১. রিং-এর পাশে দুটো লোক

বক্সার রতন – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

রিং-এর পাশে দুটো লোক পাশাপাশি বসে আছে। একজন বেঁটেখাটো, দুর্দান্ত স্বাস্থ্য, মুখে দাঁড়িগোফের জঙ্গল, মাথায় একটা নীল ক্যাপ, গায়ে ডোরাকাটা নীল সাদা টি শার্ট, পরনে ব্লু জীনস। অন্যজন লম্বা, ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতো ছিপছিপে, পরনে ধূসর রঙের সুট, গলায় টাই, মুখচোখ খুব ধারালো, দুজনেরই বয়স ত্রিশ বত্রিশের মধ্যে।

রতন রিং-এর ভিতর থেকে দুজনকে লক্ষ করল। লক্ষ করারই কথা। গত দু-তিন মাসে সে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ও ভারতের বাইরেও নানা আসরে বক্সিং-এ নেমেছে অন্তত পাঁচ ছ’বার। দিল্লি, বাঙ্গালোর, ভুবনেশ্বর, কলম্বো এবং এখন এই খপুর। সব জায়গাতেই সে রিং-এর ধারে এই দুজনকে লক্ষ করেছে। এমন হতে পারে যে, এই মানিকজোড় বক্সিং-এর সাংঘাতিক ভক্ত। তাই যেখানে বক্সিং-এর আসর বসে সেখানেই গিয়ে হাজির হয়।

কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। রতন দেখেছে, এই দুজন আসে

কেবল তারই লড়াই দেখতে। আগে বা পরে যে-সব লড়াই হয়, তাতে এই দুজনের টিকিও দেখতে পাওয়া যায় না। কেন এরা তাকেই নজরে রেখেছে, তা রতন জানে না, কিন্তু আজ সে বেশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

গ্লাভস পরানোর আগে রতনের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হচ্ছিল। পাশেই দাঁড়িয়ে পশ্চিমবাংলা দলের ম্যানেজার চিত্তব্রত দে।

রতন মুখ তুলে ডাকল, “চিত্তদা।”

“কিছু বলছ?”

রতন ইশারা করল। চিত্তব্ৰত কানটা রতনের মুখের কাছে এগিয়ে আনে।

রতন বলল, “তাকাবেন না। খুব আড়চোখে আমার ডানধারে প্রথম সারিতে দেখুন, দুজন লোক বসে আছে। একজনের মুখে দাড়ি গোঁফ, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি, অন্যজন স্যুটেড বুটেড। ওঁদের চেনেন?”

চিত্তব্ৰত সোজা হয়ে চারদিকটা খুব উপেক্ষার চোখে একবার দেখে নেয়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, “না। কেন বলো তো?”

“কোথাও দেখেননি?”

“মনে পড়ছে না।”

“আমি ওদের প্রায় সব জায়গাতেই হাজির থাকতে দেখেছি।”

ঢং করে ঘন্টা বাজল। লড়াই শুরু হতে দেরি নেই। চিত্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, “ওদের নিয়ে ভেবো না। কনসেনট্রেট অন দি ফাঁইট। সুব্বা কিন্তু সাংঘাতিক অপোজিশন।”

রতন তা জানে। গত এক বছর ধরে সে আজকের রাতের জন্য তৈরি হয়েছে তিল তিল করে। দিল্লি, বাঙ্গালোর বা কলোঘোর চেয়ে খঙ্গাপুরের এই লড়াইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আজ রাতে হয় রতন না-হয় তো সারভিসেসের সুব্বা লাইট

হেভিওয়েট জাতীয় চ্যামপিয়ন হবে। রতনের চেয়ে সুব্বার নাম-ডাক অনেক বেশি। সুব্বা অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিল, খুব অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ মেডেলটা পায়নি। তাও পয়েন্টে হেরে। সেই লড়াইতে যে জিতেছিল, সেই জাপানি বক্সারকে প্রথম দু রাউন্ডে মেরে পাটপাট করেছিল সুব্বা। সুতরাং আজকের লড়াইতে সুব্বাই হট ফেবারিট।

রতনের বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। তার সম্বল শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দম। লড়ে সে খুবই ভাল। কিন্তু সুব্বার মতো উঁচু শ্রেণীর বক্সারের সঙ্গে তার তুলনা করবে কে? তাছাড়া সুব্বার সঙ্গে এর আগে লড়াইয়ের কোনো সুযোগও রতন পায়নি। সুতরাং আজ তার একটু নাভাস লাগছিল।

রেফারী রিং-এ। রতন ও সুব্বা এসে রিং-এ ঢুকল। তুমুল হাততালি ও হর্ষধ্বনি।

সুব্বার চেহারা ভারী সুন্দর। টকটকে ফর্সা রঙ। বেশ লম্বা। শরীরের পেশীগুলি চ্যাপটা এবং আট। ঘাড় দারুণ মজবুত। কিন্তু বক্সারের শ্রেষ্ঠত্ব শুধু চেহারায় তো বোঝা যায় না। সুব্বার দুটি হরিণচোখের পেছনে যে তীব্র অনুমানশক্তি, খর নজর এবং বুদ্ধি রয়েছে তা বাইরে থেকে টের পাওয়া দায়। তার ওপর সুব্বা অত্যন্ত দ্রুতবেগসম্পন্ন বক্সার। অকল্পনীয় ফুটওয়ার্ক। কেউ-কেউ তাকে আলির সঙ্গে তুলনা করে। লড়াই শুরু হওয়ার ঘন্টা পড়তেই রেফারি দুজনকে রিং-এর মাঝখানে ডাকলেন। মৃদুস্বরে পরস্পরের পরিচয় করিয়ে দিলেন সংক্ষেপে। দুজনে গ্লাভসবদ্ধ হাতে হাত ঠেকাল।

তারপরই যে যার নিজের কোণে সরে গেল।

লড়বার মুহূর্তে আবার একবার রতনের চোখ পড়ল রিং-এর পাশে বসা সেই দুটি লোকের দিকে। তারা রতনের দিকে

একবারও তাকাচ্ছিল না। রিং-এর ওপরে ঝুলন্ত আলোর দিকে খুব আনমনে চেয়ে ছিল। কিন্তু রতনের মনে হয়, ওরা তাকে খুব ভাল করেই লক্ষ করছে।

জিতবে কি হারবে তা রতন জানে না। তবে ঘুষি খেতে খেতে আর ঘুষি মারতে মারতে তার একধরনের নির্বিকার ভাব এসে গেছে। ভয়ডরের ব্যাপার নয়। অভ্যাস। কেবল আজকের লড়াইটা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত লড়াই বলে এবং প্রতিপক্ষ সুব্বার মতো সাংঘাতিক বক্সার বলে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল রতন। আজকে আর যে পাঁচটি লড়াই হয়ে গেছে তার মধ্যে মাত্র একটিতে ব্যানটাম ওয়েটে পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিযোগী ছিল, মদন রায়। পাঞ্জাবের বীর সিং-এর কাছে সে পয়েন্টে হেরে গেছে। রতন আর মদন ছাড়া আর কোনো বাঙালি বক্সার এবার ফাঁইনালে পৌঁছতে পারেনি। মদন হেরে গেছে, রতনও হারবে বলেই সবাই ধরে নিয়েছে। আর সেইটিই রতনের সবচেয়ে সুবিধে, সে হারলেও লজ্জা নেই। কেউ দুয়ো দেবে না। বরং যদি ভাল লড়ে হেরেও যায়, তবু সবাই প্রশংসা করবে।

কিন্তু ভাল লড়াইয়ের জন্য প্রচণ্ড মনঃসংযোগ দরকার। বক্সিং-এ এক চুল ভুল, এক সেকেণ্ডের এক ভগ্নাংশের সময়ের হিসেবে গোলমাল একটুখানি চকিত সুযোগের অপব্যবহারও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। মন, চোখ, হাত, পা, মগজ সব তুখোড় সজাগ আর সচল রাখা চাই। বিশেষত সুব্বার মতো প্রতিপক্ষ যেখানে।

কিন্তু রতনের মনোযোগ আজ দুলছে। যে দুটো লোক রিং-এর পাশে চুপ করে বসে আছে, তাদের নিয়ে তার তেমন মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তবু সে কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছে।

আর মিনিটখানেকের মধ্যেই লড়াই শুরু হবে। সুব্বা দু হাত তুলে দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছে। কালো স্পোর্টস প্যান্ট, কালো আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে সুব্বাকে। রতনের নিজের চেহারাও তেমন কিছু খারাপ নয়। তবে সুব্বার মতো ফর্সা নয় তার রং। অত টানা-টানা চোখও তার নেই। কিন্তু মেদহীন রুক্ষ শরীরে তার একটা ঝড়ো ভাব আছে। লড়াইয়ের সময় সে জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিতে জানে। এইসব কারণে এই অল্প বয়সেই বক্সার হিসেবে তার কিছু নাম-ডাক হয়েছে। সেমি ফাঁইনালে সারভিসেসের একজন ঝানু বক্সারকে

সে পয়লা রাউণ্ডেই নক আউট করেছিল।

চিত্তব্ৰত সামান্য ম্লান হেসে বলল, “শোনো, প্রতিপক্ষ যত নামজাদাই হোক, দুনিয়ায় অপরাজেয় কেউ নেই।”

হঠাৎ রতন বলল, “চিত্তদা, ওই দুটো লোককে আপনি একটু নজরে রাখবেন। ওরা কেন সব জায়গায় আমার লড়াই দেখতে আসে তা জানা দরকার।”

চিত্তব্রত অবাক হয়ে বলল, “এক্ষুনি লড়াই শুরু হবে, আর তুমি এখন কে না কে দুটো লোকের কথা ভাবছ? আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে এখন কনসেনট্রেট করো তো! নইলে পয়লা রাউণ্ডেই ঘায়েল হয়ে যাবে। সুব্বা ইজ ট্রিকি, ভেরি ট্রিকি।”

শেষ ঘন্টা বাজল। রতন কাঁধ থেকে তোয়ালেটা ফেলে উঠে দাঁড়াল।

রেফারী মাঝখান থেকে সরে গেলেন। তারপরই চেঁচিয়ে বললেন, “ফাইট!”

রতনের চোখে আলোটা একটু ঝলসে উঠল কি? নাকি রেফারীর স্বর তার কানে একটু দেরিতে পৌঁছল? কিছু একটা গোলমাল হয়ে থাকবে। কারণ, রেফারীর চিৎকার শেষ হতে না হতেই বিদ্যুৎ-চমকের মতো, সাপের ছোবলের মতো, চাবুকের মতো তিনটে ঘুষি উপযুপরি নাড়িয়ে দিয়ে গেল তার চোয়াল, কপাল আর ডানদিকের কান।

মেঝের ওপর থেকে নিজের শোয়ানো শরীরটা যখন টেনে তুলছিল রতন, তখন তার কপালের কাটা জায়গাটা দিয়ে গরম রক্ত স্রোতের মতো নেমে এসে মুখ আর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। ডান কানে একটি ঝিঝি পোকার ডাক। ডান চোখ রক্তে খুঁজে এসেছে। চোয়াল একদম লক জ’ হয়ে আটকে রয়েছে। হয়তো হাঁ করতে পারবে না, চেষ্টা করলেও।

রেফারী ছয় পর্যন্ত গুনে শেষ করেছেন। রতন তখন উঠে দাঁড়াল।

দর্শকরা সবাই চিৎকার করে আর হাততালি দিয়ে সুব্বাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

রেফারী মৃদুস্বরে রতনকে জিজ্ঞেস করলেন, “উড ইউ ফাঁইট অর রিটায়ার?”

রতন মাথা নাড়ল, গ্লাভস দিয়ে ডান চোখের রক্ত খানিকটা মুছে নিয়ে আড়ষ্ট চোয়ালে অতি কষ্টে উচ্চারণ করল, “ফাইট। ফাঁইট!”

“ফাইট?” বলে চেঁচিয়ে রেফারী সরে গেলেন।

ঘুষি খাওয়া বা রক্তপাত রতনের কাছে নতুন নয়। সে হতভম্ব হয়ে গেছে সুব্বার চকিত আক্রমণে। এত দ্রুত যে কারো হাত-পা চলতে পারে তা রতনের জানা ছিল না। সে বুঝল, সে যা। শুনেছিল, সুব্বা তার চেয়েও ভাল লড়িয়ে।

রতনের দ্বিধা আর অমনোযোগের যে ভাবটা ছিল, তা তিনটি ঘুষিতেই একদম কেটে গেল। যে দুটো লোককে দেখে সে অস্বস্তি বোধ করছিল, তাদের কথা আর তার মনেই রইল না। তার সামনে শুধু জেগে রইল রিং-এর ছোট্ট চৌহদ্দি আর তার মধ্যে দুর্ধর্ষ এক প্রতিপক্ষ।

নিয়ম হচ্ছে প্রতিপক্ষকে একবার ভাল করে মার জমাতে পারলে তারপর তাকে যথেচ্ছ মারা। তাকে আর থিতু হতে না দেওয়া, কেবল তাড়া করে যাওয়া। ফলে তার মনোবল ভেঙে যায়। সে হারে।

সুব্বাও তাই করতে চাইছিল। হয়তো ভেবেছিল সে প্রথম রাউণ্ডেই এই এলেবেলে লড়াইটা শেষ করে ড্রেসিং রুমে একটু জিরিয়ে নেবে।

কিন্তু মার খাওয়া রক্তাক্ত রতন চমৎকার পায়ের কাজে বাঁ দিকে সরে গিয়ে এবং ঠিক সময়ে মাথা সরিয়ে নিয়ে সুব্বার দু দুটো করাল ডানহাতি রাউণ্ডহাউস এড়িয়ে গেল।

সুব্বা ডান হাতে মারছে! তার মানে সুব্বার গার্ড নেই। অর্থাৎ জয় সম্পর্কে সে এতই নিশ্চিত যে, রতনের সম্ভাব্য প্রতি-আক্রমণের কথা সে মনেই ঠাঁই দেয়নি।

রতনের পিছিয়ে যাওয়া দেখে সুব্বা খুব সহজভাবেই এগিয়ে এসে দু হাতে কয়েকটা চকিত ওয়ান-টু চালাল তার মুখে। কোনোটাই লাগল না। রতন গ্লাভসে আটকে দিল।

রতন দড়ির ওপর ভর দিয়ে সুব্বার মার আটকাচ্ছিল যখন, সেই সময়ে পিছন থেকে কে যেন চাপা গলায় বলল, “লেফট! লেফট! হি হ্যাঁজ নো গার্ড।”

দৈববাণীর মতো সেই কণ্ঠস্বর কি চিত্তদার? কে জানে। কিন্তু রতন চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল, সুব্বার বাঁ দিকটা অরক্ষিত।

কিন্তু দড়ির ভর ছেড়ে উঠে মারতে যে সময় লাগবে ততটা সময় সুব্বা দেবে কি? মহম্মদ আলি জর্জ ফোরম্যানের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় রিং-এর দড়িকে খুব কাজে লাগিয়েছিল। স্কুল খেয়ে, সরে গিয়ে, দড়িটাকে স্প্রিং-এর মতো ব্যবহার করে আলি জিতেছিল সেই লড়াই। আর সেই কৌশলের নাম আলি নিজেই দিয়েছিল ‘রোপ এ ডোপ।

রতন দড়ির সেই খেলা জানে না। আলির পক্ষে যা সম্ভব, তা কি যে-কেউ পারে? কিন্তু মজা হল রিং-এর দড়িটা তার পিছন দিকে স্প্রিং-এর মতো কাজ করছে। দড়িতে একটা স্কুল খেয়ে।

দেখবে নাকি?

সুব্বার আর-একটা জ্যাব বুকের ডান ধারে লাগতেই দম বন্ধ করে রতন পিছন দিকে প্রচণ্ড গতিতে একটা ধাক্কা দিল। দড়িটা ম্প্রিং-এর মতোই তাকে উল্টে ছুঁড়ে দিল ভিতর দিকে। রতন ছিটকে সরে এল ভিতরে।

সুব্বা ঘুরে দাঁড়াতেই রতন তার প্রথম ঘুষিটা জমাতে পারল। বেশ জোরালো এবং মোক্ষম মার। সুব্বার কপালের ঠিক মাঝখানটায়।

সুব্বা একটু পিছিয়ে গেল মাত্র। আর কিছু নয়। রতন স্পষ্ট শুনল, তার ডান-পাশ থেকে কে যেন বিরক্তির গলায় বলছে, “লেফট! ইউজ ইয়োর লেফট!”

হুশ করে একটা প্রচণ্ড শ্বাস ছাড়ল রতন। সুব্বা আর একতরফা মারছে না। সরে গেছে। ঘুরছে নেচে-নেচে।

হঠাৎ রতন দেখতে পেল, সুব্বার কপালের মাঝখানটা কেটে গেছে। সামান্য একটা রক্তের রেখা নেমে এসেছে সাদা কপাল বেয়ে নাকের ওপর। তার ঘুষিটা বৃথা যায়নি।

আড়ষ্ট ঠোঁটে আপনমনেই একটু হাসল রতন। দুনিয়ায় অপরাজেয় কেউ নেই।

প্রথম রাউন্ড শেষ হতে বাকি ছিল না বেশি। ঘন্টা পড়া-পড়া প্রায়। ঠিক সেই সময়ে সুব্বা তার ওস্তাদের মারটি মারল।

অভিনয়টা ছিল চমৎকার। দুটো ভুয়ো ঘুষি চালিয়ে কয়েকটা পয়েন্ট সংগ্রহ করে পিছিয়ে যাওয়ার সময় আচমকাই সে শরীরে একটা মোচড় দিয়ে দুম করে একটা আপার কাট চালিয়ে দিল।

ঘুষিটা লাগলে রতনকে উঠতে হত না আজ। কিন্তু লাগার আগেই আবার সেই দৈববাণী, “হি ইজ ফেইনিং। গেট আউট অফ হিজ রীচ।”

অর্থাৎ, ও অভিনয় করছে, ওর নাগাল থেকে সরে যাও।

রতন সরল ঠিকই, তবে একটু খেলিয়ে। সুব্বাকে সে ঘুষিটা তৈরি করতে দেখল। ঘুষিটা আসছে, তাও দেখল। তারপরই টুক করে মাথাটা নামিয়ে ঘুষিটাকে বইয়ে দিল মাথার ওপর দিয়ে। আর তক্ষুনি দেখতে পেল তার ডান হাতের সোজাসুজি সুব্বার থুতনি। অরক্ষিত এবং অসহায়।

এই সুযোগটাকে কাজে না লাগায় কোন্ বোকা? স্বয়ংক্রিয় ভাবেই রতনের ডানহাত পিস্টনের মতো পিছনে সরে এসেই হাতুড়ির মতো গিয়ে পড়ল সুব্বার চোয়ালে।

এত জোরালো ঘুষি রতন জীবনে কাউকে মারেনি। তার কব্জি ঝন্‌ঝন্ করে উঠল আঘাতের প্রতিক্রিয়ায়।

কিন্তু সুব্বা বক্সার বটে। ঘুষিটা খেয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পড়ে গেল না। মুখে বিস্ময়, চোখে অবিশ্বাস। দুই গ্লাভসবদ্ধ হাত দুদিকে ঝুলছে। ভ্রূ কুঁচকে সে সামনের দিকে চেয়ে যেন খুব কষ্টে কিছু দেখবার চেষ্টা করল।

রতনও হাঁ করে চেয়ে ছিল। ঐ ঘুষি খেয়েও যদি সুব্বার কিছু হয়, তবে ধরে নিতে হবে সুব্বাকে হারানো অসম্ভব। হা ঈশ্বর।

কিন্তু সুব্বা দাঁড়ানো অবস্থায় রইল কয়েক সেকেন্ড। চোখের দৃষ্টি চকচকে হয়ে শুন্য হয়ে গেল হঠাৎ। হাঁটু ভাঁজ হয়ে শরীর ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ল মেঝের ওপর।

কে যেন দানবীয় স্বরে পিছন থেকে প্রম্পট করছিল, “হিট হিম। হিট হিম এগেন।”

কিন্তু ঐ মহান বক্সারকে ওরকম অসহায় অবস্থায় আর একটি ঘুষিও মারতে বাধল রতনের। সুব্বা তার ঘুষি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, এটাই তো তার জীবনের এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ঘটনা।

রেফারী গুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাউন্ড শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ায় সুব্বা নক আউট হল না। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসানো হল টুলে।

রতনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে চিত্তব্ৰত বলল, “ভাবা যায় না কী তুমি করেছ। ও।”

অ্যান্টিসেপটিকে-ভেজানো তুলোয় ক্ষতস্থান জ্বালা করে উঠল রতনের। তবু সে একটু তৃপ্তির হাসি হাসল। পৃথিবীতে কেউই অপরাজেয় নয়। তবে সুব্বা এখনো হারেনি। পরের রাউন্ডে আছে। তার পরের রাউন্ড আছে। সে চোখ বুজে রইল। হঠাৎ একটু চমকে উঠল সে। চিত্তব্রতর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “চিত্তদা, আপনি আমাকে ডিরেকশন দিচ্ছিলেন?”

চিত্তব্রত অবাক হয়ে বলে, “না তো?”

রতন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে ডানদিকে তাকাল। না, রিং-এর ধারে বসা সেই দুই মূর্তি নেই। দুটি চেয়ার ফাঁকা পড়ে আছে।

দর্শকদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুব্বাকে ঘিরে অনেক লোক। ক্লান্তিতে চোখ বুজল রতন।

দ্বিতীয় রাউন্ডের ঘন্টা পড়তেই রতন টুল ছেড়ে উঠল। কিন্তু সুব্বা উঠল না। তাকে তখনো দুজন লোক পরিচর্যা করছে। সুব্বার চোখ বোজা, ঘাড় হেলানো।

রতন যখন অপেক্ষা করছে, তখন সারভিসেসের ম্যানেজার রেফারীর কাছে এসে মৃদুস্বরে কী একটু বলে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বিস্ময়-ভরা চোখে রতনকে দেখে গেলেন।

রেফারী যখন এগিয়ে এসে রতনের একখানা হাত উর্ধ্বে তুলে তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করলেন, তখনো রতন বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কী হল, দর্শকরা কিন্তু তখন পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে, লাফাচ্ছে আনন্দে, কয়েকজন রিং-এর মধ্যে ঢুকে রতনকে কাঁধে নিয়ে একপাক ঘুরলও।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে রতনের মাথায় ঢুকল যে, সে প্রথম রাউন্ডেই টেকনিক্যাল নট-আউটে সুব্বাকে হারিয়ে লাইট হেভিওয়েটে এবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

চিত্তদা এসে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রতনকে টেনে নিয়ে গেলেন ড্রেসিং রুমে। বাংলার অন্যান্য মুষ্টিযোদ্ধারা রতনকে আদরে-আদরে অস্থির করে তুলল। সারভিসেসের ম্যানেজার স্বয়ং এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু জয়েন দি সারভিসেস, জাস্ট সে ইট।

খবর এল, সুব্বার চোয়ালের হাড় ভেঙেছে, সে এখন হাসপাতালে। বক্সিং জিনিসটা এরকমই। প্রতিপক্ষকে কখনো অবহেলা করতে নেই। প্রতিপক্ষকে অবহেলা করে জো লুই তাঁর সবচেয়ে খ্যাতির সময়ে জার্মানির স্মেলিং-এর কাছে হেরে যান। প্যাটারসন হেরে গিয়েছিলেন সুইডেনের অখ্যাতনামা জোহানসনের কাছে। এমন কী, মহম্মদ আলিকেও স্পিংকসের মতো নাবালক মুষ্টিযোদ্ধার কাছে মাথা নোয়াতে হল এই তো সেদিন।

এত অল্প বয়সে অপ্রত্যাশিত এত বড় একটা লড়াই জিতেও রতনের তেমন আনন্দ হয় না। আসলে আনন্দ পাওয়ার মতো মনটাই তার হারিয়ে গেছে। কারণ তার এই জয়ে খুশি হওয়ার মতো আপনজন কেউ তো নেই। তার মা মারা গেছেন, বাবা পাগল, এক দিদি বিয়ের পর কণাটকের এক শহরে থাকে, দেখাই হয় না তার সঙ্গে। তাছাড়া রতনরা খুবই গরিব। বক্সিং করে বলে রতন একটা সামান্য চাকরি পেয়েছে। সেই টাকায় খুব কষ্টেই চলে তাদের।

অথচ কষ্টের কারণ ছিল না। তার বাবা ছিলেন একজন নামকরা বৈজ্ঞানিক। কী একটা বস্তু আবিষ্কার করার ভূত চেপেছিল তাঁর মাথায়। তাই নিয়ে দিনরাত ভাবতে ভাবতে একদিন পাগলামি দেখা দিল। অবশ্য অনেকে বলে তাঁর একজন সহকারী ছিল। সেই নাকি ওঁর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল ওষুধ খাইয়ে। এখনো নিজের ল্যাবরেটরিতেই দিনরাত তিনি কাজ করেন। তবে সে কাজ পাগলামিরই নানারকম খেয়াল খুশি। রতনের এক বুড়ি পিসি তাঁর দেখাশোনা করেন। আর কেউ নেই।

রাত্রিবেলা সবাই ঘুমোলে পর রতন আজ একা বাইরে এসে দাঁড়াল। প্রচণ্ড শীত। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল। বুকটা হু-হুঁ করে উঠল হঠাৎ। চোখে এল জল। এই পৃথিবীতে তার মতো হতভাগা আর কে আছে, যার জীবনে একটা আনন্দের ঘটনা ঘটলেও সে-আনন্দের ভাগিদার কেউ নেই?

নির্জন আলো-আঁধারে মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে রতন একটু দূরের স্টেডিয়ামটা দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে দেখতে লড়াইয়ের দৃশ্য ভেসে উঠছিল চোখে। হঠাৎ তখন সেই দুটো লোকের কথাও মনে পড়ল তার।

ওরা কী চায়? তাকে অনুসরণই বা করছে কেন? ওরা ভাল লোক, না মন্দ লোক? লড়াইয়ের সময় ওরাই কি নানারকম পরামর্শ দিচ্ছিল তাকে?

এইসব ভাবতে-ভাবতে আনমনে রতন চোখ ফেরাতেই তার শরীরটা শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। বক্সারের মজবুত হৃৎপিণ্ডও যেন একটু ধুকপুক করে উঠল। তার ডানদিকে একটু দূরে মাঠের ওপর সেই দুই মূর্তি পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।