মতবাদে টমাসের খুব ঝোঁক আর আম্বলবির ছিলো পুরানো পদ্ধতির প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। এই নিয়ে এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছিলো। তা ছাড়া পারিবারিক ব্যাপার নিয়েও ঝগড়া হয়েছে।
লর্ড হুইটফিল্ড বলেছিলেন যে, ওঁর একরকম বিষাক্ত ঘা হয়েছিলো।
হ্যাঁ, সামান্য একটু ছড়ে গিয়েছিল মাত্র। সেটাই পরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ডাক্তাররা তাদের পেশার খাতিরে অনেক সময় নানা রকম মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে থাকে।
তা তো নয়ই।–জবাব দেয় লিউক।
হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন মিঃ ওয়েক–আমি কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আমরা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যত কুসংস্কার আছে, আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে এখানে যাদের মৃত্যু হয়েছে-এই নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলাম। ল্যাভিনিয়া পিঙ্কারটন–আমাদের চার্চের একজন সেবিকা ছিলেন। খুবই নিষ্ঠাবতী মহিলা। আর ছিলো সেই হতভাগী মেয়ে আমি গিব। ওর মৃত্যুর মধ্যে আপনি হয়তো কিছু খুঁজে পেলেও পেতে পারেন মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্ওঁর মৃত্যু আত্মহত্যা ঘটিত এমন কথা কেউ কেউ বলেছিলো আর এ ধরনের ঘটনায় ভৌতিক-সংস্কার থাকা বিচিত্র নয়।
মূল্যবান খবর দিলেন।–লিউক বলে।
এরপর গেল টমি পিয়ার্স–চার্চে যুগ্মসঙ্গীত করতো ছেলেটি। ছেলেটি ছিলো এক নম্বরের বিচ্ছু। শেষ পর্যন্ত ওকে চার্চ থেকে বিদায় করতে হয়েছিলো। আমরাও ওকে পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাম বিলি করার একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ও রাখতে পারলো না। ওর মার জন্য দুঃখ হয়–মহিলা যেমন পরিশ্রমী তেমনি ভালো মনের মানুষ। মিস ওয়েনফ্লিট ছোকরাকে লাইব্রেরির জানলা-দরজা পরিষ্কার করার একটা কাজ যোগাড় করে দিয়েছিলেন। লর্ড হুইটফিল্ড কিন্তু প্রথমটায় আপত্তি করেছিলেন–সেই বাড়িতে ঢুকতে দিতেই চাননি। অবশ্য পরে রাজী হয়ে গেলেন–কিন্তু রাজী না হলেই ভালো ছিল।
কেন?
ছেলেটা ওই কাজ করতে গিয়েই তো মারা গেল। একেবারে ওপরতলার জানলা পরিষ্কার করছিলো। হয়তো মাথা ঘুরে ওই উঁচু থেকে পড়ে যায়, আর তারপরেই ছেলেটি মারা যায়।
কৌতূহলী হয়ে লিউক বললো–আচ্ছা, ওকে কি কেউ পড়ে যেতে দেখেছিলো?
নাঃ, বাড়ির পেছনে বাগানের দিকটায় পড়েছিলো। মনে হয়, অন্ততঃ আধঘণ্টা ওখানে অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো।
প্রথম ওকে কে দেখে?
মিস পিঙ্কারটন। এই ভদ্রমহিলাও মাত্র কদিন আগে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলেন। টমি মারা যাবার দিন ইনি বাগানে এসেছিলেন কতকগুলো গাছের চারা নিতে। এসে দেখলেন এই কাণ্ড।
উনি নিশ্চয়ই খুব হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন?–লিউক বলে।
আপনি যতটা ভাবছেন, তার চেয়েও অনেক বেশি…
ব্রিজেট বলে–আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে মিঃ ওয়েক, ওর স্বভাবের মধ্যে একটা বিরক্তিকর নিষ্ঠুরতা ছিলো?
মিঃ ওয়েক বললেন–তা, আমি জানি মিস কনওয়ে কিন্তু ওর অল্প বুদ্ধিই তার জন্য দায়ী। এমন দেখা যায় যে, কোনো পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে শিশুর মস্তিষ্ক। তাদের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা বিরাজ করে, সে কথা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না।
ব্রিজেট বললো–আপনি ঠিক বলেছেন। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে শিশুর মস্তিষ্ক বোধহয় প্রকৃতির রাজ্যে দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দুর্ঘটনা..।
লিউকের মনে হলো যেন বিশেষ কারো কথা ভেবেই ব্রিজেট এ কথাগুলো বললো।
লিউক ফিৎস্ উইলিয়াম ভাবতে বসলো ব্রিজেট কাকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যটা করলো।
***
মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
মিঃ ওয়েক বললেন–দেখা যাক আর কার নাম মনে পড়ে-মিসেস রোজ, বেচারা বুড়ো বেল আর এলকি এবং হ্যারি কার্টারের বাচ্চা।
ব্রিজেট বললো-অ্যামি গিব মারা গেল এপ্রিলে।
হ্যাঁ, একটা ভুলের ফলে বেচারার প্রাণ গেল।
লিউক দেখলো যে ব্রিজেট একটু বিরক্ত হলো–অ্যামি গিবসের প্রসঙ্গ উঠলেই ব্রিজেটের ভাবান্তর হয়, অথচ তার কারণটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।
লিউক মিঃ ওয়েকের কাছে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে প্রশ্ন করে–ঠিক করে বলতো এই অ্যামি গিবস্ মেয়েটি কে?
লিউক উত্তরে লক্ষ্য করলো ওর গলায় যেন একটা বাধো বাধো স্বর–অ্যামি ছিলো বাড়ির পরিচারিকা। এত বড় অপদার্থ আমি দুটি দেখিনি।
এই জন্যই কি ওর চাকরিটা গিয়েছিলো?
না। ও মাঝরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়ির বাইরে একটি ছেলের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে। গর্ডন এ সমস্ত ব্যাপার পছন্দ করতো না। তাই ওকে নোটিশ দেয় আর এই নিয়ে অ্যামি প্রচণ্ড সোরগোল করে।
ওকি দেখতে ভালো ছিলো?–প্রশ্ন করে লিউক।
খুবই সুন্দরী।
ওই কি সেই টুপির রং খেয়েছিলো ওষুধ মনে করে?
হ্যাঁ।
ওর সত্যিই কি বুদ্ধি কম ছিলো?
মোটেই না, বরঞ্চ-বেশি মাত্রায় বুদ্ধিমতী ছিলো।
আড়চোখে লিউক ব্রিজেটের দিকে তাকালো। প্রতিটি কথায় উত্তর দিচ্ছিলো ব্রিজেট অত্যন্ত একঘেয়ে স্বরে। ওর কোনো উৎসাহ ছিলো না।
ইতিমধ্যে একজন লোক ব্রিজেটকে টুপি তুলে অভিবাদন জানালো। ব্রিজেট তার সঙ্গে লিউকের পরিচয় করিয়ে দিলো।
এ হচ্ছে আমার এক দূর-সম্পর্কের ভাই–মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। একটা বই লেখার জন্য এখানে এসেছে। আর ইনি হচ্ছেন মিঃ অ্যাবট।
ইনিই সেই উকিল, যিনি টমি পিয়ার্সকে চাকরি দিয়ে রেখেছিলেন। ভদ্রলোকের দিকে লিউক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো।
কী বই লিখছেন? উপন্যাস?
গণগাঁথা।–ব্রিজেট বলে।
তা হলে তো বেছে বেছে ভালো জায়গাই এসেছেন। খুব উপযুক্ত জায়গা আমাদের এই গ্রাম।
লিউক বলে–আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনি কিছু সাহায্য করতে পারেন না?
নাঃ, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। হয়তো শুনেছি–তবে
আচ্ছা, এখানে লোকজনেরা কি ভূতে বিশ্বাস করে?
সে ব্যাপারে আমি সত্যিই কিছু জানি না।–উত্তর দেন উকিলমশাই।
কোনো ভূতুড়ে বাড়ি নেই এখানে?
অন্ততঃ, আমার জানা নেই।
লিউক বললো–শুনেছি, এখানে টমি না কি যেন নামে একটি ছেলে ছিলো–আপনার অফিসে এক সময়ে কাজ করতো। লোকে বলে যে, ও নাকি এখনও এখানেই চলাফেরা করে।
মুখ সাদা হয়ে যায় মিঃ অ্যাবটের। উনি বলেন–টমি পিয়ার্স? সেই অতি নচ্ছার পাজি ছেলেটা?
এই ধরনের আত্মা সব সময়ই দুষ্ট প্রকৃতির হয়ে থাকে।
ওর ভূত কে দেখেছেন? ঘটনা কী?
এ ধরনের ঘটনার সাক্ষী হিসেবে বিশেষ কারো নাম বলা যায় না।
আমারও তাই বিশ্বাস।
চতুরতার সঙ্গে লিউক প্রসঙ্গান্তরে যায়।
তাহলে তো টমাসের সঙ্গে আপনার আলাপ হওয়ার দরকার। বেশ ভালো লোক এই টমাস। বৃদ্ধ আম্বলবির মত নয়।
উনি কি খুব প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন?
একেবারে মাথামোটা–একগুয়ের রাজা।
ব্রিজেট প্রশ্ন করে–জল সরবরাহের প্রশ্নে আপনার সঙ্গে শুনেছি দারুণ ঝগড়া ছিলো?
অ্যাবটের মুখ পিঙ্গলবর্ণ হয়ে ওঠে।
আম্বলবি সব সময়ে যে-কোনো প্রগতিমূলক কাজের একেবারে বিরোধী ছিলেন।–কর্কশ স্বরে মিঃ অ্যাবট জবাব দেন। তারপর বলেন যাকগে, এবার আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে। যদি আমাকে দিয়ে কোনো কাজ হয় বলবেন মিঃ–
ফিৎস্ উইলিয়াম।মনে করিয়ে দেয় লিউক।
ওরা এগিয়ে যায়। চলতে চলতে ব্রিজেট বলে আমি তোমার পদ্ধতিটা লক্ষ্য করলাম। তুমি নিজে থেকে যাহোক কিছু বলে লোককে উকে দিয়ে তাদের কাছ থেকে কথা টেনে বের করার চেষ্টা করছে।
লিউক অস্বস্তি বোধ করছিলো। ওর এরপর কী করা উচিত ভেবে ঠিক করার আগেই ব্রিজেট বলে–তুমি যদি অ্যামি গিবসের কথা আরও জানতে চাও তবে তোমায় আমি একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারি।
সে কে?
মিস ওয়েনফ্লিট নামে এক ভদ্রমহিলা।
লিউক বলল–তাই নাকি? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
লিউক যেতে যেতে দেখলো সেই প্রকাণ্ড জর্জিয়ান বাড়ি। ব্রিজেট বললো–এটা হচ্ছে। উইচ হল-এখন ওটাই লাইব্রেরি।
হলের গায়ে একটা ছোটো বাড়ি। ব্রিজেট ফটকের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।
ব্রিজেট বলে-নমস্কার মিস ওয়েনফ্লিট। ইনি মিঃ ফিৎস উইলিয়াম।–লিউক নমস্কার জানায়। ইনি মৃত্যু, গ্রাম্য সংস্কার আর নানা রকম সব বিরক্তিকর ব্যাপারের ওপর একটা বই লিখছেন।
ভদ্রমহিলা বললেন–তাই নাকি? খুব ভালো কথা।
আমি ভাবলাম যে আপনি অ্যামির ব্যাপারে কিছু তথ্য দিতে পারবেন। ব্রিজেট বলে।
ও, অ্যামি? হা হা অ্যামি গিবস্–মিস ওয়েনফ্লিট বলেন।
মহিলা এবার যেন লিউককে যাচাই করে নিতে চাইলেন।
দয়া করে ভেতরে আসুন, আমার পরে বেরোলেও চলবে। আমার তেমন কিছু দরকারী কাজ নেই, বাড়ির জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে যাচ্ছিলাম।
চেয়ার টেনে ওদের বসতে বলে মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমি নিজে বিড়ি, সিগারেট খাই না, তাই তোমার কাছে সিগারেট নেই।
তারপর ওয়েনফ্লিট বললেন–আপনারা সেই দুর্ভাগিনী মেয়ে অ্যামির সম্পর্কে জানতে চান? মারাত্মক একটা ভুলের ফলে ওর মৃত্যু হলো।
আচ্ছা, এটা কি আত্মহত্যা হতে পারে না?–প্রশ্ন করে লিউক।
ওয়েনফ্লিট বলে ওঠেন–কখনোই না। অ্যামি সে ধরনের মেয়েই ছিলো না।
লিউক জিজ্ঞেস করে–ও কী ধরনের মেয়ে ছিলো?
মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ও বাড়ির পরিচারিকা হিসেবে মোটেই ভালো না। তবে আজকাল একজন কাউকে পেলেই বলতে হবে কপাল ভালো। ও অত্যন্ত একরোখা মেয়ে ছিলো। এ ধরনের মেয়ে আমি খুব একটা পছন্দ করি না; তবে মৃত লোকের নিন্দে মন্দ করা ঠিক নয়।
মাথা নেড়ে লিউক সম্মতি জানায়। মিস পিঙ্কারটনের কথা ওর মনে পড়ে।
মিস ওয়েনফ্লিট না থেমে সমানে বলে চলেন–অ্যামি নিজের প্রশংসা খুব পছন্দ করতো। এখানকার একটা অ্যান্টিক দোকানের মালিক মিঃ এলসওয়ার্দি। ভদ্রলোক জলরং দিয়ে মাঝে মাঝে ছবি আঁকেন। অ্যামির দুএকটা স্কেচ উনি করেছিলেন আর তাতেই নিজের সম্পর্কে ওর ধারণা আরও উঁচু হয়ে গেল। ও যে ছেলেটির বাগদত্তা ছিলো–জিম হারভে–একটা মোটর কারখানার মেকানিক, খুব ভালোবাসতো অ্যামিকে। কিন্তু বাসলে কী হবে, প্রায়ই হারভের সঙ্গে ও ঝগড়া করতো। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। অ্যামি দারুণ ঠান্ডায় বাইরে গিয়ে বিশ্রী সর্দিকাশি বাধিয়ে ফিরলো; সেইদিন বিকেল বেলা ও ডাক্তার দেখালো।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–কোনো ডাক্তারকে দেখালো?
ডাঃ টমাস, এবং তিনি ওকে সর্দির জন্য এক শিশি ওষুধ দিয়েছিলেন। ও সেটা কিনে বাড়ি ফিরলো। এই ওষুধে কোনো অনিষ্ট হবে না। ও সকাল সকাল শুতে চলে গেল। তারপর ভোর রাতে–প্রায় একটা নাগাদ গোঙানি আরম্ভ হলো। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তখন চিৎকার করে ডাকাডাকি করলাম কিন্তু কোনো উত্তর নেই। আমরা ডাকাডাকি করাতে রীড বাড়ির পেছনে গিয়ে দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠে, ওর ঘরের খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা খুলে দিলো। আহা বেচারী! কী মর্মান্তিক দৃশ্য! কেউ কিছু আর করতে পারলো না–হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলো।
কী ভাবে মারা গেল? টুপির পেইন্ট খেয়ে?
হা, ওরা কি একটা বললো, অক্সালিক অ্যাসিড নামে এক ধরনের বিষের ক্রিয়ার ফলে। বোতলটা দেখতে প্রায় সর্দির ওষুধের বোতলের মতোই ছিলো। মারা যাবার পর ওষুধের বোতলটা পাওয়া গেল ওর বেসিনের ওপর আর রঙের বোতলটা ছিলো ওর বিছানার পাশে।
আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে এটা আত্মহত্যা?
একবারও না। ও যদি আত্মহত্যা করতে চাইতো, তাহলে আরও ভালো কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারতো। ও আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিলো না।
লিউক জিজ্ঞেস করলো–তাহলে আপনার কী মনে হয়?
ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার মতে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা।
এমন সময় একটা বেড়াল ওয়েনফ্লিটের কাছে এলো। ওয়েনফ্লিট আদর করে বললো-কি রে ওয়াঙ্কিপু, সারাদিন কোথায় ছিলি?
লিউক বললো–ভারী সুন্দর বেড়াল তো। অনেক দিন যাবৎ পুষছেন না কি?
না না, এটা মিস পিঙ্কারটন নামে আমার এক বান্ধবীর বেড়াল। শয়তান ড্রাইভার ওকে চাপা দিয়ে মেরেছে।
গম্ভীর ভাবে লিউক বেড়ালটাকে একবার আদর করলো।
ব্রিজেট দাঁড়িয়ে পড়ে–এবার কিন্তু আমাদের যেতে হবে।
মিস ওয়েনফ্লিট ওদের বিদায় জানিয়ে বললেন–আশা করি আপনাদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হবে।
ওদের সঙ্গে বাইরে এলেন মিস ওয়েনফ্লিট। লিউক সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সেই অক্ষত গ্রাম্য সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলল–অপূর্ব সুন্দর আপনাদের এই গ্রাম।
মিস ওয়েনফ্লিটের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
যখন ওরা বাইরে এলো ব্রিজেট বললো–তুমি কি তোমার অনুসন্ধানের কাজ আরও চালাবে, না এবার আমরা নদীর পার দিয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাবো? ঐ পথটা কিন্তু খুব সুন্দর।
হাইড স্ট্রীট ধরে ওরা হাঁটতে আরম্ভ করলো। রাস্তার সব শেষের বাড়িগুলোর একটার গায়ে সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে–অ্যান্টিক।
লিউক সেই বাড়ির জানলা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে বললো–খুব সুন্দর একটা রুপোর ডিস্ রয়েছে এখানে। আমার পিসিমার একটা এরকম ছিলো। ওরা এটার দাম কী রকম চাইবে?
ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো?
ব্রিজেট বললো-এখানে তেমন কিছু পাবে বলে আমার মনে হয় না। এলওয়ার্দি তার জিনিষের দাম খুব ভালো করেই জানে।
দরজা খোলাই ছিল। লিউক বাঁ-দিকের একটা ঘরে ঢুকে একটা রুপোর ডিস্ তুলতেই কুইন অ্যান্ ওয়লনাট ডেস্ক-এর আড়াল থেকে এক ভদ্রলোক ওর দিকে এগিয়ে এলেন।
ও, মিস কনওয়ে, কি ভাগ্য আপনি এসেছেন।
নমস্কার মিঃ এলসওয়ার্দি।
লিউকের সঙ্গে আলাপ হতেই ভদ্রলোক বললো–খাঁটি ইংলিশ রুপোর ডিস, খুব ভালো জিনিস। বিক্রি করতে ইচ্ছে করে না।
ব্রিজেট বললো-খাঁটি শিল্পীর মেজাজ।
এলসওয়ার্দি ব্রিজেটকে বললো–আমার শিল্পী খেতাব সহ্য হবে না। লিউক বলে–কিন্তু আপনি তো একজন শিল্পীও? শুনলাম আপনি জলরঙে ছবিও আঁকেন?
এলসওয়ার্দি জিজ্ঞেস করলো–এ কথা আপনাকে কে বললো? এ জায়গাটা সত্যিই অদ্ভুত-কারুর কিছু গোপন রাখার উপায় নেই এবং এই জন্যই এ জায়গাটা আমার এত পছন্দ।
লিউক এলসওয়ার্দির প্রতি প্রশ্ন করে–মিস ওয়েনফ্লিট আমাদের বললেন যে আপনি নাকি অ্যামি গিবসের কয়েকটি স্কেচ করেছেন?
এলসওয়ার্দি বলেন–ও, অ্যামি? করেছিলাম কি? তা হয়তো করে থাকতে পারি।–তাঁর ভাবভঙ্গির মধ্যে যেন একটা বিচলিত ভাব।
মেয়েটি কিন্তু খুব সুন্দরী ছিলো।–ব্রিজেট বললো।
তারপর এলসওয়ার্দি লিউকের দিকে ফিরে বললেন–আপনার যদি রুপোর তৈরি জিনিষপত্রে আগ্রহ থাকে তাহলে আপনাকে আমি অপূর্ব একজোড়া রূপোর পাখী দিতে পারি।
লিউক বলে-না না, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
মিঃ এলসওয়ার্দি ওদের সঙ্গে দরজা অবধি এসে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন।
লিউক মন্তব্য করলো–মিঃ এলসওয়ার্দিকে খুব একটা সুবিধের লোক বলে মনে হয়নি।
ব্রিজেট বললো–ভদ্রলোকের মনটা যেমন নোংরা, অভ্যাসগুলিও তেমনি বিশ্রী।
কতকটা খাপছাড়া ভাবে লিউক বলে–হে ভগবান, এ ধরনের লোকই তো আমার দরকার। এই ব্যাপারে ওর সঙ্গে আরও বিশদভাবে কথা বলা উচিত ছিলো। যাকগে, অন্য আর একদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবো।
কোনোও উত্তর দেয় না ব্রিজেট। পথে যেতে যেতে হঠাৎ এক ভদ্রলোক ব্রিজেটকে নমস্কার জানায়। তাঁর সঙ্গে তিনটি ডালকুত্তা ছিলো।
লিউক জিজ্ঞেস করে–এই কি সেই মেজর হন এবং তার কুকুর বাহিনী?
ঠিকই ধরেছো।
আচ্ছা, এতক্ষণে কি আমরা উইচউড-এর প্রায় সবার সঙ্গেই দেখা করা শেষ করিনি?
তা করেছি।
আমার কেমন যেন নিজেকে কেউকেটা বলে মনে হচ্ছে!–লিউক বলে।
জিমি লরিমারের কথা লিউকের মনে পড়লো–আমার মনে হয়, ইংল্যাণ্ডের গ্রামে যখন নতুন কোনো লোক যায়, গ্রামে ঢোকবার মাইল খানেক আগে থেকেই সে সবার নজরে এসে যায়।
অতর্কিতে প্রস্তাব করে ব্রিজেট–আমাদের হাতে অনেক সময় আছে; এসো না নদীর পারে একটু বসি?
একটা এলিয়ে পড়া গাছের গুঁড়িতে ওরা দুজনে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে।
ব্রিজেট বলে–মেজর হর্টন একেবারে পাকা সামরিক। একটা হুমদারী ভাব আছে। বিশ্বাস করা কঠিন যে, বছর খানেক আগে পর্যন্ত ভদ্রলোক কী দারুণ রকম স্ত্রৈণ ছিলেন। আমি কস্মিনকালে ওঁর স্ত্রীর মতো একজন খাপছাড়া মহিলা দেখিনি। বছর খানেক আগে পাকস্থলীর এক মারাত্মক অসুখে ভদ্রমহিলা ওঁর স্বামী, ডাঃ টমাস আর দুজন নার্সকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন আর তার পরেই এই কুকুর কুলের আবির্ভাব।
ব্রিজেট লিউককে জিজ্ঞেস করলো, তোমার এখানে আসবার আসল উদ্দেশ্য কী?
ব্রিজেটের এই ছোট্ট প্রশ্নটা লিউককে আঘাত করলো।
***
টুপির পেইন্ট
লিউক সবেমাত্র সিগারেটে আগুন ধরাতে যাচ্ছিলো, কিন্তু ব্রিজেটের এই আকস্মিক প্রশ্নে ওর হাত দুটি বরফ হয়ে গেলো। জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি পুড়ে হাতে তাপ লাগাতে ওর বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলো। ও চমকে উঠে পোড়া কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো–কী সাংঘাতিক প্রশ্ন। তুমি আমাকে যা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিলে!–ক্লিষ্টভাবে ও হাসে।
তাই নাকি?
হা।–যাগে সে কথা। বুঝতে পারছি আমার আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা সাধারণবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব। আমার এই বই লেখার ব্যাপারটা তুমি বোধ হয় প্রথম থেকেই বিশ্বাস করোনি, তাই না?
তোমাকে দেখার পর আর করিনি।
তার আগে পর্যন্ত করেছিলে?
তা করেছিলাম।
অর্থাৎ আমার গল্পটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
মানে বই লেখার মতো বুদ্ধিসুদ্ধি আমার নেই–এই তো? না না, আমাকে আঘাত দেওয়া হবে–একথা ভেবো না, আমার জানা দরকার।
বই হয়তো তুমি ঠিকই লিখতে পারো, তবে এ জাতের বই নয়। পুরানো দিনের আচার, বিচার, সংস্কার–এসব তোমায় মানায় না।
বুঝলাম।–লিউকের মুখে ফুটে উঠে উদ্বেগের রেখা। নিকুচি করেছে। আমি এখানে আসার পর থেকেই তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছো। তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুদ্ধিতে ঠাসা!
শুকনো গলায় ব্রিজেট বললো–আমি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তুমি আমাকে কেমনটি আশা করেছিলে?
বিশেষ কিছু আশা করিনি।
ব্রিজেট শান্ত কণ্ঠে বললো–আমি জানি। তুমি ভেবেছিলে একটা মেয়ে যার বুদ্ধির দৌড় হলো বড়জোর সুযোগ বুঝে তার মনিবকে বিয়ে করা পর্যন্ত।
কতকটা ধৃষ্টতার সঙ্গে লিউক বললো–হতে পারে এমনই কিছু, হয়তো একটা ভেবে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি।
ব্রিজেট বললো–সে কথা আমি বিশ্বাস করি কারণ, ঘটনার একেবারে মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তুমি কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোও না।
এবার লিউক হতাশ হয়ে বলে–আচ্ছা, লর্ড হুইটফিল্ডও কি ব্যাপার ধরে ফেলেছেন।
না না, গর্ডন কিছুই অবিশ্বাস করে না। ও সহজাত বিশ্বাসী মনের লোক।
যে যাই হোক, আমার অজুহাত কিন্তু মোটের ওপর খুবই কাঁচা।
তোমার ধারণাটা আমার যেন কিরকম মুখস্থ, আমি যেন সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, আর তাতে–খুবই মজাই লাগছিলো।
হ্যাঁ, তা তো লাগবেই। সাধারণতঃ বুদ্ধিমতী মেয়েরা খুব ঠান্ডা মাথায় থোক না তোক নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে।
ব্রিজেট বললো–এ জীবনে যেখান থেকে যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায় সেইটুকুই লাভ। আবার বলল–কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো?
আবার সে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে লিউক ব্রিজেটের মুখের দিকে তাকাতেই ওর চোখে চোখ পড়লো। ও কতকটা তন্ময় ভাবে বললো–তোমার কাছে মিথ্যের বোঝা আর না বাড়ানোই ভালো।
খুবই ভালো কথা।
কিন্তু এক্ষেত্রে যা সত্যি তা খুব কদর্যতর শোনো।
লিউক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–শোন, আমি এখানে এসেছি অনেকটা আন্দাজের ওপর নির্ভর করে। পুরো ব্যাপারটা যেমন অদ্ভুত তেমনই আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। আমি গিবস্ সেই মেয়েটির মৃত্যুর ঘটনারাশির একটা অংশ মাত্র। আমি জানতে চাই ও ঠিক কীভাবে মারা গিয়েছিলো?
আমিও তাই ভেবেছি।
ওর মৃত্যুর মধ্যে এমন কী আছে যাতে তোমারও কৌতূহল হয়েছে?
ব্রিজেট বললো–আগাগোড়া আমার মনে হয়েছে যে ওর মৃত্যুর মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে, আর তাই আমি তোমাকে মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
কারণ ঐ ভদ্রমহিলাও আমারই মতো একই কথা ভাবেন।
আচ্ছা!–লিউক আগের ঘটনাগুলো চট করে ভেবে নিলো।–তাহলে উনিও তোমারই মতো ভাবেন যে, এই ঘটনার মধ্যে একটা অন্ধকার দিক আছে?
সম্মতি জানায় ব্রিজেট।
কিন্তু কেন? কারণটা কী?
প্রথম কারণ–টুপির রং।
টুপির রং বলে তুমি কী ইঙ্গিত করতে চাইছো?
আজ থেকে বিশ বছর আগে লোকে টুপি রং করতো। এক এক ঋতুতে এক এক রং; যেমন–গোলাপী, নীল অথবা কালো। কিন্তু আজকাল আর ওসব চলে না।
এমন কি অ্যামি গিবসের মতো মেয়েরাও?
আমি হয়তো বা টুপিতে রং করলেও করতে পারি, কিন্তু অ্যামি করবে না। তাছাড়া আর একটা বিশেষ দিকও আছে, পেইন্টটা ছিলো লাল রঙের।
তাতে কী হলো।
অ্যামি গিবসের চুলের রংও ছিলো লাল-অনেকটা গাজরের মতো।
ব্রিজেট সম্মতি জানিয়ে বলে-গাজরের রঙের চুলের সঙ্গে কেউ লাল রঙের টুপি পরে না। এটা এমনই একটা ব্যাপার যা পুরুষদের বুঝতে পারা সম্ভব নয়, কিন্তু
লিউক বলে–পুরুষদের পক্ষে বুঝতে পারা কঠিন। মিলে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি করে লিউক বলল–আমি সরকারী গোয়েন্দা নই। জিমি যা তোমায় বলেছে আমি প্রাচ্যে একজন পুলিশ অফিসার ছিলাম, এখন অবসর নিয়েছি।
ও মিস পিঙ্কারটনের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তার পরবর্তী ঘটনারাশির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়, আর কেনই বা উইচউডে এসেছে তাও বলে।
তাহলেই দেখো, কী অলীক কাণ্ড! আমি এমন একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, সে একজন ছদ্মবেশী খুনী, সে হয়তো এখানেই উইচউডে সবার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি মিস পিঙ্কারটনের, তোমার আর মিসকী যেন নাম ভদ্রমহিলার? ধারণা সঠিক হয়, তাহলে সেই লোকই অ্যামি গিবসূকে খুন করেছে।
ব্রিজেট বললো বুঝতে পেরেছি।
আচ্ছা, বাইরে থেকে কেউ এসে কি এমন সব কাণ্ড ঘটাতে পারে?
ব্রিজেট বললো–অসম্ভব নয়। রীড এখানকার কনস্টেবল। সদর বাড়ির ছাদ বেয়ে অ্যামির জানলায় উঠেছিলো। জানলা দিয়ে ওর ঘরে যাওয়া মোটেই শক্ত কাজ নয়।
আচ্ছা, যদি ঢুকলোই, কিন্তু ঢুকে কী করলো?
ওষুধের বোতলটা সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় রঙের বোতলটা রেখে দিয়েছিলো।
অর্থাৎ, লোকটা ধরেই নিয়েছিলো যে, অ্যামির ঘুম ভাঙ্গবে আর টুপির রংটাও চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলবে, তারপর লোকে বলবে যে ও হয় ভুল করে ওটা খেয়েছে অথবা আত্মহত্যা করেছে?
হা।
— আচ্ছা, কু-মতলবপ্রসূত কাজ–তেমন কোনো কথা ওঠেনি?
না।
কোনো লোক টুপির রঙের সাহায্যে এটা করেছে তেমন কোনো কথাও ওঠেনি?
না।
তা সত্ত্বেও তোমার মনে এই সন্দেহ হয়েছিল?
মিস পিঙ্কারটনের বুদ্ধি তেমনি একটা প্রখর না থাকায় প্রথমটায় ওঁর কথায় আমি কোনো গুরুত্বই দিইনি। লিউক বললো।
— ব্রিজেট বলে কিন্তু আমি আগাগোড়া ভাবতাম যে উনি খুব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। আচ্ছা, তুমি না বলেছিলে উনি আরও কয়েকটা নাম বলেছিলেন?
লিউক বললো–নাম টমি পিয়ার্স। এছাড়া, কার্টারের নামও বলেছিলেন।
ব্রিজেট বললে–কার্টার, টমি পিয়ার্স, অ্যামি গিবস, ডাঃ আম্বলবি-সবই যেন কেমন অলীক বলে মনে হয়। এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা ছিলো।
আচ্ছা, এই কার্টার কী করে মারা গেল জানো?
ও নদীতে পড়ে ডুবে মারা যায়। ঐ নদীর ওপরে সরু একটা সাঁকো আছে; সবার ধারণা পা ফসকে গিয়ে নিচে পড়ে যায়।
কিন্তু কেউ একজন খুব সহজেই ওকে ধাক্কা মেরে ফেলেও দিয়ে থাকতে পারে?
তা তো পারেই।
তা হলে এ কথাই দাঁড়াচ্ছে যে নিজেকে সবার সন্দেহের বাইরে রেখে অতি সহজেই এই তিনজনকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে?
মিস পিঙ্কারটন কিন্তু তাই সন্দেহ করেছিলেন।
–ব্রিজেট বললো।
লিউক বললো-তুমি কাউকে সন্দেহ করো কিনা, একথা জিজ্ঞেস করা কি অপ্রাসঙ্গিক হবে?
উইচউডে যাদের আমি চিনি বা জানি তাদের সবাইকেই আমার মনে হয়, তারা সুস্থ, সম্মানিত এবং সম্পূর্ণ সাধারণ।
লিউক বলে–আমি জানতাম তুমি একথাই বলবে।
ব্রিজেট বলে–যে কোনো লোক থাকতে পারে; যেমন ধরো-মাংসওয়ালা, রুটিওয়ালা, মুদী, ক্ষেতমজুর বা দুধওয়ালা।
তা হয়তো হতে পারে, তবে আমার মনে হয় যে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহের ক্ষেত্র আরও সীমাবদ্ধ।
কেন?
মিস পিঙ্কারটন বলেছিলেন যে আততায়ীর পরবর্তী শিকারকে তার চোখের শিরশিরে, ঠান্ডা দৃষ্টিতে মেপে দেখতো। ওঁর কথা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল। অবশ্য আমারও ভুল হতে পারে।
তুমি হয়তো ঠিকই বলেছে।
লিউক বললো–জানো, তোমায় সমস্ত ব্যাপারটা জানাতে পেরে আমি খুব স্বস্তি পাচ্ছি।
তাতে তোমার উপকারই হবে। আমিও হয়তো কোনো কোনো ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি সত্যিই নিজেকে জড়াবে?
নিশ্চয়ই।
লিউক বললো–লর্ড হুইটফিল্ডের ভূমিকা এ ব্যাপারে কী হবে? তোমার কী মনে হয়।
স্বভাবতই আমরা গর্ডনকে এ ব্যাপারে কিছু বলবো না। বললো ব্রিজেট।
তুমি বলতে চাও যে উনি বিশ্বাস করবেন না?
না না, বিশ্বাস ও ঠিকই করবে। গর্ডন সবকিছুই বিশ্বাস করে। ও দারুণ উৎসাহিত আর উৎফুল্ল হবে এই ঘটনা শুনলে।
তা হলে তো আর ওকে বলা যায় না।
হ্যাঁ, এমন অনাবিল আনন্দ ওকে দেওয়ার উপায় নেই।
লিউক ব্রিজেটের দিকে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে দেখে।
ব্রিজেট বলে–এবার আমাদের যাওয়া উচিত।-ও উঠে দাঁড়ায়।
দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে পথ চলে।
***
সম্ভাবনা
ওর শোবার ঘরে লিউক বসে। একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে তাতে কয়েকটা নাম লিখলো–ডাঃ টমাস, মিঃ অ্যাবট, মেজর হর্টন, মিঃ এলসওয়ার্দি, মিঃ ওয়েক, মিঃ জোন, অ্যামির প্রেমিক, কসাই রুটিওয়ালা, মোমওয়ালা ইত্যাদি। ও শিরোনাম দিলো– শিকার, তার নিচে লিখলো–
অ্যামি গিবস : বিষপ্রয়োগ;
টমি পিয়ার্স : জানলা থেকে ধাক্কা;
হ্যারি কার্টার : সরু সাঁকো থেকে ধাক্কা (মাতাল? ওষুধ প্রয়োগ?);
ডাঃ আম্বলবি : রক্তে বিষয়োগ;
মিস পিঙ্কারটন: গাড়ি দিয়ে চাপা দেওয়া;
আরো যোগ করলো ও
মিসেস রোজ
বৃদ্ধ বেন?
একটু থেমে আবার লিখলো
মিসেস হর্টন?
তালিকাটা কিছুক্ষণ দেখে আবার লিখলো–
ডাঃ টমাস : বিরুদ্ধ সম্ভাব্য যুক্তি : ডাঃ আম্বলবির মৃত্যুতে রীতিমত লাভবান। মৃত্যুর পদ্ধতিতে পেশাগত সৌকর্য, যথা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রক্তে বীজাণু প্রয়োগ। অ্যামি গিবস্ যেদিন মারা যায়, সেদিন বিকেল বেলা তার সঙ্গে দেখা করে (ওদের দুজনের মধ্যে কি কিছু ছিলো? ব্ল্যাকমেল?)।
টমি পিয়ার্স : ডাঃ টমাসের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা জানা যায় না।
হ্যারি কার্টার : কোনো যোগাযোগ আছে বলে জানা যায় না।
যেদিন মিস পিঙ্কারটন লণ্ডনে গেলেন, সেদিন কি ডাঃ টমাস উইচউডে ছিলেন?
একটা বড় নিশ্বাস ফেলে লিউক নতুন করে আরো একটা শিরোনাম লিখলো
মিঃ অ্যাবট : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : (লিউকের ব্যক্তিগত অভিমত-ওকালতি পেশার লোকজন অত্যন্ত খুঁতখুতে, সন্দেহপ্রবণ এবং অমার্জিত হয়ে থাকে)। কিন্তু এক্ষেত্রে ভদ্রলোক অতি প্রাণবন্ত, সহজ, আচরণে মার্জিত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে গল্প উপন্যাসের চরিত্রের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।
ডাঃ অ্যাম্বলবিকে খুন করার উদ্দেশ্য–ওদের দুজনের মধ্যে সবসময়ই একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলো। অ্যাম্বলবি অ্যাবটকে ঘোরতর অপছন্দ করতেন। মিস পিঙ্কারটন খুব সহজেই এঁদের দুজনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে থাকতে পারেন।
টমি পিয়ার্স : অ্যাবটের কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলো।
হ্যারি কার্টার : কোনো যোগাযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যামি গিবস : কোনো যোগাযোগ নেই। টুপির রং ব্যবহার করা অ্যাবটের চরিত্রানুগ। যেদিন মিস পিঙ্কারটন খুন হলেন, সেদিন কি অ্যাবট গ্রামে ছিলেন?
মেজর হর্টন : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : অ্যামি গিসের সঙ্গে কোনো সংযোগ ছিলো বলে জানা যায় না। টমি বা কার্টারের ব্যাপারেও তাই। মিসেস হর্টন সম্বন্ধে কোনো সূত্র আছে কি? মৃত্যুর ধরন থেকে মনে হয় যে, আর্সেনিক বিষে ভদ্রমহিলা মারা গেছেন।
বিঃদ্রঃ–টমাস চিকিৎসা করেছে। টমাসের ওপর সন্দেহের আরও একটা কারণ।
মিঃ এলসওয়ার্দি : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : বাজে ধরনের লোক; ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে কারবার। অ্যামি গিসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো। টমি পিয়ার্স বা কার্টারের সঙ্গে কি কোনো সংযোগ ছিলো? জানা যায়নি। আম্বলবির সঙ্গে? হয়তো বা এলসওয়ার্দির মানসিক গঠন নিয়ে বলাবলি করেছেন। মিস পিঙ্কারটন? মিস পিঙ্কারটন যখন খুন হলেন, তখন কি এলসওয়ার্দি উইচউডের বাইরে ছিলো?
মিঃ ওয়েক : বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তি : খুব সম্ভবতঃ খুনী নয়। ধর্মীয় অনুশাসনে খুন করার ব্রত? গল্পে এই পবিত্র পাদ্রীমশাই খুনী হলেও হয়তো হতে পারে।
দ্রষ্টব্য : কার্টার, টমি, অ্যামি–সবাই ধর্মমতের বাইরে। তবে কি স্বর্গীয় আদেশে এদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে?
মিঃ জোনস্ : তথ্য অজানা।
অ্যামির প্রেমিক : অ্যামিকে খুন করার মধ্যে হয়তো যুক্তি আছে; কিন্তু অন্যান্য খুনের কোনো কারণ নেই।
অন্যান্য : নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
ওসব লেখাটা পড়ে বলল–একেবারে অসম্ভব। ইউক্লিড কেমন ছন্দবদ্ধভাবে সাজাতে জানে! সবকটি লিস্টই ছিঁড়ে ও একেবারে পুড়িয়ে ফেললো।
নিজের মনে বললো–কাজটা খুব সহজ বলে মনে হয় না।
***