আমি মানুষ হব – উপন্যাস – রণেন ঘোষ
রোবটের তিন আইন
১. রোবট মানুষকে আঘাত করবে না অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে মানুষকে কোনও ক্ষতির সম্মুখীন হতে দেবে না।
২. প্রথম আইনের বিরুদ্ধাচরণ আদেশ ব্যতিরেকে রোবট মানুষের সব আদেশই মানবে।
৩. প্রথম ও দ্বিতীয় আইনের প্রতিবন্ধক না হওয়া পর্যন্ত রোবট নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
০১.
অনেক অনেক ধন্যবাদ। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল অ্যান্ড্রু মার্টিন। মনের গভীরে ঝড়ের দাপট, বাইরে সুনীল আকাশ। ভবলেশহীন শান্ত মুখমণ্ডল, চোখের তারায় সামান্য অস্থিরতা। পরিপাটি মাথার চুল, হালকা বাদামি, নির্লোম অবয়ব, পোশাকে অতীত ঐশ্বর্য, পাটভাঙা নিখুঁত পরিপাটি।
টেবিলের অপর পাশে সার্জন। টেবিলের উপর ফলকে নাম-পরিচয়, নামের পরে সার সার অনেকগুলো ক্রমিক সংখ্যা। অ্যান্ড্রুর কাছে অর্থহীন এসব, নামে কী আসে যায়, সার্জন… ডাক্তার… না না, সার্জন বলে ডাকলেই হবে।
অপারেশনটা কখন হতে পারে সার্জন? সরাসরি প্রশ্ন করে আন্ডু।
সঠিক করে কিছু আগে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আমার… কার ওপর অপারেশন হবে মি. অ্যান্ড্রু। যান্ত্রিক স্বরের মধ্যেও সম্ভ্রমের ছোঁয়াচ, ভাবলেশহীন নিষ্প্রাণ মুখ হালকা ছাই রঙের ইস্পাতের গড়া, ধূসর মসৃণ।
সার্জনের দুই হাত টেবিলের উপর পড়ে আছে অলসভাবে। ডান হাত যেন শাণিত অস্ত্র, ঠিক যেন অপারেশনের ছুরি। লম্বা লম্বা আঙুলগুলো ঈষৎ বক্র, স্ক্যালপেল লাগিয়ে দিলে একাত্ম হয় সুন্দরভাবে।
নির্নিমেষ নেত্রে অ্যান্ড্রুর দিকে তাকিয়ে আছে সার্জন। নিখুঁত কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ওর সর্বাঙ্গে। মানব সভ্যতার অবিশ্বাস্য অগ্রগতির মূর্তিমান প্রতিচ্ছবি। স্বতন্ত্র মস্তিষ্কের অধিকারী হলেও কার্যক্ষমতা কিন্তু সীমাবদ্ধ এদের–আর সীমাবদ্ধ বলেই অ্যান্ড্রুকে চিনতে পারল না সার্জন। মনে-মনে বেশ মজা অনুভব করল অ্যান্ড্রু, পরক্ষণে বিষাদে ভরে উঠল সমস্ত মন।
সার্জন, মানুষ হতে সাধ যায় না কখনও? একবারও কি চিন্তা করেছ সে কথা? নড়েচড়ে বসল সার্জন, মূহূর্তের জন্য সামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব। পূর্বনির্ধারিত পজিট্রনিক পথের কোথাও যেন গরমিল হচ্ছে প্রশ্নটাকে খাপ খাওয়াতে।
কিন্তু… কিন্তু আমি তো রোবট।
হ্যাঁ হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো বলছি, মানুষ হতে ইচ্ছে হয় না তোমার?
মানুষ হলে কি ভালো সার্জন হতে পারব আমি? না, মানুষেরা ভালো সার্জন হয় না কখনও। একমাত্র উন্নত সার্জন হয় মি. অ্যান্ড্রু। আর সেটাই আমার একমাত্র কামনা।
আমার কথা শোনো সার্জন, এই যে আমি আদেশ করছি তোমাকে, এতে ছোট মনে হচ্ছে না নিজেকে? আমি তো তোমাকে ইচ্ছেমতো কাজ করাতে পারি, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে বলতে পারি, বসতে বলতে পারি মাটিতে, ডাইনে বাঁয়ে ঘুরতে বলতে পারি, যা খুশি।
আপনাদের খুশি করাই তো আমার কাজ, আমার আনন্দ। এ-বিষয়ে তিন আইন মানতে আমরা বাধ্য। যাক, কার উপর অপারেশন হবে বললেন না তো আমাকে?
আমার উপর।
না না, অসম্ভব! এ তো রীতিমতো বিপজ্জনক অপারেশন!
বিপজ্জনক বলে বন্ধ আছে নাকি অপারেশন? সবই সমান আমার কাছে। শান্তস্বরে জবাব দিল অ্যান্ড্রু।
কিন্তু… কিন্তু, আপনার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু করতে পারব না আমি! নিরুত্তাপ স্বরে বলল সার্জন।
ঠিক বলেছ ডাক্তার, মানুষের কোনও ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ করবে না, কিন্তু… আমি, আমি তো রোবট, ঠিক তোমার মতো!
.
০২.
গোড়ার দিকে অর্থাৎ অ্যান্ড্রুর জন্মের সময়ে অন্যান্য রোবটের চেয়ে কোনও পার্থক্য ছিল না। ওর। রূপায়ণের নকশায় দৈনন্দিন কাজকর্মে বিশেষ পারদর্শী, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ধাতব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কঠিন ও মসৃণ চলাফেরায় যান্ত্রিক কাঠিন্য।
গৃহস্থালিতে রোবটের প্রচলন সেই প্রথম। পরীক্ষামূলকভাবে বিশিষ্ট কয়েকজনের বাড়িতেই রোবট স্থান পেয়েছে মানুষের সঙ্গে। মার্টিন পরিবার এই ভাগ্যবানদেরই একটি।
মার্টিন পরিবারের সদস্যসংখ্যাই বা তখন কত? শ্রী এবং শ্রীমতী মার্টিন, দুই কন্যা, বড় মামণি, ছোট মামণি। সেদিনের কথা যেন কালকের কথা বলে মনে হয় অ্যান্ড্রুর। দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, মাস, বছর, যুগ, তারপর… তারপর নিজের পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যাই কি মনে আছে ওর! বিস্মৃতির অতলে হাতড়ে দেখার চেষ্টা করল অ্যান্ড্রু, না, সবই পান্ডুর ধূসর, মনে পড়ে না কিছু সংখ্যা মনে নেই, হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু হয়েছিল NDR। আশ্চর্য! এই ভুলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। রোবট তো আর মানুষ নয় যে ভুলে যাবে বেমালুম, আসলে মনে রাখার চেষ্টাই করেনি সে। তার ফলে নিত্যনতুন বিষয়ের ভারে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সংখ্যাগুলো, সে কি আজকের কথা!
অ্যান্ড্রুর মনের মণিকোঠায় ছোট মামণি অক্ষয় অব্যয়। অ্যান্ড্রু নামকরণ ছোট মায়েরই কীর্তি। অ্যান্ড্রু, আন্ডু কী সুন্দর মিষ্টি নাম। নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ওর সব সত্তা, অস্তিত্ব, পরিচয়। কেন ডেকেছিল অ্যান্ড্রু বলে ছোট মামণি? সে কথা জেনেছিল অনেক পরে, ছোট মামণি তখন নিতান্তই শিশু, অক্ষর আর সংখ্যা সবই অর্থহীন, তার ফলেই মিষ্টি নাম করে ডেকে উঠেছিল ছোট মামণি, অ্যান্ড্রু।
নব্বুই বছর বেঁচেছিল ছোট মামণি। সেই ছোট মামণিই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আজ কতদিন! কত বছর চলে গেছে তারপর! সেইসব ঝলমলে দিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না অ্যান্ড্রু। একদিন নাম ধরে ডেকে উঠেছিল ছোট মামণিকে, অভিমানে থমথমিয়ে উঠেছিল ছোট মামণির মুখখানা। পুরো একদিন বাক্যালাপ করেনি অ্যান্ড্রুর সঙ্গে। তারপর… তারপর, পরের দিন ঠোঁট ফুলিয়ে প্রশ্ন করেছিল, আমি বুঝি আর মামণি নই তোমার? ছোট মামণিঃ কী হল? বলো, বলো অ্যান্ড্রু! ব্যাস, দুর্যোগের ঘনঘটা উধাও হয়ে আবার রোদ-ঝলমলে আনন্দভরা নীলাকাশ।
ঘরের যাবতীয় কাজ ফাই-ফরমাশ খাটা এসবই ছিল অ্যান্ড্রুর কাজ। মাঝে মাঝে রান্নার কাজও চাপত তার ওপর। সেসব দিন ছিল অগ্নিপরীক্ষার মতো, কোন কাজ পারবে আর কোন কাজ পারবে না সে নিজেই জানত না। তবুও মার্টিন পরিবারে বেশ সুখেই শুরু হয়েছিল অ্যান্ড্রুর জীবন। সুখ! রোবটের সুখ। কিন্তু অ্যান্ড্রু রোবট হয়েও আরও যেন কিছু বেশি। তবে বেশির ভাগ সময় বাড়ির কাজ করতে হত না, মামণিদের সঙ্গে খেলা করতে করতেই দিন কেটে যেত ওর।
এক গুপ্ত রহস্য ধরা পড়েছিল বড় মামণির কাছে, অ্যান্ড্রুকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগাবার সহজতম উপায়।
আমাদের সঙ্গে খেলতে হবে তোমাকে অ্যান্ড্রু এটা আমার আদেশ।
আমি দুঃখিত মামণি, তোমার আগেই আর একটা কাজের আদেশ করেছেন মার্টিন সাহেব, সুতরাং আগের আদেশ পালন করাই আমার কর্তব্য।
আবার ভুল করছ অ্যান্ড্রু, বাবা বলেছিলেন সময় থাকলে টেবিলটা পরিষ্কার করতে। এটা কি আদেশ? না, আদেশ নয়, আমি কিন্তু আদেশ করছি… হ্যাঁ, আদেশ করছি… জোর দিয়ে কথাগুলো বলেছিল বড় মামণি।
না, রাগ করতেন না মার্টিন সাহেব। সারা মুখে ফুটে উঠত অনাবিল হাসি। মামণি-অন্ত প্রাণ ছিল মার্টিন সাহেবের। আর অ্যান্ড্রু? সকলের কৌতুক আর খেলার সাথী। এই খেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল বিচিত্র এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, মমত্ববোধ, ভালোবাসা। তখন এসব পরিস্ফুট না হলেও এখন অ্যান্ড্রু বুঝতে পারে সব। মামণিদের সঙ্গে খেলার ছলেই একদিন ঘটেছিল এক ঘটনা, সেই ঘটনার পরই পালটে গেল অ্যান্ড্রুর জীবন।
দিদির পেন্ডেন্টের উপর দারুণ লোভ ছোট মামণির। হাতির দাঁতের উপর সোনার কাজ করা কী সুন্দর লকেট! বাবার কাছে অবদার করেও লাভ হয়নি কিছু। কিন্তু সুন্দর এক পেন্ডেন্ট না হলে যে দিনরাত সব বিস্বাদ ছোট মামণির। সুতরাং এক টুকরো কাঠ আর একটা ছুরি নিয়ে হাজির হয়েছিল অ্যান্ড্রুর কাছে। ছোট মামণির আবদার কি ফেলতে পারে? তৈরি হয়েছিল বিচিত্র এক পেন্ডেন্ট।
পেন্ডেন্ট হাতে নিয়ে আনন্দে এক পাক ঘুরে হাততালি দিয়ে উঠেছিল ছোট মামণি।
কী দারুণ সুন্দর! সত্যি তুমি যে কী ভালো অ্যান্ড্রু! যাই, বাবাকে দেখিয়ে আনি আমি।
মার্টিন সাহেব বিশ্বাস করেননি প্রথমে। একের পর এক প্রশ্ন করেছিলেন ছোট মামণিকে। অ্যান্ড্রু বাদ যায়নি প্রশ্নের হাত থেকে।
অ্যান্ডু, সত্যি কি এটা তোমার তৈরি?
হ্যাঁ সাহেব।
নকশাটাও তোমার? নিজের?
হ্যাঁ… সবই আমার নিজের তৈরি।
কোথায় পেলে নকশাটা অ্যান্ড্রু?
বলছি তো, আমার নিজের নকশা, জ্যামিতির নানা রূপরেখার সমন্বয়। এর সঙ্গে মিলিয়েছি কাঠের নিজস্ব দাগ।
পরের দিন, ভোর হয়েছে সবেমাত্র, আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্ব ঘোচেনি সম্পূর্ণ। এক টুকরো কাঠ হাতে নিয়ে অ্যান্ড্রুর ঘরে ঢুকেছিলেন মার্টিন সাহেব। বেশ বড় কাঠের টুকরো, সঙ্গে ছিল ইলেকট্রিক ভাইব্রো ছুরি।
অ্যান্ড্রু, এই কাঠ আর ছুরি দিয়ে যা-হোক কিছু বানাও তো দেখি। যে কোনওকিছু, তোমার পছন্দমতো।
সেই মুহূর্তে কাজ শুরু করেছিল অ্যান্ড্রু। নির্নিমেষে লক্ষ করেছিলেন সব কিছু মার্টিন সাহেব। কাজ শেষ হবার পর বিস্ময়ে হতবাক। শুধু কয়েকবার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন অ্যান্ড্রুর দিকে। তারপর মাটিতে বসে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে হয়নি আর। টেবিল-চেয়ার এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে, আর এসেছিল আসবাবপত্রের নকশার সব নানান বই। শুরু হয়েছিল এক নতুন জীবন। সুদৃশ্য ক্যাবিনেট আর ডেস্ক তৈরির কাজে মগ্ন হয়েছিল অ্যান্ড্রু।
এর কয়েকদিন পর অ্যান্ড্রুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মার্টিন সাহেব।
শাবাশ অ্যান্ড্রু! শাবাশ! কীসব অপূর্ব জিনিস তৈরি করেছ তুমি! যেমন সুন্দর তেমনি অভিনব!
তৈরি করার সময়ে আমারও দারুণ ভালো লেগেছিল।
ভালো লেগেছিল? কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ স্যার। কেন জানি না এগুলো করার সময়ে সহজ-সরলভাবে কাজ করে ব্রেনের সূক্ষ্ম সার্কিটগুলো, ছোট মামণির কাছ থেকে শুনেছিলাম ভালো লাগা কথাটা। দেখলাম আমার ব্রেনের প্রোগ্রামের সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খেয়ে গেল কথাটা। ভালো লাগা কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল… মনে হল যেন অনেক দ্রুত কাজ করছে আমার ব্রেন। কাজ করার ক্ষমতাও যেন বেড়ে গেছে বহুগুণ, আর… আর…
.
০৩.
আঞ্চলিক আইন সভার সদস্য বলে প্রধান রোবোসাইকোলজিস্টের সঙ্গে সাক্ষাত করতে বেশি বেগ পেতে হল না মার্টিন সাহেবের। ইউনাইটেড স্টেটস রোবটস অ্যান্ড মেকানিকেল মেন-এর সদর দপ্তরেই ঘটল এই সাক্ষাৎকার।
রোবোসাইকোলজিস্ট মেট্রন মানস্কি ধীরভাবে শুনেছিলেন সব কথা। মাঝে মাঝে কুঁচকে উঠেছিল–জোড়া। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন অ্যান্ড্রুর দিকে।
মি. মার্টিন, সত্যি কথা বলতে কি রোবোটিক্স কোনও শিল্পকলা নয়, পুরো ব্যাপারটা হয়তো বোঝাতে পারব না ঠিকমতো… সূক্ষ্ম কঠিন গাণিতিক নিয়মে পরিচালিত পজিট্রনিক ব্রেনের গতিবিধি খুবই দুর্বোধ্য, জটিল। তবে সম্ভাব্য সমাধান করলেও কোনও শিল্পকলা করা সম্ভব নয় মোটেই। তা ছাড়া তিন আইনের বাইরে যাবার ক্ষমতা নেই রোবটের। যাই হোক, পুরোনো রোবট পালটে এক নতুন রোবট পাবেন। আর এইসব ব্যাপারের জন্য রীতিমতো দুঃখিত আমরা।
না না মানস্কি, আপনি যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু। রোবটের কোনও দোষের কথা বলছি না আমি। সব কাজই নিখুঁতভাবে করে অ্যান্ড্রু। আসল ব্যাপার কী জানেন, নিজের মন থেকে নানারকম সুন্দর সুন্দর নকশা খোদাই করেছে। এক নকশা দু-বার হয়নি কখনও। ওর সমস্ত কাজই এক উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন মানস্কি।
এক অবিশ্বাস্য বিস্ময় ফুটে উঠল রোবোসাইকোলজিস্টের চোখেমুখে। কয়েক মূহূর্ত চুপ করে থেকে বলে উঠলেন, আশ্চর্য! এটা সম্ভব কী করে! সব রোবটেরই পজিট্রনিক ব্রেনের গতিবিধি তো একই নিয়মাবলির মধ্যে বাঁধা, বাস্তবিক সৃজনমূলক শিল্পকলা? ভালো করে পরীক্ষা করে বলছেন তো মি. মার্টিন?
এবার না হেসে থাকতে পারলেন না জিরাল্ড মার্টিন।
আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তবে আপনিই দেখুন নিজের চোখে… এক টুকরো কাঠ তুলে দিলেন মানস্কির হাতে। কাঠের ফলকটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন রোবোসাইকোলজিস্ট। খোদাই করা এক খেলার মাঠ, খুদে খুদে ছেলেমেয়েরা বল খেলছে মনের আনন্দে, ক্ষুদ্রকায় হলেও সৌষ্ঠবে নিখুঁত দেহগুলো, সুন্দর স্বাভাবিক।
ওই ওই রোবট করেছে বলছেন! এ এক অঘটন ছাড়া আর কিছু নয় মি. মার্টিন। পজিট্রনিকের গতিপথের হেরফের হয়েছে নিশ্চয়ই কোথাও।
আচ্ছা মানস্কি, ঠিক এমনই এক সৃজনীশক্তিসম্পন্ন রোবট তৈরি করতে পারেন আপনি?
না না, অসম্ভব! বুঝতেই পারছি না কেমন করে ঘটল এমনটা!
যাক, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই। অ্যান্ড্রুই এক… একমেবাদ্বিতীয়ম! চলো অ্যান্ড্রু, বাড়ি চলো।
.
০৪.
ছোট মামণি আর ছোট মামণি! অ্যান্ড্রুর জগৎ জুড়ে শুধু ছোট মামণি। ছোট মামণির আবদারের ফলেই অ্যান্ড্রু যেন শাপমুক্ত হল রোবটের জগৎ থেকে। এখন সে এক বিশেষ রোবট। শিল্পী রোবট।
প্রথম প্রথম অ্যান্ড্রুর হাতের কাজ সব বিনামূল্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মার্টিন সাহেব। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনেরাও খুশি হয়েছিল বিনামূল্যের উপহারে। কিন্তু আপত্তি জানাল ছোট মামণি।
বাবা, এ তুমি ঠিক করছ না। না-ই বা তোমার খরচা লাগল, কিন্তু অ্যান্ড্রুর পরিশ্রমের কি মূল্য নেই কিছু? না না, এভাবে চলবে না। দাম না নিয়ে আর দেওয়া নয় কোনও কিছু৷ দাম দিলেই কি এমন সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়?
ছোট মামণি, এত লোভ ভালো নয় কিন্তু।
না না, বাবা, লোভের কোনও ব্যাপারই নয় এটা। বিক্রি বাবদ কোনও টাকাই নেব না আমরা। এ তো শিল্পীর টাকা, অ্যান্ড্রুর টাকা।
শিল্পী! এই শব্দ সম্পূর্ণ নতুন অ্যান্ড্রুর কাছে। নানানভাবে শব্দটাকে উচ্চারণ করেও অর্থোদ্ধার করতে পারল না সে। সবার অলক্ষে অভিধানের মাধ্যমেই মালুম হল সে এক শিল্পী। আর ঠিক সেই দিনই মার্টিন সাহেবের সঙ্গে অ্যান্ড্রুকে যেতে হল অনেক দূরে, উকিলের অফিসে।
জন ফেইনগোল্ডের বয়েস হয়েছে বেশ। ধবধবে সাদা মাথার চুল, চিবুকের মাংস ঝুলে পড়েছে নিচে, মোটাসোটা নাদুসনুদুস। হাসলে বিশেষ এক ছন্দে কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ।
জন, এ সম্বন্ধে তোমার মত কী বলো তো?
উত্তর না দিয়ে কাঠের ফলকগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলেন ফেইনগোল্ড। চোখে-মুখে গভীর বিস্ময়।
অপূর্ব! দারুণ সুন্দর! এ কি তোমার রোবটের কীর্তি? এই কি সেই রোবট মার্টিন?
হ্যাঁ জন, এই হল অ্যান্ড্রু। নামকরণ করেছে আমার ছোট মামণি, এসব ওরই কাজ। তা-ই না অ্যান্ড্রু?
হ্যাঁ স্যার, এসব আমারই তৈরি। সসম্ভমে বলল অ্যান্ড্রু।
জন, এই শিল্পকলাগুলোর দাম কত হতে পারে বলে মনে হয় তোমার?
দেখো মার্টিন, আইনের মারপ্যাঁচ বোঝাই আমার কাজ। শিল্পকলা ভালো লাগলেও দাম সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। তবে হ্যাঁ, নকশাগুলো দারুণ সুন্দর।
তা হলে বলি শোনো, আড়াইশো ডলার দিয়ে কিনতে চেয়েছেন এই ফলকটা এক ভদ্রলোক। পাঁচশো ডলারে বিক্রি করেছি ওর তৈরি চেয়ারগুলো। এ পর্যন্ত মোট দু-হাজার ডলার জমা দিয়েছি ব্যাংকে। এসব অ্যান্ড্রুর জন্যেই সম্ভব হয়েছে জন।
বলছ কী তুমি মার্টিন! অ্যান্ড্রু যে তোমাকে রাজা করে তুলেছে হে!
হ্যাঁ, তা বলতে পার, তবে মোট ডলারের অর্ধেক আবার অ্যান্ড্রুর নামে জমা করে দিয়েছি জন।
কী বললে? অ্যান্ড্রুর নামে? রোবটের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট!
হ্যাঁ জন, একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি অ্যান্ড্রুর নামে। আর এই ব্যাপারটা কতটা আইনসিদ্ধ সেটা জানতেই আসা তোমার কাছে।
আইনসিদ্ধ! ফেইনগোল্ড রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে মার্টিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মার্টিনের মাথা ঠিক আছে তো? সন্দেহ হল একবার।
মার্টিন, না, এমন কোনও নজির নেই। আচ্ছা, ব্যাংকের কাগজে কেমন করে সই করবে রোবট?
কেন? নিজের নাম সই করতে পারে অ্যান্ড্রু। বাড়িতেই সই করিয়ে নিয়েছিলাম ব্যাংকের কাগজে। ইচ্ছে করেই ব্যাংকে নিয়ে যাইনি ওকে। এরপর তুমি কী বলবে জন?
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে অ্যান্ড্রু। কথার কোনও অর্থই ঢুকছে না ওর মাথায়। চোখ বুজে চিন্তায় মগ্ন ফেইনগোল্ড।
মার্টিন, একটা ট্রাস্ট তৈরি করা যায় অ্যান্ড্রুর নামে। অ্যান্ড্রুর বকলমে ট্রাস্টিরাই টাকার লেনদেন করবে। তা নয় তো বেআইনি বলে চিৎকার করে উঠবে পৃথিবীর সবাই। ঈর্ষাকাতর আমরা সবাই, তাই ট্রাস্টিই হবে অ্যান্ড্রু আর আমাদের মাঝে ইনসুলেশন। আমার মতে এটাই করা উচিত তোমার। আর যদি আপত্তি করে কেউ কোর্ট তো ভোলাই আছে, আমার সঙ্গে বোঝাঁপড়া হবে তখন।
বেশ! আশ্বস্ত হলাম জন। যাক এবার বলো তো কী ফিস দেব তোমাকে?
হ্যাঁ মার্টিন, বেশ ভালো ফিস দিতে হবে কিন্তু তোমাকে। বড় জটিল অ্যাডভাইস।
বেশ তো, তুমিই বলো কী দেব।
দেবে তো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলো তুমি।
খোদাই করা কাঠের ফলকটা দাও আমাকে, এটাই আমার ফিস!
.
০৫.
মহাকালের ছোঁয়াচ লাগে অ্যান্ড্রুর ইস্পাতের শরীরে। আধুনিক রোবটের কাছে নেহাতই জবরজং আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ো। দেহ পালটানোর প্রয়োজন একান্ত। হলও তা-ই, নিজের জমানো টাকাতে নবকলেবর লাভ করল অ্যান্ড্রু।
প্রথমে অবশ্য মত দেননি মার্টিন সাহেব। কিন্তু অ্যান্ড্রুর যুক্তিতর্কের কাছে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল অমতের বেড়াজাল। তবে দেহ পালটালেও অটুট রইল পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ।
অ্যান্ড্রু, তোমার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না আজকের রোবটের। পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে আজকাল। অর্থাৎ বিশেষ কাজ ছাড়া নতুন কিছু করার কোনও ক্ষমতাই নেই আজকের রোবটের। না অ্যান্ড্রু, না, তোমার কোনও তুলনাই হয় না। অ্যান্ড্রুর পাশে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিলেন মার্টিন সাহেব।
ধন্যবাদ স্যার।
না না, ধন্যবাদের কথা নয়। সত্যি এক নজিরবিহীন সৃষ্টি তুমি৷ সেইজন্যই আমার ভয় ছিল যে তোমার পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথ বোধহয় খোলা রাখবে না মানস্কি। ওর চোখমুখের ভঙ্গি দেখে বুঝতে দেরি হয়নি আমার। তোমার অসীম সম্ভাবনা একেবারেই পছন্দ নয় ওর। কতবার পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি একেবারে। বারেবারে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তাই মনস্কির অবসর নেবার পরই সম্ভব হল তোমার দেহ পালটানো।
সাহেবের বাঁধভাঙা সন্তানস্নেহ অঝোরধারায় বর্ষিত হয় অ্যান্ড্রুর উপর। ভালোবাসার নিবিড় আকর্ষণে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করে সে। বয়সের ভারে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে মার্টিন সাহেবের দীর্ঘ দেহ। হালকা হয়ে এসেছে মাথার চুল, ঈষৎ ধূসর বর্ণ, বলিরেখা সমাকীর্ণ সমস্ত মুখমণ্ডল। সাহেবের পাশে অ্যান্ড্রু ঝকঝকে তকতকে, বলিষ্ঠ কর্মঠ।
পরিবর্তন শুধু অ্যান্ড্রু বা মার্টিন সাহেবরই হয়নি। পরিবর্তনের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। পুরো মার্টিন পরিবার। শ্রীমতী মার্টিন ইউরোপেই থাকেন বেশি সময়। শিল্পকলা বিষয়ে কীসব যেন গড়ে তুলেছেন নানান জায়গায়। বড় মামণি এখন নামকরা কবি, নিউইয়র্কের স্থায়ী বাসিন্দা। বিয়ে হয়েছে ছোট মামণির। বেশি দূরে নয়, কাছেই বাড়ি ওদের। অ্যান্ড্রুকে ছেড়ে দূরে থাকা পছন্দ করে না ছোট মামণি। এরপর খুদে মালিকের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ করার ভার পড়েছিল ওর উপর, দুধের বোতল ধরা থেকে মায় ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত।
ঠিক এমন এক দিনে সামান্য এক অনুরোধ নিয়ে মার্টিন সাহেবের সামনে হাজির হল অ্যান্ড্রু।
স্যার আপনার দয়াতেই ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করি আমি, তাই…
দয়া? আমার দয়া কেন? এ তো তোমার রোজগারের টাকা অ্যান্ড্রু।
যা-ই বলুন না কেন, এ তো আপনার স্বেচ্ছাকৃত দান। সব টাকা নিজের কাছে রেখে দিলেও আইনের চোখে অন্যায় হত না আপনার। আইনে না থাকা সত্ত্বেও আপনার বদান্যতার কোনও তুলনা হয় না।
অ্যান্ড্রু, আইন কখনওই আমাকে অন্যায় করতে বাধ্য করতে পারে না। আর পারে না বলেই…
স্যার সমস্ত খরচ-খরচা বাদ দিয়ে আমার প্রায় ছয় লাখ ডলার জমেছে। তাই বলছিলাম…
আমাকে নতুন করে আর বলতে হবে না অ্যান্ড্রু। সমস্তই তো আমার জানা।
আপনি তো জানবেনই স্যার। তাই বলছিলাম, আমার সমস্ত সঞ্চয় আপনাকে দিতে চাই…
আমাকে? না না, তা হয় না, তা হয় না।
স্যার শুধু শুধু নিতে বলছি না। টাকার পরিবর্তে আমার সামান্য এক প্রার্থনা আছে আপনার কাছে। সামান্য এক ভিক্ষা…
কী… কী বলতে চাইছ অ্যান্ড্রু? প্রার্থনা, ভিক্ষা এসব কী বলছ তুমি! বলল, কী দেয় আছে আমার।
আমার স্বাধীনতা দিন স্যার।
তোমার… স্বাধীনতা… মানে…
হ্যাঁ স্যার, আমার সবকিছুর বিনিময়ে শুধু স্বাধীনতা চাই আমি। কেবলমাত্র স্বাধীনতা!