ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

১. রহস্যময় টারজান

বনের ছেলে টারজান (উপন্যাস) – ময়ূখ চৌধুরী

০১. রহস্যময় টারজান

বনের পথে চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল টারজান-জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা ঘাস-জমির উপর রয়েছে একটা শক্ত কাঠের খাঁচা, আর তার ভিতর বাঁধা রয়েছে একটা ছাগল! খাঁচার দরজা বন্ধ নয়, খোলা!

এক নজর তাকিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারল টারজান। পশুরাজ মার জন্য ফাঁদ পেতেছে নিগ্রোরা। বহুদিন ধরে কালো মানুষদের চালচলন লক্ষ্য করেছে টারজান, ওই কাঠের খাঁচার রহস্য তার অজানা নয়। ছাগলের গায়ে টান পড়লেই উপর থেকে নেমে আসবে শক্ত কাঠের ঝাঁপ বা দরজা, সঙ্গেসঙ্গে বন্দি হবে পশুরাজ। একসময়ে অকুস্থলে এসে খাঁচাসমেত বন্দি সিংহকে গ্রামের মধ্যে নিয়ে যাবে নিগ্রোরা, তারপর অসহায় জন্তুটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে তারা। এই দৃশ্য অতীতে বহুবার দেখেছে টারজান।

খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ছাগলটাকে লক্ষ্য করল টারজান। সে ক্ষুধার্ত ছিল। কিন্তু ছাগলের মাংসে উদর-পূরণের কথা সে ভাবছিল না।

বনমানুষদের দলে বড়ো হয়েছিল সে, তার প্রতিবেশী ছিল বিভিন্ন ধরনের জন্তু-জানোয়ার। সভ্য-জগতের বাইরে বন্য প্রকৃতির মধ্যে বড়ো হওয়ার ফলে টারজানের মধ্যে পশুর বৃত্তিগুলো ছিল অতি মাত্রায় জাগ্রত, তবু মানুষের সহজাত বৃত্তি তার মধ্যে একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি। বনের পশু ঠাট্টা বিদ্রূপ বা রসিকতার মর্ম বোঝে না, কিন্তু টারজানের মধ্যে মানুষের সহজাত রসবোধ বা রসিকতার প্রবৃত্তি ছিল প্রবল।

অবশ্য শিক্ষিত সভ্যমানুষের সূক্ষ্ম রসবোধ তার ছিল না, তার রসিকতা ছিল নিতান্তই মোটা দাগের। বনের মধ্যে যে-সব জানোয়ার টারজানের রসিকতার শিকার হত, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত তার উপর, আর তাদের নাগালের বাইরে থেকে সেই নিষ্ফল ক্রোধ উপভোগ করত টারজান। দুই-একটা উদাহরণ দিচ্ছি :

জঙ্গলের মধ্যে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনমানুষের দল, হঠাৎ নিকটবর্তী ঝোপের ভিতর থেকে জাগল শ্বাপদকণ্ঠে ক্রুদ্ধ গর্জন- শিটা অর্থাৎ প্যান্থার!

দারুণ ভয়ে পড়ি-কি-মরি করে দলের সব কয়টা বনমানুষই দৌড় দিল, মাটি ছেড়ে উঠে পড়ল বড়ো বড়ো গাছের উপর। তাড়াতাড়ি ছুটতে গিয়ে কেউ হয়তো আছাড় খেয়ে পড়ল, কেউ হয়তো মোটাসোটা একটা ধেড়ে ইঁদুরকে পাকড়াও করেছিল, (বনমানুষরা ফলমূল ছাড়াও ইঁদুর, বিছা, পোকামাকড় প্রভৃতি খায়) হঠাৎ কানের কাছে শিটার গর্জন শুনে তাড়াতাড়ি জ্যান্ত খাবারটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ল উঁচু গাছের মগডালে। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ, তারপর একসময় ওই গাছের ঝোপটা ঠেলে বেরিয়ে এল টারজান, তার মুখে বিদ্রুপের হাসি! টারজান যে শিটা আর মার গলার স্বর নকল করতে পারে সেকথা বনমানুষদের অজানা ছিল না, তাই ব্যাপারটা অনুমান করে তারা খেপে গেল। তবু তারা চুপ করেই ছিল, কিন্তু কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো টারজানের বিদ্রূপ তাদের সহ্য হল না, ওহে বনমানুষের দল, তোমরা বারা নামে হরিণটার চেয়েও ভীরু! আমার গলার আওয়াজ শুনে তোমরা ভয় পেলে। হো! হো! হো!

দলের তিন-চারটে পুরুষ মারমুখো হয়ে তেড়ে গেল টারজানের দিকে। তাদের হাত এড়িয়ে সরে গেল টারজান, তবে বেশি দূরে নয়। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা করতে লাগল তাদের। আবার তেড়ে গেল বনমানুষরা, আবার তাদের নাগালের বাইরে হয়ে গেল টারজান সঙ্গেসঙ্গে আবার মন্থরগতির জন্য তাদের ঠাট্টা করতেও ছাড়ল না। কয়েকবার তেড়ে গিয়ে টারজানকে ধরতে না পেরে বনমানুষরা আবার আহারের সন্ধানে মনোনিবেশ করল। টারজান তখন নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছে হো হো শব্দে..

আর একদিন তার রসিকতার শিকার হল স্বয়ং পশুরাজ নমা। বনপথের এক ধারে ঝোপের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে বসেছিল সে। ওই পথ দিয়েই নদীতে জলপান করতে যাবে বারা নামে হরিণ, তার জন্যই ন্যুমার অপেক্ষা। একটু পরেই দেখা দিল বারা, ভীরু চোখে এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে এগিয়ে আসছে সে। বাতাস বইছে হরিণের দিক থেকে, কাছেই ঝোপের মধ্যে অপেক্ষামান সিংহের অস্তিত্ব সে বুঝতে পারল না। দ্যুমার দেহের পেশিগুলো টান হয়ে গেল, নীচু হয়ে সে বসে পড়ল গুঁড়ি মেরে, এইবার লাফ দিলেই হয়।

হঠাৎ সাপের মতো কী-একটা বস্তু এসে পড়ল হরিণের গলায়, পরক্ষণেই ন্যুমার চোখের সামনে সাঁ করে হরিণটা উঠে গেল শূন্যে! স্থলচর হরিণকে হঠাৎ আকাশের পাখির মতো শূন্যে বিচরণ করতে দেখে দ্যুমা হতভম্ভ হয়ে গেল, তারপর শিকার হাতছাড়া হয় দেখে তেড়ে গিয়ে মারল লাফ। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, শিকার তখন নাগালেই বাইরে। মার সনখ থাবা দোদুল্যমান শিকারের পায়ের তলায় শূন্যে ছোবল মারল, শিকারকে স্পর্শ করতে পারল না। লতার ফঁসে আবদ্ধ হরিণটাকে গাছের উপর টেনে তুলল টারজান, নামার চোখের উপর তাকে হত্যা করে মাংস খেতে শুরু করল আর বনমানুষের ভাষায় চিৎকার করে বলতে লাগল, ওরে ন্যমা! ওরে ড্যাংগোর (হায়না) মাসতুতো ভাই, হরিণের মাংস তোর খাদ্য নয়। তুই বরং ইঁদুর ধরে খাওয়ার চেষ্টা কর। হরিণ খেতে হলে আর একটু চটপটে হওয়া দরকার।

ভীষণ গর্জনে বন কাঁপিয়ে সিংহ গাছের উপর উঠতে চেষ্টা করল। কিছুদূর সে উঠল, কিন্তু টারজান যেখানে বসে আছে সেই উঁচু ডালটায় ভারী শরীর নিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব অনেকক্ষণ তর্জন গর্জন করে ন্যুমা বিদায় নিল অকুস্থল থেকে। মাকে জব্দ করে টারজান তখন বেজায় খুশি, আপন মনেই সে হাসছে আর হাসছে…

আচ্ছা, এবার আমরা ফেলে-আসা গল্পটা শুরু করছি। বনের পথে খাঁচার মধ্যে বন্দি ছাগলটাকে দেখে টারজানের মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ফন্দিটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে ব্যাপারটা যে খুব মজার হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ-নাস্তি… নিজের মনেই একচোট হেসে নিল সে। খুব সাবধানে ছাগলটাকে বন্ধনমুক্ত করে খাঁচার বাইরে বেরিয়ে এল টারজান। অনেকদিন ধরে খাঁচার ফাঁদ-পাতা লক্ষ্য করেছে সে, দরজাটাকে যথাযথ অবস্থায় রেখে জ্যান্ত টোপটাকে বন্ধনমুক্ত করার কৌশল সে আয়ত্ত করেছে অনেকদিন আগেই।

ছাগলটাকে ছেড়ে দিয়ে সে বনের পথ ধরল। বাতাসে ভেসে-আসা গায়ের গন্ধ আর পথের উপর পায়ের চিহ্নগুলো তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করল এবং কয়েক মাইলের মধ্যেই দেখতে পেল দলটাকে।

একটা মস্ত গাছের উপর থেকে লোকগুলোর উপর নজর রাখতে লাগল টারজান…

নিগ্রোদের সঙ্গে ফাঁদ পাততে এসেছিল জাদুকর রব্বা কেগা। আর একটু এগিয়ে গেলেই গ্রাম, এখানে দিনের বেলা গ্রামের এত কাছে জন্তু-জানোয়ারের ভয় নেই অতএব গাছের ঠান্ডা ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না জাদুকর। ঝিরঝিরে বনের হাওয়ায় তার চোখদুটো প্রায় বুজে এসেছে হঠাৎ পিঠের উপর এক প্রচণ্ড আঘাতে সে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

ব্যাপারটা কী হল বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া শক্ত হাত তাকে ঝটকা মেরে দাঁড় করিয়ে দিল। দারুণ ক্রোধে মুখ তুলে তাকাতেই রব্বা কেগার সর্বাঙ্গ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল… তার সামনেই মূর্তিমান মৃত্যুর মতো দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতদৈত্য টারজান!

হ্যাঁ, পিছন থেকে টারজানই লাফিয়ে পড়েছিল জাদুকরের পিঠের উপর। কালা নামে যে বনমানষি টারজানকে লালন-পালন করেছিল, তাকে হত্যা করেছিল এক নিগ্রো-শিকারি। সেই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গোমাঙ্গানি অর্থাৎ নিগ্রোদের ঘৃণা করত টারজান, আর সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করত রব্বা কেগা নামে এই জাদুকরকে। টারজানের মনোভাব জানত রব্বা কেগা, তাই সে ভয় পেয়েছিল। গ্রামের পথে তার সঙ্গীরা বেশি দূর যায়নি, কাছেই আছে তারা… অতএব সাহায্যের জন্য চিৎকার করার চেষ্টা করল রব্বা কেগা। কিন্তু অর্ধস্ফুট স্বর তৎক্ষণাৎ রুদ্ধ হয়ে গেল পাঁচটা কঠিন আঙ্গুলের চাপে। আঙুলগুলো আবার গলা থেকে সরে গেল। জাদুকর আর চিৎকার করার চেষ্টা করল না। সে বুঝেছিল আবার সেই চেষ্টা করলে টারজান তাকে গলা টিপে হত্যা করবে। টারজান এবার রব্বা কেগাকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। সুবোধ বালকের মতো নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে চলল রব্বা কেগা, টারজানের সামনে থেকে দৌড়ে পালানো অসম্ভব জেনেই সেই চেষ্টা করল না জাদুকর….

খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। এতক্ষণ পরে রব্বা কেগা একটু আশ্বস্ত হল, সাদা দৈত্যটা বোধ হয় তাকে খুন করতে চায় না। কিন্তু টারজান যখন তাকে খাঁচার ভিতরে টেনে এনে ঋপের কলটার সঙ্গে বাঁধতে শুরু করল, তখনই তার বুক কেঁপে উঠল… শ্বেতদৈত্যের মতলব খুবই স্পষ্ট ছাগলের বদলে তাকেই টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে চায় টারজান!

জাদুকরের সর্বাঙ্গে ঘাম ছুটল। ন্যুমা এসে তাকে ধরলেই দরজাটা পড়ে যাবে, ফলে জন্তুটা বন্দি হবে খাঁচার ভিতর… সেই ক্ষিপ্ত সিংহের কবলে নিজের দুর্দশা কল্পনা করে ভয়ে পাগলের মতো হয়ে গেল জাদুকর। এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি সে, এবার আর্তকণ্ঠে মিনতি জানিয়ে টারজানের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল।

টারজান কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। এই জাদুকরটাকে সে পছন্দ করে না, কিন্তু নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কারুকে হত্যা করতে চায় না টারজান। জাদুকর রব্বা কেগার আদেশেই যে নিগ্রোরা নানা ধরনের নিষ্ঠুর কার্যে লিপ্ত হয়, সেকথা জানত টারজান। আর সেইজন্যেই তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল সে। এখন তার মনে হল লোকটাকে হত্যা না করলেও চলে… কারণ, এই এলাকা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব হবে না। টারজান জানাল জাদুকর যদি এই মুহূর্তে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে কখনো এখানে পদার্পণ না করে, তবেই তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। অবশ্য স্থানত্যাগের আগে তার গলার বিচিত্র কণ্ঠহারটাকে টারজানের হাতে সমর্পণ করতে হবে।

শর্ত শুনে রব্বা কেগা টোক গিলল। তার কণ্ঠের ভূষণ ওই মালাটিকে জাদুর মালা বলে জানে স্থানীয় মানুষ, ওইটার দৌলতেই তাদের উপর তার প্রভাব প্রতিপত্তি অব্যাহত! মালাটা হাতছাড়া হলে গ্রামবাসী নিগ্রোরা আর তাকে ভয় করবে না, একথা জানত জাদুকর… তবু প্রাণের ভয়ে টারজানের প্রস্তাবে সম্মত হল। শ্বেতদৈত্যের হাতে মালা সমর্পণ করে তীরবেগে স্থানত্যাগ করল জাদুকর রব্বা কেগা… বলা যায় না, দৈত্যটা যদি হঠাৎ মত বদলায়।

টারজান এইবার জঙ্গলের মধ্যে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাচ্চা শুয়োরকে নিয়ে সে ফিরে এল খাঁচার কাছে…

একটা রাত কাটল। সকাল হল। সঙ্গেসঙ্গে নিগ্রোরা ছুটে এল খাঁচার কাছে। হ্যাঁ, তাদের আশা পূর্ণ হয়েছে। খাঁচার ভিতর অস্থির চরণে পায়চারি করছে পশুরাজ নুমা। সকলে মহানন্দে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু খাঁচার সামনে গিয়েই তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। ভিতরে ছাগলটার চিহ্নমাত্র নেই, পড়ে রয়েছে একটা মালা! মালাটা তাদের পরিচিত… মালার মালিক জাদুকর রব্বা কেগা কিন্তু সেখানে নেই! খাঁচার ভিতর রক্ত বা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

যে-টোপটা ব্যবহার করে টারজান মাকে বন্দি করেছিল, সুকৌশলে সেই বাচ্চা শুয়োরটাকেও সে সরিয়ে ফেলেছিল।

নিগ্রোরা হতভম্ভ হয়ে গেল। বিগত রাত্রি থেকেই জাদুকরকে তারা দেখতে পাচ্ছে না। এখন সিংহের খাঁচার মধ্যে তার গলার মালাটাকে দেখে তারা ভয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। টিবাটো নামে এক যোদ্ধা প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল, সেই সাদা অপদেবতার কীর্তি! এই সব কাণ্ড করেছে সে!

সবাই চুপ। গাছের উপর বসে সকলের অলক্ষ্যে টারজান ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। হ্যাঁ, মজাটা এবার জমেছে বটে!

সিংহের খাঁচাটাকে গ্রামের দিকে টেনে নিয়ে চলল নিগ্রোরা। শিকার হাতে পেয়েও তাদের মধ্যে আনন্দ বা উল্লাসের চিহ্নমাত্র ছিল না, অত্যন্ত বিষণ্ণ ও চিন্তিতভাবে দলটা এগিয়ে চলল সিংহকে টানতে টানতে… গ্রামে পৌঁছেই মবংগো সর্দারকে ব্যাপারটা জানাতে হবে…

গ্রামে এসে নিগ্রোরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রত্যেকেরই মনে হচ্ছিল এক অদৃশ্য অপদেবতা আড়াল থেকে তাদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছে। গ্রামের চারপাশ ঘিরে মোটা মোটা কাঠের তৈরি মস্ত উঁচু বেড়াটার ভিতর ঢুকে তারা ঝাঁপ বন্ধ করল… এবার তারা নিশ্চিন্ত; এই বেড়ার ভিতর ঢুকে কোনো অপদেবতা তাদের ক্ষতি করতে পারবে না।

বেড়াটার চাইতে অনেক বেশি উঁচু একটা গাছের উপর থেকে নিগ্রোদের লক্ষ্য করছিল টারজান। গ্রামের মেয়েরা লাঠি আর পাথর দিয়ে বন্দি সিংহকে উত্যক্ত করছিল। ব্যাপারটা টারজানের পছন্দ হল না। উদরের ক্ষুধাকে তৃপ্ত করতে অথবা আত্মরক্ষার জন্যে জীবহত্যা করতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু অনর্থক নিষ্ঠুরতার সে পক্ষপাতী নয়। সেই মুহূর্তেই মাকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা তার মাথায় এল।

কিছুক্ষণ পরে দুটো কুঁড়ে ঘরের মাঝখানে সিংহের খাঁচাটাকে টেনে আনল যোদ্ধার দল, তারপর স্থানত্যাগ করল সকলেই। টারজান বুঝল রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার আগে তারা আর এদিকে আসবে না। টারজানের মাথায় হঠাৎ একটা চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল.. লতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে গাছের মাথায় টারজান ছুটল তার গোপন আস্তানার উদ্দেশ্যে…

টারজানের ঐশ্বর্য ছিল একটা ফাঁপা গাছের গুঁড়ির ভিতর। ওই লুকানো জায়গাটার কথা কেউ জানত না। সেখানে ছিল অনেক মূল্যবান বস্তু… পাকানো লতার দড়ি, বর্শার ফলা, কাঁচের পুঁতি এবং আরও হরেক রকম সামগ্রী! সেই ফঁপা গুঁড়িটার ভিতর থেকে টারজান বার করল একটি সিংহচর্ম। সিংহের কেশর সমেত মাথা তো ছিলই সেই চামড়াটায়, এমনকী লেজটাও ছিল অটুট। চামড়াটা নিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল টারজান। পর্যবেক্ষণের ফল বোধ হয় সন্তোষজনক হল… কারণ, তার মুখে ফুটল হাসির রেখা…।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। টারজান তখন বসে আছে মস্ত গাছটার একটা উঁচু ডালে… ওই গাছটা থেকেই সকালের দিকে সে গ্রামবাসীদের উপর নজর রাখছিল…

সন্ধ্যার ধূসর ছায়াকে গাঢ় করে নেমে এল আফ্রিকার অন্ধকার রাত্রি, সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকুণ্ডের সামনে শুরু হল যোদ্ধাদের শিকারি… নৃত্য। বৃত্তের আকারে নর্তকদের ঘিরে বসেছিল নিগ্রো জনতা। নাচের তালে তালে বাজছিল ঢাক, হিংস্র উল্লাসে অধীর হয়ে উঠেছিল সমবেত জনতা…

টারজান জানত একটু পরেই তারা সিংহের খাঁচাটাকে টেনে আনবে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের সামনে। সেইখানে বন্দি পশুরাজের উপর চলবে ভয়াবহ নির্যাতন, তারপর একসময়ে তাকে হত্যা করা হবে।

গাছের ডাল থেকে লম্বমান একটা লতা ধরে ঝাঁপ দিল টারজান, এসে পড়ল একেবারে গ্রামের মাঝখানে। পূর্বে উক্ত সিংহচর্ম এখন অবস্থান করছে তার গায়ের উপর।

বন্দি ন্যুমার খাঁচার পিছনে এসে দাঁড়াল টারজান। খুব সাবধানে চামড়ায় বসানো সিংহের মাথাটাকে সে নিজের মাথায় বসিয়ে দিল, তারপর চামড়াটাকে নিপুণভাবে পিঠের উপর ফেলে দিয়ে সিংহের মতোই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল উপবিষ্ট জনতার দিকে…

গরর…গরর…আহ…উননন!

চমকে উঠল জনতা! এ যে ক্রুদ্ধ সিংহের কণ্ঠস্বর! আচম্বিতে অন্ধকার ভেদ করে অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোকে আত্মপ্রকাশ করল পশুরাজ ন্যুমা। তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি।

কী সর্বনাশ! খাঁচার ভিতর থেকে ন্যুমা মুক্তি পেল কেমন করে। সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজল না। প্রথমেই পালাল নারী আর শিশুর দল। কয়েক মুহূর্ত পরেই যোদ্ধারাও অন্তর্ধান করল তীরবেগে। অগ্নিকুণ্ডের সামনে সমস্ত গ্রামের মধ্যে তখন একমাত্র দৃশ্যমান জীব হল পশুরাজ নুমা!

একটু পরেই কুঁড়ে ঘরের আড়াল থেকে উঁকি দিল একটা মাথা.. তারপর ধীরে ধীরে মুখ বাড়াল আরও কয়েকজন যোদ্ধা… কী আশ্চর্য! সিংহটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে কী করছে ওখানে?…

হঠাৎ সকলকে চমকে দিয়ে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠল মা! তারপরই মুণ্ডসমেত সিংহের চামড়াটা পড়ে গেল মাটির উপর… সকলে আশ্চর্য হয়ে দেখল তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতদৈত্য টারজান।

সকলের চোখের সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে গ্রামের দূরবর্তী সীমানার দিকে পদচালনা করল টারজান এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার দীর্ঘদেহ অদৃশ্য হয়ে গেল ঘন অন্ধকারের গর্ভে। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে একটু সময় গেল… কিছুক্ষণ পরেই বর্শা তুলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল যোদ্ধার দল। টারজান যেদিকে গিয়েছিল, সেই দিকেই হানা দিল তারা, কিন্তু শত্রুকে খুঁজে পেল না। পাবে কী করে? বেড়া ডিঙিয়ে অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে তখন মিলিয়ে গেছে টারজান…

একটু পরেই আবার লতার দোলনা ধরে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করল টারজান। এবার আর সিংহচর্ম সঙ্গে নেই, চামড়াটিকে সে রেখে এসেছে একটা গাছের উপর।

কুটিরের ছায়ায় ছায়ায় অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে টারজান এসে পৌঁছাল সিংহের খাঁচার কাছে… এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখল না, কেউ নেই… একলাফে খাঁচার ছাতে উঠে দড়ি ধরে টান দিতেই দরজাটা উপরে উঠে গেল… মুক্তদ্বার পথে খাঁচার বাইরে পদার্পণ করল পশুরাজ…

টারজানের উদ্দেশে কিছুক্ষণ অনুসন্ধান চালিয়ে হতাশ যোদ্ধার দল ফিরে আসছিল, হঠাৎ তাদের সামনে অগ্নিকুণ্ডের আলোয় আত্মপ্রকাশ করল মা!

এবার আর ভয় পেল না যোদ্ধার দল, উৎসাহে চিৎকার করে উঠল তারা…

শয়তান শ্বেতদৈত্যটা কী ভেবেছে তাদের? একই কায়দায় আবার তাদের বোকা বানাতে চায়? বর্শা বাগিয়ে সকলে ছুটে এল সিংহের দিকে।

ভীষণ গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে সিংহ আক্রমণ করল। সামনেই দাঁড়িয়েছিল এক তরুণ যোদ্ধা… বিশাল বক্ষ, বৃষস্কন্ধ, বলিষ্ঠ বাহু! নির্ভয়ে হেসে উঠে সে বর্শা চালাল। ছদ্মবেশী শ্বৈতদৈত্যকে সে আজ নির্ঘাত হত্যা করবে।

বর্শা সিংহের দেহ ভেদ করল, কিন্তু তার গতিরুদ্ধ হল না। প্রচণ্ড চাপেটাঘাতে তরুণ যোদ্ধাকে ছিটকে ফেলে দিল সিংহ। আরও কয়েকটা বর্শা ছুটে এল সিংহের দিকে। আহত সিংহ এবার বিদ্যুৎবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিগ্রোদের উপর, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হল আরও চার-পাঁচজন যোদ্ধা! এত দ্রুতবেগে পশুরাজ আক্রমণ চালিয়েছিল যে, শত্রুরা তার মর্মস্থানে আঘাত করার সুযোগই পায়নি…

একজন যোদ্ধা ছুটে গিয়ে কাঠের বেড়ার দরজাটা খুলে ফেলল, তারপর দৌড়ে ঢুকে গেল বনের ভিতর। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল তার সঙ্গীরা..

গাছের আড়ালে লুকিয়ে নিগ্রোরা দেখল দ্যুমা গ্রাম ছেড়ে বনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তার দেহটা অন্ধকার গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল…

স্তম্ভিত বিস্ময়ে নামার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল নিগ্রো যোদ্ধার দল। টারজান যে এক মায়াবী অপদেবতা এবিষয়ে তাদের সন্দেহ রইল না কিছুমাত্র। সন্দেহ থাকবে কী করে? একটু আগেই তারা টারজানকে সিংহ থেকে মানুষ এবং মানুষ থেকে সিংহে পরিবর্তিত হতে দেখেছে যে।

.

০২. বন্দী টারজান

বিশাল গর্তটার উপর ঘাসপাতা আর ডালপালা সাজিয়ে দিল একদল যোদ্ধা। উপর থেকে দেখে তখন আর বোঝার উপায় নেই যে, ওই পাতলা আবরণের তলায় হাঁ করে আছে মস্ত এক মৃত্যুফাঁদ! কেউ ভুল করে ওই পাতলা জঙ্গলের কৃত্রিম আবরণের উপর পা ফেললেই হুড়মুড় করে পড়বে তলায়, যেখানে অনাহূত অতিথিকে সাংঘাতিক অভ্যর্থনা জানাতে লুকিয়ে রয়েছে সাংঘাতিক বর্শাফলকের মতো অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি! গর্তের তলায় মাটিতে গাছের গুঁড়িগুলো পোঁতা হয়েছে; তাদের একদিক মাটির ভিতর, অপরদিক বর্শার ফলার মতো সরু আর ধারাল হয়ে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

অনেকক্ষণ ধরে ওই চমৎকার ফাঁদটি সাজাল নিগ্রোযযাদ্ধার দল। উপরের ডালপালার কৃত্রিম আবরণ খুঁটিয়ে দেখল তাদের সর্দার, তারপর খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। সর্দারের ইঙ্গিতে এবার যোদ্ধারা স্থানত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মধ্যে…

কিন্তু তারা জানত না, এতক্ষণ তাদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিল অর্ধ-উলঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গ কিশোর। গাছের উপর থেকে নিগ্রো যোদ্ধাদের গর্ত খুঁড়তে দেখেছিল কিশোর টারজান। শিকারের কথা ভুলে গিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিগ্রোদের লক্ষ্য করতে লাগল সে।

অর্থহীনভাবে কোনো কাজ কেউ করে না, কিন্তু হঠাৎ গর্ত খুঁড়ে চলে যাওয়ার কারণটাও টারজান বুঝতে পারল না…।

কালা নামে যে মেয়ে বনমানুষটি শিশু টারজানকে অরক্ষিত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল, তাকেই ন্যুমা বলে জানত টারজান। মায়ের স্নেহ আর মমতা দিয়েই ওই বনমানষি তাকে পালন করেছিল। টারজান যখন শৈশব উত্তীর্ণ হয়ে কৈশোরে পদার্পণ করল, তখনই একদিন ওই বনমানুষির বক্ষভেদ করল এক নিগ্রোযযাদ্ধার নিক্ষিপ্ত তীর! হন্তারকের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিল টারজান। তারপর থেকেই সমগ্র নিগ্রোজাতি সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করত সে। পরবর্তীকালে অবশ্য বহু নিগ্রোর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল; একজনের অপরাধে সমগ্র জাতিকে যে দায়ী করা উচিত নয়, সেকথাও পরিণত বয়সে বুঝেছিল সে।

কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেদিনের কিশোর টারজানের মস্তিষ্কে পরিণত মানুষের বিচারবুদ্ধি উদয় হয়নি, তাই অন্যান্য পশুর মতো সেও প্রতিবেশী অর্থাৎ নিগ্রোদের শত্রু বলেই মনে করত। তবে টারজানের মধ্যে ছিল মানুষের সহজাত বুদ্ধি, তাই কালো মানুষদের রীতিনীতি সে পর্যবেক্ষণ করত গভীর মনোযোগের সঙ্গে। আজও একটা মস্ত গাছের উপর থেকে নিগ্রোদের কার্যকলাপ দেখে তার মনে কৌতূহলের উদ্রেক হল।

নিগ্রোদের চলে যাওয়ার পর ব্যাপারটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য সে গাছ থেকে নীচে নেমে এল এবং ডালপালার আবরণ সরিয়ে গর্তটাকে খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করল। অনেকক্ষণ ধরে গর্তটা নানাভাবে দেখেও টারজান ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। অতক্ষণ ধরে গর্ত খুঁড়ে, তার তলায় কাঠের ধারাল গুঁড়িগুলোকে লতাপাতা আর ডালপালা দিয়ে চাপা দেওয়ার অর্থ তার বোধগম্য হল না। অনেকক্ষণ ধরে মাথা ঘামিয়েও টারজান যখন গর্ত রহস্যের সমাধান করতে পারল না, তখন ব্যাপারটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে আর এক গাছে লতার দোলনায় দুলে দুলে শূন্যপথে ছুটল তার দলের বনমানুষদের সন্ধানে..

গাছের মাথায় প্রায় মাইল খানেক পথ পার হয়ে যাওয়ার পর টারজানের চোখ পড়ল নীচের দিকে… সবুজ অরণ্যের মধ্যে ভেসে উঠেছে ধূসর কালো প্রকাণ্ড শরীর! …গজরাজ ট্যান্টর।

মট করে একটা ছোটো গাছের ডাল ভেঙে গেল টারজানের হাতের চাপে…সঙ্গেসঙ্গে ট্যান্টরের মস্ত দুই কান নড়েচড়ে খাড়া হয়ে উঠল, শুড়টা উপর দিকে উঠে গেল শত্রুর গায়ের গন্ধ নেওয়ার জন্য।

টারজান হেসে উঠে একলাফে নেমে পড়ল বন্ধুর মাথার উপর, ট্যান্টর! বারা নামে হরিণটার যে-সাহস আছে, তোমার তাও নেই! তুমি হরিণের চাইতেও ভীরু। অথচ জঙ্গলের মধ্যে তোমার চাইতে বড়ো কেউ নেই, তোমার গায়ের জোর সাংঘাতিক, বড়ো বড়ো গাছ। তুমি ভেঙে ফেলতে পারো চোখের নিমেষে…অথচ একটা ছোট্ট ডাল ভাঙার আওয়াজ পেলে তুমি ভয়ে কাঁপতে থাক! ছি! ছি!

গজরাজ ট্যান্টর টারজানের ধিক্কার শুনে ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে হল না। বন্ধুকে পেয়ে সে বেজায় খুশি। জঙ্গলের মধ্যে টারজানের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল ট্যান্টর। টারজান জানত তার অসীম শক্তিশালী বন্ধুটিকে সে ইচ্ছেমতো চালনা করতে পারে। বহুদূর থেকেও টারজানের আহ্বান শুনলে তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে ট্যান্টর, ছোট্ট বন্ধুটির আদেশ অনুসারে তাকে পিঠে নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় সে…।

অরণ্যবাসী পশুদের কাছে সময়ের মূল্য নেই। ক্ষুধার্ত উদরকে শান্ত করার জন্য তারা সর্বদাই খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে এবং ওই কাজটিকেই তাদের জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ বলে মনে করে। কিশোর টারজান তখন পর্যন্ত তার চতুষ্পদ প্রতিবেশীদের চাইতে উন্নত স্তরে পৌঁছাতে পারেনি, তাই পেটে টান পড়তেই সে ট্যান্টরের পিঠ থেকে নেমে পড়ল, তারপর খাদ্যের সন্ধানে প্রবেশ করল দূর অরণ্যে…।

আজ শিকার জোটেনি, ফলাহারেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে… একটার পর একটা ফল মুখে ফেলছিল টারজান। টারজানের মুখ চলছিল, কিন্তু মস্তিষ্ক সক্রিয়… সেই লুকানো গর্তটার কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না… হঠাৎ তার মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল… তার কল্পনায় ভেসে উঠেছে বনপথের উপর সেই লুকানো গর্ত আর ওই পথের উপর চলমান পর্বতের মতো একটি বিশাল জীব…ট্যান্টর।

টারজানের সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শিহরণ, এইবার সে লুকানো গর্তটার অর্থ খুঁজে পেয়েছে! নিগ্রোযযাদ্ধারা অনর্থক পরিশ্রম করেনি, তার বন্ধু ট্যান্টরের জন্যই বর্শা সাজিয়ে তৈরি হয়েছে ওই মৃত্যুফাঁদ!

জ্যা-মুক্ত তীরের মত টারজান ছুটল গর্তটার উদ্দেশ্যে, যেমন করেই হোক বন্ধু ট্যান্টরকে বাঁচাতে হবে…

হঠাৎ জঙ্গলের পথে টারজানের সামনে এসে দাঁড়াল বুটো নামক গণ্ডার। এই বোকা জন্তুটাকে টারজান পছন্দ করত না, কিন্তু এখন তার লড়াই করার সময় নেই… বুটোকে অগ্রাহ্য করে সে সোজা এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

ঝড়ের বেগে তেড়ে এল বুটো, তার নাকের উপর বসানো দু-দুটো ঘঙ্গ একবার নীচু হয়েই সবেগে উপরে উঠল টারজানের দেহকে বিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু বুটোর ভয়াবহ উদ্দেশ্য সফল হল না, তার তীক্ষ্ণ খঙ্গ শূন্যে আঘাত করে খুঁজে পেল কেবল শূন্যতাকেই! এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে খঙ্গ দুটিকে এড়িয়ে গেছে টারজান এবং এসে পড়েছে বুটোর পিঠের উপর। আবার এক লাফ… টারজান এসে পড়ল বুটোর পিছনের জমিতে! বুটো একবারও পিছন দিকে তাকাল না, মাটি কাঁপিয়ে ছুটল সামনের দিকে। গণ্ডারের মস্তিষ্ট নিতান্তই নিরেট, পিছন ফিরে শত্রুর খোঁজ করার বুদ্ধি তার নেই…

ট্যান্টর ছুটছে আর ছুটছে! দারুণ আতঙ্কে সে দিশেহারা! তার পিছনে তাড়া করে ছুটে আসছে নিগ্রোযযাদ্ধার দল। তাদের সমবেত চিৎকার পিছন থেকে কানে আসছে আর ভয়ে গতিবেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে ট্যান্টর। অবশেষে সে এসে পড়ল লুকানো গর্তটার সামনে। আর কয়েক পা এগিয়ে গেলেই লুকানো ফঁদ তার বিশাল দেহকে গ্রাস করবে… পিছন থেকে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল যোদ্ধার দল।

হঠাৎ ট্যান্টরের সামনে মাত্র কয়েকহাত দুরে শূন্য থেকে ছিটকে নেমে এল এক অর্ধ-উলঙ্গ শ্বেতাঙ্গ কিশোর… টারজান!

ছুটতে ছুটতে বিস্তীর্ণ প্রান্তর পার হয়ে এবং গাছের মাথায় মাথায় লতার দোলনা ধরে ঝাঁপ খেতে খেতে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ঠিক সময়ে অকুস্থলে এসে পৌঁছেছে টারজান… সামনের লুকানো গর্তটার একটু দূরে অবস্থিত প্রকাণ্ড গাছটার উপর থেকে নেমে এসেছে সে, তারপর হাত বাড়িয়ে ট্যান্টরকে থামতে আদেশ করছে!

ফিরে দাঁড়াল টারজান, এক লাথি মেরে গর্তের উপর থেকে কয়েকটা ডাল পালা সরিয়ে দিল সে। সঙ্গেসঙ্গে ট্যান্টরের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল বর্শা-সাজানো মৃত্যুফাঁদ! টারজান হাঁকল, ঘুরে দাঁড়াও ট্যান্টর! লড়াই কর!

টারজান জানে তার বন্ধু যদি রুখে দাঁড়ায় তাহলে ওই কটা কালো মানুষ তার সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু বন্য পশু, বিশেষ করে হাতি, যখন ভয় পায় তখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, নিজের শক্তির উপর আস্থা আর থাকে না… তাই ভয়ার্ত ট্যান্টর শত্রুকে। আক্রমণ করল না, তীব্র বৃংহন-ধ্বনিতে চারদিক কাঁপিয়ে ডানদিকের ঘন জঙ্গলের উপর আঁপিয়ে পড়ল! বড়ো বড়ো গাছগুলো গজরাজের দেহের সংঘাতে ভেঙে গেল দেশলাই কাঠির মতো, ঘন ঝোপজঙ্গল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল প্রচণ্ড পদাঘাতে.. কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিবিড় অরণ্যের দুর্ভেদ্য বেষ্টনী ভেদ করে পলায়ন করল ট্যান্টর!

হঠাৎ টারজানের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল! তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে সে সরে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে… পায়ের তলার মাটি সরে গেল, টারজান ছিটকে পড়ল গর্তের মধ্যে! সুখের বিষয়, ধারালো ফলাগুলোর ফাঁক দিয়ে তার শরীরটা গলে গিয়েছিল কোনো একটা ফলার উপর পড়লে তার মৃত্যু ছিল অনিবার্য। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও অক্ষত দেহে সে নিষ্কৃতি পেল না… একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে তার মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল, সঙ্গেসঙ্গে চেতনাকে আচ্ছন্ন করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…

জ্ঞান হতেই টারজান দেখল তার দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্শাধারী নিগ্রো যোদ্ধার দল। নিগ্রোরা এত সহজে টারজানকে হাতে পেয়ে খুব খুশি। গর্তের ভিতর থেকে তারাই টারজানকে উদ্ধার করেছে, অবশ্য উদ্ধারকার্যের আগে শত্রুর হাত দুটো বেঁধে ফেলতে তারা ভুলে যায়নি।

শ্বেতাঙ্গ দৈত্যের জ্ঞান ফিরে আসতেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল নিগ্রোরা। নরকণ্ঠের সেই মিলিত কলরব পৌঁছে গেল দূর বনে অবস্থিত ট্যন্টরের কর্ণকুহরে, তৎক্ষণাৎ তীব্র বৃংহণ শব্দে ক্রোধ জানাল গজরাজ।

টারজান মুখ তুলল, বন্ধুর কণ্ঠস্বর সে শুনতে পেয়েছে। পরক্ষণেই আকাশের দিকে মুখ তুলল টারজান, তার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল এক অমানুষিক ধ্বনি!

ভয়ে শিউরে উঠল নিগ্রো যোদ্ধার দল- কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ওই কালো মানুষগুলো টারজানকে স্বাভাবিক মানুষ বলে ভবেতে শেখেনি, ওই বিকট জান্তব চিৎকার তাদের আতঙ্কে আড়ষ্ট করে দিল…

নিবে গেল দিনের আলো। এল সন্ধ্যা। তারপর রাত্রি। একটা কুঁড়ে ঘরের ভিতর টারজানকে বেঁধে রাখা হয়েছে কাঠের থামের সঙ্গে। ঘরের ভিতর কেউ না থাকলেও কুটিরের বাইরে রয়েছে একাধিক সশস্ত্র প্রহরী। টারজানকে খাদ্য বা তৃষ্ণার জল দিতে কেউ এল না। ক্ষুধাতৃষ্ণার যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করল টারজান, কিন্তু বন্ধন দশা মেনে নিয়ে নিশ্চেষ্ট রইল না… অনবরত হাত দুটি নিয়ে টানাটানি করতে করতে মনে হল দড়ির বাঁধন কিছুটা আলগা হয়ে এসেছে…

মধ্যরাত্রে যোদ্ধার দল এল। কাষ্ঠস্তম্ভের সঙ্গে বাঁধা দড়িটার আলিঙ্গন থেকে মুক্তি দিল টারজানকে, কিন্তু হাতের বাঁধন খুলল না। ওই রকম হাত-বাঁধা অবস্থায়ই তারা টারজানকে নিয়ে এল গ্রামের মাঝখানে ফাঁকা জায়গার উপর একটা মস্ত কাঠের খুঁটির সামনে… সেখানে জ্বলছে বিশাল অগ্নিকুণ্ড।

বহুদিন ধরে কালো মানুষদের চালচলন আর রীতিনীতি লক্ষ্য করেছে টারজান। তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। বন্দিদের ওই কাঠের খুঁটিতে বেঁধে কালো মানুষরা তাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়, তারপর একসময় তাদের হত্যা করে। টারজানকেও এখন তারা নির্যাতন করতে চায়, তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতে চায় তাকে…।

টারজানের বাহুর পেশিগুলো ফুলে উঠল, বাঁধনের দড়ি সেই প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে পারল না। মট করে বাঁধন ছেঁড়ার শব্দ, সঙ্গেসঙ্গে টারজানের মুষ্ঠিবদ্ধ দক্ষিণ হস্তের আঘাতে ধরাশয্যা গ্রহণ করল সামনের বর্শাধারী যোদ্ধা!

মুহূর্তের জন্য হতভম্ভ হয়ে গেল যোদ্ধার দল, তারপরই তারা সক্রিয় হয়ে উঠল। টারজান লড়তে লাগল বন্যপশুর মতো তার হাত চলছে, পা চলছে, আর ধারালো দাঁতগুলো সুযোগ পেলেই বসে যাচ্ছে নিকটস্থ শত্রুর দেহে! এখন আর সে নীরব নয়, তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ গর্জন- পৃথিবীর কোনো মানুষের কণ্ঠ থেকে সেই জান্তব ধ্বনি বেরিয়ে আসতে পারে না!

যোদ্ধাদের সর্দার হাতের বর্শা বাগিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, সুযোগ পেলেই সে অস্ত্রটাকে বসিয়ে দেবে টারজানের দেহে। কিন্তু সুযোগ পাওয়া কঠিন– যযাদ্ধাদের মাঝখানে টারজানের দেহ তখন প্রায় অদৃশহঠাৎ দুই একটি কালো মানুষ আর্তনাদ করে ছিটকে পড়েছে, মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হচ্ছে টারজানের শরীর এবং তারপরই আবার চাপা পড়ে যাচ্ছে নতুন শত্রুর ভিড়ের মধ্যে…

গ্রামের চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল মোটা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি মস্ত বেড়া, তিন মানুষ উঁচু সেই বেড়াটার একদিক হঠাৎ ভেঙে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে! পরক্ষণেই অগ্নিকুণ্ডের আবছা.. আঁধারিতে গ্রামের মাঝখানে আত্মপ্রকাশ করল এক অতিকায় দানব ট্যান্টর!

ধেয়ে এল ক্ষিপ্ত গজরাজ, তার পায়ের তলায় প্রাণ দিল একাধিক যোদ্ধা, শুড়ের আঘাতে ছিটকে পড়ল কয়েকজন… চিৎকার! আর্তনাদ! ধুন্ধুমার!

কোনোদিকে দৃকপাত করল না ট্যান্টর, শুড় বাড়িয়ে তুলে নিল বন্ধুকে…

আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। সর্দারের হাঁকডাকে তাদের সাহস ও শৃঙ্খলাবোধ ফিরে এল। হাতিমারা বর্শা নিয়ে তারা ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করল ট্যান্টরকে।

তাদের চেষ্টা সফল হল না- হঠাৎ টারজানকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে ট্যান্টর পিছন ফিরল, তারপর ভাঙা বেড়াটার ফাঁক দিয়ে একদৌড়ে অদৃশ্য হল অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে…

যোদ্ধারা থমকে দাঁড়াল। তারা ভীরু নয়, কিন্তু অন্ধকার রাত্রে পলাতক হস্তীর অনুসরণ করার সাহস তাদের নেই। বিশেষ করে ওই হাতিটার পিঠে এখন অবস্থান করছে এক অমানুষিক মানুষ, যাকে হাতে পেয়েও হত্যা করা যায় না!

.

০৩. ঈশ্বরের সন্ধানে টারজান

কিশোর টারজানের একটি কাহিনি এখানে পরিবেশন করছি। বয়স তখন আঠারো কি উনিশ, সভ্যজগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য তখনো তার হয়নি। অরণ্যের পথে পথে, গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় কিশোর টারজান কখনো শিকারের খোঁজে, কখনো বা নিছক ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে

বনমানুষদের দলেই বড়ো হয়েছে টারজান। নিজেকে একটি বনমানুষ বলেই জানে সে। নদীর জলে নিজের ছায়া দেখে তার ভারি দুঃখ বনমানুষদের মতো বড়ো বড়ো দাঁত তার নেই, গায়ের চামড়াও বিশ্রী সাদা। দাঁতের অভাব সে পূরণ করেছে কোমরে একটা মস্ত ছুরি ঝুলিয়ে, কিন্তু সারা গায়ে অমন সুন্দর ঝাকড়া ঝাঁকড়া কালো-বাদামি লোম সে পাবে কোথায়? তবু দলের বনমানুষরা তাকেই দলপতি বলে মেনে নিয়েছে। মেনে না নিয়ে উপায় কি? জঙ্গলের আইন হচ্ছে হয় মারো, নয় মরো। শক্তিই এখানে একমাত্র যুক্তি। জোয়ান বনমানুষের দৈহিক শক্তি টারজানের চাইতে অনেক বেশি, কিন্তু দ্বন্দ্বযুদ্ধে টারজানকে পরাজিত করার ক্ষমতা কোনো বনমানুষেরই নেই। শক্তির অভাব টারজান পূরণ করেছে বুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতা দিয়ে। বনমানুষদের মতো দাঁতের জোর না থাকায় সে ভালোভাবে কামড় বসাতে পারে না বটে, কিন্তু তার ছুরিটা শত্রুর হৃৎপিণ্ড ভেদ করতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। কয়েকটা উদ্ধত বনমানুষ টারজানের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল; তাদের মধ্যে কেউ-বা ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার কেউ কেউ বুদ্ধিমানের মতো পরাজয় স্বীকার করে বেঁচে গেছে বর্তমানে স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে টারজানকেই দলপতি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের শত্রুকে নিজের শত্রু বলে মনে করে কিশোর টারজান।

বনমানুষদের সবেচেয়ে বড়ো শত্রু হচ্ছে শিটা অর্থাৎ প্যান্থার। অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চা নিয়ে যায় সে, বনমানুষরা তাকে ধরতে পারে না। সেদিনও ঘাসঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বনমানুষদের অনুসরণ করছিল শিটা, হঠাৎ টারজানের চোখে সে ধরা পড়ে গেল। একটা হাঁক দিয়ে বনমানুষদের সাবধান করে টারজান ছুটে গেল– শিটার দিকে। ধরা পড়ে গেছে দেখে শিটাও রুখে দাঁড়াল, শত্রুর মুখ লক্ষ্য করে থাবা চালাল সে।

সনখ থাবার সেই প্রচণ্ড আঘাত যথাস্থানে পৌঁছালে টারজানের মুখ এক মুহূর্তেই রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হত কিন্তু বিদ্যুৎবেগে নীচু হয়ে মারাত্মক আঘাতটা এড়িয়ে গেল টারজান এবং একলাফে শত্রুর পিঠে উঠে তার গলা আঁকড়ে ধরল! পরক্ষণেই অরণ্যের স্বব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল শ্বাপদ ও দ্বিপদের রণহুঙ্কার!

দূরে ঘাসঝোপের মধ্যে যুদ্ধের কোলাহলে পশুরাজ মার ঘুম ভেঙে গেল, অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে তারপর প্রবেশ করল নিবিড় অরণ্যের অন্তঃপুরে

ততক্ষণে বনমানুষরা এসে জড়ো হয়েছে রণস্থলের কাছে, তবে যোদ্ধাদের কাছাকাছি আসতে সাহস করছে না। টারজানের হাতের ছুরি উঠছে আর পড়ছে, শিটা তার তীক্ষ্ণ নখদন্ত বিস্তার করে বারংবার চেষ্টা করছে শত্রুকে আঘাত করতে কিন্তু একবারও টারজানকে নাগালের মধ্যে পাচ্ছে না– 

ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এল শিটা, একসময়ে রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। রক্তমাখা ছুরি হাতে মৃত শত্রুর শরীরের উপর পা রেখে উঠে দাঁড়াল টারজান, পরমুহূর্তেই তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল এক অমানুষিক জান্তব ধ্বনি- বনমানুষের রণহুঙ্কার!

জঙ্গলের মধ্যে একটা কাঠের ঘর ছিল টারজানের অতিশয় প্রিয়। অনেকসময় সে ওই ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করত। টারজান জানত না যে, ওই ঘরেই একসময়ে তার বাবা-মা বাস করেছেন এবং তাদের মৃত্যুও হয়েছে পূর্বোক্ত কাঠের ঘরে। ইংল্যান্ডের অভিজাত বংশের মানুষ হয়েও আফ্রিকার জঙ্গলে একটা কাঠের ঘরে কেন তাঁরা বসবাস করতেন, এই প্রশ্ন পাঠকের মনে আসতে পারে। বর্তমান কাহিনিতে স্থানাভাবের জন্যে সেই গল্প বলা সম্ভব নয়। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, এক দুর্ঘটনার ফলেই আফ্রিকার শ্বাপদসংকুল অরণ্যে একটা তুচ্ছ কাঠের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন লর্ড গ্রেস্টোক এবং তার স্ত্রী।

ওই কাঠের ঘরের মধ্যে শিশু টারজানকে অরক্ষিত অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে একটি স্ত্রী-বনমানুষের মনে স্নেহের উদ্রেক হয় এবং সে-ই তাকে নিয়ে যায় বনমানুষদের আস্তানায়। তারপর বনমানুষদের মধ্যেই সে বড়ো হয়ে উঠে। অনেক সময় দল ছেড়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াত টারজান। ওইভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে কাঠের ঘরটা সে দেখতে পায়। ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে বাবার ছুরিটা তার চোখে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত্রটাকে ব্যবহারের কৌশল সে আয়ত্ত করে, আর তখন থেকেই ছুরিটা তার নিত্যসঙ্গী।

ছুরিটা ছাড়া বাবার বইগুলিও তার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল। ছবির তলায় ছোটো ছোটো পোকাগুলোরঅর্থ প্রথমে সে বুঝতে পারেনি, কিন্তু দিনের পর দিন অসীম ধৈর্য ধরে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করার পর মুদ্রিত অক্ষরগুলোর অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য অক্ষরের সমাবেশে উৎপন্ন শব্দের উচ্চারণ সে তখনও জানতে পারেনি।

এই ব্যাপারে একটি সচিত্র অভিধান তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। একটি উদাহরণ দিচ্ছি

ছবির তলায় LION লেখা দেখে টারজান জন্তুটিকে চিনতে পারল। এই রকম আরও অনেক জন্তু-জানোয়ার সে চিনল, তাদের ইংরেজি নামকরণও সে বুঝল— যদিও উচ্চারণগুলো তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা রয়ে গেল। কয়েকটা কথা ছিল তার কাছে দুর্বোধ্য। ওই কথাগুলো সম্পর্কে তার কৌতূহলও ছিল অত্যন্ত তীব্র। সবচেয়ে দুর্বোধ্য কথাটি ছিল GOD বা ঈশ্বর। কাগজের উপর পোকা অর্থাৎ ছাপা অক্ষরগুলো বিশ্লেষণ করে সে জানল উক্ত ঈশ্বর নাকি শক্তিমান, সমস্ত পৃথিবীটাকে নাকি তিনিই সৃষ্টি করেছেন।

টারজান বুঝল ঈশ্বর নামক ব্যক্তিটি মস্ত যোদ্ধা আর সর্দারগোছের কেউ হবে। কিন্তু লোকটাকে দেখতে কেমন সে বুঝতে পারছিল না। কারণ, তার বাবার বইতে ঈশ্বরের কোনো ছবি ছিল না। যাই হোক, জঙ্গলের মধ্যে তার চাইতে শক্তিমান বলে কাউকে মানতে রাজি ছিল না টারজান। অতএব টারজান ঠিক করল যেভাবেই হোক ঈশ্বরের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে।

প্রথমেই টারজান পাকড়াও করল নামগো নামে বুড়ো বনমানুষটাকে। টারজানের প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল গোরো অর্থাৎ চাঁদই হচ্ছে ঈশ্বর আর বিদ্যুৎ বজ্রপাত হয় ওই চাঁদেরই নির্দেশে।

কথাটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করল না টারজান। তবে ব্যাপারটা নিয়ে সে খোঁজখবর করবে বলে ঠিক করল। তাই গভীর রাত্রে জঙ্গলের সবচেয়ে উঁচু গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে চাঁদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল টারজান।

আকাশের বুকে তখন আত্মপ্রকাশ করেছে পূর্ণচন্দ্র একটি জ্বলন্ত গোলকের মতো সবচেয়ে উঁচু গাছের মগডালে উঠে টারজান সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সে চাঁদের একটুও কাছে আসতে পারেনি। চাঁদ আগেও যতটা দূরে ছিল, এখনও ঠিক ততখানি দুরেই রয়েছে। টারজান ভাবল চাঁদ তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তাকে কাছে আসতে দেখে দূরে পালিয়ে গেছে।

টারজান চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলল, এদিকে এস, গোরো! তুমিই কি সেই মস্ত রাজা, –যে রাজা ঝড় বিদ্যুৎ আর বজ্রকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়?

চাঁদ নীরব। টারজান আবার হাঁকল, দিনগুলো যখন অন্ধকার আর ঠান্ডা হয়ে যায়, তখন। তুমিই কি উপর থেকে জল ঢালতে থাকো পৃথিবীর বুকে?

তবুও চাঁদ নীরব। এতবড়ো স্পর্ধা! জঙ্গলের রাজা টারজানের প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না চাঁদ!

ক্ষেপে গেল টারজান। তার প্রকাণ্ড বুক ফুলে উঠল, মুখের ভিতর থেকে উঁকি দিল ঝকমকে দাঁতের সারি এবং কণ্ঠে জাগল বনমানুষের রণহুঙ্কার, গোরো! তুমি এমন কিছু শক্তিমান নও। তুমি ভীরু কাপুরুষ। সাহস থাকে যদি, তাহলে নীচে নেমে এসে আমার সঙ্গে লড়াই কর। আমি টারজান, জঙ্গলের রাজা আমি তোমায় হত্যা করব।

একটুকরো মেঘ এসে চাঁদকে ঢেকে দিল। টারজান বুঝল চাঁদ ভয় পেয়েছে, তাই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। ভারি খুশি হয়ে সে ফিরে এল বুড়ো বনমানুষ নামগোর কাছে। নামগো তখন নিদ্রাসুখ উপভোগ করছে পরম আরামে। কিন্তু টারজান হই চই করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল, চাঁদ একটা কাপুরুষ। সে কখনোই ঈশ্বর নয়। ঠিক করে বলো, কোথায় গেলে ঈশ্বরকে পাব? সে কেমন দেখতে?

নামগো বলল, আমি একটা বুড়ো বনমানুষ, কতটুকু জানি? তুমি বরং গোমাঙ্গানিদের কাছে খোঁজখবর নাও। তারা অনেকটা তোমার মতো, তোমার মতোই তাদের গায়ে লোম নেই। তারা অনেক বিষয় খোঁজখবর রাখে। তুমি তাদের কাছে যাও। তারা নিশ্চয়ই ঈশ্বরের ঠিকানা জানে।

 নামগোর কথাটা টারজানের মনে ধরল। বনমানুষদের ভাষায় গোমাঙ্গানি অর্থাৎ কালো মানুষদের সঙ্গে টারজানের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না, বরং শত্রুতার ভাবই ছিল। তবে তাদের উপর নজর রাখতে পারলে ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে কিনা জানা যেতে পারে। তাই সেই রাতেই নিকটবর্তী একটি নিগ্রোপল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হল টারজান

নিগ্রোদের গ্রামে তখন এক ওঝা তার ভুতুড়ে তুকতাক করছিল। তার সামনে জ্বলছিল অগ্নিকুণ্ড এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল দলে দলে গ্রামবাসী।

নিগ্রোজাতির মধ্যে এই ওঝাদের প্রতাপ সাংঘাতিক। বর্তমানে ওইরকম এক ওঝা তার ভূতুড়ে যাদু দেখাচ্ছিল গ্রামবাসী নিগ্রোদের। কেপ বাফেলো নামক বুনো মোষের শিং মাথায় লাগিয়ে এবং তার চামড়া দিয়ে পিঠ ঢেকে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে নাচছিল ওঝা। মস্ত এক গাছের উপর থেকে সকলের অলক্ষে তার উপর নজর রাখছিল টারজান।

খুব মন দিয়ে কিছুক্ষণ ওঝার কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করার পর টারজান স্থির করল এই লোকটাই ঈশ্বর, সুতরাং এখনই এর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করা দরকার

তাবৎ গ্রামবাসী আর ওঝাকে চমকে দিয়ে অন্ধকার অরণ্যের ভিতর থেকে আচম্বিতে সকলের সামনে আত্মপ্রকাশ করল এক অর্ধউলঙ্গ শ্বেতাঙ্গ কিশোর টারজান!

অন্য সময় হলে নিগ্রোরা নিশ্চয়ই টারজানকে আক্রমণ করত, কিন্তু রাতের অন্ধকারে ওঝার কার্যকলাপ তাদের আতঙ্কে আড়ষ্ট করে দিয়েছিল। অতর্কিতে টারজানের আবির্ভাব তাদের স্নায়ুর উপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করল, সকলেই তীরবেগে ছুটে শ্বেতদৈত্যের সান্নিধ্যে ত্যাগ করে অদৃশ্য হল অকুস্থল থেকে।

ওঝা স্থান ত্যাগ করল না। অন্য সকলের মতো ওঝারও টারজান সম্পর্কে ভীতি ছিল। নিগ্রোরা টারজানকে শুধু একজন শক্তিশালী মানুষ ভাবত না, তাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দানব বলেই মনে করত। ওঝাও নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু সে বুঝেছিল পালিয়ে গেলে সকলের চোখে সে ছোটো হয়ে যাবে গ্রামবাসীরা তার সম্বন্ধে যে শ্রদ্ধা ও আতঙ্ক পোষণ করে সেই ভাবটা আর থাকবে না। তাই ভয় পেলেও সে সাহসে ভর করে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে লাগল দারুণ আতঙ্কে!

টারজান ওঝাকে ডেকে বলল, তুমি বুঝি ঈশ্বর?

ওঝা জানত গ্রামের লোক আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করছে, তাই ভীষণ ভয় পেলেও সে মুখে সাহস দেখিয়ে গর্জন করে উঠল, ওইখানে দাঁড়াও। খবর্দার, আমার সামনে আসবে না।

হাতের মড়ার হাড়টা তুলে ধরে সে বলল, আমার ন্যুমা এক যাদুকরী আর বাবা হচ্ছে একটি সাপ! আমার একমাত্র খাদ্য সিংহের কান? আমি ভীষণ শক্তিমান। আমার কখনো মৃত্যু হয় না।

ওঝার বক্তৃতায় কর্ণপাত না করে টারজান তার দিকে এগিয়ে এল।

তাড়াতাড়ি মাটির উপর মড়ার হাড় দিয়ে রেখা টেনে দিয়ে ওঝা বলল, এই রেখার গণ্ডি পেরিয়ে এলেই তুমি মারা পড়বে।

নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আর একটি বক্তৃতা দেওয়ার উপক্রম করছিল ওঝা, কিন্তু মন্ত্রপড়া রেখার গণ্ডি পার হয়ে টারজান যখন তার দিকে এগিয়ে এল, তখন আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস তার হল না

–যাক মান, থাক প্রাণ এই নীতি অবলম্বন করে ওঝা পিছন ফিরে তীরবেগে ছুটল।

আরে, আরে, পালাও কেন? টারজান হাঁক দিয়ে বলল, ওহে ঈশ্বর! আমি তোমার ক্ষতি করব না।

কে কার কথা শোনে! সাদা দৈত্যটা ভুলিয়ে-ভালিয় তাকে ধরতে পারলেই যে খুন করে ফেলবে, এ বিষয়ে ওঝার সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র–সুতরাং সে আরও জোরে পা চালিয়ে দিল।

দাঁড়াও বলছি, টারজান হাঁকল, আরে! এটা কেমন ঈশ্বর! তবুও থামে না যে! তবে

দুই লাফ মেরে ওঝার কাছে গিয়ে পড়ল টারজান, তারপর মোষের শিং আর চামড়ার আবরণ ওঝার দেহ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরল, তুমিই তাহলে ঈশ্বর? জেনে রাখ, তোমার চাইতে টারজানের ক্ষমতা অনেক বেশি। গোমাঙ্গানি (কালো মানুষ) আর মাঙ্গানির (বনমানুষ) চাইতেও বেশি ক্ষমতা রাখে টারজান। নিজের হাতে ন্যুমা (সিংহ) আর শিটাকে (প্যান্থার) হত্যা করেছে টারজান। টারজানের চাইতে শক্তিমান কেউ নেই। টারজান ঈশ্বরের চাইতেও শক্তিমান।

নিকটবর্তী কুটিরের ভিতর থেকে সর্দার মবংগো টারজানকে লক্ষ্য করছিল। সে অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে পড়েছিল। উদবেগের কারণ ছিল– ওঝার সাহায্যে কুসংস্কারগ্রস্ত গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়ে মবংগো তার আধিপত্য বজায় রেখেছিল। গ্রামের মানুষ ওঝাকে দারুণ ভয় করত। তাদের ধারণা ছিল সর্দারের বিরুদ্ধাচরণ করলে ওঝা তাদের উপর প্রেতাত্মা লেলিয়ে দেবে! সেই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা মনে করেই তারা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকত এবং সর্দার মবংগোর জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করত নীরবে। আজ মবংগো বুঝতে পারছে টারজান যদি অক্ষত শরীরে ফিরে যায়, তাহলে ওঝার অলৌকিক শক্তির উপর গ্রামবাসীসদের আস্থা আর থাকবে না। ফলে, সর্দার মবংগোর সর্দারিও যে একদিন ফুরিয়ে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি। এতএব, একটা ধারাল বর্শা হাতে নিয়ে কুটিরের বাইরে এল সর্দার মবংগো এবং পিছন থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল টারজানেরর দিকে

টারজান তখন গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে ধীর পদক্ষেপে। তার আচরণে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই।

বন্যপশুর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামটাকে ঘিরে শক্ত কাঠের বেষ্টনী বা বেড়া তৈরি করেছে গ্রামের মানুষ সেই বেড়াটার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে টারজান।

একটু পরেই বেড়া ডিঙিয়ে সে অন্তর্ধান করবে অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে

বনের মানুষ টারজানের ইন্দ্রিয়গুলো ভোতা হয়ে যায়নি সভ্যতার স্পর্শে, হঠাৎ বনের বাতাস পিছন থেকে এক ভয়াবহ বার্তা বহন করে আনল টারজানের নাকে

বিপদের গন্ধ! অর্থাৎ, মানুষের গন্ধ!

বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে মাথা নীচু করল, আর পরক্ষণেই তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল মবংগোর বর্শা!

ক্ষিপ্ত সিংহের মতো ছুটে গেল টারজান তার আক্রমণকারীর দিকে। মবংগো ছুটে পালাতে চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা মুহূর্তের মধ্যে তাকে ধরে ফেলল টারজান। তারপর জড়াজড়ি করে দু-জনেই ছিটকে পড়ল মাটির উপর।

মবংগোর অনুগত যোদ্ধার দল কুটিরের ভিতর থেকে দেখল সাদা দৈত্যটা তাদের সর্দারকে মাটিতে পেড়ে ফেলেছে, কিন্তু তারা কেউ টারজানের কাছে এগিয়ে যেতে সাহস করল না।

একহাতে সর্দারকে চেপে ধরে অন্যহাতে কোমর থেকে ছোরা খুলে নিল টারজান। দারুণ আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল মবংগো, করুণ কণ্ঠে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল শত্রুর কাছে।

কালো মানুষটার ভাষা বুঝতে না পারলেও তার মনোভাব বুঝতে পারল টারজান। হাতের ছোরা শূন্যে উঠেও থমকে গেল, আশ্চর্য এক অনুভূতি সাড়া দিল টারজানের মনে, ভূপতিত শত্রুকে ছেড়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল, ছোরা আবার প্রবেশ করল কোমরের খাপে–

না এই আতঙ্কে কম্পমান মানুষটার বুকে ছুরি বসাতে পারবে না টারজান

 বনের পথ ধরে আস্তানায় ফিরতে ফিরতে চিন্তা করছিল টারজান। আজকের ব্যাপারটা তার বুদ্ধির বাইরে। আহত সিংহ বা প্যান্থারের দেহে ছুরি বসাতে তার হাত কোনোদিন কাঁপেনি, শত্রুকে দয়া করতে শেখেনি সে তবে আজ এ কী হল? এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে বাধা দিল, তার পাশবিক হিংস্র বৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে জেগে উঠল এক অদ্ভুত অনুভূতি– করুণা!

এমন ঘটনা তার জীবনে কখনো ঘটেনি। চিন্তাকুল চিত্তে আস্তানায় ফিরে এল টারজান, তারপর চিন্তা করতে করতেই একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোর হল। চোখ মেলতেই টারজান দেখল একটি ফুল ভোরের বাতাসে ধীরে ধীরে তার পাপড়িগুলো মেলে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য টারজান আগেও দেখেছে বহুবার, কিন্তু আজ হঠাৎ সদ্য ফুটে-ওঠা ফুল তার মনোজগতে আলোড়ন তুলল, অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করল তার মনে–

ফুল ফোটে কেন? কে ফোঁটায়? ছোট্ট একটি কুঁড়ি ধীরে ধীরে ফুলের রূপ ধরে কার নির্দেশে… নিজেই বা কোথা থেকে এল?… নুমা নামে কেশরধারী জন্তুটি কোথা থেকে এসেছে? গোরো (চাঁদ) আকাশে উঠেছে কেন? কেন সে জঙ্গলে থাকে না? শুধু অন্ধকার রাতেই তার দেখা পাওয়া যায় কেন?… সূর্য শুধু দিনের আকাশেই দেখা দেয়। কিন্তু কেন?… রাতে সূর্য আর দিনে চাঁদের দেখা তো কখনোই পাওয়া যায় না। কোন অদৃশ্য শক্তি তাদের কঠিন নিয়মের বাঁধনে বেঁধে রেখেছে?- টারজানকে হরিণের মতো দেখতে নয়, হরিণকে প্যান্থারের মতো দেখতে নয় এবং বুটো নামে গন্ডারের সঙ্গে শিটা নামক প্যান্থারের সাদৃশ্য নেই কিছুমাত্র। কেন এই বৈচিত্র্য? এই তফাৎ সেই অদৃশ্য শক্তির কঠিন নিয়মের বাঁধনেই কি বাঁধা রয়েছে সকলে? তার নির্দেশ কি অগ্রাহ্য করা যায় না?

আচম্বিতে প্রভাতের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল এক তীব্র আর্তনাদ! আওয়াজ শুনেই টারজান কণ্ঠস্বরের মালিককে চিনতে পারল– গাঁজান নামক বনমানুষির বাচ্চা টীকা আর্তনাদ করছে দারুণ আতঙ্কে!

গাছের উপরে আরামের শয্যা থেকে জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে মাটির উপর নেমে এল টারজান। তারপর শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল বায়ুবেগে! চারদিক থেকে বনমানুষরা দলে দলে ছুটছে আর্তনাদ লক্ষ্য করে, কিন্তু তাদের আগেই অকুস্থলে পৌঁছে গেল টারজান। জঙ্গলের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটির দিকে তাকাতেই তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শীতল শিহরণ।

হ্যাঁ, টারজানও ভয় পেয়েছে। জঙ্গলের সব বাসিন্দাই ভয় পায় এই শত্রুকে। হিতা নামক সর্পরাজ অজগরের ভয়াল আলিঙ্গনের মধ্যে ছটফট করছে বনমানুষের বাচ্চা টীকা!

বনমানুষরা থমকে দাঁড়াল। কিন্তু টারজান আর ইতস্তত করল না। কোমরের ছোরা টেনে নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সর্পরাজের উপর। ছোরার আঘাতে একটুকু বিচলিত হল না সরীসৃপ, টীকাকে সে ছাড়ল না উপরন্তু টারজানের দেহটাকেও সে বেঁধে ফেলল তার শীতল আলিঙ্গনে

কোনোরকমে অজগরের হাঁ-করা মুখটাকে এড়িয়ে গেল টারজান। তার হাতের ছুরি বার বার রক্তপান করল অজগরের দেহ থেকে অবশেষে ছুরিকাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে রক্তাক্ত দেহে মৃত্যুবরণ করল অতিকায় সরীসৃপ। মৃত্যুর পরেও অজগরের মৃতদেহ একটার পর একটা কুণ্ডলী রচন করে ছটফট করছিল। সেই কুণ্ডলীর মধ্যে ধরা পড়লে দশ-বারোটা মানুষ বা বনমানুষের ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতে পারে কিছুক্ষণের মধ্যে।

বাচ্চাটাকে অজগরের নাগপাশ থেকে মুক্ত করল টারজান, তারপর নিজেও সরে এল সেই সাংঘাতিক মৃত্যুফাঁদ থেকে।

শ্রান্ত ক্লান্ত টারজান একটা জলাশয়ের ধারে গিয়ে আকণ্ঠ জলপান করল। দেহ তার ক্লান্ত, মনটা আজ ভারি খুশি হয়ে উঠেছে।

জলাশয়ের ধারে স্থির হয়ে বসল সে। মনের ভিতর তার অজস্র প্রশ্ন ভিড় জমিয়েছে। বনের পশু অকারণে নিজের জীবন বিপন্ন করে না, তবে কেন হিসতার মতো ভয়ংকর জীবের কবলে সে নিজেকে বিপন্ন করেছিল? টীকা তার কেউ নয়, তার জন্য অজগরের আলিঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো বোকামি সে কেন করল? কেন?

সে কি কোনো অদৃশ্য শক্তির নির্দেশ পালন করছে– পরাজিত সর্দারের বুকের উপর উঁচিয়ে ধরা ছোরাটা কী থমকে গিয়েছিল সেই অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে? তারই প্রভাব কি তাকে চালিত করেছে অজগরের আলিঙ্গনের মধ্যে? সেই শক্তির নামই কি ঈশ্বর? সাদা সাদা গাছের পাতার উপর কালো কালো পোকাগুলো (কাগজের উপর ছাপা অক্ষর) যাকে মহাশক্তিধর ঈশ্বর বলে বর্ণনা করেছে, সে-ই কি তাহলে এই সব কাণ্ড করিয়েছে তাকে দিয়ে। তাহলে তো স্বীকার করতেই হবে টারজানের চাইতে সে অনেক বেশি শক্তিমান।

অনেক চিন্তা করে, অনেক মাথা ঘামিয়ে অবশেষে টারজান স্থির করল যা-কিছু সুন্দর, যা-কিছু মহৎ, সবই ওই অদৃশ্য ঈশ্বরের সৃষ্টি। গাছপালা, চাঁদ, সুর্য, সে নিজে সব কিছুই সৃষ্টি করেছে ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বর কী? কে? তার চেহারা কেমন? ভেবে ভেবে কিছুতেই ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেল না টারজান।

আরও একটা প্রশ্নের সদুত্তর পেল না সে-যা-কিছু সুন্দর, যা-কিছু মহৎ, সবই যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাহলে সর্পরাজ হিস্তকে সৃষ্টি করেছে কে?

.

০৪. টিবো আর টারজান

টারজানের মনে ভারি দুঃখ–

জঙ্গলের তাবৎ জানোয়ার তাদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুখে রয়েছে; নিরীহ-বাব (হরিণ) অথবা হিংস্র শিটা (প্যান্থার) কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়– সকলেরই বাচ্চা আছে– টারজানের নেই! এটা কি কম দুঃখের কথা!

বর্তমানে টারজানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে পশুরাজ মা, তার বউ স্যার আর তিনটি বাচ্চা। বাচ্চাগুলো ঘুরে ঘুরে খেলা করছে, মাঝে মাঝে বাবা মায়ের গায়ের উপর লাফিয়ে পড়ে তাদের আদর উপভোগ করছে। একটা বাচ্চা হঠাৎ নামার কান কামড়ে ধরে বিষম টানাটানি লাগিয়ে দিল। বিরক্তি প্রকাশ না করে একটানে কান ছাড়িয়ে নিল দ্যুমা, তারপর প্রকাণ্ড দুই থাবার মধ্যে বাচ্চাটাকে চেপে ধরে তার সারা শরীর চাটতে লাগল পরম আদরে।

গাছের উপর থেকে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল টারজান তাকে আদর করার জন্য, তার আদর খাওয়ার জন্য কেউ এমনভাবে তার কাছে ছুটে আসবে না। অরণ্যের আতঙ্ক পশুরাজ নামা, তারও স্নেহের পাত্র আছে কিন্তু টারজানের কেউ নেই।

গাছ থেকে গাছে লতার দোলনায় দোল খেতে খেতে ঘুরতে লাগল টারজান। সে আজ ক্ষুধার্ত নয়, অস্থির মনকে শান্ত করার জন্যই ঘুরছিল বন থেকে বনান্তরে

নদীর কাছে আপনমনে খেলা করছিল নিগ্রো শিশু টিবো, তার একটু দুরে বসে সংগৃহীত ফুলগুলো ভালোভাবে গুছিয়ে নিচ্ছিল টিবোর ন্যুমা মোমাইয়া। গাছের উপর থেকে তাদের দেখল টারজান বাঃ এই নিগ্রো ছেলেটাই তো তার বাচ্চা হতে পারে। তারই মতো দেখতে এই শিশু, শুধু গায়ের রংটা কালো এই যা তফাৎ। ওটুকু তফাৎ ধর্তব্যই নয়–

অতএব দড়ির ফাসটা বাগিয়ে ধরল টারজান

 টিবোর আর্তনাদ শুনে চমকে উঠে মোমাইয়া দেখল তার ছেলে একটা দড়ির ফঁসে আবদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করছে আর সেই দড়িটা চেপে ধরে টানছে বিপুলবপু এক শ্বেতাঙ্গ দৈত্য! চিৎকার করে ছেলের দিকে ছুটে গেল মোমাইয়া, ছেলেকে উদ্ধার করার জন্য শ্বেতদৈত্যর সঙ্গে দাঁতে নখে লড়াই করতেও সে প্রস্তুত।

টারজান লড়াই করল না। একহাতে টিবোকে চেপে ধরে সে চটপট উঠে গেল মস্ত একটা গাছের উপর। তলা থেকে উদগ্রীব ভয়ার্ত চক্ষে মোমাইয়া দেখল শ্বেতদৈত্য তার ছেলে নিয়ে গাছ থেকে গাছে ঝাঁপ দিতে দিতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে

নিরাপদ দূরত্বে এসে থামল টারজান। একটা গাছের ডালে টিবোকে রেখে টারজান তাকে বোঝাতে শুরু করল, আমি টারজান। তুমি এখন টারজানের বাচ্চা। কেউ এখন তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমি তোমায় খাবার এনে দেব। তোমার কোনো ভয় নেই।

বনমানুষের ভাষায় কথা বলছিল টারজান। টিবো সেই ভাষা বুঝতে পারল না, তার মনে হল একটা হিংস্র জানোয়ার চাপা গলায় গর্জে গর্জে উঠছে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রইল সে!

বক্তব্য শেষ করে আবার টিবোকে তুলে নিল টারজান। আবার তার যাত্রা শুরু হল শূন্যপথে গাছ থেকে গাছের মাথায় লতার দোলনায় দুলতে দুলতে ছেলে নিয়ে নিজস্ব আস্তানার দিকে চলল টারজান

তিনদিন পরের কথা। টিবোর ন্যুমা মোমাইয়া এসে দাঁড়াল একটা গুহার সামনে। গুহার প্রবেশপথে রয়েছে একটা কাঠের দরজা। দরজা এখন ভিতর থেকে বন্ধ।

সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল মোমাইয়া, বাকওয়াই! বাকওয়াই! দরজা খোল!

উত্তরে ভেসে এল অমানুষিক হট্টহাস্য, ঈয়া-য়া-হা-হা-হা!

দরজা খুলে গেল, ভিতর থেকে উঁকি দিল একজোড়া হায়নার কুৎসিত মুখ। জন্তু দুটো আবার হেসে উঠল, ঈয়া-হা-হা-হা! এবার মানুষের গলায় সাড়া এল, কে ডাকে বাকওয়াইকে?

–আমি মোমাইয়া ডাকছি। আমি এসেছি সর্দার মবংগোর গ্রাম থেকে। তোমার জন্তু দুটোকে সরিয়ে নিয়ে বাইয়ে এসে কথা বল।

গুহার ভিতর থেকে ভেসে-আসা কণ্ঠস্বরের উত্তরে কথা কইলেও মোমাইয়ার হাতের উদ্যত বর্শা আর চোখের সতর্ক দৃষ্টি স্থির লক্ষ্যে নিবদ্ধ ছিল হায়না দুটোর দিকে। শ্বাপদসংকুল অরণ্যে বাস করে বনবালা মোমাইয়া, পুরুষের মতোই অস্ত্রধারণ করতে জানে সে। অনেক ভেবেছে সে, অনেক মাথা ঘামিয়েছে তিনদিন ধরে, তারপর দুঃসাহসে ভর করে উপস্থিত হয়েছে কুখ্যাত জাদুকর বাকওয়াই-এর আস্তানায়। গ্রামের মানুষ এই লোকটার ধারে-কাছে আসে না। শোনা যায় লোকটা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তার সঙ্গে বাস করে জীবন্তু প্রেতের মতো দুটো মস্ত হায়না।

মোমাইয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাইরে এল বাকওয়াই, হায়না দুটোকে সামলে প্রশ্ন করল, আমার কাছে মোমাইয়ার কী দরকার?

..জঙ্গলের সাদা দৈত্য আমার ছেলে টিবোকে ধরে নিয়ে গেছে। তিনদিন ধরে সন্ধান করেও আমি তাকে পাইনি। এখন আমি এসেছি তোমার কাছে। তোমার জাদু দিয়ে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও।

জাদুকর বাকওয়াই জানাল একটা মোটা তামার তার, পাঁচটা নধর ছাগল আর দুটো মাদুর পেলে সে জাদুবিদ্যার সাহায্যে টিবোকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবে।

মোমাইয়া জানাল দুটো ছাগল সে দিতে পারে, তার চেয়ে বেশি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

তারপর দরাদরি। বিস্তর বাগবিল্ডার পর একটা চুক্তি হল। মোমাইয়া বলল, তিনটে মোটা-সোটা ছাগল আর একটা মাদুর আমি দিতে পারি।

–মাদুরটা নতুন চাই।

তাই হবে।

–জিনিসগুলো আগাম না পেলে আমি জাদু তৈরি করব না।

 –ঠিক আছে। আমি তাহলে গাঁ থেকে ছাগল আর মাদুর নিয়ে এখনই ফিরে আসছি।

 দ্রুত পদক্ষেপে জঙ্গলের পথ ধরে গ্রামের দিকে রওনা হল মোমাইয়া

.

বনের পথে টিবোর হাত ধরে অলস মন্থরচরণে হাঁটছিল টারজান, হঠাৎ বাতাসে ভেসে এল একটা পরিচিত গন্ধ-বারা। অর্থাৎ হরিণ।

সঙ্গে সঙ্গে উদরে ক্ষুধার দংশন অনুভব করল টারজান। শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে হরিণ-শিকার সম্ভব নয় তাই চটপট একটা গাছের ডালে টিবোকে তুলে দিল সে, তারপর ছুটল হরিণের সন্ধানে।

টারজান সম্পর্কে টিবোর ভীতি এতক্ষণে একটু কমেছে। সে বুঝেছে শ্বেতদৈত্য তাকে হত্যা করবে না। এই গভীর জঙ্গলে হঠাৎ কোনো শ্বাপদের আবির্ভাব ঘটলে টারজান ছাড়া কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না, একথাও বুঝেছিল টিবো- এখন নিঃসঙ্গ অবস্থায় গাছের উপর সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।

-বনপথে একটা শব্দ ভেসে এল। চমকে উঠল টিবো- কার পায়ের তলায় সশব্দে ভেঙে যাচ্ছে শুকনো ডাল আর ঝরাপাতার রাশি- মনুষ্যশিশুর গন্ধ পেয়ে যদি এখানে হাজির হয় ক্ষুধার্ত প্যান্থার, তাহলে টিবোর অবস্থা কী হবে?

সামনের ঝোপ কাঁপতে লাগল কোনো অদৃশ্য জীবের দেহের ধাক্কায়, সঙ্গেসঙ্গে কাঁপতে লাগল ছোট্ট টিবোর হৃৎপিণ্ড; দুই চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইল সে না-জানি কোন ভয়ংকর এখনই উপস্থিত হবে তার চোখের সামনে

দ্রুত পা ফেলে হাঁটছে মোমাইয়া, হাতে তার ধারাল বর্শা। দিনের আলো থাকতে থাকতেই তাকে ছাগল আর মাদুর নিয়ে আসতে হবে বাকওয়াই-এর গুহায় এবং সেখান থেকে সন্ধ্যার আগেই ফিরে যেতে হবে গ্রামের নিরাপদ আশ্রয়ে। যাতায়াতের সময়ে দেরি হলে পথেই ঘনিয়ে আসবে সন্ধ্যার অন্ধকার। শ্বাপদসংকুল আফ্রিকার অরণ্য রাতের অন্ধকার মৃত্যুপুরীর মতোই ভয়াবহ, তাই দ্রুত পদক্ষেপে অতিক্রম করছিল মোমাইয়া। সামনর ঝোপটা পার হয়ে ফাঁকা মাঠের উপর উপস্থিত হল সে, সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর থেকে ভেসে এল পরিচত শিশুকণ্ঠে উল্লাসধ্বনি, মা!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল মোমাইয়া– সামনের গাছে একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়েছে তার হারানো ছেলে টিবো! পরক্ষণেই ডাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল টিবো, তারপর ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে!

টিবো! আমার টিবো! হাতের বর্শা ফেলে দিয়ে মোমাইয়া ছেলেকে বুকের মধ্যে চেপে ধরল গভীর আবেগে।

আচম্বিতে একটা চাপা গম্ভীর শব্দ ভেসে এল পিছন থেকে। শব্দ লক্ষ্য করে সচমকে ফিরে তাকাল ন্যুমা আর ছেলে অরণ্যের আবরণ ভেদ করে ফাঁকা মাঠের উপর এসে দাঁড়িয়েছে পশুরাজ ন্যুমা!

মা আর ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগল। মাটিতে পড়ে থাকা বর্শাটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করল না মোমাইয়া। ক্ষুধার্ত সিংহের আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার নেই।

ন্যুমার দুই কান চ্যাপা হয়ে কেশরের আড়ালে ঢাকা পড়ল, সুদীর্ঘ লাসুলে পাক খেয়ে খেয়ে দুলে উঠল কয়েকবার আক্রমণের সংকেত।

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল মোমাইয়া–

ওদিকে টারজান হরিণের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে চলতে চলতে একসময়ে জন্তুটাকে দেখতে পেল, ছুরি বাগিয়ে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হল সে হঠাৎ উলটো দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করল এবং টারজানের গায়ের গন্ধ পৌঁছে গেল বারার নাসারন্ধ্রে! হতাশ দৃষ্টি মেলে টারজান দেখল তার খাদ্য চোখের পলকে অন্তর্ধান করল গভীর অরণ্যের অন্তরালে।

টারজান বুঝল মৃগমাংস আজ তার ভাগ্যে নেই। একটা লতা ধরে সে গাছে উঠে পড়ল, তারপর গাছ থেকে গাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুতবেগে ধেয়ে চলল টিবোর কাছে! ধূর্ত শীটা যদি টিবোর সন্ধান পায়, তাহলে ওই শিশুটির মৃত্যু অনিবার্য। অতএব লতার দোলনায় শূন্যপথে টারজানের গতি হল দ্রুত থেকে দ্রুততর

টিবো আর মোমাইয়াকে লক্ষ্য করে দ্যুমা লাফ দেওয়ার উপক্রম করল, কিন্তু এক অদৃশ্য বস্তুর প্রবল আকর্ষণে উলটে পড়ল মাটির উপর। অতর্কিতে একটা লতার দড়ি শূন্যপথে ছিটকে এসে পড়েছে তার গলায় এবং সেই ফাঁসে বন্দি হয়েই পশুরাজের এই দুরবস্থা।

 নিজেকে মুক্ত করার জন্য সগর্জনে উঠে দাঁড়াল নমা। সঙ্গেসঙ্গে শূন্য থেকে এক শ্বেতাঙ্গ দৈত্য ছুরি হাতে লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে

টারজান!

হ্যাঁ গাছের উপর থেকে টারজানই লতার ফাস ছুঁড়ে মার আক্রমণে বাধা দিয়েছে, তারপর সোজা গাছের ডাল থেকে ঝাঁপ দিয়েছে সিংহের ঘাড়ে!

ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে মোমাইয়া আর টিবো সেই বিস্ময়কর লড়াই দেখতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও সিংহ তার পিঠের উপর উপবিষ্ট শত্রুকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারল না, তার ধারাল নখ আর ভয়ংকর দাঁতগুলো একবারও স্পর্শ করতে পারল না শত্রুকে- কিন্তু শত্রুর ধারাল ছুরির আঘাতে তার বুক আর পাঁজর হয়ে গেল ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত অবশেষে এক প্রচণ্ড আঘাতে হৃৎপিণ্ড ভেদ করে ঢুকে গেল টারজানের ছুরি, অন্তিম আর্তনাদে বন কাঁপয়ে মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়ল পশুরাজ নমা।

মৃত শত্রুর দেহের উপর পা রেখে উঠে দাঁড়াল টারজান, তার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হল এক ভয়ংকর শব্দ- বনমানুষের রণহুঙ্কার!

মোমাইয়া তখন ভয়ে কাঁপছে। সিংহ আর টারজানের মধ্যে কে বেশি বিপজ্জনক, তা সে বুঝতে পারছে না।

টিবো ভয় পেল না; জলভরা চোখে টারজানের দিকে তাকিয়ে বলল, মায়ের কাছ থেকে আমায় নিয়ে যেও না তুমি। আমাদের গাঁয়ের চারধারে যে-বেড়া আছে, সেই বেডার দরজায় প্রতিদিন আমরা তোমার জন্য খাবার রেখে দেব। আমরা যতদিন বাঁচব, ততদিনই তুমি আমাদের কাছ থেকে খাবার পাবে। আমাকে তুমি মায়ের সঙ্গে থাকতে দাও। মায়ের কাছে না থাকলে আমি বাঁচব না।

টারজান দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাকে ভালোবাসবে, তাকে আদর করবে, এমন কেউ তার নেই।

মা আর ছেলেকে অভয় দিয়ে সে বলল, তোমরা মবংগোর গাঁয়ে ফিরে যাও। আমি পিছনে যাব। পথে কোনো বিপদ তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।

টিবো আর টারজান পরস্পরের ভাষা বুঝতে না পারলেও পরস্পরের মনোভাব বুঝতে তাদের অসুবিধা হয় নি। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার টারজানের দিকে তাকিয়ে বনপথে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল টিবো আর মোমাইয়া

মোমাইয়া গ্রামের পথে রওনা হতেই তার পিছু নিয়েছিল বাকওয়াই। দূর থেকে টারজানের কণ্ঠ- নিঃসৃত বনমানুষের রণ-হুঁঙ্কার আর সিংহের গর্জন বাকওয়াই-এর শ্রুতিগোচর হয়েছিল, কিন্তু অকুস্থলে পৌঁছানোর আগেই লড়াইটা শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে যুদ্ধটা তার চোখে পড়ে নি। লড়াই-এর শব্দ শুনে সে ভেবে নিয়েছিল বনমানুষ আর সিংহের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছে। অকুস্থলে পৌঁছে সিংহের মৃতদেহ দেখে একটা বনমানুষকেই এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক বলে ভাবল বাকওয়াই। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বনমানুষের পক্ষে সিংহকে হত্যা করা একেবারে অসম্ভব নয়। ছুরিকাঘাতের চিহ্নগুলোকে বাকওয়াই দংশন-ক্ষত বলে ভুল করছিল। ভালোভাবে সিংহের মৃতদেহ পরীক্ষা করলে অবশ্য সে ব্যাপারটা বুঝতে পারত, কিন্তু সেই চেষ্টা সে করে নি। মত সিংহের দিকে একবার তাকিয়েই মোমাইয়ার চলার পথ ধরে এগিয়ে চলল বাকওয়াই কিছুক্ষণ পরেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য

নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে টিবো আর মোমাইয়া, তাদের অনুসরণ করেছে শ্বেতদৈত্য টারজান!

দারুণ ক্রোধে দাঁত কড়মড় করতে করতে বাকওয়াই প্রতিজ্ঞা করল যেমন করেই হোক তার প্রত্যাশিত জিনিসগুলো সে মোমাইয়ার কাছ থেকে আদায় করবেই করবে।

পরের দিন গ্রামে কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে মোমাইয়া গেল চাষের কাজে। ন্যুমা আর তার সঙ্গিনীদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল টিবো, হাতে একটা ছোটো বর্শা নিয়ে। হঠাৎ একটা কাঠবেড়ালি তার চোখে পড়তেই জন্তুটাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ল টিবো। মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হল কাঠবেড়ালী লক্ষ্যভ্রষ্ট বর্শা হারিয়ে গেল নিকটবর্তী ঝোপের অন্ধকারে।

একটু দূরে কর্মব্যস্ত ন্যুমা আর অন্যান্য মেয়েদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল টিবো, তারপর নির্ভয়ে এগিয়ে গেল ঝোপের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া-বর্শাটাকে উদ্ধার করতে।

অকস্মাৎ একটা শক্ত হাত টিবোর মুখ চেপে ধরল! ওই ঝোপটার মধ্যেই সুযোগের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসেছিল জাদুকর বাকওয়াই!

একহাতে টিবোর মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে ছুরি উঁচিয়ে চাপা গলায় গর্জে উঠল বাকওয়াই, চুপ! চাঁচালেই খুন করব! চল আমার সঙ্গে।

ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে টিবো দেখল লোলুপ চক্ষে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে এক জোড়া হায়না!

টানতে টানতে তাকে নিয়ে চলল বাকওয়াই, সঙ্গে চলল হায়না দুটো। ছোট্ট টিবো তখন মনে-প্রাণে টারজানের উপস্থিতি কামনা করছে- আহা, সাদা দৈত্যের কাছে যদি সে এখন থাকত, তাহলে শয়তান জাদুকরটা তাকে স্পর্শও করতে পারত না।

কিছুক্ষণ পরে বন্দি টিবো এসে পৌঁছাল জাদুকর বাকওয়াই-এর গুহার সামনে। নড়বড়ে কাঠের দরজাটা খুলে দিল বাকওয়াই, হায়না দুটো তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করল গুহার মধ্যে। এবার টিবোকে নিয়ে হায়না দুটোকে অনুসরণ করল বাকওয়াই।

গুহার অন্ধকার, ভয়াবহ জাদুকর আর মাংসলোলুপ দু-দুটো হায়নার উপস্থিতি টিবোর সর্বাঙ্গ আতঙ্কে অবশ করে দিয়েছিল পদে পদে হোঁচট খেতে খেতে সে এগিয়ে চলল বাকওয়াই-এর সঙ্গে। এবার আর তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল না, হায়নার ভয়ে জাদুকরের গায়ের সঙ্গে সে লেগেছিল আঠার মতো।

হঠাৎ একটা হায়না দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এল টিবোর দিকে। সঙ্গেসঙ্গে গুহার ভিতর থেকে ক্ষিপ্রহস্তে একটা লাঠি টেনে নিয়ে সজোরে আঘাত হানল বাকওয়াই লাঠিটা এসে পড়ল আক্রমণোদ্যত শ্বাপদের ঘাড়ে। আর্তনাদ তুলে জন্তুটা সরে এল টিবোকে ছেড়ে। আহত হায়নার সঙ্গী হিংস্র দন্তবিকাশ করে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল প্রভুর দিকে। বাকওয়াই আবার লাঠি তুলল, দু-নম্বর হায়নাও চটপট সরে এল টিবোর সামনে থেকে।

গুহার ভিতর সরু গলিপথের একদিকে টিবোকে রেখে অপরদিকে প্রবেশপথ একটা নড়বড়ে কাঠের বেড়ার সাহায্যে বন্ধ করে দিল বাকওয়াই, তারপর বেড়ার অপরদিকে দাঁড়িয়ে টিবোকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি এখন যাচ্ছি। তুমি যদি বেড়া সরিয়ে পালাতে চেষ্টা কর, তাহলে আমার হায়না দুটো তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। খবরদার, পালাতে চেষ্টা কর না।

-শোকে-দুঃখে কাতর মোমাইয়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল সর্দার মবংগো। জঙ্গলের মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও টিবোর সন্ধান পাওয়া যায় নি। আর্তস্বরে বিলাপ করছিল মোমাইয়া। দূরে দাঁড়িয়েছিল গ্রামের স্ত্রী-পুরুষ। প্রত্যেকেরই মুখে-চোখে দুঃখের ছাপ। পুত্রহারা জননীকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে সর্দার মবংগো বলছিল তার যোদ্ধাদের দূর বনে সে এখনই পাঠিয়ে দেবে টিবোকে খুঁজে বার করার জন্য।

হঠাৎ বনের আড়াল থেকে তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করল জাদুকর বাকওয়াই। ঘটনা শুনে সে বলল সাদা দৈত্যটাই আবার টিবোকে চুরি করেছে।

ফুঁফিয়ে উঠে মোমাইয়া বলল, আমার টিবো এখন কোথায় আছে? বাকওয়াই, তুমি বাছাকে ফিরিয়ে আনো আমার কাছে।

গম্ভীরভাবে বাকওয়াই বলল, দশটি মোটা-সোটা ছাগল পেলে আমি টিবোকে টারজানের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারি।

রুষ্টস্বরে মোমাইয়া বলল, দশটি ছাগল আমি কোথায় পাব? কয়েক বছরের মধ্যেও দশটা ছাগল আমি জোগাড় করতে পারব না।

বাকওয়াই জানাল দশটা ছাগল না পেলে সে কিছু করতে পারবে না। সর্দার মবংগো এবার এগিয়ে এসে মোমাইয়ার হয়ে অনুরোধ করল কিন্তু বাকওয়াই অটল, তার দাবি দশটি ছাগল, কম হলে চলবে না। অনুরোধ আর তর্কবিতর্ক শুরু হল উভয় পক্ষে

সেদিনও মাংস ভোজনের আশা ছেড়ে দিয়েছিল টারজান, কারণ একটু আগেই তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে একটা জেব্রা। অগত্যা ফলাহারেই ক্ষুধার্ত উদরকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল টারজান, এমন সময়ে হঠাৎ উপস্থিত হল ছোট্ট ন-কিমা।

ন-কিমা হচ্ছে ছোটোখাটো একটি বানর, আকারে একহাতের বেশি বড়ো নয়। টারজানের সঙ্গে তার ভারি বন্ধুত্ব। প্রায়ই টারজানের কাঁধে চড়ে সে ঘুরে বেড়ায়, তাই ধূর্ত শিটা (প্যান্থার) ছোট্ট ন-কিমাকে পেটে পুরতে পারে নি এখনও।

একলাফে টারজানের কাঁধে উঠে ন-কিমা বলল, খুব তো ফল খাচ্ছ, ওদিকে কী হয়েছে জানো?

মৃদু হেসে টারজান বলল, কী হয়েছে? শিটা তোমায় ধরতে আসছে?

মুখৰিকৃত করে ন-কিমা বলল, টারজানের সামনে আসতে সাহস পাবে না শিটা। কিন্তু শিটা নয়– কালো মানুষের যে বাচ্চা ছেলেটাকে তুমি নিয়ে এসেছিলে– তাকেই ধরে নিয়ে গেছে শয়তান।

শয়তান! টারজানের কুঞ্চিত হল, কোন শয়তান ধরেছে টিবোকে?

একটু দূরে পাহাড়ের গুহায় দুটো জ্যাংগো (হায়না) নিয়ে থাকে একটা শয়তান, ন-কিমা বলল, সেই শয়তানটাই ধরে নিয়ে গেছে কালো মানুষের বাচ্চাকে।

মুখের ফল ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল টারজান, তারপর ঝড়ের বেগে ছুটল– কখনো গাছের মাথায় মাথায় লতার দোলনায় দুলে শূন্যপথে, আবার কখনো বা তৃণাবৃত প্রান্তরের উপর দিয়ে ধাবমান ঝটিকার মত ধেয়ে চলল ক্রুদ্ধ টারজান জাদুকরের আস্তানার দিকে

আতঙ্কে বিস্ফারিত দুই চক্ষু মেলে টিবো দেখল হায়না দুটো সজোরে আঁচড়াচ্ছে কাঠের বেড়াটাকে। ক্ষুধার্ত শ্বাপদের আক্রমণের সামনে তুচ্ছ কাঠের বেড়া বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না– কাঠের টুকরোগুলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়তেই জন্তু দুটো ঢুকে পড়ল গুহার সংকীর্ণ গলিটার মধ্যে।

কিন্তু টিবোর গায় দাঁত বসানোর আগেই ঝড়ের মতো সেখানে উপস্থিত হল টারজান। এত আশার খাদ্যে বিঘ্ন ঘটার উপক্রম দেখে দাঁত খিঁচিয়ে রুখে দাঁড়াল হায়না দুটো।

টারজান কোমরের ছুরিতে হাত দিল না, সামনের হায়নাটার ঘাড় চেপে ধরে সজোরে আছাড় মারল। ছিটকে পড়ে আর্তনাদ করে উঠল আহত হায়না।

সঙ্গীর দুর্দশা দেখে দু-নম্বর হায়না আর দাঁড়াল না, তীরবেগে ছুটে গুহার বাইরে অন্তর্ধান করল। আহত হায়নাটাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে গুহার বাইরে পালিয়ে গেল।

আতঙ্কে কম্পমান টিবোকে হাত ধরে টেনে তুলল টারজান; ভয়ার্ত শিশু তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল

পুত্রশোকে কাতর মোমাইয়া তখন সর্দার মবংগোকে দশটা ছাগল বাকওয়াই-এর হাতে তুলে দিতে অনুরোধ করছে অত্যন্ত বিপন্ন মুখে ঘন ঘন দাড়িতে হাত বুলিয়ে সর্দার জানাচ্ছে দশ-দশটা ছাগল দান করার মতো অবস্থা তার নয় এবং নির্বিকার চিত্তে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে পরিস্থিতি উপভোগ করছে জাদুকর বাকওয়াই

আচম্বিতে সকলের মাথার উপর থেকে গাছের লতা ধরে মাটির বুকে পদার্পণ করল টারজান, তার গলা জড়িয়ে পিঠের উপর ঝুলছে ছোট্ট টিবো!

তড়াক করে টারজানের পিঠ থেকে নেমে টিবো ছুটে গেল মায়ের কাছে। আসেপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারাও দৌড়ে এসে ঘিরে ফেলল টিবো আর মোমাইয়াকে। একসঙ্গে সবাই মিলে প্রশ্নের পর প্রশ্নে টিবোকে বিব্রত করে তুলল। টিবো তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য যে-ঘটনার বিবরণ দিয়েছিল, সে-সব কথা আগেই বলা হয়েছে, সুতরাং পুনরুক্তি অনাবশ্যক।

ছেলের মুখে সব কথা শুনে ক্ষিপ্তা সিংহীর মতো বর্শা উঁচিয়ে ফিরে দাঁড়াল মোমাইয়া–কিন্তু বাকওয়াই যেখানে বসেছিল, সেখানে কাউকেই দেখতে পেল না।

টিবোকে দেখেই বাকওয়াই বুঝেছিল অবস্থা সুবিধের নয়, সকলের অজ্ঞাতসারে সে সরে পড়েছিল।

টারজানও নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়েছিল জনতার সামনে থেকে। অরণ্যে তার শত্রুর সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। শত্রুদের তালিকায় সেদিন আরও একটি সংখ্যা যুক্ত হল, নাম– জাদুকর বাকওয়াই।