১. মৃত্যুদণ্ডের আসামী
কিছুদিন আগে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। যে অপরাধের জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের মতো বড় শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেটিকে আদৌ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কী না সেটি নিয়ে আমি কারো সাথে তর্ক করতে চাই না। অপরাধ এবং শাস্তি দুই-ই খুব আপেক্ষিক ব্যাপার, রাষ্ট্র যেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছে, সেটি আমার কাছে নিছক কৌতূহল ছাড়া আর কিছু ছিল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে আমার দৈনন্দিন জীবন আশ্চর্য রকম পাল্টে গেছে। বিচার চলাকালীন সময়ে আমার সেলটিকে অসহ্য দমবন্ধ-করা একটি ক্ষুদ্র কুঠুরি বলে মনে হত। আজকাল এই কুঠুরির জন্যেই আমার মনের ভেতর গভীর বেদনাবোধের জন্ম হচ্ছে। ছোট জানালাটি দিয়ে এক বর্গফুট আকাশ দেখা যায়, আমি ঘন্টার পর ঘন্টা সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। নীল আকাশের পটভূমিতে সাদা মেঘের মাঝে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। ইদানীং পৃথিবীর সবকিছুর জন্যে আমার গাঢ় ভালবাসার জন্ম হয়েছে। আমার উচ্ছিষ্ট খাবারে সারিবাঁধা পিপড়েকে দেখে সেদিন আমি তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করেছি।
গত দুই সপ্তাহ থেকে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত করেছি, এটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। অকারণে জগৎ-সংসারের প্রতি তীব্র অভিমানববাধে যুক্তিতর্ক অর্থহীন হয়ে আসতে চায়। আমার বয়স বেশি নয়, আমি অসাধারণ প্রতিভাবান নই, কিন্তু আমার তীব্র প্রাণশক্তি আমাকে সাফল্যের উচ্চশিখরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনকে উপভোগ, এমন কি অর্থপূর্ণ করার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু আমাকে সে সুযোগ দেয়া হল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর আমার জীবনের শেষ কয়টি দিনের জন্যে কিছু বাড়তি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার খাবারে প্রোটিনের অনুপাত বাড়ানো হয়েছে, ভালো পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাথরুমের ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, সর্বোপরি খবরের কাগজ এবং বইপত্র পড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে পৃথিবীর দৈনন্দিন খবরের মতো অর্থহীন ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। আমি প্রথম দিন একার খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে আর দ্বিতীয় বার সেটি খোলার উৎসাহ পাই নি। দূর মহাকাশে একটি মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান পাঠানো-সংক্রান্ত একটি অভিযান নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা ছিল, আমার তাতে কোনো উৎসাহ ছিল না।
মাঝে মাঝে আমি কাগজে আঁকিবুকি করি বা কিছু লিখতে চেষ্টা করি, তার বেশিরভাগই অসংলগ্ন এবং আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন চিন্তা। আমার মৃত্যুর পর হয়তো এগুলো আমার ব্যক্তিগত ফাইলে দীর্ঘকাল অবস্থান করবে। আমি কয়েক বার প্রিয়জনকে চিঠি লেখার কথা ভেবেছি, কিন্তু আমার প্রিয়জন বেশি নেই, যারা আছে তাদের দুঃখবোধকে তীব্রতর করার অনিচ্ছা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে।
আজকাল আমার সাথে দিনে তিন বার এই সেলটির ভারপ্রাপ্ত রক্ষকের সাথে দেখা হয়, তিন বারই সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসে। আগে সে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করত, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে খানিকটা সদয় ব্যবহার করা শুরু করেছে। গত রাতে সে নিজের পকেট থেকে আমাকে একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে দিয়েছে, আমি সিগারেট খাই না জেনেও! আমি লোকটিকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ করি, মাঝারি বয়সের সাদাসিধে নির্বোধ লোক, সরকারের নির্দেশিত বাঁধাধরা গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে অক্ষম। ব্যক্তিগত জীবনে এরা সাধারণত সুখী হয়। জীবনের শেষ কয়টা দিন আরেকটু বুদ্ধিমান একটি প্রাণীর সংস্পর্শে থাকতে পারলে মন্দ হত না। আমাকে যেদিন হত্যা করা হবে সেদিন আরো কিছু মানুষের সাথে দেখা হবার কথা। প্রাচীন কালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে চেয়ারে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হবে। মৃত্যুদণ্ড প্রতিশোধমূলক শাস্তি, এটিকে যতদূর সম্ভব যন্ত্রণাদায়ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাত থেকে দশ জন মানুষ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে গুলি করে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই যন্ত্রণা খুব অল্প সময়ের জন্যে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে নাকি সারাজীবনের স্মৃতি একসাথে মাথায় উঁকি দিয়ে যায়, আপাতত সেই ব্যাপারটি নিয়ে খানিকটা কৌতূহল ছাড়া আমাকে দেয়ার মতো ভবিষ্যতে কিছু অবশিষ্ট নেই—অন্তত আমি তাই জানতাম।
তাই যেদিন সকালবেলা আমার সেলের দরজা খুলে দু’জন গার্ডসহ একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক আমার সাথে দেখা করতে এল, আমার তখন বিস্ময়ের সীমা ছিল না। লোকটি অত্যন্ত কম কথার মানুষ, আমাকে এবং আমার ক্ষুদ্র অগোছাল ঘরটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল। বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি রাজি থাকলে আপনার মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মে গুলি না করে অন্যভাবে করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধু এটুকু বলার জন্যে আপনি কষ্ট করে এসেছেন?
না।
কী বলবেন বলুন। অপ্রচলিত নিয়মে মারা যাওয়ার জন্যে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আপনি হয়তো জানেন মনুষ্যবিহীন একটা স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান কিছুদিনের মাঝেই মহাকাশে রওনা হচ্ছে।
হঠাৎ করে এই অপ্রাসঙ্গিক কথাটি শুনে আমি খুব অবাক হয়ে উঠি। আমি সত্যি সত্যি খবরের কাগজে এটি দেখেছিলাম।
উচ্চপদস্থ লোকটি শান্ত স্বরে বলল, আপনি রাজি হলে আপনাকে ঐ মহাকাশযানে তুলে দেয়া হবে।
মহাকাশযানটি আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না?
আসবে।
আমি ফিরে আসব না?
আপনিও ফিরে আসবেন, কিন্তু আপনি জীবিত থাকবেন না।
কেন?
জানি না, এখন পর্যন্ত এই অভিযানে কেউ জীবিত ফিরে আসে নি।
ও! আমি চুপ করে যাই। পৃথিবীতে গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার বদলে মহাকাশের। কোনো এক অজানা পরিবেশে অজ্ঞাত কোনো-এক কারণে মারা যাওয়ার জন্যে আমি নিজের ভেতরে কোনো উৎসাহ খুঁজে পেলাম না। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কতদিনের অভিযান?
প্রায় এক বছর, যেতে ছয় মাস, ফিরে আসতে আরো ছয় মাস।
আমি প্রথমবার খানিকটা উৎসাহিত হলাম। যে দুই সপ্তাহের ভেতর মারা যাচ্ছে তার কাছে এক বছর বা ছয় মাস অনেক সময়, যদিও সেটি মহাকাশের নির্জন, নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ পরিবেশ। কিন্তু আমার উৎসাহ পুরোপুরি নিভে গেল লোকটির পরের কথা শুনে। সে বলল, অভিযানের শুরুতে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, আপনার ঘুম ভাঙবে গন্তব্যস্থানে পৌছে। সেখানে আপনার কী হবে আমি জানি না, কিন্তু কোনো কারণে আপনি মারা যাবেন, আপনার মৃতদেহ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে।
আমার মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে সে বিষয়ে আমার কোনো কৌতূহল ছিল না, লোকটি সেটা আমার মুখ দেখেই বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। আমি বললাম, তার মানে যদিও প্রায় ছয় মাস পরে আমি আক্ষরিক অর্থে মারা যাব কিন্তু আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার পর আমার বেঁচে থাকা না-থাকার কোনো অর্থই নেই। কাজেই আমার বেঁচে থাকা শেষ হয়ে যাবে অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে।
বলতে পারেন।
অভিযান শুরু হবে কবে?
ঠিক এক সপ্তাহ পরে।
শুনে খুব স্বাভাবিক কারণে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, আপনি হয়তো জানেন না, কাউকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়ার পর সময় তার কাছে কত মূল্যবান হয়ে ওঠে। আমার এখনো দুই সপ্তাহ সময় আছে, আমি সেটা অর্ধেক করব কেন?
লোকটি ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আপনি যেভাবে বেঁচে আছেন, তাতে এক সপ্তাহ আর দুই সপ্তাহের মাঝে খুব পার্থক্য থাকার কথা নয়।
আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে রইলাম। মানুষ এরকম হৃদয়হীন কথা কীভাবে বলতে পারে। লোকটিকে কিছু বলতে আমার ঘৃণা। হল। আমি মেঝেতে শব্দ করে থুথু ফেলে কোনায় সরে গেলাম। লোকটি এক পা এগিয়ে এসে বলল, আপনার বেঁচে থাকার সময় যদিও কমে যাবে, কিন্তু বেঁচে থাকার গুণগত মান অনেক বাড়িয়ে দেয়া হবে।
মানে?
আপনি যদি রাজি থাকেন আপনাকে এক সপ্তাহ জেলের বাইরে আপনার ইচ্ছেমতো থাকতে দেয়া হবে।
আমার বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, পুরো এক সপ্তাহ স্বাধীন মানুষের মতো থাকতে পারব? জেলখানায় চার দেয়ালের ভেতর এক চিলতে আকাশ নয়, বাইরে, সুদীর্ঘ সমুদ্রতটে সুবিশাল আকাশ? মানুষজন, তাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার কাছাকাছি সাত-সাতটি দিন?
আপনি রাজি থাকলে এখনই আমাকে জানাতে হবে।
এখনই?
হ্যাঁ।
এই সাতদিন আমি পুরোপুরি স্বাধীন মানুষের মতো থাকতে পারব?
হ্যাঁ।
আমি যদি পালিয়ে যাই? আর কোনোদিন যদি আপনাদের কাছে ফিরে না আসি?
এই প্রথম বার লোকটিকে আমি হাসতে দেখলাম, সত্যি কথা বলতে কি, তাকে হাসিমুখে বেশ একজন সদয় মানুষের মতোই দেখাল। লোকটি হাসি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই বলল, আপনি ফিরে আসবেন।
যদি না আসি?
আপনার শরীরে যে ট্রাকিওশান লাগানো হবে, সেটি আপনাকে ফিরিয়ে আনবে।
ট্রাকিওশান এক ধরনের ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক পালস জেনারেটর। এটি ইনজেকশান দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের সাথে মিশে গিয়ে এটি শরীরের যে-কোনো জায়গায় পাকাপাকিভাবে বসে যেতে পারে। কোনো মানুষের মস্তিষ্কের কম্পনের স্পেকট্রাম জানা থাকলে এই ট্রাকিওশান দিয়ে তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমি ট্রাকিওশানের নাম শুনেছিলাম, কখনো কারো উপরে ব্যবহার করা হয়েছে শুনি নি। নিজের উপর ব্যবহার করা হবে খবরটি আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে, শুকনো গলায় বললাম, পুরোপুরি স্বাধীনভাবে থাকতে দেবেন কথাটি তাহলে সত্যি নয়। আমাকে সবসময়েই নজরে রাখা হবে।
না, তা ঠিক নয়। লোকটি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে স্বাধীনভাবেই থাকতে দেয়া হবে। শুধুমাত্র মহাকাশযানটি রওনা দেবার ছয় ঘন্টা আগে ট্রাকিওশানটা চালু করা হবে আপনাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। আপনি নিজেই যদি এসে যান তাহলে সেটিও করতে হবে না।
তার কি নিশ্চয়তা আছে?
নেই, কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আমি বলছি, আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।
আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম।
আমাকে ওজন করা হল, শরীরের প্রতিটি অংশের ছবি নেয়া হল, রক্তচাপ, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের স্থায়িত্ব মাপা হল। রক্ত সঞ্চালনের গতি, মস্তিষ্কের তরঙ্গ এবং অনুভূতির সাথে সেই তরঙ্গের সম্পর্ক বের করা হল। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির পরিমাপ নেয়া হল। শব্দতরঙ্গের প্রতিফলন দিয়ে শরীরের যকৃৎ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও কিডনির যাবতীয় অংশের ছবি নেয়া হল। তেজস্ক্রিয় দ্রব্য রক্তের সাথে মিশিয়ে শরীরের মেটাবোলিজমের হার বের করা হল। আমার রক্তের প্রকৃতি, নিউরোনের সংখ্যা পরিমাপ করা হল।
সবশেষে আমার শরীরে ক্ষুদ্র একটি ট্রাকিওশান প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।