রাত অনেকটা হয়ে গেছে।
ব্রিজে ওঠার সময় লক্ষ পড়েনি, ব্রিজ পার হয়ে রাস্তায় নেমে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে ছায়ামূর্তিটায় চোখ পড়ল গৌতমের।
গৌতমের বাঁ ধার ঘেঁষে হেঁটে চলেছে।
গৌতমের থেকে অনেকখানি লম্বা।
কখন থেকে যে ও সঙ্গ নিয়েছে টের পায়নি গৌতম, হঠাৎ চোখে পড়ে যেতেই কেমন যেন চমকে উঠল।
মনে হল হঠাৎ যেন কোনও ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, অথচ বড় পরিচিত কাকে দেখল। থেমে পড়ল গৌতম। ছায়ামূর্তিটাও থেমে পড়ল।
গৌতম ওর দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ, দেখতে চেষ্টা করল ওর ঠোঁটে তামাকে পাইপ আছে কিনা।
দেখতে পেল না।
নিজের ঠোঁটটা একবার কামড়াল গৌতম, তারপর আবার এগোতে লাগল আস্তে আস্তে।
ছায়ামূর্তিটাও আবার চলতে লাগল ঠিক গৌতমের পায়ে পায়ে বাঁ ধার ঘেঁষে। তার মানে গৌতমের আকাশে এখন ডানদিকে চাঁদ!
চাঁদের আলোতেও ছায়া পড়ে? আশ্চর্য তো!
খবরটা বোধহয় জানা ছিল না গৌতমের। হয়তো গৌতম এর আগে কোনওদিন জ্যোৎস্নারাত্রে, একটু বেশি রাত্রের নির্জন রাস্তায় এমন একা একা আস্তে আস্তে হাঁটেনি।
জ্যোৎস্নারাত্রি! চাঁদের আলো!
গৌতমের মনের কোণে একটু বাঁকা ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল। …চাঁদ মহাশয়, তোমার আর কিছু নেই। যে ব্যাঙ্কে তোমার সর্বস্ব ছিল, সেই ব্যাঙ্কটি ফেল হয়ে গেছে। তোমার পূর্ণিমার রাতটাত বেবাক মুছে গেল। মানুষ শুধু তোমার বুকে পায়ের ছাপই রেখে আসেনি, তোমার হৃৎপিণ্ডে তীক্ষ্ণ যন্ত্র পুঁতে রেখে এসেছে, তোমার হৃদস্পন্দনের হিসেব রাখবে বলে।
তার মানে, হে চির রহস্যের রাজা, স্রেফ দেউলে হয়ে গেলে তুমি।
অথচ মানহীন মর্যাদাহীন রহস্যহীন তুমি, এখনও পুরনো নিয়মে তিথির হিসেব কষে কষে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা তুলবে, পথ চলতে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে থাকবে প্রিয় বন্ধুর মতো।
তোমার এ ডিউটির শেষ হবে না।
ডিউটির কি শেষ আছে? মৃত্যুর মুহূর্তটিতে পর্যন্ত তোমার ডিউটির ছুটি নেই।
কে বলেছিল একথা? ভারী ভারী ভরাট গলায়!
মুক্তি! মুক্তি! রাতদিন কেবল মুক্তির চিন্তায় ছটফট করছ। মুক্তি কথাটার মানে জানো? দায়িত্ব থেকে মুক্তি নেবে তুমি, কিন্তু নিজের কাছ থেকে?
কার গলা এটা?
প্রাচীন ভারতের আদর্শ আঁকড়ে থাকা এক কঠিনচিত্ত বৃদ্ধের না?
রাস্তায় বাঁক নিতেই ছায়ামূর্তিটা অন্তর্হিত হয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ অনেকদিন পরে বাবার কথা মনে পড়ে গেল গৌতমের।
দীর্ঘদেহী হাস্যোজ্জ্বল এক পুরুষ।
প্রকৃতির মধ্যে প্রাবল্য আছে, কিন্তু সে প্রাবল্য অপরের অধিকারকে খর্ব করতে এগিয়ে আসে না, শুধু সমস্ত প্রতিকূলতাকে স্রোতের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
বাবাকে দেখতে পেল গৌতম।
সকালবেলা বাগানে বেড়াচ্ছেন!
পরনে রাতের পোশাক, মুখে তামাকের পাইপ।
বাগানের মধ্যেকার ছবির মতো সুন্দর বাড়িটার সুন্দর বারান্দায় একটা ছোট ছেলে ঘুমভাঙা চোখে দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দেখছে বাবার পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছে একটা দীর্ঘ ছায়া।
ছায়াটার মুখেও তামাকের পাইপ, ধোঁয়া বেরোচ্ছে তা থেকে, সেটাই দেখছে ছেলেটা পরম কৌতুক আর কৌতূহলের দৃষ্টিতে।
ওই বাগানওলা বাড়িটা কোথায়? ঘুরতে ঘুরতে কোনখানে বদলি হয়েছিলেন তখন বাবা? কবেকার ছবি ওটা?
বাবার কথা মনে এলেই জোর করে সেই মনে আসাটাকে ঠেলে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে গৌতম। না করে কী করবে? বাবার কথা মনে পড়ে গেলেই এখনও যে ভয়ানক একটা কষ্ট হয় গৌতমের! মাথার মধ্যে না কোথায়, যেন মুঠোয় চেপে ধরার মতো একটা যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। আর চোখ দুটো বালি পড়ার মতো ভীষণ জ্বালা করতে থাকে।
এই অনুভূতিটা বড় ভয়ের।
গৌতম তাই ওটা আসবার আগেই ঠেলে সরাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু আজ পারছে না সরাতে।
আজ ওই ছায়াটা যেন গৌতমকে ছেলেমানুষের মতো দুর্বল করে দিয়েছে। তাই ছায়াটার ঠোঁটে তামাকের পাইপ খুঁজছে গৌতম।
অথচ ছায়াটা গৌতমের নিজের।
বিনুমাসির ওই বোকার মতো কথাটাই কি গৌতমকেও আজ বোকা করে দিয়েছে?
বাংলার বাইরে থাকে বিনুমাসি, অনেকদিন অনেকদিন পরে আসে। এবার বারো তেরো বছর পরে এসেছেন। বাবা মারা যাবার পর আর মার সঙ্গে দেখা হয়নি বিনুমাসির। এতদিন পরে হল।
তাই এতদিন পরে দেখা হওয়াটা তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করবার জন্যে অনেকবার চেষ্টা করল বিনুমাসি বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবার, কিন্তু সেই ধরার সুযোগটা দিল না মা। দিদির হাত এড়িয়ে এড়িয়ে দিব্যি কেটে পড়ল।
বিনুমাসি অতঃপর বোনের ছেলেটাকে নিয়ে পড়ল। বলল, ইস, কত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই গৌতম! আর কী লম্বা! বাবার মতো লম্বা হয়েছিস দেখছি। আর শুধু লম্বাটুকুই বা কেন, নাক, মুখ, চোখ, চুল, সব কিছুই অবিকল বাপের মতো! মনে হচ্ছে যেন রাজাকেই দেখছি।…ঠিক তোর মতোই দেখতে ছিল তোর বাবা বিয়ের সময়। সেই দেখাটাই আসন দেগে আছে মনের মধ্যে। কত বয়েস হল তোর? কুড়ি? ঠিক, ঠিক বিয়ের সময় তোর বাবার তেইশ বছর বয়েস ছিল।
বারবার ওই একটা কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছিল কিনুমাসি, গৌতম অবিকল তার বাবার মতো দেখতে।
এই কথাটা এত বিস্তার করে বলবার কী ছিল, জানে না গৌতম।
গৌতমের খুব খারাপ লাগছিল।
গৌতমের মনে হচ্ছিল, মানুষ কী করে একজন মরে-যাওয়া মানুষের কথা এত সহজে বলতে পারে! এত সহজে উচ্চারণ করতে পারে তার নাম! অথচ বিনুমাসি অবলীলায় করেছিল।
ইচ্ছে করে বলবার জন্যেই বলছিল যেন।
কেন?
বিনুমাসি কি ভেবেছিল বাবার নাম আর বাবার গল্প শুনে খুব আহ্লাদ হবে গৌতমের? হয়তো তাই ভেবেছিল। যার যেমন বুদ্ধি!
অথচ গৌতমের মনে হচ্ছিল মামাদের ওই ফার্ন রোডের বাড়িটার সাজানো গোছানো ড্রইংরুম থেকে উঠে ছুটে পালিয়ে আসে। মনে হচ্ছিল বাবার নামটার পবিত্রতা নষ্ট করছে বিনুমাসি।
ঢাকুরিয়ার একটা গলির মধ্যে সামান্য চেহারার একখানা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গৌতম, হাতের ঘড়িটা দেখল, একটু ইতস্তত করল, তারপর আস্তে দরজার পাশের কলিং বেলটা টিপল।
ছোট্ট একটা চাকর এসে দরজা খুলে দিল, এবং মুখের ইশারায় ও হাতের ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল, বাড়ির কর্থ গৌতমের ফিরতে দেরি হওয়ায় চিন্তিত অথবা ক্রুদ্ধ। অতএব সাবধান!
ছেলেটা ওটুকু না বললে হয়তো গৌতম অপরাধীর মনোভাব নিয়েই দাদুর কাছে গিয়ে দাঁড়াত, কিন্তু ছোট্ট ওই ছেলেটার সাবধানবাণী গৌতমকে কঠিন করল। গৌতম শক্ত হল।
গৌতম ভাবল, কী আশ্চর্য! আমি একটা কচি খোকা নাকি? কোনও কারণেই কোনওদিন রাত দশটায় বেড়িয়ে ফেরার স্বাধীনতা আমার নেই? কেন, আমি কি বলে যাইনি মামার বাড়ি যাচ্ছি? মা ডেকে পাঠিয়েছে?
যেখানে গৌতমের মা আছে, গৌতম সে বাড়িটাকে বর্জন করতে পারে না অবশ্যই।
যুক্তি খাড়া করবার জন্যেই কথাটা ভাবল গৌতম, কিন্তু যেখানে আমার মা আছে এই কথাটা ভাবতে গিয়ে মনে হল ওর, ও যেন একটা শূন্যের উপর পা রাখল।
ছেলেবেলায় প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখত গৌতম। দেখত, যেন দীর্ঘ সময় ধরে একটা সিঁড়িতে উঠছে সে, সিঁড়ির পর সিঁড়ি, ফুরোতেই চায় না।
অবশেষে এক সময় সিঁড়ি শেষ হত, একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হত গৌতমকে।
এটা তা হলে ছাদের দরজা, ভাবত গৌতম, তারপর আস্তে দরজাটা খুলে পা বাড়াত, আর শিউরে উঠত।
দরজার বাইরে ছাদ নেই, শুধু ফাঁকা। গভীর একটা গহ্বরে পা নেমে যাচ্ছে। অদ্ভুত সেই অনুভূতিটায় ঘুম ভেঙে যেত গৌতমের।
আজ হঠাৎ সেই অনুভূতিটা যেন ধাক্কা দিয়ে গেল গৌতমকে, যখন গৌতম ভাবল দাদুকে শুনিয়ে দেব, সেখানে আমার মা আছে।
কিন্তু গৌতমের শানানো অস্ত্রশস্ত্রগুলো কোনও কাজে লাগল না। দাদু ওর ওই দেরিটা নিয়ে কোনও প্রশ্নই করলেন না। এ কথা বললেন না, মা কেন ডেকেছিল?
অবশ্য এটা বলার কথা নয়।
দাদু কোনওদিনই নিজে থেকে গৌতমের মায়ের কথা তোলেন না। পিসিও না।
তার মানে, গৌতমের এই বাড়িতে সহজে কোনওদিন গৌতমের মা বাবার নাম উচ্চারিত হয় না। যেন এ পৃথিবীতে কেবলমাত্র গৌতমের দাদু আছে, পিসি আছে, আর গৌতম আছে। গৌতমের যেন কোনও অতীত ছিল না।
তা গৌতমও তো সেই অতীতকে একটা পুরু ধুলোর স্তরের নীচে চাপা দিয়ে রাখতে চায়। ধুলোটা একটু সরিয়ে দেখতে গেলেই যে সেই এক হাস্যোজ্জ্বল দীর্ঘদেহী পুরুষের ছবি ঝলসে ওঠে! আর গৌতমের চোখ দুটো হঠাৎ খুব জ্বালা করে ওঠে!
দাদু কোনও প্রশ্ন করলেন না, শুধু একটা খবর দিলেন। বললেন, তুমি যখন ছিলে না, একটি মেয়ে তোমায় খুঁজতে এসেছিল।
গৌতম চমকে উঠল।
টুনু কি পাগল হয়ে গেছে নাকি? তাই দুদিন দেখা হয়নি বলে বাড়িতে এসে হানা দিয়েছে? টুনু কি জানে না গৌতমের দাদু কী পরিমাণ সেকেলে। জানে না, গৌতমের পিসি খবরের গন্ধ পেলেই পুরো ঘটনাটা অনুমান করে নিতে পারে। আর সে অনুমানটা প্রায়ই নির্ভুল হয়।
গৌতম তবু নিজেকে সামলে নিল।
জলের গ্লাসে হাত ধুতে ধুতে নির্লিপ্ত গলায় বলল, মেয়ে!কই কারও তো খুঁজতে আসার কথা ছিল না। নাম বলেছে?
ভাল নাম বলেনি, দাদুও নির্লিপ্ত গম্ভীর গলায় বলেন, বলল, বলবেন টুনু এসেছিল, তা হলেই বুঝতে পারবে।
দাদুর ভাষায় কোনও অভিযোগ ছিল না, ভঙ্গিতেও না। তবু গৌতমের মনে হল, দাদু যেন খুব একটা ব্যঙ্গ মাখানো ধিক্কার দিলেন গৌতমকে। যেন বলে উঠলেন, তলে তলে তা হলে এতদুর এগোনো হয়েছে? টুন এসেছিল বললেই বুঝতে পারবে।
তার মানে ডাকনামে ডাকাডাকির স্টেজে এসে গেছ!
গৌতম তবুও সামলাতে চেষ্টা করে। বলে ওঠে, টুনু। সেই কালো রোগা দাঁত-উঁচু মেয়েটা? বকবক করে গেল তো খুব?
দাদু রুটির গোছা দুধের বাটিতে ভরতে ভরতে বলেন, আমার সঙ্গে আর কী বকবক করবে?
খুব সাধারণ কথা।
তবু গৌতমের মনে হল, ওর অন্তরালে আরও অনেকগুলো কথা ঢুকিয়ে দিলেন দাদু। সেই কথাগুলো হচ্ছে, আমার সঙ্গে বকবক করতে তো আর আসেনি, এসেছিল তোমার সঙ্গে বকবকম করতে।…তার মানে, এতদিন ধরে বৃথাই ভস্মে ঘি ঢালোম আমি। তুমি ঠিক তোমার পথেই চলেছ। মাতৃরক্তের ঋণশোধ না করে গতি নেই তোমার।
এর একটা কথাও উচ্চারণ করেননি দাদু, তবু গৌতম যেন প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। গৌতম কি কোনও দৈবীশক্তি লাভ করেছে? তাই অনুক্ত কথাগুলোও শুনতে পাচ্ছে?
গৌতমের দাদুর বাড়িতে এখনও খাবার টেবিল ঢোকেনি। কার্পেটের আসন পেতে খেতে বসেছে তিনজনে–দাদু, পিসি আর গৌতম। পাশাপাশি নয়, এক লাইনেও নয়, তিনজন তিন কোনায়। বরং বলা যায়, মুখোমুখি বসেছে।
দাদুর বসবার আসনটা প্রকাণ্ড।
পিসি নিজে হাতে করে বুনেছে, লম্বা লম্বা ঝালর লাগিয়ে। অতবড় বিশাল দেহ মানুষটা বসা সত্ত্বেও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ঝালরগুলো। গৌতম নিজের মনে আস্তে রুটি ছিঁড়ছিল, দাদুর দিকে তাকাতে পারছিল না। তবু গৌতম বুঝতে পারছিল, এখন দাদু তাঁর ঈষৎ শিরা-ওঠা বলিষ্ঠ হাতের থাবাটা দিয়ে মস্ত বড় কাঁসার বাটিটার মধ্যে চটকে চটকে রুটি মাখছেন দুধ দিয়ে, আমসত্ত্ব আর চিনি দিয়ে। এগুলো চাই-ই দাদুর। ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাত যাই হোক বাজারে, পিসি ঠিক মজুত রেখে দেবে দাদুর অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো। দাদুর প্রয়োজনীয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো একেবারে অবশ্য প্রয়োজন।
দাদুর দুপুরের ভাতের পাতে কোনও একটা তেতোর আয়োজন নেই, অথবা থালার পাশে ঘরে পাতা দইয়ের বাটিটা নেই, এটা যেমন ভাবা যায় না, তেমনি ভাবা যায় না দাদুর আঁচানোর পরই তাঁর সামনে একটা মুখকাটা ডাব নেই।
গৌতম ভাবতেও পারে না, কী করে কোনও একটা মানুষ প্রতিদিন একই জিনিস খেয়ে চলেছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
গৌতম জানতেও পারে না প্রতিদিন জিনিসগুলো জোগাড় করে রাখা হয় কীভাবে। দাদু সম্পূর্ণ পিসির পোয্য।
পিসি যেন বাঘিনীর শাবক আগলানো মনোভাব নিয়ে দাদুকে আগলে রাখে।
টুনুর কথাটা শেষ হয়ে যাবারই কথা, তবু গৌতম ঘটনার ছিদ্রটায় আরও একটা মিহি সেলাই দিতে চেষ্টা করে। টুনুর আসার একটা কারণ প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই বুঝি সেলাইটা পড়ে।
অতএব গৌতম বলে, কোনও বইটই চাইল নাকি মেয়েটা?
এবার পিসি কথা বলল।
বলল, চাইলে কি আর বাবার কাছে চাইবে? তবে খুব সপ্রতিভ মেয়ে বাবা।
গৌতম বলতে পারত, অপ্রতিভই বা হতে যাবে কেন? পারল না। গৌতমের কানটা লাল হয়ে উঠল। আর টুনুর উপর রাগে হাড় জ্বলে গেল।
কী দরকার ছিল তোমার এখানে, এই সেকেলে বাড়িটায় এসে নিজেকে বিকশিত করবার? তুমি যে একটি মস্ত কথকী সেটা একা গৌতম জানলেই কি যথেষ্ট নয়? গৌতমের বাড়িসন্ধু সবাইকে জানাতে হবে? রোসো, কাল তোমায় মজা দেখাচ্ছি।
পিসির কথার কোনও উত্তর দিল না গৌতম, সামনে দাঁড়ানো সেই ছোট্ট চাকরটাকে বলল, এই সাধন, জল দে।
গৌতমের জলের কুঁজোটা সাধনের এলাকা। ভাঁড়ার ঘরে কোথায় যেন একটা বিশুদ্ধ কলসি আছে, তাতে পিসির আর দাদুর খাবার জল থাকে। পিসি মাছ খায় না বলে দাদুও খায় না। যদবধি পিসি বিধবা হয়েছে তদবধিই দাদুর এই কৃচ্ছসাধন।
তখন দাদু কোথায় যেন থাকতেন, গৌতম সঠিক জানে না। গৌতমের শুধু মনে পড়ে, গৌতমের বাবার সেই বাগানঘেরা কোয়ার্টার্সের বাড়িটার বারান্দায় বসে পাইপটা হাতে রেখে বাবা বলেছিল, এ কৃচ্ছ্বসাধনের তুলনা হয় না। বাবার খাওয়া-দাওয়ায় যথেষ্ট বিলাস ছিল। মাংস ছাড়া চলতই না।
কথাটা বলার সময় বাবা কোন মুখে বসেছিল, তাও স্পষ্ট মনে আছে গৌতমের। আর এও মনে আছে, শুনেই মা ঠিক ম্প্রিঙের মতো ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিল, আমার মতে এটা স্রেফ ন্যাকামি। অথবা ছেলে ভুলোনো প্রতারণা।…বিভার আবার বিয়ে দেওয়া উচিত ছিল বাবার। তা নয়, বৈধব্যের দুঃখ নিবারণ করতে নিজে বৈধব্য নিলেন। হাস্যকর! স্রেফ হাস্যকর! তুমি আবার এই নিয়ে বড়াই করছ।
গৌতম বারান্দার একধারে একটা তুলোর খরগোশ নিয়ে খেলছিল। মা আর বাবা বোধ হয় ভেবেছিল, গৌতম কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু গৌতম সবই শুনতে পাচ্ছিল। গৌতম সবই শুনতে পেত। খেলতে খেলতে শুনতে পেত। এমনকী রাত্রে যখন ঘুমিয়ে থাকত তখনও যেন গৌতম কত সব কথা শুনতে পেত মা আর বাবার। বেশি বেশি মায়ের গলাটাই শুনতে পেত।
প্রায়ই একটা কথা শুনত গৌতম, উত্তেজিত গলা, ফুলের বাগান, ভাল বাড়ি, দাসদাসী, আসবাব! ধুয়ে জল খাব! সোসাইটি আছে এখানে? সোসাইটি? মানুষ বাঁচতে পারে এখানে?
বাবার হাসির গলা। তা হলে বলো এখানে যারা আছে, তারা স্রেফ মরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
মায়ের গলা আরও উত্তেজিত শোনাত, ভূতেদের আর ভূত হবার জন্যে নতুন করে মরতে হয় না। মানুষ আছে এখানে? জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ?…নেই। আছে শুধু তোমার মতন কাজের যন্ত্র।
কথাগুলোর মানে বুঝত না তখন গৌতম, জানত না সোসাইটি কাকে বলে। তবু আবছা ভাবে যেন বুঝতে পারত মা সুখী নয়, সন্তুষ্ট নয়। গৌতম তখন ধরে নিত, মা ভীষণ রাগী।
আর সেই রাগের কারণের কোনও ঠিকঠাক নেই। না হলে দাদুর কৃচ্ছসাধন নিয়ে বাবা যদি কিছু গৌরব করেই থাকে, মার রেগে ওঠবার কী ছিল?
অন্য অন্য সময় মা রেগে উঠলে, কতদিন দেখেছে গৌতম, বাবা টপ করে মাকে একহাতে তুলে ধরে উঁচু করে দোলাত। মা রেগে চিৎকার করে একশা করত, তখন বাবা নামিয়ে দিয়ে হেসে হেসে বলত, রাগ কমল?
কিন্তু সেদিন বাবা হাসেওনি, মাকে তুলে ধরেনি। গম্ভীর একটু হেসে বলেছিল, বাবা দিতে চাইলেই বিভা বিয়ে করত?
করত না হয়তো! হিন্দু নারীত্বের মহিমার আফিং খাইয়ে খাইয়ে মানুষ করা হয়েছে তো! মনকে চোখ ঠেরে ঠেরে সেই মহিমার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে বইকী! স্রেফ শো!
বাবা আর একটু হেসে বলেছিল, তুমি অবশ্য ও সব শো করতে যাবে না। আমি মরলে তৎক্ষণাৎ আর একটা বিয়ে করেই ফেলবে।
মা গা থেকে খসে পড়া আঁচলটা ঝাঁপট মেরে পিঠে ফেলে ঠিকরে চলে যেতে যেতে বলে গিয়েছিল, তার জন্যে কারুর পরামর্শের দরকার নেই।
গৌতমদের সেই সুন্দর কোয়ার্টার্সের বাড়িটায় মাকে কদাচ হাসিখুশি দেখেছে গৌতম। বাইরের কেউ বেড়াতে এলে মা খুব হাসত। নচেৎনয়। কিন্তু এখন? মার দাদাদের ওই ফার্ন রোডের বাড়িটায়?
একটা বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে গড়িয়ে হইচই করে বেড়ায় মা।
.
আজ যখন গৌতম গিয়ে গেট খুলে দাঁড়াল, মা তখন পোর্টিকোর সামনে খোলা বারান্দায় একটা কুকুর ছানার পিছনে ছুটোছুটি করছে। বিনুমাসির কুকুরে ভয়, মার তাই মজা। কুকুরছানাটাকে ধরে বিনুমাসির গায়ে ফেলে দেবে বলে অত হুড়োমি করছে।
গৌতম গিয়ে দাঁড়ানোর পরও মা অনেকক্ষণ তাকে দেখতেই পেল না, লাফালাফি করতে লাগল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে আর শাড়ির আঁচল গোছাতে গোছাতে বলল, গৌতম এসেছিস? বোস।
গৌতম বলেছিল, ডেকেছ কেন?
মা উত্তর দেবার আগে বিনুমাসিই উত্তর দিয়ে বসেছিল, মা ডেকেছে তার আবার কেন কী বাবা?
গৌতম দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, দরকার না থাকলে ডাকবার কোনও মানে নেই।
বিনুমাসি এগিয়ে এসেছিল।
চট করে একঝলক জলও চোখে এনে ফেলেছিল বিনুমাসি। গৌতমের গায়ে একটা হাত রেখে সেই জলভরা চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ছি বাবা, ওভাবে কথা বলতে আছে? মার মনের অবস্থা ভাবো? ভিতরের আগুন চাপা দিতে হইচই করে বেড়ায় বই তো না।
গৌতম নিজের শরীরটা ওঁর হাতের আওতা থেকে সরিয়ে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছিল। আর বিনুমাসি শুরু করেছিল, দেখ সুমি, তাকিয়ে দেখ, যেন সদ্য সে বসে রয়েছে। অবিকল বাপের চেহারা।
মা বলেছিল, তুমি যতটা বলছ ততটা নয় বাবা। তবে আছে আদল।
বিনুমাসি মাথা নেড়েছিল, সে তোরা সর্বদা দেখছিস বলে বুঝতে পারিস না। আমি অনেকদিন পরে দেখছি তো। যেন অবিকলরাজা।
গৌতমের বাবার পুরো নামটা ছিল রাজেন্দ্রনারায়ণ, কিন্তু সংক্ষিপ্ত ডাকনামটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল আসল।
সবাই বলত রাজা। ওদের সেই বিদেশের বাড়িতে বাবার সহকর্মীরাও এসে ডাক পাড়ত, রাজা আছ? রাজামশাই!
বাবা মাসে বলত, তুমি অতএব রানি! মহারানি!
মহারানি বলেই মাকে ডাকত বাবা!
ফার্ন রোডের বাড়িতে এরা মাকে মার সত্যি নাম ধরে ডাকছে।
সুমিতা।
বিনুমাসির নাম বোধহয় বিনতা।
বড়মাসি না বলে গৌতম কেন বিনুমাসি বলে, তা জানে না। বোধহয় ঠিক সাধারণ লোকের মতো যথাযথ ডাকটা অ্যারিস্টোক্র্যাসি নয়, তাই।
ফার্ন রোডের এই বাড়িটায় ঠিকমতো সম্পর্ক হিসেবে কেউ কাউকে ডাকে না।
মা তার দাদাদের স্রেফ নাম ধরে ডাকে। বউদিদের বলে লাল গোলাপ আর নীল গোলাপ।
মার দাদাদের ছেলেমেয়েরা মাকে পিসি না বলে বলে পুসাই।
এ বাড়িতে দাদু নেই, দিদা আছেন, তাঁকে নাতি-নাতনিরা বলে বুলবুল পাখি।
গৌতমও বলে। কেন বলে তা জানে না।
বুলবুলি যে দিদিমার নাম নয় তা জানে। কিন্তু ওই কেন-টা নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামায়নি গৌতম। মামার বাড়ির সব কিছুই যে একটু বিদঘুঁটে তা দেখছে বলেই হয়তো অকারণ মাথা ঘামায় না।
আগে ছেলেবেলায় ভাবত, কেন এরকম!
বাবার সঙ্গে ছুটির সময় সে আসত। বাবা চলে যেত তার বাবার কাছে, মা আর গৌতম এ বাড়িতে থাকত।
বাবা এক-একদিন আসত।
হেসে হেসে বলত, অসাধারণ হবার ভারী ইচ্ছে এদের, বুঝলি গৌতম? কিন্তু অসাধারণ তো ইচ্ছে করলেই হয় না, ঘটে কিছু থাকা দরকার। তা ঘটে তো মা ভবানী! তাই এরা না-সাধারণ হবার সাধনা করছে। দেখ না এদের আপাদমস্তক না-সাধারণ!
অথচ এই বাড়িটা মায়ের মনের মতো।
তখনও তো দেখেছে। একমাস ছুটির মধ্যে বাবা হয়তো একটা দিন মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তুলত ঢাকুরিয়ায় দাদুর বাড়ি। তাও মা রাত্রে থাকত না, পালিয়ে আসত।
শুধু বাবা মারা যাবার পর যখন ওদের সেই কোয়ার্টার্সের বাড়িতে দাদু গিয়ে হাজির হলেন নিয়ে আসতে, আর মামারা টেলিগ্রাম করলেন, ছুটি পেলাম না, যেভাবে তোক চলে এসো। এসে এখানে ওঠো–
তখন মা দাদুর বাড়িতে গিয়েই উঠল। কে জানে শ্বশুরের ভয়ে না ভাইদের ওপর অভিমানে। না কি বাবার টাকাকড়িগুলোর বিলি ব্যবস্থার জন্যে? কী সব যেন কাগজপত্র দাদুই নিয়ে এসেছিলেন বাবার অফিস থেকে।
গৌতমের মনে আছে, মাকেও তখন পিসির মতো সরু সরু পাড়ের সাদা শাড়ি পরতে হত। গৌতমের বিচ্ছিরি লাগত। গৌতমের কান্না পেত। মাকে দেখতে ভয় করত।
কিন্তু এখন?
এখন তো মা নতুন বিয়ের কনেকেও হার মানাচ্ছে। চুলটা আর চেহারাটা নিয়ে যত পারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। গৌতমের কি ভাল লাগছে? গৌতমের মাকে দেখে আনন্দ আসছে? চোখ জুড়োচ্ছে? ভয় করছে না?
গৌতম জানে না। জানে সে আসলে কী চায়।
পিসির সরু পাড়ও তার যত অসহ্য, তত অসহ্য মায়ের ওই জরির আঁচলা লাল, নীল, সবুজ, হলদে।
গৌতম নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে অনেক সময়। বলে, গৌতম, আসলে তুমি চাও কী? তোমার পিসি যখন দূরে দাঁড়িয়ে তদারক করে সাধনকে দিয়ে ভাইপোর জন্যে ডিম সেদ্ধ করায়, মাছ রাঁধায়, আর একটুখানি ছোঁয়া লাগলেই চান করতে ছোটে, তখন কি তোমার রাগে হাড় জ্বলে যায় না? অথচ আবার যখন তোমার মা তার দাদাবউদির সঙ্গে এক টেবিলে বসে মুরগির ঠ্যাং চিবোয়? তখন?
তখন কেন সে দৃশ্য দেখে সারা শরীরের মধ্যে খুব একটা বমির ইচ্ছে পাক দিতে থাকে তোমার?
কতদিন যেন ছিল গৌতম মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে দাদুর বাড়িতে? যে বাড়িটা দাদুরও পৈতৃক আমলের।
কতদিন, ঠিক মনে নেই।
তবে মনে আছে, পিসিতে আর মায়েতে কিছুতেই যেন মিল হত না। কেবল দুজনে কথা কাটাকাটি হত। মা ঠিকরে উঠে ছাদে গিয়ে বসে থাকত, খেত না। নীচে নামত না। দাদু ডাকতে যেতেন। ভারী ভারী গম্ভীর গলায় বলতেন দাদু, মেয়ের হয়ে তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি বউমা! বলতেন, ভেবে দেখো বউমা, গৌতমকে তোমায় মানুষ করে তুলতে হবে। একটা বড় লক্ষ্যর জন্য অনেক ছোট ছোট ত্যাগস্বীকার করতে হয়।…গৌতম তোমার সেই বড় লক্ষ্য।
কিন্তু মা সেই বড় লক্ষ্যর দিকে লক্ষপাত করত না।
মা দাদুর মুখের উপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, আপনার বংশের বংশধরকে আপনিই মানুষ করে তুলুন। আপনার সনাতন পদ্ধতিতে, ভারতীয় ভাবধারায়, খুশি। আমায় মুক্তি দিন। মুক্তির জন্যে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে আমার।
তখন একদিন সেই ভারী ভারী ভরাট গলাটা শুনতে পেয়েছিল গৌতম, মুক্তি মুক্তি!রাতদিন কেবল মুক্তির জন্যে ছটফট! মুক্তি কথাটার মানে জানো?..দায়িত্ব থেকে মুক্তি নেবে তুমি, কিন্তু নিজের কাছ থেকে?
তারপর একদিন মা বাক্স-টাক্স নিয়ে চলে গেল। বুলবুলি পাখির এই ফার্ন রোডের বাড়িতে এসে উঠল।
কতদিন যেন মাকে আর দেখতেই পেল না গৌতম।
কতদিন পরে হঠাৎ একদিন বুলবুলি পাখি এল এ বাড়িতে। দাদুর কাছে বসে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বলল, মায়ের প্রাণ! ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা না দেখতে পেলে
দাদু বললেন, আমি তো তাঁকে এখানে আসতে নিষেধ করিনি?
বুলবুলি পাখি করুণ গলায় বলল, ভয়ে আসতে পারে না সে।
ভয়ে! কীসের ভয়ে? দাদু খুব বিস্ময়ের গলায় বললেন কথাটা।
বুলবুলি পাখি তাড়াতাড়ি বলল, না, অন্য কিছুর ভয়ে নয়, নিজের কৃতকর্মের ভয়েই। আপনার সঙ্গে তো ভাল ব্যবহার করে যায়নি।
দাদু খুব আশ্চর্যের গলায় বললেন, সে কী! কে বললে একথা? কারুর সঙ্গেই কিছু খারাপ ব্যবহার করেননি তিনি। শুধু এখানে তাঁর অসুবিধে হচ্ছিল বলেই
বুলবুলি পাখি বলল, আপনি মহানুভব, তাই একথা বলছেন। আমি তো আমার নিজের মেয়েকে জানি। তবু আমারও তো মায়ের প্রাণ। মনমরা হয়ে বেড়ায় মেয়েটা। একদিনের জন্যে ওকে নিয়ে যাই আমি।
ও যদি যেতে চায় আমার আপত্তি কী?
বলে গৌতমের দিকে শুধু তাকিয়েছিলেন দাদু। খুব প্লেন পরিষ্কার চোখে।
তবু গৌতম বোধকরি তার সেই অলৌকিক ক্ষমতার বলেই অনুভব করেছিল, দাদু বলছেন কী গো, যাবে নাকি? সেই তোমার মেম মায়ের কাছে? যে তোমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে নিজের স্বার্থ সুখ আমোদ আহ্লাদের জন্যে? তোমাকে বাদ দিয়ে যে তার নতুন জীবনের কাঠামো বেঁধেছে?
সেই অনুক্ত ব্যঙ্গই গৌতমকে পাথর করে দিয়েছিল। গৌতম মাথা তোলেনি।
বুলবুলি পাখি অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল, গৌতম নড়েনি।
তারপর দাদু তাঁর ভরাট দরাজ গলায় বললেন, গৌতম, তোমার দিদিমা এসে তোমায় এত ডাকাডাকি করছেন, না গেলে ওঁকে অপমান করা হবে। আমার ইচ্ছা তুমি ওঁর সঙ্গে যাও।
তখন গৌতম নামের সেই পাথর হয়ে যাওয়া ছেলেটা চোখ তুলে চাইল। দেখল, দাদুর চোখে আর সেই ভয়-ধরানো ব্যঙ্গদৃষ্টিটা নেই, যেন কৌতুকের ঝিলিক রয়েছে।
ওঠো! জামা জুতো পরে নাও।
এরপর আর পাথর হয়ে থাকা সম্ভব নয়।
পিসি এসে হাত ধরে নিয়ে গেল জামা জুতো পরাতে।
গাড়িতে এসে চমকে গিয়েছিল গৌতম। গাড়িতে মা বসেছিল।
গৌতমকে নিয়ে দিদিমা উঠতেই বলে উঠল, পাঠাতে রাজি হচ্ছিলেন না বোধহয়?
বুলবুলি পাখি বলে উঠল, উঃ, বুড়ো কী ঘুঘু! বাপস!
আমার জানা আছে। তোমরা দেখোবলে মা গৌতমকে কাছে টেনে নিল।
কিন্তু সেই নেবার মধ্যে কি সে একটা আত্মসমর্পিত বালচিত্তকে পেয়েছিল? না, একটা অনমনীয় কাঠিন্যকে?
মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাঠ হয়ে বসেছিল না সেই কাঠিন্য?
হাতটা ছুঁড়ে দিয়ে মা বলেছিল, চমৎকার! বেশ তৈরি করা হয়ে গিয়েছে। হবে নাই বা কেন! বাঁশ তো একই ঝাড়ের। ঠিক আছে।
.
তবু সেটাই বেড়া ভাঙা।
তারপর মাঝে মাঝেই মামারা কোনও একটা ছুতোয়নাতায় গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। দাদু কখনও গৌতমের পড়ার ছুতো করে গাড়ি ফেরত দিয়েছেন, কখনও বা বলেছেন, আচ্ছা যাও।
স্কুলের পড়া বাদে ছুটির দিনে দাদুর কাছে সংস্কৃত পড়তে হত। মামার বাড়ি যাবার আদেশ পেলে সেটা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যেত। সেই অব্যাহতির আকর্ষণেই মামাদের গাড়ি এলে উফুল্ল হয়ে উঠত গৌতম।
পিসির বোধহয় সেটা চোখ এড়াত না।
পিসি গৌতমের জামা জুতো এগিয়ে দিত, আর বলত, বৃথাই তুমি খেটে মরছ বাবা! আমে দুধে ঠিকই মিশছে।
পিসির কথাগুলো ভাল লাগত না গৌতমের। তবু সেই অসহায় বালকটার পিসিই তো ছিল আশ্রয়স্থল।
ছেলেটার তো একটা নিষ্পত্র বিরাট বৃক্ষের নীচে বাস। যাতে ছায়া নেই, স্নিগ্ধতা নেই।
পিসির কাছ থেকে সেটা অনেক সময়ই পাওয়া যেত। দাদুর আড়ালে একথাও তো বলতে শুনেছে পিসিকে, বাবার যেমন! একটা কচি ছেলেকে বিদ্যাদিগগজ করে তুলবেন। বাপ নেই, মা তো থেকেও নেই, ওর প্রাণটার দিকে তাকাতে হবে তো? না কি বিদ্যে গিলিয়ে গিলিয়ে সেই তোতা কাহিনীর তোতার মতো অবস্থা ঘটাতে হবে ওর?
ওইটুকু ছায়া। ওইটুকু স্নিগ্ধতা।
কিন্তু মার সম্পর্কে কথা হলেই পিসি অন্য মূর্তি। পিসির মধ্যে থেকে যেন ঘৃণার বিষ উপচে ওঠে! যেন কোনও নরকের কীটের বিষয়ে কথা বলছে পিসি।
আশ্চর্য, তখন আক্রোশটা পিসির উপর হয় না গৌতমের, হয় মায়ের উপর–মা গৌতমকে এই পিসির সাহায্য নিতে বাধ্য করেছে বলে, আর পিসি এই ঘৃণাটা প্রকাশ করবার স্কোপ পাচ্ছে বলে।
একথা যে অনায়াসেই বলতে পায় পিসি এবার পুজোয় তোর মা ভাইদের কাছে কী শাড়ি নিল রে গৌতম? লাল বেনারসি?
সেইটা বলতে পায় পিসি কার দোষে?
তা কেউ কারও বাড়ি না গেলেও হঠাৎ হঠাৎ দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যায় বইকী! ঢাকুরিয়া আর ফার্ন রোডের মাঝখানে তো বিরাট একটা ব্যবধান। হট হট করে দোকানে বাজারে না গেলেও, পুজোমণ্ডপে তো যায় পিসি? রামকৃষ্ণ মিশনে ভাগবত কথা শুনতেও যায় পাড়ার গিন্নিদের সঙ্গে।
দাদু যান না।
এয়ার কন্ডিশন্ড ঘরে গদি আঁটা চেয়ারে বসে ভাগবত কথা শোনাকে দাদু ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেন।
পিসির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে যে মা কথা কয় না তা নয়। পুরনো পাড়ার প্রতিবেশী-টেশির সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে যেমন কথা কয় লোকে, সেইভাবে কয়। পিসিও কথার ফাঁকে ফাঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয় মা নতুন কোন গয়না গড়িয়েছে, নতুন কোন ধাঁচের ব্লাউজ পরেছে। তারপর বাড়ি ফিরে বলে, চল্লিশ বছর বয়েস হল, ছেলের বিয়ের বয়েস হতে চলল, এখনও এই প্রবৃত্তি! ছি ছি! সধবাতেও যে এ বয়সে এত সাজে না।
.
এই দাবদাহ থেকে টুনুর কাছে পালিয়ে আসে গৌতম।
কালো রোগা দাঁত-উঁচু সেই মেয়েটার কাছে যেন অনেকখানি ছায়া আছে, অনেকখানি শীতলতা আছে।
টুনুর বুদ্ধিটা এত প্রখর, একটু কিছু বলে ফেললেই সব বুঝে ফেলে। মাকে, পিসিকে, দাদুকে, বুলবুলি পাখিকে, কাউকেই ও চক্ষে দেখেনি, তবু সবাইকে কী অদ্ভুত স্টাডি করে ফেলেছে! ওদের সম্পর্কে কটা কথাই বা বলেছি আমি ওর কাছে?
কথাটা ভাবে গৌতম আশ্চর্য হয়ে।
কারণ গৌতম জানে না এটা মেয়েমাত্রেরই সহজাত ক্ষমতা। একটা কথা শুনলেই ওরা গোটা মানুষটাকে চিনে ফেলতে পারে। প্রখর বুদ্ধি না হলেও পারে।
আর টুনু হয়তো সত্যিই প্রখর বুদ্ধিশালিনী।
কিন্তু আজকে টুনু কী বিশ্রি রকমের বোকামি করে গেল!
দাদুদের দৃষ্টির কাছ থেকে সরে এসে ভাবল গৌতম, কাল তোমায় আমি দেখাচ্ছি মজা। মানে হয়। এই বোকামির?
মনে মনে টুনুকে বকতে বকতে কখন যেন টুনুর জন্যে ভয়ানক মন কেমন করতে শুরু করল গৌতমের।
টুনু এই বাড়িতে এসেছিল। টুনু এই দরজা থেকে ফিরে গেছে।
কী দুঃখ!
সেই এল, অথচ এমন দিনে এল যে, গৌতম নেই।
কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় গৌতম বাড়িতে থাকবেই বা কেন? এটা তো টুনুর ভাবা উচিত ছিল।
আচ্ছা, টুনু কি ঠিক সন্ধ্যার সময়টাতেই এসেছিল? না আরও পরে? গৌতম তো আজ দীর্ঘ সময় বাড়িতে ছিল না।
দাদুর খবর পেশের ভাষাটা কী ছিল যেন!
তুমি যখন ছিলে না, তখন একটি মেয়ে তোমার খোঁজ করতে এসেছিল।
আমি তো অনেকক্ষণ বাড়ি ছিলাম না, গৌতম ভাবল, আমি তো সে কথাটা বলতে পারতাম দাদুকে, ঠিক কখন? কিন্তু বলতে পারলাম না।
টুনু ঠিকই বলে, তুমি আর মানুষ হয়েছ।
কিন্তু টুনুকে কোথায় পেল গৌতম?
সে কথা বলা শক্ত।
বোধহয় ওদের দুজনের কারুরই প্রথম দেখার ক্ষণটি মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে গৌতমের, উত্তর কলকাতার মেয়ে টুনু শুধু গৌতমের জন্যেই যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে।
.
গৌতম মাথায় হাত দিয়ে বলল, আমি তো আর দুবছর পরেই বেরিয়ে যাব।
তাতে কী? টুনু বলেছিল, দু-দুটো বছর কি কম নাকি? আর তেমন ইচ্ছে থাকলে, প্রেমের-পরীক্ষা দিতে আরও গোটা তিনেক বছর থেকে যেতেও পারো।
আরও কিছু নয়! গৌতম মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এই মতলব নিয়ে আমার পিছনে ধাওয়া করেছ?
তা তপস্বীর তপোভঙ্গ করাই তো উর্বশীদের ধর্ম।
উর্বশী! কী একখানা উর্বশী রে! দাঁড়কাক বললে কিছুটা কাছাকাছি আসে।
বলতে পারো যা ইচ্ছে।
তবু রেগে চলে যাবে না?
পাগল!
বাড়িতে কী বলল?
বাড়িতে? বাবা থেকে শুরু করে বাড়ির রান্না করার বামুনদি পর্যন্ত যা বলল, তার সারার্থ হচ্ছে, আমার ঊনপঞ্চাশটা বায়ুই প্রবল হয়ে উঠেছে। অতএব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বদলে আমার জন্যে মেন্টাল হসপিটালে সিট জোগাড়ের চেষ্টা করাই উচিত।
তবু ছাড়ল তো?
এ যুগে কি আবার ও প্রশ্নটা আছে নাকি? না ছাড়লে বাড়ি ছাড়তাম।
অথচ কারণটা আমি। গৌতম আর একবার মাথায় হাত দিয়েছিল, অবাক হয়ে যাচ্ছি।
টুনু ওর কাছ ঘেঁষে বসে পড়ে খুব আলগা গলায় বলেছিল, কারণটা যে আসলে কী, হয়তো আমি নিজেও জানি না। কিন্তু ভেবে আনন্দে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে, সংগ্রাম-টংগ্রাম গোছের একটা কিছু করলাম আমি।
থাক মরতে হবে না। কিন্তু ক্লাস তো এক নয়, রোজ দেখা হবে কী করে শুনি?
দেখা হবে না? তোমায় আমি খুন করব।
লাভ হবে না তাতে। কিন্তু কী করে যে তুমি সিট পেলে তাই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি।
ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকলে সবই পাওয়া যায়।
আহা! যায় বুঝি? আমার তো ঐকান্তিক ইচ্ছে লটারিতে একটা মোটা টাকা পাই।
লটারিতে টাকা! ছি ছি! এই তোমার ইচ্ছের দৌড়। ত্যাগের আদর্শে মানুষ হয়ে এই চরিত্র! শুনলে দাদু কী বলবেন?
গৌতম হাসে। বলে, ওই তো, ওইটিই হচ্ছে মূল কথা। সব কিছুতেই দাদুর ভয়ে কাঁটা হবার একমাত্র কারণ তো স্রেফ অর্থনৈতিক পরাধীনতা। কিছু টাকা পেলে হস্টেলে এসে থাকি।
এটা অকৃতজ্ঞতা।
হয়তো তাই। কিন্তু একটা অকপটতা।
তারপর থেকে তো রোজই দেখা হচ্ছে। দুজনের ক্লাস এক নয়, বিভাগ এক নয়। কিন্তু চেষ্টাটা এক। ফলে দেখাটা হয়েই যায়।
অনেকখানি হেঁটে হেঁটে চায়ের দোকানে গিয়ে দুজনে এক কাপ করে চা খেয়ে নেওয়া, অফ-পিরিয়ডে কোথাও বসে পড়া, এ সব চলছেই। এবং টুনুর সহপাঠীরা ধরেই নিয়েছে টুনু ফোর্থ ইয়ারের গৌতম চৌধুরীর সঙ্গে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
মাঝখানে দুটো দিন দেখা হয়নি।
হয়নি নেহাতই দৈবের কারণে।
তাই বলে টুনু এতই অস্থির হবে যে, বাড়িতে এসে হাজির হবে!
.
বুলবুলি পাখির মনের কথা বলার কোনও লোক ছিল না।
ছেলেরা ফিরেও তাকায় না, বউরা গ্রাহ্য করে না। আর ছোট মেয়েকে বুলবুলি পাখি ভয় করে। কোন কথায় ফোঁস করে উঠবে, সে বলা শক্ত।
অনেকদিন পরে বড় মেয়েকে পেয়ে বেঁচেছে বুলবুলি পাখি।
ছোট মেয়ে চোখের আড়াল হলেই বড় মেয়ের কাছে মনের কথা বলতে বসে সে, দেখছিস তো বিনু! দেখ ওর হালচাল। অথচ চল্লিশ বছর বয়েস হতে চলল।
তার মানে গৌতমের পিসির সঙ্গে কোনও তফাত নেই বুলবুলি পাখির। শুধু গৌতমের পিসি বিভা দুঃখ হলে আঁচলে চোখ মোছে, আর বুলবুলি পাখি ফুলকাটা রুমালে।
বিনুকেও এখন আর বিশেষ পালিশ করা দেখাচ্ছে না। বরাবরই ঢিলেঢালা স্বভাব বিনুর। সাজগোজ করে, কিন্তু খানিক পরেই দেখা যায় সব সাজ কেমন গুবলেট হয়ে গেছে।
সেই আলুথালু বিনু খাটে গা গড়িয়ে বলে, সাজে সাজুক গে, মরুক গে, কিন্তু কথা হচ্ছে ওই লোকটা কেন রোজ সন্ধেবেলা এসে আড্ডা মারে? এটা তুমি কী করে অ্যালাউ করো মা?
আমি অ্যালাউ করি? বুলবুলি পাখি শিরে করাঘাত করে, আমার কথায় চলছে সংসার?
চলা তো উচিত। তুমি হেড।
রেখে দে বিনু উচিতের কথা। সংসারে এখন হেড টেল-এ তফাত নেই। ওই মজুমদারটা হচ্ছে ববির বন্ধু, শুনতে পাই নাকি ওর বিজনেসের পার্টনার, ওকে দূরছাই করা চলবে না।
দূরছাই! দূরছাইয়ের কথা হচ্ছে না, তবে ববির বন্ধুকে ববিই নিয়ে বসুক না, সুমি কেন? সুমির কী দরকার সারা সন্ধে ওকে নিয়ে উছলে উছলে গল্প করবার?
কী দরকার! বুলবুলি পাখি নিশ্বাস ফেলে বলে, কী দরকার। সে তুমিও বুঝছ, আমিও বুঝছি, মুখে প্রকাশ করলেই নীচতা। আমার শুধু ভয় কতদূর গড়ায়।
বিনু দীর্ঘদিন আগের কথা তোলে।
বিনু বলে, ছেলেকে কাছছাড়া করে রাখাটা ঠিক হয়নি। ছেলে কাছে থাকলে একটু রাশটানা থাকত।
বুড়ো কি পাঠালে ছেলেকে? আমরা আর কী করব? সুমিকে তো বলতে পারি নে তবে তুমি চলে যাও।
না, সে কি আর বলা যায়! বিনু বলে, তবে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ছেলে তো মাকে আপন বলে ভাবেই না। বরং যেন অগ্রাহ্যর ভাব।
আপন ও ছেলে কাউকেই ভাবে না। বুলবুলি পাখি আর একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, আমি তো চেষ্টা করলাম। ঘরের নাতিদের লুকিয়ে ভালমন্দ দিতে চেষ্টা করেছি, কোনও ফল হয়নি। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। দেখলি তো সেদিন? অত রাত পর্যন্ত রইল, অত সাধলাম, খেয়ে গেল না। কী, না দাদু বসে থাকবেন।
শাসনে শাসনে ওই রকম হয়ে গেছে বেচারি। আহা, রাজার কত আদরের ছেলে!
বুলবুলি পাখি এখনও অভিযোগের বালির মধ্যেই পাক খাচ্ছিল, বলে উঠল, বললে বিশ্বাস করবি, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করায় একটা রিস্টওয়াচ কিনেছিলাম ওর জন্যে, নিল না!
নিল না?
না! বলল কি, দাদু এখন থেকে এসব বিলাসিতা পছন্দ করেন না। অথচ দাদু যে পৈতের সময় মুক্তো বসানো আংটি গড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা তো বেশ পরে আছেন বাবু। আবার বলে কি না, দাদু বলেছেন শরীরে মুক্তোধারণ করলে, দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
আ ছি ছি! এত কুসংস্কার?
এইটুকুতেই চমকাচ্ছিস? সব শুনলে তো ফেন্ট হয়ে যাবি। সেই পৈতে হওয়া থেকে তিনসন্ধে গায়ত্রী জপ করতে হয় বাছাকে।
চমৎকার! সুমি কিছু বলে না?
সুমির বলবার কী আছে? বুড়ো যে মন্ত্রপূত করে রেখেছে। নইলে এমন করে কখনও ছেলেপুলে?
অতপর দুটি বিজ্ঞ মাথা আলোচনা করতে থাকে কেমন করে সুমিতাকে সন্ধ্যার নেশা ছাড়ানো যায়।
ছেলেটা যদি রোজ বিকালে এসে মার কাছে বসে থাকে রাত অবধি
যদি! হু! যদির কথা নদীতে থাক। কথা হচ্ছে, মাকে আর কী উপায়ে ঠেকানো যায়, সেই পরামর্শ করা।
.
কিন্তু ঠেকাব বললেই কি ঠেকানো যায়? উপচে ওঠা নদীকে ঠেকানো যায়? সর্বনাশা কুলপ্লাবিনী বন্যাকে?
সাতাশ বছর বয়েস থেকে সুমিতা শূন্যতার হাহাকার নিয়ে বসে আছে। অথবা সাতাশও নয়, সতেরো থেকেই।
রাজা তাকে মহারানি বলে ডেকেইছে শুধু, রাজ ঐশ্বর্যে তার শূন্যতাকে ভরে তুলতে পারেনি। রাজা ছিল অনেকের মানুষ, কেবলমাত্র একজনের নয়।
অথচ সুমিতা শুধু তাই চেয়েছে। সুমিতা বোধহয় সন্তানকেও ভালবাসার ভাগীদার বলে হিংসে করেছে।
তা ছাড়া রাজার মধ্যে উল্লাস ছিল, উন্মত্ততা ছিল না; আবেগ ছিল, উগ্রতা ছিল না; ভালবাসার প্রাবল্য ছিল, বাসনার জটিলতা ছিল না। অথচ সুমিতার মধ্যে প্রবল চাহিদা ছিল ওই না থাকাগুলোর জন্যেই।
রাজা চাইত মানুষ, সুমিতা চাইত সোসাইটি। রাজা ফুটতে চাইত ফুলের মতো, সুমিতা ফুটতে চাইত কাঁটার মতো।
রাজা ভাবত, অনেক পেয়েছি।
সুমিতা ভাবত, কিছুই পাইনি।
এই দুই বিপরীত শক্তি নিজেকে কেবল নিজের মধ্যে সংহত রাখতে রাখতে ক্ষয় হয়েছে।
সুমিতা হয়তো তেমন করে সংহত রাখেনি, হয়তো ফেটে পড়েছে যখন তখন, কিন্তু রাজা সংহত রেখেছিল। রাজা সেই একবারই শুধু ফেটে পড়ল। উদ্ঘাটিত হয়ে গেল।
কিংবা উদঘাটিত হল না। বন্দুক সাফ করতে করতে গুলি ছুটে মারা গেলে আর উদঘাটিত হবার কী আছে?
রাজা নামের লোকটা যে ঢিলেঢালা আর অসাবধান ছিল, সেই কথাটাই শুধু প্রকাশ পেল।
.
এমন কী দেবেন্দ্রনারায়ণ নামের বৃদ্ধ লোকটি পর্যন্ত বাজে পোড়া তালগাছের মতো সোজা দাঁড়িয়ে নিষ্কম্প গলায় বলে উঠেছিলেন, এরকম একটা কিছু হতেই হবে। জানতাম! ধর্মের বংশে পাপের স্পর্শের প্রতিক্রিয়া।…বহু জীবহত্যার শাস্তি! মৃত্যুপথযাত্রী নিরীহ প্রাণীদের অভিশাপের ফল!
রাজা যে শিকার করত, এটা দেবেন্দ্রনারায়ণ অনুমোদন করতেন না, কিন্তু বয়স্ক ছেলেকে নিষেধ করবার গ্রাম্যতা ছিল না তাঁর।…তা ছাড়া যৌবনে তো তিনি সাহেব ছিলেন।
আশ্চর্য, বুড়ো হয়েও লোকটার গলা কাঁপে না। এখনও নিষ্কম্প গলায় বলে, রক্তের ঋণ অমোঘ! ওর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।
জাঁতি দিয়ে হর্তুকি কুচিয়ে একটা ছোট পাথরবাটিতে করে বাপের হাতে তুলে দিয়ে বিভা আক্ষেপের গলায় বলে, আপনার হাতে মানুষ হয়েও যে–
যেটা যে কী সেটা আর বলল না।
তারপর আস্তে বলল, মেয়েমানুষ হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, সেই মেয়েকে পছন্দ হল গৌতমের!
যেন এর থেকে অধঃপতন আর হতে পারে না। যেন গৌতম নরকের টিকিট কিনেই ফেলেছে।
অথচ কারণটা আর কিছুই নয়, একটি মেয়ে গৌতমকে খুঁজতে এসেছিল, আর বলেছিল, বলবেন টুনু এসেছিল, বুঝতে পারবে।
তাই এঁরা বুঝতে পেরেছেন।
তা হয়তো বুঝতে পারা যায়। ভালবাসার চোখে যে আলো জ্বলে, সেই আলোই ধরা পড়িয়ে দেয়। বলে দেয়, গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।
কিন্তু ছি ছি! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
ক্ষোভে ধিক্কারে বিদীর্ণ হতে থাকেন দেবেন্দ্রনারায়ণ।
মাত্র কুড়ি বছর বয়েস গৌতমের।
অথচ সেই সাত বছর বয়েস থেকে আমি ওকে পবিত্রতার শিক্ষা দিচ্ছি, ত্যাগবাদের শিক্ষা দিচ্ছি, আর বলিষ্ঠ চরিত্র এক ব্রহ্মচারীর মূর্তির স্বপ্ন দেখছি। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানের দীক্ষা আর আধুনিক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের শিক্ষা, এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন সৃষ্টি দেখাতে চেয়েছিলাম সমাজকে।…তাই আমি ওকে ব্রাহ্মণসন্তানের সর্ববিধ আচার পালন করিয়েছি, ওকে মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছি, হোমের আগুনের মতো পবিত্র শিখায় জ্বালাতে চেয়েছি।
কিন্তু ও?
ও প্রতি পদে আমাকে চিন্তিত করেছে ওর প্রবণতার চেহারা প্রকাশিত করে। ও ওর সেই অশুচিচিত্ত মাকে বর্জন করবার দৃঢ়তা সংগ্রহ করতে পারেনি, বারবার তার কাছে যায়।
সেই একদিন বাঁধ ভেঙে দিয়ে আমি ভুল করেছিলাম! ওকে একেবারে মার কথা ভুলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব করে নিতে পারলেই ভাল ছিল। অনেক যত্নে আমি শিব গড়বার মাটি ছানলাম, কিন্তু লক্ষ করলাম না কাঁকর রয়ে গেছে ওর মধ্যে।
তবু এতটা আশঙ্কা করিনি। ছি ছি!
কুড়ি বছর পূর্ণ না হতেই ও একটা কুশ্রী কুরূপা, হয়তো বা ওর থেকে বয়েসে বড়ই, মেয়ের প্রেমাসক্ত হল।…
এ যেন দেবেন্দ্রনারায়ণের সমস্ত পরিকল্পনাকে এক নির্লজ্জ ব্যঙ্গের ফুৎকারে ধূলিসাৎ করে দেওয়া।
আমি সেই পাজি মেয়েটার কাছে হেরে গেলাম! ভাবলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ, যে লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটা বৈধব্যের শুভ্রতাকে পায়ে মাড়িয়ে রঙিন হয়ে বসে আছে।
সে আমার পরাজয়ে উল্লাসের হাসি হাসবে। আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে, কী হল? মায়ের কাছ থেকে ছেলে ছিনিয়ে রেখে, খুব উচ্চ আদর্শে মানুষ করছিলে না? একটা ভাল জামা জুতো পরতে দাওনি তাকে ছেলেবেলায়। শুনতে পাই বড় হবার পরও তাকে নাটক নভেল পড়তে দাওনি, সিনেমা কাকে বলে জানতে দাওনি, একটা বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যেতে দাওনি।
অর্থাৎ তাকে তুচ্ছ জৈবিক বাসনার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিল। যেটা ছিল আমার প্রতি চ্যালেঞ্জের মতো।
কিন্তু এখন দেখলে তো?
কৈশোর না যেতেই সে নারী-প্রেমের স্বাদ পেতে গেল।
বলল এখন জিত হল কার?
আমি কি বলিনি, বজ্র আঁটুনিতেই গেরো ফস্কায়। ইচ্ছে বাসনা লোভ শখ, এগুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, ওকে জোর করে চাপা দিতে গেলে সেটা বিকৃতই হয়ে ওঠে। স্কুলের সব ছেলে রোজ পয়সা নিয়ে যায়, ও বেচারি একটা দিনও নিয়ে যেতে পারে না! ওর দুঃখ না? ওর অভিযোগ জমে না?
হ্যাঁ, সেই একদিন ছেলের হাতে পয়সা দেবার জন্যে রাজার বউ মহারানিকে তিরস্কার করেছিলেন। রাজপুত্রের জ্ঞানবৃদ্ধ পিতামহ।
বলেছিলেন, আক্ষেপ আর অভিযোগ–এর কখনও শেষ নেই বউমা! পাওয়া জিনিসটা কুম্ভকর্ণের মতো। যত পাবে, পাবার বাসনা ততই বেড়ে যাবে। আর বাড়তে থাকবে অসন্তোষ। অনেক পেলে, সামান্য না পাওয়াটাই মস্ত বড় হয়ে দেখা দেয়। ওকে আমি মানুষ করতে চাই বউমা! আদর দিয়ে তুমি ওকে বাঁদর করে তুলো না।
সেই দুর্মতি মেয়েটা বলেছিল, ও তো আমারও ছেলে, ওর উপর আমার কোনও অধিকার নেই?
তার জ্ঞানবৃদ্ধ শ্বশুর রূঢ় গলায় বলেছিলেন, নষ্ট করবার অধিকার নেই। মনে রেখো, এই চৌধুরী বংশের একমাত্র বংশধর ও। দ্বিতীয় আর একজনকে দেবার ক্ষমতা এখন আর স্বয়ং ভগবানেরও নেই।…ওকে গৃহবিগ্রহের মতো সাবধানে রাখতে হবে।
সে বলেছিল, বেশ, তবে করুন ওকে মানুষ। বংশের উপযুক্ত করে। নিষ্ঠুর নিয়মে। আমায় ছেড়ে দিন।
এখন সে বলবে বইকী, হয়েছে তো বংশের উপযুক্ত? কুড়ি বছরে প্রেম করতে, বোধহয় আমার হাতে থাকলেও শিখে উঠতে পারত না।
অদৃশ্য এক প্রগলভা প্রতিপক্ষকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিজেই তার হাতে ব্যঙ্গের ছুরিটা তুলে দিয়ে জর্জরিত হতে থাকেন দেবেন্দ্রনারায়ণ।
বিভা সরে আসে। বিভা এ সময় কথা বলতে পারে না।
বিভা বাবাকে যমের মতো ভয় করে।
ভয় আর দাসত্ব, এই আছে বিভার মধ্যে, আর সব বৃত্তিগুলো বোধহয় বিনা আহারে মরে গেছে। অথচ বিভার থেকে বয়েসে বড়, মান্যেও বড় আর এক মহিলা ঠিক সেই মুহূর্তেই সোফায় গা ডুবিয়ে বসে আবেগে মদির কণ্ঠে সামনে বসে থাকা প্রায় প্রৌঢ় বিহ্বল পুরুষটির দিকে তাকিয়ে বলছিল, হৃদয়বৃত্তি কখনও মরে যায় না মজুমদার! শুধু অনশনে অনটনে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে। তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে আর কিছু নেই? ফুরিয়ে গেছ তুমি?
মজুমদার বয়েসে প্রায় প্রৌঢ় হলেও তরুণের ভূমিকায় উতরে যান।
যারা সত্যি তরুণ তারা হয়তো অতটা পেরে ওঠে না। অতটা বিহ্বল কটাক্ষ, অতটা ভালবাসাবাসির কথা ওদের হাস্যকর রকমের নাটকীয় লাগে। ওদের প্রকাশভঙ্গি আলাদা।
ওরা আবেগের সিন্দুকে চাবি লাগিয়ে চড়া গলায় বলে, আমার আজকের প্রথম কাজ হচ্ছে তোমাকে ফাঁসি দেওয়া।
যে শোনে সেও তেমনি সুরে বলে, সেটা এখনও বাকি আছে নাকি? ঝুলেই তো আছি ফাঁসিকাঠে। তা নইলে আর মরতে মরতে তোমাদের দাদুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই?
কেন? কেন? সেইটি যাওয়া হয়েছিল কেন? দুদিনের অদর্শনে মারা যাচ্ছিলে?
মারা যেতে যাব কোন দুঃখে। ভাবলাম হয়তো বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছ। যাই একবার বন্ধুকৃত্য করে আসি।
অপূর্ব! দাদুকে বুঝি জানো না?
জানতাম বলে গর্ব ছিল, সে গর্ব ধূলিসাৎ। দেখে বুঝলাম, কল্পনা ধারে কাছে লাগে না। উঃ, কী সাংঘাতিক রাশভারী! শুধু মাত্র জিজ্ঞেস করেছেন, গৌতম এলে কী বলব? তাতেই হৃৎকম্প। উঃ, রাতদিন তোমার ওঁর সঙ্গে থাকতে ভয় করে না?
করে। মানে করত। কিন্তু ঠিক করেছি আর ভয় করব না। অকারণ ভয় করার কোনও মানে হয় না।
অকারণ? অকারণ কোথা? রীতিমত সকারণ। দেখলেই তো ভয় করে। আচ্ছা, উনি কি সত্যিই কখনও জামা গায়ে দেন না?
না!
শীতকালে?
উঁহু। শুধু গরম চাদর।
আর যখন চাকরি-টাকরি কাজকর্ম করতেন?
তখন? তখন তো শুনতে পাই ঘোরতর সাহেব ছিলেন। ভোগবিলাসে ত্রুটি ছিল না।
ধ্যেৎ! তাই আবার হয় নাকি?
জগতে কী না হয়? মানুষের মতো পরিবর্তনশীল আর কী আছে?
তুমি জিজ্ঞেস করো না কিছু?
কী দরকার? বৃদ্ধমহোদয়কে ঘাঁটাতে যাই না। শুনতে পাই স্ত্রী-বিয়োগের পরই হঠাৎ ভদ্রলোকের হৃদয়ে এক বিরাট পরিবর্তন আসে, তারপর মেয়ের বৈধব্য জীবন একেবারে রূপান্তর ঘটায়।
তাই নাকি, তা হলে তো বলতেই হয় ভদ্রলোক রীতিমত হৃদয়বান।
হতে পারে। তবে সে হৃদয়টি ঝুনো নারকেলের ভিতরকার জলের মতো, চট করে ব্যবহারে আসে না। আমার ভাগ্যে ওই ঝুনো খোসাটাই জুটেছে।
তোমার ঠাকুমা বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন?
জানি না। দেখিনি। তাঁর জীবদ্দশায় কোনও ফোটো তুলে রাখবার খেয়াল কারও হয়নি। পিসির মুখে শুনেছি সারাদিন শুধু ঠাকুরঘরেই পড়ে থাকতেন। গুরু-টুরু ছিল। রান্নাঘরও আলাদা ছিল মহিলার। এদিকে দাদু তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাহেব, ব্রিটিশ সরকারের প্রিয় অফিসার। বাবুর্চির রান্না ছাড়া মুখে রোচে না, ছেলেমেয়েকেও নিজের দলে টেনে রেখেছেন তাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত মায়ের কাছ থেকে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কেবল তাঁর ওই ঠাকুর-দেবতা গুরু দুরু ব্যঙ্গ করা, তাঁর বার-ব্রত উপপিস-টুপোস নিয়ে রাগ করা। অন্য সব অফিসারের স্ত্রীরা বাইরে-টাইরে বেরোত, উনি সে সুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তাই রাগ ছিল।…তবে মনে হয় সুন্দরীই ছিলেন, না হলে বাইরে বার করবার ইচ্ছে হত না। সুন্দরী স্ত্রী পাশে নিয়ে বেরোলে তবেই না সুখ?
চমৎকার! টুনু ঝংকার দিয়ে বলে, আমার বর তা হলে আমাকে পাশে নিয়ে বেরিয়ে সুখ পাবে না?
তোমার বর? সে হতভাগা কি তার ভাঙা কপাল নিয়ে জন্মেছে পৃথিবীতে? এত বড় দুর্ভাগা কি জন্মায়?
টুনু একটা ভ্রূভঙ্গি করে বলে, এই বয়েসে খুব কথা শিখেছ তো? এদিকে মানুষ তো হয়েছ ওই ঝুনো নারকেলের কাছে।
আর পিসির কাছে হইনি? গৌতম হেসে উঠে বলে, তিনি যে কথার সম্রাট!
হু! একদিনেই বুঝেছি। কী জেরা! কী জেরা! বাপস্!
খুব জেরা করেছিল?
হুঁ।
কী বলল?
এখন অত মনে নেই। বোধ হয় তোমার সঙ্গে কী সুত্রে আলাপ, কতদিনের আলাপ, এই সব।
সূত্র? আচ্ছা সত্যি সূত্রটা কী বলল তো?
মনে নেই। বোধ হয় বাসে লেডিস সিট নিয়ে ঝগড়া।
হু। তাই, মনে পড়েছে।
কিন্তু এই ভেবে অবাক হচ্ছি, এত ছটফটে, এত বাক্যবাগীশ, এত ইয়ার তুমি হলে কী করে? তোমার যা পরিবেশ আর যা শিক্ষাদীক্ষার পদ্ধতি, তাতে তো ল্যাবাভ্যাবা একটি সুবোধ বালক হবার কথা তোমার।
হয়তো এটাই প্রতিক্রিয়া। গৌতম হাসে, স্কুলে থাকতে মনে হত, কলেজে একবার উঠতে পারলে হয়। যেদিন উঠব, সেইদিনই রেস্টুরেন্টে খাব আর সিনেমায় যাব।
বাঃ! বাঃ! শুনে এত আহ্লাদ হল! তা রেখেছিলে প্রতিজ্ঞা?
তা অবশ্য নয়। ইচ্ছেই হয়েছে, কিন্তু ঠিক প্রেরণা পাইনি। গোল্লায় গেলাম তোমার সঙ্গে মিশে।
আমার পক্ষে এটা একটা ভাল সার্টিফিকেট। টুনু বলে ওঠে, অন্তত একটা অতি সুবোধ গোপাল বালককে গোল্লায় যাওয়াবার ক্ষমতা ধরি। কিন্তু তোমার ওই পিসির কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তিনিও তো সাহেব বাবার এলাকায় মানুষ, তবে ওরকম কণ্ঠিফষ্ঠি পরা বৈষ্ণবী প্যাটার্নের হলেন কী করে বলো তো?
ওই তো বললাম, স্ত্রী-বিয়োগের পরই হঠাৎ ভদ্রলোক সমস্ত সাহেবিয়ানা ত্যাগ করলেন, টাইমের আগেই রিটায়ার করলেন, এবং স্ত্রীর সেই গুরুকে খুঁজে বার করে তাঁর কাছে দীক্ষা নিলেন।
সর্বনাশ! বলো কী! এত প্রেম! সাজাহানকেও হার মানাচ্ছে যে!
প্রেম কিংবা অনুতাপ!
আরে বাবা, প্রেম না থাকলে কি আর অনুতাপ আসে?
আসে না তা বলা যায় না। চিতায় মঠ দেওয়ার নজিরও তো আছে…মোটকথা, ছেলেটি তখন প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ওই মেয়েটিই হল দাদুর অনুতাপ যজ্ঞের বলি! ওকে দশবছর বয়েসে ফ্রক ছাড়িয়ে শাড়ি ধরানো হল, স্কুল ছাড়িয়ে শিবপুজো ধরানো হল, এবং দাদুর স্বপাক হবিষ্যির খিদমদগারির চাকরিটা দেওয়া হল। তারপর পনেরো ষোলো হতে না হতেই একটি পবিত্র বৈষ্ণবকুলতিলকের হাতে সম্প্রদান। আর তারও পর? ভাগ্য বিড়ম্বনায় কন্যার অবিলম্বে বৈধব্য।…ব্যস, অতঃপর তার গলার নেকলেস খুলে নিয়ে গলায় তুলসীর মালা তুলে দেওয়া।…কর্মজীবন ত্যাগ করে পৈতৃক এই বাড়িটায় ফিরে এসে বিধবা কন্যার সঙ্গে আদর্শ বাপের ব্রাহ্মণোচিত জীবন যাপন করা। চলছিল মন্দ নয়। গণ্ডগোল ঘটালেন আমার বাবা।
বলেই চুপ করে যায় গৌতম।
টুনুও একটু চুপ করে থাকে।
টুনু জানে, বাবার কথা উঠলেই থেমে যায় গৌতম, আর গল্প করতে পারে না।
তবু টুনু এতদিনে জেনে ফেলেছে, ছেলে মারা যাবার পর দেবেন্দ্রনারায়ণ পিতৃহীন পৌত্র ও বিধবা পুত্রবধূকে নিয়ে এসে কী পরিমাণ সনাতন আদর্শের ছাঁচে ভরে ফেলতে চেয়েছিলেন।…পুত্রবধূ তো খাঁচা খুলে উড়ে গেছে। নাতিটা পারেনি। সে একটা অদ্ভুত জগতের মধ্যে মানুষ হয়েছে।
সে দাদুর প্রাবল্যে বশ্যতা স্বীকার করে চলতে বাধ্য হয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্রোহের সুর তার রক্তে বেজেছে।
দাদুকে সে অশ্রদ্ধা করতে পারে না, কিন্তু সর্বদা মনে হয় কোথায় যেন একটা বিরাট ভুল আছে ওঁর। যেন কোথায় আছে একটা বড় ফাঁকি, যেটা ঢাকবার জন্যে প্রাণপণ সাধনা করে চলেছেন।
মনে হয় কী জানো? পিসির আবার বিয়ে দিতে পারলেই যেন উনি বাঁচতেন।
ধ্যেৎ! ওঁর প্রকৃতিতে ওটা কী করে খাপ খাবে?
জানি না খাপ খায় কিনা, আর আমার মনে হওয়াটাই নির্ভুল কিনা, তবু মনে হয়। নিজেকে নিজে এমন এক অদ্ভুত শৃঙ্খলে বেঁধে বসে আছেন, তার থেকে ওঁর মুক্তি নেই। ওঁর সেই গুরু ওঁকে মুঠোয় চেপে বসে আছেন।…পিসির বঞ্চিত জীবন ওঁকে জগতের সকলের ওপর আক্রোশপরায়ণ করে তুলেছে, অথচ উনি ভাবছেন, প্রাচীন ভারতের ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করেছি বলেই আমার বিলাসিতা দেখলে রক্তে আগুন ধরে যায়। তা ছাড়া আমার মার ব্যবহারও হয়তো এই বিকৃতির জন্যে কিছুটা দায়ী।
বলেই আবার চুপ করে যায় গৌতম।
টুনু আস্তে ওর হাতের উপর একটা হাত রাখে। তারপর বলে, ছেলেবেলায় তুমি যদি জোর করে কেঁদেকেটে তোমার মায়ের সঙ্গে চলে যেতে, ভাল হত।…আচ্ছা, এত কঠোর শাসনের মধ্যে থাকতে হয়েছে তোমায়, তবু চলে যাওনি কেন?
জানি না। গৌতম বলে, হয়তো আমার মধ্যে প্রবাহিত আমার পিতৃপিতামহের রক্তই আমাকেও উলটোপালটা করেছে। আমার বাবাও তোনা টুনু, মামার বাড়িতে যাবার কথা আমি ভাবতেই পারতাম না। এখনও পারি না। দাদুর বাড়ির কঠোরতাও যেমন বিদ্রোহী করে তোলে আমায়, দিদিমার বাড়ির ওই শিথিলতাও তেমনি বিদ্রোহী করে তোলে।…আমি নিজের সম্পর্কে এত বেপরোয়া চিন্তা করি, কিন্তু যখন আমার বুড়ি দিদিমা–
বুলবুলি পাখি বলো?
বলে হেসে ওঠে টুনু।
গৌতম হাসে না। কেমন একটা কঠিন মুখে বলে, যখন দেখি সেই বুলবুলি পাখি বাড়ির ঝি-চাকরের রান্নাকরা মুরগির ঠ্যাং ঠোকরাচ্ছে, আমার সমস্ত চেতনা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
টুনু বলে, এটা তোমার ওই দাদুর শিক্ষার ফল আর কী। নইলে দেখো, মানুষ তো? তার খাবার, পরবার, বেড়াবার সব ইচ্ছে আর একজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে? তোমার দাদুর কথা বাদে, পুরুষরা তো বউ মরে গেলে কিছু ত্যাগ করে না। বরং
টুনু চোখটা একটু কৌতুকে নাচিয়ে বলে, সে রকম একটি নমুনা আমার দৃশ্যগোচরে রয়েছে কিনা।
গৌতম ওর ওই শেষ কথাটায় কান দেয় না, পুরনো কথাটার জের ধরেই বলে, বুদ্ধি দিয়ে তোমার যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারি না টুনু, কিন্তু অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে উপায় কী? কিন্তু কীসের যেন নমুনা বলছিলেন?
টুনু হেসে উঠে বলে, বিপত্নীকের নমুনা। ও কিছু না, একটা বাজে কথা।…কিন্তু আমি তোমার বাড়ি গেলাম। এবার তুমি আমার বাড়ি এসো।
কেন, বাড়ি গিয়ে কী হবে? গৌতম হাসে, এটা কি মন্দ?
মন্দ নয়! কিন্তু সব সময় বুঝি এই রকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভালবাসতে ইচ্ছে করে? মনে হয় আমাদের যেন স্থিত নেই, ভিত নেই, সমাজ নেই, সংসার নেই, অতএব ভরসা নেই, ভবিষ্যৎ নেই। এই রকম পথে ঘুরতে ঘুরতে কোনওদিন কে কোন পথে ভেসে যাব।
গৌতম হেসে উঠে বলে, এর মধ্যেই এত সব ভাবনা চিন্তা এসে গেছে তোমার? আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, স্থিত নেই ভিত নেই। কত বয়েস হল?
টুনু হাসে না। বলে, তোমার থেকে কম নয়। কিন্তু কি জানো গৌতম, মান নেই বলেই হয়তো আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, কিছু নেইভাব। মা না থাকা, যেন সব কিছুই না থাকা।
টুনুর মা নেই, সে কথা জানে গৌতম।
আর ওই না থাকাটা যে খুব দীর্ঘকালের নয়, তাও জানে। টুনু যখন হায়ার সেকেন্ডারির জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ওর মা মারা গেলেন।
টুনু বলেছিল, মা অনেকদিন থেকেই ভুগছিল, মা বিশেষ কিছুই করতে পারত না। শেষে কমাস তো বিছানাই নিয়েছিল, তবু কোথাও কোনও শূন্যতাবোধ ছিল না। মা মারা যাবার পর ঠিক কী মনে হল জানো? যেন আমি দিব্যি একটা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দোলনার দড়িটা ছিঁড়ে পড়ে গেলাম।
গৌতমের মা আছেন। তাই হয়তো এসব কথা বলতে পেরেছিল টুনু। গৌতমের যে আমার মা আছেন–ভাবতে গেলেই হঠাৎ প্রকাণ্ড একটা গহ্বরে পা বসে যায়, সে কথা তো জানে না টুনু।
টুনু জানে, দাদুর শাসনের দাপটে মায়ের কাছে থাকতে পায় না গৌতম। অথবা গৌতমের কাছে মা।
তোমার বাবা নেই, আমার মা নেই– বলেছিল একদিন টুনু, অবস্থায় একটা বিশেষ সাদৃশ্য আছে।
কিন্তু বাবা নেই এই খবরটুকু ছাড়া আর কোনও কথাই বলেনি গৌতম, তার অন্তরঙ্গ বান্ধবীকেও।
বাবার কথা ভাবতে গেলেই যে সেই ভয়ানক কষ্টটা হয় গৌতমের।
আর গৌতমের সমস্ত চৈতন্যকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে সেই শব্দটা সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
একটু আগেই দেখে গিয়েছিল গৌতম, বাড়ির পিছন দিকের বারান্দায় বসে বন্দুক সাফ করছেন বাবা।
গৌতমকে দেখে বন্দুকটা পাশে নামিয়ে রেখে ডেকেছিলেন।
গৌতম তখন একটা কুকুরছানার গলায় বগলস পরাবার জন্যে অস্থির, ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়িয়েছিল, কী বলছ?
বাবা বলেছিলেন, নাঃ, কিছু বলছি না। যাও খেলা করোগে।
গৌতম চলে গিয়েছিল।
তার কতক্ষণ পরে যেন সেই শব্দটা। তার সঙ্গে তীব্র একটা গন্ধ।
গৌতমকে কারা যেন সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জোর করে ধরে, তবু গৌতম দেখে ফেলেছিল ঘরের মেঝেয় শুয়ে পড়ে আছেন বাবা, রক্ত গড়াচ্ছে মেঝেয়। বন্দুকটা শুয়ে আছে বাবার কাছে।
অসাবধানে বন্দুকের গুলি ছুটে মারা গিয়েছিলেন বাবা।
কিন্তু বারান্দা থেকে কখন ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন বাবা, আর কেনই বা গিয়েছিলেন তা কোনওদিন বুঝতে পারল না গৌতম।