নবীগঞ্জের দৈত্য – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শরৎকালের সকাল। চারদিকে বেশ নরম রোদ। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে। গোরুর হাম্বা শোনা যাচ্ছে। হরিহরের পাঠশালায় ছেলেরা নামতা মুখস্থ করছে। মহিমের পিসি উঠোনের কোণে ভাত ছড়িয়ে কাকদের ডাকাডাকি করছে। পাঁচু চোর সারারাত চুরির চেষ্টা করে বাড়ি ফিরে পান্তাভাত খেতে বসেছে। রায়বাবু রুপোবাঁধানো লাঠি হাতে প্রাতভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে কুকুর। হাড়কেপ্পন হাবু বিশ্বাস খালের জলে গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। নিমাই আর নিতাই দুই বন্ধু পুকুরের ধারে বসে দাঁতন করতে করতে সুখ-দুঃখের গল্প করছে। শিকারি বাসব দত্ত তার দাওয়ায় বসে পুরনো বন্দুকটায় তেল লাগাচ্ছে। জাদুকর নয়ন বোস বাইরের ঘরে বসে পামিং-পাসিং প্র্যাকটিস করছে। হরেন চৌধুরী ওস্তাদি গানের কালোয়াতি করে যাচ্ছে। আর বটতলায় হলধরের কাছে বসে ন্যাড়া হচ্ছে পুঁটে সর্দার।
পুঁটে বলল, “দিনকাল কী পড়ল রে হলধর। আলুর কেজি আশি পয়সা! চাল আড়াই টাকা কিলো!”
হলধর পুঁটের মাথা কামাতে-কামাতে বলল, “আমার ছোট ছেলেটার কথা বলছ তো! না, তার এখনও কোনও হিল্লে হল না।”
“তাই তো বলছি রে! যুদ্ধের সময় আকাল পড়েছিল, আর এই এইবারই দেখছি।”
“তা যা বলেছ। আজকালকার ছেলে-ছোঁকরারা কি আর মা-বাপের কথা শুনে চলে? আমার মেজো শালার মস্ত পাটের ব্যবসা, কতবার বলি, ওরে একবার মামার কাছে যা। না, তার নাকি সম্মানে লাগে।”
“একেবারে নিয্যস কথাটা বলেছিস কিন্তু। রামভজন দুধওলার দুধে আর সর পড়ে না। ঘি, তেল, কোনটা খাঁটি আছে বল?”
কথাটা হল, পুঁটে সর্দারের বয়স নব্বই ছাড়িয়েছে, হলধরের পঁচাশি, দু’জনেই শক্তসমর্থ আছে বটে, কিন্তু কেউই কানে শোনে না। এ একরকম বলে, ও আর-একরকম শোনে। তবু দু’জনেই সমানে কথাবার্তা চালিয়ে যায়। গত পঞ্চাশ বছর ধরে চালিয়ে আসছে। পুঁটে সর্দার প্রতি মাসে একবার করে ন্যাড়া হয়, আর হপ্তায় দু’দিন দাড়ি কাটে। সবই হলধরের কাছে।
প্রতি মাসে ন্যাড়া হওয়ার পেছনে একটা বৃত্তান্ত আছে। পুঁটে সর্দার যৌবনকালে মস্ত ডাকাত ছিল! এই নবীগঞ্জের পশ্চিমে নদীর ওধারে যে পেল্লায় জঙ্গল ছিল, সেখানেই ছিল তার আচ্ছা। আশপাশে গাঁয়ে-গঞ্জে তার অত্যাচারে কেউ আর টাকাপয়সা ঘরে রাখতে পারত না। ডাকসাইটে সাহেব-দারোগা অবধি তাকে কখনও ধরতে পারেনি। তবে নবীগঞ্জের রাজা ক্ষেত্রমোহন চৌধুরীকে সে একটু এড়িয়ে চলত। ক্ষেত্র চৌধুরীর একখানা ছোটখাটো ফৌজ ছিল। তাদের বিক্রমও ছিল খুব। সাহেব-দারোগা হিলটন অবশেষে একদিন ক্ষেত্রমোহনের দ্বারস্থ হয়ে আরজি জানাল : ডাকাত পুঁটে সর্দারকে ঢিট করতে সাহায্য চাই। ক্ষেত্রমোহনও পুটের ওপর খুশি ছিলেন না। তাঁর প্রজাদের অনেকেই পুটের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে তাঁর কাছে। কিন্তু ইংরেজ আমলে একজন দিশি রাজা তো নিজের দায়িত্বে এসব করতে পারেন না। হিলটনের আরজিতে ক্ষেত্ৰমোহন রাজি হয়ে গেলেন। ক্ষেত্রমোহনের অত্যন্ত চালাক-চতুর একটি চর ছিল। তার নাম বিশু। সেই বিশুকে পুটে সর্দারের গতিবিধির খবর আনতে পাঠালেন ক্ষেত্রমোহন। বিশু দুদিন বাদে খবর এনে দিল, সামনে অমাবস্যায় গোবিন্দপুরে মদন সরখেলের বাড়িতে ডাকাতি হবে।
অমাবস্যার সেই রাতে গোবিন্দপুরে আর পৌঁছতে হয়নি পুটেকে। গোবিন্দপুরের লাগোয়া ময়নার মাঠে ক্ষেত্রমোহনের ফৌজ ঘিরে ফেলল তাদের। একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা তেমন কিছু নয়। পুটেকে ধরে আনা হল নবীগঞ্জে, ক্ষেত্রমোহনের দরবারে। পুটে সর্দার হাতজোড় করে বলল, “রাজামশাই, আমার বাপ আর পিতামহ আপনার বাপ আর পিতামহের ফৌজে ছিল। আমি কুলাঙ্গার, ফৌজে না এসে বেশি লাভের আশায় ডাকাতিতে নাম লেখাই। দোহাই মহারাজ, সাহেবদের হাতে দেবেন না, ওদের ওপর আমার বড় রাগ। যা শাস্তি হয় আপনিই দিন, গদান যায় তাও ভাল।”
ক্ষেত্রমোহন বিচক্ষণ লোক। মৃদু হাসলেন। সবাই জানে, ক্ষেত্রমোহনও ইংরেজদের মোটেই পছন্দ করেন না। তাঁর হাতের ইশারায় সেপাইরা পুঁটেকে হাজতে নিয়ে গেল। পরদিন সকালে এক নরসুন্দর এসে পুঁটের মাথাটা ন্যাড়া করে দিল। উড়িয়ে দিল পেল্লায় গোঁফজোড়াও। এর চেয়ে বেশি সাজা ক্ষেত্রমোহন দেননি।
ওদিকে হিলটন যখন খবর পেয়ে ধরতে এল তখন ক্ষেত্রমোহন সাহেবকে বললেন, “পুঁটে সর্দার আর ডাকাতি করবে না, তার হয়ে আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু তাকে আমার হেফাজতেই থাকতে দাও।”
হিলটন গাঁইগুঁই করল। পুঁটেকে ধরে দিলে তার কিছু বকশিশ পাওনা হয়। ক্ষেত্রমোহন বকশিশটা নিজের তহবিল থেকেই দিয়ে সাহেবকে বিদায় করলেন। পুঁটে আর তার দলবলকে ক্ষেত্রমোহন ফৌজে ভর্তি করে নিলেন।
পুঁটে সেই থেকে প্রতি মাসে ন্যাড়া হয়ে আসছে।
সেই ক্ষেত্রমোহন বহুদিন গত হয়েছেন। তস্য পুত্র পূর্ণচন্দ্রও আর নেই। তবে ক্ষেত্রমোহনের নাতি আজও আছে। তার নাম বীরচন্দ্র। নামে বীর হলেও বীরচন্দ্র মোটেই বীর নয়। সাঙ্ঘাতিক লাজুক প্রকৃতির বীরচন্দ্র রাজবাড়ির ভেতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে। কারও সঙ্গে দেখা করে না। একা-একা বীরচন্দ্র যে প্রাসাদের মধ্যে কী করে তা কেউ জানে না। বিয়েটিয়ে করেনি। রাজবাড়ির সেই জৌলুস নেই, দাস-দাসী, দরোয়ান, বরকন্দাজ ওসব কিছু নেই। থাকার মধ্যে এক বৃদ্ধ চাকর বনমালী আছে। আর আছে তোধিক বৃদ্ধ এক রাঁধুনি। একজন সরকারমশাইও আছেন বটে, কিন্তু আদায়-উশুল নেই বলে তিনি বসে বসে মাছি তাড়ান আর মাঝেমধ্যে বাজারহাট করে দেন।
শরৎকালের এই সুন্দর সকালে রাজবাড়ির সরকারমশাই ভুজঙ্গ হালদার বাজারে চলেছেন। এক হাতে ছাতা, আর-এক হাতে চটের থলি। ভারী অন্যমনস্ক মানুষ। ছাতাটা হাতে ঝুলছে, থলিটা মাথায়।
রাজবাড়ির ভাঙা ফটকের সামনে দু’জনের দেখা হল। ভুজঙ্গবাবু আর পুঁটে সর্দার।
ভুজঙ্গবাবু ভূ একটু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললেন, “এই যে বৃন্দাবনদাদা, চললে কোথায়?”
পুঁটে সদর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “না হে না, বাজারে যাব কেন? আমার বাজার কোন সকালে হয়ে গেছে। তা রাজবাড়ির খবরটবর কী, বলো!”
ভুজঙ্গবাবু হাত উলটে হতাশ গলায় বলেন, “খবর আর কি।
ওই গয়ংগচ্ছ করে চলছে। আদায়-উশুল উঠে গেছে, ঘটিবাটি বেচে চলছে কোনওরকমে।”
পুটে সর্দার চোখ বড় বড় করে বলল, “বলো কী! রাজবাড়িতে সাপ ঢুকেছিল? কতবড় সাপ?”
ভুজঙ্গবাবু বললেন, “তা সাপখোপেরও অভাব নেই। মেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুঁচো, ইঁদুর, বাদুড়, তক্ষক সবই পাবে। রাজবাড়িতে এখন ওদেরই বাস কিনা। দুঃখের কথা কী বলব রে ভাই জনার্দন, আজকাল চোর-ছ্যাঁচড়রা অবধি লজ্জায়-ঘেন্নায়রাজবাড়িতে ঢোকে না।”
“তাই নাকি? তা হলে তো খুব ভয়ের কথা হল! ভূত-প্রেতের উপদ্রব তো মোটেই ভাল কথা নয়। তা তুমি বাজারের থলিটা মাথায় চাপিয়েছ কেন গো? মাথাটা আবার গরম হল নাকি?”
জিভ কেটে ভুজঙ্গবাবু তাড়াতাড়ি থলি ঝুলিয়ে ছাতা খুলে মাথায় ধরে বললেন, “যাই, কচু-ঘেঁচু যা পাই নিয়ে আসি। রাজামশাই চাট্টি খাবেন।”
“না, না, আমার বাগানে এখনও লাউ ফলেনি। তবে কুমড়ো কিছু হয়েছে। ফলন মোটেই ভাল নয়। তা আসি গিয়ে। রাজামশাইকে আমার পেন্নাম জানিয়ো।”
ভুজঙ্গবাবু বললেন, “ইঃ, রাজামশাই! রাজা হতে মুরোদ লাগে। বুঝলে আজিজুলভায়া, রাজা শুধু মুখের কথায় হয় না।”
এই বলে ভুজঙ্গবাবু হনহন করে চলে গেলেন। পুঁটে সর্দার নিজের ন্যাড়া মাথায় খুশিমনে হাত বোলাতে-বোলাতে নবীগঞ্জের খবরাখবর নিতে চলল। আজ মনটা খুশিতে একেবারে টাকডুমাডুম। যেদিন ন্যাড়া হয় সেদিনটায় ভারী আনন্দ হয় তার।
নবীগঞ্জের সবচেয়ে দুঃখী লোক হলেন দুঃখহরণ রায়। ছোটখাটো, দুর্বল, ভিতু এই মানুষটি একসময়ে নবীগঞ্জের স্কুলে মাস্টারি করতেন। কিন্তু ছেলেরা তাঁর কথা মোটেই শুনত না, ক্লাসে ভীষণ গণ্ডগোল হত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডসার প্রতাপচন্দ্র মার্কণ্ড অবশেষে দুঃখবাবুকে ডেকে বললেন, “এভাবে তো চলতে পারে না। আপনি বরং কাল থেকে আর ক্লাস নেবেন না, কেরানিবাবুকে সাহায্য করবেন। ওটাই আপনার চাকরি।”
দুঃখবাবু একথায় খুব দুঃখ পেয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তাঁর দজ্জাল স্ত্রী চণ্ডিকা এতে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দুঃখবাবুকে খুব কড়া কড়া কথা শোনাতে লাগলেন দুবেলা। দুঃখবাবু অগত্যা বাড়ির বাইরের দিকে একখানা খোঁড়া ঘর তুলে আলাদাভাবে বাস করতে লাগলেন। তাঁর দুটো ছেলে রাম আর লক্ষ্মণ নবীগঞ্জের কুখ্যাত ডানপিটে দুষ্টু ছেলে। তাদের অত্যাচারে লোকে জর্জরিত। একে মারছে, তাকে ধরছে, ফল-পাকুড় চুরি করছে, গাছ বাইছে, যখন-তখন যাকে-তাকে দূর থেকে ঢিল মেরে পালাচ্ছে। তাদের সামলানোর সাধ্যও দুঃখবাবুর নেই। কিন্তু লোকে এসে তাঁকেই অপমান করে যায়। দুঃখবাবু মাথা নিচু করে অপমান নীরবে হজম করেন। হতদরিদ্র, মুখচোরা দুঃখবাবুকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। একা-একা থাকেন। একা থাকতে-থাকতে নিজের মনেই নানা কথা বলেন। কখনও আপনমনে হাসেন। কখনও মনখারাপ করে বেজার মুখে বসে থাকেন। মাঝে-মাঝে খুব হতাশ হয়ে বলেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
একদিন রাতের বেলা চোর এল। ঘরে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে উঠে বসলেন দুঃখবাবু। কাঁপা গলায় বললেন, “কে হে বাপু? আমি বড় ভিতু মানুষ।”
চোরটি লাইনে নতুন। পুরনো চোর হলে কখনও দুঃখবাবুর ঘরে ঢুকত না। আর ধরা পড়লে ভয়ও পেত না।
কিন্তু আনাড়ি চোরটি ভয় পেল এবং ভাঙা জানলা দিয়ে পালাতে গিয়ে বাখারির খোঁচা খেয়ে ‘বাপ রে’ বলে বুক চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে। দুঃখবাবু তাড়াতাড়ি আলো জ্বেলে দেখেন জানলার ভাঙা বাখারির খোঁচায় চোরটার বুকে বেশ ক্ষত হয়েছে।
দুঃখবাবু দুঃখিতভাবে বললেন, “পালানোর কোনও দরকারই ছিল না তোমার। আমি কি তোমাকে মারতুম রে ভাই? আমার গায়ে জোরই নেই। দেখছ না আমার কেমন রোগা-রোগা হাত-পা? কস্মিনকালে কেউ আমাকে ভয় খায়নি। দাঁড়াও আমার কাছে একটা মলম আছে, লাগিয়ে দিচ্ছি। তারপর একটু জলবাতাসা খাও, জিরোও।”
চোরটার ক্ষতে মলম লাগানো হল। খুবই লজ্জার সঙ্গে জলবাতাসাও সে খেল। কিন্তু খুব গুম হয়ে রইল। নিজের আনাড়িপনার জন্যও বোধ হয় লজ্জা হয়েছে। বয়সটাও বেশি নয়। দুঃখবাবুর চোরটাকে বেশ ভালই লাগল। লোকটার সঙ্গে একটু কথাটথা বলতে ইচ্ছে করছিল। দুঃখের বিষয়, দুঃখবাবুর সঙ্গে কেউই বিশেষ কথাটথা বলতে চায় না। অথচ দুঃখবাবুর খুব ইচ্ছে করে একজন বেশ সহৃদয় লোককে বসেবসে নিজের দুঃখের কথা শোনান।
দুঃখবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে আলাপ শুরু করলেন, “ওহে বাপু, অমন বেজার হয়ে থেকো না। আমি যে লোকটা খারাপ নই তা তো টের পেলে। তোমার ওপর আমার কোনও রাগও নেই। তা তোমার বাড়ি কোথায়? নাম কী?”
চোরটা একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “ওসব বলা বারণ আছে।”
“কেন, বারণ কেন গো? আমি কি আর পুলিশের কাছে বলতে যাচ্ছি?”
“বললেই বা আটকাচ্ছে কে?”
দুঃখবাবু একটু দমে গিয়ে বললেন, “পুলিশও কি আর আমার কথা কানে তুলবে? আমাকে কেউ পোঁছে না, বুঝলে? কেউ পোঁছে না, অথচ আমার পেটে কত কথা জমে আছে। এসো, একটু গল্প করা যাক।”
চোরটা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, আমার কাজ আছে। আপনার এখানে তো কিছু হল না। খালি হাতে ফিরলে কি আমাদের চলে?”
চোরটা ফের ভাঙা জানলা দিয়েই পালিয়ে গেল। দুঃখবাবু বুকভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বললেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
না, দুঃখবাবুর সত্যিই কেউ নেই। তাই দুঃখবাবু মনের দুঃখে মানুষ ছেড়ে অন্যদের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করতে লাগলেন। একটা নেড়ি কুকুর জুটল। তার নাম দিলেন ভুলু। তা ভুলু দুঃখবাবুর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নিল। প্রায়ই এসে দরজার কাছে বসে, লেজ নাড়ে। দুঃখবাবু আদর করে বলেন, “ভুলু নাকি রে? ইস। বড্ড রোগা হয়ে গেছিস যে ভাই। সারা দুপুর টো-টো করে বেড়াস, অসুখবিসুখ করে ফেলবে যে।”
এইভাবে কথা চলতে থাকে। কিন্তু ভুলুর শুধু দুঃখবাবুকে নিয়ে চলে না। কারণ দুঃখবাবুর খাওয়াদাওয়া বড্ড সাদামাঠা। ডাল আর ভাত। ভুলু সুতরাং মাছ-মাংসওলা বাড়িতেও গিয়ে হানা দেয়।
ভুলু ছাড়া আরও দু-একজন বন্ধু জুটে গেল দুঃখবাবুর। ঘরের মধ্যে একজোড়া চড়াইপাখি বাসা করেছে। তাদের আবার ছানাপোনাও হয়েছে। দুঃখবাবু চড়াইপাখি দুটোর নাম দিয়েছেন হরিপদ আর মালতী। কিন্তু হরিপদ আর মালতী সারাদিন ভারী ব্যস্ত। চুড়ক করে উড়ে যাচ্ছে, ফুড়ত করে ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে, আসছে। তার ফাঁকে-ফাঁকে অবশ্য দুঃখবাবু তাদের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন, “হরিপদ যে, শরীর ভাল তো! ছেলেপুলেরা সব কেমন আছে রে? বলি ও মালতী, কয়েক দানা মুড়ি বা চিড়ে খাবি? মুখোনা যে শুকিয়ে গেছে!”
কেঁদো চেহারার একটা ছুঁচো প্রায়ই দুঃখবাবুর ঘরে উৎপাত করে। দুঃখবাবু তার নাম দিয়েছেন হলধর। তাকে বিস্তর ডাকাডাকি করেন দুঃখবাবু, “বলি ও হলধর, শুনছিস? বেশ আছিস ভাইটি। মাটির তলায় ডুব দিয়ে থাকিস, দুনিয়ার কোনও ঝঞ্জাট পোহাতে হয় না। আর এই আমার অবস্থা দেখ। মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম বটে, কিন্তু মানুষের মতো কি বেঁচে আছি?”
বোলতা, ফড়িং, ব্যাঙ ইত্যাদির সঙ্গেও কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেন দুঃখবাবু। তবে বুঝতে পারেন, এরাও সব ভারী ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন বিষয়কর্মে ঘুরে বেড়ায়, রাতে একটু জিরোয়। দু দণ্ড বসে কথা শোনার সময় কারও নেই। তিনি যে একা সেই একা।
একদিন মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে তিনি বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বলে উঠলেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই?”
বলেই তিনি হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠলেন। ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিল কে? একেবারে স্পষ্ট সুড়সুড়ি। ভয় পেলেও ভাবলেন সেই চোরটা হয়তো ভাব করতে এসেছে। তাই কাঁপা গলায় বললেন, “চোরভায়া নাকি? অনেকদিন পর এলে।”
না, চোর নয়। বাতি জ্বেলে চারদিক ভাল করে দেখলেন তিনি। কেউ নেই। মনের ভুলই হবে হয়তো। আবার বাতি কমিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতেই ফের ঘাড়ে কে যেন সুড়সুড়ি দিল। এবার আরও স্পষ্ট। সাপখোপ বা বিছেটিছে নয় তো? তাড়াতাড়ি উঠে ভাল করে বিছানা-টিছানা হাঁটকে-মাটকে দেখলেন। কোথাও কিছু নেই। আবার শুলেন। চোখ বুজে মটকা মেরে রইলেন, ঘুম এল না। আচমকা মাথার চুলে কে যেন পটাং করে একটা টান মারল। “বাপ রে বলে উঠে বসলেন তিনি। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। ভূত নাকি? “রাম, রাম, রাম, রাম” বলতে বলতে ভয়ে কেঁদেই ফেলছিলেন তিনি। হঠাৎ মনে হল, আমার তো কেউ নেই। তা ভূতবাবাজির সঙ্গেই না হয় একটু বন্ধুত্ব হল!
গলাখাঁকারি দিয়ে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় দুঃখবাবু বললেন, “ভূত বাবাজি নাকি? আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক। এই অভাজনের কাছে যে আপনি আগমন করেছেন সেটা এক মস্ত সৌভাগ্যই আমার। দয়া করে কোনও বিকট চেহারা নিয়ে দেখা দেবেন না। আমি বড় ভিতু মানুষ।”
না, ভূত দেখা দিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখবাবু শুয়ে পড়লেন। রাতে আর কিছু হল না।
কিন্তু পরদিন হল। দুঃখবাবু শুয়ে আছেন। ঘুমটাও এসে গেছে। এমন সময়, না, সুড়সুড়ি নয়, কে যেন পেটে বেশ একটা রামকাতুকুতু দিল। দুঃখবাবুর বড্ড কাতুকুতুর ধাত। তিনি কাতুকুতু খেয়ে হেসে ফেললেন। তারপর “বাপ রে” বলে উঠে বসলেন। টের পেলেন ভয়ের চোটে তাঁর মাথার চুল খাড়া-খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ভূত নাকি? ঘরে তো কেউ নেই! বসেবসে দুঃখবাবু বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ শুনলেন কিছুক্ষণ। এসব হচ্ছেটা কী? এসব হচ্ছে কেন? তিন গেলাস জল খেয়েও তাঁর গলাটা শুকনোই রইল। অনেকবার রামনাম করলেন।
ফের কাতুকুতুটা হল ভোরের দিকে। দুঃখবাবু প্রথমটা খিলখিল করে হেসে উঠেই ভয়ে খাড়া হয়ে বসলেন। আর ঘুম হল না।
কাতুকুতু বা সুড়সুড়ির ওপর দিয়ে মিটে গেলে কথা ছিল না। কিন্তু দিন-দুই পরেই দিনেদুপুরে যখন বাজার থেকে ফিরছিলেন তখন বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কে যেন পেছন থেকে পটাং করে একটা গাঁট্টা দিল। প্রথমটায় ভেবেছিলেন, কোনও দুষ্টু ছেলে ঢিল মেরেছে। কিন্তু ঢিল মারলে ঢিলটা মাটিতে পড়ার শব্দ হবে। হয়নি। ঢিল খেতে কিরকম লাগে তা দুঃখবাবু ভালই জানেন। অনেকবার টিল খেয়েছেন।
সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুর সঙ্গে গাঁট্টাটাও সুতরাং যোগ হল। আগে রাতে হত, আজকাল দিনমানেও হচ্ছে। কখনও গাঁট্টা, কখনও সুড়সুড়ি, কখনও কাতুকুতু। কে যে এসব করছে, তা বুঝতে পারছেন না দুঃখবাবু। ভূতই হবে। তবে আজকাল আর তেমন একা লাগছে না নিজেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যদি হঠাৎ বলে বসেন, “হায় রে, আমার কি কেউ নেই!” সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় খটাং করে গাঁট্টা খেতে হয়।
আর কেউ না থোক, মাঝে-মাঝে পুঁটে সর্দার এসে তাঁর খোঁজখবর নেয়।
আজও পুটে ন্যাড়া হওয়ার আনন্দে ডগমগ হয়ে দুঃখবাবুর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক মারল, “কই হে মাস্টার। আছছ টাছছ কেমন?”
দুঃখবাবু বিমর্ষ মুখে বেরিয়ে এসে বললেন, “আছি কই দাদা! সেই কাতুকুতু সমানে চলছে। গাঁট্টাও খেতে হচ্ছে প্রায়ই।”
পুটে সর্দার চোখ ছোট করে বলল, “কতবড় মাছ বললে! দেড় মন? উরেব্বাস! তা হলে তো মস্ত মাছই ধরেছ! কোথা থেকে ধরলে, রাজবাড়ির পুকুর থেকে নাকি?”
দুঃখবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “মাছের বৃত্তান্তই নয়। বড় কঠিন সমস্যা চলছে দাদা। আমি বোধ হয় এবার মারা পড়ব।”
পুটে গম্ভীর হয়ে বলে, “না রে ভাই, সে যুগ কি আর আছে? আগে তো এক পয়সাতেই ন্যাড়া হওয়া যেত। আজকাল মজুরি ঠেলে উঠেছে এক টাকায়। তা হলধর পুরনো খদ্দের বলে কমই নেয়, মাত্র একটা আধুলি। তোমার কাছ থেকেও ওই পঞ্চাশ পয়সাই নেবে, আমি বলে দেব’খন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখবাবু বললেন, “গাঁট্টার যা বহর দেখছি তাতে পয়সা দিয়ে আর ন্যাড়া হতে হবে না। গাঁট্টার চোটে চুল সব উঠে যাবে।”
বলেই একটু আঁতকে উঠলেন দুঃখবাবু। কারণ কথাটা মুখ থেকে বেরোতেই একটা রাম গাঁট্টা এসে পড়ল মাথায়।
দুঃখহরণকে পেছনে ফেলে পুঁটে সর্দার ফের হাঁটা ধরল।
হাসি-হাসি মুখে রায়বাবু প্রাতভ্রমণ সেরে ফিরছেন। আহ্লাদি চেহারা, ফরসা, নাদুস-নুদুস। মুখে সদাপ্রসন্ন ভাব। হাতে রুপোর হাতলওলা লাঠি। সঙ্গে বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর প্রহরী।
“পাতঃপেন্নাম হই রায়বাবু। সব খবর ভাল তো?”
“হ্যাঁ ঠা, সব খবর ভাল। তা তোমার খবর-টবর কী?”
“আজ্ঞে, তা যা বলেছেন। কুকুরের মতো ভাল জিনিস আর হয় না। কুকুরের কাছে মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে।”
রায়বাবু বুদ্ধিমান লোক। আর কথা বাড়ালেন না। বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। অনেকটা হাঁটা হয়েছে আজ। বাড়ি ফিরেই এক গেলাস নিমপাতার রস খাবেন! বুকটা ঠাণ্ডা হবে।
একটু এগোতেই দেখলেন, দুঃখমাস্টার দৌড়ে আসছেন। “ও কী, ও মাস্টার? দৌড়োচ্ছ যে! বাড়িতে আগুন লাগেনি তো!”
“আজ্ঞে না মশাই। দিনরাত ভূতের গাঁট্টা খাচ্ছি। আর পারা যাচ্ছে না।”
“ভূতের গাঁট্টা? সে আবার কী জিনিস? ভূতের কিল শুনেছি। গাঁট্টা তো শুনিনি!”
“খেলে বুঝতেন। ওঃ, ওই আবার! নাঃ, পারা যাচ্ছে না। আসি রায়মশাই, থামলেই গাঁট্টা মারছে।”।
রায়বাবু একটু অবাক হলেও ব্যাপারটা তাঁর খারাপ লাগল না। দুঃখহরণ কুঁড়ে লোক, কোনওকালে শরীরের দিকে নজর দেয়নি। এই যে দৌড়ঝাঁপ করছে, এতে ওর উন্নতি হবে। কিন্তু ভূতের গাঁট্টাটা কী জিনিস, তা তিনি বুঝতে পারলেন না।
বাড়ি ফিরে রায়বাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে এক গেলাস নিমপাতার রস তারিয়ে-তারিয়ে খেলেন। ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রায়বাবু স্বাস্থ্য ছাড়া কিছু বোঝেন না। স্বাস্থ্যের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন লিভার ভাল রাখাকে। ফলে চিরতা, কালমেঘ, শিউলিপাতা ইত্যাদি যত তেতো জিনিস আছে সারাদিন তা খেয়ে যান। বাড়ির লোকজন, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, কাজের লোক, এমনকী কুকুর-বেড়ালকেও খাওয়াতে চেষ্টা করেন। ফলে আজকাল সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলে। তাঁর রস খাওয়ার সময় হলেই স্ত্রী পাশের বাড়িতে, ছেলেমেয়েরা খাটের তলায়, ঠাকুর, কাজের লোক বাড়ির পেছনকার জঙ্গলে, বেড়ালরা বেপাড়ায় পালিয়ে যায়। শুধু প্রহরী পালায় না। তবে রায়বাবু রস খাওয়াতে এলে সে এমনভাবে দাঁত বের করে গড়-ড় গড়-ড় করে যে, রায়বাবু বিশেষ সাহস করেন না। তিনি ছাড়া আর যে কেউ তেতো খেতে চায় না এতে তিনি খুবই দুঃখ বোধ করেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, দুনিয়াটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
ওদিকে দুঃখবাবু দৌড়চ্ছেন। দৌড়লে গাঁট্টা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দৌড় বন্ধ করলেই খটাং করে মাথায় গাঁট্টা পড়ছে। সুতরাং তাঁকে দৌড়তেই হচ্ছে।
ব্যায়ামবীর ভল্লনাথ তার উঠোনে দাঁড়িয়ে মুগুর ভাঁজছিল। দুঃখবাবুকে সামনের রাস্তা দিয়ে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়তে দেখে সে আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “দৌড়চ্ছেন কেন দুঃখবাবু? কদমতলার ভীমরুলের চাকে কেউ ঢিল দিয়েছে নাকি?”
দুঃখবাবুর জবাব দেওয়ার সময় নেই। তিনি দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। ভল্লনাথ “ওরে বাবা রে” বলে মুগুর ফেলে দৌড়ে গিয়ে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
খালের জলে হাবু বিশ্বাসের মাথাটা ভুস করে ভেসে উঠল। বিরক্তির গলায় বলল, “দিলে তো সব ভণ্ডুল করে! এতবড় মাগুর মাছটাকে সাপটে তুলেছিলাম প্রায়। আচ্ছা বেআক্কেলে তোক হে তুমি! শরীরটাই তাগড়াই, মাথায় গোবর।”
ভল্লনাথ দু ঢোক জল খেয়ে ফেলল তাড়াহুড়োয়। হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, “ভীমরুলের চাকটা ভেঙেছে। আসছে সব ভোঁ-ভোঁ করে তেড়ে। ডুব দাও! ডুব দাও।”
হাবু বিশ্বাস খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বলল, “ভীমরুল! সে তো জলের তলাতেও হুল দেয়। বাপ রে!”
বলে হাবু বিশ্বাস হাঁচোড়-পাঁচোড় করে খালের ওধারে উঠে ছুটতে লাগল।
নিমাই আর নিতাই দুঃখবাবুকে ছুটে আসতে দেখে লাফিয়ে উঠল।
“দুঃখদাদা, হলটা কী? ও দুঃখদাদা…”
কিন্তু দুঃখবাবু থামলেন না, জবাবও দিলেন না। দৌড়তে লাগলেন। নিমাই তখন নিতাইকে বলল, “ছোটো তো, লোকটা দৌড়চ্ছে কেন জানতে হবে।”
দুজনেই দুঃখবাবুর পেছনে ধাওয়া করতে লাগল।
হরিহরের পাঠশালার কাছাকাছি নিমাই আর নিতাই প্রায় ধরে ফেলল দুঃখবাবুকে।
তিনজনকে ওরকম ছুটে যেতে দেখে পাঠশালার ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল, “সার, বাঘ বেরিয়েছে! বাঘ বেরিয়েছে!”
হরিহর পণ্ডিত সঙ্গে-সঙ্গে পাঠশালা ছুটি দিয়ে বললেন, “তোমরাও সব দৌড়ে বাড়ি চলে যাও।”
ছুটি পেয়ে ছেলেরা সব হুল্লোড় করে বেরিয়ে পড়ল। তারপর দৌড়তে লাগল দুঃখবাবুর পেছনে-পেছনে। সঙ্গে চিৎকার, “বাঘ! বাঘ।”
“কোথায় বাঘ? আঁ! কোথায় বাঘ!”
বলতে বলতে বন্দুক হাতে বাসব দত্ত খিড়কির দরজা দিয়ে পালিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ল। হরেন চৌধুরী সারেগামা থামিয়ে তানপুরাটা বাগিয়ে ধরে চেঁচাতে লাগল, “অ্যাই খবর্দার! অ্যাই খবর্দার” নয়ন বোস কপিকলের দড়ি বেয়ে কুয়োয় নেমে গেল। সোজা কথায় নবীগঞ্জে হুলুস্থুল কাণ্ড। দৌড়োদৌড়ি, চেঁচামেচি।
দুঃখবাবু আর পারছেন না। দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস নেই। শরীরও মজবুত নয়। নবীগঞ্জের পুবধারে মাধব ঘোষালের বাড়ির ফটক খোলা পেয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন। মাধব ঘোষাল বারান্দায় বসে তামাক খেতে-খেতে একটা পুঁথি দেখছিলেন। সোজা গিয়ে তাঁর সামনে পড়লেন দুঃখবাবু, “ঘোষালমশাই, রক্ষে করুন।”
গাঁয়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ লোক বলে সবাই ঘোষালমশাইকে জানে। মাথা ঠাণ্ডা, বুদ্ধিমান, পরোপকারী। মাধব ঘোষাল দুঃখবাবুর দিকে চেয়ে পুঁথিটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“শ্যামা পালোয়ানের নাতির ঘরের পুতির অবস্থা যে শোচনীয় দেখছি। ওরে কে আছিস, এক গেলাস জল নিয়ে আয়।”
দুঃখবাবু ঢকঢক করে জল খেলেন। মাধব ঘোষাল কান পেতে কী একটু শুনে বললেন, “গাঁয়ে এত গোল কিসের?”
দুঃখবাবু একটু দম নিয়ে বললেন, “আমাকে নিয়েই গণ্ডগোল। আমি দৌড়চ্ছিলাম দেখে কেউ ভাবল ভীমরুল, কেউ ভাবল বাঘ। সব খামোখা দৌড়োদৌড়ি-চেঁচামেচি করে মরছে।”
“তুমিই বা দৌড়লে কেন?”
দুঃখবাবু যেন বেজায় অবাক হয়ে বললেন, “দৌড়ব না? ভূতটা যে দিনরাত গাঁট্টা মারছে। দৌড়লে আর মারে না। থামলেই মারে। এই দেখুন, মাথার পেছনে সব সুপুরি তুলে দিয়েছে।”
মাধব ঘোষাল দেখলেন। বাস্তবিকই তিন-চার জায়গা রীতিমত ফুলে আছে। ঘোষাল একটু চিন্তিত মুখে বলেন, “গাঁট্টা মারছে কেন তা কি আন্দাজ করতে পেরেছ?”
“আজ্ঞে না। কখনও কাতুকুতু দেয়, কখনও সুড়সুড়ি, কখনও গাঁট্টা। প্রথমটায় সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুই দিত। তারপর হঠাৎ গাঁট্টা শুরু হয়েছে।”
মাধব ঘোষাল একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “তার মানে সুড়সুড়ি আর কাতুকুতুতে কাজ হয়নি। তাই গাঁট্টা মারতে শুরু করেছে।”
দুঃখবাবু একটু অবাক হয়ে ঘোষালের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “কাজ হয়নি! কাজ হয়নি মানে কি ঘোষালমশাই!”
মাধব ঘোষাল ভ্রূকুটি করে দুঃখবাবুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠলেন, “কপালে তোমার এখনও বিস্তর গাঁট্টা আর দৌড়োদৌড়ি লেখা আছে।”
দুঃখবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “সে কী? মরে যাব যে মশাই!”
“মরতে এখনই তোমাকে দিচ্ছে কে?”