১. শহর বাগদাদ

মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া (এরকুল পোয়ারো)

০১.

শহর বাগদাদ। প্রিন্সটন হোটেলের হলে হাসপাতালের একজন নার্স তখন একটা চিঠি, লেখায় দারুণ ব্যস্ত, কাগজের উপর তার ঝর্ণা কলম দ্রুত চলছিল।

……প্রিয়, সত্যি এ সবই যেন আমার খবর। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গা দেখে রাখা ভালো, যদিও আমার কাছে ইংলন্ড সব সময়েই দর্শনীয়। বাগদাদের অবস্থা যে এত নোংরা ও অগোছালো চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না। আরব্য রজনীর সেই মিষ্টি পরিবেশ, রোম্যান্টিক ভাবের সঙ্গে শহর বাগদাদের মিল খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হয় যেন। অবশ্য প্রকৃতি এখানে কৃপণ নয়, কল কল শব্দে নদী তার ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে বাগদাদ শহরটাকে নিজের কোলে টেনে রেখে। কিন্তু শহরটা যেন গিলতে চাইছে, কি ভয়ঙ্কর বীভৎস তার চেহারা! ভালো দোকানের বড় অভাব। মেজর কেলসি সঙ্গে করে আমাকে বাজারে নিয়ে যান।

ডঃ রেলির সেই কাজটার প্রসঙ্গে পরে আমি তোমাকে সবিস্তারে লিখে জানাব। তিনি জানিয়েছেন, সেই আমেরিকান ভদ্রলোক এখন এই বাগদাদ শহরেই আছেন এবং সম্ভবত আজ অপরাহ্নে তিনি আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে পারেন। প্রসঙ্গ তাঁর স্ত্রী, ভদ্রমহিলা দারুণ সৌখিন, কল্পনাবিলাসীনী। তার সম্বন্ধে ঠিক এরকমই একটা আভাস দিয়েছিলেন ডঃ রেলি। এর বেশি আর কিছু তিনি বলেন নি। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিশক্তি অবশ্যই আছে, আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই। এই ডঃ লিডনার, ইনি একজন প্রত্মতত্ত্ববিদ এবং বিশাল এই মরুভূমির কোন এক প্রান্তরে আমেরিকান মিউজিয়াম তৈরি করার জন্য মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত এখন তিনি।

এবার চিঠির ইতি টানতে যাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম, স্টাকিন্স সম্বন্ধে তুমি যা বলেছিলে সেটা নিছক ধ্বংসের ব্যাপার। আচ্ছা মেট্রন কী বলছিল?

বলার আর কিছু নেই।

তোমার চিরদিনের অ্যামি লিথেরান।

 খামের উপর ঠিকানা লিখল সে, সিস্টার কারশ, স্টোফার হসপিটাল, লণ্ডন।

লেখা সে সবে মাত্র শেষ করেছে, এমন সময় স্থানীয় এক যুবক তার সামনে এসে দাঁড়াল।

ডঃ লিডনার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

নার্স লিথেরান ফিরে তাকাতেই দেখল তার সামনে মাঝারি উচ্চতার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, কাঁধটা ঈষৎ ঝুঁকে আছে, বাদামী রং-এর দাড়ি, ক্লান্ত চোখ।

ওদিকে ডঃ লিডনারের সেই ক্লান্ত চোখের সামনে তখন ভাসছিল বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবতী, ঋজু দেহ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তার ধারণা বদলাতে হল, তিনি ভেবেছিলেন লিথেরানকে তিনি দেখবেন মৃত্যুপথযাত্রী কোন রুগীকে দেখে ঘাবড়ে যাওয়া হসপিটাল নার্সের মতো; কিন্তু তার মুখের অবয়ব যেন অন্য কথা বলছিল, স্পষ্ট নীল দুটি চোখে কৌতুকের ছোঁয়া, মসৃণ চকচকে বাদামি চুলে তার মুখ ঢেকে গেলেও উৎফুল্ল ভাবটা ঢাকা পড়েনি। নার্স লিথেরান, তিনি ভাবলেন, তার কাজে লাগতে পারে।

.

০২.

অ্যানি লিথেরানের পরিচয়

আমি লেখিকা নই, লেখার সম্বন্ধে আমার কোন ধ্যান-ধারণাও নেই। কিন্তু ডঃ রেলির অনুরোধ কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারে না বলেই আমি এ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি।

কিন্তু ডাক্তার, বললাম, আমি আদৌ কোন সাহিত্যিক নই।

অবান্তর কথা? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, মনেই করো না এটা একটা কেস নোট লিখছো তুমি।

তা বটে, ঘটনাটাকে এভাবে নেওয়া যেতে পারে।

ডঃ রেলি আরো বললেন, তেল ইয়ারিমাহর ব্যবসা সংক্রান্ত একটি সহজ সরল ঔজ্জ্বল্যহীন বিবরণ পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।

স্বার্থসম্পন্ন কেউ যদি সেটা লেখে তাতে কোন প্রত্যয় থাকে না।

বেশ তো, তাহলে আপনি নিজে কেন লিখছেন না ডক্টর? –প্রশ্নটা হঠাৎ আমার মুখে এসে গেল।

ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না, কিন্তু তুমি ছিলে, তাছাড়া, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার বললেন, আমার মেয়ে আমাকে অনুমতি দেবে না।

এভাবে মেয়ের কাছে তাঁর পরাজয় স্বীকার করাটা কত যে ঘৃণ্য, কথাটা আমি তাকে বলতে গিয়েও চেপে গেলাম, তাঁর চোখে একটা অসহায় ভাব দেখে। বিচিত্র তার সেই চাহনি, বোঝা মুশকিল, তিনি কৌতুক করছেন কি করছেন না।

ঠিক আছে, দ্বিধাগ্রস্থভাবে আমি তাকে শুধোলাম, মনে হয় আমি পারব।

অবশ্যই তোমাকে করতে হবে।

কিন্তু কিভাবে সেটা শুরু করব বুঝতে পারছি না।

এর অতীতের কিছু ভাল নজির আছে। শুরু থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে হবে।

কিন্তু কথা হচ্ছে এর কোথায় এবং কীভাবে শুরু সেটাই তো আমার ভাল করে জানা নেই।

বিশ্বাস কর, নার্স, শুরু করার অসুবিধেটা যত না বেশি তার চেয়েও বেশি অসুবিধে হল কীভাবে তুমি শেষ করবে।

আপনি কী আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন ডক্টর?

না, না মোটেই তা নয়। আমার কথায় পরিহাসের কোন স্থান নেই। এ কাহিনী রক্তে মাংসে গড়া মানুষের, মানুষে গড়া তাদের নকল প্রতিমূর্তির নয়। তোমার নিজের মতো করে তাদের বিষয়ে লেখবার চেষ্টা করো। তুমি বুদ্ধিমতী, এ ব্যাপারে তোমার সাধারণ জ্ঞান যথেষ্ট আছে বলেই আমার বিশ্বাস।

অতএব এই হল আমার কাজের ভূমিকা। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আমার সাধ্য মতো আমি চেষ্টা করে দেখব।

কিন্তু শুরুতেই আমি হোঁচট খেলাম। ডাক্তারকে আমি ঠিকই বলেছিলাম, কীভাবে শুরু করব এটা জানার খুবই অসুবিধা আছে এ ব্যাপারে।

আমার ধারণা আমার নিজের সম্বন্ধে দু-চার কথা অবশ্যই বলা দরকার। আমার বয়স বত্রিশ, নাম অ্যানি লিথেরান। সেন্ট কৃস্টোফারে ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর দু’বছর প্রসুতি-বিদ্যার শিক্ষা নেওয়ার পর ডিভোন-শায়ার প্লেসে মিসেস বেন্ডিক্সের নার্সিংহোমে বছর চারেক কাজ করি। ইরাকে আমি মিসেস কেলসির সঙ্গে এসেছি, তিনি বাগদাদে আসছিলেন তার স্বামীর সঙ্গে। মিসেস কেলসির স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না তখন। বাচ্চা ছেলেমেয়ে নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল একা বহন করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই মেজর কেলসি তাদের সঙ্গে আমায় বাগদাদে আসার ব্যবস্থা করেন। আমার কাজ বরাদ্দ হল তাঁদের ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার ভার নেওয়া। আমার খরচের ভার নিলেন তারা। অন্য আর একজন নার্স পেলেই তারা আমাকে রেহাই দেবেন এরকম কথা হয়েছিল তাদের সঙ্গে।

ভালো কথা, কেলসিদের সম্বন্ধে বেশি বিবরণ দেবার আর দরকার নেই বলে আমি মনে করি। ভারি সুন্দর তাদের ছোট্ট বাচ্চাটি। মিসেস কেলসি একটু খিটখিটে স্বভাবের হলেও ভারি চমৎকার মানুষ ছিলেন। ওরকম দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা আমার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি।

লম্বাটে মুখ ডাঃ রেলির, কালো চুল। কখনো কখনো নিষ্ঠুর এবং বিমর্ষ গলায় খুব মজার মজার কথা বলতেন তিনি। হাসানিয়ে বলে একটি জায়গায় সিভিল সার্জেন ছিলেন তিনি, বাগদাদ থেকে দেড় দিনের যাত্রাপথ।

বাগদাদে সপ্তাহ খানেক থাকার সময় ডঃ রেলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি জানতে চান, আমি কবে নাগাদ কেলসিদের ছেড়ে আসছি। আমি তাঁকে বলি, তার এরকম অদ্ভুত কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে থাকতে পারছি না, কারণ সত্যি কথা বলতে কি রাইটস্ পরিবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেশে ফিরে যাচ্ছেন এবং তাঁদের নার্স ছাড়া পাওয়া মাত্র সোজা চলে আসছে।

প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, রাইটসদের কথা তিনি শুনেছেন এবং সেই জন্যেই নাকি তিনি আমাকে প্রশ্নটা করেছিলেন।

আসল কথা কি জানো, ডঃ রেলি একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যে একটা সম্ভাব্য কাজের সন্ধান আমি পেয়েছি।

কেন?

তার মুখটা একটু কুঁচকে উঠল, তাঁকে একটু চিন্তিত বলে মনে হল।

হ্যাঁ, এটাকে তুমি একটা কেস বলেও ধরে নিতে পারো। প্রসঙ্গ একটি ভদ্রমহিলার, বলা যেতে পারে তার একটা নেশা আছে।

ওঃ! অস্ফুটে একটা ছোট্ট শব্দ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। (এর অর্থ যে কেউ ধরে নিতে পারে–মদ কিংবা মাদকদ্রব্য জাতীয় কিছু!)।

ডঃ রেলি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, বেশি কিছু বলতে চাইলেন না।

হ্যাঁ’, প্রসঙ্গান্তরে ফিরে এলেন তিনি, মিসেস লিডনার। তাঁর স্বামী একজন আমেরিকান, আমেরিকান–সুইডিশ বললেই বোধহয় ঠিক হবে। বিরাট জ্ঞানী মানুষ আমেরিকান খননকার্যের প্রধান তিনি। ডঃ রেলি ব্যাখ্যা করে বললেন, আমিরিয়ানের মতো বিরাট প্রাচীন শহরের নিচে খননকার্যের অভিযান কি করে চালানো হচ্ছে। জায়গাটা হাসানিয়ের থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না, তবে খুব নির্জন। এখন ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

সারাদিন কি তাকে স্থানীয় লোকেদের মধ্যে ছেড়ে রাখা হয়? জিজ্ঞেস করলাম।

না, না, তার কাছে যথেষ্ট ভিড় থাকে, সাতটা আটটা পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় না, তিনি বাড়িতে কখনও একা থাকেন। তবে সন্দেহ নেই, এক অস্বস্তিকর জায়গার মধ্যে তাঁকে কাজ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও স্বীকার করতে হয়, শত কাজের মধ্যেও লিডনার তার স্ত্রীর ভাল-মন্দের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। প্রখর দৃষ্টি থাকে তার স্ত্রীর উপর। এ অবস্থায় কোন অভিজ্ঞ নার্স যদি তার স্ত্রীর উপর নজর রাখার দায়িত্ব নেয়, তিনি তাহলে খুব খুশি হবেন।

তো এ ব্যাপারে মিসেস লিডনার নিজে কী ভাবেন বলুন তো?

 ডঃ রেলি গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন?

মিসেস লিডনার? চমৎকার মহিলা। দু দিন আগেও এ ব্যাপারে একমত ছিলেন না তিনি। তবে সামগ্রিক বিচারে এই পরিকল্পনাটা তার মনঃপুত বলা যেতে পারে। তিনি আরও বললেন, বড় অদ্ভুত এই মহিলা, মিথ্যা কথায় তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু লিডনারের ধারণা, অন্য কোন কারণে তার স্ত্রী প্রাণের আশঙ্কা করছেন।

বেশ তো সব মানলাম, তা মিসেস লিডনার নিজে আপনাকে কিছু বলেন নি?

ওহো, তিনি আমার সঙ্গে কোন পরামর্শই করেননি। অনেক কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করেন না। আসলে লিডনারই আমার কাছে আসেন এবং এই পরিকল্পনার কথা বলেন। তা তোমার এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে কি অভিমত বল? বাড়ি ফেরার আগে এ দেশটার ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য তুমি সংগ্রহ করতে পারবে। আরো দুমাস খনন কার্যে লিপ্ত থাকছেন তারা, আর এ কাজটা খুবই আকর্ষণীয়।

ডঃ রেলির প্রস্তাবটা আমার মনে ঝড় তুলেছিল তখন। দ্বিধা, জড়তা মুহূর্তে কাটিয়ে উঠে বললাম, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। অপূর্ব, ডঃ রেলি উঠতে গিয়ে বললেন, লিডনার এখন বাগদাদে। আমি তাকে বলব, তোমার সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা পাকা করে নেবার জন্য।

সেদিনই অপরাহ্নে ডঃ লিডনার এলেন হোটেলে। ভদ্রলোক মাঝ-বয়সী, দ্বিধাগ্রস্থ মনোভাব, বুঝি বা একটু ভীত সম্প্রদায়েরও। দেখলে মনে হয়, স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত অনুগত তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, স্ত্রীর ঠিক অসুবিধাটা যে কি সেটা তাঁর কাছে এখনও অজ্ঞাত।

দেখ, অভ্যাস মতো তিনি তার দাড়িতে টান দিয়ে বললেন, আমার স্ত্রী অত্যন্ত দুর্বল, স্নায়ুর চাপে ভুগছেন। তার সম্বন্ধে আমি খুবই উদ্বিগ্ন।

আচ্ছা ওঁর স্বাস্থ্য ভাল তো?

 ও হ্যাঁ, স্বাস্থ্য ওর খুব ভাল। সেদিক থেকে কোন চিন্তা আমার নেই। তবে

তবে কী?

বলতে গিয়ে কি যেন চেপে গেলেন তিনি। দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে বললেন, কোন কাজই তাকে করতে হয় না এক রকম। ওর এই ভয়ের কোন কারণ তো আমি খুঁজে পাই না।

ভয়! কিসের ভয় ডঃ লিডনার?

ও কিছু নয়। ডঃ লিডনারের কথায় একটা অস্পষ্টতার ছাপ, স্নায়বিক দুর্বলতায় আজকাল সব কিছুতেই আতঙ্কের ছায়া দেখতে পায় বুঝলেন।

দশটা থেকে একটা, ভাবলাম, এ আর এমন কিছু নয়, অতিরিক্ত মাদক দ্রব্য সেবনের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ডঃ লিডনার সে কথা বিশ্বাস করতে চান না, বিশ্বাস করতে চান না তাদের স্ত্রী এমন অস্বাভাবিক অভ্যাসের বশবর্তী হতে পারেন।

জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার ব্যাপারটা আপনার স্ত্রী নিজের থেকে অনুমোদন করেছেন তো? ডঃ লিডনারের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমি তো রীতিমতো অবাক। শুনে ও কি বলল জানো? ও এখন অনেকটা নিরাপদ বলে মনে করছে।

নিরাপদ! কথাটা হঠাৎ আমার কানে বাজল। সেই থেকে আমি ভাবতে শুরু করলাম, মিসেস লিডনারকে হয়তো মানসিক রুগিনীর পর্যায় ফেলা যেতে পারে।

তারপর তিনি ছেলেমানুষের মতো আগ্রহের আতিশয্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন।

আমি নিশ্চিত ওর সঙ্গ তোমার ভাল লাগবেই। আমার নিজের স্ত্রী বলে বলছি না, মানুষকে আকর্ষণ করার মতো সত্যি ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। হাসলেন তিনি ওকি মনে করে জান? তোমাকে কাছে পেলে ওর মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। আমিও তাই মনে করি। কেন জানি না, তোমাকে দেখা মাত্র আমার স্ত্রীর কথাটাই সর্বপ্রথম মনে হয়েছিল। আমি হলফ করে বলতে পারি, একমাত্র তুমিই হলে লুসির উপযুক্ত সঙ্গিনী।

ঠিক আছে মিঃ লিডনার, আমি আবার বলছি, সাধ্যমত চেষ্টা করব। খুশি হয়ে বললাম, মনে হয় আমি বোধহয় আপনার স্ত্রীর সাহায্যে আসতে পারি। আমার ধারণা, ওঁর এই স্নায়বিক দুর্বলতার মূলে এখানকার স্থানীয় কালো চমড়ার লোকগুলো।

ওহো না, তা নয়। মাথা নাড়লেন তিনি সকৌতুকে। আমার স্ত্রী আরবদের খুবই ভালবাসে, তাদের সরলতা ওর খুব পছন্দ। এখানে আমরা মাত্র এক বছর এসেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েকেরও কম হবে, কিন্তু এর মধ্যেই ও কেমন সুন্দর আরবী ভাষায় কথা বলতে শিখে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে আমি আর একবার চেষ্টা করে দেখলাম। আচ্ছা ডঃ লিডনার, সত্যি করে বলুন তো আপনার স্ত্রীর ভয়ের প্রকৃত কারণটা কী?

প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করে তারপর ধীরে ধীরে তিনি বললেন, আমার বিশ্বাস সে কথা ও নিজের থেকেই তোমাকে বলবে।

ব্যস, এর বেশি কিছু জানা গেল না তার কাছ থেকে।

.

০৩.

খোশগল্প

ঠিক হল আগামী সপ্তাহে আমি তেল ইয়ারিমাহর যাব।

মিসেস কেলসি তার আলইউয়ার বাড়িতে বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করছিলেন, এবং আমি তার কাজের বোঝা কিছু হাল্কা করবার ব্যবস্থা করছিলাম, সেই সময় লিডনারের অভিযান সংক্রান্ত ব্যাপারে দু একটা মন্তব্য আমার কানে ভেসে এল। মিসেস কেলসির বন্ধু অল্পবয়সী স্কোয়ার্ডন লিডার হঠাৎ বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে, চমৎকার লুসি। ইনিই তাহলে ওঁর শেষতম সঙ্গিনী? বলে আমার দিকে ফিরল সে। আশ্চর্য হবেন নার্স, আমাদের দেওয়া ওঁর ডাকনাম এটা। চমৎকার লুসি নামেই পরিচিতা উনি আমাদের কাছে।

তিনি কী সত্যিই খুব সুন্দরী? আমি জানতে চাইলাম।

উনি তো নিজেকে তাই মনে করে থাকেন।

এটা তোমার ব্যক্তিগত আক্রোশের কথা হয়ে গেল জন, মিসেস কেলসি টিপ্পনী কাটলেন, তুমি বেশ ভাল করেই জানেন যে, ও কথা উনি কেবল একাই মনে করেন না, অনেকেই ওঁর রূপের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছেন।

তোমার কথাই হয়তো ঠিক। তবে যাই বল এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ওঁর একটা বাড়তি আকর্ষণ করবার ক্ষমতা আছে।

 মিসেস কেলসি হেসে ওঠেন শব্দ করে। তুমি যে দেখছি সম্পূর্ণ ভাবে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছ।

স্কোয়ার্ডন লীডারের মুখ লজ্জায় আরক্তিম। যাইহোক, ওঁর একটা নিজস্ব জগৎ আছে। ডঃ লিডনারের ক্ষেত্রে বলা যায়, ওঁর মতো পত্নীবৎসল স্বামী খুব কম চোখে পড়ে। ওঁর স্ত্রী যে পথ দিয়ে যান, সেই পথ উনি পুজো করে থাকেন। তাদের সম্পর্কে এখন এই মুহূর্তে হয়তো আলাপ করা যেতে পারে।

এক সঙ্গে কজন তারা থাকেন বলতে পারেন?

অনেক দেশের অনেক মানুষ, আনন্দের সঙ্গে স্কোয়ার্ডন লীডার জানালেন, একজন ইংরেজ স্থপতি, একজন ফরাসী ফাদার। আরও আছেন, বুঝলেন? মিস জনসন, ইংরেজ মহিলা। মোটাসোটা ফটোগ্রাফার, উনি একজন আমেরিকান নাগরিক এবং মারকাডোরা–ঈশ্বর জানেন কোন জাতি তারা? আর একটি অল্প বয়সের মেয়ে, সাপের মত চেহারা। সুন্দরী লুসিকে কী ঈর্ষার চোখে দেখে না সে? তাদের মধ্যে কয়েকজন খাপছাড়া হলেও মোটের উপর সবাই বেশ চমৎকার, পেনিম্যান এ ব্যাপারে আপনি আমার সঙ্গে একমত নন?

পেনিম্যান একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি তখন নিজের নাকে স্প্রিংয়ের চশমা আটকাবার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ অনুরোধের বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠে ফিরে তাকালেন স্কোয়ার্ডন লীডারের দিকে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অত্যন্ত চমৎকার বৈকি! তবে আলাদাভাবে বলতে গেলে, তার মানে, মারকাডোকে আমার এক বিচিত্র মানুষ বলেই মনে হয়।

তার ওই অদ্ভুত দাড়ি দেখলেই মনে হয়। মিসেস কেলসি মন্তব্য করলেন, লোকটা কেমন যেন সন্দেহজনক।

কথার মধ্যে বাধা পাওয়া সত্ত্বেও মেজর পেনিম্যান কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই বলতে থাকলেন আমেরিকানরা একটু চুপচাপ থাকতে ভালবাসে, আর ওদিকে ইংরাজ ছেলেরা যেন একটু বেশি মাত্রায় কথা বলে থাকে। লিডনার নিজেই অত্যন্ত আমোদপ্রিয়, ভদ্র এবং বিচক্ষণ। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত ভাবে তারা সবাই অত্যন্ত আমোদপ্রিয় মানুষ। যে কারণেই হোক আমি একটু কল্পনাবিলাসী, বাস্তবের ধার আমি ধারি না। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের দেখবার জন্য আমি যাই এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করে আমি বুঝতে পারি মানে আমার এই ধারণা হয় যে, একটা কোন গণ্ডগোল এর মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে। তবে গণ্ডগোলটা যে ঠিক কোথায় তা আমি জানি না। সত্যি কথা বলতে কি কাউকেই স্বাভাবিক বলে আমার মনে হয় না। চারিদিকে একটা সন্দেহের আবহাওয়া। এর একটা ব্যাখ্যাও আমি অবশ্য করেছি, বাইরে থেকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে সবাই সবাইকার পিঠ চাপড়াতে চায়, এই আর কি। ভেতরে ভেতরে তারা যে কতখানি এ ওর উপর হিংসাপরায়ণ উপর থেকে সেটা বোঝা মুশকিল।

এ ঘটনা আমার কাছে যেন সম্পূর্ণ নতুন, এই মনোভাব ব্যক্ত করতে মুখে কৃত্রিম আরক্তভাব ফোঁটাতে হল, কারণ আমি আমার মতামত খুব বেশি প্রকাশ করতে চাই না এই মুহূর্তে। তাই নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে বললাম, লোকেদের যদি এক জায়গায় অনেকদিন ধরে আটকে রাখা হয়, দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের স্নায়ুর উপর দারুণ চাপ পড়ছে। এ কথা আমি হসপিটালে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

সে কথা ঠিক, মেজর কেলসি বললেন, তবে এখন কথা হচ্ছে, এ ঘটনা তো হালফিলের। আর কতদিনই বা তাদের আটক করে রাখা হয়েছে? এই অল্প সময়ে অমন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠার কোন কারণ যে থাকতে পারে আমার তা জানা নেই।

এখানে এই অভিযানটা আমরা আমাদের নিজেদের জীবনের মত মনে করে থাকি। মেজর পেনিম্যান এবার মুখ খুললেন অনেকক্ষণ পরে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, ঘোঁট পাকাবার দল এর মধ্যে থেকেই গড়ে উঠছে বলে আমার অনুমান।

যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। মেজর কেলসি সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেন, এ বছর বহু ভাল ভাল নবাগতরাও এসেছে।

দেখা যাক কে কে এসেছে। স্কোয়ার্ডন লীডার তার আঙুলে গুনতে গিয়ে বলে, রেইটারের মতো কোলম্যান নবাগত। মারকাডোদের মতো ইমাট গতবছর এখানে আসে। তবে ফাদার ল্যাভিগনিও নবাগত, ডঃ বার্ডের পরিবর্তে তিনি এখানে আসেন। অবশ্য ক্যারি এখানকার সব থেকে পুরনো লোক, শুরু থেকে আছে সে এখানে, তা প্রায় পাঁচ বছর হবে। ক্যারির মতোই মিস জনসন এখানে পাঁচ বছরের পুরনো।

সব সময় আমার মনে হয় তেল ইয়ারিমাহে, মেজর কেলসি মন্তব্য করলেন, এরা যেন একটি সুখ দুঃখে সমান অংশীদার। এ রকম একটা সুস্থ পরিবেশ, এক সঙ্গে এতগুলো লোকেদের মধ্যে নির্বিবাদে থাকা যেটা কল্পনা করা যায় না। নার্স লিথেরান যে আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবে, সেটা আমি নিশ্চিত জেনে গেছি।

আপনি ঠিক বলছেন কিনা, সেটা আমি কী করে জানব বলুন?

হ্যাঁ, প্রত্যেকে আরো গভীরে যেতে চাইবে বৈকি’, মেজর পেনিম্যান বোধহয় আমার মনের খবরটা হদিশ করতে পেরেছিলেন। আমারও তাই মনে হয়, এ ব্যাপারে বোধহয় আরও কিছু জানবার থাকতে পারে। অত্যন্ত ভদ্র ডঃ লিডনার। তাছাড়া তার সব থেকে বড় গুণ হল, পরের মেজাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে তাঁর। সব সময় সকলের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে তিনি তার অভিযান সুখময় রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। তবু এ সব সত্ত্বেও একদিন একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করেছিলেন।

হাসলেন মিসেস কেলসি।

আর তার কারণ আপনি জানতে পারলেন না?

আপনি কী বলতে চাইছেন?

অবশ্যই মিসেস লিডনার।

ওঃ মেরি, তার স্বামী একটু যেন বিস্মিত, উনি চমৎকার মহিলা, আমার তো মনে হয় না, তিনি ঝগড়াটে স্বভাবের।

না, না আমি বলছি না তিনি ঝগড়াটে। তবে কখনো কখনো ঝগড়ার কারণ হয়ে ওঠেন তিনি।

কীভাবে? আর কেনই বা তিনি তা হতে যাবেন?

কেন? কারণ তাঁর জীবন একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর হবেনই বা কেন? তার কাজ কোথায়! তিনি তো আর প্রত্নতত্ত্ববিদ নন, এখানে প্রত্মতত্ত্ববিদের স্ত্রী মাত্র। তাই নিজের একঘেয়েমি জীবনে বৈচিত্র্য আনতে মাঝে মাঝে ঝগড়াটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, হয়তো তাতে তিনি নতুনত্ত্বের স্বাদ পান, আনন্দ পান।

মেরি, এ সবই তোমার অনুমান মাত্র। আসলে তুমি এর কিছুই জানো না।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই এ আমার অনুমান বটে। তবে একদিন দেখবে, আমার অনুমানই ঠিক। সুন্দরী লুসি কোন মতেই মোনালিসা নয়। হয়তো সে কারোর ক্ষতি করবে না, তবু তিনি দেখতে চান, তাঁকে ঘিরে কি ঘটতে পারে।

তিনি কিন্তু স্বামীর প্রতি অনুগত। ওঃ ওঁদের দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস আমার নেই। সে প্রসঙ্গে আমি যেতেও চাই না। আমি কেবল বলতে চাইছি, ওই ভদ্রমহিলাকে আমরা কেউই চিনতে পারিনি।

মেয়েরা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত সহৃদয় শুনেছি, কথাটা বলে হাসলেন মেজর কেলসি। আমি জানি, বিড়াল, বিড়ালের মতো ব্যবহার করে থাকে তারা, এই কথাটা আপনি বলতে চাইছেন তো! তবে এ কথাও জেনে রাখুন, আমরা মেয়েরা আমাদের নিজেদের ব্যাপার অত্যন্ত সচেতন।

ওই একই ব্যাপার, মেজর পেনিম্যান কি যেন চিন্তা করে বললেন, মিসেস কেলসির সব বক্তব্য সত্য বলে ধরে নিলেও, আমি মনে করি না, তার সেই কৌতূহলের কোন রেশ থাকতে পারে। বরং আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, একটা বিরাট ঝড় উঠতে যাচ্ছে এবং সে ঝড় যে কোন মুহূর্তে উঠতে পারে।

তাই বলে এই নতুন নার্সটিকে শুরুতেই ভয় পাইয়ে দেবেন না, মিসেস কেলসি সতর্ক করে দেন, দিন তিনেকের মধ্যে ও সেখানে যাচ্ছে। এ সময় এমন কিছু বলবেন না, যাতে ও ঘাবড়ে যায়।

ওহো, আপনারা আমাকে কিছুতেই ভয় পাওয়াতে পারবেন না। কথাটা বলে আমি হাসলাম।

যাইহোক, ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু কানে তখন বাজছিল। বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সেই অদ্ভুত মন্তব্য তার স্ত্রীর সম্বন্ধে। আমার সঙ্গ পেলে ওঁর স্ত্রী নাকি নিরাপদ বলে মনে করবে নিজেকে। কিন্তু তার স্ত্রীর প্রকৃত ভয়ের কারণটা সবার কাছে তখন অজ্ঞাত? আর সেই জন্যই কী তাদের এত মাথা ব্যথা? নাকি তার ভয়ের কারণটা তারা জেনে গেছেন বলেই তাঁদের এত ভয়, কখন কি হয়, কে জানে?

মিসেস কেলসির শেষ মন্তব্যের অর্থটা এখন আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না।

ঠিক আছে, আমি নিজের মনে ভাবলাম, আমি অপেক্ষা করে দেখব।

.

০৪.

হাসানিয়েয় পৌঁছে

তিনদিন পরে আমি বাগদাদ ছেড়ে এলাম।

মিসেস কেলসি এবং বেবীকে ছেড়ে আসতে গিয়ে আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল। মেজর কেলসি নিজে আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনে এলেন। আগামীকাল সকালে কিরকুকে আমার পৌঁছানোর কথা, যেখানে হয়তো কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

বিশ্রীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ট্রেনে কখনো আমার ভাল ঘুম হয় না। যাইহোক, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার বাইরে নজর পড়তেই চোখ সার্থক হল, দিনটা চমৎকার বলে মনে হল, চলমান দৃশ্যগুলো আরো বেশি চমৎকার যেন। আমার খুব কৌতূহল হল লোকগুলোর সম্বন্ধে, যাদের আমি দেখতে যাচ্ছি।

আমার দৃষ্টি প্রসারিত প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে, বুঝি বা একটু ইতস্ততঃ। চেয়ে থাকতে গিয়ে আমার মনে হল একটি যুবক আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফ্যাকাশে লাল গোল মুখ। সত্যি কথা বলতে কি জীবনে এ রকম আর কাউকে দেখিনি যার সঙ্গে মিঃ পি. জে. উডহাউসের বইয়ের সেই যুবকটির সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই মুখ, সেই চোখ।

হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো,তার চোখে এক অজানা কৌতূহল, আপনি নার্স লিথেরান না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি নার্স লিথেরান নিশ্চয়ই। হ্যাঁ হ্যাঁ! অধমের নাম কোলম্যান। ডঃ লিডনার আমাকে পাঠিয়েছেন। কেমন বুঝছেন? জঘন্য ট্রেন যাত্রা, এই তত? এই দেখুন, আমি খুব বেশি কথা বলছি, না? চলুন, এবার যাওয়া যাক, বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

বাস নয়, স্টেশন-ওয়াগান বলা যেতে পারে, আবার ছোট লরী কিংবা বড় গাড়িও বলা যেতে পারে। মিঃ কোলম্যান আমাকে চালকের পাশের আসনে বসার পরামর্শ দিল, ঝাঁকুনি কম হবে।

ঝাঁকুনি! এখানে এসে পথ চলতে গিয়ে আমার দেহের সব হাড়গুলো যে এখনো আস্ত আছে সেটাই এখন বড় বিস্ময়। এখানকার জীর্ণ ক্ষত-বিক্ষত রাস্তাগুলো দেখে আমাদের ইংলণ্ডের দৃষ্টি নন্দনকারী রাস্তাগুলোর কথা মনে পড়লে দেশে ফেরার জন্য মনটা কেমন উতলা হয়ে ওঠে।

কোলম্যান বোধহয় আমার মনের কথা টের পেয়েছিল, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে সে বলে, ট্রাকটার অবস্থা মোটামুটি ভালই! ভয়ের কোন কারণ নেই। তাছাড়া আপনার পক্ষে খুব ভাল, লিভারটাকে ঝাঁকুনি দেয়। বললো সে, আপনার সেটা জানা দরকার নার্স।

যদি আমার মাথা ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে লিভার ভাল রেখে কী লাভ?

বৃষ্টির পর আপনার আসা উচিত ছিল। নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারতেন।

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

চারঘন্টা লাগল হাসানিয়েতে আসতে। জায়গাটা বেশ বড়। নদী পেরিয়ে শহর। চোখ ধাঁধান মনোরম দৃশ্য। দূর থেকে শ্বেত পাথরের সাদা ধবধবে মিনারগুলো পরীদের মতো মনে হয়।

মিঃ কোলম্যান আমাকে ডঃ রেলির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ডঃ রেলি লাঞ্চের অপেক্ষায় বসেছিলেন। চির হাস্যময় শান্ত সুন্দর মেজাজের ডঃ রেলির মতোই তাঁর বাড়িটাও বেশ ঝকঝকে উজ্জ্বল, ঘর বাথরুম সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। স্নান সেরে গায়ে ইউনিফরম চাপাবার পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে খোশ মেজাজের বলে মনে হল।

লাঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ডঃ রেলি তার মেয়ের দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলেন। লাঞ্চের মাঝে তার মেয়ে এসে হাজির হল। ডঃ রেলি পরিচয় করিয়ে দিলেন, নার্স, এ আমার মেয়ে শীলা।

টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে করমর্দন করল সে এবং আশা করল, আমার ট্রেন যাত্রা সুখকর হয়েছে নিশ্চয়ই। তারপর কোলম্যানের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নেড়ে বসল শীলা।

আচ্ছা, বিল, জিজ্ঞাসা করল সে, সব কেমন চলছে?

তারা ক্লাব আর পার্টি নিয়ে আলোচনা করছিল। ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু আমার ঠিক পছন্দের নয়। মনে হয় মেয়েটি একটু হাল্কা ধরনের, যদিও সে দেখতে ভাল, নীল চোখ, কালো চুল, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে ক্লান্তির ছাপ, দেখলে মায়া হয়। কিন্তু ওদের বিদ্রুপে ভরা কথাবার্তা আমাকে দারুণ আঘাত করল। কোলম্যানের কথাবার্তাও এখন কেমন বিসদৃশ্য। শীলার সংস্পর্শে এসে সে তার সেই আগেকার স্বাভাবিক কথাবার্তা ভুলতে বসেছে। কেমন নিরেট নির্বোধের মতো কথা বলার ভঙ্গি তার। সে আমাকে এমন একটা কুকুর সম্বন্ধে সতর্ক করে দিল, যাকে আমি আদৌ চোখে দেখিনি এখনো।

লাঞ্চের পর ডঃ রেলি হাসপাতালে চলে গেলেন। তার দেখাদেখি মিঃ কোলম্যান শহরের পথে চলল কিছু কেনাকেটা করার জন্য। মিস রেলি জানতে চাইল, শহর ঘুরে দেখতে আমি যাব কিনা, নাকি বাড়িতে বিশ্রাম নেব। সে আরো বলল, মিঃ কোলম্যান তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসবেন।

দেখবার কিছু আছে এখানে?

কতকগুলো ছবির প্রদর্শনী আছে, মিস রেলি সঙ্গে সঙ্গে বলল, তবে আমার মনে হয় না সেগুলো তোমার পছন্দ হবে। কারণ অত্যন্ত নোংরা সেগুলো।

ওর কথাটা কাটার মতো বিধল আমার কানে। ওর এ কথা বলার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না। এ ব্যাপারে ও আমার পছন্দ অপছন্দের কথা জানল কী করে। অন্তত আমি তো ওকে বলিনি।

একেবারে শেষে ও আমাকে ক্লাবে নিয়ে গেল। সামনেই নদী, জলের ক ক শব্দ ভেসে আসছিল হাওয়ায়। ইংরাজি পত্র পত্রিকা চোখে পড়ল সেখানে।

বাড়ি ফিরে এসে মিঃ কোলম্যানকে দেখতে পেলাম না। তাই কি করি! ফিরে দুজনে আবার গল্প করতে বসলাম। তবে কথাবার্তা খুব একটা সহজভাবে এগুলো না। শীলা জানতে চাইল, এখনো পর্যন্ত মিসেস লিডনারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কি না।

‘না’, প্রত্যুত্তরে বললাম, তার স্বামীর সঙ্গে কেবল দেখা হয়েছে।

ও, তাই বুঝি, শীলা বলে, জানি না মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে কী তুমি ভাবছ?

ওর এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমি দিলাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবার নিজের থেকেই বলতে লাগল, ডঃ লিডনারকে আমি খুব পছন্দ করি। সবাই তাকে পছন্দ করে থাকে।

তার মানে তার স্ত্রীকে তুমি পছন্দ করো না। উত্তরে এই কথাটা আমার বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু এর পরেও আমি আগের মতোই নীরব রইলাম। এবার ও আকস্মিক ভাবে জিজ্ঞাসা করল, মিসেস লিডনারের কী ব্যাপার বলো তো? ডঃ লিডনার কিছু বলেছেন তোমাকে?

আমি আমার রুগিনীকে এখন পর্যন্ত চোখে দেখিনি, না দেখার আগেই তার সম্বন্ধে খোশগল্পে মেতে উঠতে আমি রাজী নই। তাই কৌশলে তার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, শুনেছি ভগ্ন-স্বাস্থ্য ওঁর। দেখাশোনা করার জন্য ওঁর লোক দরকার। হাসল শীলা, ওর সেই হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল।

ভাল, ভাল, তেমনি বিশ্রী হাসি হাসতে হাসতে ও বলল, নজন লোক তার দেখাশোনা করছে এখন, সেটাই কী যথেষ্ট নয়?

আমার মনে হয় তারা যে যার কাজে ব্যস্ত।

 যে যার কাজে ব্যস্ত? অবশ্যই তাদের কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা হয় বৈকি। কিন্তু লুসি কী তাতে সন্তুষ্ট হয়?

জানি না, আমি নিজের মনেই বললাম, তুমি নিশ্চয়ই ওঁকে পছন্দ কর না। করলে এ কথা কখনো বলতে না।

এটা একটা কথা হল, মিস রেলি বলতে থাকে, আমি ভেবে পাই না, একজন পেশাদার নার্সের এমন কী প্রয়োজন হল তার? আমার তো মনে হয় অপেশাদার কাউকে রাখলে তার পক্ষে সেটা যথেষ্ট বলেই মনে হতো। মুখে থার্মোমিটার খুঁজে দেওয়া কিংবা পালস্ দেখার মতো রুগীনী তো আর নন তিনি।

আমার কি রকম কৌতূহল হল যেন। তাই ভাবলাম, শীলার যুক্তিটা মেনে নেওয়া বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

তাহলে তুমি কি মনে কর অসুখ বলতে তার তেমন কিছু হয়নি? প্রশ্নটা শীলার দিকে ছুঁড়ে দিলাম।

হ্যাঁ, ঠিক তাই! ষাঁড়ের মতোই শক্ত সমর্থ হল মেয়েটা। প্রিয় লুসির চোখে ঘুম নেই। তার চোখের নিচে কালো বৃত্তের দাগ। হ্যাঁ সেখানে নীল পেন্সিলের দাগ টেনে দাও। এই অবস্থায় একটা কিছু আকর্ষণ করতে হলে সবাই তার সামনে দলবদ্ধ হতে হবে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলবার জন্য। তবে যদি ঘুম আসে।

এর থেকে বোঝা যায়, একটা কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে ওঁর মধ্যে। আমি জানি (যা অন্য কোন নার্সের জানা নেই) এমনি এক স্নায়বিক রোগগ্রস্থ রুগীদের সংস্পর্শে আমি এসেছিলাম, তাদের একটা খেয়াল ছিল। বড় অদ্ভুত সেই খেয়াল, পরিবারের সকলকে নাচিয়ে ছাড়তে সে।

মনে হয়, মিসেস লিডনার হয়তো এ ধরনের কোন এক রুগীনী হবেন। স্বভাবতই এক্ষেত্রে স্বামীরাই সর্ব প্রথম শিকার হয়ে থাকেন, প্রতারিত হয়ে থাকেন। আমি দেখেছি এ ধরনের অসুখ সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বামীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহজ সরল বিশ্বাসী হয়ে থাকে। তবু এ সব সত্ত্বেও এতদিন আমি যা শুনে এসেছি, যা দেখে এসেছি, এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। সেই সব যুক্তি তর্ক যেন একেবারেই বেমানান মিসেস লিডনারের বেলায়। নিরাপদ ডঃ লিডনারের সেই কথাটা ভাবতে গিয়ে আমি যেন খেই হারিয়ে ফেলি।

মজার ব্যাপার হল সেই কথাটা এখনো আমার মনের মধ্যে কেমন গেঁথে আছে। সেই প্রসঙ্গে ফিরে এসে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা মিসেস লিডনার স্নায়ুর চাপে ভুগছেন না তো? মানে একটু ঘাবড়ে যাওয়া

কিন্তু সেরকম হবার কারণই বা কী থাকতে পারে? সব সময় দশজন অনুচর তাঁর কাছে থাকে। তারা সব অনেক দিনের পুরনো প্রহরী, ভয় পাবার কি আছে! না, না তার ঘাবড়াবার কোন কারণ থাকতে পারে না।

কি ভেবে শীলা মিনিট দুই চুপ করে থাকল। তারপর আবার মুখ খুলল ও।

 কী অদ্ভুত সব কথা বলছ তুমি?

কেন?

একদিন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জার্ভিস এবং আমি ঘোড়ায় চড়ে আসছি। সময় সকাল। প্রায় সবাই তখন খননকার্যে লিপ্ত। মিসেস লিডনার তখন চিঠি লিখতে ব্যস্ত। মনে হয় আমাদের দেখতে কিংবা পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। যে ছেলেটি তোমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসে, সেও তখন ছিল না সেখানে। আর আমরা সোজা বারান্দায় চলে এলাম। আপাত দৃষ্টিতে দেওয়ালে ফ্লাইট-লেফটেনান্ট জার্ভিসের ছাঁয়া পড়তেই সেদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন তিনি। পরে অবশ্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নিতে গিয়ে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন অচেনা আগন্তুক কেউ। কিন্তু তাই যদি বা হয়, আগন্তুক কাউকে দেখে ও ভাবে কেন তিনি আঁতকে উঠবেন। আগন্তুক তো আর বাঘ-ভাল্লুক কিছু নয় যে, ভয় পেতে হবে?

সে কথা আমিও ভাবছিলাম বৈকি। তাই নীরবে মাথা নাড়লাম।

মিস রেলি মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে হঠাৎ ফেটে পড়লেন : জানি না এ বছর ওদের মধ্যে কি হয়েছে। একটা ব্যাপারে সবাই একমত। প্রত্যেকের মধ্যে একটা ঢাক ঢাক ভাব, চাপা গুঞ্জন। জনসন এমনি বিষণ্ণ যে, তার মুখ দিয়ে একটা কথাও বার হয় না। ডেভিড ভুলেও কথা বলে না, পাছে অজান্তে তার পেট থেকে অজানা কোন তথ্য বুঝি বা বেরিয়ে যায়। অবশ্য বিল ঠিক উল্টো, কিন্তু তার অনর্গল বকবকানিতে সবাই বিরক্তবোধ না করে পারে না। ক্যারি এমন অদ্ভুত চোখে তাকায়, দেখলে মনে হয় অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝি সে কারোর মনের গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে। আর তারা পরস্পরের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে যেন, যেন–ওঃ আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বুঝি না; তবে এটুকু বলতে পারি, সন্দেহের অবকাশ থেকে কেউ বোধহয় মুক্ত নয়।

বিচিত্র, বড় বিচিত্র সব ঘটনা। তার চেয়েও বিচিত্র বোধহয় মানুষের মন। ভাবলাম, দুজন দুই প্রান্তের মানুষ যাদের মধ্যে কোন মিল নেই, অথচ সেই দুজন মানুষ মিস রেলি এবং মেজর পেনিম্যান কিন্তু একটা ব্যাপারে একই মতামত পোষণ করছে, অন্তত তাদের আলোচনা আমার মনের মধ্যে যথেষ্ট দাগ ফেলতে পেরেছে। আমাকে এক অজানা ভাবনায় ফেলে দিতে পেরেছে।

ঠিক সেই সময় মিঃ কোলম্যান হৈ-চৈ করতে করতে ফিরে এল। হৈ-চৈ বললাম বটে, বা এও হতে পারে, তার কথাবার্তার ভাবভঙ্গীই হয়তো এইরকম।

হ্যালো, বলল সে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাজার সরকার বলতে নিশ্চয়ই আমি। শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন ওঁকে?

 শহর দেখার উৎসাহ খুব একটা নেই ওর, মিস রেলি শুকনো গলায় জবাবটা দিল। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ছবির প্রদর্শনী কিংবা প্রাচীন নিদর্শন দেখবার ঝোঁক তোমারও তো নেই বিল, আছে নাকি তোমার? আমি ভাবতেই পারি না, কি করে তুমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হলে?

তার জন্য আমাকে দোষ দিও না, দোষ যদি দিতে হয় তাহলে আমার অভিভাবককে দিও। শিক্ষিত তিনি, কলেজের ফেলো তিনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাষা ভাষা চোখ বুলিয়ে নেয় বইয়ের উপর, এমনি লোক তিনি।

তুমি মূর্খ, তাই তোমার পেশাগত কাজে তেমন মন নেই, শীলা তাকে স্পষ্ট কথা শুনিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না।

কিন্তু এ আমার মুর্খামী নয় শীলা, আসলে কি জানো, এই চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার কোন বিশেষ পেশার প্রতি লক্ষ্য আছে কিনা। আমি না বলে দিই, তাই তিনি নিজের খেয়াল-খুশি মতো এখানে পাঠিয়ে দেন আমাকে। যাইহোক, টাকা রোজগারের ধান্দায় আমি এখানে এসেছি। আমার ইচ্ছে মোটর-দৌড় কপ্রতিযোগিতায় যোগদান করা। ব্যস, এই পর্যন্ত।

অবাস্তব তোমার ধ্যানধারণা, মিস রেলিকে ক্রুদ্ধ বলে মনে হল।

তুমি ভুল করছ। হে আল্লা বলে যে কোন লোকের সঙ্গে এখানে মিশে গিয়ে আমি চিৎকার করতে পারি তাদের গলার স্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে। স্কুল জীবন থেকে অপরের হাতের লেখা নকল করার দিকে আমার দারুণ ঝোঁক ছিল। এখন আমি একজন ফার্স্টক্লাস জালিয়াত। যদি কোনদিন বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমাকে তোমার সামনে দিয়ে রোলস্ রয়েস হাঁকিয়ে চলে যেতে দেখো, তাহলে ধরে নিও আমি একজন ক্রিমিনাল।

ভুলে যেও না, অনেক আগেই এখান থেকে তোমার রওনা হয়ে যাবার কথা ছিল। সে জায়গায় তুমি এখনো এখানে সেই থেকে বকবক করে যাচ্ছো।

আমার অতিথি সেবাপরায়ণ, তাই না নার্স?

আমি নির্লিপ্ত ভাবে বলি, মনে হয়, এবার আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিৎ মিঃ কোলম্যান।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ নার্স।

 মিস রেলির সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এবং একটু পরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট রূপ আছে শীলার, মিঃ কোলম্যান বললেন, তবে সব সময় ও আমার কাজ কিংবা কথার খুঁত ধরে, হয়তো ও আমাকে সরিয়ে দেবার মতলব আঁটছে।

শহরের বাইরে ছোটে আমাদের ছুটন্ত গাড়িটা। পথের দুধারে সবুজ শস্যখেত। প্রায় আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একটা বিরাট বাঁধের দিকে আঙুল দেখিয়ে মিঃ কোলম্যান বলেন, আরো একটু এগুলেই আমাদের তেল ইয়ারিমাহ।

দূরে কালো কালো চেহারার মানুষগুলোকে এখান থেকে ছোট ছোট পিঁপড়ের দল বলে মনে হচ্ছিল। আমার চোখে চোখ পড়তে তারা ছুটতে শুরু করল।

অভিযান পরিচালনা করার বাড়িটা ছিল নদী থেকে খানিকটা দূরে। মাঝখানে একটা কোটইয়ার্ড। সেই কোর্টইয়ার্ডের চারপাশে সারি সারি ঘর। প্রথমদিকে দক্ষিণ দিকের ঘরগুলো নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের অভিযানের তৎপরতা, পরে পূব দিকের কয়েকটা অপ্রয়োজনীয় ঘরগুলোর দখল নেওয়া হয়।

প্রত্যেক ঘরের দরজাগুলো কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে। আর জানালাগুলো বেশির ভাগ বহির্মুখখা। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা সিঁড়ি উপর দিকে উঠে গেছে। বিল্ডিং-এর আর তিনটে দিকের থেকে এ দিকটা একটু বেশি বড়।

পূর্বদিকে একটা খোলা বারান্দা। বারান্দা পার হলেই দরজা। মিঃ কোলম্যান দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন এবং আমাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন। আমরা যে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম সেখানে বহু লোক একটা চায়ের টেবিল ঘিরে আড্ডা দিচ্ছিল জমিয়ে।

টেবিলটার মাঝখানে বসে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল। এক পলকে সেই আমার প্রথম দেখা লুসি লিডনারকে।