০১. সময় মধ্যরাত্রি

ম্যালোরী

প্রথম পরিচ্ছেদ

০১.

সময় মধ্যরাত্রি। মেঘভরা কালো আকাশের বুক থেকে হিমেল বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়িগুড়ি। করিডন ওল্ডকম্পটন স্ট্রীট ধরে হাঁটছে। মাথার সোলার টুপিসামনের দিকে টানা, দুটি হাত বর্ষাতির পকেটে ভরা। সোহোর এই অঞ্চলে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায় যেসকল মানুষ তারা সন্ধ্যা থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জন্য বাইরে বের হতে পারেনি।

ওল্ড কম্পটন স্ট্রীট আর ক্রিম স্ট্রীটের সংযোগ স্থলে এসে সে একটা সিগারেট ধরাবার জন্য দাঁড়াল। সিক্ত বায়ুর থেকে দেশলাই কাঠির আগুন আড়াল করবার সময় সে অনুসরণকারীর পদধ্বনি শুনবার চেষ্টায় উকর্ণ হল। কিন্তু শুনতে পেল না কিছুই। আড়চোখে পাশের দিকে দৃষ্টি দিতে শুধু চোখে পড়ল অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জন সুবিন্যস্ত রাস্তা। লোকটা দেশলাই কাঠিটা রাস্তার পাশের নালীতে ফেলে দিয়ে ক্রিম স্ট্রীট দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।

গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সে উপলব্ধি করছে যেখানেই যাচ্ছে দুই বা তিনজন লোক কোন কারণ ছাড়াই তাকে অনুসরণ করছে।

এ ধরনের ঘটনা তার কাছেনতুন কিছুনয়। অতীতে পুলিসে তাকে অনেকবার অনুসরণ করেছে। যুদ্ধের সময় এখানে-ওখানে যখন ঘুরে বেড়াত গেস্টাপোরা তাকে নজরে নজরে রাখত। তারপর থেকেই তার মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা জন্মেছে কেউ তাকে অনুসরণ করলেই বুঝতে পারে। কোন কারণ ছাড়াই কেন তাকে মানুষগুলো অনুসরণ করছে সে এখনও বুঝতে পারছে না। তার কোন আপত্তি নেই স্বীকার করতে যে সে খুব সহজেই শত্রু সৃষ্টি করতে পটু। কিছু লোক আছে যারা তাকে মোটেই পছন্দ করে না। কিন্তু তারা তো তাকে অনুসরণ করবে না। কারণ তারা ভালভাবেই জানে কোথায় সে থাকে আর কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে। ব্যাপারটা তাকে বিভ্রান্ত আর উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

তবে এখন বুঝতে পারছে তার কল্পনা তাকে প্রতারিত করছে না। তাই এই বৃষ্টিঝরা রাতে সে বাইরে বেরিয়েছে অনুসরণকারীদের কোন একজনকে হাতেনাতে ধরে জিজ্ঞাসা করবে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? কিন্তু এখন পর্যন্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। এখন রাত প্রায় একটা বাজতে চলল, বারবার ঘুরে দাঁড়িয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে, আড়ালে আত্মগোপন করে আর লুকিয়ে অপেক্ষা করেও তাদের হদিশ করতে পারেনি। তারা যেন প্রেতাত্মাদের মতই অদৃশ্য। তবে অসীম তার ধৈর্য। ধরবেই ঠিক সুযোগ মত।

এমিথিস্ট ক্লাবটা কাছেই ক্রিম স্ট্রীটের একটা গলিতে। সেখানে ঢুকে এই অনুসরণকারীদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। ক্লাবের উপর তলার জানালা থেকে একজনের চেহারা দেখে রাখবে। তবে এই বৃষ্টি তাদের উৎসাহ কিছুটা খর্ব করবে।

.

০২.

 একটা কানাগলির শেষ মাথায় এমিথিস্ট ক্লাবটা। যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে সোহোর এই অঞ্চলে এই রহস্যময় ক্লাবটির। এখানে দিনরাত মদ পাওয়া যায়, আর এই জেলার পুলিসের তৎপরতা বাড়লে এখানে নিরাপদ আশ্রয় মেলে। কোন এক সময় এই বাড়িটা পানীয় জমিয়ে কাজে ব্যবহার করা হতো, তবে বর্তমানে ঘরগুলো রং করে, চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজিয়ে আর দেওয়ালে ছবি টাঙ্গিয়ে বাড়িটা সাজান-গোছান হয়েছে। জনি বারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে গায়ের রং কালো আর তেল চকচকে বিশালাকৃতি দেহ।

এই জনি এমিথিস্ট ক্লাবের মালিক। এই সোহো অঞ্চলে যেসব ঝামেলা সৃষ্টি হয় আড়ালে তার হাত থাকে। লোকটার নিগ্রোর মত কালো চেহারা করিডনকে মনে করিয়ে দেয় কদোর বিভীষিকার কথা। তার পরনে সিভিল বো স্যুট আর পরিষ্কার ঝকঝকে সাদা সার্ট। তাতে রং করা টাই আর বাঁ হাতের আঙ্গুলে বড় হীরে বসান আংটিতে তাকে খুব বেমানান দেখাচ্ছে।

ক্লাবে অনেক নরনারীর ভীড়। করিডন ভেতরে ঢুকতেই সকলে তীক্ষ্ণ নজরে তার দিকে তাকাল। আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। তার মিলিটারি ছাঁটের বর্ষাতি, চওড়া মাংসল কঁধ আর দাঁড়ানোর ভঙ্গি বুঝিয়ে দেয় সে তাদের দলের কেউ নয়, কিংবা পুলিশেরও লোক নয়। তারা বুঝতে চাইছে লোকটা কে।

ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তাকে পাত্তা না দিয়ে করিডন বারের দিকে এগিয়ে গেল।

আমি শুনেছি তুমি ফিরেছ–হাত বাড়িয়ে দিয়ে জনি বলল, তবে বিশ্বাস করিনি। ফিরলে কেন? যদি এই নোংরা দেশ থেকে আমি একবার বের হতে পারি তাহলে আর ফিরব না।

তাতে কারো ক্ষতি হবে না বাড়িয়ে দেওয়া হাতটাকে পাত্তা না দিয়ে করিডন বলল, যদি শরীরের ক্ষতি না হয় তাহলে একটা স্কচ খাব ভাবছি।একটা টুল টেনে নিয়ে সে বসল।

লাল আর সাদা চেকেরশার্ট পরা একজন রোগা আর বেঁটে লোক নিপুণ হাতে পিয়ানো বাজাচ্ছে দুরে এক কোণে।

এখানকার যে পানীয়ই পান কর না কেন বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই–জনি আলতো হেসে বলল, ভালো ছাড়া খারাপ হবে না। এইটা একটু চেখে দেখ। সে একটা বোতল আর একটা গ্লাস তার সামনে ঠেলে দিল।

যখন করিডন গ্লাসে মদ ঢালতে ব্যস্ত জনি বলল, শুনেছিলাম তুমি আমেরিকায় ছিলে?

–ঠিকই শুনেছ। কিন্তু ওখানে খাবারদাবারের দাম এমন প্রচণ্ড যে আমায় পালিয়ে আসতে হল।

জনি একটা বিজ্ঞের হাসি হেসে ফেলল চোখ বুজে। আমি অন্যরকম শুনেছি। ওখানকার পুলিশি ব্যবস্থা নাকি খুব কড়া, সত্যি নাকি?

করিডন হুইস্কির দিকে তাকাল, তারপর মাথা তুলল। দৃষ্টিতে কাঠিন্য। সে বলল, আজকাল তোমার মত লোককে ভাঙ্গা বোতলের সাহায্যে শায়েস্তা করে। আমাকে হয়ত তাই করতে হবে।

হাসি উবে গেল জনির মুখ থেকে। সেবলল, আরে বাবা আমি ইয়ার্কি মারছি।বাইরে বেড়িয়েও তোমার মেজাজ ঠিক হলো না দেখছি।

আমার মেগজ ঠিকই আছে। তোমার ইয়ার্কিগুলো মেয়েমানুষদের জন্যে জমা করে রেখ। ওরা পছন্দ করতে। আমার এসব ভালো লাগে না।

অস্বস্থিকর নিস্তব্ধতা নেমে এল। জনি বলল, ওসব বাদ দাও। বল কেমন কাটছে। খুব ব্যস্ত নাকি?

না।

তুমি অনেক দিন দেশ ছাড়া, তাই বোধহয় মানুষ তোমায় ভুলে গেছে। এখন তো ফিরেছ, কি করবে ভেবেছ কিছু?

এটাব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার সম্বন্ধে যত কম জানবে পুলিশের কাছে তত কম বলতে পারবে। রলিন্স ভেতরে আছে নাকি? মনে হচ্ছে আমার সম্বন্ধে ও কিছু জানতে চেয়েছে তোমার কাছে।

–ও সবসময় আশেপাশেই থাকে। তোমার ব্যাপারে ও আলোচনা করেনি। তুমি যখন বাইরে ছিলে ওর প্রমোশন হয়েছে। সে এখন ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।

তাহলে পুলিস তাকে অনুসরণ করছে না। যদি তার চলাফেরার উপর তাদের কোন আগ্রহ থাকত তাহলে জনি জিজ্ঞাসাবাদ করত। জনি চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্থকে বলে জেগে থাকতে। কিছু কিছু লোক জানে সে পুলিশকে খবর সরবরাহ করে। করিডনও তাই জানে। তার ব্যবসা এইভাবে খবর জোগাড় করা। এটাই সহজ পথ ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার।

আমার সম্বন্ধে কেউ আগ্রহী। কথায় কথায় সে বলল, তারা আমায় সারাদিন চোখে চোখে রাখছে।

তাতে তোমার চিন্তার কিছুই নেই। শুনেছ গেস্টাপোরা দুবছর তোমায় খোঁজ করেছিল। কিন্তু তোমার হদিশ তারা পায়নি। নাকি পেয়েছিলো?

একবার পেয়েছিল। করিডনের মুখ কঠিন হয়ে এল, তবে সে ব্যাপার তো আলাদা। এখন যা ঘটছে আমি তাই জানতে চাইছি। কোন ধারণা করতে পারছ?

আমি? আমি পারব কি করে? সম্প্রতি তো কিছু শুনিনি।

করিডন তার নিগ্রোসদৃশ মুখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করল, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে। এসব বাদ দাও, আমি খোঁজ খবর নেব। হুইস্কি শেষ করে দাম মিটিয়ে বারের কাছ থেকে সরে এসে কিছুক্ষণ বসল। বৃষ্টি এখনও ঝরেই চলেছে।

এখানে তোমার ভালই লাগবে। তুমি তো জানই যতক্ষণ খুশি বসতে পার। মেয়েটেয়ে লাগবে নাকি?

জীবন থেকে মেয়েছেলে বাদ দিয়েছি করিডন বিরসবদনে হাসল, তাছাড়া তোমার মেয়েদের তো আমি দেখেছি–আমার উপযুক্ত নয়, ধন্যবাদ।

বারের কাছ থেকে সরে গিয়ে পিয়ানোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারছে প্রতিটি নরনারী তাকে প্রচণ্ড কৌতূহলজড়ানো চোখে দেখছে।

হ্যালো, ম্যাক্স!-পিয়ানোবাদকের উদ্দেশ্যে সে বলল।

বাজনা থামলো না পিয়ানোবাদক। ঠোঁট না নেড়ে সে বলল–হ্যালো।

ম্যাক্সের অস্থির আঙুলগুলোর দিকে তাকালোকরিডন। সে বলল, তুমি কিছু জান নাকি, ম্যাক্স?

 ম্যাক্স নাইট অ্যান্ড ডে’র সুর বাজাচ্ছে। সুরের মূর্হনার সঙ্গে তার মুখের ভাজ বদলাতে লাগল।

একটা মেয়ে তোমার খোঁজ করছিলো–ঠোঁটনা নেড়েই সে বলল, ক্রিডের সঙ্গে দিন তিনেক আগে রাত্রে এসেছিল।

সিগারেটের ছাই ভাঙল করিডন। তারপর সে ম্যান্সের অস্থির আঙুলগুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, মেয়েটা কে?

জানি না। এখানে আগে কখনো আসেনি। দেখে তো মনে হল বিদেশিনী, যুবতী, গায়ের রং ময়লা। চোখ দুটো ভাসা ভাসা, পরনে ছিল সোয়েটার আর স্ন্যাকস, নাম জিনি।

কেন খোঁজ করছিল?

 জিজ্ঞাসা করছিল তুমি কোথায় থাক, জানি কিনা, আর সম্প্রতি তুমি এখানে এসেছিলে কিনা। উত্তরে বলেছি, আমার জানা নেই আর তোমাকে দেখিনি।

করিডন অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নাড়ল। আর কিছু বলেনি?

বলছিল, তুমি এখানে এলে ক্রিডকে যদি জানাই পাঁচ ডলারের একটা নোট আমায় বকশিস দেবে।

পাঁচ ডলার! ভ্রূ কুঁচকালো করিডন। তাহলে ক্রিডের সাথে দেখা করাই ঠিক হবে কি বল!

আমাকে এর মধ্যে জড়িও না।

ঠিক আছে। ধন্যবাদ, ম্যাক্স। ক্ষতি হবে না তোমার কোন।

আমি ক্ষতির চিন্তা করছি না–ম্যাক্স কথাগুলো বলে চেয়ার এক পাশে সরিয়ে দিল, মনে কর না কেন তুমি ভালোর জন্যেই গিয়েছিলে।

এফি খুব খুশি হবে তোমাকে আবার দেখলে।

 হাসল করিডন। ম্যাক্স, ও কেমন আছে?

ভালই আছে। এখন দেখতে হয়েছে গ্র্যাবেলের মত।

একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট বের করে লুকিয়ে খোলা পিয়ানোর উপর রেখে করিডন বলল, বাজাও ম্যাক্স। তারপর সে চলে গেল। ম্যাক্স নাইট অ্যান্ড ডের সুর থেকে দি ম্যান আই লাভ এর সুরে চলে এল।

.

০৩.

 ক্রিড…করিডন ক্রিডকে ভুলে গিয়েছিলো। গত চারটে বছর তার সাথে দেখা হয়নি। মন অতীতে ফিরে গেল আর মানসপটে ভেসে উঠল দীর্ঘকায় মেয়েলি স্বভাবের ক্রিডের চেহারা-মাথায় নরম মসৃণ চুল। ত্রুটিহীন স্যুটের বোম ঘরে গোঁজা লাল ফুল। রহস্যময় মানুষটার চাল চলন। কেউ জানে না কোথা থেকে টাকা পায়। কেউ কেউ বলে সে নির্ভরশীল একজন মহিলার উপর। আবার কেউ বা বলে পুলিশের গুপ্ত সংবাদদাতা। অনেকে হৃদয়হীনের মত বলে, তার আয় আছে গোপনীয়। কোন চাকরি-বাকরি করে না আর তাকে সাধারণতঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন পিকাডিলি অঞ্চলে দেখা যায় অথবা দেখা যায় লিস্টার স্কোয়ারের কোন অভিজাত বারে। মোটেই জনপ্রিয় নয় মানুষটি। আর বিশ্বাসযোগ্যও নয়। যদিও ক্রিডকে শুধুমাত্র চেহারায় চিনলেও সত্যি কথা বলতে কি তার সঙ্গে করিডনের মাত্র একবার দেখা হয়েছে। একবার এক তাসের আসরে করিডন জিতেছিল, ক্রিড সেই খেলায় যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর কি যে হল, তাস গেল ঘুরে। তৃতীয়বার খেলার সময় সে ধরে ফেলল যে ক্রিড-জোচ্চুরি করছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় বীয়ারের বোতল তুলে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গেইঞ্চি চারেক কপাল ফেটে গেল। করিডন ভাবল, ক্রিড হয়তো এখনও তার উপর রাগ পুষে রেখেছে।

করিডন কখনও রাগ পুষে রাখেনা। তাই তার ভাবতে খারাপ লাগলো যে চার বছর ধরে কেউ তার উপর রাগ পুষে রাখবে। যে সকল মেয়েদের সে চেনে তাদের কারো সঙ্গে এই মেয়েটির চেহারার বর্ণনা মিলছে না। একটা সময় ছিল যখন মেয়েছেলে না হলে তার চলত না। তবে এখন সেই অভ্যাস চলে গেছে। যুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতার পর তার জীবনে না হলে চলবে না এমন কিছু নেই, আর তাকে আগ্রহী করে তোলে না।

করিডন ফিরে এল বারে।

উপর তলায় এমন কোন ঘর আছে, যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়?–সামনে শরীর ঝুঁকিয়ে সে জানতে চাইল।

সন্দিগ্ধ মনে জনি জিজ্ঞাসা করল, যদি থাকেই তাতে কি হয়েছে?

উপর থেকে জানলা দিয়ে দেখতে চাই। বেশ তো দেখগে। একটা ঘর আছে এফির। এখন শুতে যায়নি। ওকে বলে দিচ্ছি

বারের পেছন দিকে একটা দরজা খুলে জনি বলল, এই যে এফি এখানে একটু এস। তারপর করিডনের কাছে এসে বলল, জানলা দিয়ে কি দেখতে চাও?

নিজের চরকায় তেল দাওগে। করিডন সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, আজকাল তুমি আমার ব্যাপারে খুব নাক গলাচ্ছ।

কেউ কি কোন প্রশ্ন করতে পারে না?

চুপ কর।–করিডন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আমার কাছে তোমার কথাবার্তা অসহ্য মনে হয়।

বারের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল এফি। করিডনের সঙ্গে যখন শেষ দেখা হয়েছিল তখন তার বয়স পনের। তখন ও ছিল যথেষ্ট আনাড়ি, লাজুক আর শরীরেও ছিল না তেমন পরিপূর্ণতা।

ম্যাক্সের ধারণাই ঠিক। বিগত তিন বৎসরে মেয়েটার মধ্যে পরিপূর্ণতা এসেছে। করিডন বিস্মিত আর চমকৃৎ হল। যদির ও শরীরে কোন খুঁত না থাকত, যেমন উপরের কাটা ঠোঁট, তাহলে ওকে প্রকৃতই সুন্দরী বলা যেত। তাকে দেখামাত্র মেয়েটির মুখ আরক্ত হয়ে উঠল আর চোখের দৃষ্টি হল উজ্জ্বল।

হ্যালো এফি, ভুলে গেছ নাকি আমায়?করিডন মৃদুকণ্ঠে বলল। সে জানে মেয়েটা তার পরম ভক্ত। বন্ধুত্ব দিয়ে তার মনটা জয় করেছে। কিন্তু এর জন্য তাকে কোন মূল্য দিতে হয়নি।

ছবছর আগে জনি মেয়েটাকে রাস্তায় পেয়েছিল। নিজের বাবা-মা, নিজের অতীত জীবন অথবা নিজের ঠিকানা জানাতে চায়নি বলে তার ধারণা হয়েছে বাড়ি থেকে সে পালিয়ে এসেছে। সেই সময় মেয়েটা দেখতে ছিল কুশ্রী নিতান্ত বালিকা, অর্ধভুক্ত আর সারা অঙ্গে নোংরা। কাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দুটো দাঁত দেখা যেত। অকারণে কিছু করবার মানুষ জনি নয়। রান্নাঘরে ফাইফরমাস খাবার লোকের প্রয়োজন ছিল। আর কেউ তার খোঁজ করেনি বলে তাকে থাকতে দিয়ে, অন্যদের যেমন নির্দয়ভাবে খাটিয়ে নেয় তাকেও খাটিয়ে নিতে কসুর করেনি।

এফি বলল, হ্যালো মিঃ করিডন। এফির বিহ্বলভাব দেখে জনি মুখ বিকৃত করে হাসল। করিডনের প্রতি তার ভালবাসা হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

-ওকে ওপরে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। বাইরেটা দেখতে চায় জানলা দিয়ে। ওকে সাহায্য কর।

এফিকে অনুসরণ করে বারের পিছনের দরজা দিয়ে স্বল্পালোকিন্তু একটা প্যাসেজে এল করিডন। তারপর দরজা বন্ধ করতেই বাজনার সুর আর মানুষের চাপা কথাবার্তা কানে ভেসে এল। সে এফির হাত চেপে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল।

এফি আমাকে দেখে কি তুমি খুশী হওনি? হাসিমুখে করিডন জিজ্ঞাসা করল। যদিও তুমি ভাব দেখাচ্ছ আগের মতই আছ, তবু আমি বাজি রেখে বলতেপারি, আমার কথা তুমি ভুলে গেছ।

না, না, ভুলিনি আমি। এফি রুদ্ধশ্বাসে প্রতিবাদ করল, সত্যি বলছি আমি ভুলিনি, আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। তবে ভাবতে পারিনি তুমি আবার ফিরে আসবে।

ভুল ভেবেছিলে। আসলে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি এফি।–দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যেন রাতারাতি বড় হয়ে গেছ। দেখতেও সুন্দরী হয়েছ।

নিজের কাটা ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে এফি বলল, এমন করে তুমি বল না, কথাটা সত্যি নয়।

তোমার ঠোঁট ঠিক করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়–একটা ফন্দি তার মাথায় খেলে গেল, অগ্রপশ্চাৎনা ভেবেই সে বলল, কাজটা করতে পারে এমন চেনা লোক আমার জানা আছে। হাতে টাকা জমলে ঠিক করে নেওয়া যাবে। আর বেশিদিন লাগবে না। তবে মাস খানেক লাগতে পারে।

একমাস? এফির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

না একমাসে হবে না। তাহলে ছসপ্তাহ লাগতে পারে। সঠিক জানি না। তবে সব নির্ভর করছে টাকার উপর।

তোমার টাকা তত তোমার নিজের জন্যই লাগবে। কিছু করবার প্রয়োজন নেই। সত্যি বলছি, আমার খারাপ লাগছে না। আমার উপর তোমার দয়া যথেষ্ট আছে।

এখন চুপ কর, এফি-করিডন বলল, আমাকে ওপরে নিয়ে চল। অন্য কোন সময়ে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

এফি করিডনের ঠোঁটে জড়ান চাপা হাসি থেকে রেহাই পেয়ে খুশী হল। সে ছুটে ওপরে উঠে গেল। করিডন তাকে ধীর পায়ে অনুসরণ করে ওপরে উঠে এল।

এই ঘর–এফি বলল তারপর দরজা খুলল। করিডন অন্ধকার ছোট ঘরটাতে ঢুকল। সে বিছানার উপর বসে বলল, আলো জ্বেলল না, বাইরে কেউ অপেক্ষা করছে কিনা দেখতে চাই।

তারপর জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কে লোকটা?–জানলার কাছে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে এফি প্রশ্ন করল।

সেটাই তো জানতে চাই। তারপর দৃষ্টিগোচর হল কানাগলির মুখ আর ক্রিম স্টীটের সামান্য অংশ। দূর হয়ে গেছে রাস্তার আলো-আঁধারি। কিন্তু রাস্তায় কাউকে দেখা গেল না। করিডন আবো অন্ধকারের মধ্যে কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইল। তারপর জানলা দিয়ে বাইরে ঝুঁকে পড়ল। চোখেমুখে বৃষ্টির ছাট এসে পড়তে লাগল।

এ আবার কি করছ?–এফি ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করল।

 ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছি।

পড়ে যাবে। এরকম করো না।

আমার অভ্যেস আছে। পড়ব না। ব্যস্ত হয়ো না।–করিডন জানালা দিয়ে নীচে টালির উপর নামল।

এখান থেকে গলিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটা বাড়ির দরজার উপর চোখ বুলাল করিডন। দেখল একটা বাড়ির দরজায় নিজেকে আড়াল করে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

সে বৃষ্টির মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি ছুটে চলে গেল রাস্তার দিকে। তার আলোয় লোকটিকে এবার চোখে পড়ল। বেঁটে আর মোটা। তার গায়ে ময়লা কুঁতে রংয়ের ফ্রেঞ্চ কোট। মাথায় ব্যারেট ক্যাপ।

করিডন বুঝল, যারা তাকে অনুসরণ করছে এই লোকটা তাদের অন্যতম। আগে কখনো লোকটাকে দেখেনি। সে বর্ষার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে তার বাইরে বের হওয়ার। আর সে নিশ্চিত যে লোকটার সঙ্গী সাথী ধারে কাছে কোথাও অপেক্ষা করছে। বিদেশীর মত দেখতে যে মেয়েটিকে ক্রিড সাথে করে এনেছিল সেও এই দলে।

করিডন এফির ঘরে ফিরে এসে ঠিক করল লোকটাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এসব ব্যাপারে জনি নিশ্চয়ই জানে, ক্রিড কোথায় থাকে সেই বলতে পারবে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

০১.

পরের দিন সকাল দশটা বাজবার কয়েক মিনিট পরে করিডন ক্রিডের ফ্ল্যাটে উপস্থিত হল।

জনি তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও করিডন এমিথিস্টক্লাবের একটা চেয়ারে বসে আর টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাত কাটিয়েছে। পরের দিন সকালে আবার ছাদে উঠে সেই লোকটার খোঁজ করেছে। কিন্তু সন্ধান পায়নি। শেষ পর্যন্ত ক্লাবের পিছন দিককার পাঁচিল টপকে রাস্তায় নেমে ক্রিডের খোঁজে রওনা হয়েছে।

একটা তামাকের দোকান রয়েছে ড্ররী লেনের নোংরা গলিতে, তার উপর তলায় চার কামরাওয়ালা ফ্ল্যাটটা ক্রিড-এর। সদর দরজার সামনে থেকে কার্পেট ঢাকা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। ল্যান্ডিং-এর পাশে ক্রিড-এর ফ্ল্যাটের দরজা।

ক্রিড অনেক বছর ধরে পকেট মারছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে পুলিশ সম্বন্ধে তার আতঙ্ক আছে। যার পকেট মারলে লাভের আশা আছে শুধু তারই পকেট মারে সে। দুআঙ্গুলের সাহায্যে কব্জি থেকে ঘড়ি খুলে নিতে ওভার কোটের পকেটে রাখা টাকার ব্যাগ আর শার্টের হাতা থেকে কাফলিং খুলে নিতে, তার জুড়ি নেই। গলা থেকে নেকলেস অথবা ব্রোচ খুলে নিতে, কিংবা মহিলাদের কাঁধে ঝোলান ব্যাগ খুলে টাকা তুলে নেওয়া তার কাছে ছেলেখেলা। কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারে না। পুলিশ জানে একজন চৌখস পকেটমার ওয়েস্ট এন্ডে পকেট মারছে। তাকে ধরবার জন্য কয়েক বছর হল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সফল হয়নি।

যখন করিডন ক্রিডের ফ্ল্যাটে পৌঁছল, বৃষ্টি থেকে গিয়ে সূর্যের আবছা আলো এসে পড়েছে রংচটা পুরনো বাড়িগুলোর ওপর। খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি অতিক্রম করে সে ক্রিডের দরজার সামনে এসে দরজার গায়ে টোকা মারল। অনেকক্ষণ কোন সাড়া মিলল না, তারপর দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল ক্রিড।

চার বছর ক্রিডকে না দেখলেও করিডন সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারল। মানুষটা সামান্য রোগা হয়ে গেছে।

করিডনকে দেখামাত্র পিছিয়ে গিয়ে ক্রিড দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হল, কিন্তু করিডনের পা ভেতরে থাকায় বন্ধ করতে পারল না।

হ্যালো ক্রিড! মৃদুকণ্ঠে বলল, আমাকে আশা করনি কেমন?

ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল ক্রিডের চোখেমুখে, সে বলল এখন ভেতরে এস না, অসুবিধে আছে।

হাসিমুখে করিডন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর সে বলল, আমাকে চিনতে পারছো তো?

তুমি করিডন না?–ক্রিড সভয়ে বলল, ভেতরে যেও না। এখন বাইরে যাচ্ছি।কথা না শুনলে জোর করে বাইরে বের করে দেব। অন্য কোন সময়ে এস।

হলঘরটার চারিদিকে চোখ বুলাল করিডন। টেবিলে রাখা ফুলদানিতে কেটজার কুন ট্যুলিপ ফুল শোভা পাচ্ছে, লাল আর হলুদ পাপড়িগুলো একটু বেশি ফুটেছে। সে বিস্মিত হল। ফুল আর ক্রিড পাশাপাশি বাস করছে একথা ভাবতেও পারছে না।

কপালের সেই কাটা দাগটা এখনও আছে দেখছি। দাগটা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে করিডন বলল, আরো একটা দাগ হওয়ার সম্ভবনা আছে কিন্তু।

তোমার প্রয়োজন কি জানতে পারি?

 একা আছ?

 হ্যাঁ। আমার গায়ে হাত তুললে ফল ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।

ভেতরে চল। তোমার সঙ্গে কথা আছে। ক্রিড ঘরে ঢুকল।করিডন তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরটা সাজানো গোছানো আর একটা সুগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে আছে। সে বলল, কি করে ভালভাবে থাকতে হয় তুমি জান দেখছি।

ভয় পেয়ে ক্রিড আড়ষ্ট হয়ে সোফার পিছনে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।

তোমার কি হয়েছে বলত? তীক্ষ্ণকণ্ঠে করিডন জিজ্ঞাসা করল, অতো ভয় পাচ্ছো কেন?

ক্রিড বিড়বিড় করে বলল, কিছু না কিছুই হয়নি।

তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়েছ। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, জিনি কে? ক্রিড চুপ করে রইল। সারা ঘরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

আমি জানতে চাইছি জিনি কে? তুমি যাকে এমিথিস্ট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলে–তার কথা বলছি।

চলে যাও তুমি। যদি না যাও আমি পুলিশ ডাকব।

–বোকার মত কথা বল না। মেয়েটা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ম্যাক্সকে। মেয়েটা কে?

মিথ্যে কথা। ক্রিড বলল, মেয়েটা তোমায় চেনেই না, কখনও দেখেও নি। কেন জিজ্ঞাসা করতে যাবে বল, ম্যাক্স মিথ্যে কথা বলেছে।

বেশ মিথ্যেই না হয় হল। কিন্তু মেয়েটা কে?

ক্রিড ইতস্ততঃ করে বলল, তোমার পরিচিত কেউ নয়। মেয়েটা কে তা জেনে তোমার কি লাভ?

তুমি কি চাও, তোমার গায়ে হাত তুলি?-করিডন বলল, আমায় না বললে গায়ে হাত উঠবে বলে দিচ্ছি।

ক্রিড শঙ্কিত হল। সে মুখ বিকৃত করে বলল, গায়ে হাত দেবে না বলে দিচ্ছি, ভাল হবে না।

লোকটা কি বোঝাতে চাইছে এই ফ্ল্যাটে সে একা নয়,করিডন অবাক হল। ক্রিডের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে দরজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। এমনভাবে ক্রিড মাথা নাড়ল যেন অন্য ভাষার কোন মানুষটিকে আকার ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাইছে। আঙ্গুল রাখল ঠোঁটে।

জিনির সম্বন্ধে আমায় বল। উঠে দাঁড়াল করিডন।

বলবার মত কিছু নেই। একজন মেয়ে মাত্র।

ক্রিডের দিকে এক-পা এগিয়ে গেল করিডন, ভেতরে কে আছে? মেয়েটা কি করে? কোথা থেকে এসেছে?

তিনটে আঙ্গুল তুলে দরজার দিকে নির্দেশ করল ক্রিড। সে বলল, মেয়েটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। জোর করে এখানে এসে উঠেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছো? মেয়েটা সুন্দরী। ওকে আগে কখনো দেখিনি।

ওরা তিনজন?-করিডন জিজ্ঞাসা করল।

ক্রিড ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

কালো ব্যারেট ক্যাপ মাথায় কোন লোককে চেন? ক্রিড হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল এমনভাবে যেন করিডন তাকে ঘুষি মেরেছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। চলে যাও এখান থেকে। অনেক দেরী হয়ে গেছে। তোমার সুন্দরী বোধহয় তোমার জন্য এতক্ষণে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

করিডন গলা চড়িয়ে বলল, তোমরা বাইরে বেরিয়ে এস হে। ক্রিড বলেছে তোমরা এখানেই আছ।

ক্রিড মুখে অস্ফুট আওয়াজ করে চেয়ারে বসে পড়ল। ঘরের দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। প্রবেশ করল কালো ব্যারেট টুপি মাথায় সেই লোকটা। তার দস্তানা পরা হাতে একটা পিস্তল।

.

০২.

 জীবনে অনেকবার বন্দুকের মুখোমুখি হয়েছে করিডন। আগের অভিজ্ঞতা তাকে বিভ্রান্ত করে তুলল, কারণ একজন বোকা লোক কত অপ্রয়োজনে বন্দুক ব্যবহার করে। সে বন্দুক তাক করা লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারে কে গুলি ছুঁড়বে আর কে ছুঁড়বে না।

নড়াচড়া করো না,বন্ধু।–কালো ব্যারেট টুপি মাথায় লোকটা বলল, তার কথার টানে করিডন বুঝল লোকটা পোল্যান্ডের অধিবাসী, কোন রকম চালাকি করলে পস্তাতে হবে।তার পিস্তলের লক্ষ্য করিডনের বক্ষের মধ্যস্থল।

দরজার দিকে তাকাল করিডন। মেয়েটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো বুকের উপর ভাজ করা। পরনে কালো সোয়েটার আর স্ন্যাকস কোন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। বেঁটে হলেও শরীরের গঠন সুন্দর। গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে হলুদ আর কালো টানাটানা চোখ দুটি তার রাঙ্গানো ঠোঁট দুটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

ঘাড় পর্যন্ত নামা কালো চুল। কালো টুপী পরা লোকটির চেয়ে মাথায় সামান্য উঁচু। বুক উন্নত আর পাছা সরু। চেহারায় পুরুষালী ছাপ বর্তমান। কাছে না গেলে বুঝতে পারার উপায় নেই যে সে নারী।

হ্যালো জিনি। করিডন হাসল, এই বন্দুক তাকের মানে কি?

বসো। হাত দুটো এমনভাবে রাখ যাতে আমরা দেখতে পাই।–জিনি বলল। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই আমরা।

মুখে হাসি বজায় রেখে করিডন বলল, এই জন্যই কি এতদিন আমায় অনুসরণ করছিলে? তুমি কি কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলে, নাকি মনস্থির করতে পারছিলে না?

জিনি বলল–বস।

কালো টুপি পিস্তল নেড়ে জানালার পাশে রাখা একটা আরাম কেদারা নির্দেশ করে বলল, ওখানে বস।

করিডন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বসে পড়ল। সে বলল, এই বন্দুকবাজির মানে কি?

দরজার সামনে আর একজন পুরুষকে দেখা গেল। লোকটা রোগা লম্বা আর মাথার চুল সোনালী। একটা হাত নেই আর মুখের পাশে চোখের উপর দিয়ে নেমে গেছে গভীর কাটা দাগ।

সব ঠিক আছে তো?–সে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, যদি মনে কর তোমরা পারবে তাহলে আমি চলে যাই।

এই লোকটির সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ বিন্দুমাত্র নেই। সেইংরেজ। সদবংশজাত, লেখাপড়া জানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ আছে। পরনের স্যুটটা নোংরা হলেও সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা, একজোড়া গোঁফ আছে নাকের নীচে।

সব ঠিক আছে। ক্রিডকে দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। রাস্তায় আনা প্রয়োজন।

ঠিক বলেছ।–এক হাতওয়ালা লোকটা কাছে এসে ক্রিডকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। তারপর করিডনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, এর নাম জিনি পারসিগনী। বন্দুক হাতে জন। ওর ভাল নামটা জানি না। আমার নাম রনলি–নিগেল রনলি। আমার অন্য কাজ আছে, চললাম। তোমার সঙ্গে কথা জিনিই বলবে।

ক্রিডকে সাথে নিয়ে রলি এঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে গেল।

তোমার সম্পর্কে আমার কতকগুলো প্রশ্ন আছে উত্তর দেবে কি?–মেয়েটা হঠাৎ প্রশ্ন করল।

কেন দেব?-করিডন বলল, তোমাদের মতলব কি বল তো? তোমরা কারা?

কঠিন আকার ধারণ করল মেয়েটার মুখ। সে বলল, আমরা একজনকে খুঁজছি। তোমাকে দিয়ে সেই কাজটা করাতে চাই। তবে তার আগে জানতে চাই তুমিই সেই লোক কিনা। আমরা ভুলের পাহাড় তৈরী করতে রাজি নই।

আমি কাজ খুঁজছি নাকরিডন বলল, তোমরা আমার সময় নষ্ট করছ।

তুমি টাকা কামাতে চাও না? আমরা ভাল অংকের টাকা দিয়ে থাকি।

কি রকম ভাল শুনি?

এই ধর এক হাজার পাউন্ড। এখন অর্ধেক পাবে, কাজ মিটে গেলে পাবে বাকি অর্ধেক।

এক হাজার পাউন্ড অনেক টাকা। টাকার অংক করিডনকে আগ্রহী করে তুলল, সে বলল, কাজটা কি?

তোমার সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে কি জবাব দেবে? মেয়েটা প্রশ্ন করল।

 প্রশ্নগুলো কি?

তুমি মার্টিন করিডন, বয়স তেত্রিশ বছর, অবিবাহিত আর আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। তাই তো?

হ্যাঁ, তাই

কোনদিন কোন নির্দিষ্ট ব্যাপারে লেগে থাকনি, তাই না। তুমি সকল রকম কাজে পটু। নানা ধরনের কাজ করে অর্থ উপার্জন কর। তুমি জীবন শুরু করেছ বাড়ি বাড়ি গিয়ে অটোমেটিক মেশিন আর পিন-টেবিল বিক্রি করে। এ কাজ শুরু করেছিলে সতের বছর বয়সে। বছর যখন তেইশ থেকে পঁচিশ তুমি কুঁড়েমি করে সময় কাটিয়েছ, প্রচুর রোজগার করতে বিলিয়ার্ড খেলে। তারপর টুরিস্ট গাইড হয়ে আমেরিকার টুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখাতে প্যারিস আর বার্লিন। অনর্গল ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষায় কথা বলতে পার। এই কাজ ছেড়ে দিয়ে একজন ধনী ব্যক্তির দেহরক্ষীর কাজ করেছ, যে সকল সময় ভাবত কেউ তাকে খুন করবে। তবে এইসব করেছ যুদ্ধের আগে। ঠিক বলছি তো?

স্বীকার করতেই হবে দু-একটা পয়েন্ট বাদ গেলেও বাকি সব ঠিক বলেছ। সবিস্ময়ে করিডন বলল।

ওই পয়েন্টগুলোতে পরে আসছি।–মেয়েটা বলতে লাগল, উনিশশো আটত্রিশ সালে তোমাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক অফিসের লোক ভাড়া করেছিল শত্রুপক্ষের রাষ্ট্রদূতের কিছু কাগজপত্র চুরি করার জন্য। কাগজপত্রগুলো তোমার সরকারের কাছে ছিল খুবই জরুরী। তোমাকে সাবধান, করে দেওয়া হয়েছিল যে ধরা পড়লে তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা তারা করতে পারবে না। তুমি সেই শর্তে রাজী হয়েছিলে। যখন সেফ খুলছিলে রাষ্ট্রদূতের সচিব তোমায় দেখে ফেলেছিল।–একটু থেমে মেয়েটি বলল, তুমি তাকে খুন করেছিলে।

চুপচাপ তাকিয়ে রইল করিডন পাশে হাত রেখে।তোমাকে পালাতে দেখা গেলেও কোন রকমে বেঁচে ফিরে এসে কাগপত্রগুলো সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলে। পুলিশ জানত না যে ব্রিটিশের বৈদেশিক অফিস তোমায় নিয়োগ করেছে, তাই তারা প্রায় মাস দুয়েক তোমার উপর নজর রাখে। তাদের ধারণা হয়েছিল যে তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করবে, অবশ্য তুমি সেরকম কিছু করনি। তোমার বিচারের জন্য যে সব প্রমাণ প্রয়োজন ছিল তাদের কাছে তা ছিল না।

–ঠিক বলেছ করিডন বলল, আমার অত মনে নেই।

মেয়েটি বলে চলল, উনিশশো ঊনচল্লিশ সালে তুমি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে যোগ দিয়ে সারা ইউরোপ চষে বেড়াতে। তুমি খবরাখবর দিতে জার্মানীর যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্বন্ধে। একমাস কাজটা করেছিলে,তারপরজার্মান পুলিশ তোমায় সন্দেহকরতেইতুমি দেশে ফিরে আস। পরেকাজটা তোমার ভাল না লাগায় তুমি কাজে ইস্তফা দিয়েছিলে। তারপর যুদ্ধ বেঁধে গেলে সৈন্যবিভাগে যোগ দিলে। ডানফ্রিকে অবস্থানকালে আহত হলে আর পরে হলে একজন গেরিলা যোদ্ধা। ঠিক কিনা?– তোমার ভাল লাগলে বলে যাওকরিডন আরামকেদারায় নড়েচড়ে বসে বলল। দেখছি বলতে টলতে ভালই পার।

ফ্রান্সের কয়েকটা বর্ডার আক্রমণে তুমি ছিলে,মেয়েটি বলতে লাগল। তারপর তোমাকে আরো বিপজ্জনক কাজ দেওয়া হল, গুপ্তচরের কাজ।

গুপ্তচর কথাটা উচ্চারিত হতেই করিডনের চোখের দৃষ্টি কঠিন হল।

তোমাকে অনেকবার প্যারাসুটের সাহায্যে ফ্রান্সে নামানো হয়েছে। তুমি জার্মানীতেও নেমেছ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর তো জোগাড় করেছিলে। কিন্তু তোমার আসল কাজ ছিল যারা খুব ঝামেলা করছিল তাদের শেষ করা। তাদের মধ্যে কিছু ছিল আস্থাহীন আর কিছু জার্মান বিজ্ঞানী। যেসব স্ত্রীলোক যুদ্ধবন্দীদের কাছে যাতায়াত করে তাদের কাছ থেকে খবরাখবর আদায় করত, তোমার উপর ভার পড়েছিল তাদের খুঁজে বের করার। তোমাকে ফ্রান্সে নামানো হয়েছিল তাদের খুঁজে বার করে খতম করার জন্য। সে কাজ তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলে।

করিডনের অতীতের কথা মনে পড়ল। একটা মেয়ে ছিল ছিপছিপে চেহারার আর সুন্দরী। তাকে খতম করেছিল মুখের ভেতর গুলি করে। বুলেটের ধাক্কায় মাথার খুলির খানিকটা উড়ে গিয়েছিল। মুখ হয়ে গিয়েছিল বিকৃত। অতীতের কথা স্মরণ করে তার শরীর ঘেমে উঠল। আর হৃদপিণ্ড বুকের ভেতর লাফালাফি করতে লাগল।

একবার গেস্টাপোর হাতে তুমি ধরা পড়েছিলে, মেয়েটি বলতে লাগল, তোমায় কারা পাঠিয়েছে, আর তোমার উদ্দেশ্য জানবার জন্য তারা তোমার উপর নির্যাতন করেছিল। প্রচণ্ড অত্যাচারের পরেও তুমি মুখ খোলনি। পালাতে পেরেছিলে জার্মানীর বন্ধু দেশে ঢুকে পড়েছিলে বলে। তারপর তোমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তোমার উপর গেস্টাপোরা এমন অত্যাচার করেছিল যে তোমাকে চারমাস মিলিটারী হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

ইতিহাস বলা শেষ কর।–অভদ্রভাবে করিডন বলল, কি চাও তোমরা, আমার সম্বন্ধে তো অনেক কথা হলো। তোমাদের মতলব কি শুনি?

এতক্ষণ যা বললাম সব সত্যি তো?–মেয়েটি বলল, তা এসব তোমার জীবনে ঘটেছিল তো?

ঘটেছিল। তবে আমার কথা থাক, নাহলে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

আর একটা কথা। এই কথাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের পর তোমার কাউকে পছন্দ হয়নি। তুমি ঠিক করেছিলে আমেরিকায় চলে যাবে। কানাডাতে এক বছর ডলার চোরাচালানের কারবার করেছ। তোমার কারবার পুলিশের কাছে গোপন থাকেনি। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে লন্ডনে ফিরে এসেছ। এখানে আছ এক সপ্তাহ হল আর বর্তমানে তোমার হাত একেবারে শূন্য। তুমি কি করবে এখনো মনস্থির করতে পারো নি। অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায়কারী দলের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতে তোমার ভালই লাগে, সেই দল যদি পুলিশের সাহায্যপুষ্ট হয় তবুও। তুমি এখনও মনস্থির করতে পারনি তাই না? একটা কাজ আছে তোমার জন্যে, কাজটা তোমার ভালই লাগবে। এক হাজার পাউন্ড এর বিনিময়ে পাবে।

.

০৩.

 ঘরে ঢুকল রনলি। ট্রাউজারের পকেটে হাত। একঝলক করিডনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিনির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

তোমরা দুজনে কতদূর এগোলে,–সে করিডনকে বলল। তোমার সম্বন্ধে অনেক খবর জোগাড় করেছি কি বল?

হাতে সময় থাকলে যে কোন লোকের সম্বন্ধে খবর জোগাড় করা যায়।

প্রত্যুত্তরে কথাগুলো বলে করিডন পকেটে হাত ঢোকাল।

হাত বাইরে রাখ–তীক্ষকণ্ঠে জন বলল।

না, না, ভয়ের কিছু নেই। ও ঝামেলা করবে না–রনলি বলল।

 ঠিক বলেছ–পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে করিডন বলল, আমি কখনও ঝামেলা পাকাই না। হাসল সে।

বন্দুক সরাও–জিনি জনকে বলল।

বন্দুক সরাব না–জন বলল, ওকে বিশ্বাস নেই।

কাজের কথা বলবার আগে আর একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই–জিনি কোনদিকে কর্ণপাত না করে বলল।

আমি যে ওকে বললাম বিশ্বাস করি না–জন বলল।

জিনি চীৎকার করে বলল, চুপকর। আমি কথা বলছি তুমি চুপ করে থাক।…আর একটাকথা

কথাটা কি?–জানতে চাইল করিডন।

জিনি সামান্য ইতস্ততঃ করে রনলিকে বলল, ওকে জিজ্ঞাসা কর।

হ্যাঁ, করছি অনলি বলল, দেখ, এখনো আমরা নিশ্চিত নই যে তুমিই করিডন, কারণ করিডনের কোন ফোটগ্রাফ হাতে পাইনি। তুমিই যদি করিডন হও তাহলে তোমার পিঠে আর বুকে কালচে জরুলের চিহ্ন আছে, আমরা নিশ্চিন্ত হতে চাই

করিডন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।বড় একঘেয়ে লাগছে। তার চোখে বরফ জমা দৃষ্টি ভাসছে আর দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে রাগে।

বসে থাক চুপচাপ।–জন বলল, নড়াচাড়া করলে গুলি ছুঁড়ব।

করিডন আবার গা এলিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। সে বলল,এভাবে সৎহয়ে বসে থাকতে পারব না। তোমরা জাহান্নামে যাও।

নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে। জন কয়েক পা এগিয়ে এল। রনলি তার পিস্তল ধরা হাতের কব্জি চেপে ধরল।

থাম দেখি–সে চেঁচিয়ে উঠল, ভুল পথে এগোচ্ছি আমরা। তুমি ক্রিডের উপর নজর রাখো গে। যাও, দূর হও এখান থেকে।

জন ঘুরে দাঁড়াল।

আমরা বৃথা সময় নষ্ট করছি। উত্তেজিত কণ্ঠে রনলি বলল, ওর ভার আমাকে দাও। লোকটা চুপচাপ বসে অবজ্ঞাভরে আমাদের দেখছে।

বোকা কোথাকার?-হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জিনি রনলিকে বলল, ভাবছ ওর কাছ থেকে তুমি কথা আদায় করতে পারবে? গেস্টাপোর অত্যাচার যে সহ্য করেছে?

জন চিৎকার করে বলল, বড় বেশী কথা হচ্ছে–ঠিক সেই মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে করিডন তার হাতের কব্জি চেপে ধরে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে মাথায় এক ঘা বসিয়ে দিল। জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

জিনি আর রনলি বন্দুক হাতে করিডনের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তাদের দিকে বন্দুকের নল।

ও ঠিক কথাই বলেছে, আমাদের মধ্যে বড় বেশী কথা হচ্ছে। অনেক হয়েছে, এবার চললাম। হাসল করিডন, নিজের পকেটে বন্দুকটা রেখে দিল। নীচু হয়ে টুপি তুলে নিয়ে বলল, আমি একাই যাব। আবার যদি পরে দেখা হয়, এরকম ভদ্র ব্যবহার করব না।

চমৎকার কাজ। রনলিরকণ্ঠ থেকে প্রশংসাঝরে পড়ল। সে জনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ভেতরে গিয়ে ক্রিডের দিকে নজর রাখো, আজকের দিনটা মাটি করলে।

কোন কথা না বলে জন ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

করিডন চলে যেতে উদ্যত হতে রনলি বলল, আমরা তোমার সাহায্য চাই, এর জন্য টাকা দিতেও প্রস্তুত। আমাদের কথা শোন।

আগে আমাদের নিশ্চিন্ত হতে হবে ও করিডন কি না–জিনি বলল।

হা। রনলি বলল, শোন, যদি আমরা প্রকৃত সত্য না জেনে কথাবার্তা চালাই তাহলে আমাদের ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজটা গোপনীয়। এর মধ্যে আমরা একটা ভুল করে ফেলেছি। ক্রিড হচ্ছে পকেটমার। ও আমার পকেট থেকে ব্যাগ চুরি করে কাগজপত্র থেকে আমাদের উদ্দেশ্য জেনে নিয়েছে। অনেক সময় লেগেছে ওকে খুঁজে বার করতে। তারপর লোকটা আমাকে ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করতে লাগল। তাই আমরা এখানে এসে ওকে পাকড়াও করেছি। এখনো ঠিক করতে পারিনি ওকে নিয়ে কি করব। সুতরাং আমরা আর একটা ভুল করতে পারি না। গেস্টাপোরা যে চিহ্ন তোমার শরীরে এঁকে দিয়েছে তা আমাদের দেখাও। আমরা তোমায় সন্দেহ করছি না। তবে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

করিডন সিগারেটের ধোঁয়া ত্যাগ করল। তারপর একহাতের কোটের আর শার্টের হাতা গুটিয়ে ফেলল। সে বলল, ওরা প্রত্যেক রাতে আমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখত। আমি যাতে ঠাণ্ডা বোধ না করি তাই হ্যান্ড কাফ গরম করে রাখতো। হাতে তারই দাগ, এবার সন্তুষ্ট হতে পেরেছ?

দুজনে পৃথক পৃথক ভাবে হাতের দাগ দেখল। তাদের চোখে আতঙ্ক বা সহানুভূতির ছাপ পড়ল না।

ওদের কাজের তুলনা হয় না। তাই না?অনলি কথাগুলো বলে নিজের মুখের দাগে হাত বুলিয়ে বলল, ওরা গরম বেয়োনেট দিয়ে এই দাগ করে দিয়েছে।

করিডন বলল, অত্যাচার তোমার উপরেও হয়েছে?

হা। জিনির উপরেও হয়েছে। কাছে এসে করিডনের হাতের দাগ পরীক্ষা করে জিনিকে বলল, ঠিক আছে, এ করিডনই। দাগ হ্যান্ডকাফেরই।

হ্যাঁ, ঠিক আছে– জিনি বলল, তাহলে ওকে বল।

রনলি একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, বুঝলে কাজটা একটু বিচিত্র ধরনের। খুব বিপজ্জনকও বলতে পার। তুমি ছাড়া একাজ আর কেউ করতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমরা চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারিনি।

কাজটা কি?

একজনকে খুন করতে হবে। অনলি বলল, আমরা চাই কাজটা তুমি কর।

মেয়েটা বলেছিল, আমরা একহাজার পাউন্ড দেব। অর্ধেক এখন আর কাজ শেষ হলে বাকী অর্ধেক।

করিডনের মনের মধ্যে কথাগুলো আবর্তিত হতে লাগল।

ঘর থেকে জিনি চলে গেছে। রনলি তাকে বলছিল, মনে হচ্ছে আমি একাই কাজটা করতে পারব। তবে তুমি যদি থাকতে চাও

তারপরেই মেয়েটা ঘর থেকে চলে গেল। রনলি কাপবোর্ড থেকে এক বোতল মদ আর দুটো গ্লাস বের করে সামনের টেবিলে রাখল। তারপর সে বলল, জানি এখন পান করবার সময় নয়, তাহলেও একটু পান কর-করবে না?

করিডন ঘাড় নাড়ল। এক ঢোক মদ পান করল।

যা বলব তা সাধারণতঃ নভেলেই পড়া যায় বাস্তব জীবনের সঙ্গে কোন মিল নেই। মেয়েটাও ঠিক তাই। ওকে দেখলে অদ্ভুত মনে হয়, তাই না?

তোমরা সকলেই অদ্ভুত।শীরসকণ্ঠে করিডন বলল, তোমাদের পরিচয় কি? তোমরা কি গোপন সমিতি বা ওই ধরনের কোন সংস্থার সভ্য?

রনলি হেসে বলল, তা বলতে পার। তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। নিজের অজান্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছ সেই জন্যই তোমার সাহায্য আমরা নেব ঠিক করেছি। আমরা জানি, কাজটা না করলেও তুমি আমাদের ছেড়ে যাবে না।

আমি ছেড়ে না যেতে পারি। না হয় নাই যাবকরিডন বলল, তবে তার মানে এই নয় যে কাজটা করব। তুমি কি এ ব্যাপারে সিরিয়াস…?

হা। তোমাকে তাহলে সব কিছু খুলেই বলি।ফ্রেঞ্চ রেজিমেন্ট মুভমেন্টের নারী-পুরুষের মিলিত একটা ছোট গ্রুপের আমরা মাত্র তিনজন বেঁচে আছি। শুরুতে আমরান জন ছিলাম–দুজন ফরাসী পিয়েরী গোর্ভিল আর জর্জ; দুজন ফরাসীনারী জিনি আর কার্লোট,দুজন পোলিশ, লুবিস আর জন; তিনজন ইংরেজ, হ্যারিস, ম্যালোরী আর আমি নিজে।

এই ধরনের নারী-পুরুষের সম্মিলিত গ্রুপের সাথে করিডন সুপরিচিত। এদের অনেকের সান্নিধ্যে সে এসেছিল গুপ্তচরবৃত্তি গ্রহণ করার পর। তারা প্রত্যেকেই ছিল চৌখস, দেশভক্ত, অত্যন্ত গোঁড়া আর তাদের যখন যা বলেছে কোন প্রশ্ন না করে তাই করেছে।

আমাদের কাজ ছিল ট্রেন লাইনচ্যুত করা। অনলি বলল, সারা দেশে আমরা ঘুরে বেড়াতাম। দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতে হত। কাজ যা করবার করতাম রাত্রে। আমরা অনেক ভাল কাজও করেছি। আমাদের দলপতি ছিল পিয়েরী গোর্ভিল। মানুষটা ছিল আলাদা ধরনের এবং অনমনীয়। ভাল ছিল লোক হিসাবে। ও আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠ করে তুলেছিল।

এক ঢোক মদ পান করল করিডন। তার মনে পড়ছে, এমন একজন লোকের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে চুপচাপ তাকিয়ে রইল।

জিনি আর গোর্ভিল পরস্পরকে ভালবাসত। রনলি বলল, আমি চাই তুমি জিনিকে বুঝতে চেষ্টা কর। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।

ওরা মনে প্রাণে ছিল অভিন্ন। ওদের মত আর কাউকে আমি দেখিনি। হা ওরা পরস্পরকে ভালবাসত। কিন্তু আমরা ভালোবাসা বলতে যা বুঝি ঠিক সে ধরনের ভালবাসা ওদের মধ্যে ছিল না। তার চেয়েও বেশী কিছু। যদি বলতে চাও বলতে পার মনের, দেহের আর আত্মার একীভূত হওয়া; ওরা একজন আর একজনের জন্য মরতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিল।

তোমাদের মধ্যে কেউ গোর্ভিলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাই না?

 সত্যিই ওর জীবনে তাই ঘটেছে।

 এসব তোমাদের ব্যাপার। হুইস্কি শেষ করেকরিডন বলল, আমাকে এর মধ্যে কেন জড়াচ্ছ?

বলছি, রনলি বলল, তবে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলব। জিনি, ম্যালোরী আর আমি শত্রুপক্ষের হাতে একবার ধরা পড়েছিলাম। আমাদের বন্দী করে গেস্টাপোর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওরা জানত আমরা পিয়েরীর দলভুক্ত। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করল। পিয়েরীকে ওরা চায়। ওদের কথায় আমরা কান দিলাম না। ও আছে বলেই তো আমরা আছি। যতক্ষণ ও বেঁচে আছে, ট্রেন লাইনচ্যুত ঠিকই হবে। আমার কাছ থেকে যখন কথা আদায়ের চেষ্টা করছে তখন জিনি আর ম্যালোরী সেখানে উপস্থিত ছিল। ওদের কাছে সেই অত্যাচার নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কঠোর মনে হয়েছিল। আমি তেমন সাহসী ছিলাম না। ওদের অত্যাচারে বার দুয়েক আর্তনাদ করে উঠেছিলাম।

এসব ব্যাপারে ওরা একজনকেই বেছে নিত। করিডন হেসে বলল।

হা। পিয়েরীর হদিস জানতে চাইল। মুখ খুললাম না। শেষ অবধি আমাকে নিয়ে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপর জিনিকে বেছে নিল। আমরা জানতাম ওর কাছ থেকে কোন কথা আদায় করতে পারবে না এবং নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও পারেনি। এমন কি ওর মুখ থেকে একবারের জন্যও যন্ত্রণা কাতর চিৎকার বের হল না। তারপর আমাকে নিয়ে পড়ল। একটা হাত ভেঙ্গে দিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। পরে জিনির মুখে সব শুনেছি। সহসা উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল রনলি, গেস্টাপোরা ম্যালোরীকে চেপে ধরতেই ও বলল, তারা যা জানতে চায় সব জানাবে ও।

সামান্য সময় চুপ করে থেকে সে বলল, ওরা আমার একটা চোখ নষ্ট করে দিল আর নষ্ট করে দিল একটা হাত। আর জিনির কথা কল্পনা কর, জিনির কি অবস্থা ওরা করতে পারে। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল এত দিন যা করেছি সব বৃথা।

রনলি জানালার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল, অত্যাচারের পর আমাদের তিনজনকেই একটা সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তখন আমার অর্ধচেতন অবস্থা আর জিনির প্রচণ্ড রক্তপাত হচ্ছে। আমাদের এড়িয়ে চলতে লাগল ম্যালোরী। ওর গায়ে গেস্টাপোরা হাত তোলেনি। জিনির দিকে তাকানো যাচ্ছিল না, বার কয়েক চেষ্টা করেছিল ম্যালোরীকে ধরতে। চিৎকার করে কাঁদছিল আর অনর্গল গালাগাল দিচ্ছিল ওকে, কিন্তু এতো দুর্বল হয়ে পড়ছিল যে ম্যালোরীর কাছে পৌঁছতে পারছিল না। আমার জীবনে যত রাত এসেছে সেই রাতটাই ছিল ভয়ঙ্কর। ম্যালোর মাত্র একবার কথা বলেছিল, তোমরা বুঝতে পারছ না বোকার দল, ওরা দিনের পর দিন এভাবে অত্যাচার চালাত। আমাদের মধ্যে একজন ঠিকই বলে ফেলত। পিয়েরী ঠিক বুঝবে;একেই বলে যুদ্ধের নিয়তি।

করিডনের কানে সব কথা পৌঁছল না। তার চিন্তা পাঁচশ পাউন্ড নিয়ে। যা দেবে বলেছে তারা, তার চেয়ে বেশী পাওয়া উচিৎ। দরদস্তুর সে ভালই করতে পারে। হ্যাঁ, দর একটু বেশীই হাঁকাতে হবে। যদিও শুধুমাত্র রনলিকে নিয়ে কাজ করতে তার কোন অসুবিধা হবে না।

.

০৪.

 তোমাকে ম্যালোরীর ব্রায়ান ম্যালোরীর কথা অবশ্যই বলা প্রয়োজন। অনলি গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলল, ও ফাইটার প্লেন চালাত। বন্দী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তার চরিত্রে কোনদিন দুর্বলতার ছাপ দেখা যায় নি। দেখতে শুনতেও চমৎকার। বয়স হবে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ, লেখাপড়া জানা আর প্রভূত অর্থের মালিক পিয়েরী একবার তাকে বলেছিল সে ভাল কর্মীদের মধ্যে একজন বলে মনে করে। বেছে বেছে কঠিন কাজগুলো করতে সে এগিয়ে যেত। তার সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে মানুষটা সাহসী, অদম্য আর অনমনীয়।

 এই ধরনের লোকের দেখা আমি আগেও অনেক পেয়েছি।করিডন বলল, বিপদ হবার আগে পর্যন্ত ওরা ঠিক থাকে, তারপরেই দেখা যায় ওরা একেবারে অপদার্থ।

ম্যালোরী সম্বন্ধে তেমন কথা খাটেনা। অনেকবার ওর উপর চাপ এসেছে। কোন রকম ক্ষতির কারণ না হয়ে ফিরে এসেছে। ঈশ্বর জানেন সেই রাতেওর কি হয়েছিল! সে গেস্টাপোদের কাছে বলে দিয়েছিল পিয়েরীকে কোথায় পাওয়া যাবে আর সঙ্গে কারা আছে; কালোট আর জর্জ ছিল ওর সঙ্গে। সৌভাগ্যবশতঃ লুবিস, জন আর হ্যারিস অন্য কাজে বাইরে গিয়েছিল, তাই ধরা পড়েনি। তবে সে প্রত্যেকের চেহারার বর্ণনা দিয়েছিল।

এ ঘটনা কতদিন আগের?

 প্রায় আঠার মাস আগের।

 ধরা পড়েছিল গোর্ভিল?

হা। জর্জ আর কার্লোট খণ্ডযুদ্ধের সময় মারা যায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা পিয়েরীকে জীবন্ত ধরেছিল। বন্দী ছিল গেস্টাপোদের হাতে, দু সপ্তাহ আগে ওকে হত্যা করেছে।

তোমাদের জীবনে কি ঘটল?

আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল বলতে হবে। একদিন বিমান আক্রমণ হয়, বন্দীদের ক্যাম্পে বোমা পড়ে। আমাদের চিনতে পারেনি বলে পালাতে পারি।

আর ম্যালোরী?

সেও পালায়। আমাদের ফেলেই পালিয়েছে। হা। দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ জিনি। ওর ব্রেন ফিভার হয়েছে। মাঝে মাঝে কিছুই স্মরণ করতে পারে না। একটা বিশ্বাস ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একদিন না একদিন ম্যালোরীর দেখা সে পাবেই। আমাদের মিলিত সিদ্ধান্ত তাকে খুঁজে বের করতেই হবে আর এ ব্যাপারে অন্য কোন লোকের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।

কিন্তু এর মধ্যে আমাকে টানছ কেন?

বলতে পার এটা আমার পরিকল্পনা। বাকি দুজনের এ পরিকল্পনা মনোমত নয়।কার্লোটের সঙ্গে জনের বিয়ে হয়েছিল। ম্যালোরীকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত কারণ আছে। জিনিরও তাই। আমার এ ধরনের কোন দাবী নেই, তবে আমি ওদের কথা দিয়েছি লোকটাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করব।

বাকি দুজন? তারা কোথায় আছে?

ওরা মারা গেছে। গত সপ্তাহে ম্যালোরী ওদের খুন করেছে।

করিডনের দুচোখে সামান্য আগ্রহ ফুটে উঠল। সে বলল, গত সপ্তাহে? তুমি বলতে চাইছ–এখানে, এই লন্ডনে?

হা। ম্যালোরী যে এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে তা আমরা ভাবিনি। লুবিসকে পাওয়া গেছে রেললাইনের উপর। আর হ্যারিসকে মৃত অবস্থায় একটা পুকুরে ভাসতে দেখা যায়। ম্যালোরী জানে আমরা ওকে খুঁজছি। আমাদের কাউকে ও রেহাই দেবেনা। এ অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন অন্যের সাহায্য। তুমি ওকে শুধু খুঁজে বের করে দাও। বাকি কাজ আমরা করব। এই কাজের জন্য এক হাজার পাউন্ড দিতে চাইছি।

এটা খুন খারাপির ব্যাপারে দাঁড়াবে,করিডন বলল, সে কথা ভেবে দেখছ?

 হফম্যান বা আরো কয়েকজনকে যে তুমি হত্যা করেছিলে, ও গুলোকেও কি তুমি খুন বলবে?

না। ওই খুনগুলো করা হয়েছিলো আইন সঙ্গত ভাবে। এখন যদি আমি কাউকে খুন করি তাহলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে, বিচার হবে এবং খুব সম্ভব ফাঁসি কাঠে ঝোলান হবে।

দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যার ঘটনা সাজান যেতে পারে,-রনলি বলল, ও আমাদের দলের দুজনকে ওই ভাবে খুন করেছে।

করিডন এক চুমুক হুইস্কি পান করে বলল, তবু ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। যুদ্ধের সময় একজনকে হত্যা করা এক জিনিস আর এখন ওকে খুন করলে অন্য জিনিস দাঁড়াবে।

সিগারেট নিবিয়ে রনলি বলল, এমন এলোপাথাড়ি আলোচনা করে কোন লাভ হবে তুমি কাজটা হাতে নাও, অথবা নিও না। কি করবে বল?

এক হাজারে এ কাজ করা যাবে না।

রনলির চোখ দুটি জ্বলে উঠল। সে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, তার মানে তুমি কি?

ঠিক তাই। তুলনামূলকভাবে দেখতে গেলে এক হাজার যথেষ্ট নয়। নিজের জীবন বিপন্ন করতে হচ্ছে। এর মূল্য এক হাজার পাউন্ডের বেশী বলেই মনে করি।

বেশ-পনের শ পাবে।

 সামান্য ইতস্ততঃ করে করিডন বলল, ঠিক আছে ওই টাকাতেই কাজটা হাতে নিলাম। ভেবেছিলাম তুমি আরো বেশী টাকা দেবে।রনলি হেসে বলল, জানতাম তুমি কাজটা হাতে নেবে। আমি বাজি ধরেছিলাম।

এখন অর্ধেক আর কাজ শেষ হলে বাকি অর্ধেক।

.

০৫.

 ক্রিড ঘরে এল। করিডনের দিকে তাকিয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগল। জিনি আর জনের সঙ্গে আলোচনা করবার জন্য রনলি তাকে পাশের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।

মুখ বুজে চুপচাপ বসে থাককরিডন বলল, আমাকে বলা হয়েছে তোমার উপর নজর রাখতে।

ওরা আমাকে নিয়ে কি করতে চায় বলত? তার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ, তুমি তো জান ওরা কি জন্য এসেছে, জান না? তুমিও কি ওদের মধ্যে আছ নাকি?

করিডন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, খুব সম্ভব জানি। ওরা তোমাকে নিয়ে ঠিক কি করবে বলতে পারছি না। তুমি একেবারে বোকা, তাই ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করেছিলে।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি বুঝব কি করে বল? মেয়েটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, ও যা ইচ্ছা করতে পারে। মনে হচ্ছে মাথায় গোলমাল আছে।

তুমি বিদেশীদের সঙ্গে তো কোনদিন মেলামেশা করনি তাই বুঝতে পারছনা, আসলে মেয়েটার মাথায় কোন গোলমাল নেই।

ওরা এখানে আছে চারদিন হল। আমাকে একেবারে একা ছাড়ে না। কোন গোপন রাখা যাচ্ছে না। এসব বরদাস্ত করতে পারছি না। এর যে শেষ কোথায়?

রনলির পকেট মারা তোমার উচিৎ হয়নি।

লোকটা বুঝি এইসব তোমায় বলেছে।

বলেছে তুমি একজন পকেটমার আর ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করেছিলে।

হাত টানাটানি চলছিল যে। ওদের এদেশে থাকা ঠিক নয়।কাগজপত্রে গোলমাল আছে। গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারে। আমি–আমি শুধু পঞ্চাশ পাউন্ড চেয়েছিলাম।

ঘাটিয়ে ঠিক করনি। আমার কাছে কাঁদুনি গেয়ে কোন লাভ হবে না। তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না।

ক্রিড অস্থিরভাবে পায়চারী থামিয়ে বলল, জান ওরা আমায় বিশ্বাস করে না, এই হচ্ছে অসুবিধে। বাইবেল ছুঁয়েও প্রতিজ্ঞা করতে চেয়েছি যে ওদের কোন ক্ষতি করব না।

কাছে বাইবেল আছে?–মুচকি হেসে বলল করিডন।

না, নেই–তবে ওরা তো একটা কিনতেও পারে। আমি বলেছি দাম দেব।–ক্রিডকে অসহায় দেখাল, ওরা আমাকে একেবারে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তুমি বরং আমাকে হুইস্কি দাও।

ক্রিডের কানে গেলনাকরিডনের কথা। সেবলতে লাগল, ম্যালোরীনামে একজন লোককে ওরা খুনকরতে চায়।যদি খুনকরেতাহলে ব্যাপারটা খুনের পর্যায়ে পড়বে।আমি আড়াল থেকে সব শুনেছি। ওদের মধ্যে মেয়েটা সবচেয়ে বেশী বিপজ্জনক। কি রকম যেন কঠিন হৃদয়া।ওরা যদি ম্যালোরীকে মারতে পারে তাহলে আমাকেও পারবে। ভয়ে দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না।

একটু মদে চুমুক দাও।–করিডন বলল, তোমাকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মনে হচ্ছে।

তোমার কি মনে হয় ওরা আমাকে খুন করবে? পোলিশ লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে, মনে মনে ও কোন মতলব ঠাওরাচ্ছে।

করিডন গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে ক্রিডের হাতে দিল। তারপর সে বলল, বোকামী করো না। মন শক্ত কর, যা ভাবছ ওরকম কিছু ঘটবে না।

এই চিন্তা আমায় পাগল করে তুলেছে। আমার উপর কড়া নজর রেখেছে। মেয়েটা অমানুষ। ওর চরিত্র সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণাই নেই।

জিনিকে সাথে নিয়ে রনলি ঘরে ঢুকল। ক্রিড সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

তুমি কি ভেতরে জনের কাছে যাবে? রনলি ক্রিডকে বলল, তোমাকে এঘর ওঘর করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। এর জন্য তুমিই দায়ী, কি বল?

আমি যাব না–ক্রিড চেঁচিয়ে উঠল; যথেষ্ট হয়েছে। দয়া করে এবার বিদায় হও। ঠিক এমন সময় জন ঘরে ঢুকল।

এসজন কঠিন কণ্ঠে ক্রিডকে বলল। বাধ্য ছেলের মত পাশের ঘরে চলে গেল ক্রিড। জন ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

.

০৬.

 ওর ধারণা হয়েছে, তোমরা ওকে খুন করবে।–করিডন বলল।

 আমরা ঠিক করেছি তুমি যে টাকা দাবী করেছ আমরা তাই দেব। মেয়েটি বলল।

বিস্ময় আর আনন্দে ক্রিডের কথা করিডনের মন থেকে মুছে গেল। সে কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, এখন অর্ধেক আর বাকি কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সাতশো পঞ্চাশ পাউন্ড?

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ।

করিডন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জিনির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর সে বলল, বেশ এখন তোমরা যা করতে বলবে আমি তাই করব। এখন আমার প্রয়োজন মালোরর একটা ফটো অথবা তাহার দৈহিক বর্ণনা। তাকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে বলতে পারবে নিশ্চয়ই?

আমাদের কাছে ওর কোন ফটো নেই, তবে চেহারার বর্ণনা এক টুকরো কাগজে লিখেছি। রনলি বলল, ওকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবেনা। আমাদের হাতে মাত্র দুটো সূত্র আছে, লুবিস আর হ্যারিস সেগুলো জানত বলে ম্যালোরীকে খুঁজে বের করতে পেরেছিল। তোমাকে চেষ্টা করতে হবে একা আর খুব সাবধানে।

হাসল করিডন। রনলি যখন কথা বলছিল জিনি তাকে নির্বিষ্ট মনে লক্ষ্য করছিল। মেয়েটির এই খুঁটিয়ে দেখা তাকে বুঝিয়ে দিল যে, নিজেকে সাবধানে এগোতে হবে। সে বলল, বেশ তো সাবধানেই এগোব। সেই সূত্রগুলো কি?

ওরমাসীর একটা ঠিকানা।ম্যালোরীআমাকে দিয়েছিল এই ভেবে যে যদি কোনদিনও মারা যায় তাহলে যাতে খবর পৌঁছে দিতে পারি। আর ওর প্রেমিকার নাম। ওর মাসী থাকে ওয়েন ডোভারের কাছে। তোমাকে দেববলে ঠিকানা লিখে রেখেছি। লুবিস এই ঠিকানায় ওর মাসীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।পরেতার দেহখণ্ড খণ্ড অবস্থায় রেললাইনের উপরে পাওয়া যায়।এর থেকেআমার ধারণা হয়েছে বিসযখনওরমাসীরকাছেযায় ম্যালোরীওখানেইছিল।রীটাঅ্যালেন ম্যালোরীর প্রেমিকার নাম, রিজেন্ট স্ট্রীটে ম্যাস্টিস অ্যান্ড রবার্ট নামে একটা হরেক রকম জিনিসের দোকানে চাকরীকরে। মোজার কাউন্টারে বসে। হ্যারিস তার কাছে গিয়েছিল। তার দেহ পরদিন পাওয়া গেছে উইম্বলডন কমনের কাছে একটা পুকুরে। সম্ভবতঃ রীটা অ্যালেন সেই অঞ্চলের বাসিন্দা। মাত্র এই দুটো সূত্রই আমাদের হাতে আছে। এরপর থেকে তোমাকে এগোতে হবে।

আশা করি এই দুজনের একজনের কাছে ম্যালোরীর হদিশ পাবে। করিডন বলল, ঠিক আছে দেখা যাক কি করতে পারি। সম্ভবতঃ তোমরা এইখানেই থাকবে। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলব।

আমরা এখানে থাকব কিনা বলতে পারছি না। থাকতেও পারি, অন্য কোথাও যেতেও পারি। রনলি বলল, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখ। যদিও আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা খুব কঠিন।

হাসল করিডন, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি পালাব না। কাজ শুরু করব। মনে হচ্ছে কাজটা খুব আকর্ষণীয় হবে। পকেট থেকে পিস্তল বের করে সামনের টেবিলের উপর রেখে সে বলল, পিস্তলটা রেখে যাচ্ছি। জনের কাজে লাগতে পারে। আমার নিজের বন্দুক আছে। ম্যালোরীর চেহারার বর্ণনা তোমার কাছে আছে বললে না?

রনলি পকেট থেকে একটা খাম বের করে বলল, এর মধ্যে সব পাবে।

করিডন হাসল। খাম, টিপে দেখে সে বলল, সব? টাকাও? না, টাকা আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল এখন অর্ধেক–বলনি?

জিনি কাপবোর্ডের কাছে গিয়ে ভেতর থেকে একটা চামড়ার ব্রীফকেস বের করে এনে বলল, তোমাকে চুক্তিপত্রে সই করতে হবে।

নিশ্চয়ই করব।

রনলি কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল।

ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করল, টেবিলের উপর টাকাটা রাখলে হয় না? তোমাদের অবিশ্বাস করছি ভেব নাব্যাপারটা স্রেফ ব্যবসা। তাই না?

জিনি তিন বান্ডিল এক পাউন্ডের নোট টেবিলের উপর রাখল। আঙ্গুলগুলো বন্দুকটার কাছে রাখল। করিডন চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবার ইচ্ছা থাকলে কি বন্দুকটা ফিরিয়ে দিতাম?–জিনিকে করিডন বলল।

টাকা গুনে নাও। জিনি বলল।

তোমরা তো চাইছ কাজটা আমি করি তাই না, করিডন বলল–আমাকে কাজটা দিতে তোমাদের একবারও বলিনি। তাই কাজটা যদি আমাকে দিয়ে করাতে চাও টাকা দিতেই হবে।

টাকা গুনে নাও।মেয়েটার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য।

গুনছি। টাকা গুনে কাগজে সই করে করিডন বলল, চললাম এখন। আমরা এমিথিস্ট ক্লাবে কাল দেখা করতে পারি কি বল?–উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল, আশা করি তোমাদের জানাতে পারব কতটা এগোতে পেরেছি, তাই না?

ঠিক আছে। রনলি বলল, আমরা চটপট কাজ চাই। টাকাগুলোর মূল্য আমাদের কাছে অনেক।

আমার দায়িত্ববোধ আছে।

 তোমার উপর নির্ভর করছি।

ঠিক আছে। আমার সই করা চুক্তিপত্র তোমার কাছে। জিনি কিছু বলল না, সে কঠিন দৃষ্টি মেলে করিডনের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাহলে চলি। করিডন বলল, খুব শীঘ্র দেখা হবে। তারা কিছুই বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল।

রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে করিডন লক্ষ্য করল, তামাকের দোকানের লোকটি সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে টাওয়ার তৈরী করতে ব্যস্ততার দিকে তাকালে করিডন চোখ টিপল।