১. শেষ পর্যন্ত লালমোহনবাবুর কথাই রইল

॥ ১ ॥

শেষ পর্যন্ত লালমোহনবাবুর কথাই রইল। ভদ্রলোক অনেকদিন থেকে বলছেন, ‘মশাই, সেই সোনার কেল্লার অ্যাডভেঞ্চার থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে রইচি, কিন্তু তার আগে লখ্‌নৌ আর গ্যাংটকে আপনাদের যে দুটো অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে তখন ত আর আমি ছিলাম না। কাজেই সে দুটো জায়গাও আমার দেখা হয়নি। বিশেষ করে লখ্‌নৌ-এর মতো একটা ঐতিহাসিক শহর। আপনারা ত গেছেন সেই কবে, চলুন না এবার পুজোয় আরেকবার যাওয়া যাক।’

ফেলুদার লখ্‌নৌ ভীষণ ভালো লাগে জানি, আর সেই সঙ্গে আমারও। আইডিয়াটা মন্দ না। প্রথমবার যখন যাই, আর আমাদের বাদশাহী আংটির অ্যাডভেঞ্চারটা হয়, তখন আমি খুব ছোট। এখন গেলে লখ্‌নৌ আরও ভালো লাগবে সেটা আমি জানি।

ফেলুদা বলল, ‘আমারও লখ্‌নৌ-এর কথা হলেই মনটা চনমন করে ওঠে। আর অত সুন্দর শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। শহরের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে গেছে এ রকম ক’টা জায়গা পাবেন আপনি? ব্রিজের একদিকে শহরের অর্ধেক, বাকি অর্ধেক অন্য দিকে। তা ছাড়া নবাবী আমলের গন্ধটা এখনও যায়নি। চারিদিকে তাদের কীর্তির চিহ্ন ছড়ানো। তার উপর সেপাই বিদ্রোহের চিহ্ন। নাঃ—আপনার কথাই শিরোধার্য। ক’দিন থেকে ভাবছি কোথায় যাওয়া যায় এবার পুজোয়। লখ্‌নৌই চলুন।’

ফেলুদা আজকাল ভালো রোজগার করে। প্রাইভেট গোয়েন্দাদের মধ্যে ওর নামডাকই সবচেয়ে বেশি। মাসে অন্তত সাত-আটটা কেস আসে, আর প্রতি তদন্তের জন্য দু’ হাজার করে পায়। অবিশ্যি রোজগারের দিক দিয়ে লালমোহনবাবুকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল। একবার বলেছিলেন ওঁর বইয়ের থেকে বার্ষিক আয় নাকি প্রায় তিন লাখ টাকা। তার উপরে নতুন নতুন বই প্রতি বছরই বেরোচ্ছে।

আমরা আর দ্বিধা না করে লখ্‌নৌ যাবার ব্যবস্থা করে ফেললাম। দুন এক্সপ্রেসে তিনটি প্রথম শ্রেণীর টিকিট—রাত ন’টায় বেরোনো, পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় পৌঁছানো। সেই সঙ্গে অবিশ্যি হোটেল বুকিংও টেলিগ্রাম করে ফেলা হল। ফেলুদা বলল, ‘যাবই যখন তখন আরামে থাকব, নইলে ক্লান্তি যাবে না।’

‘কোন্‌ হোটেলে উঠবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

‘হোটেল ক্লার্কস-আওয়ধ।’

‘আওয়ধ? আওয়ধ ব্যাপারটা কী?’

‘আওয়ধ হল অযোধ্যার উর্দু নাম।’

‘লখ্‌নৌ বুঝি অযোধ্যায়?’

‘সেটাও জানেন না? লখ্‌নৌ নামটাও এসেছে লক্ষ্মণ থেকে।’

‘রামের ভাই লক্ষ্মণ?’

‘ইয়েস স্যার। আওয়ধ হল লখ্‌নৌ-এর সেরা হোটেল। একেবারে গুমতীর উপরে। হোটেলের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে।’

‘বাঃ—আইডিয়াল। আওয়ধ অন দি গুম্‌তী। ঠাণ্ডা কেমন হবে?’

‘সন্ধের জন্য একটা পুলোভার নিয়ে নেবেন। অথবা আপনার গরম জহর কোট। আপনি সাহেব সাজবেন না বাঙালি সাজবেন তার উপর নির্ভর করছে।’

‘দুটোই নেব।’

‘ভেরি গুড।’

‘ওখানে ত বাঙালি অনেক?’

‘বিস্তর। ছ-সাত পুরুষ থেকে লখ্‌নৌতে প্রবাসী এমন বাঙালিও আছে। বেঙ্গলি ক্লাব আছে—সেখানে পুজো হয়। বলা যায় না—আপনার অনুরাগী পাঠকও সেখানে কিছু পেয়ে যেতে পারেন।’

‘তা হলে আমার লেটেস্ট বই “সাংঘাইয়ে সংঘাত” কয়েক কপি সঙ্গে নিলে বোধহয় মন্দ হয় না।’

‘কয়েক কপি কেন—এক ডজন নিয়ে নিন।’

৫ই অক্টোবর শনিবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনে প্রচুর ভিড়। রিজার্ভেশন ক্লার্ক দেখলাম ফেলুদাকে দেখে চিনলেন—বললেন, ‘চলুন স্যার, আপনাদের বোগি দেখিয়ে দিচ্ছি। একটা ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্টে তিনটে বার্থ—এই ত? এই যে আপনাদের বোগি। তিন নম্বর কামরা আপনাদের জায়গা—একটা লোয়ার, দুটো আপার বার্থ।’

আমরা গিয়ে আমাদের জায়গা দখল করলাম। বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে এসেছি, তাই ট্রেনে খাবার ঝামেলা নেই। একটা লোয়ার বার্থে আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন, বছর পঞ্চাশ বয়স, মাঝারি হাইট, ঠোঁটের উপর একটা সরু গোঁফ। আমাদের দেখে একটু সরে বসে পাশে জায়গা করে দিলেন। ফেলুদা সেখানে বসল, আমরা দু’জন উল্টো দিকের বার্থে। দশ দিন থাকব আমরা লখ্‌নৌ। মালপত্র বেশি নিইনি; আমার আর ফেলুদার জিনিস একটা বড় সুটকেসে আর লালমোহনবাবুর জিনিস তাঁর বিখ্যাত লাল জাপানী সুটকেসে। বলেন ওটা নাকি ওঁর পাড়ার এক ধনী ব্যবসাদার বন্ধু হৃষীকেশ চৌধুরী জাপান থেকে স্পেশালি লালমোহনবাবুর জন্য এনে দিয়েছেন।

আমাদের সহযাত্রীটি বাঙালি কি না সে বিষয় একটু সন্দেহ ছিল। সেটা দূর হল ভদ্রলোক যখন নিজে আলাপ করলেন।

‘আপনারা কদ্দূর যাবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

‘লখ্‌নৌ’, বললেন লালমোহনবাবু। ‘আপনি?’

‘আমিও লখ্‌নৌ যাচ্ছি। ওখানেই থাকি। আমরা তিন পুরুষ ধরে ওখানেই আছি। আপনারা কি বেড়াতে যাচ্ছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বললেন লালমোহনবাবু।

এবার ফেলুদা বলল, ‘আপনার সুটকেসে দেখছি তিনটি ইংরিজি হরফ লেখা রয়েছে—এইচ. জে. বি.। এরকম অদ্ভুত ইনিশিয়ালস ত বড় একটা দেখা যায় না। আপনার নামটা জিজ্ঞেস করলে আশা করি আপনি বিরক্ত হবেন না।’

‘মোটেই না। আমার নাম জয়ন্ত বিশ্বাস। এইচ-টা হল হেক্টর। আমি ক্রিশ্চান। আমাদের পরিবারের সকলেরই একটা করে ক্রিশ্চান নাম আছে।’

‘ধন্যবাদ’, বলল ফেলুদা। ‘আপনার নামটা যখন বললেন তখন আমাদের নামও বলা সমীচীন। আমি প্রদোষ মিত্র, এটি আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ, আর ইনি আমাদের বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার শাশুড়ির নাম হয়তো আপনারা শুনে থাকবেন। উনি সাইলেন্ট যুগে ফিল্মে অ্যাকটিং করতেন। খুব পপুলার ছিলেন।’

‘কী নাম বলুন ত?’ জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।

‘শকুন্তলা দেবী।’

‘আরেব্বাস’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘তিনি ত যাকে বলে তখনকার দিনে একজন বিখ্যাত স্টার! আমার এক প্রতিবেশী আছেন, নরেশ বোস—এখন বয়স হয়েছে, তবে যুবা বয়সে তিনি-ফিল্মের পোকা ছিলেন। তাঁর কাছে বাঁধানো “বায়োস্কোপ” পত্রিকা দেখেছি। তাতে শকুন্তলা দেবীর বিস্তর ছবি রয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে লেখাও রয়েছে অনেক। তিনি বোধহয় বাঙালি ছিলেন না।’

‘না। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলতে পারেন। আসল নাম ছিল ভার্জিনিয়া রেনল্ডস। তাঁর বাবা টমাস রেনল্ডস ছিলেন আর্মিতে। তিনি লখ্‌নৌতেই পোস্টেড ছিলেন। চোস্ত উর্দু বলতে পারতেন। তিনি একজন মুসলমান বাঈজিকে বিয়ে করেন। তাঁরই মেয়ে হলেন ভার্জিনিয়া।’

‘হাইলি ইন্টারেস্টিং’, বললেন লালমোহনবাবু। ‘কিন্তু তিনি ত বোধহয় টকিতে অভিনয় করেননি।’

‘না। এদেশে টকি আসার আগেই তিনি বিয়ে করে ফেলেন একজন বাঙালি ক্রিশ্চানকে। তারপর প্রথম সন্তান হবার পরই শকুন্তলা দেবী ছবির কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম দুটি সন্তান ছিল মেয়ে, তৃতীয়টি ছেলে। আমি দ্বিতীয় মেয়েকে বিয়ে করি ১৯৬০-এ। আমার বড় শালী বিয়ে করেন একটি গোয়ানকে। আমার ছোট শালা বিয়ে করেননি।’

এতদিন লখ্‌নৌতে থাকবার জন্যই বোধহয় ভদ্রলোকের বাংলায় একটা পশ্চিমা টান এসে গেছে। যদিও ভাষায় কোনও গণ্ডগোল নেই।

এবার ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।

‘কোনও এক মহারাজা শকুন্তলা দেবীকে একটা মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন, তাই না?’

‘আপনি ঠিকই বলেছেন,’ বললেন জয়ন্তবাবু। ‘মাইসোরের মহারাজা। শকুন্তলার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে একটি বহুমূল্য কণ্ঠহার উপহার দেন। তখনকার দিনেই দাম ছিল লাখ খানেকের মতো। কিন্তু এটা আপনি কী করে জানলেন? যদ্দূর মনে হয় শকুন্তলা অভিনয় করতেন আপনার জন্মের আগে।’

‘তা ত বটেই’, বলল ফেলুদা। ‘কিন্তু বছর পনেরো আগে আমি খবরের কাগজে একটা খবর পড়ি। এই হার চুরি হয়েছিল, তারপর পুলিশ সেটা উদ্ধার করে।’

‘ঠিক কথা। তখনও শকুন্তলা দেবী বেঁচে। তিনি মারা গেছেন তিন বছর আগে আটাত্তর বছর বয়সে। মারা যাবার পরেও এই হারটার কথা কাগজে বেরিয়েছিল। কিন্তু আপনার সেই পনেরো বছর আগের খবরের কথা মনে আছে—আপনার মেমরি ত খুব শার্প দেখছি।’

‘ক্রাইমের খবর আমি বহুদিন থেকেই খুব উৎসাহ নিয়ে পড়ি। আর পড়লে আমার মনেও থাকে। আসল কথাটা আপনাকে বলেই ফেলি। আমার পেশাটিও হচ্ছে ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত।’

ফেলুদা পকেট থেকে তার একটা কার্ড বার করে জয়ন্তবাবুর হাতে দিল। ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল।

‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর! তাই বলুন। আপনার নামটা চেনা চেনা লাগছিল। আপনার ত একটা ডাকনামও আছে।’

‘হ্যাঁ। ফেলু।’

‘ফেলু। ইয়েস—ফেলুদা। আমার মেয়ে আপনার বিশেষ ভক্ত। আপনার সব অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী তার পড়া। বাংলা সে এমনিতে একেবারেই পড়ে না, কিন্তু আপনার বইগুলো পড়ে। যাক্‌, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল।’

এবার ফেলুদা লালমোহনবাবুর পরিচয়টাও দিয়ে দিল। বলল, ‘এঁর নাম লখ্‌নৌ অবধি পৌঁছেছে কিনা জানি না, তবে ইনি বাংলার একজন বিশেষ জনপ্রিয় থ্রিলার রাইটার। জটায়ু ছদ্মনামে এঁর উপন্যাস বেরোয়।’

‘বাঃ দু’জন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে ট্রেনের কামরায় আলাপ হয়ে গেল এতো আশ্চর্য ব্যাপার। লখ্‌নৌতে আপনারা উঠছেন কোথায়?’

‘ক্লার্কস-আওয়ধ।’

‘আমি থাকি নদীর ওদিকে—বাদশবাগে। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। একদিন আমাদের বাড়িতে খেতে আসতে হবে আপনাদের। আমার স্ত্রী খুব ভালো মোগলাই রান্না রাঁধেন। তা ছাড়া আমার মেয়ে ত ফেলুদাকে দেখে থ্রিল্‌ড হয়ে যাবে। আপনাদের তিনজনেরই আসা চাই কিন্তু।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই’, বলল ফেলুদা। ‘আর সেই সঙ্গে আশা করি বিখ্যাত কণ্ঠহারটাও একবার দেখা যাবে।’

‘সে ত খুব সহজ ব্যাপার। কারণ হারটা আমার কাছেই আছে। অর্থাৎ আমার স্ত্রীর কাছে।’

‘কেন? ছোট মেয়ের কাছে কেন? বড় মেয়ের কাছে নয় কেন?’

‘কারণ ভার্জিনিয়ার তাঁর ছোট মেয়ের উপর বেশি টান ছিল। আর অনেক গুণ ছিল এই ছোট মেয়ের—অর্থাৎ আমার স্ত্রী সুনীলার। অবিশ্যি সেসব গুণের সদ্ব্যবহার সে করেনি। বিয়ের পর পুরো গৃহিণী বনে গিয়েছিল। বিয়ে না করলে হয়ত ফিল্মে চান্স নিত, কারণ তার অভিনয় দক্ষতা ছিল যথেষ্ট।’

‘আপনার স্ত্রীর নাম সুনীলা বললেন। ওঁনার কোনও ক্রিশ্চান নাম নেই?’

‘হ্যাঁ। ওর পুরো নাম প্যামেলা সুনীলা।’