সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে আটটা
খোঁজা কবরখানার পাহারাওলা ইয়াকুব খাঁ যখন দেউড়ির ঘণ্টা ঘড়িতে মগরেব ঘোষণা করছিল, তখনই সবুজ রঙের গাড়িটা এল। এসে সামনের ফাঁকা ঘাসের জমিতে দাঁড়িয়ে গেল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধ্যার আবছায়া গায়ে ছুঁতে না। ছুঁতেই পোকামাকড়গুলো ঘুম থেকে জেগে একটা ঘুমঘুম আচ্ছন্নতার জাল বুনতে থাকল। আলোহীন নির্জন এই জায়গায় দ্রুত সাড়া পড়ে যাচ্ছিল যথাবিহিত সব অলীক উপদ্রবের। আড়াইশো বছরের পুরনো চরিত্রেরা এবার নিজের হাড় খুঁজে বেড়াবে এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। এবং বুড়ো পাহারাওলা ইয়াকুব খাঁ মাঝে মাঝে খাঁটিয়া থেকে চকিত হয়ে চেঁচাবে—কৌন হ্যায় রে শালালোক? ভাগ, ভাগ্! অবশ্য তার ছোরি বিবি, সিতারার মতে–সবই বুঢঢাকা খোয়াব। বৃদ্ধের স্বপ্ন!
গাড়িটা দেখে অবাক হয়েছিল ইয়াকুব। সচরাচর মুর্শিদাবাদ শহরের একটেরে বসতিহীন ঘন জঙ্গলের এই অখ্যাত খোঁজা কবরখানায় কোন ট্যুরিস্ট আসে না। তারা সবাই অদূরে কাটরা মসজিদ আর মুর্শিদকুলি খাঁর কবরটা দেখেই চলে যায়। কোন স্থানীয় গাইডও এই কবরখানা দর্শনীয় তালিকায় রাখে না।…তো উও হ্যায় মুখসুদাবাদ নবাব বাহাদুরোকা পেয়ারা ইয়ার ঔর গোলাম লোগোঁকা গোরবহৎ মামুলী! এবং ইয়াকুব ক্ষোভে-দুঃখে আফসোসে ছটফট করে। গাইড লোকগুলো তার অকারণ দুশমন হয়ে জন্মেছে। তার ন্যায্য হক বা পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে ওরা। ট্যুরিস্টরা সবখানেই পাহারাওলা বা সেবকদের পয়সা বখশিশ দেয়। বেশ কামায় অনেকে। জাফরাগঞ্জের ওদিকে ইয়াকুব খার এক ভাই আছে। সে তিনটে সাইকেল রিকশার মালিক হয়েছে। ইয়াকুবের কিছু হল না। আগে নবাব বাহাদুরদের রবরবা দু-চারবার পালাপরবে দরবারে সেলাম দিতে গেলে অনেক ইনাম-বখশিশ মিলত। টাকা পোশাক-আশাক আর উৎকৃষ্ট খাবারদাবার পেত। ইংরাজ চলে যাবার পরও কিছুদিন এরকম সুখ ছিল ইয়াকুবের। তারপর দিনে দিনে অবস্থা বহুৎ খারাপ হয়ে গেল। খাস মোতিঝিল প্যালেসই এখন পড়োপড়ো দশা–দেয়ালে ফাটল। লনের বিদেশী ফুল-ফলের গাছগুলো মুড়িয়ে যাচ্ছে গরুর পাল। দরবারখানার বাইরে দেয়ালের আয়নাটা হয়েছে ঝাপসা। ইয়াকুব সেলাম বাজাতে গিয়ে কতবার তার দাড়ি ঠিকঠাক করে নিয়েছে ওটার সামনে। মেঝের দামী নকশাকাটা পাথরগুলো আর নেই। শ্যাওলা আমরুল আর ঘাসের ছবি আঁকছে সবখানে কালান্তক আসমানের মৃত্যুদূত আজরাইল। কেল্লাবাড়ির পাঁচিল ধসেছে। সুরম্য বাগিচা, ফোয়ারা, মীনাবাজার বিলকুল খতম। হারেমের স্কুপে জঙ্গল। সেখানে দিনদুপুরে শেয়াল ডাকে। সাপের খোলস পড়ে থাকে। আর তারই এখানে-ওখানে কিছু কিছু জায়গা সাফ করে টুটাফাটা পুরনো ঘর কিংবা টালির খোপড়ি বানিয়ে বাস করছে নবাবী খানদানের বিষণ্ণ এবং দেমাগী কিছু পরিবার। স্তূপের আগাছায় শুকোতে দেওয়া রঙিন শালোয়ার কিংবা শাড়ি হালকা হাওয়ায় কাঁপতে থাকে। কখনো কোন নবাবনন্দিনী গাছের ছায়ায় বসে দুপুরবেলাটা ভরিয়ে দেয় সেলাইকলের চাপা গরগর শব্দে। কোন ভাঙা ঘরের ভিতর থেকে মধ্যরাতে কে গেয়ে ওঠে দরবারী কিংবা মালকোষ। বর্ষার রাতে কোন ঘরের কোনায় জড়োসড়ো বসে থাকে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে মধ্যবয়সিনী রূপসী বেগমসাহেবা প্রবাসী স্বামী এলাহাবাদে রেলের কেরানি। অভিশাপলানৎ দেয় ঈশ্বর ও মৃত্যুকে, স্বামীকে। হঠাৎ কোথায় সেই কেল্লাবাড়ির মধ্যে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে কোন পুরনো ঘর। অনেককালের এক মাতাল নীলাভ জ্যোৎস্নার স্মৃতি, কিছু চটুল হাসি আর ঘুঙুরের শব্দ, কিছু সেতারের ধ্বনি সমেত কাঁপতে কাঁপতে বিদ্যুতের মতো মিলিয়ে যায় সময়ের কালো জোব্বার ভিতর।
হ্যাঁ–কালো জোব্বা। ইয়াকুব খাঁ মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে। আস্তে আস্তে সেই কালো জোব্বা তার দিকেও এগিয়ে আসছে। এই খোঁজা কবরখানায় তার কালো ছায়া অনেক আগেই পড়ে গেছে। এখন তার পালা। নবাবী এস্টেটের পরিচালক বোর্ড ইয়াকুবের মৃত্যুর দিন গুনছে। এই লোকটি খতম হলেই আর হয়তো কোন পাহারাওলা বা খাদেম (সেবক) রাখা হবে না। এই কবরগুলো এমন কিছু প্রচণ্ড ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করছে না!
সত্যিই করছে না। একবার একজন একলা খামখেয়ালি ট্যুরিস্ট এখানে কিভাবে ছিটকে এসে পড়েছিল। ইয়াকুবের সে কী আনন্দ! …আইয়ে, আইয়ে হুজুর মেহেরবান! দেখিয়ে–পয়লা ইয়ে হ্যায় খোজা নবাব ইসমত-উ-দ্দৌলা কা গোর। উও খোজা নবাব খানখানান রহমত বখসকা। উও খোঁজা বান্দা আমিরুদ্দীন জাহাবাজ…! কিন্তু তাকে হতাশ করে কেটে পড়েছিল ট্যুরিস্ট। এসব আজেবাজে লোকের কবর দেখে কী হবে।
তো কবর ছাড়া আর কী দেখবার আছে মুর্শিদাবাদে! সবখানে শুধু কবর– যত পা বাড়াও কবরে হোঁচট খেয়ে পড়ো। এখানে শুধু মৃত্যুর স্বাদ আর গন্ধ, রূপ আর স্পর্শ। তো হুজুর মেহেরবান, মউতকো ভি সমঝনে পড়ে গা মৃত্যুকেও বুঝতে হয়। না–এ মৃত্যু কোন ব্যক্তির নয়, জনপদ ও জাতির জীবনকে সময়ের এই ধূসর আবছা আয়নার অবলোকন করা চাই, তবেই জানা যায় জীবন কী, কতদূর তার বিস্তৃতি আর শক্তি।…..
গাড়িটা দেখতে দেখতে মনে মনে এমনতরো কিছু বাৎচিৎ চালিয়ে যাচ্ছিল ইয়াকুব খাঁ। তার মধ্যে একটা ছটফটানি অসম্ভব আশা নিয়ে জেগে উঠছিল। আজ এতদিনে এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি-হাওয়ার আসন্নদুর্যোগে, তার বরাত কি খুলে গেল? লেকিন-আফসোস! কোন হ্যাঁজাগ আলো নেই। একটা খুবই পুরনো একচোখা কেরোসিন লানটিন আছে মাত্র। আলো খুবই কম হবে। তবে এই হয়তো দেখনেওয়ালা সমঝদার মানুষের পক্ষে যথেষ্টই। উঠোনে কিছু বড়ো ফলগাছ আছে তাদের তলায় মোট উনিশটি কবর। তিনদিকে উঁচু ফাটা দেয়াল। একদিকে একটা দোতলা দালানবাড়ি–ওপরে নিচে বারোটা ঘর। সব ঘরই পড়ো পড়ো, দেয়ালে গাছপালার শেকড়, বুনো জানোয়ার আর পাখপাখালির নাদি, আবর্জনা, কোনটারই দরজা-জানলায় কপাট নেই–সব লোপাট; কেবল নিচের একটা ঘরে ইয়াকুব তার বউ নিয়ে থাকে–সেটাই মোটামুটি ভালো। এই বাড়িটার লাগোয়া একটা ছোট্ট মসজিদ আছে–যার গম্বুজ ফাটা, মেঝেয় ইয়াকুব লকড়ি সংগ্রহ করে রেখেছে। তার পিছনে গভীর একটা ছোট্ট পুকুর চারদিকে পাঁচিল আর জঙ্গল, ঘাটের পাথুরে সিঁড়ির দেউড়ির পাঁচিল। সিতারা তার ছোকরি বিবি এখানে ইচ্ছেমতো গা খুলে গোসল করে। জলের রঙ ঘন। সবুজ। সেই সবুজ জলের ধারে বসে সিতারা মৃদু সুগন্ধি সাবান মাখে। কখনও সরু ছিপ ফেলে ল্যাটা মাছ ধরে কোন কোন বিকেলে। ইয়াকুব তখন ছাগলের জন্যে জঙ্গলে জামপাতা আনতে গেছে।…
তো ইয়াকুব গাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হুজুর মেহেরবানদের নেমে আসার প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু কয়েক মিনিট কেটে গেল, তবু কেউ নামল না দেখে তার কষ্ট হল। বোঝা গেছে। এবার বাইরে বাইরে জায়গাটা দেখেই কেটে পড়বে নির্ঘাত।
ইয়াকুব আরও এগিয়ে গাড়ির কাছে গেল। তখন শুনল, বাবুসায়েবরা নিজেদের মধ্যে বাৎচিৎ করছেন। দুটি জওয়ান লড়কীও দেখতে পেল সে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হয়তো তাই ওঁরা কেউ নামছেন না। ইয়াকুব আবার সেলাম দিয়ে বলল, কুছু অসুবিধা হবে না হুজুর বারাণ্ডা হ্যায় আচ্ছা। সেখানে দাঁড়ালে সবকুছ সা-সাফ নজর হবে। আইয়ে, নবাব বাহাদুরোঁকা পেয়ারা খোঁজা লোগোকো গোরস্তান হ্যায়।…
গাড়িটা স্টেশন ওয়াগন। যে গাড়ি চালিয়ে এসেছে, সে যে নেহাত ড্রাইভার নয়, বোঝা যাচ্ছিল। খুব চমৎকার একটা আজগুবি ঐতিহাসিক গল্প দ্রুত বানিয়ে নিয়েছে ইয়াকুব খাঁ। সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দেবে এবং ভাল বখশিস আদায় করে ছাড়বে। ইয়াকুব তার দিকে এগিয়ে ফের সেলাম করল।
…কুছু তকলিফ হবে না সাহাব। আসুন, বান্দা ইয়াকুব খাঁ জিম্মাদার আছে।
স্টিয়ারিঙে কনুই রেখে চুরুট টানছিল বাবুসায়েবটি–সে সকৌতুকে হাসল।..শান্ত! এ বুড়ো নির্ঘাত একটা মারাত্মক গল্প ঝাড়বার তালে আছে। ভঙ্গিটা দেখেই ধরে ফেলেছি, বুঝলে?
পিছনের সিট থেকে গোঁফদাড়িওয়ালা একটি যুবক বলল, গেঁথে নিন সোমনাথদা–একটা রিয়েল লাইফ চরিত্র।
তার পাশের যুবকটির গোঁফ এবং একরাশ চুল আছে। সে বলল, ক্যামেরা আপনার পেন বলছিলেন দাদা!
সামনের সিটে দুটি মেয়ের একজন বলল, ওকে হিরো করলে স্মিতাদি কি রাগ করবেন?
সবাই হেসে উঠল। তার পাশের যুবতীটি বলল, আমি কি নায়িকা নাকি? সোমদা বলুন–আমার মতো পেঁচী খেদির রোলটা কী রেখেছেন!
পিছনের গোঁফদাড়িওয়ালা ছেলেটি বলল, কিছুই রাখেননি। এ ছবির কোন স্ক্রিপ্ট নেই। তাই না সোমনাথদা?
ওদের সোমনাথদা জবাব দিল না। ভুরু কুঁচকে কবরখানার উঁচু দেউড়িটা দেখতে থাকল। ফো ছেলেটি বলল, স্ক্রিপ্ট একটা আছে–তবে মনে। দাদা এটাই কি আমাদের ডেস্টিনেশান তাহলে?
উঁ? বলে সোমনাথ মুখ ফেরাল। তাকে অন্যমনস্ক দেখাল।
আমাদের কি এখানেই রাত কাটাতে হবে?
ইয়াকুব খাঁ ঝাঁপিয়ে এল অমনি। .কুছু তকলিফ হবে না হুজুর। অনেক ঘর আছে। লেকিন–হামি সব সাফা করে দেব। দেখিয়ে না, আসমান বিলকুল বুরা বাত বলছে। মালুম হচ্ছে, রাতমে বহুৎ বরষাবে। আইয়ে আপলোক, সব বধ্বস্ত, হয়ে যাবে।
তার আগ্রহ দেখে শান্ত নামে যুবকটি বলল, সায়ন্তনবাবু, লোকটার মনে হচ্ছে প্রচণ্ড খিদে। ওর চোখদুটো দেখুন!
সায়ন্তন দেখে নিয়ে বলল, স্বাভাবিক। …বলে সে দেউড়ির দিকটা লক্ষ্য করতে থাকল। তারপর হাঁসফাঁস করে চাপা গলায় বলল, দাদা! সোমনাথদা! · আপনার হবু নায়িকা! দেখুন, দেখুন!
সিতারা দেউড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। আবছায়া আর মৃদু বৃষ্টির মধ্যেও তার ডোরাকাটা তাঁতের শাড়িটা জ্বলজ্বল করছে, কারণ দূরে গঙ্গাপারের আকাশে তখনও সূর্যের ফেলেযাওয়া কিছু লালচে ছটা ছিল–যা ঝলসে দিচ্ছিল সিতারাকেও।
ইয়াকুব পিছনে ঘুরে ওকে দেখে নিয়ে কড়াস্বরে বলল, যাও। জলদি, লানটিন জ্বালাকে লে আও। তামাশা দেখনেকা টাইম নেহী জি!
সিতারা অমনি সরে গেল। স্মিতা হেসে বলল, ভারি বাধ্য মেয়ে তো। বুড়োর মেয়ে হবে।
পিছন থেকে শান্ত বলল, বাজি। ওর বউ।
স্মিতা বলল, বাজি। হতেই পারে না–মেয়ে। এই শ্রীলেখাদি, চুপ করে আছেন কেন? সায় দিন!
শ্রীলেখা বলল, বউ হতেও পারে।
ইয়াকুব গোমড়ামুখে শুনছিল। এবার বলল, জী মেমসাব, উও আমার বহুবিবি আছে। উনকী দাদা শহরে আস্তাবল বস্তিতে হেকিমসাব আছে–দাওয়াই দেতা বেমারিকা। বহুৎ বড় খান্দান হ্যায় মেমসাব। উওভি নবাব খান্দান হ্যায়। কালেকটার সাহাবকা পাশ মাহিনা-মাহিনা তনখা মিলতা থাবহুৎ দিন আগে। বছর সালমে একদফা নজরানাভি মিলতা ঔর কালেকটার সাহাব, জী হাঁ–খোদ কালেকটার উস রোজ সেলামভি দে। মেরা বহুকী দাদা বড়া আদমী থা। আজ…
শান্ত বলল, উরে ব্বাস! তাহলে তো নবানন্দিনী নিয়ে ঘর করছে বুড়ো।
সবাই হাসল। স্মিতা বলল, বাঃ, চমৎকার! সোমদা, নায়িকা পেয়ে গেলেন।
শ্রীলেখা বলল, বুড়ো সে চান্স দিলে তো? আবার সবাই হেসে উঠল। সেই সময়ে সোমনাথ গাড়ি স্টার্ট দিল। ইয়াকুব দুঃখিত মুখে একপাশে সরে দাঁড়াল। কিন্তু গাড়িটা দেখা গেল একেবারে খোলা দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। কাঞ্চনগাছের তলায় গিয়ে সেটা থামলে ইয়াকুব এক দৌড়ে সেখানে হাজির হল। যদিও এটা বে-আইনি, এবং গোরস্তানের আত্মাদের পক্ষে অসম্মানজনক, তবু ইয়াকুবের এ একটা অযাচিত সৌভাগ্য। সে সতর্কতার দরুন ভাঙাচোরা বিশাল কবাট দুটো টেনে বন্ধ করে আবার সেলাম দিয়ে বলল, আইয়ে মেহেরবান। হামরা বারাণ্ডাপর বইঠিয়ে-খাঁটিয়া হ্যায়। সিঅরা! সিতারা! …সে ডাকতে ডাকতে তিনটে কবর ডিঙিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সেখানে দেশলাই জ্বালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল তার ছোকরি বহু সিতারা।…
এক ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। বৃষ্টিও বেড়েছে। কাঞ্চনতলায় গাড়িটার ওপর একটা ছেঁড়াখোঁড়া তেরপল চাপিয়ে দিয়েছে ইয়াকুব। এবং তার ঘরের লাগোয়া মোটামুটি চওড়া ঘরটা সাফ করে ফেলেছে। সিতারাও তাকে একাজে মদত দিয়েছে। তারপর সোমনাথের দল নিজেদের বিশাল শতরঞ্জি বিছিয়ে আরাম করে বসেছে। কোণে একটা হারিকেন আর স্টোভ জ্বলছে। চায়ের জল। বসানো হয়েছে। জিনিসপত্র যা-কিছু লাগে, সবই ওরা সঙ্গে এনেছিল।
সোমনাথ তার আইডিয়া নিয়ে কথা বলছিল। সেটা খুব স্পষ্ট কিছু নয় অবশ্য। বলছিল, আসলে এ বিষয়ের কোন পূর্বনির্ধারিত স্ক্রিপ্ট সম্ভবই নয়। কারণ, বিষয় হচ্ছে–সময়। না–অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলতে যে পর্ব বিন্যাসের ব্যাপারটা বুঝি, মোটেও তা নয়। আমার এ সময় অবজেকটিভ সম্পূর্ণ ব্যক্তিনিরপেক্ষ। শান্ত, তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। জানো তো আইনস্টাইন বলেছেন সময়ের অতীত-ভবিষ্যৎ কিছু নেই এ নিখিল বিশ্বলোকে সময় চিরবর্তমান একটা সত্তা।…
এসব পণ্ডিতী আলাপে অবশ্য শান্তর কান নেই। সে আলতো দৃষ্টিতে বার বার শ্রীলেখাকে দেখে নিচ্ছিল। আজ সকাল অব্দি এই বিবাহিতা ভদ্রমহিলাকে দেখেনি কিংবা কোনরকম জানাশোনাও ছিল না। সোমনাথের ফ্ল্যাটে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়ে তারপর আলাপ হয়েছে। তার একটু অবাক লেগেছিল তখন। ভদ্রমহিলার স্বামী নাকি একটা ঘড়ি সারানো দোকানের মিস্তিরি–সেই যারা এক চোখে ঠুলি পরে ঝুঁকে বসে থাকে ঘরের কোনায়! এ খবর শান্তকে দিয়েছে সায়ন্তন। সায়ন্তন এখন হাঁ করে সোমনাথের বিষয় গিলছে। সায়ন্তন গুল ঝেড়েছে কি না কে জানে! শান্ত দেখেছিল, শ্রীলেখার সঙ্গে সায়ন্তনেরও আগে আলাপ ছিল না–তার মতোই।
গোলগাল পুতুলগড়ন মেয়ে শ্রীলেখা! নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই মনে হয়। চেহারায় তেলকালিমাখা আবর্তনের ছাপ নেইনতুন টায়ারের স্ফীতি ও টানটান নিটোলতা আছে। যেন প্রচণ্ড গড়িয়ে যেতে তৈরি।
শান্তর মনে হচ্ছিল শ্রীলেখা প্রেমে ও সংসারে যুগপৎ পটীয়সী। অবশ্য সোমনাথ ভট্টের ফিল্ম ইউনিটে তাকে বিস্ময়কর বৈষম্য লাগে। সোমনাথ কী জাদু জানে! এর আগে নাকি তার একটা বাণিজ্যফিল্ম কোন আদার ব্যাপারীর হাতে হারিকেন দিয়ে ছেড়েছিল। তারপর একটা ডকুমেন্টারিতে দারুণ কেল্লা জেতে। তৃতীয় অবদান একটা শর্ট ছবিকার ছোটগল্পের বস্তুরূপ। নাম হয় প্রচুর। বিদেশে কোন জাঁদরেল সিনেক্লাব পিঠ চাপড়ে দেয়। তারপর সোমনাথ ভট্ট ঘোষণা করে–আমার ক্যামেরাই আমার কলম। কিন্তু তার হাতে শ্রীলেখার মতো রীতিমতো গৃহস্থ ভদ্রমহিলা এসে পড়াটা আশ্চর্য লাগে। মেয়েটি নির্ঘাত অ্যামবিশাস!
একটু আগে সিতারাকে উপলক্ষ করে জনান্তিকে শান্ত সায়ন্তনকে বলেছে, কোথাও বোকাবোকা শুদ্ধতা দেখলে আমার আলকাতরা ধেবড়ে দিতে ইচ্ছে করে! সে ইচ্ছে এখন শ্রীলেখাকে ঘিরে ছটফট করছে। অন্তত ওই টলটলে টানটান মুখটা, পুরু ভুরু, ভাসা ভাসা দৃষ্টি!
ইয়াকুব সামনে নেই কিন্তু অনুভব করা যায় ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে। হয়তো দরজার ওপাশে তার ঘরের বারান্দায়, কিংবা চৌকাঠের ওপাশে। নির্জন কারখানায় এই বৃষ্টির রাতে মানুষ পেয়ে সে ভারি খুশি। শান্ত অন্ধকারের ভিতর তাকে একবার খুঁজল।
শ্রীলেখাই রান্নার যোগাড় করছিল। খুব নিষ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তার মধ্যে। সোমনাথ অনর্গল কথা বলছে–তার চুরুট নিভে গেছে। এবং হাতদুটো পলেস্তারা চটে যাওয়া আড়াইশো বছরের দেয়ালে লম্বা ছায়া দোলাচ্ছে।…শান্ত, তুমি কিছু শুনছ না! কিন্তু এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। তোমার রোল খুঁড়ে বের করতে হবে। ..সোমনাথ বলে উঠল।
শান্ত একটু হেসে ইংরেজিতে বলল, জাস্ট ডিগ ইন।
সোমনাথ বলল, তুমি নিশ্চয় মাকড়সা দেখেছ শান্ত?
কে জানে! বলে শান্ত একটা সিগারেট ধরাল।
সায়েন্সের বইতে আলবৎ দেখেছো! …সোমনাথ বিরক্ত হয়ে বলল। মাকড়সার জাল…
শান্ত বলল, আমি বায়োলজি পড়িনি সোমনাথদা। ফিজিকস।
তখন সোমনাথ হাসল। …ঠিক আছে। তোমাকে কাল সকালে আমি ব্যাপারটা দেখাব। যাক গে শোন। এক বেলার জন্যে পথ ফাঁকা পেলেই মাকড়সা জাল বুনে দেয় পথে ঠিক তেমনি প্রকৃতি–তুমি পা তুললেই সেই ফাঁকে সে তুলি বুলিয়ে ঝট করে ঘাস বা গাছের ছবি এঁকে ফেলে। বুঝতে পারছ? সায়ন্তন, পোভড়াবাড়ি আমরা সবাই এখন দেখছি। আমরা এখন তার মধ্যে রয়েছি। এখন কথা হল, সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটা বিশ্লেষণ করলে আমরা সাংখ্যদর্শনে ফিরে যাই।
সায়ন্তন মেধাবী ছাত্রের গলায় বলল, প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব।
চমৎকার!…সোমনাথ নিভন্ত চুরুট জ্বালাতে ব্যস্ত হল।
শান্ত উঠে দাঁড়াল।
স্মিতা বলল, কোথায় যাচ্ছেন? বাইরে?
সোমনাথ বলল, টর্চ নাও। ইয়াকুব, ইয়াকুব!
ইয়াকুবের আওয়াজ এল তক্ষুনি–জি হুজুর!
ইয়াপর ল্যাট্রিন হ্যায়?
জি সাব?
মানে-টাট্টিউট্টিকা কোই বন্দোবস্ত হ্যায়?
ইয়াকুব আবির্ভূত হল। …নেহী মেহেরবান! বাহারমে বহৎ জায়গা হ্যায়। সাফ জমিন হায়, সাব! হাম বদনামে পানি ভর দে। ঠারিয়ে!
সবাই হাসল। স্মিতা চোখ ঠারল শ্রীলেখার দিকে। শ্রীলেখাও চোখের ভাষায় জবাব দিল। ইয়াকুব শান্তকে বলল, চলিয়ে সাব–খিড়কিকা উধার হাম দেখা দেতা! লেকিনবরসাতমে…হুজুর, ঠারিয়ে। ছাতি লাতা হ্যায়। সে লাফ দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
শান্ত বলল, কবরের ভূতগুলো ঘাড় মুচড়ে দেবেনয় তো… সে থেমে গেল এবং হাসল।
শ্রীলেখা অপ্রসবিত অশ্লীলতার আঁচ পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল চায়ের কাপের দিকে। স্মিতা অবশ্য নির্লজ্জ ফিকফিক হাসতে লাগল। সোমনাথ সস্নেহে বলল, শান্তর মধ্যে পরিমিতিবোধ আছে ভীষণ। শান্ত, বেশিদুরে যেও না কিন্তু। আমি এনেছি তোমাদের–আমার একটা দায়িত্ব আছে, মনে রেখো।
শান্ত টর্চ হাতে বেরোল। বাইরে ইয়াকুবের গলা শোনা গেল-লিজিয়ে– ছাতি ঔর বদনা। হাম ভি সাথ-সাথ যাতা আপকা।
শান্ত বলল, না বাবা তুমি চুপচাপ ওদের কথা শোন গিয়ে। কপাল খুলে যাবে। চাই কি হিরো হয়ে যাবে, বুঝেছ? সমঝতা, হিরো কেয়া চিজ হ্যায়?
জি–ইয়ে ঠিক নেহী। আপনি কুছু চিনবেন না সাব। হামি দেখিয়ে দেবে।
মলো ছাই! তুমি শুধু বলে দাও কোনদিকে যাব- ব্যস। আর ওই বদনাটদনা রাখো। দরকার নেই। সোমনাথদা, বুড়োকে ডেকে নিন তো! বড্ড জ্বালাচ্ছে!
সোমনাথ ডাকল, ইয়াকুব! তুম ইধার আও।
ইয়াকুব অভিমানে সরে এল। তারপর বদনাটা অন্ধকারে সিতারা নিঃশব্দে তুলে নিচ্ছেল।
শান্ত চমকে উঠেছিল। বলল, কে?
আমি।
নির্ভুল বাংলা উচ্চারণ শুনে শান্ত অন্ধকার বারান্দার দিকে টর্চ জ্বালল– জেনেশুনেই। সিতারার পিছনটা দেখতে পেল সে দরজায় তারপর একবার ঘুরল। তখন শান্তর বুকে আচমকা এক ঝলক গরম রক্ত ছিটকে উঠেই তক্ষুণি, দারুণ ঠাণ্ডা হয়ে পড়ল। সিতারা হেসে উঠল। যেন বাজারের হাসি-ফুল ও ফলে, পোশাকে, জিনিসপত্রে, সাদা নিয়ন আলোয় ঝলসে ওঠা। কাকে কি ভেবেছিল! কিন্তু..থাক। পরে ভাবা যাবে।
বুক ঢিপঢিপ করতে থাকল কতক্ষণ। সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকল। সামনে সাদাপাথরের একসার কবর একপাশে সরু একফালি ঘাসেঢাকা পথ। পথের দুধারে দিশি ফুলের গাছ। তারপর কাঞ্চনতলায় গাড়িটা সামনে পড়ল। সে গাড়ির পিছনে গিয়ে সস্নেহে মৃদু চাপড় মেরে চাপাস্বরে বলল, হ্যাল্লো, হাউ, ডু ডু? গাড়ির পাশ কাটিয়ে সে উঁচু দেয়ালের ধারে ধারে চলতে থাকল। ডাইনে সার-সার সাদা ধু ধু কবর। একেবারে শেষে পাঁচিলের বাঁকের কাছে একটা খিড়কি দেখল। খিড়কিটা খুলতে গিয়ে সে পিছন ফিরে দালান বাড়িটার দিকে তাকাল। তারপর দ্বিতীয়বার চমকালো দোতলার কোণের ঘরে একপলকের জন্য একটুকরো লাল আগুন–পরক্ষণেই গাঢ় অন্ধকারে আবার ঢেকে গেল। বাড়িটা। সিগারেট খাচ্ছে কেউ? কে সে? ভূতের ভয় শান্তর নেই। কিন্তু এতক্ষণে মনে হল, হঠাৎ কবরখানাটা দারুণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। অলৌকিক অদৃশ্যেরা ফিসফিস করছে পিছনে। বৃষ্টির শব্দের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্রের চাপা শব্দ এই অন্ধকার রাতটাকে রহস্যের সমুদ্রে টালমাটাল নৌকোর মতো দোলাতে শুরু করেছে। তার মাথার ওপর বর্ণবিহীন ছাতাটা মনে হচ্ছে ফুলে ওঠা ভারি পাল–যার ওপর একটা বাঁদর চড়ে বসেছে যেন। হ্যাঁ, একটা বাঁদর! এই অনুভূতি ক্রমশ চেপে ধরল তাকে। উঁচু পাথুরে দেয়াল আর গাছপালা জুড়ে। পালে পালে বাঁদর ছোটাছুটি করছে আর তার ছাতার ওপর ডিগবাজি খাচ্ছে– এই অলীক উপদ্রবের সকৌতুক ভীতি তাকে কিছু হাসাল এবং শিহরিত করল। পা বাড়িয়ে সে ভাবল–এসব কিছু না, স্রেফ নিজেরই বদমাইসি। দোতলার ওই জ্বলজ্বলে আলোটুকুও। আবার একটা সিগারেট জ্বালাল শান্ত। খিড়কিটা আর খুলতে ইচ্ছে হল না। দাঁড়িয়ে ওখানেই সামান্য জৈব নিয়মটুকু পালন করল। এবং ধরে নিল যে চারপাশের অলীক প্রাণীদের এতে যথেষ্ট অপমান ও শায়েস্তা করা হল!
শান্ত ফিরে এসে প্রকাণ্ড কাঞ্চনগাছটার নিচে দাঁড়াল–তাদের গাড়ির পাশে। টর্চের আলোয় দেখল একটা লম্বাচওড়া অসাধারণ কবরের মাথায় গাছটা গজিয়েছে। চমৎকার একটা বেদির মত জায়গা। সে একটুখানি বসার লোভ সামলাতে পারল না। ছাতার ছাদে মোটাসোটা ফোঁটার শব্দ, গাছের পাতা থেকে। পিছলেপড়া বৃষ্টির। মসৃণ কবরের বেদি যথেষ্ট ভিজে এবং প্যান্ট নিশ্চিতভাবে আন্ডারউয়ার সমেত সংক্রামিত হচ্ছে। তবু বসে মৌজ করে সিগারেট টানতে থাকল সে এবং নিচে যে খোঁজা ভদ্রলোকের অসন্তুষ্ট পুরনো শরীর আছে, তার সম্পর্কে কিছু কল্পনা করতে চেষ্টা করল।
সেই সময় মনে হল, খুব কাছে এসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ জ্বালবার সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় সিতারা বলে উঠল, বন্ধ করুন। সিতারা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে টর্চটা নিভিয়ে ফেলার তাড়া দিয়েছে।
শান্ত একহাতে তাকে টানল। লাম্পট্যে নয়, স্বাভাবিক কৌতুকেই। মেয়েটির সম্পর্কে তার কৌতূহল বেড়ে গেছে।
সিতারা আস্তে বলল, আঃ ছাড়ুন! একটা কথা বলতে এলুম।
শান্ত ছেড়ে দিল তক্ষুনি। …বলল, তুমি তো দিব্যি বাংলা বলতে পারো দেখছি!
সিতারা যেন হাঁফাচ্ছিল। …ওসব পরে। একটা কথা শুনুন–আপনারা এখানে থাকবেন না। শহরে চলে যান–অনেক হোটেল আছে। আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি।
শান্ত অবাক হয়ে বলল, থাকব না! কেন?
অত বলার ফুরসৎ নেই। থাকলে বিপদ হতে পারে। ..বলেই সিতারা সাঁৎ করে মিশে গেল অন্ধকারে।… ..
.
শান্তকে গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকতে দেখে সোমনাথ বলল, এত দেরি হল! ভাবলুম, ভূতে ঘাড় মটকে দিল নাকি! সে জোরে হাসতে লাগল। অন্যেরাও।
সায়ন্তন বলল, খুব বৃষ্টি হচ্ছে–তাই না শান্তবাবু?
শান্ত জবাব দিল, তেমন কিছু না। তারপর বসে পড়ল।
শ্রীলেখা বলল, আপনার চা-টা ঢেকে রেখেছি। দেখুন জুড়িয়ে গেছে নাকি!
কাপটা টেনে নিয়ে শান্ত চুমুক দিল। তারপর বলল, খুব গরম আমি খাই না।
সায়ন্তন উঠে দাঁড়িয়েছে। …এবার আমি একবার ঘুরে আসি। ..বলে সে ছাতাটা নিয়ে বেরলো। ইয়াকুব তাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, সোমনাথ মৃদু হেসে হাত নেড়ে নিবৃত্ত করল। ইয়াকুব বসে পড়ল ফের। তার দুচোখে প্রচুর আনন্দ চকচক করছে।
সোমনাথ বলল, হ্যাঁ–শ্রীলেখা, যা বলছিলুম। হরর ত্রাস সম্পর্কে। আমার পয়েন্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ত্রাসের উদ্ভব হয় কখন? যখন নিজেরই, বানানো বস্তু কিংবা রূপের সঙ্গে নিজের সচেতন যোগসূত্রটা হারিয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিই..
সেই মুহূর্তে সায়ন্তন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বলল, দাদা, সোমনাথদা! এ। বাড়িতে কী একটা ব্যাপার আছে!
একটুখানি চুপচাপ হয়ে পড়ার পর প্রথমে সোমনাথের হাসি। শ্রীলেখা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইয়াকুবও।
সায়ন্তন চাপা গলায় বলল, এই বুড়োটা বলল, এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না। কিন্তু এইমাত্র, দেখলুম ওপরের ঘরে কে সিগারেট খাচ্ছে!
শান্তও গম্ভীরভাবে বলল, হ্যাঁ–আমিও দেখেছি।
ইয়াকুব লাফিয়ে উঠল–সিগ্রেট পিতা হ্যায়? আজীববড়া আজীব বাত। হুজুর। আপনোক নীচা কামরা সব তো দেখ লিয়া–বিলকুল জংলী ঔর টুটাফাটা! উপরমেভি এইসা হ্যায়! আইয়ে, দেখ লিজিয়ে!
বলে দৌড়ে সে বেরলো। বাইরে তার চ্যাঁচামেচি শোনা গেল–সিতারা! অ্যাই সিতারা! কঁহা হ্যায় তু?
সিতারার গলাও শোনা গেল।..চিল্লাও মাৎ জি। আদমীনা পাজামা।
সোমনাথ হেসে বলল, কে ওপরের ঘরে সিগারেট খাচ্ছে, তাই নিয়ে– আমাদের মাথাব্যথার কারণ নেই সায়ন্তন। চুপ করে বসো। শ্রীলেখা, খিচুড়ি চাপাও লক্ষ্মীটি। স্মিতা, ওকে ভাই একটু সাহায্য করো। শান্ত, আমার আইডিয়াটা শোন–এখন পুরোটা ধরে ফেলেছি। কাল সকালে আশা করি রোদ্দুর ফুটবে। তখন কাজে লেগে যাব। সোমনাথ আবার হেলান দিল দেয়ালে। চুরুটটা নিভে যাচ্ছিল–জোরে জোরে টেনে উজ্জ্বল করতে ব্যস্ত হল।
সায়ন্তন বসল। বিমর্ষভাবে বলল, কে জানে, চোর-ডাকাতের আড্ডায় পড়া গেল নাকি।
সোমনাথ বলল নেবেটা কী? ক্যামেরা? চোর-ডাকাত কামেরা নেবে না।