১. মিঃ শ্যাতানা

কার্ডস অন দি টেবল (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

০১.

মিঃ শ্যাতানা আর্জেন্টিয়ান, পর্তুগীজ, গ্রীক না অন্য কোনো জাতির লোক সে সম্বন্ধে কারো কিছু জানা নেই। ভদ্রলোক পার্ক লেনের আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে বাস করেন।

মাঝে মাঝেই তিনি নানা রকমের পার্টি দেন। সেই পার্টিতে বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই স্থানলাভ করেন। পার্টির একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে।

মিঃ শ্যাতানা এমনই লোক যে তাকে দেখলেই সকলে কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন।

সকলের ধারণা ভদ্রলোকের দৃষ্টি প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করছে। মিঃ শ্যানার রসিকতার ধরনটাও কেমন অদ্ভুত।

সকলে তাকে এই কারণে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।

আজকে যাকে কেন্দ্র করে কৌতুকপ্রবণতা গেজিয়ে উঠলো তিনি হচ্ছেন খর্বাকৃতি পোয়ারো।

মিঃ শ্যাতানা পোয়ারোকে তার ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি বললেন, আমার ফ্ল্যাটে একদিন চলে আসুন, অনেক আকর্ষণীয় জিনিষ দেখাতে পারবো। আমার সংগ্রহশালায় কেবলমাত্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্যগুলোই স্থান পেয়ে থাকে।

অপরাধ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রষ্টব্য বস্তু বলতে আপনি তাহলে কি মনে করেন?

আমি তাদেরই বলছি, যারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ খুনী!

হ্যাঁ যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেও নির্বিঘ্নে তাদের কাজ হাসিল করে গেছে। যাদের ইতিহাস কেবল সফলতায় ভরা, কোনো ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ পর্যন্ত এই সমস্ত অপকীর্তির বিন্দুবিসর্গও জানে না।

তিনি আরও উচ্ছ্বসিত ভাবে বললেন, জানেন মিঃ পোয়ারো, কেউ যদি কোনো কাজ নিখুঁত শিল্পসম্মত উপায়ে সমাধা করতে পারে তবে তাকে নিশ্চয় পুরস্কার দেওয়া উচিত। সব খুনীকেই হাতকড়া পরিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে হবে, দূরদর্শিতার অভাব থেকেই আপনার মনে এমন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। আমার মতে সরকারের তরফ থেকে এইসব খুনীদের জন্যে বিশেষ ভাতার বন্দোবস্ত থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেক সভ্য নাগরিকের কর্তব্য এদের মহাসমারোহে সান্ধ্য ভোজে আপ্যায়িত করা। তাই আপনাকে শুক্রবার আঠারো তারিখে আমার ফ্ল্যাটে আসতে বলছি।

মিঃ শ্যাতানা বিদায় নিয়ে এগোলেন। পোয়ারো অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

.

০২.

 শুক্রবার মিঃ পোয়ারো মিঃ শ্যাতানার ফ্ল্যাটে গেলেন। উর্দিপরা খানসামা তাকে দরজা খুলে দিলেন।

পোয়ারোকে মহাসমারোহে ভেতরে নিয়ে গেলেন শ্যাতানা। আসুন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই…।

ইনি হচ্ছেন শ্রীমতি অলিভার, গোয়েন্দা ও রহস্য গল্পের লেখিকা। ভদ্রমহিলার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। খুনীদের মানসিক গতিপ্রকৃতি, অপরাধীর প্রবণতা, গভীর তত্ত্বের কিছু প্রবন্ধও হালকা সুরে পরিবেশন করেছেন।

ভদ্রমহিলা হাসিমুখে পোয়ারোকে সাদর অভিবাদন জানালেন।

ধীর গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শ্যাতানা, সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলের সঙ্গে নিশ্চয় আপনার আলাপ আছে?

লম্বাচওড়া ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সুচতুর অফিসারদের মধ্যে সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেলই সর্বশ্রেষ্ঠ।

শ্যাতানা আবার মুখ খুললেন, ইনি হচ্ছেন ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ধুরন্ধর কর্মচারী, কর্নেল রেস।

পোয়ারো চিন্তা করল যে মিঃ শ্যাতানার অতিথি নির্বাচনের ক্ষমতা আছে।

এরপর আরও অতিথি একে একে প্রবেশ করলেন–ডাঃ রবার্টস…ইনি একজন বিচক্ষণ ডাক্তার এবং তার রোগনির্ণয়ের মধ্যে যে কোনো ভুল থাকে না, রুগীর মনে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতেও ভদ্রলোক যথেষ্ট পারদর্শী।

এবারে মিঃ শ্যাতানাকে খানসামা এসে জানাল মিসেস লরিমার কথা।

মিসেস লরিমার বয়স ষাটের কাছাকাছি, ভব্যসভ্য পোষাকআসাক, মাথার চুল ধূসর বর্ণের, গলার স্বরও বেশ তীক্ষ্ণ।

খানসামার কণ্ঠস্বর আবার ধ্বনিত হলো–মেজর ডেসপার্ড। দীর্ঘকায় স্বাস্থ্যবান পুরুষ হচ্ছেন ইনি। নানাধরনের শিকার সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা গল্প করতে লাগলেন দুজনে।

এবার প্রবেশ করলেন…মিস মেরিডিথ…, ইনি সেদিনের শেষ অতিথি। বয়স বাইশ তেইশের মধ্যে। সর্বাঙ্গে একটা বিষাদকোমল শ্ৰী আছে।

মিস মেরিডিথের সঙ্গে মিঃ পোয়ারোর আলাপ করিয়ে দিলেন মিঃ শ্যাতানা।

মিস মেরিডিথ বললেন, আমি আপনার বিষয়ে অনেক কথাই কাগজে পড়েছি। এ.বি.সি. মার্ডারের মতো রোমহর্ষক মামলার আসামীকে আপনিই তো পুলিসের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের বড় বড় কর্তারা এই রহস্যের কোনো হদিশ পাচ্ছিলেন না।

মিস মেরিডিথ এবার মিঃ শ্যাতানার সম্বন্ধে বলতে শুরু করলেন কিন্তু মাঝপথে থেমে গেলেন।

পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বাকিটা ব্যক্ত করলেন। ভদ্রলোক খুবই অপরাধপ্রবণ। তার চোখের দৃষ্টিও ক্রুর। তাকে দেখলে লোকের মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। কিন্তু ভদ্রলোকের ডিনারটা খুবই উপভোগ্য।

ইতিমধ্যে ডিনারের ডাক পড়লো। পোয়ারোর অনুমান সর্বৈব সত্য রাজকীয় আয়োজন খাদ্য তালিকায় ত্রুটিহীন পরিবেশন।

অতিথিরা সবাই খুব তৃপ্তি করে এবং রসিকতা করতে করতে এই ডিনারটি উপভোগ করলেন। ডিনার সারতে সারতে এক একজন নানাধরনের খুনের প্রক্রিয়া ব্যক্ত করতে লাগলেন।

মেজর ডেসপার্ড শুষ্ক স্বরে বললেন, বুনো জাতিরা স্বভাবতই প্রাচীন পন্থী। তারা তাদের পিতা-প্রপিতামহের বহু ব্যবহৃত পুরানো পন্থাই অনুসরণ করে চলে।

শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, আমি ভেবেছিলাম ওরা শেকড়বাকড় নিয়ে নানাধরনের প্রক্রিয়া চালায় খুনের জন্য কিন্তু এখন দেখছি এটা সত্যি নয়।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল এ সম্বন্ধে তার বক্তব্য পেশ করলেন। তিনি বললেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে তারা সাধারণতঃ সাবেকী আর্সেনিকই পছন্দ করে। এটা অনেক সহজলভ্য তবে মহিলাদের মধ্যে অনেক প্রথম শ্রেণীর অপরাধী আছে যারা সাংঘাতিক জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও খুব মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে।

মিঃ শ্যাতানা হেসে বললেন, বিষই হচ্ছে মহিলাদের প্রধান অস্ত্র।

খুনের ব্যাপারে ডাক্তারদের সুযোগসুবিধা প্রচুর। শ্যাতানার চিন্তার কালোছায়া এই উক্তির জন্য ডাক্তার রবার্টস রাগত স্বরে বললেন, আমি এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করছি তবে ভ্রমক্রমে আমরা কখনো কখনো রুগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াই সেটা নিছকই দুর্ঘটনা।

মিঃ শ্যাতানা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তবে আমি যদি কাউকে খুন করতে যাই তাহলে আমি সোজা রাস্তাই অবলম্বন করবো যেমন শিকার করতে গিয়ে ভুল করে অন্য কাউকে মেরে বসা; অথবা অন্যমনস্কভাবে কোনো অসুস্থ রোগীকে বিষাক্ত কোনো ওষুধ খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি।

সারা ঘর নীরব হয়ে গেল।

.

০৩.

সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। বেয়ারা কফি দিয়ে গেল। শ্যানা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা সবাই আসুন সবাই মিলে ব্রীজ খেলা যাক। ব্রীজের জন্য টেবিল পাতা হলো। পার্টনার নির্বাচন করা হল এবং পুরোদমে তাস খেলা শুরু হয়ে গেল।

মিঃ শ্যাতানার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তিনি আজ মনে মনে ভাবলেন তার অতিথিরা তাকে অফুরন্ত আনন্দের ইন্ধন জোগাচ্ছে।

পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে কর্নেল বললেন, পাঁচটা ডায়মণ্ডের খেলা হলো, তার অর্থ গেম এবং রাবার, তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে, স্পেড লিড পড়লে কি হতো বলা যায় না!

কর্নেল রেস ঘড়িটার দিকে তাকালেন, রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট একটা রাবার হতে পারে।

ব্যাটেল রাজী হলেন না। আমার বেশি রাত জাগা সহ্য হবে না।

ক্ষুণ্ণ চিত্তে কর্নেল রেস হিসাব কষতে বসলেন। ফলাফলে মহিলারা হারলেন মোট তিন পাউণ্ড সাত শিলিং।

শ্ৰীমতী অলিভার হাসিমুখে সব হিসেব মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবার সবাই বিদায় নেবার জন্য উঠে পড়লেন, সকলেই মিঃ শ্যাতানার ঘরে একে একে প্রবেশ করলেন। তিনি পাশের ঘরে চেয়ারে চোখ বুজে শুয়ে আগুন পোহাচ্ছেন।

কর্নেল রেস শ্যানার চেয়ারের দিকে এগোলেন, বললেন, এবার আমরা বিদায় নেবো মিঃ শ্যাতানা। কিন্তু কর্নেলের কথার কোনো উত্তর দিলেন না মিঃ শ্যাতানা।

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে নিদ্রামগ্ন শ্যানার হাত অল্প তুলে ধরলেন। তারপর ব্যাটেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি একটু দেখুন। মিঃ ব্যাটেল শ্যানার কোটের ফাঁকে উঁচু হয়ে থাকা শক্ত জিনিষটা স্পর্শ না করে যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে দেখে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, খুবই দুঃখের সঙ্গে আপনাদের জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে গৃহস্বামী শ্যাতানা মারা গেছেন।

সবাই অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠলেন, ভদ্রলোক যে প্রকৃতই মারা গেছেন সে বিষয়ে কি আপনি একেবারে নিশ্চিত। ডাক্তার রবার্টস প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।

ব্যাটেল তাকে বাধা দিলেন, এক মিনিট, ডাক্তার রবার্টস। ইতিমধ্যে কে কে ঘরে প্রবেশ করেছেন।

রবার্টস প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। তার মানে?..আপনার কথার মর্মার্থ কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।…আমরা কেউই বাইরে…যাইনি। ভেতরেও কেউ ঢোকেনি।

ব্যাটেল সকলের দিকে তাকিয়ে মাপা তালে মাথা দুলিয়ে বললেন, বুকে ছুরি বসিয়ে ভদ্রলোককে খুন করা হয়েছে। ব্যাটেল লক্ষ্য করলেন প্রত্যেকেরই শরীর ঈষৎ কেঁপে উঠলো। চোখ মুখে আতঙ্ক ভয় ও উত্তেজনার শিহরণ। মেজর ডেসপার্ড অল্প ইতস্ততঃ করে উঠে দাঁড়ালেন। তার দাঁড়াবার ভঙ্গীতে সৈনিকের দৃঢ়তা। আমার মনে হয় আমরা সকলেই কোনো না কোনো সময় ব্রীজ টেবিল ছেড়ে দরজার কাছে গিয়েছিলাম।

ব্যাটেল তাই মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, এই বিষয়ে আলোচনা করবার জন্যে আপনাদের পাশের ঘরে যেতে অনুরোধ করছি।

চারজন ব্রীজ খেলোয়াড় ধীরে ধীরে পাশের ঘরের দিকে এগোলেন।

ব্যাটেল ফোন তুলে হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠালেন। স্থানীয় পুলিস বাহিনী এখনই এসে পড়বে। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ, আমি যেন এই তদন্তের ভার গ্রহণ করি।

তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোক কতক্ষণ আগে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়।

পোয়ারো বললেন, আমার মনে হয় ঘণ্টাখানেক তো হবেই।

ব্যাটেল অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, হত্যাকারীর প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?

ইতিমধ্যে পুলিস বাহিনী এসে পড়েছে। দরজা ঠেলে ডিভিশনাল সার্জন ঘরে প্রবেশ করলেন। ডান হাতে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ তার পেছনে পুলিস ইনসপেক্টর, সঙ্গে ক্যামেরাম্যান। সবার শেষে পুলিস কনস্টেবল। রুটিন বাঁধা পুলিসী কাজ শুরু হয়ে গেলো।

.

০৪.

ইতিমধ্যে পুরো এক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে।

মৃতদেহ পরীক্ষা করবার পর বিভিন্ন ভাবে তার ফটো নেওয়া হয়েছে। একজন ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশারদও এসেছিলেন।

ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা ডিনার পার্টিতে মিঃ শ্যাতানা আপনাকে কি যেন বোঝাতে চেয়েছিলেন।

পোয়ারো উত্তর দিলেন, ভদ্রলোক ছিলেন অতিমাত্রায় দাম্ভিক। ভাবতেন শয়তানের শ্রেষ্ঠ অনুচর সেজে পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করে যাবেন। এই গর্বেই মারা পড়লেন।

ব্যাটেল মনে মনে বিড়বিড় করলেন, তাহলে মোট আটজন নিমন্ত্রিত–তার মধ্যে চারজনের ভূমিকা শুধু দর্শকের, বাকি চারজন হত্যাকারী।

দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন মিসেস অলিভার, অসম্ভব! এর মধ্যে কেউ খুনী হতে পারে না। এখানে সকলেই বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

ব্যাটেল ধীর ভাবে মাথা দোলালেন, এই বিষয়ে এখনই একেবারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। খুনীরাও অনেক সময় আপনার আমার মতো পোষাক পরে থাকে। বাইরে থেকে তাদের বোঝা যায় না। মিঃ শ্যাতানা হয়তো আজকের ভোজসভায় কতিপয় খুনীদের এক অভূতপূর্ব সম্মেলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন, ভদ্রলোকের একটা খ্যাতি ছিলো। ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায় ভদ্রলোকদের আর বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা উচিত হবে না। এবার তাদের জবানবন্দি নেওয়া প্রয়োজন।

তাহলে আমরা না হয় বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি? কর্নেল রেস উঠে দাঁড়াবারা ভাব দেখালেন।

….ব্যাটেল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, না, না, আপনারা সকলেই থাকতে পারেন।

ব্যাটেল উঠে দাঁড়িয়ে কর্তব্যরত কনস্টেবলকে ডাক দিলেন, পাশের ঘরে এণ্ডারসন ডিউটিতে আছে। ওকে গিয়ে বলবে অতিথিদের মধ্যে ডাক্তার রবার্টস যেন অনুগ্রহ করে একবার আমার সামনে হাজির হন।

ডাক্তার রবার্টস দ্রুতপায়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, সত্যি সুপারিন্টেন্টে, কি সাংঘাতিক একটা ব্যাপারের মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়লাম, ছুরি মেরে কাউকে খুন করা…। না, এতোখানি দুঃসাহস আমার নেই। আর তাছাড়া ওনাকে ভালো করে আমি চিনি না পর্যন্ত সুতরাং ওনাকে খুন করবার পেছনে আমার বিন্দুবিসর্গ কারণ নেই।

ব্যাটেল নীরস ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। আপনার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম, তবে আপনি জানেন আমাকে আইনমাফিক তদন্ত চালাতে হবে। ঘরের অপর অতিথিদের সম্বন্ধে কিছু জানেন?

না, দুঃখিত কিছু জানি না।

যাইহোক মিঃ ব্যাটেল সবাইকেই জেরা করলেন। জেরা করে জানতে পারলেন তিনজনই টেবিল ছেড়ে উঠেছিলেন কিন্তু মিঃ শ্যাতানার দিকে কেউই লক্ষ্য করেননি যে তিনি ঠিক তখন কি করছিলেন।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, আপনি নিশ্চয় খুঁজে বার করতে পারবেন যে কে খুনী। তবে আপনার তিনজনের মধ্যে কাকে খুনী বলে মনে হয়?–মিঃ ব্যাটেল ডাক্তার রবার্টসকে জিজ্ঞাসা করলেন।

ডাক্তার রবার্টস থতমত খেয়ে বললেন, আমার মনে হয় মেজর ডেসপার্ডই হত্যাকারী। ভদ্রলোকের নার্ভ খুবই শক্ত একমাত্র তিনিই এই ঝুঁকি নিতে পারেন।

এখানে মহিলাদের কোনও ভূমিকা নেই, কারণ এই খুনের পিছনে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন।

ব্যাটেল তাড়াতাড়ি বললেন, না, ওনাকে একটা লম্বা পাতলা ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ডাক্তার রবার্টস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠলেন, কি সাংঘাতিক ব্যাপার!

ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি বক্তব্য আছে তা প্রকাশ করুন।

পোয়ারো স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে হাত নাড়লেন এবং প্রশ্ন করলেন, আপনারা কটা রবার খেলেছিলেন?

রবার্টস চটপট জবাব দিলেন, তিনটে।

আমার আরও দুটি প্রশ্ন, এক হচ্ছে হারজিতের ভাগে কার কি রকম ভূমিকা এবং দুই ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এঁদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?

মিসেস লরিমা একজন দক্ষ খেলোয়াড়। মিস মেরিডিথ এমন কিছু ভালো নয়।

আর আপনি?

হা…আমি সাধারণত হাতের তাসের তুলনায় ডাকটা বেশি দিয়ে থাকি। এতে আমার লোকসানের থেকে লাভ হয় বেশি।

পোয়ারো বিজ্ঞের মত হাসলেন। চেয়ার ছেড়ে রবার্টস উঠে দাঁড়ালেন, তবে আজ চলি, শুভরাত্রি, বলে দ্রুত পায়ে ডাক্তার রবার্টস ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

.

০৫.

ব্যাটেল এবার মিসেস লরিমাকে জেরা শুরু করলেন। মিঃ শ্যাতানাকে আপনি নিশ্চয় খুব ভালো করে চিনতেন?

না। ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ভাবে কখনো মিশিনি।

তার সম্বন্ধে আপনার কি রকম ধারণা?

তাকে একজন প্রকৃত সৎ ব্যক্তি বলে মেনে নেওয়া কঠিন।

মাপ করবেন; একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি। মিঃ শ্যাতানার মৃত্যুতে আপনার কোনো স্বার্থসিদ্ধি ঘটবে না নিশ্চয়ই?

চিন্তিত চিত্তে মিসেস লরিমা বললেন, না সুপারিন্টেন্ডেন্ট, মিঃ শ্যাতানার মৃত্যুতে আমি কোনো লাভবান হবো না।

আপনার বাকি তিনজন সঙ্গী সম্বন্ধে কোনো কিছু বলতে পারেন?

ওদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আমি জানি না।

 আচ্ছা আপনি চেয়ার ছেড়ে ক বার উঠে গিয়েছিলেন?

একবার ডামি অবস্থায় আমি চেয়ার ছেড়ে ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়েছিলাম। মিঃ শ্যাতানা তখন জীবিত ছিলেন।

লরিমাকে ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন, এই তিনজনের মধ্যে কাকে আপনি খুনী বলে সন্দেহ করেন?

লরিমা বললেন, এ প্রশ্নটা আমার কাছে রীতিমতো অসঙ্গত বলে মনে হয়।

এর পর মিসেস লরিমাকে প্রশ্ন করলেন মিঃ পোয়ারো। আচ্ছা ম্যাডাম ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এঁদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা।

অসীম ধৈর্যসহকারে মিসেস লরিমা বললেন, মেজর ডেসপার্ড হিসেবী খেলোয়াড়।

ডাক্তার রবার্টসের হাতের খেলা খুবই ভালো, মিস মেরিডিথের খেলাও মন্দ নয়।

অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।

মিসেস লরিমা চারজনের সঙ্গে করমর্দন করে শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলেন।

.

০৬.

পোয়ারোকে ব্যাটেল বললেন, ভদ্রমহিলা একটু প্রাচীন পন্থী, অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল। অবশ্য কিছুটা একগুঁয়েও।

পোয়ারো স্কোরের কাগজগুলো যত্ন করে টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন। এবং বললেন, আমরা এর ভেতর থেকে নিগূঢ় সত্যের ইঙ্গিত পেতে পারি। মিস মেরিডিথ অতিমাত্রায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, শ্বাসপ্রশ্বাসও কেমন এলোমেলো। চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া।

মিঃ ব্যাটেল ত্বরিৎ পায়ে উঠে গিয়ে মেরিডিথের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতে সাহায্য করলেন।

অযথা নার্ভাস হবেন না। আমি জানি এ ধরনের ঘটনাবলী স্নায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

মিস মেরিডিথ বললেন, কি ভয়ঙ্কর একবার ভাবুন…আমাদেরই চারজনের মধ্যে একজন খুন করেছে।

আচ্ছা মিস মেরিডিথ মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

মিস মেরিডিথ উত্তর দিলেন, সত্যি বলতে কি ওনার সাথে আমার তেমন পরিচয়ই নেই, ভদ্রলোককে আমি একটু ভয় করেই চলতাম।

যাক এবার আসল কথায় আসা যাক, আপনি কি ব্রীজ খেলার সময় কখনো নিজের আসন ছেড়ে উঠেছিলেন?

হ্যাঁ, একবার বোধহয় উঠেছিলাম।

 ঠিক আছে, এবার বলুন, অপর তিনজনের সম্বন্ধে কিছু জানেন কিনা।

আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মেজর ডেসপার্ড এ কাজ করেছেন বা দলের অন্যান্যরাও একাজ করতে পারে না।

মিঃ ব্যাটেল এবার বললেন, তাহলে আর মিছিমিছি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন? এবার আপনি যেতে পারেন।

মিস মেরিডিথ বিদায় দিলেন। শ্রীমতী অলিভার লঘু অথচ গম্ভীর সুরে মন্তব্য করলে, আমার মনে হয় এই মেয়েটাই আসলে খুনী।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল কনস্টেবলকে আদেশ দিলেন মেজর ডেসপার্ডকে ডেকে দেবার জন্য।

.

০৭.

দ্রুত পায়ে মেজর ডেসপার্ড ঘরে প্রবেশ করলেন।

আপনাকে এতক্ষণ আটকে রাখবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।

যাক, মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা কতটা ছিলো?

দেখুন ওনার সাথে মাত্র দুবার আমার দেখা হয়েছিলো।

এক মাস আগে বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়ে আলাপ হয়। আর একবার তিনি একটা ককটেল পার্টিতে আমাকে আহ্বান জানান।

ব্যাটেল আবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিঃ শ্যাতানাকে অপছন্দ করবার মতো আপনার কোনো কারণ আছে?

হা… অসংখ্য কারণ আছে। তবে হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিল না।

ব্যাটেল জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ শ্যানার অপকীর্তি সম্বন্ধে কি জানেন?

মেজর ডেসপার্ড অবহেলা ভরে বললেন, এর ওর গোপন ব্যাপারে নাক গলাননা পরলোকগত মিঃ শ্যাতানার একটা স্বভাব ছিলো। উনি কোনো নারীঘটিত ব্যাপারেও জড়িত থাকতে পারেন।

ওসব কথা থাক। এঁদের মধ্যে কাকে আপনি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন?

একাজ আমি করিনি আর মিস মেরিডিথ ও মিসেস লরিমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভবই নয়।

ব্রীজ খেলার সময় আপনার এবং অন্য সকলের গতিবিধির কথা কিছু স্মরণ করতে পারেন?

দুবার মাত্র আমি আসন ছেড়ে উঠেছিলাম। প্রথমবার সাড়ে দশটার সময় আর তার আধঘন্টা পরে দ্বিতীয়বার উঠেছিলাম। মিসেস লরিমা একবার উঠেছিলেন এবং মিস মেরিডিথ একবার ঘরের চারধারে পায়চারী করেছিলেন। তবে ডাক্তার রবার্টস প্রায়ই তার চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন।

মিঃ ব্যাটেল আর একটা প্রশ্ন করলেন–ব্রীজ খেলোয়াড় হিসেবে এই তিনজনের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

মিস মেরিডিথ ও মিসেস লরিমা সত্যিই ভালো খেলে। লরিমা তো একজন জাত খেলোয়াড়।

আপনি আর কোনো প্রশ্ন করবেন, ডেসপার্ড জিজ্ঞাসা করলেন।

 না, আর কোনো প্রশ্ন নেই। আপনি আসতে পারেন, ব্যাটেল জানালেন।

ডেসপার্ড বিদায় নিলেন শুভরাত্রি জানিয়ে।

.

০৮.

সবাই নির্বাক। ব্যাটেলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রত্যেকের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেলো। শ্রীমতী অলিভার তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করতে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ওই মেয়েটা আর নয়তো ডাক্তার রবার্টস খুন করেছেন মিঃ শ্যাতানাকে। এই বিষয়ে তাদের কেউ কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহ দেখালেন না।

মিনিট দুয়েক সকলেই নির্বাক। ব্যাটেল এবার আলোচনায় মুখর হলেন। প্রথমে ডাক্তার রবার্টসের কথা স্মরণ করুন, ভদ্রলোককে সন্দেহ করবার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। বুকের ঠিক কোথায় আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে অভিলাষিত ফল পাওয়া যাবে এটা তিনি বেশ ভালোই জানেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নেই। এবার আসছেন মেজর ডেসপার্ড। এনার মানসিক শক্তি খুবই সুদৃঢ়। ইনি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত। মহিলাদেরও সন্দেহ করবার মতো অবকাশ আছে। মিসেস লরিমার নার্ভ ভীষণ শক্ত তিনি একজন আদর্শবাদী মহিলা। তিনি কাউকে খুন করেছেন এটা কল্পনাতীত। সবশেষে মিস মেরিডিথ তার সম্বন্ধে কিছু আমাদের জানা নেই।

আলোচনা বেশ জমে উঠেছে হঠাৎ অতি উৎসাহের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন শ্রীমতী অলিভার, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে, সেটা হচ্ছে আমরা সংখ্যায় চারজন সবাই গোয়েন্দা বিভাগের ক্রিয়া পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত সুতরাং আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের সন্দেহভাজন এক একজনের ওপর নজর রাখি আর তাছাড়া আমরা আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যাব।

ব্যাটেল এই প্রস্তাবে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, পুরো তদন্তটা আমাকেই চালাতে হবে। এর মধ্যে আইনের প্রশ্ন জড়িত তাছাড়া ব্যক্তি নির্বাচনেও আমাদের মধ্যে মতান্তর দেখা দিতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে কে কার ওপর নজর রাখবে সেটাও একটা সুবিপুল সমস্যার ব্যাপার।

শ্ৰীমতী অলিভার হতাশ হলেন, কিন্তু প্ল্যানটা খুবই চমৎকার ছিলো। যাইহোক আমি যদি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালাই তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বাধা দেবেন না।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, না। তাতে আমার খুব বেশি আপত্তি থাকবে না। তবে এই সব খুনের মামলায় মাথা না গলানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

কিন্তু আমি আমার তদন্তের ফলাফল সম্পূর্ণ গোপন রাখবো।

কর্নেল রেস এবার বলে উঠলেন, আমি ডেসপার্ডের ব্যাপারে যাবতীয় খোঁজখবর এনে দেবো। তবে দু-চারদিন সময় লাগবে।

অজস্র ধন্যবাদ, এতেই আমাদের অনেক উপকার হবে। কি ধরনের অনুমান করতে পারছেন।

হ্যাঁ, অনুমান করতে পারছি। যেমন ভদ্রলোক কোনো শিকার দুর্ঘটনা বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা ইত্যাদি।

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন।

 কর্নেল রেস মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

এবার মিঃ ব্যাটেল হঠাৎ পোয়ারোকে বলে উঠলেন, আচ্ছা আপনি এই চারজনের মানসিক গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কি অভিমত পোষণ করেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন, এদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর প্রত্যেকের সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা জন্মেছে। এই হত্যার ব্যাপারে দুটি জিনিষ খুব স্পষ্ট। প্রথমত খুনীর মনের জোর অসাধারণ, দ্বিতীয় আত্মম্ভরিতাও তার বিপুল। এবার ডাক্তার রবার্টসের ব্রীজ খেলার কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক ভাওতা দিতে ওস্তাদ। বিপদে পড়লে ঝক্কি সামলাতে পারবেন।

আবার এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সন্দেহের তালিকা থেকে মিস মেরিডিথকে বাদ দেওয়া যায় কারণ তিনি খুবই ভীত এবং নার্ভাস মহিলা। সুতরাং তার পক্ষে এই হত্যা ঘটানো অসম্ভব। এবার আসে মেজর ডেসপার্ড। চিন্তাশীল আত্মবিশ্বাসী মানুষ। অপরিহার্য মনে করলে যে কোনো রকমের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। সবশেষে মিসেস লরিমার বয়স ষাটের কাছাকাছি প্রখর বুদ্ধিমতী। স্বভাব বেশ শান্ত। তিনি যদি কোনো অপরাধ করেন তবে বেশ ভেবে চিন্তেই অগ্রসর হবেন। অঙ্কের মতো সবকিছু হিসেব করে চলেন। সেইজন্য আজকের খুনটা তার পক্ষে না করাই সম্ভব।

পোয়ারো খানিক দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, তাহলে দেখতে পাচ্ছেন আমাদের সামনে এখন মাত্র একটা পথই খোলা–তা হচ্ছে অতীত।

ব্যাটেল বিড় বিড় করে বললেন, পরিস্থিতিটা খুবই জটিল। আমরা অনেক সময় কোনো গণ্ডগোলের ব্যাপার আঁচ করতে পারি, বুঝতে পারি কেউ কোনো চালাকি খেলছে কিন্তু নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া খুব কষ্টকর হয়।

এই মামলাটা অনেকদিন গড়াবে। অনেক ঝামেলা দেখা দেবে, প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কিছুই প্রায় হাতের কাছে নেই। আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হচ্ছে চারজন খুনীর ইতিহাস সংগ্রহ করা। একজন দুজন হলে তবু না হয় চেষ্টা করে দেখা যেত। মানব প্রকৃতির মধ্যে মৌলিকত্বের একান্তই অভাব! দার্শনিক ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

শ্ৰীমতী অলিভার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন। মহিলাদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। কেবল তারাই নিত্য নব উপায় উদ্ভাবন করতে পারে। এক মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে তার দুই চোখ নতুন ভাবনায় উদ্ভাসিত হলো। আচ্ছা যদি এই চারজনের মধ্যে কেউই মিঃ শ্যাতানাকে খুন না করে থাকে, হয়তো ভদ্রলোক প্ল্যান করে চারজন খুনীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে তারপর মজা দেখাবার জন্য ঠান্ডা মাথায় আত্মহত্যা করে থাকেন!…

মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আপনার কল্পনা শক্তির ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু মিঃ শ্যাতানা আত্মহত্যা করবার মতো মানুষ নন। জীবন তার কাছে পরম প্রিয়। বস্তু।

তবে ভদ্রলোক যে খুব ভালো লোক ছিলেন না, সে কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

পোয়ারো বললেন, সে যাইহোক এখন তিনি মৃত…নিহত সুতরাং খুনীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত, এখনও পর্যন্ত আমি সেই অভিমতই পোষণ করি।…আর সেই জন্যই বাঘের খাঁচার মধ্যেও আমি যেতে প্রস্তুত।

.

০৯.

ডাক্তার রবার্টস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার হাতের তালুতে এখনো কার্বলিক সাবানের গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

আপনার তদন্ত কেমন এগুচ্ছে? খুনী ধরা পড়বে তো?

মিঃ ব্যাটেল উত্তর দিলেন, যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তবে কাগজে খবরটা প্রকাশ পায়নি এইটুকু বাঁচোয়া।

ইতিমধ্যে পোস্টমর্টেমের রিপোর্টও এসে পৌঁছেছে, সেই রিপোর্টটি ডাক্তার রবার্টসকে দেখতে দিলেন।

ভদ্রলোকের সলিসিটরের সঙ্গে উইল নিয়ে কথা হয়েছে। সিরিয়ায় তার এক আত্মীয়কে দানপত্র করে গেছেন।

ক্ষণিকের জন্য রবার্টসের মুখখানি কালো হয়ে গেল। মিঃ ব্যাটেল আরও বললেন, ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত কাগজপত্রও আমরা ঘেঁটে দেখেছি।

রবার্টস নিজেকে সংযত করে নিলেন। ব্যাটেলের দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করলেন, আমার কাগজপত্রও নিশ্চয় পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন না।

ব্যাটেল উত্তর দিলেন, সেইরকমই বাসনা আছে।

আমি আপনাকে বাধা দেবো না, ডাক্তার রবার্টস বললেন। আপনাদের কাজে সহায়তা করা প্রত্যেক সৎ নাগরিকের কর্তব্য।

অজস্র ধন্যবাদ, ব্যাটেল বললেন, আপনার কর্তব্যবোধকে সম্ভ্রম না জানিয়ে পারা যায় না। আরও একটি ব্যাপার…আপনাকে গোটা কয়েক প্রশ্ন করবো আশা করি উত্তর দেবেন।

বেশ! কি জানতে চান বলুন?

 আপনার ব্যক্তিগত জীবন, আপনার জন্ম, আপনার বিবাহ…এই আর কি।

রবার্টস সোজা হয়ে বসলেন। ছোটবেলায় আমি স্নো ভিউ হোটেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। বাবা ডাক্তার ছিলেন। পনের বছর বয়স যখন আমার তখন বাবা মারা যান, দুবছর বাদে মাও মারা যান। আমি তাদের একমাত্র সন্তান, এখনো অবিবাহিত। ডাক্তারীতে ভালোই পসার আমার রুগীরাও সকলে অবস্থাপন্ন ঘরের। এই হচ্ছে আমার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

মিঃ ব্যাটেল বললেন, আপনার পরিচিত চারজন লোকের নাম বলুন, যারা আপনার সম্বন্ধে খোঁজখবর দিতে পারবেন।

ডাক্তার রবার্টস সাবলীল ভঙ্গিমায় প্যাডের পাতায় চারজনের নাম লিখে ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। আপনি দরকার হলে সবকিছুই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি আমার সেক্রেটারীকে আপনাকে সাহায্য করবার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। আমি এখন রুগী দেখতে বাইরে বেরিয়ে যাব। ডাক্তার রবার্টস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তাহলে আমি চললাম। কথা বলতে বলতে ডাক্তার রবার্টস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল প্রথমে দেরাজ খুলে তন্নতন্ন করে সবকিছু গ্রীক্ষা করলেন। ব্যাঙ্কের পাসবইটা দেখলেন খুঁটিয়ে। বিষের আলমারিটা পরীক্ষা করে বিফল হলেন। চিঠিপত্রের ফাইলটা দেখলেন সবই ব্যক্তিগত চিঠি। হতাশভাবে ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। এবার ব্যাটেল ডাক্তার রবার্টসের সেক্রেটারীকে কিছু জেরা করবার জন্য ডাকলেন। তিনি বললেন, আচ্ছা শ্রীমতী বার্জেস, আপনি বোধহয় সমস্ত ঘটনাই শুনেছেন।

হ্যাঁ, ডাক্তার রবার্টস আমায় বলেছেন। সমস্ত পরিস্থিতিটা খুবই নোংরা এবং সাংঘাতিক। মিঃ ব্যাটেল মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ তা ঠিক কিন্তু আপনি একটু মনে করে বলুন যে শ্যাতানাকে কখনো দেখেছেন কিনা?

না, কখনো দেখিনি। ডাক্তার রবার্টসকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানোর সময় তার নামটা শুনেছি মাত্র।

শ্ৰীমতী বার্জেসকে বাগে আনা খুবই কষ্টকর, মিঃ ব্যাটেল তা বুঝতে পারলেন। তবু তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না এবং নতুন করে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তাহলে স্থির নিশ্চিত যে মিঃ শ্যাতানা ডাক্তার রবার্টসের কোনো পেশেন্ট ছিলেন না।

হ্যাঁ সেটা আমি জোরের সঙ্গেই বলতে পারি।

তবে আর কি করা যাবে। বিরস মুখে ব্যাটেল দরজার দিকে এগোলেন।

ডাক্তার রবার্টসকে বলবেন, আমি তার সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আচ্ছা, নমস্কার শ্রীমতী বার্জেস।

.

১০.

ব্যাটেলের মুখে গভীর উদ্বেগ আর বিষাদের ছায়া।

পোয়ারা প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনার সকালের পরিশ্রমটা বৃথাই গেল মনে হয়?

ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, খুবই জটিল সমস্যা, তবে আমার বিশ্বাস ডাক্তার রবার্টস ভদ্রলোক সত্যই একজন খুনী। কিন্তু শ্যাতানাকে তিনি খুন করেছেন বলে মনে হয় না। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।

তবে এটা তো আপনি বিশ্বাস করেন, তিনি আর কাউকে খুন করেছেন। একজন কেন, বহু লোককেই খুন করে থাকতে পারেন। তবে প্রমাণ পাওয়া শক্ত।

ভদ্রলোক অবিবাহিত তাঁর নামে কিছু স্ক্যাণ্ডাল রটেছিল। ভদ্রমহিলার নাম মিসেস ক্র্যাডাক। ভদ্রমহিলার স্বামীর অ্যানথ্রক্স রোগ হয়েছিল–বাজারে নিচুমানের একধরনের সেভিং ব্রাশ চালু ছিলো। তার মধ্যে কিছু ছিলো এই রোগের জীবাণুবাহী।

হত্যাকারীর পক্ষে এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ! পোয়ারো মন্তব্য করলেন।

ব্যাটেল কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করলেন, আপনি কোন পথ ধরে এগোবেন বলে ভাবছেন?

পোয়ারো উত্তর দিলেন, আমি সন্তর্পণেই অগ্রসর হবো। আমি কেবল তার সঙ্গে ব্রীজ খেলা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবো।

পোয়ারো চোখ মিটমিট করে ফিরে তাকালেন, কেন? আপনার কাজের ধারা কি রকম, মিঃ ব্যাটেল?

খুবই সোজা একজন কর্তব্যপরায়ণ পুলিস অফিসার যে রকম নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, সেই রকম। হাসিমুখে পোয়ারো পানীয়ের গ্লাস তুলে ধরলেন।

লাঞ্চের পর তারা দুজনে যে যার পথ ধরলেন। ব্যাটেল পরবর্তী কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে নির্দেশ দেবার জন্য স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে ফিরে গেলেন।

পোয়ারো এগোলেন ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারের দিকে। পোয়ারোকে দেখে ডাক্তার রবার্টসের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠলো।

ঠাট্টার সুরে বললেন, একদিনে দুজন টিকটিকির শুভাগমন! রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে। সন্ধের মধ্যেই গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বেরিয়ে যাবে।

পোয়ারো মৃদু হাসলেন, না না, আমি আশ্বাস দিতে পারি আমার দৃষ্টি এখনো আপনাদের চারজনের প্রতিই নিবদ্ধ।

রবার্টস বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, বলুন কিভাবে আপনার কাজে লাগতে পারি?

পোয়ারো মিনিট খানেক কোনো কথা বললেন না। তারপর তার কোটের পকেট থেকে নিখুঁত ভাঁজ করা তিনটে ব্রীজ খেলার স্কোরশীট বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। শান্ত সুরে তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন, এই প্রথমটা হচ্ছে মিস মেরিডিথের হাতের লেখা। এখন আমার জিজ্ঞাস্য, এই স্কোরশীট দেখে কি স্মরণ করতে পারেন খেলাটা কিভাবে এগিয়েছিল?

এতদিন বাদে স্মরণ করা মুশকিল, আচ্ছা দাঁড়ান, দাঁড়ান ভাবতে দিন। হ্যাঁ মনে পড়েছে। স্পেডের খেলা ছিলো। ওঁরা একটা শর্ট দিলেন।

পরের তাসটা আমি আমার পার্টনার দুটো ডায়মণ্ডে খেলেছিলাম।

 আচ্ছা কোনো উত্তেজনাপূর্ণ ডাক বা খেলার কথা আপনার মনে পড়ে না?

একটা গ্র্যাণ্ডস্লামের কথা মনে আছে। আমার হাতের খেলা। একবার তিনটে নো ট্রাম্প ডেকে বিশ্রীভাবে অনেকগুলো শর্ট দিলাম। প্রত্যেকটা রঙের ডিস্ট্রিবিউশন এত খারাপ ছিলো যে কল্পনা করা শক্ত। বলতে গেলে আমরা কোনো পিটই পাইনি, তবে এটা শেষদিকের তাস। তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিসেস লরিমা।

মিঃ পোয়ারো এবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডাক্তার রবার্টস, সেদিনের খেলার মধ্যে কি এমন কোনো ভুলভ্রান্তি নজরে পড়েছে সাধারণ দৃষ্টিতে যা বিস্ময়কর?

ডাক্তার রবার্টস মিনিট দুয়েক চিন্তা করলেন তারপর মাথা নাড়লেন, না তেমন কিছুই আমার মনে পড়ছে না। ইতিপূর্বে নতুন কোনো বক্তব্য নেই তবে মিসেস লরিমা প্রকৃতই একজন জাত খেলোয়াড়। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁত খেলে। মেজর ডেসপার্ড ভালোই খেলেন, তবে বাইরে যেতে চান না। ঝুঁকি নেবার সাহস তার নেই।

বাকি মিস মেরিডিথ, তিনি মাঝে মধ্যে ভুল করে বসছিলেন। অন্যমনস্কতাই তার প্রধান কারণ।

সেইজন্য বিপরীত দিক দিয়ে প্রশ্নটা আমি আপনার কাছে রাখছি, সেদিন ডিনারের পর যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলেছিলেন তার একটা বিবরণ দিন।

রবার্টস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিবরণ দিতে শুরু করলেন : হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বড় টেবিল ছিলো, চার-পাঁচটা বড় বড় চেয়ার। আটটা কি নটা পার্সিয়ান কম্বল। খুব সুন্দর চাইনিজ আলমারি। বারোটা চেয়ারের সেট। ছটা ভালো জাপানী ছবি। একটা বড় পিয়ানো, পাঁচ-ছটা নস্যির কৌটো, হাতির দাঁতের কাজ করা ছোট ছোট মূর্তি, প্রথম চার্লসের শীলমোহর খচিত কিছু মুদ্রা।…

চমৎকার চমৎকার। আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। আর কিছু ছিল কি?

হা, কিছু প্রাচ্যদেশীয় জিনিষপত্র সূক্ষ্ম রুপোর কাজ করা কতগুলো শিল্পবস্তু। কিছু অলঙ্কার। কতিপয় ছোট ছোট বস্তুর সমাবেশ। এবার ডাক্তার রবার্টস একটু থেমে মৃদু হেসে বললেন, আপনি যে জিনষটার কথা জানতে চান সেটা কি আমার তালিকার মধ্যে আছে?

পোয়ারো রহস্যময় হাসি হাসলেন, আমার ধারণা নির্ভুল হয়েছে; জানতাম আপনি সেটার কথা উল্লেখ করবেন না, তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আজ আপনি আমাকে যা বললেন তা আমার পরবর্তী উদ্যোগে সহায়তা করবে।

দুজনে করমর্দন করলেন। পোয়ারো ডাক্তার রবার্টসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরলেন।